হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৪১
তোয়া নিধী দোয়েল
সূর্যের আলো অনেক আগেই নিজের তপ্ত চাদর বিছিয়ে দিয়েছে ধরণীর বুকে। বালিশিরার সবুজ চূড়ায় ঝিম মেরে রয়েছে। সূর্যের সোনালী আলো সবুজ পাতায়, চূড়ায় পড়ে চিকচিক করছে। সাদা রঙের পর্দা হাওয়ায় দুলছে ধীরে ধীরে। সেই পর্দার ফাঁক দিয়ে আসছে নরম রোদের ছায়া।
তুর্কি সাদা কুর্তি পরে— খোলা ব্যালকনিতে কাঠের চেয়ারে বসে রয়েছে। ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি ঝড়ে পড়ছে মেঝেতে। সবুজ অরণ্যের মাঝ থেকে বয়ে আসছে শীতল হাওয়া।
আদনান দুই কাপ চা নিয়ে ব্যালকনিতে আসে। টেবিলে কাপ দুটি রেখে— তুর্কির পাশে কাঠের চেয়ারে বসে। তুর্কির দিকে তাকিয়ে বলে—
– হাই ম্যাডাম! হোয়াটস্ আপ?
তুর্কি আদনানের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলে—
-ভালো।
আদনান তুর্কিকে বিরক্ত করার জন্য আবারও বলে—
-তো ম্যাডাম, ঘুম কেমন হলো? নতুন জায়গায় ঘুম হয়েছো তো ঠিকঠাক ভাবে?
আদনানের ভাব দেখে তুর্কির গা জ্বলে ওঠে। ও জানে এই লোক ওকে জেনে বুঝেই খোঁচাচ্ছে। ও সম্পূর্ণ আদনানের দিকে ঘুরে বলে—
– সেটা তো আপনার ভালো জানার কথা। অযথা আমার কাছে জিজ্ঞাসা করছেন কেনো?
আদনান নিজের চায়ের কাপ ওঠিয়ে অবাক কণ্ঠে বলে—
-আমি কীভাবে জানবো? আমি কি তোমার ঘুমে ডিস্টার্ব করেছি নাকি?
তুর্কি কণ্ঠে তেজ ঢেলে বলে—
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-জানিনা। অসভ্য লোক! ঢং করা বাদ দিয়ে বলুন—আজ কোথায়-কোথায় ঘুরতে যাবেন?
এই বলে তুর্কি নিজের চায়ের কাপ ওঠায়। আদনান চায়ে চুমুক দিয়ে বলে—
-কোথায় যেতে চাও বলো। আমার তো বিছানা ছাড়া আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। আজ সারা-দিন ঘুমিয়ে কাটাতে পারলে ভালো লাগতো।
-মোটে ও না। আজ সারাদিন ঘুরবো আমরা।
আদনান, তুর্কিকে ভালোভাবে একবার পরখ করে বলে—
-তোমাকে আজ অন্য রকম সুন্দর লাগছে! বাকি দিন গুলোর তুলোনায় অন্য রকম!
আদনানের কথা শুনে— গরম চা-য়ের ছ্যাঁকা লাগে তুর্কির জিভে। ও চায়ের কাপ টেবিলের উপর রেখে কপালে ভাঁজ ফেলে বলে—
-কেমন সুন্দর?
-কেমন যেনো সুন্দর! অন্য রকম সুন্দর!
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। এই লোকের সাথে কথা বলতে কেমন যেনো লাগছে আজ! অসভ্য একটা লোক। তুর্কি অন্য দিকে তাকিয়ে বলে—
-আপনি জানেন, আপনি কত অসভ্য হয়ে গেছেন?
আদনান চায়ের কাপ টেবিলের উপর রেখে বলে—
-তোমার ভাষ্যমতে— আমি তো শুরু থেকেই অসভ্য মার্কা খারাপ লোক!
তুর্কি আদনানের দিকে ফিরে বলে—
-হুম। কিন্তু, এখন লাগাম ছাড়া অসভ্য হয়ে গেছে। খিদে পেয়েছে চলুন।
তুর্কি সম্পূর্ণ ঘুরলে— আদনান ওর গলায় লালচে দাগ দেখতে পায়। কপালে ভাঁজ ফেলে চিন্তিত কণ্ঠে বলে—
– দেখি দেখি, গলায় ব্যথা পেলে কীভাবে?
আদনানের কথা শুনে দ্রুত ওড়না দিয়ে গলা প্যাঁচায় তুর্কি৷ চেয়ার ছেড়ে ওঠে আড়ষ্ট কণ্ঠে বলে—
-আপনার চোখ এত বারো জায়গায় যায় কেন? কিচ্ছু হয়নি। চুপ-চাপ আসুন।
-আরে দাঁড়াও। এই দিকে আসো।
-পারবো না। আপনি আসলে আসুন, না আসলে বসে থাকুন। আমার খিদে পেয়েছে।
আদনানকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে জায়গায় ত্যাগ করে তুর্কি। এই লোক এক নাম্বারের ফাউল হয়ে যাচ্ছে! ফালতু লোক! এক মনে বক-বক করতে থাকে তুর্কি।
বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে উপমা। ওর পরনে জলপাই রঙের থ্রি-পিস। চুল গুলো কোনো রকম খোঁপা করা। হাতে ছোট একটা হ্যান্ড-ব্যাগ। মনে হাজারো বিষন্নতা! মুখে ক্লান্তির ছাপ!
একটু পর ওর উডবি আসবে। গতকাল-ই ছেলে পক্ষের লোক আংটি পরিয়ে গেছে। আর এই ও কথা হয়েছে, কাল দিন পরেই ওদের বিয়ে। খুব সাধারণ ঘরোয়া ভাবেই হবে। এত দ্রুত বিয়ের ডেট ফালানোর পিছনে কারণ— ফারুক। সে চায় না, তার মেয়ের অপকর্মের ঘটনাটা তঁরা জানুক। যত তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাবে, তত মঙ্গল। তাই, আজ টুকটাক শপিং করতে যাবে ওর উডবি-র সাথে।
হঠাৎ উপমার কানের সন্নিকটে বেজে ‘কাঠগোলাপ’ ডাকটি। ও দ্রুত পাশ ফিরে তাকায়। রেজুয়ান এসেছে! কিন্তু না। সেখানে কেউ নেই। ওর মনে হচ্ছে ওকে রেজুয়ান ডাকছে। ওর হৃদস্পন্দন দ্রুততর হয়। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মাথা নিচু করে রয়। ও কি মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে? ওর মন কি অন্যকারোর অপেক্ষা করছে? এত ব্যাকুল হচ্ছে কেনো হৃদয়? রেজুয়ানের সাথে কথা বলা দূর, ওর কথা মনে হতেই হৃদস্পন্দন—কেনো এই ভাবে বেরে যায়?!
না কোনো উত্তর মিলে না প্রস্ন গুলোর! উপমা যখন নিজের মনের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত; তখন ওর সামনে এসে থামে একটা নেভি ব্লু কার। কার থেকে নেমে আসে সাইমম। ওর উডবি!
উপমাকে সেই কলেজ প্রাঙ্গনে দেখে প্রেমে পড়ে ছিলো। আজ তাকে বউ করে ঘরে তোলার পালা!
সাইমম— উপমার সামনে এসে হাত বাড়িয়ে উপমার হাত ধরতে যায়। উপমা সাইমমের এগোনো হাত দেখে দ্রুত হাত গুটিয়ে নেয়। যতই বাগদান হোক—এখনো বিয়ে বাকি। আর বিয়ের আগে হাত ধরাধরি ওর পছন্দ নয়। উপমা অন্য দিকে ফিরে বলে—
-আমার সামনের মাস থেকে পরীক্ষা। কই যাবেন, একটু দ্রুত চলুন।
উপমার উপেক্ষা দেখে সাইমম দাঁড়িয়ে যায়। হয়তো পাবলিক প্লেসে মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে! তাই ও মৃদু এসে বলে—
– ওকে। আসুন। গাড়িতে ওঠুন।
উপমা গাড়ির দিকে ফিরে বলে—
– তৃপ্তি প্লাজার তো এখান থেকে পাঁচ মিনিট। অযথা গাড়িতে উঠতে হবে কেনো?
-আমরা টাউনে যাচ্ছি না। সাভার যাচ্ছি!
উপমা অবাক কণ্ঠে বলে—
-সাধারণ কিছু শপিং এর জন্য সাভার যাওয়ার কী প্রয়োজন?
-এইভাবে বলবেন না। মানুষের জীবনে এই সময়টা তো একবার-ই আসে। যদিও আমাদের বিয়েটা খুব সাধারণ ভাবে হচ্ছে। তবে আমি চাই আমার ওয়াইফ…
সাইমম কে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে উপমা বিরক্ত কণ্ঠে বলে—
– ওয়াইফ! এখনো আমাদের বিয়েটা হয়নি৷ সো, প্লিজ ডোন্ট কল মি ওয়াইফ।
-আজ না হোন কাল তো হবেন।
-কাল দেখা যাবে।
-আচ্ছা, আসুন।
উপমা আনমনে কিছু ভেবে গাড়িতে ওঠে পড়ে। সত্যি তো— আজ বাদে কাল তো এই লোককেই আপন করে নিতে হবে।
মানিকগঞ্জ বাস স্ট্যান্ড ছেড়ে সাভারের উদ্দেশ্যে ছুটে গাড়ি। উপমা-সাইমমের মাঝে অনেক দূরত্ব। এই দূরত্ব উপমাই সৃষ্টি করেছে। ও এক ধ্যানে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। মানসপটে ভেসে ওঠে— রেজুয়ানের সাথে দ্বিতীয় সাক্ষাৎ এর কথা। যে দিন আসার সময় ওর জন্য এক ঠোঙা কাঠগোলাপ নিয়ে এসেছিলো! সাইমম একটু পর-পর ওর দিকে তাকাচ্ছে। ওকে ওই ভাবে অন্যমনস্ক দেখে মাঝের দূরত্বটুকু ঘুচিয়ে উপমার সন্নিকটে এসে বসে।
উপমার হাতের উপর হাত রাখতেই— কেঁপে ওঠে উপমা। দ্রুত সাইমমের দিকে তাকিয়ে এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নেয়। তেজি কণ্ঠে বলে—
– সমস্যা কী আপনার? বিয়েটা তো এখনো হয়নি। তাহলে এখনি আমার কাছে আসার চেষ্টা করছেন কেনো?
সাইমম অবাক কণ্ঠে বলে—
-কালকের দিন পরেই তো হবে? আর আপনার মন খারাপ দেখে…
-ধরবেন না। কালকের দিন পর থেকেই ধরবেন। আমার এই সব পছন্দ না।
এই বলে ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরে দৃষ্টি নেয় উপমা। সাইমম অপমানে মুখ লাল হয়ে যায়। ডাইভারের সামনে এই ভাবে সিনক্রিয়েট করলো! ও দৃষ্টি ঘুরিয়ে বাইরে নেয়। বিয়েটা শুধু হোক একবার!
আদনান-তুর্কি সকালের খাবার খেয়ে বের হয়েছে ঘোরার উদ্দেশ্যে। রিসোর্টে থেকে প্রথমে গিয়েছে বাইক্কা বিলে।
আকাশে তুলোর মত মেঘ ভেসে আছে। সূর্যের জলের উপর ছড়ানো আলোর কারুকাজ দেখে মনে হচ্ছে— কেউ যেন সূর্যের আঁচল ছড়িয়ে দিয়েছে জলের গায়ে।
চারপাশে বিস্তীর্ণ জলরাশি, যেখানে কোনো শব্দ নেই। শুধু নিঃশব্দে বয়ে চলা হাওয়া আর জলের মৃদু গর্জন। জলের উপরে ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে সাদা বক। কখনো হঠাৎ ডানার ছায়া পড়ে ঢেউয়ের ওপরে।
এই ঢেউয়ের ওপরে নৌকা ভ্রমণে বেড়িয়েছে আদনান-তুর্কি। তুর্কি পানিতে পা ডুবিয়ে বসেছে। আর আদনান ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর পিছনে বসেছে।
নৌকা এসে থামে হাজারো লাল-শাপলার মাঝে। সেখানে শত শত লাল শাপলা ফুটে আছে। তুর্কি বায়না ধরার আগেই আদনান হাত বাড়িয়ে শাপলা তুলতে থাকে৷ অনেক শাপলা সংগ্রহ করার পর— নৌকা আবার ভেসে যায়। আদনান কয়েকটা শাপলা আলাদা ভেবে নিয়ে— লম্বা ডাট ছোট ছোট করে ভেঙে মালা বানায়। তার পর তুর্কির খোঁপায় প্যাঁচিয়ে দেয়৷ একটা তুর্কির হাতে বেঁধে দেয়। ফিসফিসিয়ে বলে—
-ইসস! গতকাল এইভাবে তোমাকে সাজলে বেশি সুন্দর লাগতো। লস হয়ে গেলো!
আদনানের কথায় শব্দ করে হেসে ফেলে তুর্কি। পুনোরায় আদনান আবার পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বসে৷ তুর্কি আদনানে হাতের আঙুলের ফাঁকে-ফাঁকে ওর আঙুল গুঁজে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ঢেউয়ের তালে তাল মিলিয়ে ভেসে যায় নৌকা।
বাইক্কা বিলে অনেক সময় অতিবাহিত করে; বেশ অনেকক্ষণ জার্নির পরে— আদনান-তুর্কি এসে পৌঁছায় হামহামে। গভীর অরণ্যের গায়ে গায়ে হেঁটে এসে দাঁড়িয়েছে দু’জন। চারদিকে ঘন সবুজ, মাথার উপর ঝুঁকে থাকা পাতার ছায়া।
পথ পেরিয়ে, কাদামাটি, বাঁশের ঝোপ, ভেজা পাথর, সব ছুঁয়ে ওরা এসে দাঁড়ায় এক বিস্ময় দৃশ্যের সামনে!
চারপাশে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ। বাঁশঝাড়, বনলতা, আর নাম না জানা শত গাছের ঘন ছায়া। হাওয়ার প্রতিটি দমকে যেন পাতারা নিজেদের কথা বলে ওঠে— ওদের কানে কানে!
আদনান-তুর্কি হাতে হাত ধরে পায়ের নিচে কাদামাটি, ভেজা শেকড়, পেরিয়ে আর একটু সামনে এগিয়ে গেলে। এমন সময় কানে ভেসে আসে প্রথম ধ্বনি—জলের গর্জন!
জলের সেই গর্জন যেন শরীর কাঁপিয়ে তোলে তুর্কির! একধরনের শান্তি এসে বসে ওদের দু’জনার চোখে। প্রকৃতির এই রূপ তুর্কির মনে শান্তির ফোয়ারা বয়ে দিলো। ও সামনের দিকে তাকিয়েই আদনানের ডান হাতের আঙুলের ফাঁকে-ফাঁকে— ওর হাতের আঙুল গলিয়ে দিয়ে ভীষণ জোরে দিয়ে চেপে ধরলো। প্রিয় পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির এই রূপের সাক্ষী হয়ে; তুর্কি নিজেকে ধন্য মনে হলো!
পাহাড়ের বুক চিরে ধেয়ে আসছে সাদা জলের ধারা! মনে হচ্ছে বিশাল সাদা কাপড়ের মতো জল গড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের বুক বেয়ে।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিলাগুলো ভিজে আছে। ওপরে ঝুঁকে আছে শীতল পাতার ছায়া। বন্য অর্কিড গাছের ফাঁকে ফাঁকে ফুটে আছে।
তুর্কি আদনানের হাত ধরে পা রাখে জলে— ঠান্ডায় গা শিরশির করে ওঠে! ওর চোখে নির্ভীক শিশুর মত উচ্ছ্বাস। আদনান কে-ও ইশারা করে পানিতে নামতে। তুর্কি দুই হাত মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে জলের গর্জনে সাথে তাল মিলিয়ে চিৎকার করে ওঠে—
– আই লাভ ইউ, স্যার! আই লাভ ইউ! আমি আপনাকে ভীষণ, ভীষণ, ভালোবাসি!
তুর্কি কণ্ঠ প্রতিধ্বনি হয়ে বাজতে থাকে পাহাড়ের গায়ে। আদনান দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মৃদু হেসে ওর দিকে দৃষ্টিপাত করে। ভাগ্যক্রমে একটা বউ পেয়েছিলো! ‘আই লাভ ইউ’ বলতে বলতে জীবন পারি দিয়ে দিলো। তুর্কি ঘাড় ঘুরিয়ে আদনানের দিকে তাকালে— আদনান হাসি লুকিয়ে বলে,
– মানুষ তোমাকে পাগল ভাবে জানো? এত বার কেউ ‘আই লাভ ইউ’ বলে?
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে বলে—
-আই অ্যাম টোটালি অ্যাডেক্টেড টু ইউ, স্যার! আপনার প্রেমে পড়ে আমি কেমন পাগল হয়েছি; আপনি বুঝবেন না! একজন মাদকাসক্ত লোক যেমন—মদ ছাড়া থাকতে পারে না। আমিও ঠিক সেই রকম— আপনাকে ছাড়া এক মূহুর্ত ভাবতে পারি না। এতে মানুষ আমাকে পাগল কেনো— আরও কিছু বলেও আমার যায় আসে না! আপনি আমার ভয়ংকর নেশা, স্যার!
তুর্কির লম্বা বক্তব্য শুনে চোখ বড়-বড় হয়ে যায় আদনানের। ও মৃদু হেসে বলে—
– বুঝেছি। এই দিকে আসো। হাত দেও।
আদনান তুর্কির হাত ধরে আদনানের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বলে—
– স্যার, ‘এই দিকে আসো’ এই কথাটা আর বলবেন না। এর পরিবর্তে অন্য কিছু বলেবন।
আদনান ভ্রু কুঁচকে বলে—
-কেনো?
তুর্কি গলা ঝেড়ে বলে—
-এমনি। আমি বললাম তাই।
আদনান ঠোঁট উল্টিয়ে ওর কথার মানে বোঝার চেষ্টা করে। তুর্কি আর কিছু বলে না। কাল এই সর্বনাশী ডাকের সাড়া দিতে গিয়ে— ওকে অনেক মাশুল দিতে হয়েছে। তাই, এই ডাক শুনলেই তুর্কির বুক কেঁপে ওঠে!
কিছুক্ষণ হাঁটার পরে— ওরা একটা পাথরের গায়ে গিয়ে পাশাপাশি বসে। পায়ের নিচে জলের ঢেউ হালকা হালকা ধাক্কা দেয়। একটা ছোট কাঁকড়া পায়ের পাশ ঘেঁষে চলে যায় তুর্কির। ও ভয়ে আদনানের বাহু খামছে ধরে। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে—
-স্যার, কী যেনো ছিলো!
-কই?
-এখানে।
আদনান আশেপাশে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পায় না। তুর্কির দিকে তাকিয়ে বলে_
-কিছুই নেই।
পাথরের গায়ে বসে ওরা কিছুক্ষণ, জলের স্পর্শে পা ছড়িয়ে রাখে স্রোতের ভিতর।
আকাশ থেকে একমুঠো রোদ পড়ে— পাতার ফাঁকে ফাঁকে, আর সেই আলোতে ঝিলিক দেয় তুর্কির ভেজা চুল। আদনান সযত্নে ওর ভেজা চুল কানের পিঠে গুঁজে দেয়। জলের গায়ে ওরা একে অপরের প্রতিবিম্ব দেখে। আদনান তুর্কির দিকে দৃষ্টি স্থির করে; আর তুর্কি আদনানে। তুর্কির ঠোঁটে ফোটে মৃদু হাসি। আদনানের হাতের আঙুল ফাঁকে-ফাঁকে ওর আঙুল গুঁজে দেয়।
আদনান ও মৃদু হেসে ভাবে— এভাবেই যদি জীবনটা পার হয়ে যেত! এই একপশলা ভালোবাসা নিয়ে!
পেছন থেকে আবার ভেসে আসে জলের গর্জন।
হামহাম ও তখন ওদেরর দিকে তাকিয়ে থাকে —
একটা সাক্ষী হয়ে৷ ওদের নির্জন, ভেজা, অপার্থিব ভালোবাসার।
বিছানায় দুই হাঁটু বুকের সাথে মিশিয়ে বসে রয়েছে উপমা। মাথার চুল গুলো খোলা। বাতাসে দরুন উড়ছে। পরনে বেগুনি রঙের কাতানের কাপড়। ওর আপন নানি বলছে — কাপড় পরতে। মেয়ে মারা যাওয়ার পর— এই নাতনিকে অনেক আদরে মানুষ করেছেন তিনি। আর কালবাদে সেই নাতনির নাকি বিয়ে। সে ও উপমার পাশে বসে রয়েছে।
আগামীকাল ওর গায়ে হলুদ। হলুদের কোনো প্ল্যান ছিলো না। কিন্তু, সাইমমদের বাড়ির কিছু লোক আসবে। কিছু লোক বলতে— সাইমমের কাজিনরা। তারা ঘরোয়া ভাবে ছোট করে একটা অনুষ্ঠান করবে। ফারুক ও মানা করেনি। তাই বিয়ের সব জিনিস আজই পাঠিয়ে দিয়েছে। সূচি সহ কিছু আত্মীয় সেই সব তত্ত্ব দেখছে।
দরজা ঠেলে ভেতরে আসে জুবাইরা। উপমার পাশে বসে ওর মাথায় হাত দেয়। মাথায় কারো হাত পড়তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় উপমা। জুবাইরা মৃদু হেসে বলে—
-ভয় লাগছে নারে মা? চিন্তা করিস না। এই রকম সব মেয়েদেরই লাগে।
উপমা প্রত্যুত্তরে মৃদু হেসে বলে—
-কামরুনরা আসবে না?
-জানি না মা। ওরা তো শ্রীমঙ্গল গেছে। কবে আসবে কে জানে।
উপমা দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। ওর ফোন বেজে ওঠে। ও ফোন হাতে নেয়। স্কিনে থাকা নাম্বারটি দেখে বুক মোচড় দিয়ে ওঠে। রেজুয়ান!
ও দ্রুত রিসিভ করে ব্যালকনিতে যায়। ওপাশ থেকে সেই মনকাড়া ডাক ভেসে আসে—
-কাঠগোলাপ!
‘কাঠগোলাপ’ ডাকটি শুনে হৃদস্পন্দন আরও বেড়ে যায় উপমার। ওর কণ্ঠনালি ভার হয়ে যায়। ওপাশ থেকে রেজুয়ানের সেই চাঞ্চল্য কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—
-তোমার কী হয়েছে বলো তো। গতকাল একটা চুড়ি পড়া ছবি চাইলাম দিলে না। এসএমেস দিলাম— তাও রিপ্লাই করো না। চুড়ি গুলো তোমার পছন্দ হয়েছে?
উপমা কোনো কথা বলে না। ওর কথা আসছে না। অদৃশ্য এক জড়তা ওকে গ্রাস করে রেখছে। রেজুয়ান আবার বলে
-কাঠগোলাপ, শুনতে পাচ্ছো? চুড়ি গুলো লেগেছে তোমার হাতে? হ্যালো।
রেজুয়ান কানে থেকে ফোন এনে মুখের সামনে ধরে। নেট প্রব্লেম নাকি? কথা বলছে না কেনো? ও আবার বলে—
-কাঠগোলাপ!
উপমা দীর্ঘ এক শ্বাস নেয়। মৃদু ভেজা কণ্ঠে বলে—
-আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।
রেজুয়ান মাথার নিচে বালিশ দিয়ে বলে—
-হুম বলো।
-পরশুদিন আমার বিয়ে! আমিই আপনাকে কল করে ইনভাইট করতাম। কিন্তু, আপনিই যখন দিয়ে দিয়েছেন তো এখানেই ইনভাইট করি। একজন ফ্রেণ্ড হিসেবে তো আমি এইটুকু চাইতেই পারি; আপনি অবশ্যই আসবেন।
কথাটা বলে দুই চোখ বন্ধ করে ফেলে উপমা। রেজুয়ান সোজা হয়ে শুয়ে দুই পা নাড়াচ্ছিলো। উপমা যেনো একটি তীরের মুখে বিষ মাখিয়ে ওর বুকে ছুঁড়ে দিয়েছে! সেইটা সোজা এসে হৃদয়ে গেঁথে গিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে সব! ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে শোয়া থেকে সোজা ওঠে বসে৷ ওর বুক যেনো স্পষ্ট কাঁপছে। কিছুক্ষণ মৌন থেকে কাঁপা কণ্ঠে বলে—
-এই..সব কী বলছো কাঠগোলাপ!
উপমা আবারও দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে—
-হুম! আসবেন কিন্তু!
রেজুয়ান ফের কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে বলে—
-কাঠগোলাপ, আমি ভালোবাসি তোমায়!
উপমা চোখ বন্ধ করে কথাটি শুনে অকপ
-আমি বাসি না!
-মানুষ তো এক ঘরে থাকতে-থাকতে সেই ঘরের মায়ায় জড়িয়ে যায়। পরে ওই ঘর ছেড়ে চলে যেতে কষ্ট হয়।
আর আমি সেখানে, একজন জলজ্যান্ত মানুষ—তোমার আশে-পাশে রইলাম, এক বিন্দু ও মায়া ও কি জন্মালো না আমার প্রতি!?
উপমা তখনই কোনো উত্তর দিতে পারে না। ওর বুক কাঁপছে। ওপাশে রেজুয়ানের হাত অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। কানে ফোন ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। ও আবার
বলে—
-জানিনা, কীভাবে বোঝাবো তোমাকে কত ভালোবাসি! হয়তো বলতে দেরি হয়ে গেলো। আমি জানি আমার কোনো ক্যারিয়ার নেই, কোনো ফিউচার নেই। তবে যদি সম্ভব হয়, তুমি আমাকে কিছু দিন সময় দেও, আমি খুব তাড়াতাড়ি কিছু একটা করে তোমাকে ঘরে তুলবো। জানি একটু কঠিন। তবে আমি পারবো। তবুও দয়া করে আমাকে ছেড়ে যেও না! অন্য কারো হইও না!
রেজুয়ানের শেষ কথাটি শুনে বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হলো উপমার। ও সেই তোলপাড় টুকু লুকিয়ে দ্রুত কণ্ঠে বলে—
-দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি রাখছি। আশাকরি আসবেন। এখন মেহেদী পড়বো।
– কাঠগোলাপ!
ও পাশ থেকে আর কোনো উত্তর এলো না। উপমা কল কেটে দিয়েছে। রেজুয়ান কান থেকে ফোন নামিয়ে— সন্তর্পণে ফোন বিছানায় রেখে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। ওদিকে উপমা ফোন মেঝেতে নিক্ষেপ করে দুই হাত দিয়ে মুখ ছাপিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠলো! কেনো এই কান্না, কেনো এই বিষন্নতা! ওর জানা নেই। কেনো রেজুয়ানের জন্য ওর বুক কাঁপে— ওর কথা মনে হতে ঠোঁটে হাসি ফুটে কিছুই জানা নেই ওর।
মায়ের সাথে কথা বলে ফোন রাখে তুর্কি। আদনান ব্যালকনিতে বসে রয়েছে। তুর্কি চিরুনি নিয়ে ব্যালকনিতে যায়। প্রতিদিন নিয়ম করে আদনান রাতে শোয়ার আগে ওকে বেণী করে দেয়।
আদনান সুইমিং পুলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে রয়েছে। তুর্কি ও ওর পাশে বসে পানিতে পা ডুবায়। আদনানের হাতে চিরুনি দিয়ে লম্বা কেশ গুচ্ছ খোঁপার যাতাকল থেকে মুক্ত করে দেয়। এক হাত দিয়ে পানি ছুঁয়ে বলে—
-চুল বেঁধে দিন।
আদনান ওর হাত থেকে চিরুনি নিয়ে চুল আঁচড়ে দিতে থাকে। কটেজের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝিরির কলকল শব্দ ভেসে আসছে। দিনের বেলা বিভিন্ন শব্দের দরুন বোঝা না গেলে— ও রাতে স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যায়। তুর্কি পানি নিয়ে খেলতে-খেলতে বলে—
– স্যার, আমরা হানিমুনের চক্করে একটা বিয়ে মিস করে ফেললাম।
আদনান চুল আঁচড়ানো শেষ করে বেণী করতে করতে
বলে—
-কার বিয়ে?
-উপমা আপুর। আম্মু আসছে আজ ওই-বাড়ি। তাই বললো আসতে পারবো কিনা। আগামীকাল হলুদ। তার পরের দিন বিয়ে।
-আগামীকাল তো চলে যাবো। যদি চাও, তাহলে তার পরের দিন বিয়েতে অ্যাটেন্ড করতে পারবে।
তুর্কি মুখে খুশির রেখা দেখা গেলো। ও হাস্যজ্জ্বল মুখে
বলে—
-ওকে।
বেণী শেষ করে আদনান, তুর্কিকে নিজের দিকে ঘোরায়। শাড়ি পরলে মেয়েটাকে যতটুকু বড় লাগে— কুর্তিতে ততটাই বাচ্চা-বাচ্চা লাগছে। তার ওপর বেণী করাতে আরও। আদনান চিরুনি পাশে রেখে এক হাত দিয়ে তুর্কির কোমড় জড়িয়ে ধরে ওদের মাঝের দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলে। অন্য হাত দিয়ে গলার কালচে দাগটায় বৃদ্ধা অঙ্গুলি চালাতে-চালাতে বলে—
– এই দিকে আসো! তোমাকে একটা জিনিস দেই!
আদনানের ‘এই দিকে আসো’ ডাক শুনে ভড়কে যায় তুর্কি। কাল এই ডাকেই সাড়া দিতে গিয়েই পুরো রাত তার ফল ভোগ করেছে। আজ আর নয়! আদনান ওর গলার দিকে অগ্রসর হলে ও দ্রুত আদনানের বুকে দুই হাত দিয়ে বাধা সৃষ্টি করে। ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বলে—
-এক দম না। আমার কোনো কিছু চাই না। ভুলেও আজ আপনি কিছুই চাইবেন না। সরুন এখান থেকে। অসভ্য লোক!
আদনান ওর বাধা ভেদ করে বলে—
-একটুউউউ…বউ! একটা…. এই দিকে আসো প্লিজ…!
তুর্কি বাধা দেওয়া সত্ত্বেও আদনানের কামনার কাছে ও হেরে যায়। আদনান, তুর্কির গলা থেকে হাত সরিয়ে দুই হাত দিয়ে খুব শক্ত করে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। তুর্কির গলার সেই লালচে দাগটায় অধর ছুঁয়ে দেয়। তুর্কি অনুভূতির যাতাকলে পড়ে আদনানের জেলহীন চুল গুলো ডান হাতের আঙুলের ফাঁকে- ফাঁকে গুঁজে নেয়। আর বাঁ হাত দিয়ে আদনানের পিঠের শার্ট খামছে ধরে।
বেশ অনেকক্ষণ আদনান, তুর্কির গলায়, ঠোঁটে, চিবুকে রাজত্ব চালিয়ে ওর কপালে-কপাল ঠেকায়। চোখ বন্ধ করে বলে—
-আমাকে এত দিন ধরে আনরোমান্টিক বলে খোঁটা দেওয়ার ফল— এখন থেকে তুমি সুদে-আসলে ফেরত পাবে, বেগম সাহেবা। বি রেডি!
তুর্কি দ্রুত চোখ খুলে বলে—
-মোটে ও না। আমি আমার আগের সেই আনরোমান্টিক বর-টা কে চাই। আপনি কে? আমি আপনাকে চিনি না। দূর হোন!
আদনান চোখ মেলে বলে—
-আচ্ছা, এই দিকে আসো। চিনাচ্ছি আমি কে!
আবার সেই সর্বনাশের ডাক ‘এই দিকে আসো!’ ও দ্রুত আদনান কে ঠেলে সরে যেতে চাইলে; আদনান নিজেকে সামলাতে না পেরে— সুইমিং পুলে পড়ে যায়। আদনানের পড়া দেখে তুর্কি দ্রুত ওঠতে গেলে— আদনান ওর হাত টেনে ধরে পানিতে ফেলে। তুর্কি চোখ মুখ খিঁচে বলে—
– অসভ্য মার্কা খারাপ লোক। এই রাতের বেলা কোন কারণে পানিতে নামলেন?
-আমি নেমেছি? নাকি তুমি নামিয়েছো?
-আচ্ছা।
এই রকম অনেক কথা বলতে বলতে পানিতে অনেকক্ষণ কাটায় দু’জন। মাঝে-মাঝে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। মাঝে-মাঝে গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে দু’জনের দিকে দু’জন!
আদনান বাসায় না থাকলে, রেজুয়ান-মুজাহিদ খুব কমই রাতের খাবার টেবিলে খায়। আজ ও তার ব্যতিক্রম হলো না। মুজাহিদ নিজের আর রেজুয়ানের খাবার হুমাইরার কাছে বলে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। প্লেট দু’টি নিজের ঘরে রেখে পানি আর রেজুয়ানকে ডাকার জন্য ঘর থেকে বের হয়। কিন্তু, তার আগেই দরজায় উপস্থিত হয় রেজুয়ান। মুজাহিদের দুই হাত ধরে অস্থির কণ্ঠে বলে—
-বাপের ভাই! বাপের ভাই! তুমি একটু কাঠগোলাপ কে বোঝাও, আমি ওকে ঠিক কতটা ভালোবাসি! আমি খুব তাড়াতাড়ি কোনো একটা কাজ খুঁজবো। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ওকে ঘরে তুলবো। তবুও ও যেনো অন্য কারো না হয়। প্লিজ, ওরে একটু বুঝাও!
আচমকা রেজুয়ানের মুখে এহেন বাক্য শুনে কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ে মুজাহিদের। রেজুয়ানের কণ্ঠ কাঁপছে! ওর হাত জোড়া কাঁপছে! মুজাহিদ ওকে শান্ত হতে বলে। এক বাহুতে হাত রেখে বলে—
– কী হয়েছে, বাচ্চা? এমন করছিস কেনো?
-বাপের ভাই, বাপের ভাই, কাঠগোলাপের বিয়ে। তুমি কিছু করো।
রেজুয়ানের কথা শুনে মূহুর্তের জন্য থমকায় মুজাহিদ। পরপরই আবার বলে—
-বিয়ে মানে?
-একটু আগে ও কল করে আমাকে ইনভাইট করলো বিয়েতে যাওয়ার। আমি কিছু জানিনা। তুমি কাঠগোলাপকে একটু বুঝাও।
রেজুয়ানের পাগালমি দেখে মুজাহিদ ওকে শান্ত হতে বলে। তারপর ওকে বিছানায় বসিয়ে বলে—
– শান্ত হো তুই। আমি দেখছি।
মুজাহিদ রেজুয়ানকে বিছানায় বসিয়ে উপমার নাম্বারে কল করে।
উপমা তখন ও ব্যালকনিতে একই ভাবে বসা। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। অনেকেই ডাকতে এসেছে কিন্তু, ও যায়নি। মেঝেতে পড়ে থাকা ফোন বেজে ওঠতেই ও দ্রুত সেই দিকে তাকায়। রেজুয়ান কল করেছে। ও ফোন তুলে রিসিভ করতে গিয়ে-ও থেমে যায়। অযথা রেজুয়ানের সাথে কথা বলে মায়া বাড়াতে চায় না। বেশ অনেকবার রিং হওয়ার পর ও যখন; ফোন দেওয়ার তালেই আছে— তখন উপমা ফোন রিসিভ করে। ও পাশ থেকে একটু বয়স্ক পুরুষালী কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—
– আসসালামু-আলাইকুম। আমি কি কাঠগোলাপের সাথে কথা বলছি?
মূলত আদনান-মুজাহিদ কেউ-ই উপমার সঠিক নাম জানে না। আর জানলে ও হয়তো মনে নেই। ওর কাঠগোলাপ নামেই জানে। ‘ কাঠগোলাপ’ শুনে কিঞ্চিৎ অবাক হয় উপমা। এই নাম রেজুয়ান ছাড়া আর কেউ ডাকে না। অথচ রেজুয়ানের কল থেকে লোকটা বলছে ও কি ‘কাঠগোলাপ’! উপমা সালামের উত্তর নিয়ে বলে—
-আপনাকে ঠিক চিনলাম না।
মুজাহিদ নিজের পরিচয় দিয়ে মূল কথায় আসে। রেজুয়ানের সব পাগলামির কথা ওকে জানায়। সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে উপমাকে বোঝাতে। কিন্তু, উপমার হাতে-পায়ে শিকল বাঁধা। তাই ও স্পষ্ট করে জানায় ‘ওদের মাঝে কোনো রিলেশন ছিলো না। তাই, অযথা রেজুয়ানকে পাগলামি করতে বন্ধ করতে বলুন।’ এই বলে কল কেটে দেয় উপমা।
মুজাহিদ কানে থেকে ফোন নামায়। রেজুয়ান উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মুজাহিদের দিকে। মুজাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—
-সম্ভব না। মেয়ে রাজি না।
রেজুয়ান ক্ষণকাল থমকে; ব্যথিত কণ্ঠে বলে—
-তুমি পারলে না? বাপের ভাই! তুমি পারলে না?
এই বলে বিছানায় বসে পড়ে। মুজাহিদ ওর পাশে বসে
বলে—
-মেয়ে রাজি থাকলে, আমি মুজাহিদ আমার বাচ্চার জন্য ওকে তুলে আনতাম। দরকার পড়লে ওর বাপের সাথে যুদ্ধ করতাম। তবুও আমার বাচ্চার মুখে হাসি ফোটাতাম। কিন্তু, যেখানে মেয়ে রাজি না সেখানে কার সাথে যুদ্ধ করবো বল? কাকে তুলে আনবো?
হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৪০
রেজুয়ান কোনো উত্তর দেয় না। শান্ত নয়নে তাকিয়ে থাকে মেঝের দিকে। রেজুয়ানকে দেখে মুজাহিদের বুক হুঁ হুঁ করে ওঠে। আদনান-রেজুয়ানের তার জান। ওদের কিছু হলে সে ও শেষ।
মুজাহিদ এক দৃষ্টিতে রেজুয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের তিনজনের মধ্যে রেজুয়ান সব চেয়ে হাসি-খুশি, প্রাণবন্ত! শতশত মানুষের খারাপ মন— তুড়ি মেরে ভালো করে দিতে পারে। কিন্তু এইটা বোধহয় বাস্তবতা—
‘যে মানুষ যত বেশি প্রাণবন্ত, হাসি-খুশি; সৃষ্টিকর্তা তাকেই বেছে নেয়—পৃথিবীর সব দুঃখ, কষ্ট ভোগ করানোর জন্য!’