হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৫
তোয়া নিধী দোয়েল
২৯ ডিসেম্বর ২০২১।
আসরের আজান পড়েছে কিছুক্ষণ আগে। কামরুন্নেসা তুর্কি বারান্দায় চেয়ারে বসে পা-যুগল বারান্দার গ্রিলে ঠেকিয়ে ফোন স্কোল করছে। রুম থেকে মা জুবাইরার কণ্ঠ স্বর ভেসে আসছে। খুব তৃপ্তির সাথে কারো সাথে কথা বলছেন তিনি। ক্ষণে-ক্ষণে ভেসে আসছে হাসির শব্দ। তুর্কি এতক্ষণ রুমের ভেতরেই ছিলো। মায়ের যন্ত্রণায় সে বারান্দায় এসে বসেছে।
আজ সিম কোম্পানির ঈদের দিন! প্রায় দের ঘণ্টা যাবৎ, তুর্কির মামির সাথে তুর্কির মা ফোনে কথা বলছে। তুর্কি ভেবে পায় না এরা কি এমন কথা বলে! আল্লাহর নামে একবার কথা শুরু করলে; পৃথিবীর কোন প্রান্তে কি ঘটেছে সেই সব বলা না পর্যন্ত থামে না। অসহ্য!
আগামীকাল তুর্কির এসএসসি রেজাল্ট দিবে। তাই সে একটু চিন্তিত। যদিও শুধু গ্রুপের সাবজেক্ট গুলা পরিক্ষা হয়েছে। তার ওপর আবার শর্ট সিলেবাসে। ও নিশ্চিত এ+ থাকবে। তবু-ও একটু ভয় হচ্ছে। বীপ বীপ সাউন্ড করে তুর্কির ফোন বেজে উঠে। সোফিয়া!
_ হ্যাঁ, দোস্ত বল।
ওপাশ থেকে উত্তর আসে
-কী বললবো?
-আমি কী জানি? কিসের জন্য কল দিছস।
-হুদাই মন চাইলো তাই। কেন তোকে কি দরকার ছাড়া কল দেওয়া যাবে না?
-না। তুই তো কোনোদিন দরকার ছাড়া কল দেস না।
-তো, তুই ধরলি কেন?
তুর্কি বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
-ক বা*ল। এই রকম ক্ষেপছস কেন? সাইমম ভাইয়ার সাথে ঝগড়া হইছে?
-হো বা*ল হইছে।
-হ্যাঁ, তাই তো সেই রাগ আমার উপরে দেখাইতাছস।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-শোন বা*ল, কাল তো রেজাল্ট তো দিবো। ভাই, তুই তো প্লাস পাবি। আর আমি আমি তো ফেল।
-ফেল করবি-ই তো। লেখা পড়া বাদ দিয়ে প্রেম করছস। এখন ফেল করলে আবার কান্দছ কেন?
-তামান্না বলেছিলো প্রেম করলে নাকি লেখা পড়া আরও ভালো হয়! দেখছ না ওর কয়টা বয়ফ্রেন্ড তারপর-ও ওর রেজাল্ট কত ভালো হয়। সেই জন্য-ই তো আমি প্রেম করেছিলাম। আর সাইমম কে তো দেখছসই, কত সুন্দর তার-ওপর নিজ থেকে প্রোপস করছে সেটা কি ভাবে ফিরিয়ে দেই কো।
– হো ভালো হইছে। এখন ফেল কইরা রিকশাওয়ালার সাথে ঘর বাঁদিস।
-হো। এখন একটা প্ল্যান দে, কী ভাবে পাশ করা যায়।
-এখন আর কোনো উপায় নাই। তুই আমার জন্য দোয়া কর, যেনো প্লাস টা আসে। সাইন্স থেকে প্লাস না আসলে মান-সম্মান আর থাকবে না। আর সব চেয়ে বড় কথা আম্মু থ্রেট দিছে; পাশের বাড়ির রকমান পাগলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবো।
-রকমান পাগল না সেই দিন বিয়ে করলো। আন্টি আবার তোরে ও তাঁর ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিবো। ভালোই হইছে; দুই বউ নিয়ে স্টিডিয়ামের মাঠে পাগলের খেলা দেখিয়ে তোগো নিয়ে চলতে পারবো।
-ফাজিল তুই ফোন কাট!
-দেখ তুই মানছ আর না মানছ; আমার যদি রিকশাওয়ালার সাথে বিয়ে হয়, তাহলে আমি তাও রিকশায় চড়ে ঘুরতে পারবো। আর তুই আর তর জামাই শুধু উলালা উলালা…উলালা উলালা….তু হে মেরি ফ্যান্টাসি গানে নাচ দেখিয়ে মানুষ-রে আনন্দ দিবি। আর মানুষ….
-ফাজিল তুই যদি আর একটা দিন আমারে ফোন দিছস।
ওপাশ থেকে আর কোনো উত্তর আসার আগেই কল কেটে দেয় তুর্কি। আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করে যেনো প্লাস টা পায়।
ঘর থেকে জুবাইরার কণ্ঠ আর শোনা যাচ্ছে না। সে রান্না ঘরে ঢুকেছে। তুর্কি মাকে দেখে ফোনে একটা সিংহের বাচ্চার ছবি বের করে। তারপর মায়ের সামনে যায়।
-আম্মু, কাল তো রেজাল্ট দিবে।
-হ্যাঁ। আর তুই নিশ্চিত থাক যে তুই ফেল করবি!
তুর্কি অসহায় দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকায়। নিজের মা হয়ে এমন কথা কি ভাবে বলতে পারে!
-মা…আমি তোমার নিজের মেয়ে-ই তো? মা হয়ে এমন কথা বলতে পারলে! যে আমি ফেল করবো?
জুবাইরা পানিতে চা-পাতি দিতে দিতে বলে,
-আমার কোনো সন্দেহ নেই, যে তুই ফেল করবি না। এক অক্ষর পড়ছ না। সারাটা দিন ফোন চাপছ। সারাটা দিন গোপাল ভাঁড় দেখছ কানের মধ্যে গান বাজিয়ে নাচছ। তুই যদি পাশ করছ তাইলে শিক্ষাবোর্ডের মান-সম্মান থাকবো?
তুর্কি কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে বলে,
-মা…ওকে তুমি কথা দেও যদি কাল আমি পাশ করি আর ভালো মার্কস আসে তাহলে এই সিংহের বাচ্চাটা আমাকে কিনে এনে দিবে!
তুর্কি ফোনে থাকা সিংহের বাচ্চার ছবি দেখায়৷ জুবাইরা চা নাড়া বাদ দিয়ে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে
-সিংহের বাচ্চা দিয়ে কি করবি?
-পালবো।
-মানে? সিংহের বাচ্চা কেউ পালে!
-হ্যাঁ ।আমি পালবো। ও-কে আমার শিকারি বানাবো। তারপর, যদি পড়া নিয়ে বেশি প্যারা দেও, ও-কে নিয়ে দূরে পালিয়ে যাবো। বেশি পড়া-লেখা আমার ভালো লাগে না।
-দোষ আসলে তোর না। তোর জাত-গুষ্টির। সব তো পাগলের বংশ তাই তুই এমন পাগলামি করছ।
-আম্মু….
-সর বলতেছি এখান থেকে।। সিংহের বাচ্চা এনে ওরে খাওয়াবি কী? প্রতিদিন দুইটা করে গরু খাইতে দিতে হবে। পারবি? তোর বাপে তো জমিদার তাইনা?
-আরে গরু খাবে মানে? ও আমার সাথে ভাত খাওয়া শিখবো। জাননো না ‘সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে’?
-আমার হাতে ঝাড়ু ওঠার আগে এখান থেকে সরিস।
-মা শোন না…
-আমি টয়লেটে যাবো চা টা দেখ।
জুবাইরা চুলার আঁচ কমিয়ে দিয়ে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে চলে যায়। তুর্কি বিরক্তির সাথে বলে ধ্যাত। তাকিয়ে থাকে চা-য়ের পাতিলের দিকে। তাঁর খুব শখ একটা সিংহের বাচ্চা পালবে। তাকে বড় করবে। যখন অনেক বড় হবে, তখন ওর পিঠে চড়ে ও সারা দেশ বিদেশ ঘুরবে। যেখানে বেশি পড়া-লেখার প্যারা থাকবে না। শুধু কম কম পড়া-লেখা থাকবে। আর থাকবে মজা আর মজা। কিন্তু, মায়ের জন্য কিচ্ছু হলো না।
রুম থেকে খুব শব্দ করে জুবাইরার ফোন বেজে উঠে। শব্দে তুর্কির কান ঝালা-পালা হয়ে যায়। মানে আম্মু কি কানে কম শোনে? এত ভলিউম দিয়ে রাখে কেনো। তুর্কি গ্যাস অফ করে রুমে এসে দেখে কে কল দিয়েছে। ‘নয়াডিঙ্গির রাশেদা ২’। বিরক্ত মুখে উচ্চারন করে মামি! মাত্র না দুই তিন ঘণ্টা ভরে কথা বললো এখন আবার কিসের জন্য কল দিয়েছে। দুই বার বাজার পর যখন দেখলো জুবাইরা আসছে না তখন ও কল রিসিভ করে।
-আসসালামু-আলাইকুম মামি। কেমন আছেন?
-ওলাইকুমুস-সালাম। ভালো ভালো। তোর মায় কই?
-আম্মু তো টয়লেটে গেছে। কেনো কি দরকার?
-আর কইছ না। যে কারণে তোর মায়রে কল দিছিলাম, সেইটাই তো বলা হয় নাই।
-মানে!
-আরে শীতের পিঠা খাবি না? সেই দাওয়াত দেওয়ার জন্য-ই তো কল দিছিলাম। কিন্তু, দাওয়াত দিতে ভুলে গেছি।
তুর্কি হতাশ হয়ে যায়। মানে তখন তাহলে দাওয়াত দেওয়ার জন্য কল দিছিলো। এক দের ঘণ্টার মত কথা বলার পর এখন বলছে দাওয়াত দিতে-ই ভুলে গেছে! সত্যি! তাহলে এতক্ষণ এরা কি কথা বললো!?
-আমার মেয়েটার জন্য দোয়া করিছ। কাল রেজাল্ট দিবো। আল্লাহ জানে কি করবো।
জুবাইরা সন্ধ্যা থেকে তার সব আত্নীয়-স্বজনের কাছে কল দিয়ে দিয়ে দোয়া চাচ্ছে। এখন প্রায় রাত নয়টা বাজে। তুর্কি পাশের রুমে শুয়ে ফোন দেখছে। বীপ বীপ সাউন্ড তুলে ফোন বেজে উঠতেই তৃপ্তির সাথে কল ধরে
-বাবুউউউউ।
-হ্যাঁ, মা কেমন আছিস? কি করছিস?
-এই তো বাবা, শুয়ে আছি। তুমি কি করো?
-এই তো মা, বসে আছি।
বলা-বাহুল্য, তুর্কির বাবা শহিদ হাসান সৌদি- আরব থাকেন।
-তোমার আম্মু ফোন ধরে না কেন? কত বার করে ফোন দিলাম।
-মা তো তাঁর জাত-গুষ্টির সাথে কথা বলছে বাবা। জানো-ই তো একবার কথা শুরু হলে…
-পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও থামবে না। যতক্ষণ না পর্যন্ত ফোনের টাকা না শেষ হয়।
মেয়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন শহিদ হাসান। তারপর দুই বাপ বেটি এক সাথে হেসে উঠে।
-কাল তো রেজাল্ট দিবো মা টেনশন করো না। আমার মেয়ে পারবে-ই।
-হ্যাঁ, বাবা একটু ভয় করছে।
-এক দম ভয়ের কিছু নেই মা। তুমি পারবে।
-জানো আম্মু বলেছে, রেজাল্ট খারাপ হলে আম্মুর ক্রাশের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিবে।
শহিদ হাসান অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
-ক্রাশ আবার কী মা?
-আরে, আম্মুর একজন পছন্দের মানুষ আছে। যাকে দুই দিন পর পর তাঁর মেয়ের জামাই হিসেবে ঘোষণা দেয়। ওই যে পাশের বাড়ির রকমান পাগল আছে না উনার সাথে।
শহিদ হাসান হেসে বলে,
-কি! এত বড় সাহস! আমার এক মাত্র রাজকন্যা কে এই কথা বলেছে? দেখি দেও তো তোমার মায়ের কাছে ফোন।
-হ্যাঁ, দাঁড়াও।
তুর্কি বিছানা থেকে নামতে গিয়ে দেখে জুবাইরা নিজে-ই এসেছেন। তাকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলে,
-নেও বাবা কথা বলবে।
দীর্ঘক্ষণ স্বামীর সাথে কথপোকথন শেষ করে জুবাইরা এসে তুর্কির সামনে বসে
-মা তুর্কি তোকে একটা কথা বলি? রাখবি?
তুর্কি একটু অবাক হয়ে যায়। তার মা এত সুন্দর করে কথা বলছে! তুর্কি সুন্দর করে হেসে বলে,
-হ্যাঁ, মাতাশ্রী অবশ্যই বলুন।
-তুই যদি কাল কোনো মতে পাশ করতে পারছ; দয়া করে ইন্টারে আর সাইন্স নিছ না। তোর হাতে ধরে বলি।
-মা……..
তুর্কি একটু রাগ নিয়ে বলে।
-মা তুমি জানো ছোট বেলা থেকে আমার সপ্ন আমি ডাক্তার হবো। আর তুমি এই কথা বলতে পারলে?
-দেখ মা সবার সব সপ্ন দেখতে হয় না। কি লাভ ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার সপ্ন দেখা। আর যদি তুই লেখা পড়া করতি তাহলে একটা কথা ছিলো। যেহেতু তোর লেখা পড়া ভালো লাগে না; তাই আমি বলবো দয়া করে ইন্টারে আর সাইন্স নিছ না ঠিক আছে। এসএসসির সাইন্স আর ইন্টারের সাইন্স আকাশ পাতাল ভিন্ন। তাই আমি বলি কি…
-মা আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না৷ আমি সাইন্স নিয়ে পড়বো যখন বলেছি, তখন সাইন্সই নেবো। তুমি আমাকে বাধা দিতে পাররো না।
হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৪
-সব সময় আবেগ দিয়ে কাজ করলে চলে না মা। মাঝে মাঝে বিবেক দিয়ে ও কাজ করতে হয়। আর এই রকম বড় বড় কাজ আবেগের বশে হয় না।
– আমি আর কোনো কথা শুনতে চাইনা। আমি সাইন্স নেবো মানে সাইন্স-ই নেবো।
তুর্কি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।