হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৯

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৯
তোয়া নিধী দোয়েল

সারারাত ভাবার পর তুর্কি শেষেমেশ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ও এখন থেকে বোরকা পরে কলেজে যাবে। আর বেশিক্ষণ বাইরে থাকবে না। এত বড় মানিকগঞ্জ শহরের মধ্যে ওকে কি ভাবে-ই বা খুঁজে পাবে, ওই লোক। আর ও কেনো-ই বা ওই লোককে ভয় পেয়ে কলেজ ছেড়ে দেবে। কোনো প্রশ্ন-ই উঠে না। বুড়ো একটা লোক। সাহস কত ওকে থ্রেট করে।
বাসের জানালার পাশের সিটে বসে এই সব ভাবছে তুর্কি। ওর পাশের সিটে বসেছে জুবাইরা। ঠান্ডা বাতাস এসে তুর্কির মুখের নিকাব উড়িয়ে দিচ্ছি।

কলেজ প্রাঙ্গণে পৌঁছানো মাত্র, জুবাইরা ফারুকে কল করে। ফারুক ডিপার্টমেন্টে উপস্থিত নেই৷ তাই, সে জুবাইরাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে। তুর্কি মাকে বলে ক্লাসের দিকে চলে যায়। হাঁটার সময় ওর মনে হয়, কেউ একজন ওকে অনুসরণ করছে। ও ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। না এমন কেউ নেই। কিন্তু, কেমন যেনো অস্বস্তি লাগছে। বোধহয় মনের ভুল। ওর সারা শরীর কালো বোরকা দিয়ে প্যাকেট করা। ওই লোক এমনি তে ও চিনতে পারবে না।
ক্লাস শেষে তুর্কি আর সোফিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ওর সাথে হওয়া সব ঘটনা খুলে বলে। সোফিয়া অবাক হয়ে প্রশ্ন করে
-দোস্ত হাও রোমান্টিক! লোকটা তোকে বেগম সাহেবা বলে ডাকলো?
-হুম। তাই তো একটু ভয়ে আছি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-দোষ কিন্তু তোর বেশি। তুই কেন অন্যের পাকা চুল নিয়ে খোটা দিবি? অনেক মানুষের অনেক হরমনজনিত প্রব্লেম আছে যার জন্য অল্প বয়সে ও দু একটা চুল পেকে যায়। হয়তো তার ও এমন কোনো প্রব্লেম আছে।
-তুই চুপ থাক। লোকটার বয়স মোটে ও অল্প না। চল্লিশ পঞ্চাশ তো হবে-ই।
সোফিয়া বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে,
-চল্লিশ পঞ্চাশের বেডা কোনো দিন ওই রকম মার-পিট করতে পারে? এত বয়স হবে না।
-তুই আমার থেকে বেশি জানছ?

-বা*ল বাদ দে। তুই তো একটা কথা জানছ-ই না। কাল তুই ক্লাসে না এসে কত বড় ভুল করছস। কাল আমাদের ফিজিক্স ক্লাস ছিলো। ভাই যে স্যার টা আসছিলো না পুরাই আগুন!
তুর্কি সোফিয়ার কথা কানে নেয় না। অবজ্ঞার স্বরে বলে,
-ভাই, তুই একটা বেডাবাজ। যারে দেখছ তারে-ই তোর ভালো লাগে। সে পায়খানা পরিষ্কার করুক আর কিংবা রাজমিস্ত্রী। বেলাহাজ মেয়ে।
-আরে না বা*ল। সত্যি স্যার-টা অসাধারণ ছিলো। হায়, কি তাঁর কথা-বার্তা! কি তাঁর চালন! কি তাঁর পড়ানোর স্টাইল! আইম সিউর, ক্লাসের নাইন্টি পার্সেন্ট মেয়ে স্যার এর উপর ক্রাশ খেয়েছে। বা*ল যদি সাইমমের সাথে রিলেশন না করতাম; তাহলে, স্যার কে পটিয়ে ফেলতাম।
-উঁঃ (মুখ ঝামটা দিয়ে) তোর বা*লের মত চেহারা দেখে পছন্দ ও করতো না।
সোফিয়া তুর্কির দিকে ভ্রুকুঞ্চন করে তাকিয়ে বলে,

-তোর থেকে সুন্দর আছি শাকচুন্নি৷ তাই-তো আমার বাবু সোনা ডাকার মানুষ আছে। তোর প্যাকাটির মত চেহারা দেখেই তো কোনো বেডা তোরে পাত্তা দেয়।
-আমার অন্য বেডা গো পাত্তা পাওয়ার সময় ও নাই। আমি শুধু মাত্র আমার জামাইয়ের পাত্তা পেতে চাই। আমার মনে প্রাণে সপ্নে সব সময় আমার জামাই-ই থাকে। আমি শুধু তাঁর-ই ভক্ত।
-দোস্ত……….।
জোরে চিৎকার করে উঠে সোফিয়া। তুর্কি সোফিয়ার চাওনির দৃষ্টি অনুসরণ করে সেই দিকে তাকায়। বোধহয় সাইমম ভাইয়া কে দেখেছে।

-দোস্ত দোস্ত, ওই যে আদনান স্যার। চল না চল একটু কথা বলে আসি। স্যার কে আমার সেই লাগে। চল না দোস্ত।
ওরা তিন তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। এত উপরে থেকে সোফিয়া চিনলো কি ভাবে! কাট বাগানের পাশ দিয়ে রাস্তা নতুন ভবন থেকে পুরনো ভবনের। তারপর মেইন রোড৷ কাটবাগান এ রাস্তায় অনেক মানুষ। তুর্কি সেই দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বললো,
-এখানে তো অনেক মানুষ। কোনটা আদনান স্যার?
-আরে বা*ল ঐ যেএএএ গু গু কালার শার্ট পরা।
তুর্কি নাক মুখ কুঁচকে সোফিয়ার দিকে তাকায়।
-গু গু কালার আবার কি?
-তোর এত বোঝা লাগবো না। তুই আয় আমার সাথে।

সোফিয়া তুর্কির হাত ধরে টেনে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামিতে থাকে। এত দ্রুত নামার ফলে ওরা দুইজন হাঁপিয়ে যায়। কিন্তু, সোফিয়া আদনান স্যার কে আর খুঁজে পায় না। তুর্কি হাপাতে হাপাতে বলে,
-ছাগল, কই তোর স্যার?
-ধুর বা*ল চলে গেছে। আরেকটু তাড়াতাড়ি নামা উচিত ছিলো।
-তো উড়াল দিলি না কেন?
সোফিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে আদনান স্যার কে খুঁজেতে থাকে। কিন্তু, এত ভিড়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। তুর্কি সোফিয়া কে বলে,
-আমি সাইমম ভাইয়া কাছে বলে দেবো। তুই একটা বেডাবাজ ছেরি। যারে দেখছ তার প্রেমে-ই পড়ছ।
-না বা*ল ওরে কিছু বলিস না। স্যার রে পটিয়ে নেই তার পর বলিস।
-ভাই, কথায় কথায় মুখ খারাপ করস কেন? শুনতে ভালো লাগে না। ভদ্র ভাষায় ভদ্র ভাবে কথা কবি তা না হলে কথা বলার দরকার নেই।
-তোর মত বা*লের লগে কথা বলতে ইচ্ছা ও করে না। ছোট বেলা থেকে আমার কাছে মানুষ হইছস তাই মানবতার খাতিরে কথা বলি।

তুর্কি কিছু বলতে যাবে এমন সময় ব্যাগের উপর হাত পরে। ব্যাগের ভেতর থাকা ফোন কাপছে। বোধহয় জুবাইরা কল দিছে। তুর্কি ফোন বের করে দেখে 7 Missed call from ammu। এই কয় মিনিটের মধ্যে এত গুলা কল! আল্লাহরে! ফের কল আসলে তুর্কি রিসভ করে,
-হ্যাঁ, আম্মু।
-ফোনের ওজন কি অনেক বেশি?
-সরি আম্মু, দেখি-নি। বলো তুমি কোথায়; আমি আসছি।
-প্রিন্সিপাল রুমে। তাড়াতাড়ি আয়।
এই বলে জুবাইরা কল কেটে দেয়। তুর্কি সোফিয়া কে ওর সাথে যেতে বলে৷ সোফিয়া বলে,
-তুই যা দোস্ত। আমার সাইমমের সাথে দেখা করতে যেতে হবে।
– শালার বেডাবাজ! তুই না মাত্র আদনান স্যার নামে, কোন স্যারের জন্য পাগল হলি।
-আরে স্যার তো এখনো পটাতে পারি নাই। পটে গেলে সাইমম বাদ। এখন আমি গেলাম। টাটা বেবি।
সোফিয়া তুর্কি-কে একটা হাগ দিয়ে চলে যায়।

তুর্কি প্রিন্সিপাল রুমের দিকে অগ্রসর হয়। কয়েক পা এগিয়ে আবার পেছনে ঘুরে তাকায়। অনেক ছেলে মেয়ে আসছে। কেউ কেউ ক্যাম্পাসে বসে রয়েছে। তাহলে ওর এমন কেনো মনে হচ্ছে কেউ ওর পেছন পেছন হাঁটছে! ও-কে অনুসরণ করছে! ও ঢোক গিলে৷ এই ভাবে আসা সত্ত্বেও লোকটা অকে চিনে ফেললো না তো? লোকটার বলা কথা ওর স্মরণ হয়। ❝আমি সহজে কোনো বিষয় নিয়ে জেদ ধরি না। কিন্তু একবার কোনো বিষয় নিয়ে জেদ ধরলে, সেই বিষয়ে যদি আমি ভুল ও থাকি, আমার ক্ষতি হওয়ার আশংকা থাকে তবু ও সেটা হাসিল করে ছাড়ি❞।
তুর্কি আর কিছু না ভেবে দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরে। ওর মনে হয় ওকে অনুসরণ করা পা জোড়া ও খুব দ্রুত পায়ে হাঁটছে!
প্রিন্সিপাল রুমের ভেতরে ফারুক জুবাইরা সহ আরও দু-জন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী পুরুষ বসে রয়েছে। পুরুষ-টির মুখে বিরক্তির ছাপ।

তাদের মধ্যে এতক্ষণ অনেক কথোপকথন হয়েছে।
এই দুই জন ব্যাক্তির সাথে ফারুকের অন্য রকম সম্পর্ক।
-তোর মেয়েকে ঠিক মত কলেজে আসতে বলিস। উনাদের সাথে তো কথা হলো-ই। বাকিটা উনারা দেখে নেবে। আর নাম্বার তো নিলিই; কোনো সমস্যা হলে কল করবি।
কথা-বার্তার এই পর্যায় জুবাইরার ফোন বেজে উঠে। তুর্কি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। জুবাইরা বাইরে গিয়ে তুর্কি কে নিয়ে আসে। তুর্কি ভেতরে এসে সালাম দেয়। ফারুক সুন্দর হাসি দিয়ে সালামের উত্তর নেয়।
-এই দিকে আসো মামুনি।
পরিচিত কণ্ঠ স্বর শোনে ছেলেটির পাশে থাকা মেয়েটি ভ্রুকুঞ্চন করে পেছনে তাকায়। তুর্কি নিকাব উপরে তুলে মাথা নিচু করে ফারুকের পাশে এসে দাঁড়ায়। একটু ভয় হচ্ছে ওর। ফারুক আবারো তুর্কির উদ্দেশ্যে বলে,

-কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
-আলহামদুলিল্লাহ। শোন মামুনি, উনি হচ্ছে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের প্রভাষক সারফারাজ আদনান ফরাজি। আর উনি কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের প্রভাষক কোহেলি মুন কোয়েল। তোমার ফিজিক্স কেমিস্ট্রির যাবতীয় সকল সমস্যা এই দুজন টিচারের সাথে শেয়ার করবে। তোমার কোনো টেনশন নেই। আমার ছেলে মেয়ে দু-জন তোমার সব সমস্যা দূর করে দিবে।
তুর্কি চোখ তুলে তাকায়। সামনে বসে থাকা দুজন নারী পুরুষকে দেখে বিদ্যুতের শক খাওয়ার মত চমকে উঠে!
এই….এই….দুজন ওর টিচার!আদনান বুকে হাত ভাঁজ করে শান্ত দৃষ্টিতে তুর্কির দিকে তাকিয়ে আছে। আর কোহেলি অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে!
তুর্কি জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে মুখে বোকা বোকা হাসি দিয়ে বিড়বিড় করতে থাকে,

-পড়ালেখার খেতায় আগুন! এরা আমার ফিজিক্স কেমিস্ট্রির স্যার হলে আমি আর পৃথিবীতে বেঁচে থাকবো না! এরা আমার কি সমস্যা সমাধান করবে এরাই আমার জীবনের বড় সমস্যা! আজ থেকে লেখা পড়া বাদ। বেঁচে থাকলে এই কলেজের দিকে আমি আর আসছি না।
তুর্কি বোকা বোকা হাসি ঠোঁটে বিদ্যমান রেখে সালাম দেয়
-আসসালামু-আলাইকুম স্যার। -আসসালামু-আলাইকুম ম্যাম।
তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-আম্মু, আমি আর লেখা পড়া কর‍তে চাই না ওকে। আমি বাইরে গেলাম তুমি আসো।
এই বলে তুর্কি ফারুকের দিকে তাকিয়ে সালাম দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়। ফারুক জুবাইরা ভীষণ অবাক হয়। জুবাইরা মনে মনে ক্ষিপ্ত হতে থাকে। এই মেয়েকে আজ বাসায় গিয়ে আচ্ছা মত ধুবে। কেমন অসভ্যের মত বেরিয়ে গেলো।

-কি হলো তর মেয়ের?
আদনান ফারুকের দিকে তাকিয়ে বলে,
-ডোন্ট অরি, স্যার। ওর কিছু হয় নি। তবে এবার হবে। আপনি টেনশন করবেন না আমি আর কোহেলি খুব ভালো মত ওকে টিচ করবো
কোহেলি আদনানের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
-একদম উল্টা-পাল্টা কথা বলবিনা। ওই মেয়েকে আমি মরে গেলে ও টিচ করবো না। আর তুই ও না। তাড়াতাড়ি বাইরে আয়।
এই বলে কোহেলি ফারুককে সালাম দিয়ে বেরিয়ে যায়। আগে যদি জানত এই মেয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে ও কোনো দিন ও করতো না।

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৮

তুর্কি এক ছুট লাগিয়ে বারান্দা পেরোই। ওর মনে হচ্ছে ওই লোকটা এখনি ভূতের মত হাত বাড়িয়ে ওর গলা চেপে ধরবে। ওই লোকটা হাত না বাড়ালে-ও ওই মেয়েটা ঠিক-ই বাড়াবে। উনার ওডবি কাল ওকে বেগম সাহেবা বলেছে। আল্লহ্! কেনো তুমি আমাকে এত ঝামেলার মধ্যে ফেলো?
শেষ সিঁড়ি পেরিয়ে মোড় ঘুরতে-ই একটা ছেলের সাথে সজোরে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় তুর্কি। ছেলেটা পড়ে না গিয়ে দুই পা পিছিয়ে যায়। পাশ থেকে কয়েকটা গলার স্বর ভেসে আসে ❝ মীম ভাই, মীম ভাই! আর ইউ ওকে?❞

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ১০