হৃদয়ের সঙ্গোপনে শেষ পর্ব
তোয়া নিধী দোয়েল
কয়েক বছর পর…
আজ কক্সবাজার—সমুদ্র-সৈকতের বুকে হাজির হয়েছে এক গুচ্ছ নক্ষত্ররা। মাস্টারবাড়ির সকালে গতকাল রাতে এসে পৌঁছিয়েছে এখানে। দুপুর পর্যন্ত সবাই নির্ধারিত কামড়ায় বিশ্রাম নিয়ে — এখন বেরিয়েছে সমুদ্রকে ছোঁয়ার জন্য।
সমুদ্রের তীরে এসে দাঁড়িয়েছে সবাই। উঁহু! সবাই এক সাথে না। যে যার প্রেয়সীকে নিয়ে। শুধু কপালপোড়া মুজাহিদই— বুঁকে দুই হাত ভাঁজ করে একা দাঁড়িয়েছে নিরালায়। সমুদ্র গর্জন করছে দূরে। মাঝে-মাঝে বিশাল ঢেউ এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে তার পা। পরনে সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি-পায়জামা। বাতাসের দরুন পাজাবি কিছুটা উড়ছে। সে লম্বা এক শ্বাস নিয়ে— চোখ বন্ধ করে একবার স্মরণ করে নিজের সঙ্গোপনে থাকা মানুষটিকে। না তাঁর দুঃখ নেই সে যে একা! বরং— ববিতার জায়গায় অন্য কেউ তার পাশে থাকলে তার দুঃখ হতো। সে তাকে ভালোবাসা দিতে পারতো না। তার হৃদয় তো একজনের জন্যই ব্যাকুল। অহেতুক সেই নারীর জীবন নষ্ট হতো।
এই যে সে এখন একা— এতে পরিপূর্ণ অনুভব না করলেও স্বস্তি আছে। তাকে দেওয়া ওয়াদা রক্ষা হয়েছে। সে কথা দিয়েছিলো— আজীবন ভালোবাসবে। সে বাসছে। হ্যাঁ, হয়তো সে পাশে নি। তবে তাতে কী? ভালোবাসা তো আছে। মুজাহিদ চোখ মেলে সমুদ্রের দিকে তাকায়। তার গর্জন, ঢেউ লক্ষ্য করে। এর পর আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। ঠোঁটে আঁকা হাসি নিয়ে ও দূরে হারিয়ে যাওয়া মানুষটির উদ্দেশ্যে শুধায়—
—আমি তোমাকে আজও ভালোবাসি, ববিতা। এ সমুদ্রকে ও জানিয়ে রাখলাম। আজ তুমি থাকলে কতই না ভালো হতো বলো। তুমি যেখানেই থেকো ভালো থেকো। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে বলবো— খুব তাড়াতাড়ি যেনো আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যান। মাঝে-মাঝে ভীষণ মনে হয় তোমাকে। ভীষণ ভাবে এ মন চায় তোমাকে। কিন্তু, আমি তো পরাজিত সৈন্য। তবে, আমি তোমাকে ভালোবাসি! শুধুই ভালোবাসি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কথা টি বলার সময় এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে নামে তার চোখ বেয়ে। সে তা আলতো হাতে মুছে নেয়। হেসে বলে—
— দেখেছো, আমার চোখজোড়া ও কেমন ছন্নছাড়া হয়েছে। তোমার কথা মনে হতেই জল চলে আসে। অসহ্য লাগে মাঝে-মাঝে। আমার সব কিছু আজও তোমাকে ভীষণ ভাবে ভালোবাসে!
সে মুখ ভালোবাবে মুছে কয়েক পা সামনে এগিয়ে যায়। ভালোবাসা তো ভালোবাসাই। থাকুক না হয় সে একটু দূরে। পাই আর না পাই— সবার উর্ধ্বে তাঁকে ভালোবাসি। এটাই সত্য। আর সেই সত্য বহমান থাকুক হৃদয়ে।
একটা বড় ঢেউ এসে মুজাহিদের পায়জামার অর্ধেক পর্যন্ত ভিজিয়ে দিয়ে যায়। সে স্মিত হেসে তাকিয়ে থাকে দূরে। সূর্যাস্তের সময় কী দারুণ না দেখা যায় এই সমুদ্র!
নীল শাড়ি পড়ে সমূদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে আছে উপমা। বুকে হাত ভাঁজ করা। লম্বা চুল বাতাসের দরুন উড়ছে। ঠোঁটে গোলাপি রঙের লিপস্টিক। সূর্যের সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো আকাশে। সেই রঙ প্রতিফলিত হয়ে পড়েছে সমুদ্রের বুকে। ইসস! কতই না সুন্দর লাগছে৷
কানে কেউ কিছু গুঁজে দিতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ও। রেজুয়ান একটা কাঠগোলাপ ওর কানে গুঁজে দিয়েছে। ও মুচকি হেসে সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়ায়। রেজুয়ানের হাতে আরও দু’টা কাঠগোলাপ। ও হাঁটু ভেঙে বসে— রেজুয়ানার দুই কানে গুঁজে দেয়। কপালে চুমু দিয়ে বলে—
—আম্মা।
রেজুয়ানা ও বাবার কপালে চুমু দিয়ে কান থেকে একটা ফুল খুলে গলা জড়িয়ে বলে—
—আব্বু, এইতা তোমান কানে দ্যাও।
এই বলে ফুলটা ওর কানে দেওয়ার চেষ্টা করে। রেজুয়ান মৃদু হেসে মেয়েকে সাহায্য করে ফুলটা ওর কানে গুঁজে দিতে। তারপর মেয়েকে কোলে তুলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
উপমা সব কিছু কপালে ভাঁজ ফেলে দেখছে। মেয়ে হওয়ার পর থেকে— রেজুয়ান আর ওকে পাত্তা দেয় না। সব সময় মেয়েকে নিয়ে ঢং করে বেড়ায়। ও একটু অভিমানী কণ্ঠে বলে—
— আমাকে একটা ফুল দিলে৷ আর নিজের মেয়েকে দু’টা ফুল।
রেজুয়ান ঘাড় বাঁকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে—
— আমার মেয়ে তো এমনি তেই একটা ফুল৷ তার আবার ফুল লাগে নাকি?
— হ্যাঁ৷ আর আমি তো উড়ে এসে জুড়ে বসা মৌমাছি তাইনা?
রেজুয়ান শব্দ করে হেসে ওকে এক বাহু দিয়ে চেপে ধরে বলে—
— ধুর! তুমি তো ওই ফুলভারা গাছ। আর আমি হচ্ছি মালি। যার কাজ তোমাদের যত্ন, ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখা।
উপমা মুখ বাঁকায় দৃষ্টি সরিয়ে নেয়৷ এক সঙ্গে পা ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে সমুদ্রের দিকে। সাগরের ঢেউ এসে ছুঁয়ে দেয় ওদের পা৷ রেজুয়ান ভ্রু কুঁচকে বলে—
— তুমি এই ‘মুখ বাঁকানো’ ভাবিজানের কাছ থেকে শিখেছো তাইনা? ভাবিজান তো নতুন-নতুন সব সময় মুখ বাঁকাতো। কিছু বলেই হয়েছে। আর আমি দোয়া করতাম— যেনো চিরদিনের জন্য মুখ টা যেনো বেঁকে যায়!
উপমা, রেজুয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে—
— একদম আমার বোনের নামে নিন্দে করবে না। তোমরা ভাইয়ে রা যেমন… সেটা আর বললাম না।
রেজুয়ান আড় চোখে তাকিয়ে বলে—
— একদম আমার আর আমার ভাইয়ের নামে কিছু বলবে না। আমি আর আমার ভাই অনেক ভালো। তোমার আর তোমার বোনের কপাল ভালো যে— আমার আর আমার ভাইয়ের মত একটা বর পেয়েছো।
আরও কিছু বলার আগে রেজুয়ানা বলে—
—উফফ! তোম্মা জদরা (ঝগড়া) বন্দ কব্বে? দেতো তত মানি(পানি)!
তারপর রেজুয়ানের দুই গাল ধরে বলে—
—আব্বু, আজ আম্মা নদী থেতে মাচ ধব্বো ওতে?
উপমা কপালে ভাঁজ ফেলে বলে—
— এইটাকে সাগর বলে, আম্মু। আর এখানে মাছ ধরা যায় না।
রেজুয়ান, উপমার দিকে তাকিয়ে বলে—
— চুপ করো। আমার মেয়ে যখন বলেছে এইটা নদী— তার মানে এইটা নদী। আর আমরা এখান থেকেই মাছ ধরবো।
উপমা মুখ বাঁকিয়ে বলে—
— তোমার শ্বশুর তো এখানে মাছ ছেড়ে গেছে তাই না।
— আমার যে শ্বশুর! এত বছর পর মেনে নিয়েছে এই তো অনেক। আবার নাকি মাছ ছাড়বে! শখ কত।
— এইবার বাড়ি ফিরে একবার ওই বাড়িতে যাবো। বাবা উমা কে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছে। শুধু বলছে— ওকে একবার নিয়ে যেতে।
—তোমার ইচ্ছে তুমি যাও। আমি আমার মেয়েকে কোনো যমের বাড়ি যেতে দিবো না।
— আমার বাবাকে একদম যম বলবে না।
এই রকম খুনসুটি করতে-করতে এগিয়ে চলে ওরা। বালিময় পথ গুলোতে পায়ের ছাপ পড়ে ওদের। সমুদ্রের ঢেউ আবার ভাসিয়ে নিয়ে যায় সেই পায়ের চিহ্ন।
সমুদ্রের বালুমাখা তীরে ছাপ পড়ছে আরও একজোড়া ছোট-ছোট পায়ের। সাথে আরও এক জোড়া বড় পায়ের। আদনান— তাঁর মেয়ে আদ্রিতার হাত ধরে হাঁটছে। পুরো নাম—আদ্রিতা ফরাজি তমা। আদনানের পরনে আকাশী রঙের শার্ট। বাপের সাথে মিলিয়ে— আদ্রিতার পরনে ও আকাশী রঙের হাতা কাটা জামা। ছোট-ছোট চুল গুলো— দুই মুঠো করে ছোট-ছোট দুই ঝুটি করা। তার মধ্যে আবার ডলফিন শেপের হেয়ার ক্লিপ। গায়ের রঙ মায়ের মত ধবধবে ফরসা। তবে, ফেস পুরোই বাপের কপি। আদ্রিতা হাঁটতে-হাঁটতে বাবার উদ্দেশ্যে বলে—
— আব্বু, আম্নু তই? আম্মু এত দোয়া-দোই (দৌড়াদৌড়ি) তোরে তেনো?
আদনান মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে—
— তোমার আম্মুর মাথায় একটা তারছেঁড়া আছে তো— সেই জন্য সবসময় ছোটাছুটি করে বেড়ায়। ছেঁড়া তার কখন কোন দিকে নিয়ে যায়— তাই সেইদিকে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়ায়!
— ও আত্তা!
পেছন থেকে এক তেজি নারী কণ্ঠস্বর থেকে ভেসে আসে—
— কী বললেন? কী বলেন আমার নামে?
আদনান- আদ্রিতা, তুর্কির কণ্ঠস্বর পেয়ে নিজেদের দিকে চাওয়া-চাওই করে৷ তার পর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় পিছনে। তুর্কি আকাশী রঙের শাড়ি পড়ে কোমড়ে দুই হাত দিয়ে ঘাড় কিঞ্চিৎ বাঁকা করে— বাপ-বেটির দিকে তাকিয়ে আছে৷ আদনান চলন্ত কথা ধামাচাপা দিতে বলে—
— আরে কিছু না, ম্যাডাম। কই ছিলেন আপনি? আপনার খোঁজই করছিলাম।
আদ্রিতা ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বলে—
— না না। আব্বু বলেচে— তোমার মাতার তারচিনা (ছেঁড়া)!
আদনান দ্রুত মেয়ের মুখ চেপে ধরে। এই মেয়ের কাছে একটা সত্য কথা বলে লাভ নেই! গড়গড় করে মায়ের কাছে বলে দেয়। তুর্কি ভ্রু কুঁচকে বলে—
— কী বলেছেন ওকে? আমার মাথার তারছেঁড়া?
আদনান মেয়েকে কোলে তুলে বলে—
— আরে না। একদম না। তুমি তো আমার লক্ষ্ণী বউ। তোমার মাথার তারছেঁড়া হতে পারে নাকি।
তুর্কি আঙুল উঁচিয়ে বলে—
— একদম নাটক করবেন না। আপনারা দুই বাপ-বেটি যে সব সময় আমার নামে বদনাম করে বেড়ান— আমি খুব ভালো করে জানি। আমি কালই বাপের বাড়ি চলে যাবো। তারপর দেখবো আপনারা দু’জন কীভাবে থাকেন।
আদনান, আদ্রিতার দিকে তাকায়। আদ্রিতা বাবার কপালে চুমু দিয়ে বলে—
— আমি ছব(সব) নানা (রান্না) কত্তে পানি (পারি), আব্বু! আম্মু চনে গেনে; আম্মা দু’জন নানা তলে থাবো!
আদনান লম্বা করে হেসে মেয়ের কপালে চুমু দেয়। ছোট হাত খানা মুঠোয় নিয়ে বলে—
—ওকে আম্মাজান, ডিল।
তারপর তুর্কির দিকে তাকিয়ে বলে—
— আপনি নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারেন, ম্যাডাম। আমি আর আমার আম্মাজান একাই থাকবো।
তুর্কি চোখ ছোট-ছোট করে ফুঁসে ওঠে। দেখেছো মেয়েটা কত কথা শিখেছে! কত সুন্দর করে বাপের সাথে প্ল্যান করছে— ও চলে গেলে দু’জন কীভাবে থাকবে! তুর্কি অবাক কণ্ঠে বলে—
— ও এই সব আজব কথা ও কই থেকে শিখছে?
— যেখান থেকেই শিখুক। আমার আম্মাজান সত্য কথা বলেছে। তুমি যেখানে খুশি চলে যাও।
— হ্যাঁ। এখন তো আর আমাকে প্রয়োজন নেই। থাকুন। আপনারা বাপ-বেটি মিলেই থাকুন। চললাম আমি।
তুর্কি ওদের ফেলে আগে- আগে হেঁটে সাগরের দিকে যেতে থাকে। আদনান মেয়ের দিকে তাকায়। আদ্রিতা ছোট-ছোট দুই হাত ওর মুখের কাছে নিয়ে বলে—
— তুমা (চুমা) দেও, আব্বু।
আদনান লম্বা করে হেসে মেয়ের দুই হাতে চুম্বন এঁকে দেয়। তারপর মেয়ের কানে-কানে বলে—
— তোমার আম্মু রাগ করেছে, বলো তো কী করা যায়।
— আম্মুতে ততলেত(চকলেট) তিনে(কিনে) দেও।
—ততলেত? ততলেত দিলে আম্মুর মন ভালো হয়ে যাবে?
আদ্রিতা উপরে নিচে মাথা নাড়ায়। আদনান কিছু ভেবে বলে—
— ওকে, আম্মাজান। চলো আগে আমরা ততলেত নিয়ে আসি।
আদনান মেয়েকে কোলে নিয়ে চকলেট আনতে যায়। তুর্কি হাঁটতে-হাঁটতে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। ভেবেছে আদনান মেয়েকে নিয়ে এগিয়ে আসছে। কিন্তু, ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে সে তার মেয়েকে নিয়ে অন্য দিকে যাচ্ছে। মানে ও যে রাগ করেছে এইটা নিয়ে বাপ-বেটির কোনো মাথা ব্যথাই নেই! তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে সামনে তাকায়। কত সুন্দর মনোরম দৃশ্য! গোধুলি বিকেল যেনো সমুদ্রের বুকে ঢেউ খেলছে। ঠান্ডা পানি এসে পা ছুঁয়ে যাচ্ছে। মৃদু বাতাস বয়ে আসছে। তার দরুন ওর শাড়ির আঁচল উড়ছে।
কিছুক্ষণ পর, আদনান-আদ্রিতা চকলেট নিয়ে ফিরে আসে। দূর থেকে দেখে তুর্কি নিচু হয়ে বসে ঢেউয়ের সাথে ছন্দ মেলাচ্ছে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে৷ আদনান মেয়েকে কোলে নিয়ে এগিয়ে এসে তুর্কির পিছিনে দাঁড়ায়। মেয়েকে নামিয়ে দিয়ে পকেটে থেকে চকলেট বের করে। তারপর দুই বাপ-বেটি তুর্কির সামনে গিয়ে হাঁটু ভেঙে বসে৷ তুর্কি ওদের দেখে কিছুটা বিচলিত হয়। আগে আদ্রিতা ছোট-ছোট দুই হাতে চকলেট শক্ত করে ধরে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে আদুরে স্বরে বলে—
—চরি(সরি), আম্মু! আম্মা আর বববো না তোমানে।
আদনান ও ওর দিকে চকলেট ধরে বলে—
— সরি, বউ। প্লিজ, রাগ করোনা। আমার কি আরও বউ আছে বলো? তুমি রাগ করলে আমি কার কাছে যাবো বলো। প্লিজ, এবারের মত মাফ করে দেও।
দুই বাপ-বেটির কাণ্ড দেখে তুর্কির হাসিতে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করে। মাঝে-মাঝেই এমন ঘটে। তুর্কি যখনই গাল ফুলায়— তখনই দুই বাপ-বেটি মিলে কোনো না কোনো ভাবে ওর মান ভাঙায়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। কিন্তু, আজ কিছুতেই মান ভাঙবে না ওর। ও মুখ বাঁকিয়ে অন্য দিকে ফিরে। ছোট আদ্রিতা দ্রুত দাঁড়িয়ে— ছোট-ছোট পায়ে দৌড়ে এসে মায়ের সামনে দাঁড়ায়। ফের আদুরে স্বরে বলে—
— চরি, আম্মু চনি। আব্বু আর তোমানে বব্বে না। চনি (সরি)।
এমন আদুরে অনুরোধ ফেলা যায় নাকি? তুর্কি না চাইতেও আইসক্রিমের মত গলে পড়ে মেয়ের কথায়। মায়ের মন কিনা! ও দ্রুত হাঁটু ভেঙে বসে মেয়ের দুই গাল ধরে শতশত চুমু খায়। বুকে নিয়ে হেসে বলে—
—হয়েছে। হয়েছে। আর চরি বলতে হবে না।
— ততলেত নেও।
তুর্কি মেয়ের হাত থেকে চকলেট নেয়। আদনান এগিয়ে হেসে হাঁটু ভেঙে বসে বলে—
— সরি, ম্যাডাম। আমার টাও নিন।
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে বলে—
— সরুন।
আদ্রিতা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে—
— না…আব্বুর তাও নেও। আব্বুর তাও নেও। আব্বু ও চরি বলেচে।
তুর্কি মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে—
— নেবো?
আদ্রিতা উপরে-নিচে মাথা নাড়ায়। তুর্কি, আদনানের দিকে তাকিয়ে চকলেট টা নেয়। এর পর ফিসফিসিয়ে বলে—
— আপনার সাথে বোঝাপড়া আমার পরে হবে। আপাতত মেয়ের কথা শুনে মেনে নিলাম।
আদনান ওর দিকে একটু ঝুঁকে বলে—
— ওকে, ম্যাডাম। তবে, এইবারও আমার একটা রাজকন্যা চাই!
আদনানের কথা শুনে তুর্কি কপালে ভাঁজ ফেলে বাহুতে মৃদু চড় দিয়ে বলে—
— অসভ্য লোক। আপনি দিন-দিন এত বেশি অসভ্য হয়ে যাচ্ছেন বলার বাহিরে।
আদ্রিতা, তুর্কির কোল থেকে নেমে বাপের গলা জড়িয়ে ধরে বলে—
— না। আমাল আব্বু অনেত ভানো।
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে বিড়বিড় করে—
— ঘোড়ার ডিম ভালো।
এর পর বসা অবস্থায় বালুর মাঝে আঙুল দিয়ে একটা লাভ আঁকে তুর্কি। তারপর আদনানের উদ্দেশ্যে বলে—
— স্যার, এখানে হাতের ছাপ দিন। এক সাথে দিবো। ওকে?
এই বলে ওরা লাভটির ভিতরে এক সাথে এক হাতের ছাপ ফেলে। আদ্রিতা অস্থির কণ্ঠে বলে—
— আমান হাত তই? আমার হাত তই?
—তুমি মাঝখানে দেও।
আদ্রিতা দ্রুত ছোট-ছোট হাত জোড়া ওদের হাতের মাঝে দেয়। তুর্কি, আদনানের উদ্দেশ্যে বলে—
— স্যার, পিক তুলুন।
আদনান পকেট থেকে ফোন বের করে নিজেদের হাতের পিক তুলে। এছাড়াও আরও কিছু পিক তোলে তিনজনের৷ তিনজন সমুদ্র বিলাস শুরু করে। ক্ষণে-ক্ষণে ভেসে আসে তুর্কির হাসির শব্দ। আদ্রিতার হাসির শব্দ। তুর্কি, আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে—
— স্যার!
আদনান ওর দিকে তাকায়। তুর্কি এক হাত জড়িয়ে ধরে বলে—
— ভালোবাসি! আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।
আদনান মৃদু হেসে ওর কানে চুল গুঁজে দিয়ে ওর কপালে মৃদু চুম্বন এঁকে দিয়ে বলে—
— আপনাকে ও ভীষণ ভালোবাসি, বেগম সাহেবা!
আদ্রিতা দ্রুত দৌড়ে এসে বলে—
— আব্বু, আমান তপালে তুম্মা দেও।
আদনান হেসে মেয়েকে কোলে তুলে কপালে, হাতে চুমা দেয়। তারপর তুর্কিকে এক হাত দিয়ে বাহুবন্ধ করে সমুদ্রের দিকে তাকায়। স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলে—
— এই ভাবেই যেনো হাজার বছর কেটে যায় আমাদের।
তুর্কি আলতো ভাবে আদনানের বক্ষস্থলে মাথা ঠেকায়। চোখ বন্ধ করে বলে—
— ইন-শা-আল্লাহ্।
বেশ কিছুক্ষণ পর কিছুটা দূর থেকে ভেসে আসে রেজুয়ানের কণ্ঠ—
— ভাই, প্রেম শেষ হলে এই দিকে আয়। সবাই ছবি তুলবো।
আদ্রিতা, রেজুয়ানের কণ্ঠস্বর শুনে দ্রুত আদনানের কোল থেকে নেমে উচ্চস্বরে বলে—
— তাত্তু, আপু তই?
রেজুয়ান বলে—
— এইযে এখানে, আম্মাজান। এইদিকে আসো।
রেজুয়ানা উপমার কোলে ছিলো। আদ্রিতার কণ্ঠ শুনে দ্রুত উপমার কোল থেকে নামার চেষ্টা করে বলে—
— আপু, আপু। আমানে তোল তেতে নামাও।
উপমা দ্রুত মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। সে হাত বাড়িয়ে আদ্রিতার দিকে ছুটে আসতে থাকে। আদ্রিতা ও ছুটে বোনের দিকে যায়। উপমা বলে—
— আসতে। পড়ে যাবে।
দুই বোন ছোট-ছোট পায়ে দৌড়ে এসে দু’জন- দু’জনকে জড়িয়ে ধরে। কোলাকুলি করতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে যায়। তুর্কি দ্রুত বসা থেকে ওঠে ওদের দিকে আসতে থাকে। উপমা ও ছুটে আসতে থাকে। তবে দু’ই বোন পড়ে গিয়ে ও সবে ওঠা দু’-তিনটা দাঁত বের করে হেসে ওঠে। ওরা দু’জন এগিয়ে এসে মেয়েদের ওঠায়। ওঠে দাঁড়িয়ে ফের দু’জন হাত ধরে হাঁটতে থাকে।
সবাই সমুদ্রের তীরে এসে দাঁড়ায় ছবি তোলার জন্য। সবাই পিছনে সমুদ্র আর সূর্য ফেলে দাঁড়ায়। আলামিন- হুমাইরা পাশা পাশি দাঁড়ায়। ওদের পাশে মুমিনুল আর রচনা। তার পাশে রেজুয়ান-উপমা। আর সবার শেষে আদনান-তুর্কি। মুজাহিদ এসে দাঁড়াতে গেলে— আদনান-রেজুয়ান বাঁধা দেয়। বলে—
— এখানে সিংগেল মানুষের কোনো জায়গা নেই। চুপচাপ সবার সামনে দাঁড়াও।
মুজাহিদ কপালে ভাঁজ ফেলে বলে—
— কে সিংগেল? আমি তোদের থেকে বেশি মিংগেল। কই রে আমার দুই নায়িকা কই?
দাদার এক ডাকে— ছুটে আসে আদ্রিতা, রেজুয়ানা। মুজাহিদ ওদের এক সাথে দুই কোলে তুলে সবার সামনে দাঁড়ায়। ওদের উদ্দেশ্যে বলে—
— আমার দুই বউ থাকতে আমাকে বলে সিংগেল। কত বড় সাহস! কই তোলো ছবি।
মুজাহিদের কথায় সবাই হেসে ওঠে। সবাই সুখকর একটা হাসি দিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকায়। সুন্দর একটা ছবি ক্লিক করা হয়— সব চেয়ে সুন্দরতম একটা পরিবারের।
এতকিছুর মাঝে ও তুর্কি আদনানের কানে ফিসফিসিয়ে বলে—
— আই লাভ ইউ, স্যার।
আদনান কোনো উত্তর দেয় না। তুর্কি ভ্রু কুঁচকে বলে—
—কী হলো? উত্তর দিন।
— প্রেজেন্ট ইন্ডিফিনিট টেন্স!
তুর্কি দাঁতে-দাঁত চেপে বলে—
— অসভ্য লোক! ঢং বাদ দিয়ে উত্তর দিন। ভুলে যাবেন না— আমি এখন সেই গণ্ডমূর্খ তুর্কি নই। প্রায় অর্ধেক— ডক্টর কামরুন্নেসা তুর্কি ফরাজি!
আদনান চাপা স্বরে বলে—
— আগে হও, ম্যাডাম।
— হ্যাঁ। খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবো। মিঃ বেশি শিক্ষিতঅসভ্য স্যার।
এই বলে তুর্কি চোখ ফিরিয়ে নেয়। আদনান ওর ভাব দেখে মৃদু হাসে। তুর্কি মনে-মনে বিড়বিড় করে— ‘এই লোক এই জীবনে শুধরাবে না।’
মুজাহিদের রুমে আড্ডা দিচ্ছে— আদনান, মুজাহিদ আর রেজুয়ান। হাসাহাসি করে ভরিয়ে ফেলছে রুম। ওদের আড্ডার মুল থিম হিসেবে রয়েছে— মুজাহিদের সিংগেল জীবন নিয়ে। এ জীবনে যে বেচারা এইভাবেই কাটাবে সেটা নিয়েই গবেষণা করছে— আদনান-রেজুয়ান। আদনান উচ্চসরে গান গেয়ে ওঠে—
‘ দাদা আমার তো বিয়ে হলো না
দাদা আমার তো বিয়ে হলো না।’
রেজুয়ান বলে—
‘ ও তোগো পায়ে পড়ি রে
মেলায় থেকে একটা চাচি এনে দে।’
ওদের গানে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে মুজাহিদ। দাঁতে-দাঁত চেপে বলে—
— এই তোরা থামবি জংলীর দল। এক জায়াগায় আসছস৷ তবুও এমন শুরু করছস।
আদনান গান থামিয়ে বলে—
— এখানে সবাইকে জানাতে চাই, আমার পালিত বাপ এখনো সিংগেল। আমাদের পালিত মা কে কই লুকিয়ে রাখছে কে জানে। আমাদের…
আর কিছু বলার আগেই— মুজাহিদ দ্রুত ওর মুখ চেপে ধরে। চোখ বড়-বড় করে বলে—
— তোরা দেখি আমার মান-সম্মান খেয়ে ফেলবি।
আদনানের মুখ চেপে ধরলে ও— ও দিকে আবার রেজুয়ান শুরু করে।
— ছিঃ ছিঃ! এ কী লজ্জা! আমাগো…
মুজাহিদ অন্য হাত দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরে। এই জীবনে তার এই সব শুনতে-শুনতেই কেটে যাবে। ওদের হুড়োহুড়ির মাঝে দরজা ঠেলে দুই হাত ধরে আসে— রেজুয়ানা-আদ্রিতা। ছোট-ছোট পায়ে হেঁটে এসে আদুরে কণ্ঠে বলে—
— দাদুভাই-দাদুভাই, আম্মা ধুত্তে(ঘুরতে) যাবো। চনো। আর অনেক মজা থাবো।
মুজাহিদ ওদের বালিশ দিয়ে বাড়ি মেরে বলে—
— দেখ, আমার দুই নায়িকা চলে এসেছে। নিজে থেকে ডাকছে। তোদের তো এক বউ। আর আমার দুইটা। তোদের থেকে আমি বেশি বড়লোক। থাক এক বউওলা গরিবেরা।
মুজাহিদ ওদের ছেড়ে রেজুয়ানা-আদ্রিতার দিকে এগিয়ে আসে। দু’জন কে কোলে তুলে নিয়ে বলে—
— অবশ্যই, সাহেবারা। চলুন। কই যাবে।
— বাইনে।
মুজাহিদ দুই নাতনি নিয়ে বেরিয়ে যায়৷ আদনান-রেজুয়ান নিজেদের দিকে চাওয়া-চাওই করে কপাল চাপড়ে।
তুর্কি আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। আদনান-আদ্রিতা বিছানায় বসে নিজেদের মধ্যে গবেষণা শুরু করেছে। তুর্কি ভেবে পায় না— এই দুই বাপ-বেটি সারাক্ষণ কী নিয়ে এত আলোচনা করে। শুধু এখন না— আদ্রিতা যখন এক দম ছোট ছিলো— তখন ও আদনান ওর সাথে কী নিয়ে যেনো গবেষণা করতো। রোজ কলেজ থেকে এসে— মেয়ের সাথে আলোচনায় বসতো। আর ছোট আদ্রিতা ছোট-ছোট হাত পা নাড়িয়ে; মুখে অদ্ভুত শব্দ তুলে তার মতামত জানাতো। আর আদানান সেই মতামত গ্রহণ করে পরের আলোচনা শুরু করতো।
তুর্কি চুল আঁচড়ানো শেষ করে রোজকার মত আদনানের সামনে এসে বসে বেণী করার জন্য। আদনানের উদ্দেশ্যে বলে—
— নিন। বেণী করুন।
আদ্রিতা, আদনানের কোল থেকে নেমে সেও বাপের সামনে বসে। ছোট পা জোড়া মেলে আদনানের উদ্দেশ্যে বলে—
— আমানে আগে কনে দেও।
তুর্কি মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে—
— চুল নেই কিছু নেই ও নাকি বেণী করবে।
আদনান, তুর্কিকে ছেড়ে আগে মেয়ের চুলে বেণী করার জন্য উদ্যত হয়। ছোট-ছোট চুল গুলো হাতে নিয়ে বলে—
— অবশ্যই, আমার আম্মাজানের চুল তোমার চুলের থেকে বেশি বড় হবে।
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে বলে—
— ঢং। তাড়াতাড়ি করুন।
আদ্রিতা বলে—
—ছুন্দর তরে তরবে, আব্বু।
— ঠিক আছে, আম্মাজান।
তুর্কি ভ্রু কুঁচকে বলে—
— আপনি যে মেয়ে নিয়ে এত আদিখ্যেতা করতে পারেন। আল্লাহরে!
আদনান কোনো মতে ছোট-ছোট চুল গুলো প্যাঁচিয়ে বলে—
— হেয়ার ক্লিপ নিয়ে আসো যাও।
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে উঠে— আদ্রিতার হেয়ার ছোট-ছোট হেয়ার ক্লিপ নিয়ে আসে। কোনো টা সূর্যমুখী ফুল, কোনোটা রঙিন প্রজাপতি, কোনোটা চেরি ফল, আঙুর, কোনোটা আবার বিড়াল, খরগোশের কোনোটা আবার ডলফিন শেপের।
আদনান, আদ্রিতার সামনে ক্লিপ গুলো ধরে বলে—
— কোনটা লাগাবো, আম্মাজান?
আদ্রিতা ক্লিপ গুলো একবার নেড়েচেড়ে বলে—
— এই ম্যাউ (বিড়াল) টা নাগাও। আর ফুন টা।
আদনান সুন্দর করে মেয়ের চুলে লাগিয়ে দেয়। মাথায় চুমু দিয়ে বলে—
— মাশাল্লাহ! আমার আম্মজানকে তো অসাধারণ লাগছে।
আদ্রিতা বাপের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে—
— চত্যি?
আদনান উপরে-নিচে মাথা নাড়ায়। আদ্রিতা বিছানা থেকে ধীরে-ধীরে নেমে আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। তুর্কি মেয়ের ঢং দেখে বলে—
— স্যার, ও এত ঢং কই থেকে শিখলো?
আদনান, তুর্কির চুলে বেণী করতে-করতে বলে—
— তার মায়ের কাছ থেকে।
তুর্কি কপালে ভাঁজ ফেলে বলে—
— আমার কাছ থেকে?
— হ্যাঁ। যে দিনে শতবার নিজেকে আয়নায় দেখে। তো মেয়ে ও শিখেছে।
আদনান বেণী করা শেষ করে। তুর্কি, আদনানেদ দিকে তাকিয়ে বলে—
—সরুন। মেয়েকে ঘুম পাড়াতে হবে। সারাদিন টইটই করে বেড়িয়েছে। সরুন সরুন।
তুর্কি আদনানকে তাড়া দেয়। আদনান উঠতে- উঠতে
বলে—
— ওকে মাঝে দিও না। আমার কিছু কাজ আছে। শেষ হয়ে গেলে পরে দিও।
তুর্কি চোখ রাঙিয়ে বলে—
— সরুন, অসভ্য লোক। আপনি দিন-দিন এত বেশি অসভ্য হয়ে যাচ্ছেন বলার বাহিরে৷ মেয়েকে নিয়ে আসুন।
আদনান কয়েক পা হেঁটে মেয়েকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে এসে তুর্কির কোলে দেয়। তুর্কি মেয়েকে আদনানের কোল থেকে নিয়ে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত করে। আদ্রিতা বলে—
— আগে আব্বু কে ধুম পানাবো। সনো। সনো(সরো)
আদ্রিতা শোয়া থেকে ওঠে আদনানের কাছে যায়। তুর্কি চোখ রাঙিয়ে বলে—
— পিটুনি খাওয়ার আগে বালিশে শোও।
— না না। আগে আব্বু ধুম্পু আছবে।
সে আদনানকে শুতে আদেশ দিয়ে বলে—
— চোক বন্দ কনো। চোক বন্দ কনো।
তুর্কি কিঞ্চিৎ রাগান্বিত স্বরে বলে—
— যেমন বাপ তার তেমন মেয়ে। নিজে ঘুম আসা বাদ দিয়ে বাপ কে যায় ঘুম পাড়াতে।
আদনান মেয়ের তালে-তাল দিয়ে চোখ বন্ধ করে। আদ্রিতা কিছুক্ষণ তুর্কি ওকে যেভাবে বুকে পিঠে হাত থাপড়িয়ে ঘুম পাড়ায়— ও-ও সেইভাবে আদনানকে ঘুম পাড়ায়। আদনান ঘুমের ভাব ধরলে— তুর্কি মেয়েকে নিয়ে টেনে নিয়ে বলে
— হয়েছে অনেক হয়েছে। এবার নিজে ঘুম আসুন। অসহ্য লাগে এদের কাহিনি আমার।
তুর্কি বেশ অনেক্ষণ যুদ্ধ করে মেয়েকে ঘুম পারাতে সক্ষম হয়। এই মেয়ে এত পাজি হয়েছে বলার বাইরে। এত বাপ নেওটা হয়েছে!
আদ্রিতা ঘুম আসতেই— আদনান পাশ ফিরে তুর্কিকে জড়িয়ে ধরে। তুর্কি, আদনানের হাত ধরে বলে—
— কী করেছেন। মেয়ে ওঠে যাবে।
আদনান ওর গলায় মুখ গুঁজে মহোময় কণ্ঠে বলে—
— একটু আদর করি?
— পরে। এখন বারান্দায় চলুন।
— এখন?
— হুম। চলুন না। মেয়ে ওঠে যাবে।
তুর্কি ধীরে-ধীরে ওঠে আদনান কে টেনে বাইরে নিয়ে যায়।
বিশাল খোলা বারান্দা। দূর থেকে সাগরের গর্জন ভেসে আসছে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। আকাশে শত-শত নক্ষত্ররাজি। অর্ধবৃত্ত চন্দ্র ঝুঁলছে তাদের মাঝে। সেই মৃদু আলো ছুঁয়ে দিচ্ছি দু’টি প্রেমময় মানবকে। তুর্কির পরনে আদনানের পছন্দের লাল শাড়ি। বাতাসের দরুন শাড়ির আঁচল উড়ছে। কানে ছোট দুল। চুল গুলো মুক্ত বাতাসে উড়ছে। গলায় লাভ পার্ল নেকলেস। এর পরে ও আদনান ওকে অনেক নেকলেস দিয়েছে। কিন্তু, এইটা ওর কাছে বেশি স্পেশাল।
আদনান একটা গোলাপের তোড়া এনে তুর্কির সামনে ধরে। তাতে অনেক গুলো গোলাপ। বড়-বড় সাইজের লাল টকটকে গোলাপ। সেখান থেকে একটা গোলাপ তুলে আদনান— তুর্কির কানে গুঁজে দেয়। তুর্কি বাকি গোলাপ গুলো নিয়ে মৃদু হাসে। আদনান ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে। তুর্কি গোলাপ গুলো হাপ ওয়ালের ওপর রেখে, আদনানের হাতের উপর হাত রেখে শান্ত কণ্ঠে বলে—
— গোলাপ কই পেলেন?
—আগেই এনে ছিলাম।
— আপনার ভীষণ পছন্দের ফুল।
—তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে, বেগম সাহেবা।
— লাল যে কেনো আপনার এত পছন্দ আল্লাহ জানে!
— তোমাকে এতে অতিরিক্ত সুন্দর লাগে তাই!
আজ আদনানের পরনে তুর্কির পছন্দের ব্ল্যাক ফর্মাল শার্ট। দু’জন আজ দু’জনের পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরিধান করেছে। নিজেদের মনের মত করে সেজেছে। তুর্কি মৃদু হেসে আবার বলে—
—স্যার, দূর থেকে সমুদ্র কী সুন্দর লাগছে তাইনা?
আদনান মৃদু কণ্ঠে বলে—
— হুম। আদ্রিতা তো ঘুমিয়েছে। যাবে?
— না না। যদি ওঠে যায়? তখন দেখতে না পেলে কান্না করবে। এখান থেকেই আমরা সমুদ্র বিলাস করি।
— তাহলে চলো ওই কর্ণারে গিয়ে বসি।
কয়েক পা হেঁটে ওরা বারান্দার কর্ণারে গিয়ে বসে। তুর্কি গোলাপের তোড়াটি পাশে রাখে। সেখান থেকে মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছে। আদনান, পিছন থেকে তুর্কিকে জড়িয়ে ধরে বসে। তুর্কি, আদনানের বুকে মাথা ঠেকায়। চোখ বন্ধ করে বলে—
— জানেন স্যার, মাঝে-মাঝে মনে হয়— সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করে আমি শেষ করতে পারবো না। সে (আল্লাহ্) আমাকে এত কিছু দিয়েছে— যে আমি বুঝতেই পারি না কীভাবে তার শুকরিয়া করলে উত্তম হবে।
আদনান ওর মাথায় থুতনি ঠেকিয়ে মৃর্দু দুলছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে—
— তুমি, পরিষ্কার-পবিত্র মনে যেভাবেই তাঁকে (আল্লাহ্) স্মরণ করবে, শুকরিয়া আদায় করবে— সে (আল্লাহ্) সেইভাবেই তা কবুল করবে। শুধু একটা পবিত্র মন থাকা অবশ্যক।
— হুম। তা তো অবশ্যই। তবে আপনার মত একজন জীবন-সঙ্গী পেয়ে আমি ধন্য। পরিশেষে সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার একটাই প্রার্থনা— যতদিন আমার শ্বাস চলবে ততদিন যেনো আমি আপনার সাথে এইভাবেই কাটিয়ে দিতে পারি। এইভাবে হাতে-হাত রেখে আরও দূর এগিয়ে যেতে পারি। এ ছাড়া আর কিছুই চাইনা।
আদনান চোখ বন্ধ করে বলে—
— ইন-শা-আল্লাহ।
— স্যার, দেখুন ওই তারাটা কী পরিমাণ জ্বলজ্বল করছে।
তুর্কি আকাশের দিকে তাকায় আঙুল উঁচিয়ে বলে। আদনান ওর ইশারার দিকে তাকায়। মৃদু কণ্ঠে বলে—
—হুম।
কিছুক্ষণ মৌন থেকে আদনান, তুর্কিকে নিজের দিকে ঘোরায়। দুই গালে হাত দিয়ে কপালে চুম্বন করে। তুর্কি মৃদু হেসে আদনানকে জড়িয়ে ধরে৷ আদনান ও শক্ত করে ওকে বক্ষস্থলে আবদ্ধ করে। তুর্কি চোখ বন্ধ করে বলে—
— আমার শান্তিময় আশ্রয়। সারাজীবন কেটে যাক এখানে।
ওর কথায় আদনান মৃদু হাসে। এরপর তুর্কি আবার বলে—
— ভালোবাসি, স্যার। আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।
— তোমাকেও ভালোবাসি। তোমাকে ও ভীষণ ভালোবাসি, ম্যাডাম।
তুর্কি বুক থেকে মাথা তুলে বলে—
— উঁহু! আদ্রিতার আব্বু, আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি…!
আদনান মৃদু হেসে বলে—
— আপনাকে ও ভীষণ ভালোবাসি, আদ্রিতার আম্মু। সারাজীবন আমার হৃদয়ের সঙ্গোপনে এইভাবেই বেঁধে রাখবো। যেনো কোথাও যেতে না পারেন।
তুর্কি ডানে-বামে মাথা নেড়ে বলে—
হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৪৭+৪৮
— বাঁধতে হবে না, স্যার। আমি শুরু থেকেই আপনাতে আবদ্ধ! আফটার ওল, আমার মাথার চারিপাশে শুধু আপনার নাম টাই ঘোরে, প্রিয় অসভ্য স্যার!
আদনান মুচকি হেসে তুর্কির দিকে তাকায়। তুর্কি শব্দ করে হেসে স্বামী কে গভীর ভাবে আলিঙ্গন করে। বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে। এইটা ওর কাছে পৃথিবীর সব থেকে শান্তিময় ও নিরাপদ আশ্রয়। যা ওর সব ক্লান্তি মুছে দেয়। অসীম নির্মল, পবিত্র ভালোবাসায় বাঁধা পড়ে দু’জন।