হৃদস্পন্দনের টানে পর্ব ৩

হৃদস্পন্দনের টানে পর্ব ৩
written Nurzahan akter Allo

কেউ জানে না পরী আর উৎস কোথায় আছে? আর ওরা দুজন গেলোই বা কোথায়??? নুর তো পাগলপ্রায় অবস্থা কারন ওর দুইজনেই ছিলো নুরের প্রাণ। নুর খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে একটা সময় ঘর বন্দী করে ফেলে নিজেকে।সারাদিন কান্না করতো, চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে উৎস আর নুরকে ডাকতো। নুরের বাবা মাও নুরকে বোঝাতো বাট নুর কোন কথা শুনতো না।পরীর বয়স পাঁচ… ওর কথা গুলো বলতো পাকা বুড়ির মত.. আর পরীর কথা মনে করতো আর চিৎকার করে কাঁদতো। নুর তো নিজেকে সামলানো ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছিলো দিন দিন…

প্রায় ১ মাস ১৮ দিন পর….
একদিন সকালে নুর নামাজ পড়ে বাগানে যাবে বলে ওদের দরজা খুলতেই দেখে দুইটা লাশ সাদা কাপড়ে প্যাচানো!নুর চিৎকার করে ওর মা আর বাবাকে ডাকে! নুরের চিৎকার শুনে উনারা দৌড় আসে আর দেখে দুইটা লাশের সামনে নুর পাথরের মত বসে আছে।উনারা কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে এসে দেখে দুইটা লাশের মুখ খুব খারাপ ভাবে থেতলে দেওয়া! উনারা আর একটু সামনে গিয়ে দেখে একটা পরীর লাশ আর একটা উৎসের।দুজনেই মুখ কোন ভারী কোন পাথর দিয়ে থেতলে দেওয়া। এটা দেখার পরে নুর চিৎকার করে কান্না করে সেন্স হারিয়ে পাঁচদিন পর সেন্স ফিরে! বাট আগের কোন কথায় মনে রাখতে পারে নি।নুরের মেমোরি লস হয়েছে….

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মেমোরি লস হওয়ার পর থেকে নুরের অত্যাচার বাড়তে থাকলো।আর এভাবেই আস্তে আস্তে নুর একজন মানসিক রুগীতে পরিণত হয়।সেদিন পরীর আর উৎসের ভয়ংকর মুখের আকৃতি আর এক কাছের মানুষ হারানোর শোক নুর সহ্য করতে পারে নি।

জুবিন ফাইলটা পড়ে ওর মাথায় বেশ কিছু কথা ঘুরপাক খাচ্ছে! কেন জানি মনে হচ্ছে এখানে আরো অনেক কিছু অজানা থেকে গেছে। জুবিনের মনে হচ্ছে এর পেছনে আরো অনেক কাহিনী আছে!তবে নুরের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা জুবিনের মনকে নাড়া দিয়ে গেছে!…..

জুবিন দুপুরে লাঞ্চ সেরে বাকি রুগীদের দেখে ওর বাসায় চলে যায়।আজকে ওর মনটা ভালো নেই! জুবিন ওর রুমের বারান্দা গিয়ে ইজি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে ভাবছে…
জুবিনঃ বাস্তবতা এত নিষ্ঠুর কেন? কেন এত কঠিন কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় আমাদের।নুর হয়তো উৎসকে অনেক ভালবাসতো! এজন্য ওর এভাবে মৃত্যুটা সহ্য করতে পারে নি।আর কোন বোনই তার ছোট বোনের এমন লাশ চোখের সামনে দেখতে পারবে না। তারমানে নুরের ব্রেনে প্রচুর চাপ পড়ছে আর একটা সময় ব্রেণ কাজ করা বন্ধ করে দিসে তখনই নুর সেন্স হারিয়েছে।
আর বড় কথা নুরের সাথে কার এমন শএুতা ছিলো যে পরী আর উৎসকে এত কষ্ট দিয়ে মেরে ফেললো।তার মানে নুরের কলিজা পরী আর উৎস কেউ এখন বেঁচে নেই!হুমম তারমানে এখন উৎস নামটা ব্যবহার করেই নুরের চিকিৎসার প্রথম ধাপ শুরু করতে হবে।

এসব ভাবতে ভাবতে জুবিন একটা সময় চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়ে।সন্ধ্যার দিকে ডাঃশ্রাবনের ফোনে জুবিনে ফোন কল আসে!ডাঃ শ্রাবণ জুবিন কে ইমিডিয়েট হসপিটালে আসতে বলে কারন হসপিটাল কমিটি একটা বোর্ড বসাবে। জুবিন দ্রুত ফ্রেশ হয়ে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে বেরিয়ে পড়ে!জুবিন হসপিটালে পৌঁছে মিটিং রুমে যায়! অনেক অনেক ডাক্তার এখানে উপস্থিত জুবিন একটা চেয়ারে বসে পড়ে। জুবিনের এখনো জানা নেয় আজকে মিটিং টা হচ্ছে আসলে কি বিষয় নিয়ে??

তারপর হসপিটাল কমিটির একজন বড় ডাক্তারের কথা জুবিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো উনার দিকে।কারন এখনকার একজন মানসিক ভারসামহীন রুগী নাকি প্রেগনেন্ট তাও আবার পাঁচ মাসের।জুবিন এমনিতেই নুরের বিষয়টা নিয়ে ওকে খুব ভাবাচ্ছে তার মধ্যে এই ঘটনা।জুবিন চুপ করে সবার কথা শুনছে আর ভাবছে এমন কাজ কে করতে পারে?? সবাই এক এক করে তাদের মন্তব্য পেশ করছে! এবার জুবিনের পালা জুবিন কিছু একটা ভেবে তারপর বললো…

জুবিনঃ জানিনা কাজটা কে করছে? তবে কোন নিকৃষ্ট জানোয়ার ছাড়া এমন কাজ কোন মানুষ করতে পারে না। যদি রুগীকে দেখে কোন ডাক্তার নিজেকে নিজেকে কনট্রোল করতে না পারে তো সেই ডাক্তার না সে মানুষ রুপী জানোয়ার।আর ডাঃ যদি করে না থাকে তাহলে ওয়াড বয়,দারোয়ান,কোন স্টাফ কেউ তো একজন করছে। আর আমি বলবো এখন এবোশন করালে রুগীর আরো সমস্যা হবে।
নিশিঃ কিন্তু রুগী এই বাচ্চার জন্ম দিবে কিভাবে? ও তো নিজেই একজন মানসিক রুগী..
শ্রাবণঃ ডাঃ জুবিন ঠিক বলছে এখন এবোশন করানো উচিত হবে না।কারন পাঁচ মাসে বাচ্চা এবোশন করানোটা খুব রিস্ক হয়ে যাবে…
জুবিনঃ হুমম ওই রুগীর জন্য আরো কেয়ার করার ব্যবসথাকরা হোক।আর এখানকার সব নার্স থেকে শুরু করে ওয়াড,বয়, দারোয়ান সবাইকে জিজ্ঞাসা বাদ করা হোক। আর দুই জন ডিটেকটিভ রাখুন সবার আড়ালে যাতে এমন কাজ কে করছে সেটা জানা যায়।….

অনেক আলোচনা মাঝেই সবার মিটিং শেষ হলো! এটা যদি মিডিয়া জানে তো হসপিটালে নামে খুব খারাপ বদনাম ছড়িয়ে যাবে তাই সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।জুবিন মিটিং রুম থেকে বের হয়ে কেবিনে আসছিলো হঠাৎ “বন্ধু” ডাক শুনে থেমে যায়।তারপর পেছনে তাকিয়ে দেখে নুর জানালা ধরে ঝুলছে!জুবিন কিছু না বলে মুচকি হেসে ওর কেবিনের যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো! নুরও দৌড়ে এসে জুবিনের কেবিনে ভেতর ঢুকে গেল…

জুবিনঃ তোমার সাথে আমার কথা নাই!আমি রাগ করছি তোমার উপর..
নুরঃ কেন আমি কি করছি? (মাথা চুলকে)
জুবিনঃ তুমি আমার চেয়ারে আঠা লাগিয়ে দিয়েছো! জানো কত কষ্ট করে আমি উঠছি চেয়ার থেকে…
নুরঃ ওহহ্! আচ্ছা আর আঠা দিবো না।সরি (কান ধরে)
জুবিনঃ আচ্ছা থাক আর কান ধরতে হবে না।এখন বলো এখানে কি করছো তুমি??এই নাও এটা খাও…
নুরঃ না আমি মেডিসিন খাবো না।তিতা খেতে…
জুবিনঃ আরে বোকা এটা মেডিসিন না এটা অনেক
মিষ্টি খেতে! এটা সিভিট চকলেটের মত..এই দেখো আমিও খাচ্ছি (একটা মুখে পুরে)
নুরঃ তাহলে আমিও খাবো।

জুবিন একটা সিভিট নুরের মুখে দিলো। নুর চোখ মুখ কুচকে ফেললো তারপর যখন দেখলো মিষ্টি খেতে তখন জুবিনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিলো।জুবিন নুরের সাথে কথা বলতে বলতে উৎস আর পরীর কথা জিজ্ঞাসা করলো। বাট নুর মাথা চুলকে মনে করার চেষ্টা করছে! জুবিন যখন দেখছে নুর ভ্রু কুচকে সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে! তখনই অন্য কথা বলে নুর মনযোগ সরিয়ে ফেলছে। একবারে বেশি প্রেশার দেওয়া যাবে না….নুর ওর মুখের সিভিট টা কড়মড় করে চিবিয়ে খেয়ে জুবিনের দিকে আবার হাত বাড়িয়ে আরেকটা সিভিট চাইলো।

নুরঃ আরেকটা সিভিট চকলেট দে (হাত বাড়িয়ে)
জুবিনঃ আর নাই!আবার কালকে আনবো কেমন..
নুরঃ আচ্ছা আমি প্রতিদিন আসবো আর তুই আমাকে সিভিট চকলেট দিবি আচ্ছা।
জুবিনঃ হুমমম!দিবো এখন তুমি তোমার রুমে গিয়ে চুপটি করে বসে থাকো।আমি এখন একটু কাজ করবো..
নুরঃ বন্ধু আমাকে একটা জিনিস কিনে দিবি!আমি তোর সব কথা শুনবো।
জুবিনঃ হুমমম বলো! আমি এনে দিবো…
নুরঃ আমাকে রান্না বাটি আর পুতুল কিনে দিবি (মাথা নিচু করে)

নুর কথাটা বলেই এক দৌড় দেয়!জুবিন নুরের কান্ড দেখে মুচকি হাসে আর ওর কাজে মনোযোগ দেয়।তারপর জুবিন চেক করে নুরের এখন কি কি মেডিসিন চলছে, তারপর নুরের সব মেডিসিন বদলে দেয়। তারপর নুরের আগের কথা সব টেস্টের রিপোর্ট দেখে….

রাত ১০ টার দিকে নুর জুবিন ছাড়া কারো হাতে খাবারও খাবে না মেডিসিনও খাবে না বলে চিৎকার চেচাঁমেচি শুরু করছে।জুবিন তখন ডাঃ শ্রাবনের সাথে কথা বলছিলো।একটা নার্স জুবিনকে ডেকে নিয়ে যায় তারপর জুবিন নুরকে খাইয়ে দিয়ে মেডিসিন খাইয়ে ঘুমাতে বলে উঠতে যাবে!তখন নুর জুবিনের হাত ধরে আবার বসিয়ে দেয় আর বলে মাথা হাত বুলিয়ে দিতে।জুবিন হাত বুলিয়ে দেয় একটা সময় নুর ঘুমিয়ে পড়ে।জুবিন নুরের গায়ে চাদর টেনে দিয়ে বলে…

জুবিনঃ আল্লাহ কার ভাগ্যতে কি লিখে রাখে বোঝা বড় দায়! তোমার নামের সাথে তোমার অনেক মিল।আজকে সুস্থ থাকলে হয়তো উৎসের সাথে অনেক সুখে থাকতে! বাট ভাগ্য আজকে তোমাকে এখানে এনেছে….আমাদের জীবনটা বড়ই অদ্ভুত। তবে তোমাকে সুস্থ করার জন্য আমার যা করার দরকার আমি তাই করবো!এটা আমার নিজের কাছে নিজের ওয়াদা… (মনে মনে)

রাত ১ টা….
ডাঃ শ্রাবণ আর জুবিন একটা রুমে আছে! জুবিন আর শ্রাবণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে কারন ওই মেয়েটাকে গর্ভবতী করছে………. । আর এই প্রমানটা জুবিনরা কালেক্ট করছে সিসি টিভির ফুটেজ দেখে!হসপিটালে এক দেড় বছর কোন ফুটেজই ডিলিট করা হয় না।আর জুবিন প্রমান হিসেবে সেই ফুটেজটা নিলো আর সিসি টিভি থেকে ফুটেজ টা ডিলিট করে দিলো…

সেই রাতেই জুবিন হসপিটাল কমিটিকে প্রমান সহ দেখাবে বলে ঠিক করে। কারন রক্ষক যদি ভক্ষক হয় তো এখানে কেউ নিরাপদ থাকবে না।জুবিন আর শ্রাবনের মাঝে একটা ভাল সম্পর্ক হয়ে গেছে।শ্রাবণ জুবিনকে খুব পছন্দ করছে কারন জুবিন একজন মানুষ হিসেবে যথেষ্ট ভাল।

সেদিন রাতে জুবিন ওর কেবিনেই ঘুমিয়ে পড়ে! তারপর সকালে নুরকে খাবার খাইয়ে মেডিসিন দিয়ে একটু বাইরে যায়।নুর সারাদিন এর ওর পেছনে লাগে,দুষ্টুমি করে, চিৎকার করে কান্না করে তারপর আবার দম ফাটানো হাসি শুরু করে।জুবিন নুরকে ছোটদের রান্না বাটির সেট আর একটা খুব সুন্দর পুতুল কিনে দেয়।নুর তো পুতুল দেখে খুব খুশি…নুর হাজিবাজি রান্না করে আর জুবিনকে সেটা মিছি মিছি খেয়ে খুব সুনাম করতে হয়!আর জুবিনের সুনাম শুনে নুরের তো খুশির শেষ নেই…..

আর সেইদিনই জুবিন প্রমানটা দেখানোর আগেই জুবিনের ফোন চুরি হয়ে যায়।এজন্য প্রমানটা দেখাতে পারে নি!জুবিন বুঝে গেছে এই হসপিটালে এমন কেউ আছে যে সব সময় ওকে ফলো করে…

হৃদস্পন্দনের টানে পর্ব ২

দেখতে দেখতে কেটে যায় ২ টা মাস!
নুরের সাথে জুবিনের এখন খুব ভাল বন্ধুত।নুর আগের থেকে অনেক ডেভেলপ করছে, এখন নুর জুবিনকে কথা মত মেডিসিন নেয়, গোসল করে,খাবার খায়,জুবিনের দেখে ব্যায়াম করে,। জুবিন একটা জিনিস খেয়াল করে যে দুই মাস হচ্ছে ওর এখানে আসা বাট কেউ এখনো নুরকে দেখতে আসি নি,পরে জানতে পেরেছে নুরের আম্মু নাকি অসুস্থ তাই আসতে পারে না।

২ মাস নুর ভালো ছিলো বাট ১৫ দিন পর থেকে নুর আবার পাগলামি শুরু করছে!জুবিন এর কারন খুজে পাচ্ছে না। জুবিন কি মনে করে নুরের সব মেডিসিন চেক করতে গিয়ে ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মত অবস্থা… কারন নুরের সব মেডিসিন বদলে দেওয়া হয়েছে!আর তার বদলে ড্রাগ মিশ্রণ এমন মেডিসিন নুরকে ইনজেকশন দিয়ে পুশ করা হচ্ছে…

হৃদস্পন্দনের টানে পর্ব ৪