হৃদয় নিবাসে তুই পর্ব ২৬

হৃদয় নিবাসে তুই পর্ব ২৬
লেখনীতেঃভূমি

টিউশনি শেষ করে নেহাদের বাসার সামনে দিয়েই চলে যাচ্ছিল দিহান।রাত তখন আটটা কি সাড়ে আটটা।রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলোয় চারপাশটা বেশ আলোকিত।সোডিয়ামের সে আলোয় একনজর তাকিয়েই নেহাদের বাসার দিকে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল দিহান।বেলকনিতে মিনিট কয়েক তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ নেহাকে সেখানে উপস্থিত হতে দেখেই চমকাল সে।

বুকের ভেতর দমবন্ধকর চাপা পরিবেশ সৃষ্টি হলো মুহুর্তেই।বেলকনির লালচে ঢিম লাইটের আলোয় মেয়েটার আবছা ছায়া স্পষ্ট।গ্রিলে হাত রেখেই দাঁড়িয়েছে।দিহানের নজর তার উপর পরতেই বোধ হয় খিলখিলিয়ে হাসল।ঢিম লাইটটা নিভিয়ে সাদা ঝকঝকে লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়েই হাত নাড়াল সে।দিহান ভারী চাহনিতে তাকাল।ইশশ!টিউশনি শেষে ফেরার পথে ব্যস্ততার মাঝে একদমই উচিত হয়নি নেহার বেলকনির দিকে তাকানো।কি ভাবছে এখন?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পরমুহুর্তেই বেপরোয়া মন বলল,”ভাবলে ভাবুক না। কি ক্ষতি?সে তো তোমাকেই ভালোবাসে।তোমার নরম চাহনি দেখে সে নিশ্চয় তোমায় খারাপ ভাববে না।তোমার দৃষ্টিতে তার উপস্থিতির রেশ, ভালোবাসার এটুকু ছিটেফুটে যদি পেয়েও থাকে সে। ক্ষতি কি?মানুষটাতো ভালোবাসে তোমাকেই। তোমারই তো।”দিহান ভ্রু চুলকাল।উশখুঁশ করে কৃত্রিম হাসল।এই মুহুর্তে কোন দক্ষ প্রেমিকের মতো কোন আচরণ বা কথা মনে পড়ল না তার।

নেহাকে কি বলা উচিত, বা কি করা উচিত তাও বুঝল না।মাথা কেমন ভোতা হয়ে গেল।সেই ভোতা মাথা নিয়েই দাঁড়িয়ে থেকে হা করে নেহার দিকে তাকিয়ে রইল সে।নেহা হাসল সেই চাহনি আর নার্ভাস হওয়া মুখ দেখে।দিহানের দিকে তাকিয়েই মিষ্টি হেসে চোখ টিপল সে।দিহান অপ্রস্তুত হলো।নেহার আচরণে বিস্মিত হয়ে চোখ বড়বড় করে চাইতেই নেহা ইশারা দিয়ে বুঝাল সেও নিচে আসছে।দিহান ছোট শ্বাস ফেলল।মার্চের শুরুর দিকে ভ্যাপসা গরমে ঘেমে উঠা শার্টটা একহাতে হালকা ঢিলে করে আবার ছেড়ে দিল।কপালের ঘামটা মুঁছে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকার মাঝেই তার সামনে এসে দাঁড়াল সেই চমৎকার, চঞ্চল, প্রাণবন্ত মেয়েটি।মুখে তার দারুণ এক হাসি।দিহান ইতস্থত হয়ে এক নজর নেহার দিকে তাকিয়েই মাথা নোয়াল।উঁশখুঁশ করে বলে উঠল,

‘ আসলে এখান দিয়েই বাসায় ফিরছিলাম তাই। ‘
নেহা হাসল।ভ্রু উঁচু করে প্রশ্ন ছুড়ল,
‘ তাই?তাই কি?’
দিহান গলা ঝাড়ল।কয়েক সেকেন্ড নেহার দিকে তাকিয়েই নেহার হাসিটা দেখে হতাশ হলো।নেহা নিশ্চয় মনে মনে তাকে অনেক কিছু ভাবছে।ছিঃ ছিঃ!একদমই উচিক হয়নি এভাবে টিপিক্যাল প্রেমিকদের মতো নেহার বাসার সামনে এসে তার বেলকনির দিকে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকা।একদমই না।মানসম্মানটা কোথায় গিয়ে ঠেকল এখন?উঁশখুঁশ করেই বলে উঠল সে,

‘ না কিছু না।আসি?’
নেহা মুখ ফুলাল।দিহানকে যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে পথ আটকে দাঁড়াল সে।দিহানের হাতটা চট করেই বাচ্চাদের মতো জড়িয়ে ধরে চোখ টিপে হাসল।ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ উহ,তুই মেয়েদের মতো লজ্জ্বা পাচ্ছিস কেন দিহান?আমি কি তোকে খেয়ে ফেলব?মেয়েদের মতো লজ্জ্বায় মাথা নামিয়ে নিচ্ছিস, পালাই পালাই করছিস কেন? আমাদের ফুলশয্যা হচ্ছে না তো ইয়ার..’
দিহান ক্লান্ত চাহনিকে তাকিয়ে রইল।ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলল,

‘ ছেলেদের মতো বিহেভিয়ার করব?করি?’
নেহা ড্যাবড্যাব করে তাকাল।চোখজোড়ায় খেলল তীব্র বিস্ময়।সেই বিস্ময় কাঁটাতেই দিহান মুচকি হাসল।নেহার হাতের তালুটা শক্তভাবে চেপে ধরেই মুচকি হেসে বলল,
‘ প্রেমিকের মতো বিহেভ করব না।ভয় পাস না।চল হাঁটবি?আকাশের চাঁদ দেখি দুজন মিলে।রাস্তার একধারে আজ তোর হাত ধরে হাঁটব।যাবি? ‘
নেহা হাসল।হাত দুলিয়ে হাঁটতে লাগল দিহানের সাথে পা চালিয়ে।মাঝেমাঝেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটির দিকে থাকাল গভীর দৃষ্টিতে।

অদ্রিজা থম মেরে বসে রইল।মুখে চোখে বেশ গম্ভীর ভাব।দৃষ্টিটা মোবাইলের স্ক্রিনে স্থির।প্র্যাগনেন্সির রিপোর্ট পাওয়ার পর থেকেই তার প্রতি অত্রিয়ার খেয়াল করা, যত্ন নেওয়া বেশ করে বেড়ে গিয়েছে।নেহাও তার সাথে যুক্ত হয়েছে।ইদানিং তার আর মন খারাপ হয় না।এই দুইজন মেয়ে সবসময় তাকে আগলে রাখার চেষ্টা করে।কিন্তু হঠাৎ করেই এত ভালোবাসা?এত আগলে রাখা?প্র্যাগনেন্সির জন্য? অদ্রিজা বুঝল না।

একটু আগেও নেহা কল করে অনেকক্ষন কথা বলেছে।মাঝে সাঝেই তার কথাবার্তা, ছুটোছুটি করা ভিডিও করে।কখনও বা তার দিকে মোবাইলটা তাক করে ধরে রাখে।অদ্রিজা বুঝে উঠে না বিষয়গুলা।এখন ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা।তবুও তার চোখে ঘুম আসছে না।কিছুক্ষন আগে যখন নেহা কল করেছিল, সাফসাফ বলে দিয়েছে কোন এক আননোন নাম্বার থেকে কল আসলে যাতে সে রিসিভড করে।কিন্তু কেন করবে?

নাম্বারটা কার?কিছু জানায়নি।অদ্রিজা থম মেরেই বসে রইল।মোবাইলের স্ক্রিনে এখনো জ্বলজ্বল করছে সেই আননোন নাম্বারটা।আজ বেশ কয়দিন হলো এই নাম্বারটা থেকে কল এসেছে।সে একবারও রিসিভড করে নি।কিন্তু এবার বিস্তর কৌতুহল জমল। বেশ কয়বার কল দেওয়ার পরই হাত দিয়ে মোবাইল তুলল অদ্রিজা।ক্লান্ত চাহনিতে নাম্বারটা দেখেই বুঝল নাম্বারটা দেশীয় নয়।অদ্রিজা ক্লান্তি নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলল।কল রিসিভড করেই রাশভারী গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,

‘ হ্যালো?’
ওপাশ থেকে কথা বলল না কেউ।বেশ গাঢ় নিরবতা উপলব্ধি করতেই চুপ হয়ে রইল অদ্রিজা।আবারও বলল,
‘ হ্যালো।’
ওপাশ থেকে এবার কেউ একজন কেঁশে উঠল।হালকা মৃদু গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
‘ কেমন আছেন? ‘

অদ্রিজা থমকাল।কন্ঠটা শুনে বুঝতে বাকি রইল না মানুষটা কে।সঙ্গে সঙ্গেই চোখমুখ কঠিন হলো।কপালে ফুটে উঠল গভীর ভাজ।তীব্র বিরক্তি নিয়ে কল কাঁটতে যাবে ঠিক তখনই ওপাশের মানুষটা আবার ও বলল,
‘খবরদার কল রাখবেন না অদ্রিজা।অনেক কষ্টে কলে আপনাকে পেয়েছি।আজকে কতদিন ধরে কতবার কল দিয়েছি খবর আছে আপনার?কোন দরকার আছে নিশ্চয় এতবার যখন কল দিচ্ছি।কিন্তু আপনি তো আপনিই।তাই না?’
অদ্রিজা মুখে চোখে তীব্র রাগ নিয়ে বসে রইল খাটে।থমথমে মেজাজ নিয়ে কয়েক সেকেন্ড বসে থেকেই গম্ভীর গলায় শুধাল,

‘ কি দরকার?আপনার সাথে কোন দরকার থাকবে বলে মনে হয় না,হচ্ছে ও না।’
রক্তিম হালকা হাসল বোধ হয়।বেশ কিছুটা সময় চুপ থেকেই হালকা কাঁশল।জড়ানো কন্ঠে বলে উঠল,
‘ আমি আপনাকে একবার দেখতে চাই।সুযোগ দিবেন প্লিজ?একবার আপনার মুখটা দেখব।প্লিজ। একবার ভিডিও কল দিব?’
অদ্রিজার স্পষ্ট উত্তর,

‘ একদমই না।মাঝরাতে এসব বলে বিরক্ত করছেন একটা মেয়েকে?লজ্জ্বা করছে না?রাখছি।’
‘ এই এই।না রাখবেন না।আরেকটু কথা বলি প্লিজ।অনেকদিন হলো আপনার সাথে কথা বলা হয় না অদ্রিজা।অনেকদিন আপনার চুলগুলো ফু দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়ে উঠে না।অনেকদিন আপনার ঘুমন্ত মুখটাও দেখা হয় না।খুব অভাববোধ করছি আপনার।খুবব!’

অদ্রিজা চুপ রইল।কিছু বলল না।মিনিট দুই চুপ থাকতেই রক্তিম আবারও বলল,
‘ আজ খুব ইচ্ছে হচ্ছে আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরি অদ্রিজা।আপনার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে এক অপ্রত্যাশিত শব্দ মুখ দিয়ে আওড়াতে ইচ্ছে করছে ভীষণ।আপনার খোলা চুলে মাতাল হতে বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে।আপনার ঠোঁট একবার ছুঁয়ে দেখতেও ইচ্ছে হচ্ছে।আমি খুব খারাপ ভাবে আজ আপনাকে মিস করছি অদ্রিজা।আপনার কোমড় জড়িয়ে কিছুটা সময় মুখটা কাঁধে ভর দিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আপনাকে উপলব্ধি করতে ভীষণ মন চাইছে অদ্রিজা।একবার আপনার মুখটা দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।ভীষণভাবে!’

অদ্রিজা কেঁপে উঠল কথাগুলো শুনে।রক্তিমের গলা ভীষণ রকম শীতল,ঠান্ডা।এর আগে এতটা শীতল, নিচু কন্ঠে রক্তিম তার সাথে কথা বলেছে কিনা মনে পড়ে না।কয়েক মিনিট নিশ্চুপ থেকেই বলে উঠল সে,
‘ আমার ঘুম পাচ্ছে মিঃ রক্তিম।মাঝরাতে আপনার এসব ফালতু কথা শোনার সময় নেই।রাখছি।’
অদ্রিজা কল রাখার আগেই রক্তিম আবারও বলল,

‘ আজ আমায় এতটা অবহেলা করা আপনার উচিত হচ্ছে না অদ্রিজা।আপনিই বলুন উচিত হচ্ছে?এতটা আকুতি মিনতি করার পরও কেন এই ব্যবহার?পরে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন তো অদ্রিজা?’
‘ মানে?’
রক্তিম হাসল।ঠোঁট চেপে বলল,

‘ কিছুই না।যদি আর কোনদিন আমার সাথে আপনার কথা না হয় তবে নিশ্চয় কোন একদিন ভাববেন, একটা যুবক আপনার মুখ দেখার জন্য ছটফট করেছে।বোধ হয় তার চোখে পানিও ছিল কথা গুলো শুধানোর সময়। আপনি তার আকুতি মিনতি কত সহজেই প্রত্যাহার করলেন।আর যদি আবার দেখা হয়, আবার কথা হয় তবে সুদে আসলে ফেরত পাবেন আপনি সবটা।সবটাই!’
অদ্রিজা হাঁসফাঁস করল।রক্তিমের কথাগুলো মস্তিষ্কের ভেতর ঘুরতেই দ্রুত কল রাখল অদ্রিজা।

তখন গ্রীষ্মকালের পুরো দাপট।মাথার উপর সূর্যটা তীর্যকভাবে আলো ফেলছে।রোদের উত্তাপে পুরো শরীর ঘেমে চুপসে গেল কয়েক মুহুর্তেই।পরনের জামাটা সেই ঘামে লেপ্টে গেল শরীরে।অদ্রিজা ক্লান্ত শরীর নিয়ে কপালে হাত দিয়ে উপরের দিকে চাইল।দুপুরের সতেজ রোদে ক্লান্ত শরীরে আরো ক্লান্তি বোধ হলো তার।চারপাশে একনজর তাকিয়েই নেহাকে না দেখে ধীর পায়ে পা ফেলল ।অন্যদিন ভার্সিটি ফেরার পথে নেহাই সাথে থাকে।

অত্রিয়া আর নেহা এই দুইজন পাশে থাকলে আর কিছু লাগে না। সবসময় আগলে রাখে তাকে।তাদের যত্ন নেওয়াও কমেনি এই কয়দিনে বরং বেড়েছে।সে দুইজনের কেউ একজন সাথে থাকলেও বোধহয় শরীরের এই ক্লান্তিটা তার বোধ হতো না।কিন্তু এখন হচ্ছে।পা জোড়া এগোতে মন চাইছে না।তবুও এগোতে হলো।জোর করে নিজের শরীরটাকে এগিয়ে নিয়ে রাস্তার মোড় পর্যন্ত গিয়েই ল্যাম্পপোস্টের পাশে দাঁড়াল সে।

ভরদুপুরে রাস্তায় একটাও খালি রিক্সা না দেখে লম্বাশ্বাস ফেলল।কয়েক মুহুর্ত অপেক্ষা করার পর কোন রিক্সা না পেলেও তার ক্লান্ত ভারী শরীরটার সামনে এসে দাঁড়াল বেশ চকচকে কালো রংয়ের একটা গাড়ি।আকস্মিক কারটা নিজের সামনে আসাতে বিস্ময় নিয়ে তাকাল অদ্রিজা।বার কয়েক জোরে জোরে শ্বাস ফেলে ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে তাকাতেই গাড়ির গ্লাস নামল।তৎক্ষনাৎ গাড়ির ভেতর থেকে যে মুখটা ভেসে আসল সেই মুখটা দেখার জন্য যেন একেবারেই প্রস্তুত ছিল না অদ্রিজা।

না চাইতেও লোকটার মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল অদ্রিজা।বেশ অনেকদিন পর এই লোকটাকে দেখছে সে।মাস খানেক আগে কোন এক রাতে সেই কল করা, তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে কিছু কথা বলা।ব্যাস!তারপর তো আর কথা হয় নি।তারপর আর কল আসেনি। তারপর আর মিস করছে বলে কোন আবেদনও জানায়নি সেই মানুষটা।অদ্রিজা হতাশ হলো।মিনমিনে চোখে রক্তিমের ভারী চাহনির দিকে তাকাল।মুহুর্তেই রক্তিম চোখ টিপল।মুখে ফুটে উঠল বাঁকা হাসি। অদ্রিজা ফুঁসে উঠল।গা জ্বালানো রাগটা এবার দাউদাউ করে জ্বলে উঠল শরীর মন উভয়েই।রক্তিমের থেকে চোখ সরিয়ে দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে গেল।তাতে অবশ্য বিশেষ লাভ হলো না।রক্তিম গাড়িটা এগিয়ে আবারও অদ্রিজার সামনে রাখল।মুচকি হেসেই বলে উঠল,

‘ লাভ নেই।এই উত্তপ্ত দুপুরে রিক্সা পাবেন না।তার থেকে ভালো আপনাকে একটা সীমিত আকারে অফার দেওয়া হচ্ছে।গাড়িতে উঠে পড়ুন।ফ্রী তে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসব।’
অদ্রিজা চরম বিরক্ত হলো।সেই বিরক্তের রেশ স্পষ্ট ফুটে উঠল তার চোখেমুখে।শক্ত গলায় বলে উঠল,
‘ লাগবে না।’
রক্তিম বাঁকা হাসল।ঠোঁট চেপেই বলল,

‘ লাগবে।আপনার জন্য না হলেও আমার বেবির জন্য লাগবে।উঠুন দ্রুত।’
অদ্রিজা দাঁতে দাঁত চেপে তাকাল।চমৎকার!কত সহজেই এখন “আমার বেবি” বলছে।যে কিনা সন্তানের নিশ্চয়তার সংবাদ শুনেই পালিয়েছিল সেই হঠাৎ একমাস পর এসে কত নির্দ্বিধায় সন্তানের অধিকার দেখাচ্ছে।অদ্রিজা বাহবা দিয়েই বলে উঠল,

‘ বাহ!আপনাকে না দেখলে জানতামই না একজন সন্তানের আদর্শ বাবা কেমন হতে পারে!’
রক্তিম হালকা হাসল।গাড়ি থেকে নেমে পড়েই অদ্রিজার সামনাসামনি দাঁড়াল।বুকে হাত জোড়া গুঁজে নিয়েই বলল,
‘ জানলেন যখন গাড়িতে উঠে পড়ুন।নয়তো মুখ,হাত পা বেঁধে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাব বলে দিলাম।’
অদ্রিজার বিরক্তির পরিমাণ সময়ের সাথে বাড়তে লাগল পাল্লা দিয়ে। সামনের রক্তিম নামক মানুষটার প্রতি তীব্র বিরক্তি নিয়েই কপাল কুঁচকে বলল সে,

‘ কি সমস্যা আপনার?’
রক্তিম ভ্রু বাঁকিয়ে চাইল।অদ্রিজার দিকে ঝুঁকেই কানের সামনে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
‘ একমাস আগে সে রাতে বলেছিলাম তো, যদি আবার দেখা হয় তাহলে সুদে আসলে সবটা ফিরিয়ে দিব।সবটাই!যতটা যন্ত্রনা আমি পেয়েছি, যতটা কষ্ট পেয়েছি, ছটফট করে মরেছি ঠিক সেভাবে সবটুকু আপনাকে ফেরত দিব।ছারখার করে দিব আপনার জীবন।নাও রেডি ফর দিজ অদ্রিজা’

‘ ছারখার?ছারখার করতে বাকি কি রেখেছেন? যার জীবন একবার তছনছ করেই দিয়েছেন তাকে আর নতুন করে আর কি ছারখার করবেন ? ‘
রক্তিম হেসে উঠল। ফিসফিসিয়ে আবারও বলল,
‘ ধরুন ভিন্ন উপায়ে আপনাকে শেষ করব। এন্ড ইউ নো হোয়াট?এবারও আমার প্ল্যানটা চমৎকাররূপে আপনার উপর কাজ করবে। মিলিয়ে নিবেন।’
অদ্রিজা দ্বিধান্বিত চাহনিতে তাকিয়েই বলল,

‘মানে?’
‘ কিছু না।গাড়িতে উঠবেন কি উঠবেন না?এই উত্তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে থেকে ঘেমে একাকার হয়ে আমার লিটল কিডের কিছু হলে আপনি রেহাই পাবেন না।’
অদ্রিজা জ্বলে উঠল তৎক্ষনাৎ।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ জাস্ট ইরিটেটিং! ও আমার সন্তান। আমার!তার ভালো খারাপ আমি জানি, বুঝি।আপনার থেকেও ভালো বুঝি।পথ ছাড়ুন।আমাকে যেতে হবে।’

রক্তিম পথ ছাড়ল না।সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল অদ্রিজার সামনে।অদ্রিজা চোখেমুখে তীব্র বিরক্তি নিয়ে কয়েক সেকেন্ড রক্তিমের দিকে তাকিয়েই পাশ কাঁটিয়ে চলে যেতে লাগলেই রক্তিম আবারও তার পথ আগলে দাঁড়াল।মুখে চোখে তখন তার তীব্র রাগ দৃশ্যমান হলো।অদ্রিজার ডান হাতটা নিজের হাতে চেপে ধরেই বলে উঠল,

‘আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার সাহস কি করে হয় আপনার?কি করে?প্রত্যেকবার ছাড়া পেয়ে যাবেন ভাবছেন?একমাস আগে আমি আপনার থেকে অনেক দূরে ছিলাম বলে আমার চাওয়া প্রত্যাহার করাতেও আমি আপনাকে কিছু বলিনি।চাইলে আমি আপনাকে লোক দিয়ে ধরে বেঁধে রেখে ভিডিও কলে আপনার মুখটা দেখে নিতেই পারতাম। করিনি।কিন্তু এখন করব।লাস্টবার বলছি যাবেন কি যাবেন না?’
অদ্রিজা নরম হলো না।রক্তিমের কড়া কন্ঠে বলা কথাগুলোতে এটুকুও ভয় পাওয়া চাহনি দেখাল না।আগের মতোই শক্ত কন্ঠে বলে উঠল,

‘ যাব না।হাত ছাড়ুন এবার।’
রক্তিম ছাড়ল না হাতটা।বরং আরো জোরে চেপে ধরল হাতটা।নরম তুলতুলে হাতটা মুহুর্তেই ব্যাথায় তড়তড় করে উঠল অদ্রিজার।সেই ব্যাথার দাপটেই অদ্রিজার মুখচোখের চাহনির পরিবর্তন ঘটল দ্রুত । রক্তিম হাসল।হাতটা ছেড়ে দিয়ে দুইহাত দিয়ে কোলে তুলে নিল অদ্রিজাকে।আকস্মিক কোলে তুলে নেওয়াতে প্রথম দুয়েক সেকেন্ড বুঝে না উঠলেও পরমুহুর্তেই হাত পা ছুড়ল অদ্রিজা।নিজেকে রক্তিমের বাহুডোর থেকে ছাড়ানোর বিস্তর চেষ্টা চালিয়েও লাভ হলো না তার।রক্তিম তাকে কোল থেকে নামাল না।দাঁতে দাঁত চেপেই বলে উঠল সে,

‘ আপনার সাহস কি করে হয় আমাকে কোলে তুলার?নামান। নিমিয়ে দিন আমায় রক্তিম।নয়তো ভালো হবে না।’
রক্তিম বাঁকা হাসল। সেই হাসিটা দেখে গা জ্বালা করল অদ্রিজার।তীব্র রাগ নিয়ে হাত পা ছুড়েই তীব্র গলায় বলল,
‘ নামিয়ে দিন রক্তিম।ভালো হবে না।’
রক্তিম ভ্রু নাচিয়েই বলল,
‘ তাই নাকি?তো কি করবেন? কি করবেন আমার? ‘
‘ মে*রে ফেলব।খু*ন করে ফেলব। আপনার মতে অসহ্যকর একটা লোককে।বিরক্ত লাগে আমার আপনাকে।চরম বিরক্ত!’

রক্তিম দাঁত কেলিয়ে হাসল।পা বাড়িয়ে গাড়ির সামনে এসেই কোল থেকে নামিয়ে গাড়ির ভেতর বসিয়ে দিল অদ্রিজাকে। নিজেও উঠে পড়ে অদ্রিজার সিট বেল্ট বেঁধে দিয়েই অদ্রিজার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ কবেই খু*ন হয়েছি আমি আপনার হাতে।খু*ন হওয়া মানুষকে আরো খু*ন করতে চান বুঝি?’
অদ্রিজা কিছু বলল না।থমথমে মুখচোখ নিয়ে বাইরের রাস্তায় তাকিয়ে রইল।রক্তিম নামক মানুষটার প্রতি রাগ, ক্ষোভ তড়তড় করে বাড়ল সময়ের সাথে।বিরক্তিতে মুখচোখে ফুটে উঠল তিক্ত এক চাহনি।

অত্রিয়া কলেজ শেষে বাড়ির পথে ফিরতেই চোখে পড়ল সেই শ্যামপুরুষের মুখ।তীব্র ব্যস্ততা নিয়ে রাস্তা পার হয়েই গাড়িতে উঠল সে।ব্যস্ত নগরীর রাস্তায় তখন ভীষণ ভীড়।একের পর এক গাড়ি সেভাবেই স্থির হয়ে রইল রাস্তায়।মিনিট পনেরো সেই জ্যামের মাঝে আটকে পড়েই অতিষ্ঠ হয়ে উঠল অত্রিয়া।রিক্সায় বসে এদিক ওদিক তাকাতেই কিছুটা সামনে চোখে পড়ল সেই লোকটিকে।অত্রিয়া মুগ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে রইল।পরমুহুর্তেই সেই পুরুষটির প্রতি সবটা অনুভূতি কৈশোরের আবেগ ভেবেই উড়িয়ে দিল অত্রিয়া।বিরক্তি নিয়ে রিক্সা থেকে নেমে পড়েই কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়াল ।কপাল কুঁচকে রিক্সাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করেই বলল,

‘ জ্যাম কখন ছাড়বে বলুন তো মামা।’
আধপাঁকা দাঁড়িওয়ালা লোকটা হতবিহ্বল চাহনি নিয়ে তাকাল।সামনের পিচ্চি মতো মেয়েটার প্রশ্নের সঠিক উত্তর না জেনেই হতাশ হয়ে বলল,
‘ ঐডা তো জানি না আম্মা।ছাইড়তে সময় লাগব। ‘
অত্রিয়া বিরক্তি নিয়ে কপাল কুঁচকাল।ঠোঁট উল্টে বলল,

‘ আচ্ছা আপনি এখানেই থাকুন।আমি একটু হাঁটি মামা।অনেকক্ষন ধরে বসে বসে হাত পা ব্যাথা করছে আমার। ‘
লোকটা মৃদু হাসল। অত্রিয়া হাত পা নাড়িয়ে হাঁটতে লাগল।একের পর এক গাড়ি পরখ করল।রায়মানের গাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েই মুখ ফুলাল।মাথা ঝুকিয়ে হালকা উঁকি দিয়ে দেখল রায়মান নেই।অত্রিয়া অবাক হলো।এই মাত্র দেখল রায়মানকে গাড়িতে উঠেছে অথচ এখন নেই?হাওয়া?

‘ এই পিচ্চি? এখানে কি করছো?কি দেখছো আমার গাড়িতে?’
অত্রিয়া আরেক ধপা অবাক হয়ে পেঁছন ফিরে চাইল।রায়মানের শ্যামলা, লম্বা চওড়া শরীরটা তার ঠিক পেছনেই দেখে মুখ কালো করল।দু পা পিছিয়েই মৃদু গলায় বলে উঠল,
‘ ওহ।এটা আপনার গাড়ি বুঝি?জানতাম না আমি।জ্যামের মাঝে বসে থেকে থেকে হাত পা অবশ হয়ে আসছিল তো তাই একটু হেঁটে হেঁটে গাড়ির ভেতর মানুষজন কিভাবে এই সময়টা কাঁটাচ্ছে দেখছিলাম।’
রায়মান ভ্রু বাঁকাল।তীক্ষ্ণ চাহনি ফেলে বলল,

‘ সত্যি?নাকি মিথ্যে বলছো?এমনিতে তো হ্যাবলার মতো আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে প্রতিবার।কে জানে আমাকে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখতে উঁকি দিচ্ছিলে কিনা।’
অত্রিয়া ফুঁসে উঠল।রায়মানের বলা কথা গুলো মিথ্যে নয় জেনেও অহেতুক রাগ দেখাল।সুচাল গলায় বলে বসল,
‘ কি এমন দেখতে আপনি?যে আমি আপনার দিকে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকব?আমার বয়ফ্রেন্ডকে দেখেছেন? আপনার থেকে শতগুণ হ্যান্ডসাম সে।দেখতেও অসাম।’

‘ এইটুকু পিচ্চি মেয়ে প্রেম করে বেড়াচ্ছো তোমার ফ্যামিলি জানে?আন্টি জানে?জানাব?’
অত্রিয়া দাঁতে দাঁত চেপেই বলে উঠল এবার,
‘ আপনার কাজই কি মানুষের সংসার ভাঙ্গা?মানুষের ভালোবাসা সহ্য হয় না আপনার তাই না?নাকি কারো থেকে এত বড়সড় ছ্যাঁকা খেয়েছেন যে অন্য কারো ভালোবাসা দেখলেই আপনার জ্বলে উঠে।হুহ?আপুর সংসারটাও আপনার জন্য ভাঙ্গতে বসেছে।আপনার জন্য।ওদের সংসারটার আপনি ইচ্ছে করেই আজ এই দশা করেছেন।আর আজ যখন আমার প্রেমের কথা শুনলেন সাথে সাথে প্রেমকে বিচ্ছেদে পরিণত করার স্টেপ নিচ্ছেন?আসলে সমস্যাটা কি আপনার রায়মান ভাইয়া?’

রায়মান ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
‘ বাকি কথাগুলোয় মাইন্ড করছি না আপাদত।কিন্তু ভাইয়া?ভাইয়া বললে কেন?কোন জম্মের ভাই আমি তোমার?’
অত্রিয়া ছোট্ট শ্বাস ফেলেই বলল,
‘ ভাই না আপনি আমার?আপনি চাচুর শালির ছেলে।তো?আমার আপনার সম্পর্কটা তো ভাই বোনেরই। তাই না?আপু যদি আপনার বোন হয় তো আমিও আপনার বোন।’
‘ না।’

হৃদয় নিবাসে তুই পর্ব ২৫

অত্রিয়া ভ্রু কুঁচকাল।ততক্ষনে জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে।রায়মানের শক্ত দৃঢ় কন্ঠে ” না” শব্দটা শুনেও আর কিছু বলল না সে।দ্রুত পা এগিয়ে সেই রিক্সাটার কাছে গেল।তড়িঘড়ি করে রিক্সায় উঠে বসতেই রিক্সাটা চলতে শুরু করল।অত্রিয়া মুখ টিপে হাসল।মাথা ঘুরিয়ে একনজর দাঁড়িয়ে থাকা রায়মানের দিকে তাকিয়েই হাসিটা চওড়া হলো।

হৃদয় নিবাসে তুই পর্ব ২৭