শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ২৪

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ২৪
আলিশা

স্মরণের হাতটা গলা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আমি তার চাইতেও দ্বিগুণ জোর গলায় বললাম
— আপনি যে আমাকে প্রয়োজন করে রেখেছেন এটা নিয়েও আমি কখনো কিছু বলেছি? আমি বলেছি একবারও অথৈ আসলে আপনি আমাকে কোথায় রাখবেন? করেছি এই প্রশ্ন? আমাকে স্বার্থপর ভাবছেন আপনি? একবার নিজেই ভাবুন আমি স্বার্থপর নাকি আপনি স্বার্থপর? দিনের পর দিন আমি কোনো প্রতিদান আশা না করেই আপনার আর আপনার মেয়ের সেবা করে গেছি। কখনো অবহেলা করেছি আমি? কিন্তু মাঝে মাঝে আপনি ঠিকই অবহেলা করেছেন আমাকে। এখন যদি আমি বলি আপনি স্বার্থপর তাহলে আপনি কি জবাব দেবেন? সেই আপনি আমাকে বাড়িতে থাকা নিয়ে খোঁটা দিচ্ছেন?

উচ্চশব্দে কথাগুলো বলতেই স্মরণের রাগ যেন নিভে গেলো। অবাক নয়নে আমার পানে তাকিয়ে রইলো। বাবা ইতিমধ্যে ঘরের দরজায় উপস্থিত হলেন। জয়নব খালাও বাকি রইলেন না। স্মরণ কাউকে পরোয়া না করে বলে উঠলো

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— কতগুলো দিন আমি তোমার জন্য ডিউটি মিস করেছি? কতগুলো রাত তোমার টেনশনে আমার ঘুম হয় না। তুমি বাইরে গেলে আমি যেন আত্মাটা হাতে নিয়ে বসে থাকি খেয়া। এরপরও তুমি আমার ভালোবাসার ওপর আঙ্গুল তুললে আমার কিছু বলার নেই।

— ওসব সহানুভূতি। এতো ভালোবসলে অথৈয়ের কথা বলতেই আপনি চিৎকার করে ওঠেন কেন? অথৈ বলতে আপনি সবসময় পাগল। কই আমার জন্য তো এতো পাগল হতে দেখলাম না।
স্মরণ চিৎকার করে বলে উঠলো

— তাই বলে তো তুমি একটা নিষ্পাপ মানুষ কে পাপী প্রমাণ করতে পারো না আমার কাছে।
আমার চোখে জল। মাথা চড়াও। আমি পুনরায় বলে উঠলাম একই তেজ নিয়ে

— আমি চলে যাচ্ছি আপনার বাসা থেকে। দোয়া করি অথৈ আর ছোঁয়া কে নিয়ে ভালো থাকুন। আর শুনুন আমি কখনো অথৈকে হিংসা করিনি। হয়তো আপনার ধাঁচে নেই সত্যি স্বীকার করা। সেটা আপনার ব্যর্থতা আমার নয়।
কথাগুলো বলেই এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে ছুটতে লাগলাম অজানা দিকে। বাবা ডাকলেন, জয়নব খালা আটকাতে চাইলেন তবে আমি কারো বাঁধা মানতে নারাজ। মাগরিবের আজান পরছে চারদিকে। সে সময়ই বাড়ির মেইন গেইট দিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। হঠাৎ ধুমো মিশ্রিত হাওয়ার দাপট গায়ে লাগলো। মেঘ গর্জে উঠলো। ভারি বর্ষনের পূর্ব সংকেত।

বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তার পাশে এক সরকারি অফিসের সামনে বসার আসেন বসে রইলাম। একটু হাঁটতেই ক্লান্ত লাগে আজকাল। ফোনটা ফেলে এসেছি। ওয়াজিয়াহকে ফোন করার প্রয়োজন অনুভব করলাম। টাকাও নেই কাছে যে একটা রিকশা ভাড়া করে চাচার বাড়ি চলে যাবো। শূন্য হাত পা নিয়ে কেবল বসে রইলাম ইট পাথরের বসার আসনে। এরই মাঝে নামলো ঝুম বৃষ্টি। ইচ্ছে হলো না কোনো ছাদের নিচে দাঁড়াতে। কেবলই মনে হতে লাগলো স্মরণ কিভাবে পারলো আমার গলা চেপে ধরতে?

সে কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসে না? ভাবনা আবার ঘুরে যায়। অভিমানকে হার মানিয়ে মস্তিষ্ক বলে বসে আমারই ভুল। হঠাৎ যদি কেউ তার ভালোবাসার মানুষের নামে অপবাদ শোনে মেনে নেওয়া কষ্টকর হওয়ায় স্বাভাবিক। মস্তিষ্কের ভাবনা কে আবারও দূরে ঠেলে অভিমান। বলে ওঠে তাহলে কি আমাকে ভালোবাসে না? শুধুই অথৈ কে ভালোবাসে? ভাবতে ভাবতে চোখ থেকে গড়িয়ে পরলো জল। আমিও রাগ দেখিয়েছি তাই বলে কি সে আমাকে আটকাবে না বাসা থেকে বের হওয়ার সময়? ভাবনার মাঝেই গাঢ় জেদ হলো। সেই স্থানেই ঠাঁই বসে রইলাম বৃষ্টির মাঝে। সে যদি আগামী দুই ঘন্টার মাঝে না আসে তবে আমি ভাববো সে আমায় ভালোবাসে না। আর যদি আসে? যদি আসে তাহলে সে আমায় তীব্রভাবে ভালোবাসে। কিন্তু মাঝখানে অথৈ? অথৈয়ের ভাবনা মনে আসতেই আবারও জ্বলে ওঠে অভিমান। নিভে যায় মনের ভালোবাসার প্রদীপ।

থেমে থেমে আসা দমকা হাওয়া আর অবিরাম ঝাড়তে থাকা বৃষ্টির দরুন শীতে কুঁকড়ে গেলো আমার গা। শাড়ি ভিজে লেপ্টে গেলো গায়ে। বেণী করা চুলে পানি টইটম্বুর হলো। তবুও স্মরণের দেখা পেলাম না। মনটা বড্ড খারাপ হতেই আচমকা চোখে গাড়ির তীব্র আলো এসে পরলো। মনটা নিমিষেই আনন্দে মেতে উঠলো। তবে কি স্মারণ এসেছে? বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেই আঁধারের এগিয়ে এলো কেউ।

অতঃপর খপ করে আমার হাতটা ধরতেই অন্তরাত্মা লাফিয়ে উঠলো। বিপদের সংকেত রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পরলো। আমি একটা চিৎকার দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই সে আমার মুখ চেপে ধরলো। অপর কেউ এগিয়ে আসলো। দু’জনে মিলে আমাকে টানতে টানতে গাড়িতে উঠাতে চাইলো। আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেও ব্যার্থ হলাম। গাড়িতে ওঠানোর কালে হঠাৎ দূরে এক গাড়ির শব্দ কানে এলো। ল্যাম্প পোস্টের আলোর ↓ গাড়িটা দাঁড়াতেই বেড়িয়ে এলো স্মরণ। সে আমাকে নাম ধরে ডাকতেই আমার আমার আফসোস সব মাটি হলো। কারা আমায় অপহরণ করছে, আর কেনোই বা করছে তা মাথা থেকে উড়ে গিয়ে কেবল মাথায় চড়ে বসলো

” সে এসেছে। তার মানে সে আমাকে ভালোবাসে। এখন আমি মরেও শান্তি পাবো।”
গাড়িতে আমায় উঠিয়ে অপহরণকারীরা আমাকে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে হঠাৎ মনে হলো আমাকে তো বাঁচতে হবে। আমার একটা সুস্থ জীবন চাই আমার সন্তানের জন্য। তৎক্ষণাত গাড়ির কাঁচে হাত দিয়ে থাপ্পড় দিতে লাগলাম। ওরা আমার হাত শক্ত করে বাঁধতে ব্যস্ত হলে আমি পা দিয়ে গাড়িতে লাথি দিতেই স্মরণ চাইলো গাড়ির নিকট। কালো গাড়ি হওয়ার দরুণ সে হয়তো কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। ততটা ভ্রূক্ষেপ না করে সে অন্য রাস্তায় আমাকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পরলো।

অসাড় হয়ে আসা শরীর, আঁধার নামা চোখ অনুভব হলো আমার। শক্ত মেঝেতে শুয়ে আছি বলে মনে হলো। ঝট করে চোখ খুলে উঠে বসতেই খেয়াল হলো আমি বাঁধা। একটা হলুদ আলো জ্বালিয়ে রাখা ঘরে আমি বাঁধা অবস্থায় আছি। আশপাশে কেবল ধুলোবালি আর কিছু পাটের বস্তা। আমি চিৎকার করে ডেকে বললাম

— কে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছো? সামনে আসো, সাহস থাকলে সামনে আসো। তুমি হয়তো জানো না আমার স্বামীর পরিচয়। সে তোমাকে ছাড়বে না কিন্তু।
আমার কথাগুলো প্রতিধ্বনি হয়ে আমারই কাছে ফিরে এলো। বদ্ধ ঘরে কেউ এলো না। আমি দ্বিতীয় বার চিৎকার করে বললাম

— কেন আমাকে এখানে এনেছো? কে তুমি?
এবার দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। সামনে এসে দাড়ালো এক অচেনা লোক। বলে উঠলো
— চুপচাপ বসে থাক। কে এনেছে তা একটু পরই জানতে পারবি।
— এখনই বল কে এনেছে।
আমার কথার মাঝে ঘরে ঢুকলো দু’টো মেয়ে। একজনের অবয়ব দেখে মনে হলো আমি তাকে চিনি। আন্দাজ করতেই বুঝলাম এটা খাইরুন। আমি বেশ খানিকটা চমকে উঠলাম। এদের কথা আমার মাথাতেই ছিলো না।

— ঘর থেকে বের হ, বুবু বলছে কেউ ঘরে থাকতে পারবে না।
কন্ঠস্বর শুনে নিশ্চিত হলাম এটা খাইরুন। লোকটা বেরিয়ে গেলো। খাইরুনের মুখ ঢাকা ছিলো ওড়নার আঁচলে। সে মুখের কাপড় সরিয়ে দরজা আটকে দিলো। আমার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে বলল
— আপনাকে তো সাবধানে থাকতে বলছিলাম। কিভাবে আঁটকে গেলেন এদের জালে?
— আমার বোকামির কারণে।

খাইরুন আমাকে পলকহীন তাকিয়ে দেখলো। অতঃপর তার পাশে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে ইশারায় হাতের জিনিসপত্র নিচে রাখতে বলল। বড় একটা থালায় একটা ছুড়ি, একটা ব্লেড আর একটা লাঠি দেখে আমি চমকে উঠলাম। হতবুদ্ধি হয়ে তাকালম খাইরুনের দিকে। খাইরুন ঈষৎ রাগ দেখিয়ে বলল
— এগুলো দিয়ে কি করতে বলেছে আপনি জানেন? আপনাকে মারতে বলেছে। বুবু ঘুমে। আরেকটা মেয়েকে আদেশ দিয়েছিল আপনাকে মেরে রক্তাক্ত করতে। আমি মেয়েটাকে ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে নিজে কাজ নিলাম। আপনি কি বোকামি করেছেন জানি না তবে একদম উচিত হয়নি।

— ওরা আমাকে রক্তাক্ত কেন করবে?
— এতো কিছু জানি না। শুধু জানি আপনাকে নিয়ে আসতে দেখে আমি ভয় পেয়েছি।
আমি চিন্তায় পরে গেলাম। কি করবে ওরা? খাইরুনেরও মাথায় হাত পরলো। একটু ভাবনার পর খাইরুন হঠাৎ পাশের মেয়েটাকে বলে উঠলো

— রান্নাঘরে যা। বড় মাছ এনেছে। কিছু রক্ত নিয়ে আয়।
খাইরুনের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমি। খাইরুন পাত্তা দিলো না। সে নিজের কোঁচ থেকে একটা কাজল বের করে তা আমার চোখের নিচে হালকা লেপ্টে লাগিয়ে দিলো। থুতনিতে লাগিয়ে দিলো। একটু খানি গলাতেও লাগালো। অতঃপর আমাকে আরো অবক করে দিয়ে নিজের শাহাদাত আঙ্গুল একটু কেটে রক্ত বের করে তা লাগিয়ে দিলো আমার ঠোঁটের বাম পাশে। একটুখানি কপালে আর একটুখানি গলায়। আমি হিমশীতল হয়ে বসে রইলাম। বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আস্তে করে বলে উঠলাম

— কি করছো এগুলো? নিজের হাত কেন কাটলে?
খাইরুনের জবাব
— ছোট বোন হিসেবে এটুকুই করতে পারলাম। আমি শুধু চাই আপনি বিপদমুক্ত হন। আপনার গায়ে কি আমি হাত ওঠাতে পারি?

আমার চোখ জলে ভিজে উঠলো। ও আমার কে? এতো কেন করছে আমার জন্য? নিজের বোনও হয়তো এত ভাবতো না আমার জন্য। একটু পর মেয়েটা একবাটি মাছের রক্ত আনলো। খাইরুন তা আমার শাড়িতে মাখিয়ে দিলো। হাতে দিলো। অতঃপর বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। তারপর প্রায় পাঁচ মিনিট পরই ঘরে ঢুকলো কাঙ্ক্ষিত মানুষটা। অথৈ। তার হাতে পায়ে ক্ষত। চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। চোখ দু’টো কালো। আমি ভরকে গেলাম। তার চলার ধরণপ অসুস্থতার ছাপ। সে এগিয়ে এলো আমার নিকট। তার পেছনে ছিলো দু’টো লোক। আমাকে দেখেই কান্না মিশ্রিত সুরে বলল

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ২৩

— তোমাকেও এনেছে বোন?
আমি চোখ ভরে দেখলাম অথৈকে। অনেক ইচ্ছে ছিলো এই মেয়েটাকে দেখার।
— নাটক বন্ধ করো। আমি তোমার রহস্য জানি অথৈ।
অথৈ যেন চমকো উঠলো।

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ২৫