সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৩৭
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
সামনের ঘরটায় এসে গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল তীব্র। চওড়া বক্ষে তখন এক আকাশ স্বস্তি। কী হতে যাচ্ছিল এতক্ষণ! ধ্যান-জ্ঞান খুইয়ে আরেকটু হলেই ভিতু মেয়েকে চুমু খেয়ে ফেলতো। মেয়েটা কী ভাবতো তাহলে!
প্রেমে পড়ার পর তীব্র মেয়েদের ব্যাপারে গুগল ঘেটেছে। অনেক গুলো সিরিজ, সিনেমা দেখেছে। সব মিলিয়ে যা বুঝেছে,মেয়েরা বিয়ের আগে এসব চুমু-টুমু পছন্দ করে না। তারওপর সে যদি হয় ভিতু মেয়ের মতো!
কিন্তু তীব্রর পৌরুষ হঠাৎ এমন নড়বড়ে হলো কী করে? ভিতু মেয়েকে কাছে পেয়েই লুফে ধরার ইচ্ছেটা এমন আচমকা মাথা তুলল কেন? মেয়েটা ওকে ভালোবাসে জানার পর থেকেই অন্তঃপাড়ে যে তোলপাড়ের শুরু, এতো সহজে তা থামাবে না তীব্র। সদ্য তো ভালোবেসেছে,আগে অনুভূতিতে শরীর ভেজাক। মন ডুবুক প্রেমের তরে। তবেই না এক হওয়ার আসল শান্তি!
যাক,ভাগ্যিস কেউ একজন এসছে এখন। ঠিক সময়ে ডোরবেল বাজায়, এবারের মতো মরতে মরতেও বেঁচে ফিরল সে৷
তীব্র শার্ট ঠিকঠাক করল। ফরসা চেহারা তার চকচক করছে ঘামে। সেই সন্ধ্যেবেলা কলেজ থেকে ফিরেছে,অথচ এখন অবধি ফ্রেশ হতে পারেনি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নূহা যা একটা বিদ্যুৎ শক দিয়েছিল,একটুর জন্যে তীব্রর হার্ট অ্যাটাক হয়নি।
ডোরবেল সেসময় আরেকবার বাজল। সাথে জোরে জোরে কাঠে বাড়ি দিয়ে বলল,
“ দরজাটা খোল রে ভাই। এতো দাঁড়িয়ে থাকলে তো হাঁটু থেকে পা খুলে যাবে।”
কণ্ঠ শুনেই তীব্র বুঝে গেল ওপাশে কে। এগোলো, ছিটকিনি নামিয়ে খুলল দরজা।
মিরাজ, মুশফিক, আরমান আর নাহিদ এসেছে। চারটে পরিচিত মুখ তাকে দেখে একসাথে দাঁত মেলে হাসল। তারপর চটপটে কদমে ঢুকল ভেতরে।
মুশফিক কিছু বলার জন্য হাঁ করেছিল, থমকে গেল হঠাৎ। কোনও এক দিকে তার গোলাকার চোখ দেখে মিরাজও ফিরে চায়। স্তম্ভিত সে আর্তনাদ করল সহসা,
“ এ কী! এ আমি কী দেখছি!”
ভেতরের ঘর হতে বেরিয়ে এসেছে পুষ্পিতা। মেয়েটার শরীর লজ্জায় চৌচির। তারওপর আরমান থেকে শুরু করে নাহিদ অবধি হাঁ করে দেখছে । ও চোখের কোণা তুলে তীব্রকে খুঁজল। মানুষটার হদিস পেলো যখনই, সে চোখের ইশারায় বেরিয়ে যেতে বোঝায়।
পুষ্পিতা আনত। বাকীদের বিমুঢ় দৃষ্টির পাশ কাটিয়ে চুপচাপ চলে গেল বাসায়।
কিন্তু বিস্ময় ওদের কমল না। হতবাক হয়ে একজন আরেকজন কে দেখল কিছুক্ষণ। আরমান বলল,
“ আমি যা দেখলাম,তোরাও কি তাই দেখলি?”
সবাই একসাথে মাথা নাড়ে।
মুশফিক বলল,
“ দুজন একসাথে! এক ঘরে!”
মিরাজ বলল,
“ বিয়ের আগে ছেলেমেয়েরা আজকাল এসব করছে? এগুলো দেখে আমাদের বাচ্চারা কী শিখবে?”
সহসা তার মাথায় চড় বসায় আরমান,
“ হাঁদারাম, বাচ্চা পেলি কই ?”
“ সরি সরি, আমার তো বিয়েই হয়নি।”
কিন্তু নিশ্চুপ নাহিদ কপাল চুলকাচ্ছে। তীব্র এই কদিনেই এতোখানি এগিয়ে গেল? রীতিমতো পুষ্পিতা ওর সাথে ফাঁকা বাসায়! বাহ,ভালোই হয়েছে। নূহা আর ওর কাজ দ্বিগুণ কমে যাবে তাহলে।
বন্ধুদের হাহুতাশের মাঝেই,ধমক ছুড়ল তীব্র,
“ থামবি? না সবকটাকে বাসার বাইরে ফেলে আসব?”
ধমক কাজে লাগে। থামল ওরা। অথচ দু সেকেন্ডও হলো না,আচমকা গেয়ে উঠল একসাথে,
“ বন্ধু আমার রশিয়া
খাটের ওপর বসিয়া
একখানা গান বানাইছে।
ইনিয়া আর বিনিয়া,
ঘরে মাইয়া আনিয়া,
এতক্ষণ কী কইরাছে?
হোয় হোয়!”
একমাত্র বলদের মতো চেয়েছিল নাহিদ। শেষ লাইন গাইতে গাইতে মিরাজ জাপটে ধরে তীব্রকে। সাথে সাথে ঝাড়া মেরে ছাড়িয়ে দেয় সে। ভীষণ রাগে গজগজিয়ে বলে,
“ চুপ, একদম ফাজলামো করবি না আমার সাথে।”
সবকিছু সেই আগের মতো শান্ত হয়ে যায়। তারপরই হুহা করে হেসে উঠল সবাই। তীব্র বিফল শ্বাস ঝাড়ল। চ সূচক শব্দ তুলল জ্বিভে। এখন মনে হচ্ছে
এগুলো আরেকটু পরে এলেই ভালো হোতো। অন্তত এই বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না ওকে।
হঠাৎ তীব্রর মাথার মধ্যে অন্য চিন্তা দপদপ করে ওঠে। এক লহমায় কণ্ঠস্বর পালটে গেল তাতে।
প্রশ্ন করল সোজাসুজি,
“ আমিই যে বিট্টু মাস্তান,নূহার কাছে সেটা কে বলেছে!”
ব্যাস! এই এক কথায় সবার হাসি-ঠাট্টা হুড়মুড়িয়ে গায়েব। প্রত্যেকে সিরিয়াস চোখে চাইল। মুখ দেখাদেখি করল এক পল।
মিরাজ শুধায়,
“ মানে?”
তীব্রর মুখায়ব প্রস্তর সম।
“ মানেটা তো তোরা বলবি। এই গোটা গাজীপুরে শুধুমাত্র তোরা জানতি আমার আসল পরিচয়। তাহলে নূহার কাছে খবরটা দিলো কে?”
মুশফিক চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,
“ কী বলছিস ভাই? ওই মেয়ে জেনে গেছে তুই কে?”
“ হ্যাঁ। শুধু জেনেই বসে থাকেনি। রীতিমতো হুমকি-ধমকি দিয়ে আমার ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছিল। কোনওরকমে ম্যানেজ করেছি।”
আরমান একটু ভেবে বলল,
“ ওর সাথে আমাদের কখনও কথাই হয়নি। যা খাতির সেতো নাহিদের সাথেই দেখি।”
ওর বলতে দেরি,সন্দেহের তির নাহিদের দিকে টার্ন নিতে এক মিনিটও দেরি হলো না। এতো গুলো চোখের নিশানা হয়ে ভরকে গেল ছেলেটা।
দুহাত তুলে বলল,
“ এ্যাই না না। আমি কেন বলব? আমি কিছু বলিনি। মিস নূহার সাথে তো আজ সারাদিনে আমার দেখাই হয়নি।আমি তো কাল রাত থেকে তোদের সাথে আছি।”
মুশফিক রেগে রেগে বলল,
“ তাহলে কি ভূতে এসে বলেছে?”
মিরাজও সমান চোটপাট দেখাল,
“ তুই-ই একমাত্র কথা বলিস মেয়েটার সাথে। বেশ ভাব দুজনের। তুই ছাড়া কে বলবে,বোঝা আমাকে।”
কথার সাথে আরমান মাথা নাড়ল দুবার। বোঝালো সেও সহমত।
সবার মাঝে নাহিদ অসহায় হয়ে পড়ল। করুণ গলায় বলল,
“ বিশ্বাস কর বিট্টু, সত্যিই কিছু জানি না আমি। আমি কিচ্ছু বলিনি ওনাকে। প্লিজ তুই অন্তত আমাকে অবিশ্বাস করিস না। ”
তীব্র নিম্নোষ্ঠ দাঁতে পিষছে তখন। মুশফিক আবার কিছু বলতে গেলেই, হাত তুলে থামাল। বলল আস্তে করে,
“ ছাড়। এসবের মধ্যে নাহিদকে টানিস না। ও কিছু বলেনি।”
“ তুই এতো শিয়র কী করে হচ্ছিস?”
মিরাজও স্বায় মেলাল,
“ হ্যাঁ সেই তো। ও কত ইনোসেন্ট জানিস না? পরিচয় লুকিয়ে রাখা ঠিক না,কাউকে ঠকানো উচিত না এসব আউলফাউল যুক্তি ভেবে ভেবে দ্যাখ গিয়ে ঠিকই খবর পাচার করে দিয়েছে।”
নাহিদের কণ্ঠে উদ্বেগ,
“ না না, আমি এমন করিনি। আর যত যাই হোক বিট্টু তো তোদের মতো আমারও বন্ধু ভাই। আমি ওর ক্ষতি কেন চাইব?”
আরমান বলে,
“ তাহলে তুই-ই বল, কে এসে মেয়েটাকে জানিয়ে দিয়ে গেল? কার এতো দায় পড়ল ওদের উপকার করার,শুনি!”
নাহিদ উত্তর দিতে পারল না। দেবে কী করে? নির্ভেজাল, জবাব শূন্য মানুষ কী আর বানিয়ে বলতে পারে?
তক্ষুনি কড়া কণ্ঠে গর্জে উঠল তীব্র,
“ চুপ কর! যেটা নিজেরাও জানিস না,সেটা অন্যের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছিস কেন? নাহিদকে তোদের থেকেও ভালো আমি জানি। আমি চিনি ওকে। একবার বললাম না ও বলেনি? ব্যস! এ নিয়ে আর একটাও কথা নয়!”
ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে থাকা নাহিদের ভেতরটা অবধি জুড়িয়ে গেল এবার। তীব্রর ওর প্রতি এতো বিশ্বাস? এতো আস্থা? কই আগে তো কোনওদিন বলেনি।
তিনজন তখন মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে। অন্যদিকে মহাদুশ্চিন্তায় পড়েছে তীব্র।
নূহার কাছে তার গোপন কথা যে ওর বন্ধুরা কেউ বলেনি,সেটা ও জানে। কিন্তু বললটা কে! যেই বলুক, সে নিশ্চয়ই ওর শত্রু! যে চায় না পুষ্পিতা ওর হোক। পুষ্পিতার কথা তুলতেই
তীব্রর মস্তিষ্কে জেঁকে উঠল যে নাম,নিজেই চমকে গেল তাতে। শাফিন? ও বলেছে কিছু? না না,শাফিন কী করে বলবে! তীব্র মাথা নাড়ল দুপাশে।
কিন্তু কোনও ক্লুইতো নেই। ছেলেটা হতাশ ভঙ্গিতে ডিভানে বসে পড়ল। বন্ধুরা তার চেহারা দেখে উদ্বীগ্ন হয়। নিজেরাও চিন্তায় পড়ল। রুমজুড়ে এলোমেলো পায়চারি শুরু করল সবাই। শুধু এক কোণায় দাঁড়িয়েছিল নাহিদ। ওর মাথাতেও একই ভাবনা। কে বলল! কে বলল!
তারপর চট করেই নাহিদের মনে পড়ে গেল জামশেদের কথা। ভদ্রলোক এখানে আসার ব্যাপারটা বলতে বারণ করায়,নাহিদ সত্যিই কাউকে জানায়নি। কিন্তু তীব্রর অবস্থা দেখে আর চুপ থাকতে পারল না। তৎপর কাছে এসে বলল ,
“ বিট্টু! একটা কথা বলা হয়নি তোকে। আজ সকালে না, আঙ্কেল এসেছিলেন এখানে।”
তীব্র ভ্রু কোঁচকায়,
“ কোন আঙ্কেল?”
“ ইয়ে,জামশেদ আঙ্কেল।”
চমকে উঠল ও। তড়াক করে উঠে দাঁড়াল অমনি। বিস্মিত হয়ে বলল,
“ কী? কেন?”
নাহিদ জ্বিভে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
“ তা জানি না। আসলে আমাকে কিছুই বলেনি। তুই তো আজ তাড়াতাড়ি বের হয়ে গিয়েছিলি! আঙ্কেল তার পরপরই এসেছিলেন।”
আরমান সতর্ক কণ্ঠে বলল,
“ ওই যখন আমাকে দরজা খুলতে বলেছিলি? কিন্তু তুই যে বললি পেপার ওয়ালা!”
নাহিদ নিভে যায় এ বেলা। মিনমিন করে জানায়,
“ আসলে, আঙ্কেল মানা করেছিলেন বলতে!”
ফুঁসে উঠল সে,
“ মানা করলেন, আর তুইও চেপে গেলি? ওয়াও।”
“ তো কী করব আমি? মুরুব্বি মানুষের কথা অমান্য করব?”
মুশফিক বলল,
“ ওর কথা ছাড়। আচ্ছা বিট্টু তোর কী মনে হয়, আঙ্কেল হঠাৎ এখানে কেন এসেছেন?”
তীব্র ভাবুক।
একটু চুপ থেকে বলল,
“ যে জন্যেই আসুক। কাজটা যে মন্ত্রীমশাই ঘটিয়ে গেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। নাহিদ, শুরু থেকে সবটা বলতো।”
নাহিদ একটু নড়েচড়ে দাঁড়াল। সকালের সব কথা ঝরঝর করে বলতেই তীব্রর গুলিয়ে গেল পুরোটা। ঠোঁট কামড়ে ডুব দিলো বিভ্রমের স্রোতে। এই মন্ত্রীমশাই হঠাৎ এখানে এলো কেন? কী দেখতে?
উত্তর না পেলেও
মেজাজটাই বিগড়ে গেল ছেলেটার। জীবনে তো একটা ভালো কাজে ওকে সাহায্য করল না। প্রথম বার যে তীব্র একটা প্রেমের মিশনে নেমেছে সেটাতেও বাগড়া দিতে যাচ্ছিল?
এইজন্যেই সরকার দেশের মানুষের এতো গালি খায়। এরা যে এতো বেশি বোঝে কেন!
এ নিয়ে তো এখন কোনও প্রশ্ন করাও যাবে না। ভদ্রলোকের শিরায় শিরায় রাজনীতি। সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলবে তাহলে।
। পুষ্পিতার সাথে কাটানো ভালো মেজাজটা তীব্রর তলানিতে এখন। তুঙ্গে ওঠা রাগ কোথায় উগড়ে দেবে বুঝল না। সামনে পড়ল ডিভানের কাঠের পায়া।
তুরন্ত ‘ধুর’ বলে লাথি মারল সেখানে।
পরেরদিন!
ক্লাসের কাছাকাছি এসেই দাঁড়িয়ে গেল তীব্র। ভেতরে ঢুকবে কী ঢুকবে না, দ্বিধাদ্বন্দ্ব বেঁধে গেল সে নিয়ে। একদিকে যেতে ইচ্ছে করছে। পরপরই সেটা চাপা পড়ছে না যাওয়ার ইচ্ছেতে। যাওয়ার ইচ্ছে হেতু অবশ্যই পুষ্পিতা।
কিন্তু আজকে একটা ভিন্ন কারণে প্রকাণ্ড দোটানায় থুবড়ে পড়েছে সে।
গতকাল যে মেয়ে ফুল দিতে অফিস রুমে এসেছিল? সেও তো এই ক্লাসেরই। যদিও নাম জানে না তীব্র। কিন্তু ভিতু মেয়ের সাথে বেশ কয়েকবার দেখেছে।
আর আজকের এই দোটানার কারণ সেই মেয়েই। এমন ফালতু মুসিবতে তীব্র কোনওদিন পড়েনি। জীবনে প্রথম তাকে কোনও মেয়ে প্রেমের প্রস্তাব দিতে এসেছিল। বাড্ডাতে তো মেয়েরা চোখ তুলেও দেখার সাহস পায়নি। সেটাই ভালো ছিল। এই স্যার স্যার ড্রামা করার পর থেকেই তার সাথে যত্ত হাবিজাবি ঘটছে।
সব থেকে বড়ো কথা, তীব্রর এখন ও মেয়ের দিকে তাকাতেও অস্বস্তি হবে না? ধ্যাত্তেরি! কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই।
সব মনঃদ্বিধার অবসান ঘটিয়ে, বাধ্য হয়ে ক্লাসে ঢুকল সে।
প্রতিদিনকার একই রুটিন। শিক্ষার্থীরা উঠে দাঁড়াবে। সালাম ঠুকবে। তীব্র ডানে-বামে না চেয়ে বলবে‘’ বোসো।”
আগের ক্লাসটা রহমত স্যারের ছিল। প্রতিদিন হোয়াইট বোর্ডে যা লেখেন,অমনই পড়ে থাকে। ভদ্রতা দেখাতে মুছেও যান না। তীব্রর মেজাজ এমনিতেই খারাপ,এটা দেখে আরো বিগড়ে গেল।
ইচ্ছে হলো বোর্ডটা মেরে রহমতের মুখ ভস্কে দিতে।
তীব্র একটা ছেলেকে বলে
“ মোছো এটা।”
ঝড়ের বেগে উঠে এলো সে। ডাস্টার তুলে
বড়ো যত্ন নিয়ে মুছল। তারপর গিয়ে পূর্বস্থানে বসল আবার। তীব্র বই-পত্রে ব্যস্ততা দেখায়। হঠাৎ এক ফাঁকে খেয়াল করল, ক্লাসে পুষ্পিতা নেই। অমনি নিভন্ত চাউনী সচেতন হলো তার। ভ্রু গুছিয়ে পুরো ক্লাসেই চোখ বোলাল তীব্র। পুষ্পিতা কেন,সেই মেয়েও নেই।
এরা কি আসেনি আজ?
তীব্র একটু ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে শুধাল,
“ ক্লাস ফাঁকা লাগছে কেন? কারা আসেনি?
মাঝের বেঞ্চ হতে একজন জানায়,
“ তনুজা আর সুন্দর মেয়েটা আসেনি স্যার । ওই যে মাথায় এত্ত বড়ো ঘোমটা দিয়ে রাখে না? সে।”
তীব্র যখন দেখল একটা ছেলে বলেছে এসব,জ্বলন্ত চোখে চাইল তার দিকে। চাউনীতেই যেন ভস্ম হবে সে। কত্ত বড়ো দুঃসাহস! তার ভিতু মেয়েকে তারই সামনে সুন্দর বলছে? তথাকথিত কারণে ঘুষি মেরে ছেলেটার মুখ ভোতা বানাতে তীব্র পারল না । তবে দাঁতের ফাঁকে রাগ চেপে বলল,
“ মেয়েটার একটা নাম আছে। এরকম বিশেষণ দিয়ে কখনও কাউকে ডাকবে না।”
“ ইয়ে স্যার সরি! আসলে নাম জানতাম না তো।”
“ না জানলে কথা বলবে না। মেয়েদের ব্যাপারে এতো আগ্রহ ভালো কিছু নয়। its a question of your character!”
একজন ফোড়ন কাটল মাঝখানে,
“ প্রশ্ন তোলার কিছু নেই স্যার। আমরা সবাই জানি, ওর চরিত্র এমনিতেই খারাপ।”
অমনি সমস্ত ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গেল। হাসি তো নয়,তীব্রর রাগের আগুনে এক চামচ ঘি!
টেবিল থাপ্রে হুঙ্কার ছুড়ল সে,
“ শাট আপ!”
স্বতঃস্ফূর্ত ক্লাসরুম তটস্থ হয় সহসা। তীব্রর সব ক্রোধ গিয়ে বর্তাল ছেলে দুটির ওপর।
“ এই তোমরা দুজন, স্টান্ড আপ। স্টান্ড আপ।”
এক ধমকে শশব্যস্ত উঠে দাঁড়ায় ওরা। তীব্র আদেশ করল কড়া গলায়,
“ যাও, বাইরে গিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকো।”
“ স্যার আমরা কী…”
“ আই সেইড আউট ফ্রম হিয়্যার!”
উচ্চধ্বনির বিপরীতে তাদের বলার কিছু নেই। স্যার যে হঠাৎ এতো রেগে গেলেন কেন! মুখ গোঁজ করে হাঁটা ধরল ওরা৷ বাইরে গিয়ে কান ধরে দাঁড়াল। ক্লাসের বাকীরা তখন চুপচাপ পিঠ টানটান করে বসে।
তীব্র নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। পড়ানোরও এক ফোঁটা ইচ্ছে নেই। কেমন যেন ভেতর থেকেই হারিয়ে গেছে জোরটা। বইয়ের প্রতি পাতাতেও যেন প্রশ্ন লেখা আছে,
“ ভিতু মেয়ে আসেনি কেন আজ?”
ছেলেটা ক্লাস শেষ করল ছটফটিয়ে। এক মুহুর্তও দাঁড়াল না তারপর। হনহনে পায়ে রওনা করল ফোরকানের কক্ষে।
বহুদিন পর তাকে দোরগোড়ায় দেখে ভদ্রলোক আশ্চর্য হলেন খুব। ভাবটুকু ঢেকে,গদগদ হয়ে বললেন,
“ আরে তীব্র, এসো এসো! ভেতরে এসো।”
তীব্র ঢুকল। ফোরকান চেয়ার দেখায়,
“ বোসো। কী ব্যাপার, হঠাৎ কী মনে করে?”
তীব্র বসেনি। সাথে সাথেই বলল,
“ বোসবো না স্যার। আমার এক্ষুনি বাসায় ফিরতে হবে। সেটাই বলতে এসেছি আপনাকে!”
ফোরকানের কপাল বেঁকে যায়। এক পল ঘড়ি দেখে বললেন,
“ এখন? ছুটি হতে তো আরো অনেক সময় বাকী!”
“ জানি। তবে আমার আর ক্লাস নেই। ভীষণ জরুরি,তাই বলছি। নাহলে আপনি তো জানেন,আমি পড়াশোনার ব্যাপারে কত স্ট্রিক্ট?”
এ যাত্রায় ফোরকান দমে এলেন৷ কথাটা সত্যি। ছেলেটা যে পড়ালেখার বিষয়ে কতটা সিরিয়াস,তার থেকে ভালো কে জানে! হেসে বললেন,
“ আচ্ছা, যাও তাহলে।”
“ থ্যাংক ইউ স্যার।”
নূহা তৈরি হচ্ছে ভার্সিটির জন্য। অথচ মেজাজের অবস্থা বেশ চড়া৷ তারওপর আজ থেকে পরীক্ষা শুরু হবে। সময় বারোটা,কিন্তু আগেভাগেই যাবে ও। ভার্সিটির ওদিকটায় রাস্তা সাড়াইয়ের কাজ চলছে। আজকাল জ্যাম পড়ে খুব। কোনও ভাবে যদি পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়? বাড়িতে তো আর কাজ নেই। হলের সামনে গিয়েই বসে থাকবে না হয়!
নূহা ফাইল পত্র কাল রাতেই গুছিয়ে রেখেছিল। অথচ বের হতে হতে দশটা প্রায়। সব হাতে নিয়ে একবার বিছানার দিকে চাইল ফিরে৷ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে পুষ্পিতা। দিন-দুনিয়ার কোনওকিচ্ছুতে খেয়াল নেই । নূহা একবার ভাবল ডাকবে ওকে। দোর আটকাতে হবে না? কিন্তু তন্দ্রিত পুষ্পিতার মলিন মুখখানায় পালটে নিলো সিদ্ধান্ত৷
কাল সারারাত মেয়েটা জেগেছিল। শুধু চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিংটাকে এক ধ্যানে দেখেছে। এক ফোঁটা নড়েনি,কথা বলেনি। এটা-সেটা বলে নূহাকে বিরক্তও করেনি। ঘুমন্ত মায়াবীর দিক চেয়ে মুচকি হাসল সে।
মেয়েটা অহেতুক এমন উদাস উদাস থাকে।
যদি জানতো, ওর প্রেমে এক মাস্তান আড়ালে আবডালে কী লঙ্কা কাণ্ডটাই না ঘটাচ্ছে!
নূহার হাসি বাড়ল। মাথা নুইয়ে পুষ্পিতার কপালে চুমু দিলো একটা। ওরা একই বয়সী! বড়োও হয়েছে একসাথে। কিন্তু পুষ্পিতাকে নূহার একটা বাচ্চা খরগোশ মনে হয়। মানুষের পায়ের ছাপ দেখলেও,খরগোশ যেমন গুটিশুটি মেরে থাকে? পুষ্পিতাও অমন।
নূহাই তো আগলে আগলে রেখেছে এতো কাল। অবশ্য এবার থেকে ছুটি ওর। এই দায়িত্ব স্বেচ্ছায় অন্য একজন কাঁধে নিচ্ছে যে!
নূহা আর ডাকল না ওকে। চুপচাপ চাবি হাতে তুলল। ফাইল নিয়ে বাইরে এসে লক আটকানোর মাঝেই অফিসের জন্যে বেরিয়ে এলো নাহিদ। পাশ ফিরে নূহাকে দেখেই বলল,
“ গুড মর্নিং!”
উৎফুল্ল চিত্ত তার।
নূহার কানে কথাটা গেল,কিন্তু কোনও জবাব দিলো না আজ।
নাহিদ গলার জোর বাড়িয়ে বলল,
“ মিস নূহা, শুভ সকাল!”
এবারেও তার উত্তর এলো না। ছেলেটা কপাল গোছায় এবার। বিস্ময়ে চোখ আকাশে উঠল, যখন নূহা শব্দহীন পাশ কাটিয়ে নেমে গেল নিচে। বিভ্রমে এক চোট চুবানি খেল নাহিদ। মিস নূহা ওর সাথে কথা বলল না? কেন, হঠাৎ কী হলো?
নূহা ততক্ষণে সিঁড়ি ভেঙে নামছে। স্লিপারের জুতোটা মোজাইকের মেঝেয় টসটস করছে শব্দে। নাহিদ আর ভাবনাচিন্তা করল না। ত্রস্ত পিছু নিলো তার। পথে হাজারবার ডাকল,
“ মিস নূহা,এনিথিং রং? কিছু হয়েছে আপনার? নূহা, শুনছেন?”
এতো গুলো কথার পিঠে নূহার ফিরতি জবাব শূন্য। নাহিদের মাথাটাই এবার গরম হয়ে গেল। লম্বা পায়ে এসেই, পেছন হতে হাতটা টেনে ধরল ওর।
নূহা থমকে দাঁড়ায়। তবে চমকায় না। একটিবার ঘুরে দেখলও না পেছনে। গম্ভীর গলায় বলল,
“ হাত ছাড়ুন।”
নাহিদের সন্দেহ প্রগাঢ় হলো এবার। ঠিক বুঝেছে। কিছু একটা হয়েছে এই মেয়ের। কিন্তু সে করেছে টা কী!
হাত নাহিদ ছাড়ল না। তবে পেছন থেকে এক পা ফেলে পাশে এসে দাঁড়াল,
“ আপনি কি কোনও কারণে রেগে আছেন?”
নূহা নিরুত্তর। নাহিদ অধৈর্য হয়ে বলল,
“ আহা, এমন করছেন কেন? সবটা খুলে না বললে আমি কী করে বুঝব বলুন!”
নূহার কণ্ঠ থমথমে,
“ কী বলব? একটা গুণ্ডার সাথে আমার বলার মতো কোনও কথা থাকতে পারে?”
তুরন্ত আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল নাহিদ। হকচকিয়ে বলল,
“ গুণ্ডা? কে গুণ্ডা?”
নূহার আর শান্ত থাকা হলো না। গায়ের শক্তি দিয়ে, এক ঝটকায় ছাড়িয়ে আনল হাত। ফুঁসে উঠল বাঘিনীর মতো,
“ ঢং করছেন? কে গুণ্ডা আপনি জানেন না? লজ্জা করে না এতো মিথ্যে বলতে? জ্বিভটাও কাঁপে না মিস্টার নাহিদ? ওয়েট ওয়েট,আপনি নাহিদ তো? না কি আপনারও আপনার বন্ধুর মতো কোনও সিক্রেট নাম আছে?”
নাহিদের বাঁকানো ভ্রু টানটান হয়ে যায়। মনে পড়ল গত কালকের কথা। বিট্টু তো বলেছিল, নূহা সব জেনে গেছে। এই রে,মেয়েটা কী ভাবছে তাহলে? বিট্টু মাস্তানের বন্ধু বলে সেও মাস্তান?
নূহা মনে মনে আহত হলো ওকে চুপ থাকতে দেখে। ঢেঁড়সটা নিজের হয়ে একটা কোনও সাফাইও গাইবে না?
রেগেমেগে বলল.
“ কী, আসল জায়গায় ঘা পড়েছে তাই না? আমি কখনও শোবিজওয়ার্ল্ডের কাউকে দেখিনি। দেখার যা আক্ষেপ ছিল সেসবও মিটে গেছে এখন। কেন জানেন?”
নাহিদ বোকার মতো মাথা নাড়ল দুপাশে। এতেই নূহা চেতে গেল আরও।
“ অ্যাই, একদম এসব নাটক করবেন না। কী ভেবেছেন টা কী? এরকম বোকাসোকা একটা মুখ করে রাখলে,অবুঝ অবুঝ হাবভাব করলেই আমি ভুলে যাব আপনার আসল পরিচয় কী? আপনি যে বিট্টু মাস্তানের বন্ধু সে কি আমি জানি না? সব জেনে গেছি আমি। সত্যি বেশিদিন চাপা দিয়ে রাখা যায় না বুঝেছেন? মাস্তান কোথাকার!”
নাহিদের দুই চোখ কপালে উঠে যায়। উদ্বেগ নিয়ে বলল,
“ এই না না, আমি মাস্তান নই। বিশ্বের যত গালি আছে সব দিন প্লিজ্! কিন্তু যেটা আমি নই, সেটা বলবেন না!”
নূহা ধমকে বলে,
“ চুপ করুন। মাস্তান কে কী বলবে টা কী মানুষ? ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় মাস্তানি করে বেড়ায় আর তাকে মাস্তান বললেই খারাপ লাগে তাই না?”
নাহিদ জ্বিভ কেটে বলল,
“ ছি! ছি! যে কাজ আমার জীবনে করিনি সেই কাজের সার্টিফিকেট দিলে খারাপ তো লাগবেই।”
নূহা ফোস করে শ্বাস ফেলল এবার। ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,
“ দেখুন, আজ আমার পরিক্ষা। আপনার সাথে তর্ক করার সময়, ইচ্ছে একটাও নেই। দয়া করে আপনি আপনার রাস্তা মাপুন।”
“ তা বললে কী করে হয়? আপনি না জেনে আমাকে ভুল বুঝছেন, সেটা ভাঙানো তো আমার দায়িত্ব!”
নূহা কড়া কণ্ঠে বলল,
“ ভুল বুঝছি? আপনার কি আমার ধারণা শক্তিকে এতো ঠুনকো মনে হয়? আমি না জেনে কথা বলার মানুষই নই! আপনার সাথে কথা বলতে চাই না,মানে চাই না।”
নাহিদ নাছোড়বান্দা। পালটা যুক্তি দিলো,
“ দেখুন মিস নূহা! আপনার চিন্তাভাবনা ঠুনকো কী না জানি না,তবে আমি মনে করি আমাদের সম্পর্কটাও ঠুনকো নয়। আপনি কথা বলবেন না বললেই আমি চলে যাব? কক্ষনও না।”
নূহা আশ্চর্য চোখে চাইল। কী বলল লোকটা? আমাদের সম্পর্ক? অতো ক্ষোভের মাঝেও এই একটা কথায় নূহার বুক ধুক ধুক করে ওঠে। ঝগড়ার বাণে ফুঁসতে থাকা জ্বিভটা মুখগহ্বরে নেতিয়ে যেতে চায়।
তখন হুট করেই ওর হাতটা মুঠোয় ধরল নাহিদ। একই স্পর্শ! নাহিদ আগেও হাত ধরেছে। অথচ এতো ছলকে উঠল মেয়েটা! মুখ তুলতেই নাহিদের নিভন্ত চোখে দৃষ্টি মিলে গেল। থতমত ভাবটা ঢাকতে চেয়েও ব্যর্থ হলো নূহা। অপ্রস্তুত ছাপ বেশ চওড়া করে প্রলেপ তুলল মুখে।
তবে নাহিদের এসবে মন নেই। সে নিজের মতো কথা বলছে। বড্ড নরম আর কাতর সেই স্বর,
“ প্লিজ, একটু শান্ত হয়ে আমার কথাটা শুনুন! দেখুন,আমি সত্যিই মাস্তান নই। হ্যাঁ, আপনি একদম ঠিক জানেন। বিট্টু আমার বন্ধু। ইনফ্যাক্ট আজ আমি বলব, ও আমার জীবনের সবথেকে ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে! যে আমাকে এক কথায় বিশ্বাস করে,ভরসা করে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি মাস্তান। বিট্টু মাস্তান থাকাকালীন আমি ওর সাথে মিশেছি,আড্ডা দিয়েছি। কিন্তু কোনওদিন একটা লাঠি অবধি হাতে ধরে দেখিনি। ছুড়ি-কাঁচি তো অনেক বিশাল ব্যাপার।
আপনার বিশ্বাস নাহলে বিট্টুকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। তাও এভাবে আমাকে ভুল বুঝবেন না নূহা। আমার সত্যিই তাহলে ভীষণ কষ্ট হবে! আপনার সাথে আমার এই বন্ধুতের সম্পর্কটাকে আমি বড্ড মনে গেঁথে নিয়েছি। এটা কে একটা ভিত্তিহীন বিষয়ের জের ধরে নষ্ট করে দেবেন না। অনুরোধ করছি আপনাকে! ”
নূহার মন গলল কী না কে জানে! তবে মেয়েটা বিমুঢ় হয়ে রইল। মূক নয়ন জোড়া আচমকা টলটল করছে জলে। ঠোঁট দুটোতে তিরতিরে কম্পন। একবার নাহিদের ধরা হাত,আরেকবার ওর নিষ্পাপ মুখখানা দেখল সে। সাথে মনে হলো,তার বুকের কোষগুলোও কাঁপছে। প্রচণ্ড উত্তাল ঢেউ এলে একটা স্থির নৌকা যেমন দুলে দুলে ওঠে? অমন করে অলিন্দের চারপাশ ছলকে উঠছে কিছুতে। এই অনুভূতি ভিন্ন! যা নূহার আগে কক্ষণও হয়নি।
পিঠের হাঁড় থেকে বক্ষের মাঝখান? সবেতে একটা দুধ সাদা গলগলে স্রোত! পুষ্পিতা সেদিন বলেছিল না? তীব্র স্যারের প্রেমে পড়ে ওর এমন কিছু হচ্ছে! তবে কী আমিও!
নূহার বুকটা ছ্যাত করে উঠল। চমকে চাইল নাহিদের দিকে।
সেই দৃষ্টিতে নাহিদের সব গুলিয়ে যায়। বোকা ছেলে ভাবল, ও এখনও রেগে। পরিতাপে একাকার হয়ে বলল,
“ আচ্ছা বুঝেছি, এসব আপনাকে আগে জানাইনি বলে আপনার খারাপ লেগেছে? কী করে জানাব বলুন! বিট্টুর টপ সিক্রেট এটা। বন্ধু হয়ে বন্ধুর সিক্রেট কারো কাছে বলে দেয়া যায়?
আপনারও তো বেস্টফ্রেন্ড আছে,আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন? বাট, তাও সরি! আপনার রাগ কমানোর জন্য হলেও সরি বলছি আমি । এই দেখুন কানও ধরছি।”
একটা হাত তুলে বাম কানের লতি ছুঁলো নাহিদ। নূহা তখনও মূৃর্তি। ঠকঠক করা হাতে কোনও রকম মুখের ঘাম মুছল। হঠাৎ কেমন শরীর খারাপ করছে। গা গোলাচ্ছে,মাথা ঘুরছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“ পানি,পানি খাব!”
তীব্রর জিপটা আজ ঠিক বাড়ির সামনে থেমেছে। ড্যাশবোর্ডে চাবি ঘুরিয়েই সে ত্রস্ত বেগে নামল। গেট দিয়ে ঢুকতে নেবে, হঠাৎ চোখ পড়ল অন্য কোথাও। একবার বেখেয়ালে চেয়েও,আবার চটক কাটার ন্যায় ঘুরে চাইল তীব্র। হাত দুয়েক দূরের ঐ চায়ের দোকানটার টুলে বসে আছে নূহা। নাহিদ পাশেই দাঁড়িয়ে। তবে কাজে বহাল সে। বোতল কাত করে মুঠোতে জল ঢেলে ঢেলে লাগাতার মেয়েটার মাথায় দিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টায় তীব্রর খটকা লাগে! এদের হঠাৎ এই অবস্থা কেন?
কৌতূহলে টিকতে না পেরে এগিয়ে এলো সে।
নাহিদ তখন নূহাকে নিয়ে ব্যস্ত। চিত্তে তার দিশেহারা ভাব। এই তো একটু আগেই মেয়েটা সুস্থ-সবল ছিল। কেমন ফটর-ফটর করে ঝগড়া করছিল ওর সাথে। হঠাৎ এমন হলো কেন? উদ্বীগ্ন সে এই নিয়ে হাজারবার শুধাল,
“ আপনি ঠিক আছেন এখন? একটু কি বেটার লাগছে?”
বরাবরের মতো নূহা কিছু বলল না। কিংবা চেয়েও বলতে পারছে না। নাহিদ নিজেই বলল,
“ এখনও কি মাথা ঘুরছে নূহা? “
নূহার মনে হলো শুধু মাথা নয়, আস্ত দুনিয়াটাই ভো ভো করছে সামনে। কী সর্বনাশ! হায় আল্লাহ! শেষে কী না এই ঢেঁড়সের প্রেমে পড়ল সে? ছিঃ দেশে কি আর ছেলে নেই? বিড়ালের মতো মেউ মেউ করা পুরুষ যে নূহার দুচোখের বিষ , সেই নূহার বর হবে এই নাহিদের মতো ক্যাবলা ছেলেটা?
নিজের ভাবনায় নূহা নিজেই হতভম্ব! তোড় সামলাতে রীতিমতো হেচকি উঠে গেল। নাহিদ আরো উত্তেজিত হয়। কী হয়েছে? ঠিক আছেন? এসব বলে বলে ফ্যানা তোলে মুখে।
নূহা বাকরুদ্ধ হয়ে দেখে যায় শুধু। মনে মনে হাহুতাশে গলা ফাটিয়ে বলে,
“ ইয়া আল্লাহ! এসব কী? ইয়া মা’বুদ মাটি ফাঁকা করো। এখনও কিছু হলো না,অথচ আমি বিয়ে অবধি চলে গেছি? ছিঃ”
এর মধ্যে তীব্র পাশে এসে দাঁড়াল। ভ্রু কুঁচকে দুজনকে দেখল একবার। জিজ্ঞেস করল,
“ কী হয়েছে? কোনও সমস্যা?”
অনুশোচনায়, নূহার চিবুক তখন গলাতে। তবে নাহিদ হড়বড়িয়ে ওঠে,
“ দ্যাখ না,উনি হঠাৎ করে এতো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন! ঠিক করে কথাও বলতে পারছেন না। কী করি বলতো!”
তীব্রর মাঝেও একটু চিন্তা দেখা গেল। আগে হলে হতো না। কিন্তু কালকের ওই ঘটনার পর নূহাকে তার যথেষ্ট ভালো লাগছে।
কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“ সে কী, হঠাৎ কী হলো তোমার?”
নূহা তীব্রর বেলায় আর চুপ থাকতে পারেনি। ছোটো করে বলল,
“ একটু মাথা ঘুরছে স্যার!”
“ আমি বরং ডাক্তারকে একটা ফোন করি!”
তীব্র ফোন বের করতে গেলেই, নূহা ত্রস্ত দাঁড়িয়ে যায়। শশব্যস্ত বলে,
“ না না, তার দরকার নেই। সামান্য মাথা ঘোরা। ঠিক হয়ে যাবে। আপনি ভাববেন না স্যার!”
তীব্র সংশয়ী,
“ আর ইউ শিয়র?”
“ জি।”
নূহা টেনেহিঁচড়ে ঠোঁটে হাসি আনল।”
মাথা নাড়ল সে। নাহিদ কে বলল,
“ তুই অফিস যাসনি এখনও?”
ছেলেটা যেন হুশে এসছে। এক হাত জ্বিভ কেটে বলল,
“ এই রে! আমার তো অফিসের কথা মনেই ছিল না। জীবনে প্রথম চাকরি করলে যা হয়! ইস,আজ আমার চাকরি থাকলে হলো!”
পরপরই চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
“ কিন্তু, মিস নূহাকে এই অবস্থায় ফেলে যাব কী করে! ওনার আজ পরীক্ষা। অলরেডি এগারটা চল্লিশ বাজে। মিস করলে তো এভ্রিথিং উইল বি লস্ট!”
এতো ভালো একটা কথাতেও, নূহা বিরক্ত হলো। আরেকদিক মুখ ঘুরিয়ে বিড়বিড় করল,
“ উহঃ কী দরদ রে! আমার জন্যে উনি অফিস যেতে পারছেন না। আমার ক্ষতি যা করার সেতো করেই ফেলেছিস রে বেয়াদব। এখন এসব আলগা পিরিত দেখিয়ে হবে টা কী?”
তীব্র একটু ভেবে বলল,
“ তাহলে বরং আমার গাড়ি নিয়ে যা। ওকে পৌঁছে দিয়ে, নিজে অফিসে যাস। অবশ্য আজকের পরেও চাকরি থাকবে বলে মনে হচ্ছে না।”
নাহিদ ঠোঁট উলটে মাথা চুলকাল। হুট করে দাঁত মেলে বলল,
“ থাক। কিছু হবে না। আবার একটা খুঁজে নেব!
তীব্র চাবি ওর হাতে দিয়ে ফিরতে নিলো। হঠাৎ থেমে বলল,
“ তোমার বন্ধু কোথায় নূহা?”
ভাবনায় বুঁদ নূহা নড়ে উঠল একটু।
“ হু? পুষ্পিতা? ঘরে,ঘরেই তো।”
“ ঘরে? তাহলে কলেজ যায়নি কেন?”
নূহা দুদিকে মাথা নাড়ে।
“ তাতো জানি না স্যার।”
“ বেশ,আমিই দেখছি।”
তীব্র যেতে নিলেই বলল,
“ স্যার,আমি তো ঘর বাইরে থেকে লাগিয়ে এসেছি। চাবি আমার কাছে।”
“ ও,ওকে চাবিটা দাও।”
নূহা একটু ইতস্তত করল। পুষ্পিতা বাড়িতে একা। তীব্র শত হলেও পুরুষ মানুষ! এভাবে বিশ্বাস করা কি ঠিক হবে?
তার মুখায়ব দেখেই তীব্র বুঝে নিলো ব্যাপারটা। বলল ভণিতাহীন,
“ এতো ভয় পাওয়ার কিছু হয়নি। তোমার বন্ধু যদি পৃথিবীর একটা মানুষের কাছে সেফ থাকে,সেটা আমি।”
তীব্রর গলার স্বর স্থির। অভঙ্গুর তার চিবুকের গড়ন। নূহা না চাইতেও মিইয়ে এলো প্রেমিকের ওই আস্বস্তির কাছে। হাজারটা টানাপোড়েন মনে রইলেও, ব্যাগ থেকে চাবির গোছা বের করে ঠিকই হাতে দিলো ওর।
সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৩৬
তীব্র উল্কার মতো প্রস্থান নেয়।
সেদিক চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে মেয়েটা। প্রেমে মজে এক বিট্টু মাস্তান শিষ্টে নিবিষ্ট স্যার বনে গেছে। আচ্ছা, যদি সত্যিই নূহাও প্রেমে পড়ে, তাহলে কী হবে ও? সন্ন্যাসী?