পাতা বাহার পর্ব ৩২
বেলা শেখ
অন্ধকারে ছেয়ে আছে পৃথিবী। কৃত্রিম আলোয় আলোকিত ঘরবাড়ি রাস্তা। কয়েক যুগ আগেও মানবমানবী অন্ধকার ভয় পেতো। সন্ধ্যা নামলেই আপন নীড়ে ফিরে আসতে কতো তাদের যাতনা। ঘোর অমানিশায় ঘরে অন্ধকারে ছোট্ট কুপি জ্বালিয়ে ঘরেই থাকতো। জোৎস্না রাতে চাঁদের ম্লান আলোয় রাতের আহার কার্য সম্পন্ন করে পাটিতেই বউ বাচ্চা সমেত রূপকথার রাজ্যে ঘুরে বেড়াতো। মশা, মাছি ও গরম তাড়ানোর জন্য হাতে হাত পাখা থাকতো। ধীরে ধীরে মানুষ অন্ধকারকে জয় করে। রাতের অন্ধকার দূরীকরণের জন্য তাদের চাঁদের জোছনার আলো প্রয়োজন পড়ে না।
তারা কৃত্রিম আলোয় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। জোৎস্নার ম্লান আলোয় স্নান করতে তারা জানেই না হয়তো।
অরুণ সরকার সন্ধ্যার বেশ পরপরই তার আপন নীড়ে ফিরে আসে। বাড়ি মেইন ফটক খোলা থাকায় অনায়াসেই প্রবেশ করে অন্দরমহলে। ড্রয়িং রুমের কাছে যেতেই নজরে আসে ছেলে,ছেলের আম্মু ও আনিকাকে। মিনু ও আভারি টেবিলে খাবার লাগাচ্ছে। অরুণ এগিয়ে যায়। ভোর ও আনিকা পড়তে বসেছে পাতার কাছে। চুপচাপ পড়ছে কোনো দুষ্টুমি না। যেন অতি ভদ্র বাচ্চা। অথচ অরুণ যখন ভোরকে হোমওয়ার্কের জন্য বসায় কত বাহানা কত দুষ্টুমি যেন মাছের বাজার! অরুণ পকেটে হাত গুটিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ এখনো তাকে দেখেনি।
পাতা গম্ভীর মুখে ভোরকে টুইংকেল টুইংকেল ছড়াটা বলতে বলে। ভোর উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্র বাচ্চার মতো ঠোঁট নাড়িয়ে বলতে শুরু করে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” টুইংকেল টুইংকেল লিটেল স্টার
হাউ আই এভোব দা ওল সো ..”
-” হচ্ছে না ভোর! আবার বলো?”
ভোর আবার চেষ্টা করে পারে না। তার মনে পড়ছে না। এমনি হয় তার সাথে। সে একা একা বলতে পারে। টিচার জিজ্ঞেস করলেই এলোমেলো হয়ে যায়। লজ্জায় ভোরের মুখশ্রীতে আঁধার নামলো। মাথা নিচু করে নেয়। পাতা আনিকাকে বলতে বললে আনিকা সুন্দর করে আবৃত্তি করে। এতে যেন ভোর আরো লজ্জায় পড়ে। আঁখি যুগল টলমল করে। ভোর বই নিয়ে আবার পড়তে শুরু করে। সেও আম্মুকে শোনাবে! অরুণ আর দূরে না থেকে এগিয়ে এসে গলা খাঁকারি দিল। পাতা মাথা উঁচিয়ে চায়। অরুণকে দেখে কতক্ষণ আহাম্মকের মতো তাকিয়েই থাকে। অরুণ ভ্রু কুঁচকে চায়। পাতা তবুও নজর হটায় না। আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে। দাঁড়ি গোঁফে ঘেরা অধর জোড়ায় নজর আসতেই সকালের কথা মনে পড়ে, সাথে মস্তিষ্কও যেন সচল হয়। গালে জিভ ঠেকিয়ে নিজেকে ধমকায়। জামাই বলে এভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাবি? পাতা মনকে কি বোঝাবে? সদ্য কেউ যখন কারো প্রেমে পড়ে মনে হয়
“দিনকাল জাত ক্ষণ পরিস্থিতি গোল্লায় যাক আঁখি যুগল শুধু তার দিকেই নিবদ্ধ থাক।“
আনিকা অরুণকে দেখেই মিষ্টি হেসে বলে,
-” বড় চাচ্চু? কখন এসেছ তুমি?”
গম্ভীর অরুণের মুখশ্রীতে হাসি না ফুটলেও স্বাভাবিক হয়। কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা কোন আইসক্রিম বের করে আনিকার দিকে বাড়িয়ে বলে,
-” মাত্রই এলাম মামুনি! কত সুন্দর করে রাইম বললে তার জন্য এই লিটেল গিফট!”
আনিকা খুশি মনে নিল। বই বন্ধ করে আইসক্রিম খুলে মুখে পুরে পাতাকে বলল,
-” চাচিমনি আমি আর পড়বো না। আমার সব কমপ্লিট!”
ভোর আনিকার আইসক্রিমের দিকে তাকিয়ে থাকে। আইসক্রিম তার প্রিয়। আব্বু তার জন্যও নিশ্চয়ই এনেছে। সে বাবা দিকে চায় আদুরে ভঙ্গিতে। অরুণ ছেলের চাহনি দেখে গম্ভীর মুখে বলল,
-” পড়া পারবেন না আর আপনাকে আইসক্রিম খাওয়াবো? ইন ইওর ড্রিমস!”
ভোরের গাল ফুলিয়ে পড়তে শুরু করে জোরে জোরে ‘টুইংকেল টুইংকেল’। পাতা মুখে হাত চেপে হাসে। অরুণ আর কিছু না বলে গম্ভীর মুখে পা চালায় নিজের রুমের উদ্দেশ্য। পাতা আড়চোখে তার দিকেই তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ দেখা যায়। ভোর বাবার প্রস্থান দেখে ফুলো গাল আরেকটু ফুলিয়ে পড়তে থাকে। আজ সে পড়ে পড়ে আর্থের সব পড়া কমপ্লিট করে ফেলবে,হুহ!
অরুণের যাওয়ার পর পাতা উশখুশ করে। মনটা কেমন যেন আঁকুপাঁকু করছে। আশ্চর্য তার সাথে এসব কি হচ্ছে? সে কি প্রেমে পড়ে পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি। সে ভোরকে ভালোভাবে পড়া বুঝিয়ে দিয়ে ‘তুমি পড় আমি আসছি’ বলে উঠলো। উঠে কোথায় যাবে? ‘হে হে’ করে পাতার মনটা হেসে সিঁড়ি বেয়ে নিজের কামরায় যায়। সেখানে গিয়ে দেখলো শু’স ,কোর্ট, কটি, টাই, মুজো জোড়া ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পাতা অরুণের দিকে কটমট করে চায়।
-” এগুলো নিচে ফেলেছেন কেন? আশ্চর্য এটা কোন ধরনের ম্যানারস? এসেই সব ছুড়াছুড়ি!”
অরুণ পিছন ফিরে পাতার দিকে চায়। হাত চালিয়ে শার্টের সব বোতাম খুলে শার্টটাও ঢিল দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তবে সেটা পাতা ক্যাচ করে নেয়। অরুণ আলমারির দিকে অগ্রসর হয়ে চিরচেনা গম্ভীর জবাব দেয়,
-” আদর করে ম্যানারলেস ডেকে ম্যানারস আশা করো কিভাবে মিসেস পাতাবাহার?”
পাতা চোখ পিটপিট করে আড়চোখে অরুণের বলিষ্ঠ পিঠের দিকে নজর দেয় বারংবার।
-” আপনি সত্যিই ম্যানারলেস লোক! এগুলো কে তুলবে? এখন আমি তুলছি। পরবর্তীতে ফেললে আর তুলবো না। আপনাকেই তুলতে হবে। তাই আর ফেলবেন না!”
-” আমি তো ফেলবোই!”
বলেই গটগট করে ওয়াশ রুমে ঢুকে যায় অরুণ। পাতা স্থীর হয়ে দাড়িয়েই। লোকটা তার পাশ ঘেঁষেই গেলো। সাথে সাথে তার শরীরের পারফিউম ও পুরুষালী গন্ধটা ডিফিউশনের মতো তার নাসা গহ্বরের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করে মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়লো।
একটু পরেই অরুণ বেরিয়ে আসে। পরনে অ্যাশ কালারের টি শার্ট, কালো ট্রাউজার। চুলগুলো পরিপাটি না, এলোমেলো হয়ে কপালে পড়ে আছে। এতে যেন লোকটার সৌন্দর্য বেড়ে গেল। পাতা নজর সরিয়ে নেয়।
-” কেমন কাটলো সারাদিন?”
-” ভালোই!”
বলে পাতা অরুণের দিকে তাকায়। তাকিয়েই হতাশ। গোমড়া মুখে লোকটা ব্যাগ হাতাচ্ছে।
-” স্যরি আমি ভোরের পুরোপুরি খেয়াল রাখতে পারিনি!”
কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে অরুণের,
-” কি হয়েছে কলিজার?”
-” ওই দৌড়ে পড়ে গিয়ে হাঁটু ছিলে গেছে। বেশি না এই একটু!”
মিনমিনে বলে পাতা। এখন না লোকটা ঝাড়ি দেয়! সকালে কতবার করে বললো খেয়াল রাখতে। অথচ!! অরুণ দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।
-” একটুও শান্ত থাকবে না। সবসময় দৌড় ঝাঁপ! একটার পর একটা লেগেই থাকে ছেলেটার! কেঁদেছে?”
পাতা না বোধক মাথা নাড়ল। লোকটা বকলো না!! অরুণ ব্যাগ থেকে অনেক গুলো কোন আইসক্রিম বের করে বিছানায় রাখলো।
-” শুধু একটা কলিজার। বাকি গুলো তোমার! একটার বেশি ওকে দিবে না। ওর ঠান্ডা সবসময় লেগেই থাকে। ফ্রিজে রাখো! গলে গেল বলে!”
এই ঘরটা একটা মিনি বেকারি স্টোর! একটা মিনি ফ্রিজ ও একটা মিনি আলমারি আছে। আলমারিতে বিভিন্ন কেক, বিস্কুট, ক্যাডবেরি সহ বিভিন্ন সদাই সামগ্রী। এবং আলমারিটা লক বিহীন।ফ্রিজে বিভিন্ন ফ্লেভারের আইসক্রিম, বিভিন্ন সফট ড্রিংকস, জুস ইত্যাদি। তবে ফ্রিজটা লক করা। আর তার চাবি পাতার কাছে গচ্ছিত বর্তমানে। পাতা সব আইসক্রিম নিয়ে ফ্লিজে রাখে।
-” ভোরের জন্য এনেছেন ঠিক আছে! আমার জন্যে আইসক্রিম? আমি কি বাচ্চা নাকি?”
-” আইসক্রিম খেতে বাচ্চা হতে হয়? আইসক্রিম সবারই পছন্দ! ইভেন আমারও!”
পাতা তড়িৎ গতিতে অরুনের দিকে তাকায়। হেসে বলল,
-” আপনিও তো বাচ্চাই?”
অরুণ পাতার দিকে চায় শান্ত চোখে।
-” হ্যা সাঁইত্রিশ বছরের বুড়ো বাচ্চা!”
পাতার ভালো লাগলো না কথাটা। লোকটা তো পরোক্ষভাবে পাতার জামাইকেই বুড়ো বললো। এতো সুন্দর ফিট হ্যান্ডসাম জামাই তার, মেয়েরা দেখলে হুমরি খেয়ে পড়বে। আর তাকে বুড়ো বলা! পাতা প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে,
-” ভোরের ওই হোম টিউটর কি যেন নাম!!”
-” টুম্পা! কেন?”
পাতার মুখটা চুপসে যায়।
-” কি যেন বলবে শুধু আপনাকেই আমাকে বললো না!”
অরুণ উঠে দাঁড়িয়ে ঘার এদিকে ওদিকে করে। ঘারটা ব্যাথা করছে অল্প অল্প।
-” কথা হয়েছে তার সাথে। ফোন করেছিল!”
পাতার গালটা এবার ভোরের মতো ফুলে যায়। কিন্তু সেটা অরুণের নজরে পড়ে না। এটা দেখে পাতা আরো হতাশ।
-” মেয়েটা খুব সুন্দর তাই না?”
-” হুম! স্পেশালি চুল গুলো! অনেক লম্বা! ভালোই!”
সাথে সাথেই সরল মনে জবাব দেয় অরুণ। অপর দিকে যে মলিন মুখে তার দিকে চেয়ে আছে সে ধ্যান নেই। পাতা অরুণের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। অরুণ ঘার নিচু করে তার দিকে চায়। পাতা তার থেকে উচ্চতায় বেশ ছোট বুক পর্যন্ত হবে টেনেটুনে। পাতা আঙ্গুল উঁচিয়ে অরুণের মতো গম্ভীর গলায় বলল,
-” বাহ্ পরনারীর চুলও দেখা হয়! অথচ আলাভোলা মুখ দেখে মনে হয় ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেন না।”
অরুণ চোখ ছোট ছোট করে চায়। দূরত্ব কমিয়ে এগিয়ে আসে পাতার নিকটে। ঝুঁকে আসে খানিকটা। পাতা সরে না একটুও। সিনা টান টান করে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটা তার কাছে। একেঅপরের শরীর ছুঁই ছুঁই হলেও ছোঁয় নি। অরুণ গম্ভীর গলায় ধীমে সুরে বলে,
-” জেলাস হুম?”
দুজনের চোখই দুজনের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।লোকটা তার দিকে ঝুঁকে। নিঃশ্বাসের ক্ষীণ বাতাস তার মুখশ্রীতে দোলা দিচ্ছে। ছোট ছোট নেত্রযুগল যেন পাতাকে সম্মোহন করছে। আর পাতা সম্মোহিত হয়েও যায়। সম্মোহনের সুরেই বলল,
-” হুম!”
অরুণ অধরজোড়া চোখা করে পাতার মুখশ্রী জুড়ে ফুঁ দেয়। পাতা আবেশে চোখ বুজে নেয়। অধরে লজ্জালু হাসি ও কপোলজোড়া লালিমায় ছেয়ে গেছে। অরুণ পকেট থেকে হাত বের করে সেথায় আলতো ছুঁয়ে দেয়। পাতার ডাগর শান্ত কাজল নেত্রযুগল খুলে যায়। অভিজ্ঞ অরুণ পড়ে নেয় সেই চোখের ভাষা। তবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না। সরে আসে নিরাপদ দূরত্বে।
ভোর দরজার সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে। মাথাটা উঁকি দেয় ঘরের ভিতরে। ঘরে বাবার সাথে আম্মুর উপস্থিতি দেখে স্বস্তি পায়। স্বশরীরে প্রবেশ করে হাসিমুখে। অরুণ খাঁচা খুলে বিড়ালকে বের করে। পাতা তাকে বেশিরভাগ সময় বন্দি করেই রাখে। কেন? কারণ বিড়ালটা অরুণের আশেপাশে মিও মিও করবে আর গা ঘেষবে। সুযোগ পেলেই কোল দখল করবে। বিড়ালশাবকটি ছাড়া পেয়েই মিও মিও করে শতখানা অভিযোগ দায়ের করে। কিন্তু বিচারপতি তার অভিযোগ বুঝতে অক্ষম। তাই সে দৌড়ে গিয়ে ছোট মালিকের কোল দখল করে। ভোর তাকে কোলে নিয়ে পাতার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ‘টুইংকেল টুইংকেল’ পুরোপুরি আবৃত্তি করে সুন্দর ভাবে। পাতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” অনেক সুন্দর হয়েছে ভোর! দেখেছো চেষ্টা করলে সব পারা যায়!”
ভোর মিষ্টি হেসে আড়চোখে বাবার দিকে চেয়ে বলল,
-” আম্মু এখন আমার আইসক্রিম?”
অরুণ ছেলের আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে। তার থেকে ক্ষত লুকাতে ফুল প্যান্ট পড়ে আছে।
-” পাবেন। আগে বলুন এই গরমে ফুল প্যান্ট কেন পড়ে আছেন?”
ভোর জিভে কামড় দিয়ে বিড়াল শাবকটিকে ছেড়ে দেয়। কোমড়ের কাছের প্যান্টের অংশ টেনে ধরে মিষ্টি সুরে বলল,
-” ওই ওই গরম না না ঠান্ডা লাগছিলো”
-” এই গরমে ঠান্ডা লাগছিলো?”
-” হুম?”
-” কতটুকু ক্ষত হয়েছে দেখি?”
ভোর গোমড়া মুখে পাতার দিকে চায়। আম্মু সব বলেদিলো? এখন আইসক্রিম তো পাবেই না সাথে এক গাদা বকা। সে গোমড়া মুখেই প্যান্ট টেনে খুলে ফেলল। পড়নে হাফ প্যান্ট আছে। অরুণ ছেলেকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। বেশি না অল্পই ক্ষত। অনেক জ্বলেছে নিশ্চয়ই। পাতাবাহার বলল কাঁদে নি!! সে ক্ষত স্থানের আশেপাশে ঠোঁট বুলিয়ে আদর করে।
-” অনেক ব্যাথা করেছে কলিজা? এখনো জ্বলছে?”
-” তুমি আদর করে দিয়েছো আর করছে না।”
-” আমার আব্বু! কলিজা! সোনা কত বলি সাবধানে চলাচল করতে! একটুও শোনো না। এখন কার ব্যাথা করছে?”
-” আব্বুর!”
হেসে অরুনের গালে চুমু দিয়ে বলে ভোর! অরুণ ছেলেকে দেখে নয়ন জুড়িয়ে। সত্যিই তার ব্যাথা করছে। পাতা গলা খাঁকারি দেয়। বাবা ছেলের আবেগমাখা সিন আবার শুরু। পাতা তো প্রথম প্রথম নিজের চোখ কানকেই বিশ্বাস করতে পারতো না যে এ অরুণ সরকার এতটা আদুরে গলায় কথা বলতে পারে ।
-” হয়েছে বাবা ছেলের? নিচে চলুন! খেয়ে নিবেন। ভোর চলো? তুমি না বললে ক্ষিধে পেয়েছে তোমার?”
-” হুম!”
অরুণ ছেলের গালে ঠোঁট চেপে চুমু দিয়ে পা বাড়ায়। পাতা তাদের পিছনে হাঁটে আর তার পিছনে পাতাবাহার। ভোর হাসিমুখে বলল,
-” আমার আইসক্রিম?”
-‘ খাওয়ার পর পাবে!”
-” আব্বু দাদি না আমাকে একটা বড় গাড়ি ও বন্দুক এনে দিয়েছে শপিং মল থেকে।”
-” তাই?”
-” হুম”
পাতা হাসে তখন গোমড়া মুখে ছিলো উপহার পেয়েই খুশি। দাদির প্রতি সব অভিমান ভুলে গেছে।
ওরা গিয়ে ডাইনিং-এ বসে। আসমা বেগম আগেই বসে আছে। তাদের দেখে মুচকি হাসলো। অরুণ ভোর টুকটাক কথা বলে। পাতা অরুণের পিছনে লুকিয়ে চুরিয়ে থাকার চেষ্টা করে। শাশুড়ির নজরে পড়লে না জানি কোন ত্রুটি বের করে। একটু পরে আদুরি, আরিয়ান ও রুবি আসে। রুবির কোলে ঘুমন্ত রূপ। তারা নিজেদের আসন গ্রহণ করে। আদুরি হাসিমুখে বলে,
-” বড় ভাবী লুকিয়ে আছো কেন? মা’য়ের ভয়ে?”
পাতা চোখ বড় করে চায়। আদুরি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।
-” বড় ভাইয়া তোমার বউ মা কে সেইরকম ভয় পায়। মায়ের আশেপাশেই ঘেঁষে না দরকার ছাড়া। দেখলেই পলাই পলাই!”
আসমা বেগম মেয়েকে চোখ রাঙায়। অরুণ পিছনে মুড়ে তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা পাতার দিকে একবার চায়। কিছু বলে না। আরিয়ান আদুরির মাথায় টোকা দিয়ে বলে,
-” তোর বড় ভাবী ভয় পায়? যে ঝগরুটে মেয়ে! একটা কথাও ছেড়ে দেবে না!”
পাতা মনে মনে ভেংচি কাটলো। শালা তুই তো সাধু! মিনু ও পাতা সকলের খাবার পরিবেশন করে। সবাই খাওয়া শুরু করে! অরুণ পাতাকে ইশারায় খেতে বসতে বলে। পাতা রুবির দিকে চায়। রুবি খানিকটা গম্ভীর মুখে ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে, খাবার খাচ্ছে না।
-” আপু রূপকে আমার কাছে দিন! আর আপনি খেয়ে নিন?”
-” ইটস ওকে বড় ভাবী! আই ক্যান ম্যানেজ!”
-” আরে দাও তো! রূপ বাবা তার ঝগরুটে চাচি মনির কাছে যাবে!”
আরিয়ানের কথায় আনিকা, ভোর হেসে কুটিকুটি।রুবি দেয়। পাতা আরিয়ানের দিকে কটমটে চেয়ে ঘুমন্ত রূপকে নিয়ে অরুণের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। ভোর বাবার কোলে বসে খাচ্ছে আর আড়চোখে পাতার কোলে রূপের দিকে তাকাচ্ছে। তার আম্মুর কোলে উঠে আদর খাওয়া হচ্ছে? আসমা বেগম খাওয়া শেষ করে। বেসিনে হাত ধুয়ে এসে আবার বসে চেয়ারে। একটু উশখুশ করে। অরুণ সেটা লক্ষ্য করে ছেলের মুখে খাবার দিয়ে বলে,
-” কিছু বলবে ছোটমা?”
আসমা বেগম কথা বলার ওয়ে পায়।
-” হুম। একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই! এখন ব্যাপারটা হচ্ছে তুমি কিভাবে নেবে?”
অরুণের কপালে ভাঁজ পড়লেও স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করে,
-” কি কথা? নির্দ্বিধায় বলো!”
-” আসলে রুবি ব্যাংকের চাকরিটা করতে চাইছে না। ছেড়ে দেবে।”
আরিয়ান রুবি দুজনেই চুপচাপ। আজকে এটা নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা হয়েছে। আদুরি অবাক সুরে বলে,
-” কেন ছোট ভাবী? এতো ভালো চাকরি!”
-” ছেলেটা ছোট! ওকে নিয়ে ব্যাংকে গেলে অনেকেই কানাঘুষা করে। বড় স্যারও কেমন করে কথা বলে তাই ভেবছি রিজাইন করবো!’
রুবির স্বাভাবিক জবাব। আসমা বেগম অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” এখন ও চাইছে অফিস জয়েন করতে! তুমিও তো ছেলেকে নিয়েই অফিস করেছো! আর নিজেদের অফিসে অনেক সুযোগ-সুবিধা পাবে। এখন তুমি কি বলো?”
অরুণের গম্ভীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। কিসের হাসি?
-” আমি কি বলবো? নিজেদের অফিস! যখন খুশি জয়েন করতে পারো রুবি! ওলয়েজ ওপেন ফর ইউ!”
রুবি হেসে বলল,
-” থ্যাংক ইয়ু ভাইয়া!”
-” ধন্যবাদের কি আছে! অফিসটা তোমাদেরও! তবে হ্যাঁ আগে কিন্তু ইন্টার্নশিপ করতে হবে?”
-” অবশ্যই ভাইয়া!”
আরিয়ান বলল,
-” ভাইয়া সাবধান হ্যাঁ? মহিলা মানুষ! ওদের কাছে চকচক করলেই সোনা!”
-” ভাইয়া আপনাদের থেকে ভালো পরখ করতে পারবে! মনে রাখবেন অলংকার কিন্তু মহিলারাই পরিধান করে!”
পাতার কথায় অরুণ একবার তার দিকে চায়। তার পর খাওয়ায় মনোনিবেশ করে। আরিয়ান চুপ থাকে না। আদুরি, রুবি, পাতা ভদ্রভাবে টুকটাক কথাকাটাকাটি করে আরিয়ানের বিপক্ষে। আনিকা বাবার পক্ষে কথা বলে। বেশ তর্কাতর্কি হয়। আর তর্কে পাতা এগিয়ে জিতে যাবে জিতে যাবে ভাব আসমা বেগমের চাহনিতে চুপ করে যায়। অন্যদিকে বাবা ছেলে চুপচাপ, ভিন্ন ভিন্ন কারণে ।
রাত বেশি দীর্ঘ হয় নি। নয়টা কি দশটা বোধকরি। আতিকুর ইসলাম টিভিতে নিউজ দেখছিলেন। নিউজ বলতে টকশো। দুই পক্ষের সংঘর্ষের মাঝে বেচারা সংবাদ উপস্থাপক হামি তুলছে। আতিকুর ইসলাম সেই সংঘর্ষ গুলো মনোযোগ সহকারে শুনছেন। আজকের টকশোর বিষয়াবলী দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতির জন্য কে দায়ী? সেটা নিয়েই দীর্ঘ আলাপ আলোচনার নামে তর্ক বিতর্ক প্রতিযোগিতা চলেছে । লুবমান বাবার পাশে বসে সেই বিরক্তিকর টকশো গিলছে। লাবনী আক্তার টেবিলে খাবার পরিবেশন করছেন। জগ সহ খাবার বেড়ে এনে রাজা ও রাজার পুত্রের কাছে পরিবেশন করে। তারা দুজন খাবার গ্রহণ করে টিভি সহ খাবার গিলতে থাকে। লাবনী আক্তার সিঙ্গেল সোফায় বসে স্বামীর উদ্দেশ্যে বলল,
-” সাত আট দিন হয়েই গেল পাতা ও বাড়ি! আপনি গিয়ে যদি কদিনের জন্য নিয়ে আসেন মেয়েটাকে?”
আতিকুর ইসলাম স্ত্রীর দিকে একপলক চেয়ে টিভিতে মনোনিবেশ করে।
-” লুবমানকে বলো! নিয়ে আসবে।”
লুবমান লোকমা মুখে পুরে বলল,
-” আমি পারবোনা আব্বু! আমি কি বাড়ির মুরুব্বি নাকি! ওখানে গিয়ে কি বলবো কি না বলবো! তুমিই যাও! মেয়ের বাবা তুমি, একটা দায়িত্ব আছে না?”
আতিকুর ইসলাম লুবমানের দিকে চায়। লুবমান খানিকটা ঘাবড়ে যায়। প্লেট নিয়ে উঠে তড়িঘড়ি করে নিজের ঘরে চলে যায়। লাবনী আক্তার ইতস্তত বোধ করে বলল,
-” আপনিই যান না? মেয়েটা খুশিও হবে। আর তাছাড়া প্রথমবার মেয়েকে শশুর বাড়ী থেকে বাবার বাড়ি আনতে যেতে হবে! লুব গেলে কেমন দেখাবে না?”
-” আচ্ছা দেখি!”
তার ছোট্ট জবাবে লাবনী আক্তার খুশি হয়। দেখি বলেছেন মানে উনি যাবেন। এতো বছরের সংসার ওনার আচার আচরণ তার নখদর্পণে। তাদের সংসারের মাথা আতিকুর ইসলাম। ভদ্রলোকের কথাই শেষ কথা। তার কথার উপর কথা বলার সাহস কারোর নেই। লতা বাদে সবাই তাকে ভয় করে চলে।
রুপকথা! দুই তিন যুগ আগেও রাতের বেলা বাচ্চারা মা অথবা দাদির কাছ ঘেঁষে আবদার করতো রুপকথার রাজ্যে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার। সন্ধ্যার পর পড়তে বসে মনে মনে শত শত দোয়া করতো কারেন্ট চলে যাওয়ার। কারেন্ট চলে গেলেই আনন্দে নেচে উঠে মা দাদির কাছে চলে যেতো গল্প শুনতো। ভূত, রাক্ষস, রাজকন্যা, রাজা রানী কতশত গল্প! আজকের মডার্ন যুগ হয়তো সেই রূপকথা ভুলতেই বসেছে। অরুণ ছেলেকে সেই রূপকথা শোনাচ্ছে। আসমা বেগম আনিকাকে রাতে ঘুমানোর সময় বলে। আনির থেকে সেই গল্প শুনে ভোরও আবদার করে।
অরুণ তো রূপকথা জানে না। তার মা কখনো কি তাকে শুনিয়েছিলো? কি জানি! তার তো মনে নেই।ছোট বেলা অরুণকে রেখে তো নিজেই রূপকথা হয়ে গেছে। অরুণ ইউটিউব থেকে রূপকথা দেখে নিজে শিখে পড়ে ভোরকে শোনায়। ভোর হা করে শুনে! তবে এতেই ক্ষান্ত নয়! হাজারখানেক প্রশ্ন করবে। পাখি কিভাবে কথা বলে? ব্যাঙ থেকে রাজকুমার মানুষ হলো কিভাবে? মেয়েরাই কেন পরী হয়? তাদের পুকুরেও কি জলপরী আছে? একবার তো তাদের আঙিনার শেষের পুকুরে ঘড়ি ফেলে দিয়ে কেঁদেছিল মিছিমিছি। জলপরী না ওঠায় অরুণের সাথে অনেক তর্কও করেছিলো।
পাতা ঘরে প্রবেশ করে। বাবা ছেলেকে বিছানায় দেখে আস্তে দরজাটা লক করে। ভোর পাতাকে দেখে হেসে বলে,
-” আম্মু? জলদি আসো? গল্প শেষ হয়ে গেলো!”
” আসছি সোনা!”
বলে টপস ও সালোয়ার নিয়ে ওয়াশ রুমে যায়।চেঞ্জ করে এসে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। অরুণ গম্ভীর মুখে গল্প বলছে আর আড়চোখে পাতাকে দেখছে। মেয়েটার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে নাকি! ওড়না ছাড়া! ধ্যাত! অরুণ আর তাকায় না পাতার দিকে। পাতা কম্ফোর্টের ভিতরে ঢুকে কোমড় অবধি ঢেকে নেয়।কাত হয়ে অরুণের দিকে ফেরে। মাঝখানে ভোর শুয়ে। অরুণের গল্প শেষ হয়ে যায়। ভোর আরেকটা আবদার করলে অরুণ মানা করে,
-” কলিজা ঘুমাও! অনেক রাত হয়েছে। কাল জলদি উঠতে হবে তো! স্কুল আছে না?”
ভোর মাথা নেড়ে পাতাকে জড়িয়ে চোখ বুজে নেয়। পাতা মুচকি হেসে তার মাথায় চুমু দিয়ে চুলে হাত গুঁজে দেয়। অরুণ ভালোভাবে বালিশে মাথা রেখে পাতার দিকে চায় সরাসরি। পাতা প্রশ্ন করে,
-” এত গল্প কার কাছে শিখলেন?”
-” ইউটিউবে!”
-” একটা কথা বলি?”
-” না ঘুমাও!”
-” প্লিজ একটা?”
-” না!”
-” প্লিইজ?
-” ঠিকাছে!
-” আপনাদের ডিভোর্স কেন হলো? না মানে লাভ ম্যারেজ ছিল! শুনেছি আপনারা একেঅপরকে অনেক ভালোবাসতেন! পার্ফেক্ট জুটি! তারপরও..”
থেমে যায় পাতা। গম্ভীর অরুণ সরকারের মুখশ্রী যেন আরো গম্ভীর হয়ে ওঠে। ফর্সা কপালের নীল রগ দৃশ্যমান। পাতা ঢোক গিলে এতো রেগে গেলো!
-” স্যরি হ্যাঁ? বলতে হবে না! গুড নাইট!”
বলেই চোখ বুজে। কিছুসময় পরেও কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখতে পেয়ে এক চোখ অল্প খুলে চায়।খুলেই যেন ভুল করলো। লোকটা এখনো তার দিকে চেয়ে। পাতা দুই চোখ খুলে হাসার চেষ্টা করে। অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-” ওসব এখন অতীত! অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে কি করবে পাতাবাহার? আমাদের মাঝে সব ঠিক ছিল। খুশি ছিলাম দুজনে।ও বি সি এস দিয়ে দেশেই অতিরিক্ত সচিবালয়ে একটা জবে যোগ দিয়েছিল।ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধব সবাই বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ওখানেই সেটেলড হয়। ও আমাকেও বলে ভালো কোনো কান্ট্রিতে সেটেলড হতে। আমার মন টানতো না। যদিও দেশে কোনো পিছুটান নেই।
তবুও আমার দেশ! আমার জন্মভূমি! কিভাবে ছেড়ে যাই? শুরু হয় দুজনের মনোমালিন্য! এর মাঝেই ভোর আসে। ও এখনি বেবি চাইনি কিন্তু আল্লাহর রহমতে এসে গেছে। কি করার। প্রেগন্যান্সি চলাকালীন বিদেশে একটা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করার সুযোগ পায়। কিন্তু আমি যেতে দিই নি। ভোর হয়। কিন্তু ওর দিকে কেমন বিমুখ হয়ে থাকতো। যত্ন করতো না। কেমন যেন একটা বিহেভ করতো। শুধু ওর সাথে না আমার সাথেও। ধীরে ধীরে সব চেঞ্জ হয়। ও আবার কিরগিজিস্তানের এক ইউনিভার্সিটিতে পি এইচ ডির সুযোগ পায়। হঠাৎ করেই ডিভোর্স চায়। আমিও অবাক হয়েছিলাম। কিছু জিজ্ঞেস করি নি। তার চোখেই সব জবাব পেয়ে গিয়েছিলাম। ভোর সারাজীবন আমার কাছে থাকবে সেই শর্তে ডিভোর্স হলো। তারপর সে তার রাস্তায় আমি আমার রাস্তায়!”
পাতা মনোযোগ দিয়ে সব শুনে। এসব কথা সে শুনেছে আদুরি, প্রিন্সিপাল ম্যাম আরো অনেকের কাছে। তবুও লোকটার মুখে শোনার ইচ্ছে ছিল।
-” এখনো ভালোবাসেন তাকে? ভুলতে পারেননি তাই না?”
অরুণ মুচকি হেসে পাতার নাক টেনে দেয়।
-” এখনো ভালোবাসবো? ওসব আবেগী কথা বলবে না। এটা রিয়েলিটি। ভালোবেসে ছিলাম। মন থেকেই। সম্পর্ক তৈরি হলো। একবুক তিক্ততা নিয়ে ভেঙেও গেলো। দুধের ছেলেকে রেখে চলে গেছে সে, তাকে আমি এখনো ভালোবাসবো? আমার ছেলের মা মা বলে ক্রন্দনরত মুখশ্রী দেখেও যে মায়ের বুক কাঁপে না। পিছনে না ফিরেই চলে যায় তাকে ভালোবাসবো? মা মা বলে কাঁদতে কাঁদতে দম বন্ধ হবার যোগার ছেলের! ফোন করে কানে দিলে পাঁচ মিনিট কথা বলার সময় হতো না তার। কেটে দেয়ার বাহানা খুঁজতো তাকে ভালোবাসবো? অরুণ সরকার ওতটাও আবেগী না পাতাবাহার! তার ভালোবাসাও অত সস্তা না। আমার আঙিনা থেকে যেদিন বেড়িয়েছে সেদিন থেকে সে আমার অন্তঃস্থল থেকেও বেড়িয়ে গেছে।”
থামে অরুণ। পাতা অরুণের দিকেই তাকিয়ে হা করে। মনটা তার পেখম তুলে নাচছে! আহা জীবনটা কেমন আনন্দ আনন্দ লাগছে! এমন তো কখনো লাগে নি!! সিনেমার মতো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে মনে হচ্ছে। সে অরুণ সরকারের একটা লুঙ্গি পরে লুঙ্গি ডান্স দিচ্ছে! সঙ্গে ভোর সেও লুঙ্গি পড়ে লুঙ্গি ডান্স দিচ্ছে, এমনকি বিড়াল শাবকটিও। পাতা নাচ থামিয়ে দেয়! ওই তো নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক? লুঙ্গি পড়ে! দাঁত বের করে হাসছে। পাতা দৌড়ে যায়। তার গলা জড়িয়ে টপাটপ চুমু খায় বেশ কয়েকটি। আহা! সব কিছু কেমন যেন বাড়াবাড়ি রকমের ভালো লাগছে। অরুণ পাতার দিকে তাকিয়েই। মেয়েটা মটকা মেরে গেল কেন? কোন স্বপ্নে বিভোর আছে?
-” মিসেস পাতাবাহার? কোথায় হারিয়ে গেলে?”
অরুণের কথায় পাতা রঙিন সিনেমাটিক দুনিয়া থেকে বেরিয়ে আসে। গোমড়ামুখো অরুণ সরকারকে দেখে নাক মুখ কুঁচকে নেয়। স্বপ্নটাই ভালো ছিলো। সে হামি তুলে বলে,
-” কোথাও না। ঘুম পাচ্ছে আমার।”
-” তো ঘুমান!”
বলে ভোরকে পাতার থেকে ছাড়িয়ে নেয়। পাতা ভেংচি কাটলো।
-” আমার কাছে থাকলে কি হতো?”
-” কিছু না আমার ছেলেটা ভর্তা হয়ে যেতো!”
-” মানে?”
-” কিছু না! আপনার ঘুমানোর স্বভাব খুবই বাজে!”
বলে অরুণ লাইট অফ করে চোখ বুজে নিল।
পাতার মুখ খানি চুপসে যায়, কথা সত্য। মন খারাপ করে খাটের একদম কিনারা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। অরুণ ভোরকে ওপাশে রেখে হাত বাড়িয়ে পাতার পেটে রাখে। পাতা চমকে ওঠে। অরুণ কাছে টেনে এনে পাতাকে পিছন থেকে জড়িয়ে নেয় । পাতার কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বলল,
-” বিছানার নিচে ভুতের বাচ্চারা ডিনার করছে কাঁচা মাংস দিয়ে। সাবধান!”
পাতা হাসে। সে মোটেও ভয় পাচ্ছে না। তবে সে না হয় একটু অভিনয় করলো! কেউ জানতে পারবে ? উল্টো দিকে ফিরে অরুণের কাঁধে মুখ গুঁজে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। নাক ঠেকিয়ে শ্বাস টেনে নেয়। অরুণ চমকায় বেশ। কেঁপে ওঠে বক্ষস্থল। শীরায় শীরায় রক্ত কনিকা যেনো টগবগিয়ে ওঠে। মেরুদণ্ড বেয়ে পাগল করা স্রোত বয়ে যায়। তার উন্মুক্ত তনু জড়িয়ে এক নারী কায়া। পুরুষালী মন সন্ন্যাসী হয়ে ধ্যান করবে? শক্ত করে সেও নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পাতার নরম শরীরটাকে। পাতার মস্তিষ্ক সচল হলো যেন। সরে আসতে চায় পারে না। অরুণ তার চুলের রেবন খুলে দেয়। চুলের ভিতর হাত গলিয়ে শক্ত করে ধরে মুখোমুখি হয়।
একেঅপরের উষ্ণ গরম নিঃশ্বাস আছরে পড়ছে মুখশ্রীতে। পাতা ঢোক গিলে। এ কেমন মরণ অনুভূতি! অভিনয় করতে এসে এভাবে ট্রলের স্বীকার হবে জানলে কখনো করতো না। ভয়ে তার চোখের আকার বড় হয়। অজানা আশঙ্কায় বুকটা ধুকপুক করছে। কেঁপে উঠছে বারংবার। ছোটার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ভয়, উত্তেজনায় তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে, শক্তি যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। সে একবুক সাহস নিয়ে অরুণের দিকে চায়। কিন্তু লোকটার নজর অন্যদিকে। পাতা ঢোক গিলে পুনরায়। অরুণ অগ্রসর হবে পাতা চটজলদি নিজ ওষ্ঠাধরে হাত দিয়ে ঢেকে নেয়। অরুণের অধর ঠেকে পাতার করপুটে। অরুণের শ্বাস ক্রমাগত ভারী হয়। ফোঁস ফোঁস শব্দ হয়। অরুণ পাতার চোখে চোখ রাখে। পড়ে নেয় চোখের ভাষা।
তাদের মধ্যে দেয়াল সৃষ্টি হওয়া হাতে শক্ত করে কামড় বসায় অরুণ! ব্যাথায় পাতার আঁখি যুগল বুজে যায়। অরুণ সরে আসে। বালিশে মাথা রেখে ছেলের দিকে ফিরে শোয়। পাতা যেন জানে প্রাণ ফিরে পায়। বালিশে মুখ লুকিয়ে দাঁত দাঁত চেপে শুয়ে থাকে। লোকটা কি রাগ করলো? করুক! সে ওত সহজে ধরা দেবে না। পাতাকে ফাঁদে ফেলা ওতো সহজ না। যেদিন ভালোবেসে কাছে টানবে সেদিনই পাতা নিজের সর্বস্ব সপে দেবে। যতটুকু ভালোবাসা দিবে তার শতগুণ ফিরিয়ে দিবে।
পাতা বাহার পর্ব ৩১(২)
হঠাৎ অনুভব করে সরে যাওয়া কম্ফোর্ট টা পাতার গা পুনরায় ঢেকে দেয়। পাতা জানে কার কাজ! সে লজ্জায় মুখ তোলে না। মটকা মেরে শুয়ে থাকে।