ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১৯
জেনিফা চৌধুরী
অপরিচিত একটা মেয়ে মেহরিশের স্বামী নামক পুরুষটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে__দৃশ্যটা দেকে মেহরিশ এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। ভুল দেখেছে ভেবে চোখ দুটো খানিক সময়ের জন্য বন্ধ করল। পুনরায় খুলে সে একই দৃশ্য দেখল। মেহরিশের মাথা ঘুরতে শুরু করল। এই মানুষটাই তো সপ্তাহ খানেক আগে মেহরিশকে জোর করে, ভালোবাসার দাবি নিয়ে বিয়ে করেছিল। আর সেই মানুষটাই কীনা এখন…! ভাবতে পারছে না মেহরিশ। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না। সায়র কি তবে ছলনা মত্ত হলো? নাকি মেহরিশের রেগে বলা কথাগুলোকে সত্যি ভেবে দূরত্ব বাড়াতে চাইছে? সেই যে বিয়ের দিন বাসা থেকে বের হয়ে এখন অব্দি কোনোরকম যোগাযোগ করেনি। তাহলে বিয়েটা করেছিল কেন? কেন? মেহরিশকে শেষ বার চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে? নাকি এটা সায়রের কোনো প্লান? কিছু ভাবতে পারছে না মেহরিশ। এদিকে সায়রের পাশে অন্য মেয়েকেও সহ্য করতে পারছেনা। রাগ যেন মাথা নেড়ে উঠছে। মস্তিষ্ক জমে উঠেছে রাগে। মনে চাচ্ছে এক্ষুনি ছুটে গিয়ে মেয়েটাকে সরিয়ে ফেলতে। মেহনূর পাশে দাঁড়ানো। মেহরিশের থমকানো মুখখানা দেখে ভয় পেল। তবুও জিজ্ঞেস করল,
“আপু! ঠিক আছিস?”
বলে আনায়াকে হাত বাড়িয়ে নিজের কোলে তুলে নিল। মেহরিশ এখনো থমকে দাঁড়িয়ে আছে। এক নজরে চেয়ে আছে সামনে থাকা ব্যক্তি দুটোর দিকে। মেহনূরের কেন যেন ভয় হচ্ছে। মেহরিশ কোনো রেসপন্স করছে না কেন? এটা কি কোনোরকমে ঝড়ের আগের পূর্বাভাস? মেহনূর এবার মেহরিশকে হালকা ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠল,
“আপু! এই আপু!”
মেহরিশের এবার হুঁশ ফিরে আসল। হকচকিয়ে উঠল। ছোট্ট করে বলল,
“হুঁ।”
মেহনূর সাবধনতার সাথে জিজ্ঞেস করল,
“ঠিক আছো?”
মেহরিশ ঠোঁটে হাসি টানার চেষ্টা করল। বলল,
“ইয়েস, আ’ম অল রাইট।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
বলেই সামনে এগিয়ে গেল। মেহনূরও পিছু পিছু এগিয়ে গেল। মেহনূরের মুখে স্পষ্ট কৌতুহল। মেহরিশ কি করবে তা দেখার পালা। মেহরিশ গিয়ে সায়রের মুখোমুখি দাঁড়াতেই সায়রের চক্ষু চড়কগাছ। মেয়েটাকে দ্রুত নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিল। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল,
“মেহরিশ! আপনি? এখানে?”
মেহরিশ হাসি মুখেই জিজ্ঞেস করল,
“জ্বি, আমি। এনি প্রবলেম, মিস্টার সায়র?”
সায়র হাসার চেষ্টা করল। বলল,
“নো। নো প্রবলেম।”
বলেই সায়রের পাশে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে ইঙ্গিত করে বলে উঠল,
“মেহরিশ, সি ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড তৃণা।”
তৃণা এবার হাসি মুখে মেহরিশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“হ্যালো, মেহরিশ। নাইস টু মিট ইউ।”
মেহরিশ তৃণার সাথে হ্যান্ডশেক না করে, সায়র আর তৃণার মাঝে এসে দাঁড়ালো। সায়রের বাহু জড়িয়ে ধরে তৃণার উদ্দেশ্যে বলল,
“এক্সকিউজ মি, প্লিজ সাইড।”
বলেই সায়রের উদ্দেশ্যে বলল,
“চলুন।”
সায়র অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় মনে হলো আকাশ থেকে পড়ল। মেহরিশের এই আচরণের স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে মেহরিশ প্রচন্ড জেলাস। সায়র মেহনূর দুজন দুজনের দিকে তাকাল। মেহনূর ঠোঁট চেপে হাসতেই সায়র চোখ মারল। তৃণাও মুচকি হাসছে। সায়র এবার কিছু না বোঝার ভান করে বলে উঠল,
“কোথায় যাব?”
মেহরিশ চোখ গরম করে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“কোনো প্রশ্ন করবেন না। আমার সাথে চলুন।”
সায়র মেহরিশের থেকে হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,
“মেহরিশ, ছাড়ুন। মানুষ দেখছে। আমার লজ্জা লাগছে।”
মেহরিশের রাগ যেন এবার তরতর করে বাড়ল। রাগে কিড়মিড় করতে করতে বলল,
“আমি হাত ধরেছি বলে লজ্জা লাগছে? আর অন্য একটা মেয়েকে রাস্তার মাঝে জড়িয়ে ধরতে লজ্জা লাগেনি?”
সায়র উত্তর দেওয়ার আগেই তৃণা এবার উত্তরে বলল,
“এক্সকিউজ মি! অন্য মেয়ে কাকে বলছো? আমি ওর বেস্ট ফ…।”
তৃণা কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারল না। তার আগেই মেহরিশ বাঘিনীর ন্যায় তাকাল তৃণার দিকে। রাগে চিৎকার বলে উঠল,
“আর আমি ওয়াইফ হই। শুনেছো? আমি সায়রের স্ত্রী হই।”
বলেই থেমে গেল। মেহরিশের উচ্চবাক্যে কথা শুনে আশেপাশের কয়েকজন তাকাল এদিকে। সায়র আর মেহনূরও কিছুটা ভড়কে গেল। মেহরিশ এবার কণ্ঠস্বর খানিক নিচু করে বলে উঠল,
“আই থিংক, আমি থাকতে সায়রের লাইফে কোনো বেস্ট ফ্রেন্ডের দরকার পড়বে না। সো, কিপ ডিসটেন্স ফ্রম মাই হাবি। ওকে? আন্ডারস্ট্যান্ড? আই থিংক ইউ বেটার আন্ডারস্ট্যান্ড?”
বলেই সায়রের হাত ধরে সেখান থেকে হাঁটা শুরু করল। সায়রও এবার আর আটকালো না। অবাক হয়ে মেহরিশকে দেখতে দেখতে হাঁটছে। কিছু দূর গিয়ে পেছনে ফিরল। মুখে বড়োসড়ো হাসি টেনে মেহনূর আর তৃণার দিকে তাকিয়ে চোখ মারল। হাতের ইশারায় বুঝালো,
“অল ডান। মিশন সাকসেস।”
মেহনূর তৃণাকে থ্যাংকস বলে দ্রুত হাঁটা ধরল মেহরিশ আর সায়রের পিছু পিছু।
“আমার আবির কোথায়, সাবির?”
সাবির সাহেব পেছন ঘুরে তাকালেন। নীলুফা বেগমকে দেখে বাঁকা হাসলেন। বললেন,
“নিলু যে, পাশে এসে বসো। সপ্তাহ খানেক পর মাত্র বাড়ি ফিরলাম। কোথায় আমার সেবা করবে তা না করে এসব ভুলভাল প্রশ্ন করছো কেন?”
নীলুফা বেগম সাবির সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। ঠোঁটের কোনে হাসি টেনে বললেন,
“নিলু! নিলু ডাকটা শুধু আবিরের মুখেই মানায়। যে কেউ এসে আবিরের জায়গা ধকল করলেই আবির হওয়া যায় না। আবির হতে গেলে যোগ্যতা লাগে। সবার কি আর সে যোগ্যতা আছে?”
সাবির সাহেব হেসে ফেললেন। জবাবে বললেন,
“যোগ্যতা না থাকলে কি আর এত বছর শত্রুর সাথে সংসার করতে?”
নীলুফা বেগমের মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালেন সাবির সাহেবের দিকে। অসহায় বাক্যে অনুনয় করে বললেন,
“আমার আবিরকে একবার চোখের দেখা দেখতে দিবে, প্লিজ।”
সাবির সাহেব আগের ন্যায় বলে উঠলেন,
“তা তো সম্ভব না, মাই সুইট লেডি। আবির তো আর বেঁচে নেই।”
কথাটা নীলুফা বেগমের কানে যেতেই নীলুফা বেগম চিৎকার করে উঠলেন। শরীর ঝংকার দিয়ে কেঁপে উঠল তার। কাঁপাকাঁপি বাক্যে জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
“মজা করছো তুমি?”
সাবির সাহেব জবাব দিলেন,
“সাবিরের ডিকশনারিতে ‘মজা’ শব্দটা মিসিং।”
নীলুফা বেগমের মাথা ঘুরতে লাগল। যে ভয়ে সে এতবছর সব অন্যায় মুখ বুঝে মেনে নিয়েছিলেন, আজ সেই ভয়ের কাছেই কি তবে হেরে গেলেন?
সারারাস্তা মেহরিশ নিজে ড্রাইভিং করে এসেছে। মেহনূর পেছনের সীটে আনায়াকে নিয়ে বসেছে। সায়র মেহরিশের পাশে বসে ছিল। সারারাস্তা আর মেহরিশ কোনোরকম কথা বলেনি। মেহরিশদের বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামতেই মেহরিশ আগে গাড়ি থেকে নামল। সায়র বসে বসে শুধু মেহরিশের কান্ড দেখছে আর মনে মনে মজা নিচ্ছে। মেহরিশ নিজে নেমে আসল সায়রের কাছে দরজা খুলে দিয়ে বলল,
“নামুন।”
সায়র না নেমে বলে উঠল,
“আমি আপনাদের বাসায় যাব না, মেহরিশ।”
মেহরিশ আর কিছু না বলে আগের ন্যায় সায়রের হাত ধরে নামাল। সায়রের হাত ধরে সোজা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। নিজের রুমে নিয়ে আসল। রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ফেলল। সায়র এবার নড়েচড়ে উঠল। জিজ্ঞেস করল,
“কি করতে চাইছেন, মেহরিশ?”
মেহরিশ হালকা হাসল। পাল্টা প্রশ্ন করল,
“যা আপনি করতে চান।”
সায়রের প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে। তবুও হাসি আটকে মাসুম বাচ্চার মতো প্রশ্ন করল,
“আমি আবার কি করতে চাই?”
মেহরিশ সায়রের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। সায়রও বাংলা সিনেমার নায়কের মতো ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে পেছাতে লাগল। পেছাতে পেছাতে বিছানায় বসে পড়ল। মেহরিশ সায়রের কাছে এসে এক হাতে সায়রের কলার চেপে ধরল। সায়রের ঠোঁটের আশেপাশে অন্যহাতে স্পর্শ করতে করতে বলে উঠল,
“বাসর করতে চান না?”
সায়র হালকা কেশে গলা ঝেরে নিল। আমতা আমতা করে বলে মনে,
“আপনি তো আমাকে স্বামী হিসেবে মানেন না। তাহলে বাসর করব কিভাবে?”
মেহরিশ ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
“কেন? বিয়েটা যেমন জোর খাটিয়ে করেছেন, বাসরও তেমন জোর খাটিয়ে করবেন।”
সায়র সাথে সাথে জিভে কামড় দিয়ে বলে উঠল,
“ছিহ! কি বলেন? নাউজুবিল্লাহ! আমি কি বাংলা সিনেমার ডিপজল নাকি যে, জোর করে লজ্জাহরন করব?”
মেহরিশ এবার রেগে সায়রকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিল। অতঃপর সায়রের বুকের উপর উঠে বসল। দুই হাতে সায়রের গাল চেপে ধরে দাঁত কটমট করতে করতে বলল,
“তাহলে অন্য মেয়েকে জড়িয়ে ধরেছিলি কেন, শালা?”
সায়র অসহায়ের কতো বলে উঠল,
“শালা না জামাই।”
মেহরিশ বাঘিনীয় ন্যায় উচ্চবাক্যে বলে উঠল,
“তোর জামাইয়ের গুষ্টি কিলাই। আগে বল অন্য মেয়েকে জড়িয়ে ধরেছিলি কেন?”
সায়র আগের ন্যায় উত্তর দিল,
“আপনি তো আর আমাকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেন না। তাই যখন তৃণা জড়িয়ে ধরল আবেগে আপনাকে ভেবে আর ছাড়তে পারিনি।”
মেহরিশ এবার সায়রের ঠোঁট টেনে ধরল। বলল,
“আর একবার ওই মেয়ের নাম মুখে একদম মুখ টেনে ছিড়ে ফেলব।”
সায়র বেচারা পড়েছে বিপাকে। ঘুমন্ত বাঘিনী জেগে উঠেছে। সায়র বেশ মজা নিচ্ছে মেহরিশের কান্ডে। মেহরিশ এবার জোর খাটিয়ে বলে উঠল,
“আমি মানি বা না মানি, আপনি আমার স্বামী। আর আমার হয়েই থাকতে হবে বাকি জীবন। আমাকে ভুলে গিয়ে দূরত্ব বাড়িয়ে নেওয়ার চিন্তা করলে, সেদিন আপনার জীবনের শেষ দিন হবে। মাইন্ড ইট।”
বলেই নেমে পড়ল সায়রের বুক থেকে। তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। মেহরিশ চলে যেতেই সায়র উচ্চস্বরে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলতে লাগল,
“আপনাকে ভুলে যাওয়ার সাধ্য আমার নেই, মেহরিশ। আপনি আমার দেহের ভালোবাসা না,আপনি আমার রুহের ভালোবাসা৷ দেহের ভালোবাসা তো ম’রে গেলে ফুরিয়ে যাবে। তখন দেহ মাটিতে মিশে পঁচে গলে যাবে। কিন্তু রুহ? সে তো থাকবে। দেখবে। আর আপনাকেই ভালোবাসবে। আপনাকে ভালোবাসার সাধ্য আছে, ছেড়ে যাওয়ার নয়।”
ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১৮
“আংকেল, কেমন আছে?”
“জ্ঞান ফিরেনি। তাই এখনো কিছু বলতে পারছি না।”
“ডাক্তার কি বলল?”
“গুলি দুটো বের করা হয়েছে। এখনো রিস্ক আছে। যে কোনো মুহূর্তে কোমায় চলে যেতে পারেন।”
সায়র এবার থমকে গেল। থেমে থেমে বলল,
“আংকেলের শেষ ইচ্ছাগুলো পূরণ করার জন্য হলেও আংকেলকে বাঁচতে হবে।”