চন্দ্রাস্ত গল্পের লিংক || ফারহানা কবীর মানাল

চন্দ্রাস্ত পর্ব ১
ফারহানা কবীর মানাল

ভাইয়া মা’রা যাবার পর মা প্রায়ই বলত, “তোর জন্য ভালো হয়েছে। সম্পত্তির আর কোন অংশীদার রইল না। তোর ভালো হয়েছে।”
কথাগুলো বলত নিজের মেয়েকেই। মানিক মিয়া বউয়ের এই কথাটা সহ্য করতে পারতেন না। বিরক্ত হতেন। প্রায় রোজই, এক কথা শুনতে শুনতে তার বিরক্তির পরিমাণ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে সেদিন চেলাকাঠ নিয়ে তেড়ে গেলেন। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “আজ তোকে শে’ষ করে ফেলব। ছেলের কাছে পাঠিয়ে দেব।”
মিলি দৌড়ে গিয়ে বাপের হাত থেকে কাঠ কেঁড়ে নিতে চাইল। নরম গলায় বলল, “আব্বা একটুু শান্ত হন। মা ভাইয়ের মৃ’ত্যুটা মেনে নিতে পারে না।”

“দুনিয়ার ওপর থেকে পাপী মানুষ ম’র’ছে। দুনিয়ার বোঝা কমেছে। মেনে নিতে অসুবিধা হবে কেন?”
“জানেনই তো, মা ভাইয়াকে কতটা ভালোবাসত। রোজই আমার কাছে ভাইয়ার ব্যাপারে বলে, আমি তেমন গুরুত্ব দিই না দেখে অমন কথা বলে। মন থেকে বলে না।”
মানিক মিয়া কঠিন চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর কাঠ ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন। মিলি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। মায়ের কাছে গিয়ে বলল, “সবসময় এমন কথা বলার মানে কি মা? ভাইয়ার মৃ’ত্যুতে আমি খুব খুশি হয়েছি- এমন মনে করো তুমি?”
ভদ্রমহিলা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “অবশ্যই মনে করি। তেমন না হলে ভাইয়ের খু’নিদের সাথে অমন রমরমা কেন তোর? ভাবসাব দেখে মনে হয় ওরা তোর খুব বড় কোন উপকার করেছে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিলি অল্প হাসল। মা’য়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “নিজের মনের ওপর জোর খাটানো যায় মা। যাকে একবার মন দিয়ে ফেলেছি। তার থেকে মন ফেরত নেবার উপায় জানা নেই। আমি সত্যিই নিরুপায়!”
তিনি শব্দ করে থু থু ফেললেন। তবে কিছু বললেন না। মিলিরা দুই ভাই-বোন। মাস দুয়েক আগেও তাদের একটা সুখের পরিবার ছিল। ভাই, ভাবী আর তাদের একমাত্র ছেলে রোহানকে সাথে নিয়ে সংসারটা বেশ ভালোই চলছিল। আনিস তখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বেশ ভালো বেতনের চাকরি করত। আর্থিক স্বচ্ছলতার অভাব ছিল না। তারপর হঠাৎই একদিন এক কালো ঝড় এসে তাদের পরিবার লণ্ডভণ্ড করে দেয়। আনিস খু’ন হয়। সেই খু’নের দায়ে তার ভাবী কনক এখন জে’লে বসে ফাঁ’সির দিন গুনছে। রোহান ছেলেটার বয়স বেশি নয়। মা বাবাকে হারিয়ে সে-ও আজ-কাল চুপচাপ হয়ে গেছে। কথা বলে না, সময়মতো খেতে চায় না, পড়াশোনায়ও তেমন মনযোগ নেই। ভাইয়ের ছেলেকে নিয়ে মিলির চিন্তার শেষ নেই। মা বাপ হারা সন্তানকে বুকে জড়িয়ে সে মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করে।
বেলা পড়ে এসেছে। খানিক বাদে সন্ধ্যা নামবে। মিলি জানালার পর্দা টেনে দিলো। রোহানের পাশে দাঁড়িয়ে কোমল গলায় বলল, “সন্ধ্যার নাস্তায় কি খাবে বাবা? তোমার পছন্দের নুডলস করে দেব?”

রোহান মাথা দোলালো। সে খাবে না। মিলি বলল, “দুপুরে তেমন কিছুই খেতে পারোনি। এখন খেতেই হবে। বায়না করা চলবে না।”
“ফুপি আমি কিছু খাবো না। বিরক্ত করো না।” বলেই সে খাটের ওপর শুয়ে পড়ল। পায়ের কাছে গুছিয়ে রাখা চাদরটা গায়ে টেনে দিয়ে বলল, “ঘুমাতে চাই। বিরক্ত করবে না।”
সে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ছেলেটা দিন দিন বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই কথা শুনতে চায় না। সবকিছুতে জেদ করে।
রাতের খাবার সময় মানিক মিয়া মিলির বিয়ের প্রসঙ্গ তুললেন। ভাত মুখে নিয়েই বললেন, “মিলির জন্য খুব ভালো একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। ছেলে সেনাবাহিনীতে চাকরি করে। বেশ ভালো পদে আছে। আগামী শুক্রবার ওরা মিলিকে দেখতে আসতে চায়। এখন তোমাদের মতামত দাও।”
মিলি বিবর্ণ মুখে মায়ের দিকে তাকালো। তার মা বললেন, “এটা তো খুব ভালো কথা। কতদিন বাদে বাড়িতে একটা খুশির সংবাদ এসেছে। আশা করি ভালোই হবে।”
মানিক মিয়া বললেন, “আমার বন্ধু খোকনই প্রস্তাবটা দিলো। ছেলে ওদের দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। ভালো ছেলে। নামাজ কালাম পড়ে। বাজে নেশা নেই।”

মিলি বলল, “আব্বা খোঁজ নিয়েছেন?”
“না, খোকনই এসব কথা বলল। আগে দেখাশোনা হোক। তারপর না হয় আমি খোঁজ-খবর করব।”
মিলি আর কিছু বলল না। থালার ভাত নাড়াচাড়া করতে লাগল। সে আর এক গ্রাসও মুখে তুলতে পারছে না। মানিক মিয়া খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন। রোহানও তার পিছনে ঘরে চলে গেল। মিলি মায়ের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে নিচু গলায় বলল, “মা, আমি এই বিয়েটা করতে চাই না। আব্বাকে বলো যেন না করে দেয়।”
“কেন করতে চাস না? বয়সের খেয়াল আছে তোর?”
“মা তুমি তো জানোই আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি। শুধু পছন্দ করি এমন নয়, ভালোবাসি। এই বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।”

তিনি মেয়ের চুলের গোছা চেপে ধরলেন। কর্কশ গলায় বললেন, “কাকে ভালোবাসিস?”
মিলি চুল থেকে মায়ের হাত সরাতে সরাতে বলল, “তুমি তো সবকিছু জানো মা। তাহলে কেন এমন করছ?”
তার কন্ঠের গাম্ভীর্য কমল না, বরং তা আর একটু বাড়িয়ে নিয়ে বললেন, “হাবিবকে ভালোবাসিস তুই? হাবিবকেই তাই না? যার বউ আছে, কিছুদিন আগ পর্যন্ত একটা ছেলেও ছিল এখন আবার বাবা হবে। এমন একজনকে মানুষকে কি দেখে ভালোবাসিস তুই?”
“জানি না। ভালোবাসার কোন সংজ্ঞা হয় না মা।”

“নাটকের সংলাপ বকিস না মিলি। তোর আব্বা যা করছে তোর ভালোর জন্যই করছে। হাবিব দেখতে বেশ সুপুরুষ, ভালো চরিত্রের। এজন্য তোর ওর প্রতি মোহ জেগেছে। বিয়েসাদী হলে ঠিক হয়ে যাবে।”
“মোহ আর ভালোবাসার পার্থক্য করার মতো বয়স আমার হয়েছে। তোমরা অযথাই এসব নিয়ে জলঘোলা করছ।”
তিনি আর কিছু বললেন না। মেয়েকে বোঝানো সম্ভব না। বহুদিন ধরে এই জেদ নিয়ে পড়ে আছে। অথচ হাবিব তার দিকে ঘুরেও তাকায় না। বউ নিয়ে সুখের সংসার করছে।
মিলি ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। দু’হাতে চোখ-মুখ ঢেকে অনেক সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। অনেক হয়েছে! এবার এর কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। হাবিবের সাথে কথা বলবে, প্রয়োজন হলে তার পায়ে ধরে তাকে ভিক্ষা চাইবে। তবুও অন্য পুরুষের সাথে ঘর বাঁধতে পারবে না।
হাবিব বিছানায় শুয়ে ছিল। নববীকে অনেকক্ষণ আগে চায়ের কথা বলেছে। সে এখনও ফেরেনি। হয়তো চায়ের সাথে অন্য নাস্তা তৈরি করছে। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে দিয়ে মাঝরাতে এতটা খাঁটিয়ে নিতে তার ভীষণ কষ্ট হলো। সে বিছানা ছেড়ে রান্নাঘরে চলে গেল।

নববী সবে চুলায় গরম পানি বসিয়েছে। হাবিব তার কাছ ঘেঁসে দাঁড়ালো। কোমল গলায় বলল, “তোমাকে খুব কষ্ট দিলাম। এই অবস্থায় এত খাটাখাটুনি করা উচিত না।”
নববী হেসে ফেলল। বলল, “আমার শরীর এখনও সুস্থ আছে। ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারি। সামান্য চা বানাতে খুব বেশি অসুবিধা হবে না।”
“তবুও বাদ দাও। চলো, গিয়ে শুয়ে পড়বে।”
“তুমি এমন করছ কেন? পানি গরম হয়ে এসেছে। নুডলসের জন্য সবজি কা’টছিলাম বিধায় একটু দেরি হলো।”
“এখন আবার নুডলস রান্না করবে?”
“তাতে কি এমন হয়েছে? গ্যাসের চুুলায় সামান্য এতটুকু করতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। তুুমি চুপচাপ এখানে বসে থাকো।”

হাবিব বসল না। নববীর পাশে দাঁড়িয়ে রইল। পানি গরম হয়ে এসেছে। নববী তাতে চা পাতা ছেড়ে দিলো। হাবিব বলল, “চা করা শেষ হলে ঘরে চলো। নুডলসের দরকার নেই।”
নববী বিরক্ত গলায় বলল, “নুডলস রান্না হয়ে গেছে। এমন করছ কেন?”
হাবিব ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, “ভালো লাগছে না নববী। সবকিছু কেমন ছন্নছাড়া মনে হচ্ছে। অস্থির লাগছে।”
নববী স্বামীর গায়ে একটা হাত রাখল। নরম গলায় বলল, “কিছু হয়েছে? অফিসের কোন ঝামেলা?”
“ঠিক ঝামেলা নয়। তবে একটা কাজের জন্য বাইরে যেতে হবে। অফিস থেকে তিনজনকে ঠিক করেছে। আমার নামও আছে।”
“ক’দিনের জন্য যেতে হবে?”

“বলেছে এক সপ্তাহ লাগবে। দুই একদিন কম বেশি হতে পারে। কাল সকালে গাড়ি। না যাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলাম। লাভ হয়নি।”
“এমন বিষন্ন হয়ে থেকো না। অফিসের কাজের জন্য যেতে তো হবেই। কি আর করার!”
“তোমাকে এই অবস্থায় রেখে দূরে যেতে মন চায় না।”
“চিন্তা করো না। আল্লাহ চাইলে সবকিছু ঠিক থাকবে।”
নববী কাপে চা ঢাললো। পিরিচে নুডলস গুছিয়ে ট্রে-তে রাখল। শীতকাল পেরিয়ে যায়নি। মাঘের শেষ দিক। মাঝেমধ্যে দক্ষিণা বাতাস বয়। তারা দু-জনে জানালার পাশে রাখা চেয়ার দুটোতে বসল। জানালা খুলে পর্দা সরিয়ে দিলো। ঘরের বাতি নেভানো। ডিম লাইট মৃদু আলো ছড়াচ্ছে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। তার গা গলে জোছনা গড়িয়ে পড়ছে। জোছনার অনেকখানি তাদের ঘরে ঢুকে অন্যরকম পরিবেশ তৈরি করেছে। নববী অন্যরকম চোখে হাবিবের দিকে তাকাল। তার হাতে চায়ের কাপ। হাবিব বলল, “চা-টা খুব ভালো হয়েছে। এমন পরিবেশে প্রিয় মানুষের সাথে চা উপভোগ করার সৌভাগ্য খুব কম মানুষের হয়। ভাবতেই ভালো লাগে আমি তাদের একজন।”

নববী কিছু বলল না। হাসল। স্নিগ্ধ কোমল হাসি। দেখতে ভালো লাগে। অন্যরকম শান্তি অনুভব হয়।
মিলির খুব ভাঙল বেলায়। ঘুম থেকে উঠেই সে গোসলে ঢুকল। সময় নিয়ে গোসল সেরে সবথেকে ভালো পোশাকটা পরল। চুল আঁচড়ে, চোখে কাজল লাগালো।
তার মা বলল, “এত সাজগোছ করে কোথায় যাচ্ছিস?”
“কাজ আছে মা। কয়েকদিন বাড়ি ফিরব না। এক বান্ধবীর সাথে ওর মেসে থেকে যাব।”
“কিসব বলছিস? কার সাথে থাকবি?”
মিলি মা’কে জড়িয়ে ধরল। আদুরে গলায় বলল, “আব্বাকে সবটা বুঝিয়ে বলেছি। তুমি তার থেকে জেনে নিও। এখন সরো। কথা বলতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।”

মিলি মা’কে সরিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। রোদ উঠে গেছে। চারদিকে সোনালি আলো চকচক করছে।
হাবিব নিজের ব্যাগটা শেষবারের মতো করে দেখে নিলো। নববী কপলে হাত রেখে বলল, “সময়মতো খাবার খাবে। দুশ্চিন্তা করবে না। রাত জাগবে না।”
নববী ধরা গলায় বলল, “সাবধানে যাবে। পৌঁছে কল দিয়ে জানাবে। নিজের যত্ন নেবে।”
“তুুমিও নিজের যত্ন নেবে। না খেয়ে থাকবে না। দুশ্চিন্তা করবে না। নাইমাকে বলে দিয়েছে – ও তোমার খেয়াল রাখবে।”

“নাইমা সবসময়ই আমার খেয়াল রাখে, খুব যত্ন করে। এমন ননদ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।”
হাবিব আর সময় নষ্ট করল না। তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল। দশটার বেশি বাজে। বারোটায় গাড়ি ছাড়ার কথা। নববী শূন্য দৃষ্টিতে হাবিবের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। তার মন খারাপ হয়ে গেছে। চোখে পানি এসে যাচ্ছে।

চন্দ্রাস্ত পর্ব ২