চন্দ্রাস্ত শেষ পর্ব 

চন্দ্রাস্ত শেষ পর্ব 
ফারহানা কবীর মানাল

সজীব দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে। চোখে-মুখে অসহায়ত্বের ছাপ। দারোগা সাহেব তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন। শান্ত গলায় বললেন, “এই খু’নের সাথে আর কে জড়িত? হাবিব, মিলির মা বাবা এদের কেউ জড়িত নেই তো?”
“আপনাকে দেখে এতো বোকা মনে হয় না। তবুও বলছি মিলিকে খু’ন করার পরিকল্পনা আমার। এর সাথে আর কেউ জড়িত নেই।”
“তোমার সেই বন্ধুর নাম কি? যার সাহায্যে তুমি মিলিকে বি’ষ দিয়েছিলে?”
“ফাহাদ। মাস ছয়েক চায়ের দোকানে পরিচয়। তারপর থেকে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। দিনে রাজমিস্ত্রীর কাজ করলেও রাতে টুকটাক অন্য কাজ করে। ওকেই কিছু টাকা দিয়ে তান্ত্রিক সাজতে বলি। বি’ষটাও ওই জোগাড় করে এনেছে।”

“এই ফাহাদকে কোথায় পাওয়া যাবে?”
“চৌরাস্তার মোড়ে একটা চায়ের দোকান আছে। রোজ সন্ধ্যায় সেখানে চা খেতে আসে। হয়তো এখনো এসেছে। গিয়ে দেখতে পারেন। রোগামতো ফর্সা চেহারার। চিবুকের কাছে ফিনফিনে কয়েক গোছা দাড়ি। ডান হাতে কা’টা দাগ। পান খেয়ে দাঁত লাল করে রাখে।”
দারোগা সাহেব কনস্টেবল ডেকে ফাহাদকে এ’রে’স্ট করতে পাঠালেন। সজীবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেলেও একটা ব্যাপারে খটকা রয়ে গেছে।”
“বলুুন কি জানতে চান। এখন আর কোন কিছুতে লুকোচুরি নেই।”
“হঠাৎই কেন নিজের দোষ স্বীকার করে নিলেন?”
“আগেই এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। হয়তো সেই উত্তর আপনার পছন্দ হয়নি। আরও একটা কারণ বলছি– ফাহাদ আরও টাকা চাচ্ছিল। বলছিল– তাকে আরও এক লাখ টাকা না দিলে পুলিশকে সব সত্যি বলে দেবে। আমাকে ধরিয়ে দেবে। এক কথায় ব্লাকমেল করছিল।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ব্লাকমেল তাকেই করা যায় যার কাজকর্ম ব্লাক হয়। যাইহোক ফাহাদের জন্য নিজের দোষ স্বীকার করে নিলেন?”
“গতকাল আমার কক্সবাজার যাবার কথা ছিল। ভেবেছিলাম বউকে নিয়ে সেখানে পালিয়ে যাব। আত্মগোপনে থাকলে কেউ আর আমাকে খুঁজে পাবে না। তাছাড়া অফিসের কাগজপত্র যে আমিই সরিয়েছি এটা জানতে আরও দু-দিন সময় লাগত। এর মধ্যে দেশের বাইরে যাবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু কাল থানায় আসার পর এসবকিছু আর সম্ভব ছিল না। পুলিশ আমাকে নজরে রাখত। তাই আর ঝামেলা বাড়াতে চাইনি।”
“অথচ গতকাল বললেন অফিসের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেছে। আজ আবার বলছেন দু-দিনের মধ্যে জানাজানি হয়ে যেত?”

“গতকাল সত্যি কথা বলেছি। এখনও সত্যি কথা বলছি। গতকাল অফিসের নাইটগার্ড মোখলেস মিয়া কল দিয়ে সাবধান করে দিয়েছিল যে সবাই আমার খোঁজ করছে। আর আজ আপনাকে আমার পরিকল্পনার কথা বললাম।”
“নাইটগার্ড মোখলেস! সে-ও এসবের সাথে জড়িত?”
“না সে জড়িত নয়। বহুদিন আগে ওর মেয়ের চিকিৎসার জন্য হাজার দশেক টাকা দিয়েছিলাম। তখন থেকে আমাকে ফেরেশতার মতো জানত। তা-ই হয়তো বলেছে। উপকারের ঋণ শোধ করতে চাইছে।”
“বেশ ঝামেলার কে’স। দেখি তদন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে। তবে আপনার বেশ ভালো শা’স্তিই হবে। ভাগ্য খারাপ থাকলে ফাঁ’সিও হতে পারে।
সজীব ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। দারোগা সাহেব নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। মোবাইল বের করে কারোর নম্বর খুঁজতে লাগলেন।

শরিফা বেগম চুলায় চায়ের পানি চাপিয়েছেন। তার মেজাজ অসম্ভব রকমের খারাপ হয়ে আছে। মিলিদের বাড়ি থেকে ফেরার সময় মানিক মিয়াকে বলেছিলেন– রোহানকে কিছুদিন তার সাথে থাকতে দিতে। এ বাড়ির শোক কাটলে না হয় আবার ফিরে আসলো। মানিক মিয়া রাজি হননি। উল্টো মুখ তেঁতো করে বলেছেন, “আমার সবই তো শেষ। বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটুকুও কেঁড়ে নিতে চাইছেন। আমার এতটুকু সুখ আপনার সহ্য হচ্ছে না?”
মানিক মিয়ার কথায় তিনি বিশেষ কিছু মনে করেননি। তার মেজাজ বিগড়ে গেছে নাইমার কথা শুনে। নাইমা তাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলেছে– মা, এখন আর ঝামেলা করো না। উনাদের অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করো। রোহান এখানেই থাকুক। পরে এসে না নিয়ে যাওয়া যাবে।”

মেয়ের কথা তার সহ্য হয়নি। এত বড় হয়ে গেছে যে এখন মা’কেও জ্ঞান দিচ্ছে। তিনি কাপে চা ঢাললেন। তাতে দু-চামচ চিনি মেশালেন। এক চামচ উঁচু এবং এক চামচ সমান সমান। তিনি চায়ের কাপ নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। বিছানায় বসার পরপরই নাইমা এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। আহ্লাদী গলায় বলল, “আমিও চা পান করব। আমাকেও একটু দাও।”
শরিফা বেগম তাকে সরিয়ে দিলেন। বিরক্ত গলায় বললেন, “খেতে ইচ্ছে করলে নিজে বানিয়ে খা। আমাকে বিরক্ত করিস না।”
“রেগে যাচ্ছ কেন বাপু? বাচ্চা একটা মেয়ে একটু চা চাইছে। তাই দিতে পারছ না? তোমার মন এত কঠিন কেন শুনি।”
তিনি মুখের গাম্ভীর্য ধরে রাখলেন। জবাব দিলেন না। নাইমা আবারও বলল, “চা না দিলে তোমার পেট ফুলবে। তখন বাথরুমের মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে থাকতে হবে।”

শরিফা বেগম খুব বেশিক্ষণ নিজের গাম্ভীর্য ধরে রাখতে পারলেন না। মেয়ের আহ্লাদী কথায় গলে জল হয়ে গেলেন। মুখ ফুুলিয়ে বললেন, “তোমরা সবাই বড় হয়ে গেছ। এখন আর মা’কে লাগে না। নিজেরাই সব বোঝো। আমি অশিক্ষিত মানুষ, কথাবার্তা বুঝি না।”
নাইমা নিষ্পাপ মুখ করে অপরাধী গলায় বলল, “আর বলব না। এবাবের মতো মাফ করে দাও। ভুল হয়ে গেছে। আমি তো তোমারই মেয়ে নাকি!”
শরিফা বেগম হাসলেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি আর রেগে নেই। মাথা ধরা সেরে গেছে।
ঘড়িতে রাত দশটার মতো বাজে। চাঁদ আজকে আর একটু বড় হয়েছে। আগের দিনের চেয়ে বেশি জোছনা দিচ্ছে। অসংখ্য তারার মেলা বসেছে। হাবিব জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। নববী একটা চেয়ার নিয়ে এসে তার পাশে বসল। তরল গলায় বলল, “এভাবে বসে আছ কেন? মন খারাপ?”

“মন খারাপ না। মাথাটা ব্যাথা করছে। মাথা একটু টিপে দাও তো।”
“তোমার কখনও গলা ব্যাথা করে না?”
হাবিব হাসল। হাস্যজ্জ্বল গলায় বলল, “গলা ব্যাথা করলে কি করবে? গলা টি’পে দেবে?”
সে চুপ করে রইল। হাবিব তার হাত চেপে ধরল। বলল, “গলা টিপে আমাকে মে’রে ফেলতে চাও?”
নববী এমনভাবে তাকাল যেন সে খুব আহত হয়েছে। হাবিব অসম্ভব কোমল গলায় বলল, “তোমার সেই সাহস নেই। তুমি আমাকে আ’ঘা’ত করতে পারবে না। নিজের মনের সাথে যু’দ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে যাবে। তোমার মন কখনও সায় দেবে না। এখন বলো এই কথাগুলো কোথায় শুনেছ?”
নববী যন্ত্রের মতো বলল, “গল্পের বইতে পড়েছি।”

রাত প্রায় শেষ। চাঁদের আলো বেশ অনেকখানি উজ্জ্বল। অন্ধকার প্রায় ম’রে গেছে। পুরনো ক’ব’রের পাশে একটা নতুন ক’ব’র গড়ে উঠেছে। কাঁচা মাটির গন্ধ এখনো বেশ তীব্র। এই নতুন ক’ব’রের মালিক মিলি। সে এখানে ঘুমিয়ে আছে। জীবনের হিসাব চুকিয়ে, দুনিয়ার কষ্ট দুঃখ পিছনে ফেলে নিশ্চিতে ঘুমিয়ে আছে। আদো কি তাই? সত্যিই কি ঘুমিয়ে আছে? দুনিয়ার অন্যায়গুলো কি তাকে ঘিরে ধরেনি? তার ক’ব’রে কি শা’স্তি হচ্ছে না? তার কি কোনন জবাবদিহিতা নেই? এসব প্রশ্ন খুব ছোট। তবে তার উত্তর কারোর জানা নেই। মৃ’ত্যুর পর মানুষের আর কোন সাহায্যকারী নেই। এমন কোন মানুষই নেই যে একজন মৃ’ত ব্যক্তির খবর দিতে পারে। বলতে পারে সে ভালো আছে। জীবন মৃ’ত্যুর এই সমীকরণ বেশ জটিল। নিশ্চিত উত্তর পাওয়া যায় না।

ঘটনার বেশ অনেকদিন পর হয়ে গেছে। দারোগা সাহেব নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে তদন্ত করেছেন। সজীবের কথার বাইরে আর কোন কিছুর প্রমাণ খুঁজে পাননি। ফাহাদও ধরা পড়েছে। অপরাধ স্বীকার করেছে। তাদের কে’স কোর্টে উঠেছে। আজ সেই কে’সের শুনানি হবে। নাইমা হাবিবের সাথে আদালতে এসেছে। কি হয় না হয়। তারা দু-জনে বিচার কক্ষে ঢুকল। বিচারক এখনও এসে পৌঁছায়নি। পেছনের দিকে একটা বেঞ্চে বাদশা এবং রাফিয়া বসে আছে। নাইমা গিয়ে তাদের পাশে বসল। উৎসুক গলায় বলল, “আপনারা এখানে?”
রাফিয়া বলল, “এইতো এসেছি। তোমার কি খবর? দিনকাল কেমন যাচ্ছে।”
“আমি ভালো আছি।” তারা কথা বলতে শুরু করল। কথার এক পর্যায়ে নাইমা বলল, “আমার মনে এখনও একটা প্রশ্ন রয়ে গেছে।”

বাদশা বিস্মিত গলায় বলল, “এখনও কি প্রশ্ন রয়ে গেছে?”
“রাফিয়া আপু। প্রতিদিন দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। সেদিন কিভাবে অতো ভোরে ঘুম থেকে উঠে পায়েস রান্না করল? আর কেনই বা করল?”
রাফিয়া হাসল। সরল গলায় বলল, “ওদিন বাদশার জন্মদিন ছিল। রাতে বলেছিল তার পায়েস খেতে খুব ইচ্ছে করছে। তাই ভোরবেলা উঠেছিলাম।”
“সত্যি? বাদশা ভাই, ওইদিন আপনার জন্মদিন ছিল?”
হাবিব মোবাইল বের করে তারিখ দেখল। একটু হেসে বলল, “হ্যাঁ, ওইদিন বাদশা ভাইয়ের জন্মদিন।”
নাইমা বলল, “বাদশা ভাই, আপনারা জন্মদিন পালন করেন?”
“হ্যাঁ, ওই একটা কেক কা’টি। খাওয়াদাওয়া করি। এই আর কি! কেন তুমি তোমার জন্মদিন পালন করো না?”
“না। আমি কখনো আমার জন্মদিন পালন করি না। কেউ কিছু করতে চাইলেও নিষেধ করি।”
“কেন এমন করো? এটা তো একটা বিশেষ দিন।”

“আমার কাছে আমার জন্মতারিখ বছরের বাকিসব দিনের মতো স্বাভাবিক। হাদিসে আছে– “যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাদৃশ্য গ্রহণ করে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।”
(আবু দাউদ, হাদিস: ৪০৩১)
আমার জানা মতে ইসলামি সংস্কৃতিতে জন্মদিন পালনের ব্যাপারটা নেই। এটা খ্রিস্টানদের রীতি। তাই কখনো পালন করা হয় না।”
রাফিয়া একটু তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “এর আর এমন কি? আজ-কাল কত হুজুররাও জন্মদিন পালন করছে।”
“কে কি পালন করল না করল তাতে আমার কি বলেন? যে কোন পরিচয় পেতে গেলে সেই বিষয়টা সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করতে হয়। একজন ডাক্তার চিকিৎসা শাস্ত্রে যত বেশি পারদর্শী হয় তাকে তত ভালো ডাক্তার বলে। কিংবা যে যত ভালো রান্না করতে পারে সে ততো পাকা রাঁধুনি। তেমনই যে যত বেশি ইসলামের আইন মেনে নিতে পারবে সে ততো ভালো মুসলিম। এ বিষয়ে নিশ্চয়ই আপনার কোনন আপত্তি নেই?”
“না নেই।”

“পরিপূর্ণ মুসলিম হতে গেলে ইসলামের সব নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে। আমি কাউকে জোর করছি না। কাউকে কিছু মানতে বাধ্যও করছি না। যা সত্যি তাই নিজে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছি। এতটুকুই। কারণ আমার হিসাব আমাকেই দিতে হবে। কোন হুজুর কি করল তাতে আমার কিছু যাবে আসবে না। কারণ এটা একটা প্রসিদ্ধ হাদিস।”
তারা দু’জন আর কিছু বলল না। হাবিব আঁড়চোখে নাইমার দিকে তাকাল। বাচ্চা একটা মেয়ে। সেদিনও তার হাত ধরে মেলায় ঘুরে বেড়িয়েছে। মাটির হাঁড়ি পাতিল কিনে দেবার জন্য বায়না ধরেছে। আর সে কত বড় হয়ে গেছে! জ্ঞান বুদ্ধিতে এতটুকু কমতি নেই।

চন্দ্রাস্ত পর্ব ১৪

বিচারক নির্দিষ্ট সময়ে বিচারকার্য শুরু করলেন। তথ্য প্রমাণ উপস্থিত করা হলো। অনেক কথাবার্তার পর বিচারক রায় দিলেন। মিলির খু’নের সাথে অন্যকারো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। সজীব এবং ফাহাদের শা’স্তি হয়েছে। খুব দ্রুত শা’স্তি কার্যকর করা হবে। আদালত থেকে বেরোবার মুহুর্তে নাইমা এক পলক সজীবের দিকে তাকাল। কি অদ্ভুত জীবন এই মানুষটার! পৃথিবীতে তাকে যতদিন মনে করা হবে ততদিনই তার পরিচয় সে একজন খু’নী।

সমাপ্ত