আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৪৩
তানহা ইসলাম বৈশাখী
অবশেষে চলে এলো সেই রুদ্ধশ্বাস দিনটিতে। যে দিনে তাদের ক্ষণে ক্ষণে শ্বাস আটকে যাবে। কন্ঠনালী শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে।
সেই অপারেশনের দিন আজ। দুদিন পুষ্পর শারীরিক অবস্থা দেখে ডাক্তাররা সিন্ধান্ত নিয়েছে অপারেশন আজকেই হবে। কারন পেসেন্ট শারীরিক ও মানসিক দুদিক থেকেই ভীষন স্ট্রং। তার ভেতর একটা জেদ চেপেছে, তাকে বাঁচতে হবে। নিজের জন্য না হোক প্রার্থর জন্য, নিজের পরিবারের জন্য, আবার মা হবার জন্য। সেই জেদ থেকেই দুদিনেই তার এত পরিবর্তন।
অপারেশনের খুব বেশি সময় নেই। বর্তমানে পুষ্প বসে আছে তার কেবিনে। সামনে প্রার্থ বসা। কথা বলার জন্য অল্প কিছু সময়ই আছে তাদের হাতে। কিন্তু প্রার্থ চুপ হয়ে আছে অনেকক্ষণ। মনেহচ্ছে কথারা তার ঝুলিতে নেই। অথচ মনে এত এত কথা জমে আছে। সে মুখ ফুটে বলতে পারছে না।
প্রথম কথোপকথন শুরু করলো পুষ্পই। খুব আদুরে গলায় বললো,
“ভয় হচ্ছে?”
প্রার্থ কিছু বলে না শুধু তাকিয়ে থাকে। চোখদুটো আজও রক্তজবার ন্যয় টকটকে লাল বর্ন ধারণ করেছে। পুষ্প হাত বাড়িয়ে দেয়।
“এদিকে আসুন।”
প্রার্থ বেডের সামনে টুলে বসে ছিলো। পুষ্প বসে ছিলো তার দিকে ঘুরে। সে এগিয়ে গিয়ে অনায়েসে মাথা এলিয়ে রাখলো পুষ্পর বুকে। দু হাতে জরিয়ে ধরলো শক্ত করে। পুষ্পর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। চুলের ফাঁকে ফাঁকে আদুরে হাতে আঙ্গুল চালায়। মাথায় চুমু দিয়ে বলে,
“যেখানে আপনার আমাকে শান্ত করার কথা সেখানে আমি আপনাকে শান্ত করছি। এটা কোন কথা?”
প্রার্থ এ প্রশ্নের উত্তর দিলো না। বুকের যেখানে মাথা রেখেছে সেখানটায় আগুল ঠেকিয়ে আদুরে গলায় বললো,
“আমার এখানটা চাই। দিনশেষে ক্লান্ত হয়ে এসে এখানটাতে শান্তি খুঁজতে চাই। তুই নাম প্রশান্তিটা আমার চাই। সারা জীবনের জন্য চাই। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
একটু থেমে পুষ্পর মুখ দুহাতে পুরে আবার বললো,
“আমাকে স্বার্থপর ভাবতে পারিস। আমি সত্যিই স্বার্থপর। নিজের স্বার্থের জন্য হলেও আমার তোকে চাই। তুই আমার দেহের সাথে, রুহের সাথে মিশে গেছিস। তোকে ছাড়া দুনিয়াবি জীবনের এক মূহুর্তও চিন্তা করা আমার জন্য দমবন্ধকর। তুই ফিরে আসবি বল। আমার কাছে আসবি। আমার প্রশান্তির কারণ হবি।
প্রার্থর চটা হাতের উপর নিজের নরম হাতটা রাখলো পুষ্প৷।চেপে ধরে ঠোঁটের কাছে হাত এনে চুমু দিলো। মলিন হেঁসে বলল,
” আসবো। আল্লাহ চাইলে আমি আপনার কাছে অবশ্যই আসবো। যদি না আসি তাহলে……..!
বাকিটুকু সম্পূর্ণ করতে দিলো না৷ হেঁচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে এলো। পদ্ম কুঁড়ির ন্যায় পাতলা গোলাপি ওষ্ঠপুটে নিজের তামাক পোড়া অধর ডুবিয়ে দিলো প্রার্থ। ঠোঁটে রাজ চালালো নিজ গতিতে। পুষ্পর কথা বন্ধ হয়ে যায়। চোখ দুটো বন্ধ করে দুহাতে শক্ত করে খামচে ধরে প্রার্থর শার্টের কলার। বন্ধ চোখের ভেতর হতেই বেড়িয়ে আসে নোনা জল। সে জল এসে লাগে প্রার্থর গালে। প্রার্থ এক হাতে পুষ্পর সেই অশ্রু মুছে দেয়। বেশ অনেকটা সময় ধরে ওরা ডুবে থাকে নিজেদের অধরভাজে। সবটুকু দুঃখ কষ্ট এখানেই নিংড়ে দেওয়ার প্রয়াস যেন।
দীর্ঘ চুম্বন শেষে সরে আসে প্রার্থ। কপালে কপাল ঠেকিয়ে চুপ করে থাকে। দুজনেই হাঁপাচ্ছে। তপ্ত শ্বাস এসে আছড়ে পড়ছে একে অপরের মুখে।
প্রার্থ পুষ্পর ঠোঁটে আবারও ছোট্ট একটা চুমু এঁকে সরে আসে। ওর কোমল হাতদুটো নিজের বজ্রমুষ্ঠিতে পুরে মেঘমন্দ্র স্বরে বলল,
“তুই আসবি, তুই ফিরবি আমার কাছে। আমি তোকে ছাড়া বাঁচতে শিখিনি ফুল। আমাকে বাঁচাতে হলে তুই আসবি এবং তুই অবশ্যই আসবি।
কেবিনের উপর বড় বড় অক্ষরে লেখা অপারেশন থিয়েটার। তার উপরেই লাল রংয়ের একটা লাইট জ্বলছে। পুষ্পকে ভেতরে নেওয়া হয়েছে অনেক্ষণ। মেয়েটা এত স্ট্রং একটুও কাঁদেনি। উল্টো বাবা প্রত্যয় এহসান কেঁদেছেন বলে নিজে তাকে শান্তনা দিয়েছে৷
আদরের কন্যাকে এভাবে মৃত্যুর সাথে লড়তে দেখে প্রত্যয় এহসান ভেঙে পড়েছেন। কয়েকদিনের ধকলেই মুখ শুকিয়ে গেছে। তিনি বসে আছেন অপারেশন রুমের বাইরে রাখা সারিবদ্ধ চেয়ারে। চুপচাপ বসে বসে প্রার্থনা করে যাচ্ছেন মেয়ের জন্য।
হসপিটালে বর্তমানে প্রত্যয়, প্রার্থ, অন্ত আর হৃদয় আছে। বাসা থেকে আর কাউকে আসতে দেয়নি। অপারেশনের অনেক আগেই দেখা করিয়ে তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। হসপিটালে ভীর না জমিয়ে বাড়িতে বসে দোয়া প্রার্থনা করুক তাতেই ভালো। অর্নব আর রকির আসতে একটু দেরি হবে। ওরা জরুরী কাজে আটকা পরে গেছে। কার্তিক আসছে।
প্রার্থ আর এক জায়গায় স্থীর নেই। এদিক ওদিক পায়চারি করছে। তার অস্থীর লাগছে। কোথাও স্থীর হয়ে বসতে পারছে না। একবার কেবিনের দরজার বাইরে থম মেরে দাঁড়াচ্ছে আবার এদিক ওদিক হাটছে। বুকের ভেতর উথাল-পাথাল ঝড়। খানিক পর পর শ্বাস আটকে আসছে। বড় বড় দম নিতে হচ্ছে।
হৃদয় উঠে গিয়ে প্রার্থর কাঁধে হাত রাখলো৷ নরম গলায় বললো,
“শান্ত হ বন্ধু। এত বিচলিত হয়ে পরিস না। অসুস্থ হয়ে পরবি। ওখানে একটু বোস। সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
প্রার্থ কথা শুনলো। গিয়ে বসে পরলো সিটে। এরপর সব আবার নীরব। প্রার্থ হাটুর উপর কুনুই রেখে দুহাতে মাথা চেপে নিচু হয়ে বসে আছে। বেশ অনেকক্ষণ এভাবেই বসে রইলো। এক সময় টুপ করে এক ফোটা জল সাদা টাইলসের উপর পরে।
ওর পাশেই ছিলো প্রত্যয় সাহেব বসা। তার দৃষ্টিও ছিলো নিচের দিকে। ওই এক ফোটা জল তার চোখ এড়ালো না। তিনি এগিয়ে এলেন। নিঃসঙ্কোচ হাত রাখলো প্রার্থর কাঁধে। বড় অসহায় কন্ঠে বলল,
“বাবা, তুমি আমাকে মাফ করো। তোমাকে অকারণে ভুল বুঝে অনেক কথা বলে ফেলেছি। আমি বুঝিনি তুমি আমার মেয়ের এতটা জুরে থাকবে। মাঝে মাঝে বাবা-মাও পাত্র নির্বাচনে ভুল করে এবং সন্তানরাই সঠিক পাত্র নির্বাচন করে। আমার মেয়েটাও তার জন্য সঠিককেই নির্বাচিত করেছিলো। আমিই তোমাকে বুঝতে পারিনি। ”
প্রার্থ সংযত করলো নিজেকে। কাঁধে থাকা প্রত্যয়ের হাতের উপর নিজের হাত রাখলো। নরম স্বরে বলল,
“আপনার দোষ নেই আঙ্কেল। প্রথমে আমাদের সম্পর্কটাই এমন ছিলো। মাঝি হীন নাওয়ের মতো। কি করে যেন দুজনেই সেই নায়ের হাল ধরলাম আমারও অজানা। এখন সে আমাকে ফাঁকি দিয়ে পুরো নাওয়ের ভার আমার কাছে ছেড়ে দিতে চাইছে। আমি কি করে একা একা এই নাও বয়িয়ে নিয়ে যাবো বলুন তো।”
শেষের দিকে এসে কন্ঠটা মলিন হয়ে এলো প্রার্থর। প্রার্থর মাথায় স্নেহের হাত রাখলেন প্রত্যয়। বললেন,
“আমার মেয়ে এত ভীতু নয়। দায়িত্বহীনও নয়। নাও বয়িয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব যখন তোমাদের দুজনের তাহলে আমার মেয়ে পিছু হটবে না। তুমি দেখো সে তোমার সাথে আবার নাওয়ের হাল ধরবে। চিন্তা করো না বাবা। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
প্রার্থ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“সেই আশায়ই আছি।”
এরপর শুধু কয়েক জোরা দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ এলো। নীরব রইলো সব। কিছুটা সময় পার হয়ে যাওয়ার পর হৃদয়ের ফোনটা নিরবতা চিরে শব্দ করে বেজে উঠলো। ফোন পকেট থেকে বের করে দেখে প্রিয়ার ফোন। হৃদয় প্রার্থর কাছে এসে আস্তে করে বলল,
“প্রিয়া ফোন করছে প্রার্থ। বাসায় বোধহয় সবাই টেনশনে আছে। ওদের কি বলবো?”
ছোট করে বলা কথাটুকু প্রত্যয় না শুনলেও অন্তর কানে ঠিকই পৌছালো। ওমনিই দাঁত চেপে ধরলো সে। প্রিয়া হৃদয়ের ফোনে কল করেছে বিষয়টা মাথায় ঢুকতেই রাগে মাথা দপদপ করে উঠছে। জেদটুকু চেপে বসে রইলো সে।
তখনই কানে এলো প্রার্থর গম্ভীর স্বর। সে ছোট করে বলল,
“অন্তর কাছে দে।”
কথাটুকু শুনে দুজনেই হতভাগ। হৃদয় কপাল গুটিয়ে বললো,
“ও কি বলবে?”
“তুই দে ওকে।”
প্রার্থর উপর আর কথা বললো না। ফোনটা দিয়ে দিলো অন্তর হাতে। অন্ত তখনো ভীতু চোখে তাকিয়ে প্রার্থর দিকে। প্রার্থ ছোট করে বললো,
“বল এখানে সব ঠিক আছে। বেশি টেনশন যেন না নেয়।”
অন্ত ফোনটা রিসিভ করে কানে নিলো। উঠে গিয়ে একটু দূরে দাঁড়ালো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো প্রিয়ার নিভু নিভু কন্ঠস্বর,
“হৃদয় ভাই।”
“অন্ত।”
অন্তর খিটখিটে স্বর। ওপাশে প্রিয়া অবাক হয়। ফোন দিলো হৃদয়কে ধরলো অন্ত। ব্যপার কি? ও কিছু বলবে তার আগেই অন্ত বলল,
“হৃদয়কে হঠাৎ এত মনে পড়ছে কেন? এ সময়ে তার ফোনে কল দিচ্ছেন যে।”
খোঁচা মার্কা কথা শুনে মুহুর্তেই রেগে যায় প্রিয়া। নিভু স্বর বদলে যায়। কন্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে বলে,
“একদম বাজে কথা বলবে না তুমি। তোমাকে কতবার ফোন করেছি তোমার খেয়াল আছে? তোমাকে দিচ্ছি, ভাইকে দিচ্ছি, আব্বুকে দিচ্ছি কেউ ফোন তুলছো না। তো এখন আমি কাকে ফোন করবো। হৃদয় ভাই ছিলো তাই তাকেই কল করেছি। বাকিরা আমার ফোন না ধরলো তুমি তো ধরবে। আমার ফোনের কোন ভ্যালু আছে তোমার কাছে? দুদিন ধরে দেখছি ইগনোর করছো তো করছো এখনো অব্দি করেই যাচ্ছো। কতবার ফোন দিয়েছি তোমাকে খেয়াল আছে? নাকি ইচ্ছে করে খেয়াল করোনি?”
অন্ত এবার নিভে আসে। ফোনটা যে সাইলেন্ট করা। ওর অনুশোচনা হলো ভীষন। শুধু শুধু প্রিয়াকে এভাবে বলা ঠিক হয়নি। এমনিতেই মায়ের কথায় প্রিয়াকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলছে। ওর মা কেমন সেটা ও ভালো মতোই জানে। একবার যা বলবে তাই করে ছাড়বে। এর থেকে ভালো এখন একটু দূরত্ব নিয়ে চলবে। পরে যে করেই হোক বিয়ে করে একেবারে নিজের করে নিবে। ততদিনে প্রিয়াকে চোখের সামনে দেখতে পারলেই চলবে। চোখের শান্তিই মনের শান্তি।
কিন্তু কেস তো উল্টে যাচ্ছে। প্রিয়া অভিমান করলে তো সমস্যা। যে জেদ মেয়ের। একবার ভুল বুঝলে অন্তকে যে কত কি করতে হবে তার কোন শেষ নেই।
সে কন্ঠটা খাদে নামিয়ে বলল,
“স্যরি! আমি খেয়াল করিনি। ফোনটা সাইলেন্ট ছিলো। কিন্তু তুই আর কখনো হৃদয়কে কল করবি না সে যত দরকারই হোক না কেন?
প্রিয়া আরো তেতে উঠে,
” কেন? কেন? ফোন করলে তোমার কি? আমি একশো বার ফোন করবো। তোমরা তো ফোন ধরবে না। আমি কি আপুর অবস্থা জানবো না? এখানে আমাদের চিন্তা হয় না? আমি এখন বারবার হৃদয় ভাইকেই ফোন করবো।
অন্ত আহত গলায় ডাকে,
“প্রিয়া! স্যরি বললাম তো। প্লিজ ওকে ফোন করবি না। আমার ভেতরে জ্বলে পুড়ে যায়। আমাকে পোড়াতে তোর ভালো লাগে?”
প্রিয়াও এবার মিয়িয়ে আসে। ওর এমন ডাকে ও কথায় প্রিয়া বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। তাই আর জ্বালালো না ওকে। কথা ঘুরিয়ে পুষ্পর কথায় এলো,
“ঠিকাছে করবো না। এখন বলো আপুর কি খবর? আর ভাই, প্রার্থ ভাইয়ের কি খবর? ভাই কাঁদছে? আব্বুও কি কাঁদছে?
” ডাক্তাররা এখনো বের হয়নি। ভাই আর আঙ্কেল ঠিক আছে। কাঁদছে না। তুই চিন্তা করিস না। ওদিকে বড়মাদের চিন্তা করতে বারন করিস। এখানে ডাক্তার বের হলে কিছু বললে আমি তোকে কল করবো। এখানে ফোন করার দরকার নেই। ”
“ঠিক আছে। খবর জানিও কিন্তু।”
“হুম। চিন্তা করিস না। রাখছি।”
ফোনটা কেটে দিলো অন্ত। গিয়ে হৃদয়ের হাতে ফোন দিয়ে প্রার্থর পাশে আবার বসলো৷
এরও আরো অনেক্ষণ পর থিয়েটারের উপরের জ্বলা লাল বাতিটা বন্ধ হয়ে গেলো। জানান দিলো অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু সাকসেসফুলি হয়েছে তো?
কিছুক্ষণের মাথায় ডাক্তারি পোশাক ও মাক্স পড়া দুজন ডাক্তার বের হলো ভেতর থেকে। প্রার্থ হন্যে হয়ে এগিয়ে যায় তাদের সামনে। বিচলিত হয়ে বলে,
“কি হলো? ও ঠিক আছে? অপারেশন ঠিকঠাক হয়েছে? কোন ক্ষতি হয়নি তো? ও ভালো হয়ে যাবে?
ডক্টর ইফতেখার মাক্সটা খুলে থুতনিতে ঝুলিয়ে রাখলেন। বললেন,
” রিল্যক্স প্রার্থ। এত হাইপার হইও না। কাম ডাউন। অপারেশন একদম ঠিকঠাক হয়েছে। আমরা আশা রাখছি জ্ঞান ফিরলেই সব ঠিকঠাক হবে। ”
প্রার্থর বিচলিত ভাব কাটলো না দ্বিগুন উদ্বেগ নিয়ে বলল,
“জ্ঞান ফিরলে মানে? জ্ঞান কখন ফিরবে? আমাকে চিনতে পারবে ? অন্য কোন সমস্যা হবে না তো?
” রিল্যাক্স, এত উত্তেজিত হচ্ছো কেন? সব ঠিকঠাক আছে। এই অপারেশনের পর পেসেন্টের ৪৮ ঘন্টার আগে জ্ঞান নাও ফিরতে পারে। আমাদের এতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। জ্ঞান এর আগেও ফিরতে পারে অথবা পরেও ফিরতে পারে। তবে আমরা আশা রাখছি সব ঠিকঠাক হবে। টেনশন নেওয়ার কারণ নেই।
“আমি ওকে একটু দেখতে পারি?”
“এখন নয়। সময় লাগবে। অপেক্ষা করো। তুমি দেখা করতে পারবে চিন্তা নেই। এতক্ষণ যখন অপেক্ষা করেছো। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। টেনশন নিও না। শুধু যেনে রাখো সব ঠিকঠাক আছে। ওকে?”
ডক্টর বিদায় নিয়ে চলে গেলো। প্রার্থরা আবারও অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলো। এতক্ষণ সহ্য হলেও এই ৪৮ ঘন্টার অপেক্ষার কথাটুকু তার সহ্য হচ্ছে না। ৪৮ ঘন্টা ৪৮ বছরের সমান মনে হচ্ছে।
অর্নবের বাবার অফিসে কিছু জরুরী কাজ পরে গেছিলো। বিয়ের পর সে নিজেও বাবার বিজনেসে হাত দিয়েছে। সেই অফিসের কাজেই আটকা পরে গেছিলো।
দ্রুতপায়ে বাড়ি ফিরলো সে। নিজের রুমে এসে স্নেহাকে ঝটপট বলল,
“জলদি তৈরী হয়ে নাও। হসপিটালে যাবো। পুষ্পর অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। প্রার্থর কাছে যেতে হবে আমাকে। তুমি তো যেতে চেয়েছিলো জলদি তৈরী হও।”
অর্নব যেন খুব তাড়ায় আছে। মাত্রই সে খবর পেলো ওখানকার। হৃদয় ফোন করে বলেছে। কার্তিক রকি পৌঁছে গেছে। অর্নবের যাওয়া বাকি। স্নেহা কাল থেকে যেতে চাইছে তাই তাকে নিয়ে যেতে চাওয়া।
স্নেহা তখন বসে বসে বই পড়ছিলো। খুশির খবরটা শুনে লাফিয়ে উঠে। অর্নবের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। উত্তেজনায় আরেক বার জিজ্ঞেস করে,
“সত্যিই? পুষ্প আপু ঠিক হয়ে গেছে? আল্লাহ! আল্লাহ আমাদের কথা শুনেছে অর্নব। আমার যে কি খুশি লাগছে।”
বলতে বলতেই অর্নবকে গিয়ে জরিয়ে ধরে। একেবারে টাইটলি ধরে দুহাতে। অর্নব হতবাক, হতচেতন, হতবিহ্বল হয়ে পরে। ওর শরীরে ঘাম ছিলো নোংরা ছিলো। অফিস থেকে এত তাড়াতাড়ি ফিরেছে যে ঘেমে গেছে একেবারে। রাস্তার ধুলোবালি লেগেছে। এখন জলদি জলদি একটু শাওয়ার নিয়েই বের হতো। অথচ মেয়েটা এভাবে জরিয়ে ধরলো। একেবারে নিঃসঙ্কোচ! ওর ঘর্মাক্ত শরীর কি তার কাছে নোংরা লাগছে না? মেয়েটা এত সরল কেন? এত অমায়িক কেন তার ব্যবহার? অর্নব কি এত ভালো স্ত্রী ডিজার্ভ করে? ও তো স্বামী নামক কোন দায়িত্ব পালনও করে না। তাকে এক টুকরো সুখও দেয় না। ওর কপালেই কিনা এত ভালো মেয়ে জুটলো?
অর্নব আলগোছে হাতদুটো রাখে স্নেহার কাঁধে। মোহনীয় কন্ঠে সুধায়,
“স্নেহা, আমি ঘেমে আছি। তোমার শরীরে নোংরা লাগবে। ”
স্নেহা ছাড়ে না। বুক হতে মুখটা তুলে খুশিখুশি মনে বলে,
“লাগবে না। লাগলেও সমস্যা নেই। আপনি এত ভালো একটা খবর দিয়েছেন আমার ইচ্ছে করছে আপনাকে একটা চুমু খাই।”
লাগামহীন কথাটা কর্ণকুহর হতেই অর্নের চোখদুটো বড় বড় হয়ে যায়। এই কি সেই মেয়ে, যার এত প্রসংশা করলো ও এতক্ষণ যাবত?
স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই বড় বড় চোখ দেখে স্নেহা মিয়িয়ে যায়। বুঝতে পারে ভুল শব্দ ব্যবহার করে ফেলেছে। দুজন এত কাছাকাছি দেখেও মাস্তিস্ক বিরাট সাইরেন বাজিয়ে বেজে উঠে। ঝটপট সরে এসে দাঁড়ায়। মাথা নিচু করে অপরাধীর ন্যায় সাফাই গায়,
“আসলে আমি ওভাবে বলি নি। মানে….!
তখনই ভেসে এলো অর্নবের দুষ্টু কন্ঠস্বর,
” ইট’স ওকে। স্বামীকে চুমু খেতে চাওয়া অপরাধ নয়। তুমি চাইলে খেতে পারো। একটা নয় দশটাও খেতে পারো। তবে এখন নয়। এখন শরীরে জীবানু আছে। একটু শাওয়ার নিয়ে আসি তখন দিও। চুমুটুমু খেয়ে তারপর নাহয় হসপিটালে যাবো।”
আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৪২
অর্নবকে মুহুর্তেই পল্টি খেতে দেখে স্নেহা হতবম্ভ। মাত্রই তো এমন চোখে তাকাচ্ছিলো যেন কতবড় ভুল বাক্য বলে ফেলেছো সে। এখন নিজেই এমন লাগামহীন কথাগুলো বলে ফেললো?
স্নেহাকে নির্বোধ বানিয়ে রেখে অর্নব শার্ট প্যান্ট নিয়ে চলে গেলো ওয়াসরুমে। স্নেহা ওভাবেই দাড়িয়ে থাকে।
এবার কি তাহলে ওদের সম্পর্কটা একটু স্বাভাবিক হবে? স্বভাবিক আর দুটো স্বামী-স্ত্রীর মতো নিঃসঙ্কোচ ব্যবহার কি করতে পারবে তারা? স্নেহা মনে প্রানে খুব করে চায় সম্পর্কটা স্বাভাবিক হোক। তাদের মাঝে কোন জড়তা না থাকুক। একটু ভালো বাসা বাসির গল্প হোক।