আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৪৫

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৪৫
তানহা ইসলাম বৈশাখী

পুষ্পকে বাড়িতে নিয়ে এলো আজ বিকেলে। জ্ঞান ফেরার পর একদিন হসপিটালে রাখা হয়েছে। এরপর ডাক্তাররাই ডিসচার্জ করে দিয়েছে। এবং বাড়িতেই বিশেষ যত্ন নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর প্রার্থ তাতে এক বিন্দুও অজুহাত রাখেনি। কখন কি লাগে না লাগে সব ও নিজে করে।
এইতো সন্ধ্যা বেলার কথা, পুষ্পর চুলে জট হয়েছে প্রচুর। চুল আচরানো হয়নি কদিন ঠিকঠাক। পুষ্পর মা তাই মেয়ের চুল আঁচড়ে দিচ্ছিলো। তিনি আজ এ বাড়িতেই থাকবে মেয়ের কাছে।
মাথায় চিরুনি চালানোর সময় হুট করে প্রার্থ এলো। ছোটমার থেকে চিরুনি টা নিয়ে নিলো। পূর্ণতা অবাক হয়ে বলল,
“কিরে প্রার্থ, চিরুনি নিলি কেন বাবা?”
“তুমি উঠো ছোটমা। তুমি পারবে না। আমি করে দিচ্ছি।”
পূর্ণতা হেসে ফেললেন ওর কথা শুনে। বললেন,
“মাথা কি ওর আজ নতুন আঁচড়াচ্ছি নাকি? দে বাবা। মেয়েটার মাথায় জট বেঁধে গেছে। শেষে চুল নষ্ট হয়ে যাবে। ”
প্রার্থ একপ্রকার টেনে উঠালো উনাকে,
“তুমি উঠো তো ছোটমা। আজ আমাকে করতে দাও। মাথার পেছন দিকেই কিন্তু কাটা হয়েছে। তুমি ভয় পাবে। একটু এদিক ওদিক হলে ও-ও ব্যথা পাবে।”
পূর্ণতা উঠেই গেলো। ঠিকই বলেছে, মেয়ের ঘা দেখলে মায়ের মনে কষ্ট হবে। এর থেকে ভালো মেয়ের স্বামীই যত্ন করে আঁচড়ে দিক।

প্রার্থ বসলো সোফায়। পুষ্প নিচে ফ্লোরে বসে ছিলো যাতে আঁচড়াতে সুবিধা হয়। ওভাবেই বসে রইলো। ওর চুলগুলো সব প্রার্থর কোলের উপর রাখলো। কিন্তু এত বড় চুল কি করে কি করবে সেটাই বুঝতে পারছে না। তবুও চিরুনি চালালো খুব সাবধানে। মাথার পেছনে যে অংশটা কেটে সার্জারী করেছে তার চারপাশের এক ইঞ্চি জায়গায় চুল নেই। ডাক্তাররা পরিষ্কার করে নিয়েছে ওইটুকু যাতে কোন সমস্যা না হয়। পুষ্পর ঘন ও বড় বড় চুলের জন্য ওই ফাকা জায়গাটুকু খুব একটা দেখা যায় না।
প্রার্থ খুব সাবধানে চুল আঁচড়ে দিলো।
পাশ থেকে পূর্ণিমা বেগম ছেলেকে বলে উঠলেন,
“হ্যাঁ রে প্রার্থ। যেভাবে বউয়ের যত্ন নিচ্ছিস সেভাবে মায়েরও তো যত্ন নিস না।”
প্রার্থ মায়ের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“আমি তোমার যত্ন নেই না বলছো?”
“নিস বুঝি? কই কখনো তো এভাবে চুল আঁচড়ে দিলি না।”
“আসো তোমাকেও করে দিচ্ছি।”
পূর্ণিমা হেঁসে ফেললেন। ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন,
“লাগবে না। আমার যত্ন নেওয়ার জন্য আমার বউমা আছে। তুই তোর বউয়ের যত্ন নে তাতেই হবে।”
এভাবেই সন্ধ্যায় একচোট আড্ডা, গল্প হলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এখন বাজে প্রায় ১০ টা। পুষ্পর রেস্টের জন্য রাতে জলদি জলদি ঘুমানো প্রয়োজন। তবুও দেরি হয়ে গেলো। ডিনার করে একটু গল্প করতেই সময় হয়ে এলো। প্রার্থ পুষ্পকে নিয়ে রুমে শুয়িয়ে দিয়ে এসেছে। নিচ থেকে একবার মায়ের সাথে কথা বলে আবার উপরে এলো। পুষ্প চোখ বুজে শুয়ে আছে। প্রার্থ রুমের দরজা লাগিয়ে লাইট অফ করে বিছানায় এলো। নিঃশব্দে শুয়ে পড়লো। ও ভাবলো পুষ্প ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু সে ঘুমায়নি। প্রার্থ শুতেই ও পাশ থেকে জরিয়ে ধরলো। প্রার্থ ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“ঘুমাসনি?”
পুষ্প ঘনঘন মাথা নাড়িয়ে বলল,
“আপনাকে ছাড়া ঘুম আসছিলো না।”
প্রার্থ ওকে টেনে নিজের হাতের উপর শোয়ালো। দুহাতে বুকের মাঝে আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে ধরে বলল,
“ঘুমা। ”
পুষ্প ওর বুকের উপর আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলে উঠে,
“শুনুন না!”
“শুনছি।”
“আমি গল্প করবো।”
“এত রাতে কিসের গল্প। ঘুমা।”
“আমার ঘুম আসছে না।”
প্রার্থ চোখ রাঙিয়ে বলে,
“ফুল, ঘুমা। তোর রেস্ট প্রয়োজন।”

“এমন করছেন কেন? যদি আর ফিরে না আসতাম? দুদিন আগেও তো কত কথা বলতে চাইতেন। এখন কাছে আছি তো তাই কদর করছেন না। আমার পেটে অনেক কথা জমা হয়ে আছে একটু বলি?”
অভিযোগের তোপে তপ্ত শ্বাস ছাড়ে প্রার্থ। মাথায় চুমু খেয়ে বলে,
“আচ্ছা বল কি বলবি। তবে একটা কথা বলে দেই। স্মৃতির পাতার এই অধ্যায় আর কখনো খুলবি না। বিষাক্তময় পাতা অতীতের তলে ডুবে থাকুক। বারবার অতীত স্বরণ করার কোন প্রয়োজন নেই।”
পুষ্প বুঝলে এই টপিকে কথা বললে প্রার্থর কষ্ট হয়। সে পন করলো আর কখনো এটা টানবে না। অতীতের পাতায় রেখে দিবে। ও মুখে বলল,
“আচ্ছা আর কখনো স্মরণ করবো না। এখন আমার কথাগুলো শুনুন।
” বল।”
“আমার বাচ্চা চাই।”
“আমারও চাই। তবে এখন নয়। অনেক পরে।”
“আমার দুইটা বাচ্চা চাই। জমজ হবে ওরা। একটা ছেলে একটা মেয়ে। আমাকে মা মা বলে ডাকবে দুজন।”
“ভালো বুদ্ধি। কিন্তু দুটো সামলাতে পারবি?”
“আমি একা কেন সামলাবো? আপনি আছেন তো। আমি জানি, আপনি হবেন পৃথিবীর বেস্ট বাবা।”

“আর?”
“আর কি?”
“বেস্ট হাসব্যান্ড নই?”
“ওহ এটা? এটা আবার বলতেও হবে? আপনি আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও ধৈর্যবান পুরুষ। একজন আদর্শ স্বামী। একটু বউ পাগলও বটে।”
“এরকম বউয়ের জন্য পাগল না হতে পারলে আর পুরুষ হলাম কোথায়।”
পুষ্প খুশি খুশি মনে আরো মিশে গেলো প্রার্থর সাথে। ওর উদম বুকের উপর নাক ঘষে বলল,
“শুনুন না!”
“শুনছি তো।”
“ভালোবাসি।”
“হুম।”
পুষ্প রেগে গেলো। এটা বলার কোনো ধরন হলো? ভ্রু কুঁচকে শুধালো
“হুম কি?”
“এতবার বলতে হবে কেন? বোঝা যায় না?”
“বোঝা তো যায়। একটু মুখেও বলুন।”
“যা বোঝা যায় তা মুখে বলতে হবে কেন? আমি মুখে বলনো না। ভালোবেসে বোঝাবো ভালোবাসি। ”
পুষ্প মুগ্ধ হলো। ও বারবার প্রেমে পড়ে এই মানুষটার। মন ভরে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। ও প্রফুল্ল চিত্তে বলল,
“আপনি সবার থেকে আলাদা। ”
“হুম জানি। ঘুমা।”

“একটা গান শোনান তাহলে ঘুমাবো।”
পুষ্প ভাবলো প্রার্থ নাকচ করে দিবে। কিন্তু প্রার্থ কিছু বলল না। পুষ্পর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গাইল,
❝ঘুমাও তুমি ঘুমাও গো জান,
ঘুমাও আমার কোলে
ভালোবাসার নাও ভাসাবো,
ভালোবাসি বলে…….!

রাত বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। দেওয়াল ঘড়িতে সময় প্রায় ১১ টার কাছাকাছি। প্রিয়ার আর ঘুম আসছে না। একবার এপাশ আবার ওপাশ করছে মেয়েটা। অস্থিরতার কারনে একসময় উঠে বসলো সে। গলা শুকিয়ে এসেছে৷ টেবিল থেকো জগটা তুলে দেখলো সেটা খালি। রাগে দুঃখে ঠাস করে নামিয়ে রাখলো সেটা।
ভাবলো পানিই খাবে না। কিন্তু তেষ্টার দায়ে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল। জগ নিয়ে হাঁটা ধরলো। নিচ থেকে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি নিয়ে আসবে।
করিডরে আসতেই দেখলো অন্ত সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে। মাত্র দুটো সিঁড়ি নেমেছে। প্রিয়া ডেকে উঠলো তাকে,
“অন্ত।”
অন্ত ফিরে চায়। দেখে প্রিয়া। ও আর নিচে নামলো না। উপরে উঠে এলো। একহাতে চশমা ঠেলে বলল,
“এত রাতে তুই এখানে কেন? ঘুমাসনি?”
প্রিয়া অভিযোগের স্বরে বলল,
“ঘুমাতে দিচ্ছো তুমি? দিচ্ছো না তো। তোমার যন্ত্রনায় তো ঘুমাতেই পারছি না।”
অন্ত অবাক হয়। বিচলিত হয়ে শুধায়,
“আমি কি করেছি প্রিয়া? কি হয়েছে?”

“কি করোনি সেটা বলো। আগে ভালোবেসেছে কে? আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছে কে? আর ভালোবাসার পর কি করছো? আমাকে ইগনোর করছো? কেন অন্ত? সহজে পেয়ে গেছো বলে? যদি বারবার রিজেক্ট করে দিতাম তখন তো ঠিকই পেছন পেছন ঘুরতে, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করতে। এখন কি হলো তাহলে? হাওয়া ফুসস? প্রিয়া তো এখন ভালোবাসেই তাই প্রিয়াকে আর পাত্তা দিতে হবে না। তাই তো?”
এত এত অভিযোগে অন্ত ভেতরটা দগ্ধ হয়ে যায়। সত্যিই কি বেশি ইগনোর করে ফেলছে? ইগনোর করে কি ও নিজে শান্তিতে আছে? নেই তো। ওরও তো কষ্ট হয়। এত কাঠখড় পোড়ানোর পর পাওয়া ভালোবাসা কি কেউ যেচে অবহেলা করে? পরিস্থিতির কাছে বাধ্য বলেই তো দূরত্ব বজায় রাখছে। কিন্তু প্রিয়াকে এগুলো বোঝালে ও বুঝবে না। বেশি অভিমানী মেয়ে তো। আগে তার অভিমান ভাঙাতে হবে।
অন্ত এগিয়ে এলো আরেকটু। দুহাতে ওর মুখটা ধরে উচু করলো। নরম গলায় বলল,
“ভুল বুঝছিস কেন? আমি তোকে ইচ্ছে করে অবহেলা করবো, এটা তোর মনেহয়? আমার এত সাহস আছে?”
প্রিয়া অন্ত হাত সরিয়ে দিলো নিজের মুখ হতে। কন্ঠে তেজ নিয়ে বলল,

“আছে। সাহস আছে বলেই দেখাচ্ছো। কেন এমন করছো বলো তো। আমি যেখানে থাকি সেখানে তুৃমি আসতে চাও না। খাবার টেবিলে সবাই একসাথে খায় কিন্তু তুমি আসো না আমি থাকি বলে। হসপিটালে বুবুর জন্য এত কাঁদলাম একবার এসে বললে না, প্রিয়া কাঁদিস না। তুই কাঁদলে আমার কষ্ট হয়। বলবে কি, তুমি তো আমার ধারে কাছেও আসতে চাও না। মেছেজ দিলে নানা অজুহাতে কেটে পরো। কেন করছো এমন? কেন? নতুন কাউকে পেয়েছো?তাহলে….
অন্ত আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না ওকে। প্রিয়া বলতে বলতে প্রায় কেঁদে ফেলেছে।ও ঝট করে গিয়ে জরিয়ে ধরলো উন্মাদ প্রিয়াকে। প্রিয়া দু চারটে কিল ঘুষি মেরে ওকে সরাতে চাইলো। অন্ত ছাড়লো না। প্রিয়া হার মেনে নেয়। নিজেকে না ছাড়িয়ে আরো শক্ত জরিয়ে নেয় অন্তর সাথে।
অন্ত ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। শান্ত করে একটু।
“শান্ত হ প্রিয়া। আমার কথা শোন। আমি তোকে অবহেলা করি না। তুই ছাড়া আমার জীবনে অন্য কোনো নারী নেই, ছিলো না, থাকবেও না। এটুকু তো ভরসা করিস আমাকে। ”
এরপর একটু আলগা হয়ে প্রিয়ার কান্নারত মুখটা একহাতে তুলল। কেঁদে কেটে বেহাল দশা তার। অন্ত মুছিয়ে দিলো চোখদুটো। বলল,

“প্রিয়া, বাচ্চামো কেন করছিস? আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো, তুই বল? আমি ইগনোর করছি না। শুধু সামান্য দূরত্ব বজায় রাখছি।”
“কেন রাখছো দূরত্ব? ”
প্রিয়ার কন্ঠে মলিনতা। অন্ত ওর মুখে থাকা এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিলো। অন্তর মা যে সব জানে তা লুকিয়ে গেলো। কাছে টেনে বলল,
“প্রিয়া, আমাদের বয়স কম। এখন বিয়ের কথা বললে আম্মু বাড়িতে কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে ফেলবে। তুই তো জানিস আম্মু কেমন। এজন্য আমি সেটেল্ড না হওয়া পর্যন্ত বিয়ের কথা তুলবো না। কিন্তু ততদিন তো আমাদের সতর্ক থাকতে হবে তাই না? এইযে আমাদের প্রেমিক প্রেমিকার কথা যদি কেউ শুনে ফেলে তাহলে তো মুশকিল। ওরা ধরে একদম আলাদা করে দিবে আমাদের। এজন্য বাড়িতে একটু দূরত্ব মেনটেন করে চলছি। কারণ আমি কন্ট্রোললেস। তোকে দেখলেই প্রেম পায়। তখন একটা প্রেমমূলক কথা বললেই তো ধরা খাবো। এজন্য এমন করেছি। কিন্তু আমি প্রমিস করছি প্রতিদিন ফোনে কথা হবে। দরকার পড়লো পড়ালেখা ছেড়ে সারারাত তোর সাথে কথা বলবো। চলবে?”

পুরো কথাটা মন দিয়ে শুনলো প্রিয়া। বুঝলো অন্ত ওর জায়গা থেকে ঠিক আছে। প্রিয়ার নিজেকেও সংযত রাখতে হবে। ও খানিকটা মিয়িয়ে গিয়ে বলল,
“থাক দরকার নেই। পড়ালেখা বাদে কথা বলতে হবে না। আগে পড়ালেখা করো। তারপর তাড়াতাড়ি সফল হও। আমি বিয়ে করবো। ”
অন্ত হেঁসে বলল,
“বিয়ে করার এত ইচ্ছে? বয়স কত? ”
“ঢং! তোমার বয়স কত? তোমার প্রেমের বয়স হয়েছে? প্রেম করছো কেন তাহলে? আমি এই বয়সে প্রেম করতে পারলে বিয়ে করতে পারবো না কেন?”
“আচ্ছা অন্ত’র অন্তঃপ্রিয়া। আমরা বিয়েও করবো খুব শীঘ্রই। একটু ধৈর্য ধর শুধু। কিন্তু আমাকে অবিশ্বাস করা যাবে না বলে দিলাম। অন্ত তার অন্তঃপ্রিয়ার ছিলো, আছে, থাকবে। ঠিকাছে? এবার ঘরে যা।”
প্রিয়া মুগ্ধ হয়। সাথে লজ্জাও পায়। হাতের জগ দেখিয়ে বলল,
“পানি আনতে যাচ্ছিলাম তো। ”
“আমি এনে দিচ্ছি। ঘরে যা তুই।
অন্ত জগটা নিয়ে নিচে নেমে গেলো। প্রিয়া স্বস্তির শ্বাস ফেললো। এবার হালকা লাগছে অনেক। বুকের ভেতর যে চাপা আর্তনাদ ছিলো তা নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো। মন হালকা লাগছে এবার। প্রিয়া মাঝে মাঝে অবাক হয়। যে ছেলেটাকে দেখলেই ওর মারামারি করতে ইচ্ছে করতো তাকে দেখলে এখন প্রেম প্রেম পায়। ভালোবাসতে ইচ্ছে। সামনে না দেখলে ভয় হয়। ভালোবাসা কি অদ্ভুত। প্রতিটা মানুষের সকল অনুভুতি এক নিমিষেই বদলে দেয়।

সকাল সারে আটটা বাজে। পূর্ব দিগন্তে উঠা নতুন সূর্যটা নিজের তেজ ছড়াতে ব্যাস্ত। সে তেজের শিখা অর্নবের বারান্দায় এসেও ছুঁয়েছে। সেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে অর্নব ফোনে কথা বলছে কার্তিকের সাথে। কার্তিক ওপাশ থেকে কিছু বললে অর্নব এদিক থেকে বলল,
” আরে ধুর, তুই কিসব ভাবছিস। প্রিন্সেসকে আমি ওর ছোটবেলা থেকে প্রিন্সেস ডেকে আসছি। হুট করে ডাক বদলে ফেলা যায়? তবুও আমি চেষ্টা করি পুষ্প ডাকতে। এখানে নাম বদলানোরও কথা আসে না আমার মতে। দেখ, ওকে আমি পছন্দ করতাম ভালোবাসতাম। এখন……!
আর কিছু উচ্চারণ করার আগেই শব্দ করে কিছু একটা পরে গেলো। অর্নব ঘাবড়ে তাকালো পেছনে। পেছনের দৃশ্য দেখে অর্নবের চোখ ছানাবড়া। স্নেহা জড়বস্তুর ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। ফ্লোরে চা সহ চায়ের কাপটা পড়ে ভেঙে আছে। গরম ধোঁয়া উঠা চা ছড়িয়ে পরেছে চারপাশে।
ওপাশ থেকে কার্তিক হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে। অর্নবের ধ্যান নেই তাতে। ও ভীত চোখে তাকিয়ে আছে স্নেহার টলমলে চোখের দিকে।
স্নেহার হাত কাঁপছে। নরম ঠোঁট দুটোও কাঁপছে তীরতীর করে। স্নেহা ঘুরে চলে যেতে নেয়। অর্নব হম্বিতম্বি করে ফোনটা পকেটে ভরেই দৌড়ে যায় ওকে আটকাতে। স্নেহাকে ডিঙিয়ে আগে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। এরপর তাকায় স্নেহার দিকে।

স্নেহার চোখের কোটর ভরা জল। ও মাথা নিচু করে বলল,
“যেতে দিন আমাকে। আমার কাজ আছে। ”
অর্নব এগিয়ে আসে। নিজের তরফ থেকে সাফাই গায়,
“স্নেহা, তুমি যা ভাবছো তা নয়। ভুল বুঝছো তুমি আমা….
” আমি কিচ্ছু বুঝছি না অর্নব। আমাকে যেতে দিন প্লিজ। ”
স্নেহার কন্ঠটা তেজী শোনালো। অর্নব কখনো ওকে এভাবে কথা বলতে দেখেনি। ওর ভয় হচ্ছে ভীষন। আজ আবার কাউকে হারানোর ভয় জেকে ধরেছে মন। ও আরো এগিয়ে এলো। স্নেহার কম্পিত হাত নিজের মুঠোয় পুরে বলল,
“স্নেহা, প্লিজ ট্রায় টু আন্ডারস্ট্যান্ড। তুমি আংশিক শুনেছো। পুরোটা তো শুনো।”
স্নেহা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালো। বলল,
“কিছু শোনার নেই অর্নব। আমি তো জানি আপনার একটা অতীত আছে। আর কিছু বলতে হবে না।”
“কিন্তু তুমি তো জানতে না সেই অতীতটা পুষ্প।”
স্নেহার কি যে কান্না পেলো। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো সমস্ত শক্তিতে। অর্নব দুহাতে স্নেহার মুখ আঁকড়ে ধরে। কন্ঠে অসহায়ত্ব নিয়ে বলে,

“আমার পুরো কথাটা শুনো। প্লিজ ভুল বুঝো না আমাকে।
একটু থেমে ও বলতে শুরু করলো,
“আমি পুষ্পকে পছন্দ করতাম আগে থেকে। কিন্তু পুষ্প তখনো প্রার্থকে ভালোবাসতো। প্রার্থ বাসতো না। প্রার্থ জানতো আমি পছন্দ করি পুষ্পকে। কিন্তু পুষ্প জানতো না। আমি কখনো বলিনি ওকে। ও ভাবতো আমি ওকে ছোট বোনের নজরে দেখি।
হঠাৎ একদিন খবর এলো প্রার্থর সাথে ওর বিয়ে হয়ে গেছে। আমি মনে মনে ভেঙে পরি। প্রার্থও ভেঙে পরে। কারন ও জানতো আমার অনুভুতি। আমার জন্য বারবার দূরে ঠেলে দিয়েছে পুষ্পকে। আমি তখন নিজের মনকে বুঝিয়ে নিয়েছি পুষ্প প্রার্থর বউ। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর বউ। তাকে নিয়ে ভাবাটাও পাপ। এরপর থেকে আমি আর ভাবিনা। আমি নিজে ওদের মিলিয়ে দিতে সাহায্য করেছি। আমি ইমম্যাচিউর নই স্নেহা। আমার বোঝার মতো যথেষ্ট জ্ঞান আছে। নিজেকে খুব জলদিই গুছিয়ে নিয়েছিলাম আমি। এরপর প্রার্থও ভালোবাসলো পুষ্পকে এবং আমার যেন ওদের দেখে কষ্ট না হয় এজন্য আমাকে এগিয়ে দিতে সাহায্য করলো। বিয়ের ব্যবস্থা করলো ওরা নিজে৷ আমিও রাজি হয়ে যাই ওদের মন রক্ষার্থে। ভেবেছি বিয়ে হলে জীবন নিয়ে আরেকটু বিজও হয়ে যাবো। বউকে কোনো একদিন ভালোবাসা যাবেই। কিন্তু….
থেমে যায় অর্নব। স্নেহা কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে। ও তাগাদা দিলো,

” কিন্তু কি? ”
অর্নব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কথাটা কিভাবে বলবে বুঝতে পারছে না। ও স্নেহাকে ভালোবেসেছে কিনা তা এখনো জানে না। কিন্তু আজ স্নেহা যখন অভিমান করে ওমন মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে নিলো তখন অর্নবের বুক ফাকা হয়ে গেছিলো। এখনো বুকের ভেতর ধড়াম ধড়াম করছে। মনে হচ্ছে আরো একবার জীবনের গুরত্বপূর্ণ একজনকে ও হারাতে চলেছে। এই অনুভুতির নাম কি ভালোবাসা দিবে?ও কি দ্বিতীয়বার কারো মায়ায় পড়লো, কাউকে ভালোবাসলো?
অর্নব শান্ত গলায় বলল,
“স্নেহা, তুমি আমার জীবনের অনেকটা জায়গায় জুড়ে আছো। আমি কখনো ভাবিনি এত দ্রুত তুমি আমার মনে এতটা প্রভাব ফেলবে। আজ এই মুহূর্তে এসে মনে হয়েছে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলবো। এই হানোর নিয়ে ভয়ও করছে ভীষণ। এই দেখো বুকের ভেতর কেমন করছে।
অর্নব স্নেহার হাত টেনে বুকের উপর রাখলো। ওর বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে এখনো। অর্নব ফের বলল,

” এটার কী নাম দেবো স্নেহা? এটা কি ভালোবাসা? তোমার নামের ভালোবাসা?”
স্নেহা আর আটকে রাখতে পারলো না নিজেকে। লাফিয়ে জরিয়ে ধরলো অর্নবকে। উত্তেজিত সেই বুকের উপর মাথা চেপে ধরলো নিজের। চোখ নিয়ে পানি পড়েই যাচ্ছে মেয়েটার। অর্নব আলগোছে আগলে নেয় ওকে। মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। স্নেহা হেঁচকি তুলে বলে,

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৪৪

“আপনার অতীতে কে ছিলো, কি ছিলো আমি জানতে চাই না। আমি শুধু চাই আপনি আমাকে ভালোবাসুন। সমস্ত দূরত্ব ঘুচিয়ে আমাকে বুকে আগলে নিন। আমার আর সহ্য হচ্ছে না অর্নব। আমি কতদিন আপনার ভালোবাসার কাঙ্গালি হয়ে থাকবো বলুন তো। এবার একটু ভালোবাসুন না আমাকে।”
মেয়েটা এত নরম মনের, অর্নবের প্রান জুরিয়ে যায়। স্নেহাকে আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরে নিজের মাঝে। ভেতর থেকে নিজের অদৃশ্য স্বত্তা নিজেকেই বলে উঠে,
“তুমি ভালোবাসো অর্নব। এই বোকাসোকা ভোলাভালা মেয়েটাকে তুমি অতন্ত্য ভালোবাসো। পরিমানের তুলনায় একটু বেশিই ভালোবাসো।”

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৪৬