ভবঘুরে সমরাঙ্গন গল্পের লিংক || তাজরীন ফাতিহা

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১
তাজরীন ফাতিহা

“বাচ্চার সামনে সিগারেট টানতে লজ্জা করে না আপনার?”
বিছানায় শায়িত এক শ্যামবর্ণের সুদর্শন পুরুষ যুবা। খালি গায়ে উবু হয়ে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াচ্ছে সে। মাথায় কোকড়া কোকড়া এলোমেলো রুক্ষ চুল। চাপ দাড়ির আড়ালে শক্ত কঠিন মুখ। তার পাশেই উবু হয়ে শুয়ে আছে দুই বছরের বাচ্চা ‘ফাইয়াজ নাহওয়ান’। এতক্ষণ রাগান্বিত কণ্ঠে যে কথাগুলো বলছিল সে হলো বাচ্চাটার মা আর শুয়ে থাকা পুরুষটির স্ত্রী। নারীটির বয়স খুব বেশি বোঝা যায়না অথচ সে পঁচিশ বর্ষিয়া রমণী। ঘেমে নেয়ে একাকার তার সারা শরীর। বাজার করে এসেছে। বোরকা খোলার সময় পায়নি। বিছানায় শায়িত পুরুষটির অবিচকের মতো কাণ্ডে প্রচণ্ড বিরক্ত এই নারীমূর্তি। অথচ পুরুষটির এতে কোনো ভাবাবেগ নেই। সে মনের সুখে ঘুমন্ত ছেলের পাশে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে যাচ্ছে। তা দেখে রমণীটি বলে উঠলো,

“আপনি আমার কথা কানে ঢুকিয়েছেন? বিবেক বুদ্ধি তো আল্লাহ আপনাকে দেয়নি। দয়া করে নিজের সন্তানের ক্ষতি হয় এমন কাজ করবেন না।”
পুরুষটির সিগারেটের শেষ ধোঁয়া ছাড়িয়ে বিছনা থেকে ধীর পায়ে নামলো। নেমে রুদ্রমূর্তি ধারণ করা নারীটির সামনে দাড়ালো। নারীটি পুরুষটির তুলনায় বেশ খর্বকায়। বুক অবধি প্রায়। পুরুষটি ঝুঁকে বললো,
“বেশি জ্ঞান ঝেড়ো না। আমি জ্ঞান নিতেও পছন্দ করিনা জ্ঞান দিতেও পছন্দ করিনা। বুঝেছো লিলিপুট?”
রমণীটি বুকে হাত ভাঁজ করে লম্বা যুবাটির দিকে মুখ উঁচিয়ে বললো,
“যার জ্ঞানই নেই সে জ্ঞান দিতে ও নিতে পছন্দ করবে না এটাই স্বাভাবিক। এমনিতেই বিড়ি’খোর লোকের থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না। আর দূরে সরে দাড়ান। সিগারেটের গন্ধে বমি চলে আসছে।”
বমি করার ভঙ্গিতে নারীটি বললো। পুরুষটির মুখ শক্ত পাথরের মতো হয়ে গেলো। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“বিড়ি’খোর কাকে বলছিস? মুখে লাগাম টান।”
“তুই তুকারি যদি আর একবার করেছেন আমিও করবো। তখন থামিয়ে রাখতে পারবেন না। আপনাকে যে বিড়িখোর বলেছি এটা আপনার ভাগ্য। আপনি তো পুরুষ হবারই যোগ্য না। স্ত্রী, সন্তানের ভরণোষণ না যুগিয়ে যে পুরুষ ঘরে বসে বিড়ি টানে তাকে এর থেকেও জঘন্য কথা বলা উচিত।”
“আমি নিজের টাকায় বিড়ি খাই। এতে তোর সমস্যা কি?”
“হ্যাঁ কি এক ছাতার মাথার পার্ট টাইম জব করেন সব নিজের বিড়ির পিছনেই চলে যায়। স্ত্রী, সন্তানের পিছনে খরচ করতে না পারলে বিয়ে করেছেন কেন?
পুরুষটি রাগান্বিত হয়ে রমণীর চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরলো। নারীটি চোখ বন্ধ করে ফেললো। এর মধ্যেই বাচ্চাটি ঘুম থেকে উঠে ‘মা’ বলে ডেকে উঠলো। পুরুষটি তা শুনে চোয়াল থেকে হাত নামিয়ে গামছা নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। নারীটির চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গিয়েছে। সে তা সন্তপর্নে মুছে বোরকা খুলে বিছানায় গেলো। বাচ্চাটি মাকে দেখে গলা জড়িয়ে ধরলো। খানিকক্ষণ পর বললো,

“মা, তক্কেট কাবো?”
নারীটি বাচ্চাটির মুখে আদর দিয়ে বললো,
“এখন চকলেট খাওয়া যাবে না বাবা। মুখ ধুয়ে নাস্তা খেতে হবে। তারপর তোমাকে চকলেট দিবো।”
“বাবা কুতায়?”
“বাথরুমে গেছে বাবা।”
কথাটি বলে ছেলেকে বুকে নিয়ে নারীটি উদাস দৃষ্টিতে একদিকে তাকিয়ে থাকলো। নারীটির নাম ফৌজিয়া নিশাত। স্বামীর নাম মারওয়ান আজাদ। সংসার জীবনের কিছু তিক্ততা তাকে মানুষিকভাবে ভেঙে দিচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আল্লাহ ভরসা। তিনিই সবকিছু সহজ করে দিবেন একদিন। স্বামী নামক আসামিকে মানুষে পরিণত করবেন এই আশায় রমণীটি প্রহর গুনছে আজ চার বছর যাবত।

“এসব মুখে দেয়া যায়?”
‘মারওয়ান আজাদ’ নামক পুরুষটি কথাটুকু বলে খাবার মুখ থেকে ফেলে দিলো। নিশাত কোনো কথা না বলে ছেলেকে খাইয়ে দিতে লাগলো। আজকে সকালে সবজি খিচুড়ি করেছে সে। এই লোক প্রতিদিন খাবারের সময় একটা না একটা নাটক তৈরি করবেই। বদ কোথাকার। মারওয়ান নাক মুখ কুঁচকে বললো,
“এই সকাল সকাল এসব করেছো কেন? কেমন পানসে লাগছে এগুলো খেতে।”
“কি করবো তাহলে আপনিই বলুন? সারাদিন বিড়ি টানলে পানসেই লাগবে আমৃত্তি লাগবে না।”
নাহওয়ান চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মা, বাবাকে দেখতে লাগলো। মারওয়ান ছেলের সামনে সিনক্রিয়েট করতে চাইলো না। ছেলের সাথে তার আন্ডারস্ট্যান্ডিং অন্যরকম। যেন বাপ, বেটা না বন্ধু দুজনে। মারওয়ান ছেলেকে বললো,
“এই পুচকু, ভাত খাচ্ছিস?”

নাহওয়ান মাথা কাত করে সম্মতি জানালো। নিশাত বললো,
“বলো নাহওয়ান, খিচুড়ি খাচ্ছি। তুমিও খাও।”
নাহওয়ান মাকে অনুকরণ করে বললো,
“কিচুড়ি কাচ্ছি। টুমিও কাও।”
মারওয়ান বললো,
“এসব আমি খাই না। তোর মাকেই খেতে বল। আমার ভালো তোর মা কোনো কালেই সহ্য করতে পারেনি ভবিষ্যতেও পারবে বলে মনে হয়না।”
নাহওয়ান কিছুই বুঝলো না। এতো ভারী ভারী কথা তার বোঝার কথাও না। নিশাত ছেলেকে চোখ দিয়ে কি যেন ইশারা করলো। বাচ্চাটা অল্প খিচুড়ি খেয়ে পাটি থেকে উঠে বাবার মেলে দেয়া ঠ্যাংয়ের উপর বসলো। তারপর প্লেট থেকে একটু খিচুড়ি নিয়ে বাবার মুখের সামনে ধরলো। মারওয়ান এই ছোট্ট হাতের মালিককে কিভাবে ফিরিয়ে দিবে? খেতে ইচ্ছে না করলেও মুখে ঐ ছোট্ট হাতের লোকমাটুকু গিলে নিলো।

নাহওয়ান আবারও খিচুড়ি নিতে চাইলে সবটুকু খিচুড়ি ছোট হাত থেকে ফসকে পড়ে গেলো। মারওয়ান এবার ছেলেকে কোলে নিয়ে নিজেই খেলো। নিশাত আড়চোখে তা দেখে নিজেও খাবার শেষ করলো। সে একটা স্কুলে শিক্ষকতা করে। বেতন মোটামুটি পায়। তা দিয়ে সংসার কোনরকম চলে যায়। মারওয়ান আজাদের বাবা মাসে মাসে টাকা পাঠায় বলে রক্ষে নাহলে সংসার চালানো তার জন্য দুষ্কর হয়ে পড়তো। এই বিড়ি’খোর লোকটা সংসারের প্রতি ভীষণ উদাসীন। তার শ্বশুরবাড়ি মধ্যবিত্ত পরিবারের। শ্বশুর বর্তমানে গ্রামে ধান চাষ, গবাদি পশু লালন পালন করছেন। যৌবনে চাকরি করেছেন তিনি। তার শ্বশুরবাড়ির সবাই মোটামুটি শিক্ষিত শুধুমাত্র তার স্বামীই শিক্ষিত হয়েও অশিক্ষিত।

মারওয়ান ছোট বেলা থেকেই ঘাড়ত্যাড়া প্রকৃতির। সংসারের প্রতি তার তীব্র বিতৃষ্ণা ঠিক কোন কারণে জন্মেছে তা নিশাত বলতে পারবে না। সে শ্বশুরবাড়িতে পা রাখার পর পরই দেখে এসেছে মারওয়ানের এই ছন্নছাড়া রূপ। সে নিজেও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তার বাবার সাথে মারওয়ানের বাবার খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল বিধায় দুইজন পরিকল্পনা করে ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়েছে। নিশাতের এই বিয়েতে ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারেনি। নাহলে এই বিড়ি’খোরটাকে জীবনেও সে বিয়ে করতো না।
নিশাতের এখনো মনে আছে বাসর ঘরে এই লোক সিগারেট খেয়ে এসেছিল। ভুর ভুর করে সিগারেটের গন্ধ তার নাকে লেগেছিল। এতো অসহ্য লেগেছিল এই লোকটাকে। তারপর কিভাবে কিভাবে যেন সংসার জীবনের চারটি বছর কাটিয়ে ফেললো। একটা কিউটের ডিব্বার মতো তার ছানা হয়েছে। ইস্ বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকালে নিশাত সংসারের সকল দুঃখ, ক্লান্তি ভুলে যায় যেন। যদিও চেহারায় বাপের আদল পেয়েছে সম্পূর্ণ তবুও এই বাচ্চাটা তার জান, পরাণ, কলিজা।

“বাবা ভদ্র বাচ্চার মতো থাকবেন। দুষ্টুমি করবেন না। মা তাড়াতাড়ি চলে আসবো কেমন?”
নাহওয়ান মাথা নাড়িয়ে মায়ের কোলে পড়ে রইলো। মারওয়ান খাটের উপর আয়েশি ভঙ্গিতে বসে মা, ছেলের ভালবাসা দেখছে। নিশাত ছেলেকে আদর করে মারওয়ানের কাছে দিলো। বললো,
“শুনুন, ওকে দেখে রাখবেন। ওকে রেখে আবার বিড়ি কিনতে বাইরে যাবেন না যেন?”
মারওয়ান ভ্রু কুঁচকে বললো,
“আমার কাছে নতুন রেখে যাচ্ছিস যে এতো ডায়লগ মারছিস?”
“ছেলের সামনে আরেকবার বাজে কথা বললে আপনার খবর আছে? এক টাকা কামানোর মুরুদ নেই সেই লোক এসেছে তুই তুকারি করতে?”
মারওয়ান কিচ্ছু বললো না। ছেলেকে আদর করে নিশাত স্কুলে চলে গেলো। মারওয়ান নিশাতের যাওয়ার প্রতীক্ষায় ছিল। ছেলেকে কিছুক্ষণ চেপে চেপে আদর করলো। বললো,

“এই ফাইয়াজ তোর মা অনেক পঁচা?”
নাহওয়ান আধো আধো স্বরে বললো,
“মা ভালু।”
“উহু পঁচা। বল পঁচা?”
“পুচা”
“এইতো হয়েছে। এখন থেকে এটা বলেই ডাকবি ঠিক আছে?”
বাচ্চাটা পিটপিট করে চাইলো। মারওয়ান বললো,
“চল বাপ, বেটা বাইরে যাই। তোর মা না জানলেই হলো। ওই লিলিপুটের মতো মহিলা এতো পাওয়ার দেখায় মাঝে মধ্যে মনে হয় আছাড় দিয়ে নাড়িভুড়ি বের করে ফেলি।”
নাহওয়ান বাবার হাতে মাথা দিয়ে গুতো দিলো। মারওয়ান তা দেখে বললো,
“আচ্ছা চল ঘুরতে যাই।”

নাহওয়ান খুশি হয়ে গেলো। বাবা তাকে সবসময় বাইরে নিয়ে যায়। বাবা ভক্ত সে। বাবা যা বলবে সেটাই খুব মেনে চলে বাচ্চাটা। মারওয়ান ছেলেকে জ্যাকেট, প্যান্ট পড়িয়ে নিজেও তৈরি হলো। বাইরে ভালোই শীত পড়েছে। দুই বাপ, বেটা একেবারে তৈরি। ফাইয়াজকে একেবারে মিনি মারওয়ান আজাদের মতো লাগছে। যেহেতু চেহারা সুরত বাপের পেয়েছে তাই লাগাটা অস্বাভাবিক কিছু না। দুইজন রেডি হয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লো। নিশাত স্কুলে গেলেই বাপ, বেটার বাইরে যাওয়ার হিড়িক পড়ে। মারওয়ান একটা দোকানে পার্ট টাইম জব করে। সেটা থেকে তার সিগারেটের খরচ হয়ে যায় সাথে বাচ্চার চিপস, চকলেটের খরচও। বাচ্চার মায়ের খরচ নিয়ে তার কোনো ভাবান্তর নেই।

মারওয়ান ছেলেকে নিয়ে দোকানে গেলো। গিয়ে নিজের জন্য সিগারেট কিনলো। ছেলেকে চিপস, চকলেট কিনে দিলো। তারপর দুই বাপ, বেটা শহরের অলিতে গলিতে হাঁটতে লাগলো। এক হাতে বাবার হাত ধরা অন্য হাতে চিপস, চকলেটের প্যাকেট নিয়ে বাচ্চাটা হাঁটছে। ভীষণ আদুরে সেই দৃশ্য।

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২