ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৭

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৭
মিথুবুড়ি

‘বস্তায় ভরা কয়েকটা লাশ পড়ে আছে পায়ের নিচে। বৃষ্টির ফোঁটার মতো ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে বস্তার ছিদ্র ভেদ করে। পাশেই একটা বস্তা অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। স্পষ্টতই, ভিতরে কেউ আছে, যে মুক্তির সন্ধানে ছটফট করছে। রিচার্ডের চোখেমুখে হিংস্র ভাব। চিবুকে ক্রোধের ঘনঘটা। তার হাতের গানের সরু নল এখনও তাক করা রক্তাক্ত বস্তার উপর। এরা জেমসের লোক। জেমস ইতিমধ্যে রিচার্ডের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছে। কাল রাতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে রিচার্ডের রয়্যাল ক্যাসিনো। সেটারই প্রতিশোধস্পহা থেকে এদের মৃত্যু। তবে পাল্টা আক্রমণ করতে পিছুপা হয়নি রিচার্ড। লাড়াকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর জেমসরা যেই হোটেলে উঠেছিল, রিচার্ড কাল রাতেই সেই হোটেল রুফটপে ব্লাস্ট করায়। এখন জেমস লুকিয়ে আছে লাড়াকে নিয়ে। নিশ্চয়ই আড়ালে থেকে রিচার্ডকে ধ্বংসের নতুন কোনো ফন্দি আঁটছে।

‘পাহাড়ে আজ তীব্র বাতাসের ছোবল। রিচার্ডের চুল উড়ছে এলোমেলো! দৃষ্টি স্থির ও শীতল। তার চারপাশে সারি সারি কালো পোশাকের গার্ড। একজনে ছাতা ধরে রেখেছে মাথার ওপর। আকাশ ভরে আছে ঘন মেঘে। যে কোনো মুহূর্তেই সবকিছু ছিঁড়ে পড়তে পারে নিচে। গুটি গুটি বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে রক্তস্নাত মাটিতে। রিচার্ড ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে শেষ গুলিটা চালাল কাঁপতে থাকা বস্তার দিকে। মুহূর্তেই নিস্তব্ধতা যেন শ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকল। গার্ডরা বস্তাগুলো টেনেহিঁচড়ে পাহাড় থেকে নিচে ফেলে দিচ্ছে নিচে। যেন একটি একটি করে অপরাধের দলিল নিঃশব্দে হারিয়ে যাচ্ছে অতলে।এমন সময় এক গার্ড এগিয়ে এসে ফোন ধরল রিচার্ডের কানে। আজ ভোরেই ফাইনাল হবে একটি গোপন চুক্তি। কোটি কোটি টাকার ড্রাগস চালান হবে ইতালি থেকে লাস ভেগাসে। রিচার্ড এখন বাংলাদেশে থেকেই ইতালির সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। ফোনে কথা বলে গাড়ির দিকে এগোতে থাকে রিচার্ড। ফোন অন করে ম্যানশনের সিসিটিভি ফুটেজে ঝলক চোখ বুলিয়ে নেয়। হঠাৎ থেমে যায় পা। ভ্রু কুঁচকে ওঠে প্রশ্নে। পরমুহূর্তে তা মিলিয়ে গিয়ে কপালের পাশে নীল রক্তনালিগুলো দগদগ করে জ্বলে ওঠে। নিঃশব্দ অগ্নিগর্ভ প্রস্তুত হয় এক নতুন বিস্ফোরণের।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘রিচার্ডের ম্যানশনটি এক দূর্গাসদৃশের মতো নির্মাণ করা হয়েছে। ছাদহীন, আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিরাট স্থাপনা। তবে তাদের বেডরুমের সঙ্গে লাগোয়া একটি সুবিশাল ট্যারেস রয়েছে। যেখানে সারি সারি ফুলের গাছগাছালি বিস্তৃত হয়ে আছে। ট্যারেসের এক কোণে বসে আছে এলিজাবেথ। আগুনের শিখা তার সামনে জ্বলছে। আগুনের উপর হাত রেখে মিটি মিটি হেসে তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে গা জুড়ে। ঠোঁটের কোণে দোলা দিচ্ছে এক রহস্যময় হাসি। আজ তাকে অদ্ভুত খুশি মনে হচ্ছে। হঠাৎ করেই এক অদৃশ্য হেঁচকা টানে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। প্রথমে খানিকটা চমকালেও তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নেয়। মুখের হাসিটুকু অটুট। তার কব্জি শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে রিচার্ড হিংস্র মুখে। তীব্র রাগে চোখের নীল মনির পাশে সাদা অংশ রক্তিম লাল, রাগে ফুঁসছে।

“কি করছ তুমি?”
‘এলিজাবেথের মুখে কেমন এক নিষ্পাপ বিস্ময়। যেন কিছুই বোঝে না, জানে না। স্বাভাবিক স্বরে বলে ওঠে,কি করছি, দেখতে পাচ্ছেন না? তাপ নিচ্ছি।”
‘রিচার্ড চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “কি এইগুলো?”
‘এলিজাবেথ একবার নিচে জ্বলতে থাকা কাগজগুলোর দিকে তাকাল। তারপর চোখে এক চঞ্চল প্রশান্তি নিয়ে বলল,
“ওহ, এগুলো? কাগজ। রুম পরিষ্কার করতে গিয়ে পেলাম। ভাবলাম দরকার নেই। তাই পুড়িয়ে দিয়েছি। এই ঠান্ডায় একটু উষ্ণতা দরকার ছিল, বাপরে বাপ যা ঠান্ডা পড়েছে আজ৷”
“রেডডডড!”—রিচার্ডের হুংকারে কেঁপে উঠল চারপাশ, এলিজাবেথও একটু থমকাল। কিন্তু ভয় পেল না। চোখে তার খেলে যাচ্ছে এক রহস্যময় হাসির ঝিলিক। রিচার্ড দাঁতে দাঁত চেপে, রুষ্ট কণ্ঠে বলল, “ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া এখানে কত কোটি কোটি টাকার ডিল ছিল?”

‘বিস্ময় যেন আকাশ ছুঁয়ে যায়। এলিজাবেথ চোখ বড় বড় করে বলে ওঠে,”আল্লাহ! ইন্না লিল্লাহ! কী বলেন স্বামী? আপনার এতো বড় ক্ষতি করে ফেললাম?”
‘রিচার্ডের চোয়াল ক্ষোভে মটমট করছে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, জ্বলন্ত।
এলিজাবেথ মাথা নিচু করে, প্রায় বিনীত কণ্ঠে বলল,”আমি তো ভেবেছিলাম এগুলো ক্ষতিকর কিছু। পাপের গন্ধ পাচ্ছিলাম, তাই পুড়িয়ে দিয়ে আমার ঘর পাপমুক্ত করলাম। ভুল কিছু করে ফেলেছি কি মাই ডেয়ার ক্রিমিনাল হাসবেন্ড?”
‘রিচার্ড দাঁতে দাঁত পিষে নিজেকে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সে জানে এই মুহূর্তে নিজের ক্রোধ একটুও ছাড় দিলে তার পৈশাচিক রূপ ফেটে পড়বে।এলিজাবেথের ঠোঁটে খেলল এক কুটিল হাসি। চোখে একরাশ বিদ্রূপ নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল রিচার্ডের দিকে। দূরত্বটুকু ঘুচিয়ে পায়ের তালুতে ভর দিয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল রিচার্ডের কাঁধ। ঠোঁট ছুঁই ছুঁই করে কানের পাশে ফিসফিসিয়ে বলল,

“স্ত্রী হয়ে স্বামীর কিছু টাকা জ্বালিয়ে
নিজেকে উষ্ণ করে কি খুব বেশি পাপ করে ফেলেছি আমি?”
‘বাঁকা হাসল রিচার্ড। অতর্কিতে আঁকড়ে ধরল এলিজাবেথের কোমর। সে নিজেও ঝুঁকে এল। এলিজাবেথের ঠোঁট ছুঁই ছুঁই করে ফিসফিসিয়ে বলল,
“এই মুহূর্তে আমারও যে বড্ড উত্তাপের দরকার। স্বামী হয়ে স্ত্রীর সর্বাঙ্গ জ্বালিয়ে উষ্ণ হলে কি শর্ত ভঙ্গ হবে?”
‘হচকিয়ে যায় এলিজাবেথ। হাঁসফাঁস করে ওঠে, চেষ্টা করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে। কিন্তু রিচার্ডের বাঁধন কঠিন! সহজে ছাড়ে না।
“হ্যাঁ হ্যাঁ ভঙ্গ হবে। স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া ছুঁলে পাপ হবে, খুব পাপ হবে।”
“আমি তো ছিলাম ই পাপী। আজ নাহয় একটু বেশি করে পাপ করলাম। খুব করে পাপ করতে ইচ্ছে করছে।”
‘লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছে এলিজাবেথের গাল। সে মোচড়াতে থাকে, মুক্তির চেষ্টা করে। হঠাৎ কী ভেবে যেন হুট করে বলে ওঠে,

“আচ্ছা, তাহলে আমি একটু প্রিপারেশন নিয়ে আসি কেমন?”
‘রিচার্ডের ভ্রু কুঁচকে যায়, “প্রিপারেশন মানে?”
“হ্যাঁ, অনেক প্রিপারেশন নিতে হয়… আপনি রুমে যান।
আমি এক্ষুনি আসছি।” নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে চলে গেল এলিজাবেথ। হতবাক রিচার্ড স্রেফ দাঁড়িয়ে রইল কপাল কুঁচকে। ধোঁয়াটে আগুনের আলোয়, বুঝে উঠতে পারল না সে হারল, না কেবল আরও এক দফা খেলায় জড়াল।

‘এলিজাবেথ ছুটে গেল কিচেনে। ফ্রিজ খুলে একটা বোম্বাই মরিচ খুঁজে পেতেই ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক রহস্যময় হাসি। দু’হাতে মুখ চাপা দিয়ে নিঃশব্দে হেসে ফেলল। ওদিকে রিচার্ড রুমে গিয়ে জামাকাপড় বদলাচ্ছিল। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। গ্রীবা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল রিচার্ড। দাঁড়িয়ে এলিজাবেথ। ঠোঁটে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি, চোখে অদ্ভুত দীপ্তি। শাড়ির আঁচলটা নিখুঁতভাবে তোলা কাঁধে। গলা শুকিয়ে এলো রিচার্ডের।
ধীরে ধীরে এলোমেলো পায়ে এগিয়ে এলো এলিজাবেথ। রিচার্ড যেন নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল। দূর্বল অনুভূত হল নিজেকে। এলিজাবেথ এক ঝলকে তাকিয়ে লাজুক হেসে বলল,
“তো, শুরু করা যাক?”
“হুহ?”
‘জবাব না দিয়ে সে দু’হাতে রিচার্ডের কলার টেনে নিল নিজের দিকে। মুখটা আরও কাছে এনে ঠোঁটের ফাঁকে ফিসফিস করে বলল,

“Be gentle.”
“Maybe I can’t,”—ফিসফিস করল রিচার্ড। সঙ্গে সঙ্গেই কামড়ে ধরল এলিজাবেথের ঠোঁট। ঠোঁটের ভাঁজে ঠোঁট অগ্রসর হতেই হঠাৎ থমকে গেল রিচার্ড। একটা প্রচণ্ড ঝাঁজ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো মুখজুড়ে। চোখে মুখে আগুন জ্বলছে যেন। রিচার্ড টের পায় এলিজাবেথ মিটি মিটি হাসছে। তাকিয়ে দেখল, ওষ্ঠ এখনও রিচার্ডের আয়ত্তে থাকলেও এলিজাবেথের চোখে এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস। মুহূর্তে মস্তিষ্ক ছক কেটে ফেলে, বুঝে গেল সবটা। এলিজাবেথকে অবাক করে দিয়ে সরে এল না রিচার্ড। বরং তার ওষ্ঠ আরও গভীরে ঢুকে গেল। হতবাক এলিজাবেথ। ধাক্কাতে লাগল রিচার্তের বুকে। কিন্তু রিচার্ড অচল। ঝাঁজে রিচার্ডের গাল বেয়ে পানি পড়ছে, নাক লাল হয়ে আছে, তবুও ছাড়ছে না। এক সময় ঝাঁল ছড়িয়ে পড়ে এলিজাবেথের মুখেও। চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে অঝোরে। ফর্সা মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে মুহূর্তেই। সে কাঁদছে, ছটফট করছে, তবুও ছাড়ে না রিচার্ড। সে যেন ছলাকলায় প্রতিশোধ নিচ্ছে তার নিজের ভাষায়।এলিজাবেথ খুব ভালো করেই বুঝতে পারে আজ সে নিজের ফাঁদেই জড়িয়ে পড়েছে। সময় পেরিয়ে যায় তবুও রিচার্ড থামে না, তার যেন মিটে না তৃপ্তি। কানের লতি পর্যন্ত লাল হয়ে গেছে ঝালে। এদিকে নিঃশ্বাস কমে আসে এলিজাবেথের।

‘একটা সময় নিজের মর্জি মতো ছাড়ল রিচার্ড। এলিজাবেথ হাঁপাতে থাকে, রুমজুড়ে পাগলের মতো কিছু খুঁজতে থাকে। মাথা ঘুরছে, চোখের সামনে ঝাপসা সব। ছুটে গিয়ে কেবিনেট খুলে একটা চকলেট বের করে খেতে শুরু করে। ওগুলো রিচার্ডই এনেছিল তার জন্য। রিচার্ড সরাসরি যত্ন দেখাতে না পারলেও, এহেন অনেককিছুই করে থাকে এলিজাবেথের জন্য। এইসব ছোটখাটো জিনিসে যে পরোক্ষ আদর লুকিয়ে থাকে সেটাও এলিজাবেথ অনুভব করতে পারে।
‘চকলেট খেয়েও ঝাঁজ কমছে না। পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে ছটফট করতে থাকে এলিজাবেথ। অদ্ভুত শব্দ করছে। আর রিচার্ড? পাশেই দাঁড়িয়ে চুপচাপ। চোখ দুটো এখনো রক্তিম। একগ্লাস নয় পুরো জগ ভর্তি পানি খেয়ে কিছুটা শান্ত হল এলিজাবেথ। হুঁশ ফিরতেই তাকাল রিচার্ডের দিকে। রিচার্ডের চোখে তাকাতেই এক ধাক্কায় অনুশোচনায় ভরে উঠল তার ভেতর। এলিজাবেথ একটা চকলেট এগিয়ে দিল রিচার্ডের দিকে। রিচার্ড হাসল একটু বাঁকা করে। কিছু না বলেই ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল।

‘রিচার্ড শাওয়ার নিয়ে বেরুতেই দেখতে পেল এলিজাবেথ প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে। রিচার্ড সেদিকে একঝলক তাকিয়ে হাটতে হাটতে ট্যারেসে গেল। এলিজাবেথ ডাকল গম্ভীর স্বরে,
“এদিকে আসুন।”
‘কেউ এল না, না কোনো জবাব এল। এলিজাবেথ আবারও ডাকল,
“স্বামী!”
‘জবাব নেই। এলিজাবেথ চেঁচাল,
“ক্রিমিলান হাসবেন্ড!”
‘রিচার্ড ঠৌঁট কামড়ে হেসে রুমে এল। তোয়ালে কাউচের উপর ছুঁড়ে দিয়ে মিররের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে থাকা অবস্থায় বলল,
“কি ব্যাপার, খুব যেমন স্বামী বক্ত হয়ে গিয়েছ। প্রেমে পড়ে গেলে নাকি আবার?”
‘মুখ বাঁকাল এলিজাবেথ,”কি করব, স্বামী তো এতোদিন স্বীকৃতি দেয়নি, তাই এখন বর্তমান আর পূর্বের সব একসাথে পুষিয়ে নিচ্ছি।”

‘অদৃশ্য হাসল রিচার্ড। চুল আঁচড়ে কেবিনেটের দিকে এগোতেই বাঁধা পায়। একটা কোমল পিছন থেকে টেনে ধরেছে। রিচার্ড পিছু ঘুরল। এলিজাবেথ রিচার্ড’কে টেনে বেডে বসিয়ে দিল। নিজেও বসল পাশে। এক চামচ পায়েস তুলে ধরল রিচার্ডের সামনে। রিচার্ড অবাক, সাথে বিস্মিত। তবে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
“আমি সুইট খাই না।”
“খেতে হবে।”
“বললাম তো খাই না।”
“বললাম তো খেতে হবে।”
“রেড, আমাকে জোর করবে না৷ আমার উপর কারোর হস্তক্ষেপ আমি পছন্দ করি না।”
“আপনি পছন্দ করার কে? আমার হোক আছে আমার স্বামীকে জোর করার৷ চুপচাপ খান, নইলে কিন্তু চাচার বাড়ি চলে যাবো।”

‘চকিতে ভ্রু কুঁচকে রিচার্ড তাকাল এলিজাবেথের দিকে। এলিজাবেথ এখনও জানে না তার চাচার মৃত্যুর কথা। রিচার্ড জানাতে চাচ্ছে না এই মুহুর্তে। রিচার্ড এবার গুরুগম্ভীরতা ছেড়ে ঠান্ডা গলায় বলল,
“মিষ্টিজাতীয় খাবার পছন্দ না।”
‘এলিজাবেথ শয়তানি হাসি দিল। পায়েসের ভাটিটা উপরে তুলে কয়েকটা উড়ন্ত চুমু দিল ভাটিতে। হতবাক রিচার্ড। এলিজাবেথ খিলখিলিয়ে হেসে ভ্রু নাচাতে নাচাতে বলল,
“এখন?”
‘রিচার্ড না চাইতেও মৃদু হেসে ফেলল। তবে বরাবরের মতো সেটা ছিল অদৃশ্য। সে চুপচাপ হা করল। এলিজাবেথ সঙ্গে সঙ্গে মুখে পুড়ে দিল চামচ।

“প্রতিশোধ নিচ্ছ?”
‘এলিজাবেথ নিরুদ্বেগ। আরেক চামচ রিচার্ডের মুখে তুলে দিয়ে বলল,”কিসের?”
“তোমাকে দেওয়া কষ্টের।”
“ধরে নিতে পারেন তাই। এখন আমি তো আর আপনার মতো মেরে, দূরে সরিয়ে দিয়ে কষ্ট দিতে পারব না, আমি মেয়ে মানুষ তো। তাই এভাবেই শোধ তুলছি।”
‘কাঁধ উঁচিয়ে হাসল রিচার্ড,”গুড! তবে আইডিয়া খারাপ ছিল।”
‘মিইয়ে গেল এলিজাবেথ,”পরের বার থেকে এডভান্স কিছু টাই করব।”
‘রিচার্ড আড়চোখে তাকাল এলিজাবেথের দিকে,”তবে, এসবের চক্করে যদি বউয়ের হাতে খাওয়া যায়,তবে মন্দ হয় না।”
‘ফিচলে হাসল এলিজাবেথ। হঠাৎ করে মায়াভরা দৃষ্টিতে চাইল রিচার্ডের দিকে। চোখে চোখ রেখে নিদারুণ অঙ্গিকারে বলল,

“আজ থেকে রোজ আমি আপনাকে খাইয়ে দিবো। আর একবেলাও আপনাকে নিজের হাতে খেতে হবে না।”
‘রিচার্ড কিছুটা আশ্চর্য হল এলিজাবেথের এরূপ আচরণে৷ ভরাট গলায় জিজ্ঞেস করল,”হঠাৎ এতো পরিবর্তন?”
‘আরেক চামচ মুখে তুলে দিয়ে এলিজাবেথ সাবলীল ভাবে প্রত্যুত্তর করল,”ওমা, আপনিই তো সেদিন বললেন নেশার ঘোরে বলেছিলেন, আপনি নিজের হাতে খেতে পারতেন না। কত বছর ধরে পেট ভরে খান না।”
‘তৎক্ষনাৎ রিচার্ডের চেহারার রঙ বদলে গেল। নত দৃষ্টি নিবিষ্ট করে রাখে। এলিজাবেথ তা লক্ষ করে কথার সুর পাল্টে ফেলে সাথে সাথে, “ঝাল কমেছে?”

‘রিচার্ড নিশ্চুপ মাথা নাড়াল উপরনিচ। এলিজাবেথ উষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল রিচার্ডের দিকে। এই শক্ত গোছের মানুষটার ভিতরেও কত চাপা কষ্ট। অথচ লোকটা সে-সব প্রকাশে ব্যর্থ। হৃদয়হীনের মতো বুক ভুলিয়ে বলে যায় তার কোনো কষ্ট নেই, সে পাথর। তবে ঠিকই অতীতের কথা উঠতেই মানুষটার চেহারার রঙ পাল্টে গেল নিমিষেই।
“ঠিক যেভাবে এই বাড়ির রঙ পাল্টে দিয়েছি, ঠিক সেভাবেই একদিন আপনার জীবনের রঙ পাল্টে দিবো।”
‘রিচার্ড দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকাল এলিজাবেথের দিকে। কথার পারদে ফিচলে হেসে বলল,”তুমি ঠিক ততটুকুই করতে পারছ, যতটুকু আমি করতে দিচ্ছি। সামান্য কিছু কাগজ পুড়িয়ে ভেবে বসো না, যা ইচ্ছে পারবে।”
“আপনার ইচ্ছাতেই যখন এতোকিছু হল, তাহলে বাকিগুলোও আপনার ইচ্ছেতেই হবে।”

‘রিচার্ডের চোখে চোখ রেখে কোনো জড়তা বা সংকোচ ছাড়াই স্পষ্টভাবে বলল এলিজাবেথ। রিচার্ডও একগুঁয়ে অনড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল এলিজাবেথের চোখে। দুটি গভীর দৃষ্টি এক বিন্দুতে মিলল, স্বকীয়তা হারিয়ে এক স্রোতে ভেসে গেল তারা। অলিন্দের গোপন অনুভব যেন হঠাৎই উথলে উঠল চোখে। রিচার্ডের উষ্ণ হাতে নিঃশব্দে ছুঁয়ে এলিজাবেথ রাখল নিজের হাত। শীতল শিহরণ বেয়ে উঠল এলিজাবেথের শরীরজুড়ে। রিচার্ড হালকা হাসিতে হিসহিসিয়ে বলল,
“উঁহু, এটা ঠিক ততটা মিষ্টি না। আমার তো তার চেয়েও বেশি চাই।”
‘রিচার্ডের চোখে যেন সমুদ্রের নীল গভীরতা। সেখানে ডুবে গিয়ে এলিজাবেথ জবাব দিল ধীরে,
“তার চেয়েও বেশি মিষ্টি কী করে হয়?”
“টেস্ট করে দেখিয়ে দিচ্ছি,” বলেই রিচার্ডের হাত চঞ্চল হয়ে ছুটে এলিজাবেথের গ্রীবায়। এক ঝটকায় কাছে টেনে এনে ঠোঁট ছোঁয়াতে যাবে এমন সময়,

“মিউ, মিউ, মিউ।”
‘মাফি এসে হাজির। হয়তো মায়াকে খুঁজে পাচ্ছে না। এলিজাবেথ হঠাৎ ছিটকে সরে যায়। বিরক্ত রিচার্ড চোখ রাঙায় মাফির দিকে। এলিজাবেথ একগাল হাসি নিয়ে মাফিকে কোলে তুলে নেয়। রোমান্টিক মুহূর্তে বাধা পড়ায় রিচার্ডের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সে এগিয়ে গিয়ে বেডসাইড ড্রয়ার খুলে সিগারেট বের করে ধরায়।এদিকে এলিজাবেথ মাফির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলে,
“ভাবছি আরেকটা বাচ্চা অ্যাডপ্ট করব। এখন এরা স্বামী-স্ত্রী তো কাউকেই পাত্তা দেয় না!”
‘সিগারেটের ধোঁয়া শূণ্যে ভাসিয়ে রিচার্ড গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দেয়,
“অ্যাডপ্ট কেন? চল আমি’ই একটা দিচ্ছি ।”
“বিড়ালের বাচ্চার কথা বলেছি, শুয়োরের না!”
‘রিচার্ডের দৃষ্টি তির্যক বেগে ছিটকে গেল এলিজাবেথের দিকে। বিস্ময়ের ঘোরে চমকে উঠে চেঁচিয়ে উঠল,
“কিহহহ! আমি শুয়োর?”

‘ফিক করে হেসে ফেলল এলিজাবেথ। এই সুযোগে মাফি ত কোল থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে গেল৷ ওর এখন স্ত্রীকে খুঁজে বের করা দরকার। রাত গভীর হচ্ছে, আর এই সময়ে স্ত্রীর ভূমিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা সে বুঝে গেছে। শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, ভূমিকা অপরিসীম।এলিজাবেথ হাসতে হাসতে এগিয়ে এল রিচার্ডের দিকে। কাছে যেতেই হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। অবাক হল। আজ সিগারেটের গন্ধটায় একটুও ঘেন্না লাগছে না! বরং অদ্ভুত এক মিষ্টি টান যেন মিশে আছে ধোঁয়ার ভিতর।

“আপনি কি ব্র্যান্ড বদলেছেন? আজ তো একটুও সাফোকেট লাগছে না! নাম কী এই ব্র্যান্ডের?”
‘রিচার্ড মাথা নেড়ে জানাল হ্যাঁ—সে বদলেছে। এলিজাবেথের জন্যই। সে জানে সিগারেট ছাড়তে পারবে না, তবে স্ত্রীকে কষ্ট দিতেও রাজি না। তাই নিজের অভ্যাসে বদল এনেছে। একটা গভীর টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল রিচার্ড সরাসরি এলিজাবেথের মুখের দিকে।
“Sobranie Black Russian”
‘ধোঁয়ার কুন্ডলির ভেতর দাঁড়িয়ে এলিজাবেথ অপলক তাকিয়ে রইল রিচার্ডের দিকে। আজ প্রথমবার সিগারেট খাওয়া মানুষটার মধ্যে এক অন্যরকম, গাঢ় আকর্ষণ খুঁজে পেল সে। লোকটার সবকিছুতেই কেমন অন্যরকম ভাবসাব মিশে থাকে সবসময়। সে মুগ্ধতা মিশ্রিত স্বরে বলে উঠল,
“আপনাকে খুব অ্যাট্রাক্টিভ লাগছে।”

‘আজ ভোরের ড্রাগসের ডিলটা বাতিল হয়ে গেছে। কারণ তার ঘরের কর্তি ডিলের সব ডকুমেন্টস পুড়িয়ে শীত নিবারণ করেছে। ফলে রিচার্ড আর বেরোয়নি। কোটি কোটি টাকার লোকসান হলেও শান্ত রয়েছে রিচার্ড। ল্যাপটপে কিছু জরুরি কাজ ছিল কাউচে আধশোয়া হয়ে সেগুলো নিয়েই ব্যস্ত আপাতত। এসময় এলিজাবেথ গান গাইতে গাইতে রুমে ঢুকল। হঠাৎ যেন মেয়েটার সমস্ত লজ্জা উধাও। রিচার্ড একবার আড়চোখে তাকাল। ভেনেটির সামনে দাঁড়িয়ে এলিজাবেথ হাতে লোশন মাখছে, ঠোঁটে হালকা গুনগুনানি। রিচার্ড গলা খাঁকারি দিল,
“এভাবে রুমের ভেতরে পেট বের করে ঘোরাফেরা করার কোনো মানেই হয় না। এখানে সিডিউস হওয়ার জন্য বসে নেই কেউ। আমার যথেষ্ট কাজ আছে।”
‘এলিজাবেথ ভ্রু কুঁচকে পিছন ফিরল,”আমি মাংসের টুকরো না আপনি কুকুর?”
“রিচার্ড থমকে গেল, “মানে?”

“আমি তো আর কোনো মাংসের টুকরো নই যে কুকুরের সামনে ঘুরলেই জিভ দিয়ে লালার বন্যা বইবে।”
‘রিচার্ডের ছোট্ট একটা কিঞ্চিৎ বেরিয়ে এল,”বাই এনি চান্স, তুমি কি আবারও আমাকে কুকুর বললে?”
‘এলিজাবেথ ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়,”আপনি যদি আমাকে মাংসের টুকরোর চোখে দেখে থাকেন, তাহলে অবশ্যই। নাহলে কখনোই না।”
‘রিচার্ডের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, “এখন কিন্তু দেখিয়ে দেব।”
‘এলিজাবেথ ভীত অভিনয় করে বলল,”কি দেখিয়ে দেবেন শুনি?”
শধৈর্য আর কন্ট্রোল কাকে বলে।”

“ওহ রিয়েলি?”এলিজাবেথ চোখ মুছল ঠাট্টার ভঙ্গিতে, “হয়ে যাক তবে একটা ম্যাচ।”
‘তড়িঘড়ি করে সোজা হয়ে বসে রিচার্ড। তবে এলিজাবেথের কথা শোনামাত্রই থমকাল,”ম্যাচ?”
“হ্যাঁ ম্যাচ। মানুষ ম্যাচ খেলে জেতে। আর আমরা জিতে ম্যাচ শুরু করব।”
“না খেলে জিতব কি করে?”
“সহ্য করে, ধৈর্য ধরে। যদি আপনি টিকতে পারেন,তাহলে আজকেই ম্যাচ ফাইনাল।”
‘রিচার্ড চোখ সরু করে তাকাল, “তাহলে শুরু করা যাক।”
‘এলিজাবেথ মুচকি হাসল,”ঠিক আছে স্বামী। আমার স্বামী—ক্রিমিনাল স্বামী।”

‘রিচার্ড আবারও নিজেকে কাজে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করল। এলিজাবেথ পাশে এসে বসল। গুনগুনিয়ে ওঠা সুরে তার উপস্থিতি জানান দিল। একদম ঘেঁষে বসল যেন নিঃশ্বাসও ভাগ করে নিতে চাইছে। রিচার্ড চোখ নামিয়ে রাখে। সমস্ত ইন্দ্রিয় কাজে কেন্দ্রীভূত রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। হঠাৎই এলিজাবেথের আঁচল যেন অনিচ্ছায় খুলে পড়ল রিচার্ডের উরুর ওপর। চমকে উঠল রিচার্ড,তাকিয়ে দেখল এলিজাবেথের মুখ। সে যেন কিছুই বোঝেনি, অবুঝ মুখে তাড়াতাড়ি আঁচল তুলে কাঁধে গুঁজে নিল। রিচার্ডের গলা শুকিয়ে আসে৷নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একটু দূরে সরে বসল এলিজাবেথের কাছ থেকে।

‘ঠিক সেই মুহূর্তে এলিজাবেথের পা এসে পড়ল রিচার্ডের পেটের ঠিক নিচে। রিচার্ডের দেহে এক অজানা কম্পন ছড়িয়ে গেল। একরাশ আবেগ জমে উঠল ভিতরটায়। চোখ সরু করে তাকাল এলিজাবেথের পায়ের দিকে। এলিজাবেথ ততক্ষণে রিচার্ডের ধোঁয়াটে দৃষ্টি লক্ষ্য করে ঠোঁট কামড়ে হাসল। ধীরে ধীরে শাড়ি টানতে শুরু করল। একটু, একটু করে হাঁটু অবধি তুলে আনল। যেন প্রতিটি ইঞ্চি খোলার সাথে সাথে খুলে যাচ্ছে আরেকটা পরত । দৃষ্টি ধীরে ধীরে বদলে যায় রিচার্ডের। চোখে আর কাজের চাপ নেই, আছে কেবল অজানা আতঙ্ক আর প্রলোভনের দোলা। ভেতরটা শুকিয়ে আসে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। একের পর এক ঢোক গিলে যায়। এলিজাবেথ তৃপ্ত এক হাসি হেসে এগিয়ে আসে। ঠিক যেমনভাবে সাপ লতিয়ে উঠে নিরব, নিশ্চিত, লিপ্তে।

‘রিচার্ডের দুই উরুর মাঝখানে নিজের হাঁটু গেঁথে বসে পড়ে এলিজাবেথ। এক টানে ল্যাপটপ ছুঁড়ে ফেলে দেয় মেঝেতে। অর্ধেক শরীর রিচার্ডের উপর ফেলে ঝুঁকে পড়ে তার দিকে। ঘাম ঝরে রিচার্ডের কপাল বেয়ে, হাত কাঁপে টুকটুকে। এলিজাবেথ ধীরে বোতাম খোলে রিচার্ডের শার্টের। একটা, তারপর আরেকটা। ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আসে রিচার্ডের নিশ্বাসে। কামনার ঝড় গিলে নেয় তার অবশ মন-দেহ। এলিজাবেথ এবার আলতো করে হাত রাখে রিচার্ডের উন্মুক্ত ঢেউ খেলানো বুকে। রিচার্ডের হৃদপিণ্ড যেন বুকে কাঁপছে আর যুদ্ধ করছে। চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে এলিজাবেথ,”অনুভব করতে পারছেন কিছু?”
‘সেই মুহূর্তে আর রিচার্ড নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। এক ঝটকায় এলিজাবেথকে ঘুরিয়ে নিজের কোলে ঘুরিয়ে বসায়। কিছু অনুভব করতেই একটা অজানা অনুভবে শিউরে ওঠে এলিজাবেথ চমকে রিচার্ডের বুকে খামচে ধরে। রিচার্ড ঠোঁট ছোঁয়ায় ওর কাঁধে। ভেতরে একটা তরঙ্গ খেলে যায় এলিজাবেথের। রিচার্ড হেসে ফেলে। কানের কাছে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলে,

“অনুভব করতে পারছ, রেড, আমার ভিতরের উত্তাপ?”
‘এলিজাবেথ হঠাৎ ঝটকা মেরে ছিটকে সরে যায়। তর্জনী উঁচিয়ে খিলখিলিয়ে হাসে, চোখে বিজয়ের ঝিলিক।
“আপনি হেরে গিয়েছেন।”
‘রিচার্ড ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে এক মুহূর্ত। গলায় এক টুকরো আগুন মিশিয়ে বলে,”তোমাকে সাইজ করতে আমার দুইদিনও লাগবে না রেড।”
‘এলিজাবেথ হেসে ওঠে। চ্যালেঞ্জে ভরা চোখে বলে,
“আর আপনাকে সাইজ করতে আমার একটা উড়ন্ত চুমুই যথেষ্ট।”
‘এই বলে দৌড়ে যায় ট্যারেসের দিকে। রিচার্ড একটু থেমে তারপর নিজেও হেসে ছুটে যায় এলিজাবেথের পেছনে। পেছনে পড়ে থাকে ভাঙা ল্যাপটপটা নীরব সাক্ষী হয়ে রইল তাদের উত্তাল খেলার।

ইবরাতের বহুদিনের শখ ছিল বনফায়ারের। নরম সন্ধ্যায় আগুনের পাশে বসে কারো কাঁধে মাথা রেখে চুপচাপ থাকাটা সেই ইচ্ছে কখনও পুরোনো হয়নি তার। তবে এখনকার বাস্তবতা একটু আলাদা। এ-সময় বনে,জঙ্গলে গিয়ে বনফায়ার করা সমীচীন নয়। রিচার্ড পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে ন্যাসোকে বাইরে যেতে মানা করে রেখেছে।জেমসের লোকেরা সর্বত্র ছড়িয়ে।বিপদ দিকনির্দেশ মানে না। তাই বনের বদলে ম্যানশনের লনেই সেই স্বপ্ন পূরণ করল ন্যাসো। এক কোণে ছোট্ট দুর্গের মতো কাঠ সাজিয়ে দাউদাউ করে আগুন জ্বালিয়েছে সে। ইবরাত ঘাসে আধশোয়া হয়ে মাথা রেখেছে ন্যাসোর কোলের উপর। ন্যাসো এক হাতে ইবরাতের চুলে আঙুল চালায় নরম, স্নেহভরা ছোঁয়ায়। স্নিগ্ধ হাওয়া বইছে। হঠাৎ ন্যাসো বলল,

“রাত, আমি যদি তোমাকে বিয়ে না করতাম, তখন কী করতে?”
‘ইবরাত চোখ খুলল না, ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,”আপনি করতে আসলেও তখন করতাম না।”
‘খুবই আশ্চর্য হল ন্যাসো, “কিহ! কেন?!”
‘ইবরাত চোখ খুলে একঝলক দেখল ন্যাসো। পরপরই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ঠৌঁট বাঁকিয়ে বলল,
“আমার জন্মের সময় তো আপনি হাঁটতে পারতেন, তাও দেখতে আসেননি আমাকে! এমন লোকের সাথে জেনে-বুঝে আমি কিভাবে সংসার করতাম হুহ?”
‘থতমত খেয়ে গেলেও ইবরাতের শিশুসুলভ অভিমানে হেসে ফেলল ন্যাসো। ওর নাকের ডগায় গাঢ় চুৃ্ৃ্ম্বন খেয়ে সংশোধিত স্বরে বলল,
“ওরে বাবা, এতো বড় ভুলটা কিভাবে করলাম! ঠিক আছে, জান, পরেরবার আর এই ভুল করব না। ভেজা টিস্যু আর ডায়পার নিয়ে হাজির হবো হসপিটালে।”
‘ইবরাত বেহায়ার মতো দাঁত কেলিয়ে হাসে, “হিহিহি।”
“আচ্ছা, আমি যদি তোমার জীবনে না আসতাম,তখন?”
ইবরাত চোখ মেলে ছলছলে নয়নে তাকাল ন্যাসো দুধে-আলতা মুখশ্রীতে। একহাতে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে ন্যাসো দাঁড়ি হীন চোয়াল। ওর চোখের এককোণে কান্না জমানো জল চিকচিক করছে৷ বড্ড আবেগি শোনাল ইবরাতের কণ্ঠস্বর,

“তাহলে আমি বিয়েই করতাম না।”
‘আত্মায় প্রশান্তিময় অনুভূতি অনুভব করল ন্যাসো। এক মূহুর্তের জন্য মনে হল তার হাতের মুঠোয় পৃথিবী। এক চিলতে হাসির রেখা অধর কোণে টেনে ইবরাতের চোখের আঁচড়ে পড়া অশ্রু বুড়ো আঙুলের ডগা দিয়ে মুখে দিল ন্যাসো। কবুতরের মতো পাতলা শরীরটা টেনে তুলে বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে নির্ভেজাল গলায় শুধালো,
“এইজন্যই তো তোমাকে এত ভালোবাসি।”
‘চাঁদনি রাতে, খোলা আকাশের নিচে দুই কপোত-কপোতী অনুভব করল হৃদয়ের ভিতরে এক অস্থির শান্তি। অন্তরের গভীরে একসাথে ধ্বনিত হতে থাকে, “ভালোবাসি, ভালোবাসি। আলিঙ্গনের স্নিগ্ধতায় মিলিত হয় মিষ্টি শ্বাসপ্রশ্বাসের নিগূঢ় বন্ধন। খুঁজে পায় সুখের নিবাস। হঠাৎ ইবরাত গুনগুনিয়ে গান ধরল,
“যতই বাধা আসুক সখা, আর তো ছাড়ুম না ~
সোগাগ দিয়া বুকের মাঝম রাখুম বান্ধিয়া।
দেউলিয়া মনটা আমার, খালি ভাবে তোর কথা ~
তোর ছোঁয়া পাইলে সখা, ছাড়ি যায় মনের ব্যথা…”

‘আগুনের আলোয় তাদের ছায়া যেন একসঙ্গে দুলে ওঠে।দুইটা মানুষ, দুইটা শীতল অতীত আর একখণ্ড উষ্ণ রাত।নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে রাখল ন্যাসো মেয়েটাকে। এক ইঞ্চিও সরতে দিল না বৃক্ষপট হতে। আর সেই উন্মাদ প্রেমের পূজারী মেয়েটা? সে নিজেও চাইল না সরতে। বিড়াল ছানার মতন ঘাপটি মেরে রইল স্বামীর বুকে, একদম অষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। শুদ্ধতার মৃদু স্রোতে যেন তারা বিলীন হল। যে-ই স্রোতে নেই, সময়ের দিকনির্দেশনা, নেই কোলাহল, আছে শুধু মৌন ভালোবাসার অশ্রুবিহীন রূপ আর অভ্যন্তরীন আত্মসমর্পণ।
‘হুট করে ন্যাসো বলে উঠল,”রাত, বাইক রাইডে যাবে?”

‘তড়িৎ বেগকেও হার মানানো ,এক ঝটকায় মাথা তোলে ইবরাত। উত্তেজনায় ওর নেত্র যেন আগুনের মতো জ্বলছে। কোনো কথা না বলে কেবল ঘনভাবে মাথা নাড়ায়।তৎক্ষণাৎ, ন্যাসো ইবরাতকে পাশ কাটিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মুহূর্তেই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার হাজির। বাইকের একজোস্ট থেকে ছুটে আসা তীব্র শব্দে চমকে উঠে পেছনে তাকায় ইবরাত। দেখতে পেল ন্যাসো ম্যানশনের গেটের সামনে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে, মাথায় হেলমেট। ইবরাত ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই চোখ টিপে হাসে ন্যাসো। ইবরাত আর দেরি করে না। দৌড়ে গিয়ে বাইকে চড়ে বসে। মুহূর্তের মধ্যে স্পিড তোলে ন্যাসো। শহরের ভিড়ে মিলিয়ে যায় দুজন।

‘ওরা দৃষ্টিচর হতেই এলিজাবেথ একটু ঝুঁকে ঘাড় বাড়াল সামনে, যেন শেষবারের মতো তাদের চেহারা দেখতে চায়। কিন্তু তারা ততক্ষণে মিলিয়ে গেছে দূরের অন্ধকারে। হালকা একটা ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল এলিজাবেথ। এ যেন অপ্রকাশিত এক বেদনার নিঃশব্দ প্রকাশ।ঠিক তখনই পিছন থেকে ভেসে এল এক গম্ভীর, ভারী, চিরচেনা কণ্ঠস্বর—
“রেড!”
‘চমকে উঠে তড়াক করে ঘুরল এলিজাবেথ। পিছনে রিচার্ড দাঁড়িয়ে। এতক্ষণ সেও এলিজাবেথের মতো নিঃশব্দে ন্যাসো ইবরাতের সুন্দর মুহূর্তটা ট্যারেসে দাঁড়িয়ে দেখছিল। রিচার্ডের চোখ দুটো কঠোর, অনড়ও একগুঁয়ে দৃষ্টির একেবারে কেন্দ্রে এখন এলিজাবেথ। পলক ফেলে না সে। চোয়ালে হালকা টান, মুখে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে এক মিশ্র অনুভূতির ছায়া। এক পলক এলিজাবেথের মুখাবয়ব দেখে ঘাড়টা সামান্য কাত করে একপ্রকার হিসহিসে স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“Wanna go on a ride?”

‘ধরিত্রীতে নেমে এসেছে নিস্তব্ধ ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারপাশে কেবল জোছনার ম্লান আলো। চাঁদের ধুসর জ্যোৎস্নায় ঝিমিয়ে পড়েছে শহরের কোলাহল। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যেন এক স্বর্গীয় সেতু৷ দূরে দূরে আলো ঝিমিয়ে পড়ছে। বাতাস ছুটছে বাইকের গতির সাথে তাল মিলিয়ে। কালো বাইকটা শিস দিতে দিতে ছুটে চলেছে। যেন অন্ধকার চিরে এগিয়ে যাচ্ছে কোনো অলিখিত প্রতিশ্রুতির দিকে। ইঞ্জিনের ঘন গর্জনেও ঢাকা পড়ে না ভিতর থেকে ওঠা হৃদয়ের দোলা।

‘পিছন থেকে ইবরাত জাপটে ধরে রেখেছে ন্যাসোকে -নরম, অথচ অসম্ভব জেদি এক আকর্ষণ। ওর গাল ঠেকানো ন্যাসোর পিঠে। চোখ বুজে রেখেছে। বাইকের গতি, প্রকৃতির রোমাঞ্চ আর ন্যাসোর উষ্ণ শরীর সব মিলিয়ে এক ধরণের মাদকতা ছড়িয়ে পড়েছে ইবরাতের শরীরে। ন্যাসো একটু পর পর মিররে চোখ রাখছে, ইবরাত ঘুমিয়ে পড়ে নাকি সেই চিন্তায়। হঠাৎ ন্যাসো বুক থেকে ইবরাতের হাত তুলে নিগূঢ় ভালোবাসার পরশ একেঁ দিল। ইবরাত মাথা তোলে। চাঁদের আলোয় তার মুখ যেন দীপ্তিময় এক খোলা কবিতা। আবেগ, আস্থা আর এক চিলতে দস্যি প্রেমে ভরা। ঠৌঁটে হাসি।
‘কোনো শব্দ নেই, তবুও সমস্ত কিছু বলা হয়ে যাচ্ছে এই নিরবতাতেই। হঠাৎ ন্যাসো গ্লাভস পরিহিত ডান হাত মেতে দেয় বাইকের হ্যান্ডেল ছেড়ে। ইবরাত সাথে সাথেই মৃদু হেসে ন্যাসোর কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে আঙুলের ভাঁজ আঙুল দিয়ে নির্ভরতা, ভালোবাসা, আর বুকভরা আবেগে চেপে ধরে ন্যাসোর হাত।

“রাত।”
‘ইবরাত মৃদু স্বরে উত্তর দেয় কাঁধে থুতনি রেখেই,”হুমমম।”
“ঠিক এভাবেই সারাজীবন, হাত ধরে সবকিছু পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবো একসাথে। ঠিক আছে ?”
‘ইবরাত কোনো নাটকীয়তা ছাড়াই তৎক্ষনাৎ জবাব দেয় হেসে,”ঠিক আছে।”
‘শব্দটা যেন এক অনন্ত চুক্তির মতো আকাশে ঝুলে গেল। ন্যাসো প্রশান্তিতে একবার চোখ বন্ধ করে, তারপর হঠাৎ গ্যাস চেপে ধরল। বাইক ছুটে চলে বজ্রবেগে। রাতের বুক চিরে, চাঁদের আলোকে সাক্ষী রেখে এই প্রেমের গল্পটাকে পৃথিবীর বুকেও অমর করে দিতে।

‘ফাঁকা হাইওয়ের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে কুয়াশা আর গরম অ্যাসফল্টের গন্ধ। বাতাসে অদ্ভুত এক অস্থিরতা। ন্যাসোর বাইক অন্ধকার চিরে চলেছে। ছায়ার মতো ইঞ্জিনের গর্জনে কাঁপছে নীরবতা। ইবরাত পেছনে বসে জাপটে ধরেছে তাকে। দু’চোখে ভয় আর উত্তেজনার মিশেল। হঠাৎই একটা ঘূর্ণি উঠে যায় রাস্তার উপর দিয়ে। ঝড়ের বেগে পাশ কাটিয়ে যায় এক কালো বাইক। মডিফায়েড! গায়ে মনস্টার স্টিকার। গর্জে ওঠা এক অসভ্য স্পিড এক মুহূর্তে উধাও। ন্যাসোর চোখে ঝলকে ওঠে বিস্ময়। সেই বাইকটা কিছু দূর গিয়ে হঠাৎ ধীর হয়ে আসে। ন্যাসো ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে অদূরে। সামনের বাইক থেকে ধীরে ধীরে মাথা ঘোরায় একজন। কালো রাইডিং জ্যাকেট, গ্লাভস পরা হাত, দামি হেলমেট। হেলমেটের গ্লাস একটানে তুলে অকস্মাৎ চোখ মারল লোকটা। প্রথমে চমকে উঠলেও পরক্ষণেই ন্যাসোর ঠোঁটে খেলে যায় বাঁকা, রহস্যময় হাসি।সে পিছনে মাথা ঘুরিয়ে ফিসফিসায়,
“রাত, আমাকে জাপটে ধর। অনেক শক্ত করে।”

‘ইবরাত কোনো প্রশ্ন করে না। বুক জুড়ে শক্ত করে চেপে ধরে ন্যাসোকে। পরমুহূর্তে বাইক ছেড়ে দেয় শয়তানের গতিতে। রাতের রাজপথে শুরু হয় এক দহন। বাইকে নয়, তারা যেন সময়কে তাড়া করছে। সামনের বাইকে বসা মেয়েটাও আঁকড়ে ধরেছে চালককে, ঠিক ইবরাতের মতো। হাওয়ায় উড়ছে তার চুল। যেন লাল রেশমের ঢেউ। হেলমেটের ফাঁক দিয়ে কুয়াশায় জ্বলজ্বল করছে তাদের রাইডিং গিয়ার।
‘ইবরাত ভয় পায়। ঠান্ডায় হাত-পা শিথিল হয়ে আসছে।
কিছুটা সাহস নিয়ে হেলমেটের গ্লাস টেনে তোলে। সামনে তাকাতেই কেঁপে ওঠে। চোখ আটকে যায় সেই রেশমি চুলে। পরিচিত। অসম্ভব! নিঃশ্বাস ফেলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে,
“এলিজাবেথ…

‘সময় থেমে যায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য। ঠিক তখনই সেই মেয়েটা, সেই লালচুলে পিলিয়ন রাইডার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। চোখে খেলে যায় এক অচেনা হাসি, পরিচিত বিদ্যুৎ। চোখাচোখি হয় দুই বোনের। সকল ভয় যেন নিমিষেই মিলিয়ে যায় ইবরাতের। রাতের বুকে দুটো বাইক পাশাপাশি। চলন্ত গতিতে হাত বাড়িয়ে দেয় তারা, ছুঁয়ে ফেলে একে-অপরকে। হাসল এলিজাবেথ হাসল ইবরাত।

‘অপর বাইক আর কেউ না। স্বয়ং এলিজাবেথ আর রিচার্ড। ন্যাসো শিস বাজিয়ে রিচার্ডকে তার দিকে ফেরাল। স্পিড সীমায় নামাল রিচার্ড। গ্রীবা বাঁকিয়ে ন্যাসোর দিকে তাকিয়ে উস্কানিমূলক ইঙ্গিত দিল, ন্যাসোও হাসে ঠোঁটের কোণে এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে। গর্জে ওঠে ইঞ্জিন। আবার শুরু হয় রেস।রাতের বুকে কুয়াশার রাজ্যে প্রেম, রক্ত আর জেতার তীব্র তেজ নিয়ে ছুটে চলে চারজন। দুইটা বাইক। চারজন মানুষ।কিন্তু এই মুহূর্তে তারা যেন রক্তমাংসের কেউ না। তারা হচ্ছে গতি। তারা হচ্ছে আগুন।ন্যাসো এক হাত বাড়িয়ে গিয়ার ঠেলে দেয় নিচে, পেছনে এক ঝাঁক আগুন ছুটে আসে। রিচার্ডও পেছনে চায় না। তার কালো বাইকটা লাফিয়ে ওঠে স্পিডে। নিচু হয়ে যায় দুই চালক! হেলমেট ঠেকে যাচ্ছে হ্যান্ডলবারে।

‘হাওয়ায় গর্জে ওঠে দুই ইঞ্জিন। রাতে বাজ পড়ে যেন দুই দানব ছুটছে সমান্তরাল সীমানায়। হঠাৎ এক মোড়-ন্যাসো বাইক কাত করে ঝাঁকুনি দিয়ে ঘোরে রাস্তায় স্কিডের চিহ্ন রেখে। রিচার্ড এক সেকেন্ডও দেরি করে না। তারা রাস্তা ছাড়িয়ে ঢুকে পড়ে শহরের অর্ধ-নির্মিত ফ্লাইওভারে। যেখানে বাঁকগুলো অন্ধ এবং নিচে শুধু শূন্যতা।
‘ইবরাত চিৎকার করে ওঠে,”ধীরে চালান প্লিজ! নিচে…”
“চোখ বন্ধ করো!”
‘ওপাশে এলিজাবেথ কাঁপা গলায় ফিসফিসায়,”আমরা মরব না তো স্বামী?”

“আজ না।” রিচার্ডের ঠান্ডা, ধাতব কণ্ঠ। তার শিকারী দৃষ্টি সামনে। মাথায় জেতার তীব্র আগুন। দুই বাইক একসঙ্গে লাফিয়ে ওঠে একটা ধ্বংসপ্রায় র‍্যাম্পের ওপর দিয়ে। এক সেকেন্ডের জন্য যেন বাতাসে ঝুলে থাকে তারা! তারপর ধপাস করে নেমে পড়ে ফ্লাইওভারের অন্য প্রান্তে। চাকা ঘর্ষণে আগুন ছিটিয়ে ছুটতে থাকে তারা আবারও নির্বিকার, নির্ভীক ভাবে। অন্ধকার শহরের হাইওয়েতে তারা ছুটে চলছে। আজ মৃত্যুর সঙ্গেই রেসে নেমেছে। ন্যাসোর চোখ দুটো খাঁজকাটা, চোয়াল শক্ত। ইঞ্জিনের গর্জন এত জোরে উঠছে যে মনে হয় বুকের ভেতর যেকোনো ফেটে যাবে। রিচার্ডের মুখে এক শূন্য হাসি। বাইকের গতি তখন রক্তের গতিকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। রাস্তার দুই পাশে লাইট নিভে যেতে থাকে একে একে। কুয়াশা ঘন হয়ে আসে।

‘কিন্তু আজ যারা মাঠে নেমেছে, তারা ফেরার নয়। হঠাৎ সামনের রাস্তায় বিশাল এক ট্রাক উল্টো দিক থেকে তেড়ে আসে। ট্রাকের হেডলাইট দুটো যেন মৃত্যুর চোখ। ন্যাসোর চোখে এসে পড়ে হেডলাইটের হলদে আলো। পরিস্থিতি বেগতিক, মোর নেওয়ার জায়গায় নেই। হাতে সময় কম। গভীর দম টানলো ন্যাসো। অতিরিক্ত না ভেবে শেষ মুহূর্তে বাইক কাত করে স্লিপ দেয়। ইবরাতের চিৎকার কেটে যায় হাওয়ায়। খামচে ধরে ন্যাসোর কাঁধ। পেছনের চাকা আগুন ছিটিয়ে পাশ কাটিয়ে যায় ট্রাকটাকে।

‘রিচার্ড আরও ভয়ংকর। সে হঠাৎ বাইকটা দুই চাকার উপর তুলে নেয়। একচাকা ভর করে পুরো ট্রাকের গায়ে ঘষে ঘষে পাশ কাটায়। হেলমেটের গ্লাসে তখন রক্তরঙা আলো ঝলকাচ্ছে। পেছনে এলিজাবেথ একটুও ভয় পেল না। তার ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি। সে জানে—এই লোকটা হারার বস্তু নয়। এই লোক থাকতে বিপদ নেই। এক পর্যায়ে তারা ঢুকে পড়ে এক পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরি রোডে। রাস্তা ভাঙা, অন্ধকার, দু’পাশে ভেঙে পড়া দেওয়াল আর গর্তে ভরা।
একটা ছোট ব্রিজ। নিচে কুয়াশায় ঢাকা নদী। প্ল্যাঙ্কগুলো আলগা।একটাও মিস করলেই সোজা নিচে পতন। তবুও রিচার্ড থামে না। ন্যাসোও থামে না। চাকা থকে কাঠের উপর স্কিড দেয়। শব্দ ওঠে যেন হাড় ভাঙার। ইবরাত চিৎকার করতে গিয়েও পারে না, গলা শুকিয়ে গেছে। শেষ কাঠের পাটাতনটা ছিল আধভাঙা। রিচার্ড সেটার উপর দিয়ে বাইক লাফিয়ে নেয়শ পেছনে আগুনের রেখা রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্যদিকে। ন্যাসো তার পরে।

‘শহরের বুক চিড়ে দুটো দুর্বার রাইডার এসে থামল একটা পুরনো ব্রিজের ওপর। বাতাস তখনও কাঁপছে গতি আর উত্তেজনায়। বরাবরের মতো আজও রেইসে জিতেছে রিচার্ড। এলিজাবেথ আর ইবরাত দুজনেই ঘেমে একাকার, চোখেমুখে ভয় আর বিস্ময়ের ছাপ। ন্যাসো মাথা থেকে হেলমেট খুলে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। রিচার্ড মুষ্টিবদ্ধ করে তার হাত এগিয়ে দিল। ন্যাসো একপাশে বাঁকা হাসি হেসে একইভাবে নিজের মুষ্টি ছুঁইয়ে দিল রিচার্ডের সঙ্গে। ওদিকে দুই বোনের হাঁফ ধরা অবস্থা। বুক উঠছে-নামছে যেন কেউ সোজা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। ন্যাসো চোখের ভ্রু নাচিয়ে রিচার্ডের উদ্দেশ্য বলল,

“কি বস, আমাকে নিষেধ করে নিজেই বেরিয়ে পড়লেন?”
‘রিচার্ড নিরুদ্বেগ গলায় বলল,”It’s all about priority.”
‘বলেই হঠাৎ বাইক স্টার্ট দিল। তাল সামলাতে না পেরে এলিজাবেথ রিচার্ডের পিঠে আঁচড়ে পড়ে। ন্যাসো মুচকি হেসে নিজের বাইক স্টার্ট করল। গতি তোলার আগে একবার চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল, তারপর মোড় নিল ম্যানশনের পথে।
‘রিচার্ডের বাইকের গতি এখন সর্বোচ্চ সীমায়। চারপাশে প্রকৃতি যেন নৃত্যের ছন্দে দুলছে৷ মৃদু, স্নিগ্ধ, মিটিমিটি হাওয়া তাদের ঘিরে জাল বুনেছে। হঠাৎ এলিজাবেথ ঝুঁকল রিচার্ডের পিঠে। দু’হাত রাখল রিচার্ডের উরুর ওপর আলতো করে কিন্তু সজাগ। রিচার্ড একটুও চমকে না গিয়ে ধীরে এলিজাবেথের হাত দুটো টেনে আনল। রাখল নিজের বুকে। এলিজাবেথ স্পষ্ট অনুভব করল বুকের গভীরে ধুকধুক করা এক তীব্র সংযোগ। আজ নিজে থেকে রিচার্ডকে জড়িয়ে ধরল এলিজাবেথ একদম অষ্টেপৃষ্ঠে একটুও ফাঁক না রেখে। থুতনি রাখল রিচার্ডের চওড়া কাঁধে। হেলমেটের অন্তরালে থাকা কালচে ঠোঁটে ফুটল এক চুপিসার হাসি। ভেতরে জমে থাকা কিছু অনুভবের নীরব স্বীকৃতি।

“প্রথম যেদিন আপনার সাথে বাইকে উঠেছিলাম, মনে আছে?”
‘রিচার্ড চোখ না ঘুরিয়েই পাল্টা জিজ্ঞেস করল, “মনে আছে?”
‘হেসে উঠল এলিজাবেথ। বলল, “মনে থাকবে না বুঝি? মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বাইকে তুলেছিলেন!”
‘রিচার্ড ঠোঁটের কোণে একটুকরো তির্যক হাসি ঝুলিয়ে বলল, “আর এবার?”
‘এলিজাবেথ কাঁধে মুখ লুকিয়ে বলল,”এবার কিছুটা আলাদা… পুরোটা ব্যতিক্রম।”
“সেদিন কেমন ছিল?”
“ভয়ংকর।”
‘অকস্মাৎ এক ঝাঁকুনি দিয়ে ব্রেক কষল রিচার্ড। বাইক থেমে যেতেই এলিজাবেথ ভ্রু কুঁচকে সোজা হয়ে বসে। মুহূর্তেই চারপাশ নিস্তব্ধ। রিচার্ড গম্ভীর, রুদ্ধস্বরে বলল,
“নামো।”

‘কোনো প্রশ্ন না করে নিঃশব্দে নেমে এল এলিজাবেথ। রিচার্ড রিচার্ড নিজের হেলমেট খুলল, খুলল এলিজাবেথেরটাও। অতঃপর দুটোই ছুঁড়ে ফেলে দিল রাস্তার পাশে। এলিজাবেথ চমকে রিচার্ডের দিকে তাকাতেই রিচার্ডের ঠোঁটে ফুটে উঠল এক বাঁকা হাসি।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৬

“রিচার্ড কায়নাতের বরাবরের ঝোঁক ভয়ংকর জিনিসের প্রতি,” ফিসফিস করল সে। তারপর কিছু বোঝার আগেই এলিজাবেথের কোমর জাপটে ধরে ওকে শূন্যে তুলে বাইকের ট্যাংকের ওপর বসিয়ে দিল রিচার্ড। বুকের ভিতর অজানা একটা কাঁপুনি খেলতে লাগল এলিজাবেথের। মনে পড়ল সেই রাতে ইতালির ধূসর আলো, কাঁপতে থাকা শরীর আর ভঙ্গুরতা। রিচার্ড বাইক স্টার্ট দিল। খোলা রাস্তায় তারা দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই৷ না আলো, না শব্দ, শুধু নিঃসঙ্গ বাতাস আর হৃদস্পন্দনের ধ্বনি। হঠাৎ রিচার্ড এক হাতে এলিজাবেথকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে শুইয়ে দিল ট্যাংকের ওপর। এলিজাবেথের চোখে আজ কোনো ভয় নেই। ছিল না সংকীর্ণতা, না প্রতিবাদ। ছিল শুধু নিঃশব্দ আত্মসমর্পণ। এক নিবিড় অভ্যন্তরীণ সম্মতি। পুনরাবৃত্তি ঘটল—হ্যাঁ সেই রাতটারই। তবে আজ তাতে ভয় নয়। ছিল এক নতুন ভাষায় লেখা প্রেমের উন্মত্ত ঘোষণা।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৮