ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬১
মিথুবুড়ি
“তোমারও কি কান্দন আসে, আমার মতন রাইতে? তোমারও কি বুক ভাইঙ্গা যায়, আমার সাথে কথা কওয়ার তৃষ্ণায়?”
‘একটি বন্ধ ঘরের চারটি দেয়াল। তার এক পাশে একটি সরু লোহার দরজা। যেন বারো হাত দৈর্ঘ্যের অন্ধকারে চেপে থাকা এক কুয়োর মুখ। প্রতিটি দেয়ালে দেয়ালে রক্তিম রঙে আঁকা শত শত বাণী, অভিমানে ভেজা, অজানা কারও হাতে লেখা বহু আগের বহু অব্যক্ত কথা। পূর্ব দেয়ালে সবচেয়ে স্পষ্ট একটি লাইন,
“আমি বললাম তুমি কি অন্য কারো হয়ে গেছো!
সে মুচকি হেসে বলল আমি কবেই বা আপনার ছিলাম?”
‘তার নিচেই জমাট এক পোড়া ব্যাথায় লেখা,
“চোখের কোণে ঝুলে থাকা শেষ দেখার দৃশ্যটা এখনও ধূলোর মতো উড়ে বেড়ায়। সময় তাকে ধুয়ে দিতে ব্যর্থ, দূরত্ব তাকে মুছে ফেলতে অক্ষম। যে দেখার শেষে শুরু হয়েছিল অনন্ত অনুপস্থিতি, সেই মুহূর্ত আজও দৃষ্টির অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে।”
‘অতঃপর,
“স্মৃতির সীমানায় স্বাক্ষরিত
সুখগুলো শুখমাখা হয়েই সুস্নিগ্ধ”
“যৌনতার শহরে প্রেম যখন দেহের পিপাসু, তখন আমি শুধু তোমাকেই চেয়েছিলাম।”
‘পরপরই,
“রবি ঠাকুর বলেছেন ‘ভারাক্রান্ত মন নিয়ে দীর্ঘ পত্র না লিখতে, তাই সংক্ষিপ্ত বলতে চাই ভীষণ মনে পড়ে..!
মনেও পরে…. মনও পুড়ে। ভালোবাসি,,,, ভালোবাসি।”
‘বাকিটুকু জায়গায় হৃদয়চিরন্তর আহাজারিতে গুমরে ওঠা কিছু অনুভূতি তুলে ধরা হয়েছে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“জ্বলে যাচ্ছে বুক, পুড়ে যাচ্ছে। আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি এলোকেশী। বাঁচাও আমাকে…..” প্রতিটা শব্দ লেখার সময় লোকটা গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করেছিল। তার প্রতিটা আহাজারিতে ছিল ভেতরে, ভেতরে মরে যাওয়ার অনুভব। শূন্যতার হাহাকারে মরণযাত্রার সঙ্গী হয়েছিল মানুষটা। তার পাপ ছিল একটাই—ভুল মানুষকে সঠিক সময় ভালোবেসেছিল সে। এক তরুণীর প্রেমে মত্ত হয়ে সে হারিয়ে ফেলেছে নিজের সত্তাকে। তবুও লোকটা বড্ড বেহায়া, একরোখা উন্মাদ। শরীর তার সঙ্গে আর সঙ্গ দেয় না কিন্তু মন? তাতে এখনো আগুনের মতো তেজ। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীরটা যখন আর দাঁড়াতে পারে না তখন সে নোংরা মেঝেতে এলিয়ে পড়ে। অলস ভঙ্গিতে ভেজা চোখে আক্ষেপে ডুবে লেখা নামিয়ে আনে গুট গুট শব্দে,
“উত্তপ্ত মরুভূমির মতো খরখরে অন্তরটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে তবুও চারটি দীর্ঘ বছর পেরিয়েও দুটি প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। কেন সৃষ্টিকর্তা তোমাকে আমার জীবনে এমন পবিত্রতার ছায়া করে পাঠালেন? আর কেনই বা আমাকেই সেই শূন্যতার বিষাদে আচ্ছন্ন করে রাখলেন? আমরা দুই মেরুর বাসিন্দা, একে অপরকে আকাঙ্ক্ষা করি, তবু আমাদের মাঝে যেন অনন্তকাল ধরে বিস্তৃত আকাশের দূরত্ব। তোমার স্বচ্ছ, নির্মল আকাশে আমার এই কালো জীবনের এক বিন্দু ঠাঁই নেই কেনো?”
‘এই বাণীর নিচেই অর্ধেক ঝরে পড়া কিছু লাইন।
সিমেন্টের ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু রয়ে গেছে তা-ই যেন এক ভাঙা হৃদয়ের কাব্য,
“নাকি কাঁদিয়ে আমাকে সে চোখের জলে ভেজোক…
তৃষ্ণার্ত হৃদয় শুধুই আমি মরিচিকার মতো…
তবে তাই যদি হয়, করি নাকো ভয়—
জানি আঁধার রাত পেড়িয়ে হবে সূর্যদ্বয়,
আমি ভেবেছিলাম তুমি সেই—
লাল গোলাপ, যার নিরন্তর পাহারা দেয় এক কাঁটার বাগান…”
‘নিস্তব্ধ কক্ষ। বাতাসও যেন থেমে গেছে। তার মাঝখানে ধীরে ধীরে শোনা যাচ্ছে এক বিরবিরে গানের সুর। ক্ষীণ, ফিসফিসে স্বরে গেয়ে যাচ্ছে কেউ। একটা ময়লা, শুকিয়ে যাওয়া হাত আঙুলের ডগা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেয়ালের উপর দিয়ে চলছে আর সেই সাথেই গলা মিলিয়ে গাইছে,
“কারে করলো জানি আপন, আমায় কইরা দিয়া পর!
কি তুমি চাওরে পাখি, কি আর তুমি চাও?
ভাঙলা হৃদয়, ভাঙলা সবই!
আরও কি দিতে চাও?”
‘লোকটা বিধ্বস্ত হয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে ঘরের এক কোণে। তার চোখে শূন্যতা। নিঃশ্বাসে ধ্বংসস্তূপের গন্ধ।
তার পাশের দেয়ালে ঝাপসা আলোয় ফুটে আছে একটি লেখা,
“হায় রে বোকা মন আমার, শুনলি না বারণ
আবার প্রেমে মজলি রে তুই, কেন অকারণ?”
‘লেখাগুলো রক্তিম রঙের। সম্ভবত রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছে। রক্ত ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে? চৌদ্দ হাতের এই কারাগারের ভেতরে যা আছে, তা শুধু ন্যূনতা আর নৈরাশ্য।একটা শক্ত তোশক, কাঠের মতো কঠিন বালিশ আর ময়লার আস্তরণে ঢাকা মেঝে। আর একটা মাটির কলশি, সাথে স্টিলের গ্লাস। এক কোণে টানা মলিন পর্দার আড়ালে টয়লেট৷ যার গন্ধে চারপাশ পঁচে উঠেছে, তবুও সেই দুর্গন্ধের মধ্যেও অদ্ভুত স্বস্তিতে বসে আছে এক সময়ের জ্বলন্ত নাম—সাবেক সংসদ সদস্য, মিনিস্টার তাকবীর দেওয়ান। আর নেই সেই পেটানো শরীর, আর নেই সেই বজ্রকণ্ঠ। ধ্বংস এসে কেবল তাকে ছুঁয়েই যায়নি, সে ধ্বংস হয়ে উঠেছে নিজেই।
‘গায়ে পাগলাগারদের ছোপ-ধরা সাদা,কালো পোশাক। খোঁচা খোঁচা কুঁকড়ানো চুলগুলো এখন ঘাড়ের নিচে। চিবুক ভর্তি ঘন কালো দাঁড়ি। এরা শখের বশে রাখা নয়, বরংচ যত্নের অভাবে বেড়ে ওঠা আগাছা। শ্যামবর্ণ গা গিলে নিয়েছে গাঢ় অন্ধকার। দুই মাস, ঠিক দুই মাস সূর্যের আলো দেখেনি তাকবীর। এটা কোনও সাধারণ জেলখানা নয়। মানসিকভাবে সুষ্ঠু করার’ নাম করে এক বর্বর নির্জন কুঠুরি। যেখানে মানুষ নয় মানসিকতাকেই বন্দি করা হয়। তাকবীর এখন শুধু একজন কয়েদি নয় সে এক পতনের জীবন্ত দলিল। আর সেই দলিলের নথিকার—রির্চাড কায়নাত।
‘লোকটার উত্তর পাশের দেয়ালে একইভাবে রক্তিম রঙে লেখা,
“আক্ষেপ তুমি আমার হৃদয়ে থাকবে আর অন্যজনের ভাগ্যে।”
‘তার নিচেই খোদাই করা,
“যে আমার ছিলো’ই তার জন্য কেন এতো মায়া?
কেন তুমি মিছে মায়ায় বেঁধেছিলে আমায় তখন?”
‘বিধ্বস্ত লোকটার সব কথা যখন অপূর্ণ রয়ে যায়, তখন খুব করে হেসেছিল সে। তাচ্ছিল্যের হাসিতে গা দুলেছিল তার৷ সেই সময়কার লেখা দু’টো লাইন,
“জগতের সবচেয়ে সুন্দরতম আফসোসর জিনিস হলো
নিজেকে নিজে শেষ হইতে দেখা!”
‘তার পরপরই হুট করে অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করে লোকটা। এক লাস্যময়ী শীর্নকায় নারীর সংস্পর্শে স্তম্ভিত হয়েছিল সে। যার শূন্যতা তার আত্মটাকেই যেন কেউ ছিঁড়ে নিয়ে যায় প্রতি মুহুর্তে। নরকযন্ত্রণার আর্তনাদে চিৎকার করে চেঁচাতে চেঁচাতে চরম বিতৃষ্ণা থেকে সে লিখেছিল,
“মৃত্যু এসে মুছে যাক আমার সকল দুঃখ। যেই পৃথিবীতে আমার এলোকেশী নেই, থাকতে চাই না আমি সেই পৃথিবীতে।”
“কেনো সেদিন সবাই ছলনা করল আমার সাথে? সেটা কেনো কাবিননামা হলো না? তুমি কেনো আমার হলে না? আমি কেনো তোমায় পেয়েও পেলাম না? ছুঁয়েও কেনো ধরতে পারলাম না?”
‘ছোট বাচ্চাদের মতো হাত-পা ছড়িয়ে বদ্ধ উন্মাদের ন্যায় ধুলোমাখা মেঝেতে বসে আছে তাকবীর। তীব্র বেদনার জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে রক্তলাল দেয়ালে। তার হতাশায় ডুবে থাকা চাহনি খুঁজছে একটুখানি শূন্য স্থান। সেই শূন্য স্থান সে ভরিয়ে দিতে চায় মনের শূন্যতার গভীরে লুকিয়ে থাকা অভ্যক্ত বাণীতে। একবিংশ শতাব্দীর পর কেউ যখন হারিয়ে ফেলা কিছু খুঁজে পেয়ে দিশেহারা হয়ে ছুটে যায় তার দিকে,তাকবীরও ঠিক তেমনি ছুটল। হাওয়ার মত লেলিয়ে গেল চোখে পড়ে যাওয়া একফোঁটা ফাঁকা জায়গার দিকে।
‘চেনা অভ্যাসে সে এবারও ঘিরার থেঁতলানো অংশটায় ঘুষি বসাল। সঙ্গে সঙ্গে চামড়া ফেটে রক্ত ঝরল। এতে আক্ষেপ নেই কোনো। বরংচ রঙের বক্সে যেমন রংতুলি ডুবিয়ে ক্যানভাসে কেউ ছবি আঁকে তাকবীরও তেমনই আঙুলে গলগলে রক্ত তুলে লিখতে শুরু করল গানের লাইন। লোকটা তুখোড় সংগীতপ্রেমী। জীবনের ব্যর্থতা যদি পিছু না টানত তাহলে হয়তো আজ সে বড় পর্দার এক অমলিন নাম হয়ে থাকত। ওই যে থাকে নাহ কিছু গা, যেগুলো শুনলে বুকের ভেতর কাঁপন ধরে— কারণ ওগুলো হঠাৎ জীবনেরই কিছু টুকরো তুলে ধরে রক্তমাখা সত্যের মতো। তেমনই একটা গান লিখল পাগল প্রেমিক তাকবীর দেওয়ান,
“দুরে তবু দূরে,সরে থাকতে পারিনি
কাছে এসে কেন,কাছে আসতে পারিনি
আমি আজও বুঝিনি,আমি আজও বুঝিনি
তোমার আমার প্রেম, আমি আজও বুঝিনি
ঐ চোখের চাওয়াতে, প্রেম আজও দেখিনি,,,”
‘হঠাৎ করেই তাকবীর মাথার চুল টেনে ধরল। হৃদয় ফেটে যাওয়ার মতো টান অনুভব করল দেহজুড়ে। শরীরের রক্ত চলাচল তীব্র হয়ে উঠে। অন্তরে আঁধার নামে। তাকবীরের সারাজীবনের সমস্ত পাপের শাস্তিস্বরূপ একটা কথাই যথেষ্ট ছিল—এলিজাবেথের এক্সিডেন্ট হয়েছে। এই একটা কথায় তার ভিতর ঝড় তুলে। সেদিনের পর থেকে তাকবীর আর নেই। সে যেনো হারিয়ে গিয়েছে কোন বিষন্নতার গহীনে। নিজেকে, নিজে অনুভব করতে পারে না। বুকের গভীর থেকে ক্ষতের আতর্নাদ চিৎকার দিয়ে বেরোতে চায়। তবে চৌদ্দ হাতের এই ঘরের বাইরে তা বেরোয় না। নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। রিচার্ড বলেছিল সে তাকবীর’কে জানে মারবে না, তবে তার আত্মা মরে যাবে। আজ ঠিক তাই হচ্ছে।
‘তাকবীর থেকেও নেই। চাতক পাখির ন্যায় ছটফট করছে সে। সে মরতে চাইছে, তবে তাকে মরতে দেওয়া হচ্ছে না। বিধাতা সহ সকলে তাকে ফেলেছে এক দুর্বিহিস অগ্নিপরীক্ষায়। পাগলের মতো কাঁধে সে, আবার পাগলের মতোই হাসে। শরীরের ক্ষতের উপর নতুন করে ক্ষত তৈরি করে তবুও দেহে একফোঁটা বেদনা অনুভব করেনি সে। প্রথম, প্রথম বার বার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল তাকবীর। চিৎকার করে কাঁদত আর চেঁচাতো। নিয়ম করে তিনবেলা খাবার দিতে আসা লোকদের পায়ে পড়ত। তার আহাজারিতে ভারি হয়ে যেতো তাদের বুক। তবে তারা অপারগ। তারা পারেনি তাকবীরের এলোকেশী’কে এনে দিতে। তাকবীরের কান্নায় কেঁদেছিল কংক্রিটের দেয়াল। তার বুকফাটা আর্তনাদ কেঁদেছিল বাকিরা। তবুও মন গলেনি কারোর। কেউ এনে দেয়নি তার এলোকেশীর খোঁজ।
‘একটা সময় তাকবীর মানিয়ে নেয় নিজেকে। বুঝায় নিজেকে—তার এলোকেশী বেঁচে আছে, ঠিক আছে, সুস্থ আছে। তার আত্মা তো সেই লাল কেশরাশির মেয়েটার সাথে অটুট বন্ধনে আবদ্ধ। সে মারা গেলে নিশ্চয়ই সেও মারা যে। এলোকেশী ছাড়া তো তাকবীর’রা বাঁচতে পারে না। সে তো মরতে চেয়েও পারছে না। হয়তো অপর পাশের মানুষটা আছে, তাকে যে থাকতেই হবে। বাঁচার উৎস-ই তো সে। তার জন্যই তো এখনও আছে এই পাপিষ্ঠ পুরুষ।
‘কিন্তু ওই যে ব্যাকুল হৃদয়। পুরুষ মানুষ কাঁদে না। এ তো সমাজের অলিখিত বিধান। অথচ এই লোকটার ভিতরের কান্না আজ আর বাধ মানছে না। গলার গভীরে জমে থাকা দলাগুলো চিৎকার করে বেরিয়ে আসতে চাইছে, ঠেলে দিচ্ছে কান্নার বাঁধ। একসময় যার শরীরের গন্ধেই মুগ্ধ হতো সবাই, আজ তার গায়ে নেই কোনো সুবাস। আছে শুধু বেদনার স্তব। এই যে একটু পরপর কেঁপে উঠছে লোকটার শরীর, কণ্ঠস্বর ডুবে যাচ্ছে গলার অতলে। এ কি সেই বজ্রকণ্ঠ? যে এক সময় এক ভাষণেই কাঁপিয়ে দিতো রাজনীতির মাঠ? যার হাতের মুঠোয় ছিলো অন্যকে পিষে ফেলার শক্তি? আজ সেই মানুষটা কাঁপছে একাকীত্বে, কাঁদছে নিঃশব্দে। এমন ভাঙন কি সহ্য করা যায় চোখের সামনে?
‘কারোর ভারি পায়ের শব্দে মাথা তুলে তাকবীর। দেখতে পায় রিচার্ড দাঁড়িয়ে শক্ত চিবুকে। তাকবীর হুড়মুড়িয়ে গিয়ে পড়ল রিচার্ডের সামনে। নিঃশ্বাসের সুগভীর বেগে প্রশ্ন করতে থাকে,
“এল-এলোকেশী? আ-আমার এলোকেশী কোথায়?কেমন আছে ও?”
‘রিচার্ড জবাব দেয় না। নির্বিকার দাঁড়িয়ে শক্ত চোয়ালে নিবিড়ভাবে পরখ করে নিল তাকবীরের অস্তিত্ব। তাকবীর অস্থির হয়, অশান্ত হয়। প্রথম বারের মতো স্পর্শ করল রিচার্ড’কে। রিচার্ডের হাত মুঠির মধ্যে নিয়ে উত্তেজিত স্বরে অর্নগল বলতে থাকে,
“কেমন আছে আমার এলোকেশী?”
‘চোয়ালে জমে থাকা রাগে ঝাড়া মেরে হাত সরিয়ে নেয় রিচার্ড। পরিস্ফুটিত ভাবে রাশভারি আওয়াজ তুলে বলল,
“মরে গিয়েছে।”
‘নিস্তব্ধ বিস্ফোরণ অন্তরের অন্তস্তলে। নিমিষেই রক্তশূণ্য হয়ে গেল তাকবীরের কৃষ্ণগহ্বর। তার শরীর আপনাআপনি পিছিয়ে গেল দু’কদম। থরথর করে কাঁপে কণ্ঠস্বর। লম্বা শ্বাস টেনে বুক ফুলিয়ে ধাতস্থ ভঙ্গিতে বলল,
“তু-ত তুই মজা করছিস নাহ?”
‘টানটান হয়ে দুই পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়াল রিচার্ড। বজ্রপাতের মতো গম্ভীর কণ্ঠ,
“সে পুরো দুনিয়ার কাছে জীবিত থাকলেও তোর কাছে মৃত।”
‘তাকবীরের সুগভীর, নিকষ কালো চোখে সন্দেহ সংকুচিত হলো। পরপরই কথার বেড়াজাল ভেঙে ফেলতে সে সক্ষম হয় অল্প সময়ের মধ্যেই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল তাকবীর। সহসাই এক রঙিন উজ্জ্বলিত শিখা প্রজ্জ্বলিত হলো ভিতরে। বুকে হাত চেপে ধপাস করে বসে পড়ল। শরীরে যেনো এতোদিনের সকল ক্লান্তি চেপে বসেছে। অনুভব করল ক্ষত স্থান গুলোতে চিনচিনে ব্যাথা।
‘রিচার্ড তাকাল না। ভিতরে এক বিষাক্ত দোটানা, এক দাহ আর অমোচনীয় অশান্তি কাজ করছে। নিঃশব্দে হাঁটু গেড়ে বসল বিভ্রান্ত শরীরটার সামনে। দাঁতে দাঁত চেপে জ্বলন্ত স্বরে প্রশ্ন ছুড়ে,
“মিস এলিসা কোথায়?”
‘তাকবীর মাথা ঠেকিয়ে রাখল দেয়ালে। নিঃসাড়ে বলল,
“জানি না।”
‘দেয়ালের ক্ষতবিক্ষত লেখাগুলোতে চোখ যেতেই রিচার্ডের রক্তে আগুন ধরল। খামচে ধরল তাকবীরের গলা,
“খোদার কসম, তোকে ছিঁড়ে ফেলব যদি আমার ওয়াইফের নামও উচ্চারণ করিস। ভুলে যাবো প্রতিজ্ঞা, ভেঙে ফেলব রক্তের শৃঙ্খল।”
“মেরে ফেলতে পারিস। তোর সে ক্ষমতা আছে।
কিন্তু মন থেকে মুছে ফেলার ক্ষমতা স্বয়ং এলোকেশীরও নেই।”
‘রিচার্ডের চোখে ক্ষিপ্ত আগুন। বুকের গভীরে ফাটছে শপথের বাঁধ। তবু নিজেকে সংবরণ করল। সে চাই না ফাদার কে দেওয়া শেষ প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেলতে। শক্ত গলায় পুনরায় প্রশ্ন করল,
“মিস এলিসা কোথায়?”
“বলেছি তো আমি জানি না।”
“পাতাল থেকেও খুঁজে বার করব আমি ওনাকে। স্ত্রীকে কথা দিয়েছি—এই জন্মদিনে ওকে জীবনের সেরা উপহার দেব।”
‘তাকবীর হেসে উঠল। বহুদিন পর তার অধরে হাসি ফুটেছে। কণ্ঠনালী বেয়ে ঠাট্টা হাসির উদগীরণ ঘটলো ঠৌঁটে।
“তাহলে খুঁজে নে না। আমার দরজায় এলি ক্যান? ছোটবেলায় শুনতাম, হাতি গর্তে পড়লে পিঁপড়েও কাদা ছোড়ে। আজ তো দেখি সেই পিঁপড়ের কাছেই হাতি এসে দাঁড়িয়েছে?”
‘রিচার্ডের মুঠো শক্ত হয়ে উঠল, রক্তচাপা রাগে হাতে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে গৌড় শিরা-উপশিরা। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“জানিস ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তোকেই মারতে পারছি না বলে।”
‘রিচার্ড হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়। পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় বাতাসে। তাকবীর চুপচাপ মাথা তুলে চেয়ে থাকে দরজার ফাঁকা দিকে। বুকের গভীরে কোথা থেকে যেন বেজে ওঠে এক চুপচাপ স্বীকারোক্তি,
“আমি পারব না সত্যিটা বলতে। তাহলে তো আমি আরো ছোট হয়ে যাব এলোকেশীর চোখে।”
‘রিচার্ড চলে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে। তাকবীর এখনও আগের জায়গায় অবিন্যস্ত ভাবে পড়ে আছে। কোনো নড়াচড়া নেই, অভিব্যক্তি নেই। শ্বাস-প্রশ্বাস খুবই ক্ষীণ। ঝং ধরা ইঞ্জিনের মতো ধীরস্বভাবে ছুটছে, বেরুচ্ছে। গুমোট পরিবেশ শোকে গেয়ে গেছে। বুক ধুকপুকে অসহায়ত্বতা তার পিছু ছাড়ে না। কাঁঠালের আঠার মতো চটকে আছে পুরো অস্তিত্ব জুড়ে। হঠাৎ নাকে ভেসে এলো চিরচেনা স্নিগ্ধ সেই ঘ্রাণ। চকিতে মাথা তুলল তাকবীর। সামনে তাকাতেই শরীরে শ্বাস ফিরে পেলো লোকটা। বুক ধাঁধিয়ে গেল শীতলতায়। তৎক্ষনাৎ কার্নিশদ্বয় সিক্ত নোনাজলে। লোকটা দাঁড়াতে চায়, তবে পা দুটো যেন জমাট বাঁধা ভারি সীসার মতো। বহু করসতে ওঠে দাঁড়াল তাকবীর হাঁটুতে ভর দিয়ে। জীবনের সবথেকে মূল্যবান জিনিসটা হারিয়ে ফেলার পর যখন বহু প্রতীক্ষা নিরীক্ষায় তা ফিরে পাওয়ার পর মুখাবয়ব যে-ই উদ্দাম আনন্দে ঝলঝল করে, ঠিক সেভাবে এক টুকরো নিখাদ মোলায়েম আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল কৃষ্ণগহ্বর।
‘অন্তরের বয়ে যাওয়া প্রশান্তিময় নরম স্রোতে ভেসে লোকটা ছুটে গেল মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে। তবে বৃক্ষপকে এক শক্ত ধাক্কায় ছিটকে গিয়ে পড়ল এক কোণে। ক্ষতস্থানে নতুন করে রক্তক্ষরণ শুরু হলেও ঢোক গিলার মতো সমস্ত রক্তপাত, ব্যাথা, অসহনীয় যন্ত্রণা গিলে নিল সে। তৃষাতুর হৃদয় ব্যস্ত হয়ে পড়ল তার তৃষ্ণা মিটাতে। এলিজাবেথ চোখ ভরা শোচনীয় বিস্ময়ে দেখতে থাকে বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী লোকটার করুন হালত। সেই সুবিস্তৃত,শক্তপোক্ত সুঠোম বুক মাঝ থেকে ভেঙে গিয়েছে।
“এলোকেশী?”
‘এলিজাবেথ শক্ত ঢোক গিলে তাকাল চারদিকে। দেয়ালের লেখাগুলো পড়ে চিরায়ত গম্ভীর গলায় বলল,
“পরস্ত্রীর জন্য এমন পাগলামো করবেন না। কলঙ্ক লাগবে আমার গায়ে।”
‘তাকবীরের অভিব্যক্তি অত্যন্ত স্বাভাবিক। নিস্প্রভ দ্বিধাহীন নজরে অনড়ভাবে চেয়ে থেকে অভাবনীয় কণ্ঠে নিরুদ্বেগে আওড়ালো,
“থাক না কিছু কলঙ্ক, কি আসে-যায়? চাঁদেরও কলঙ্ক থাকে, আমরা-তো মানুষ.!”
‘ফোঁস নিশ্বাস ফেলল এলিজাবেথ। ব্যাথতুর কণ্ঠে গুরুতর কথাটাকেও হেসে উড়িয়ে দিল। সুচতুরভাবে জিজ্ঞেস করল,
“ভালো আছেন?”
‘নির্বিকার মাথা নাড়াল তাকবীর। গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত সে। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে, সে কি ভালো আছে? উত্তর মেলে না। অতঃপর উপযুক্ত, যুক্তিসঙ্গত জবাব না পেয়ে স্বগোতক্তিতে বিরবিড়ালো সে,
“নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি, উত্তর পাইনা, একাই কাঁদি, সঙ্গ পাইনা, অভিযোগ করে শেষে দেখি নিজেই নিজের কাছে অসহায়।”
“ভুলে যান আমাকে, তাহলেই উত্তর পাবেন সবকিছুর।”
‘তাকবীর মাথা তুলে আলোছায়া মেশানো চোখে তাকাল তার এলোকেশীর দিকে। মেয়েটার সৌন্দর্য যেন দিনকে দিন অনুপম দৃশ্যের ছন্দময় হয়ে উঠছে। তাকবীর সন্তপর্ণে জবাব দিল,
“60 বছর পরেও হুমায়ূন ফরিদ স্যারের মতো বলব ‘আমি এখনও একজনকে অসম্ভব ভালোবাসি।”
‘হঠাৎ কয়েকটা সাদা কাগজ এসে ছিটকে পড়ল তাকবীরের মুখের উপর। তাকবীর কাগজগুলো হাতে নিতেই প্রথমে দৃষ্টিকর্ষণ হয়—ইলহাম বেনজির। এলিজাবেথের বাবার নাম এটা। এই কাগজগুলো তাকবীরের সকল পাপের নথিপত্র। সেদিন দেওয়ান মঞ্জিলে এই নামটাতেই এলিজাবেথের দৃষ্টি থমকে গিয়েছিল, পরবর্তীতে এক নাম অনেকের হতে পারে ভেবে আমলে নেয়নি। তবে বর্তমান পরিস্থিতি ও রিচার্ডের সকল কথা সাদৃশ্যপূর্ণ ইঙ্গিত দেয় ইলহাম বেনজির কোনো না কোনোভাবে জড়িত এসবের সাথে। ন্যাসো এগুলো এলিজাবেথ’কে দেওয়ান মঞ্জিল থেকে এনে দিয়েছে।
‘মুহুর্তেই রক্তশূণ্য হয়ে যায় তাকবীরের অবয়ব। এলিয়েন আজ বাড়তি কথায় গেল না। এক অভিন্ন স্বরে সরাসরি বলল,
“আপনাকে আমার কসম, আমি সত্যিটা জানতে চাই। জানতে চাই আমার ড্যাড কোনো পাপের সাথে জড়িয়ে ছিল।”
‘তাকবীর তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। এই মেয়ে আজ তার সমস্ত পথ আটকে দিয়েছে। সত্য প্রকাশ্যে আনা ছাড়া আর কোনো পথ রইল না। লম্বা দম টেনে তাকবীর স্বগোতক্তিতে বলতে শুরু করল,
“তোমার ড্যাড খুনি ছিল না, তবে লোভী ছিলেন। তার লোভই তাকে ধ্বংস করেছে।”
“মানে?”
‘তাকবীর নিখিল কৃষ্ণ চোখে তাকাল এলিজাবেথের অবিস্মরণীয় চোখে। চোখ বুঝে বলতে শুরু করল সে। কেলেন্ডারের পাতায় পিছিয়ে গেল সাল,
“রাশিয়ায় তখন নির্বাচন চলছিল। আর নির্বাচন কখনওই সৎ পথে অনুষ্ঠিত হয়না। আজ থেকে ঠিক আট বছর আগেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তিন বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা এক নিষ্ঠাবান, নির্লোভ মেয়র যখন জনমানসে আস্থা অর্জন করতে শুরু করলেন তখনই শুরু হলো তার বিরুদ্ধে এক সুচতুর ষড়যন্ত্র। সেই সময় ইলহাম বেনজির ছিলেন সাংবাদিকতা জগতের উজ্জ্বল নাম। খুবই সৎ, নির্ভীক ও বেপরোয়া ছিলেন তিনি। তার কলম ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে।বিশেষ করে বিপক্ষ দলের কুকর্মের খবর প্রকাশে তার জুড়ি ছিল না। কিন্তু একদিন তার দরজায় কড়া নাড়ল লোভ। বিপক্ষ দল যারা ছিল অর্থে-ক্ষমতায় বলীয়ান তারা তাকে মোটা অংকের প্রস্তাব দিল। ইলহাম সেই ফাঁদে পা দিলেন। তার কলম থেমে গেল সত্যের পক্ষে। মেয়রের বিরুদ্ধে সাজানো খবর ছড়াতে ছড়াতে তিনি হয়ে উঠলেন এক অসততার প্রতিমূর্তি। মেয়র তখনো অর্থে পিছিয়ে ছিলেন কিন্তু তার পাশে ছিল মানুষ।
‘কিন্তু মানুষের ভালোবাসা ধুয়েমুছে গেল ভুল বার্তার স্রোতে। মেয়র অবশেষে বাধ্য হয়ে নিজের অর্জিত সব সম্পদ বিক্রি করে নামলেন নির্বাচনী ময়দানে। দ্বিগুণ দাম দিয়ে কিনে নিলেন ইলহাম বেনজিরকে, সাথে বিপক্ষ দলের গোপন সমস্ত তথ্য। কিন্তু ইলহাম জানতেন না তিনি খেলছেন আগুনের সঙ্গে। যে বিপক্ষ দলের কুকীর্তির খবর তিনি কিনেছিলেন তাদের পেছনে ছিল ভিয়েতনামের কুখ্যাত মাফিয়ারা। ইলহামের বিশ্বাসঘাতকতায় তারা ক্ষিপ্ত হয়। পরবর্তীতে তাকে আবার টাকায় কিনে নেয় তারা৷ তবে এবার শুধুই বিশ্বাস নয় জড়ানো হয় তাকে মাফিয়া গ্যাং ‘তাকবীর’-এর অন্ধকার জগতের অঙ্গ পাচার, কিডনি ব্যবসা—সবকিছুর দায় তার নামে জুড়ে দেওয়া হয় নীরবে। তাকবীর নিজেও তখন এসব কিছু জানত না।
‘তবু এখানেই শেষ নয়। ইলহাম বেনজির সেই শেষ ডিলটিও গোপনে ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন। কারণ সে অনেক আগেই বর্তমান মেয়রের হয়ে কাজ করতে শুরু করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে খেলার মোড় পাল্টে যায়। টাকার লোভের পাশাপাশি, ক্ষমতার লোভ চেপে বসেছিল তার মাঝে। নির্বাচনের ঠিক আগে সমস্ত প্রমাণ তিনি সরকারের কাছে জমা দেয়। জনসমক্ষে ফাঁস হয় এক কলুষিত রাজনৈতিক চক্রান্ত। ফলাফল নির্বাচনে জয়ী হয়নি কেউই। এবং সরকারের পক্ষ থেকে তাকে সাহসিকতার পদকের পাশাপাশি সেই পদ দেওয়া হয়। কিন্তু রাজনীতির মূল্য সবসময়ই রক্তে গোনা হয়। নিজের মোহে গড়া বিশ্বাসঘাতকতার জালে অবশেষে নিজেই বন্দী হন ইলহাম বেনজির। যে-ই রক্তের খেলায় সে মেতেছিল, সেই রক্তের খেলায় শেষ হয়েছিল তার অস্তিত্ব।
‘একদমে কথাগুলো বলে তাকবীর তাকাল এলিজাবেথের দিকে৷ এলিজাবেথ স্তব্ধ হয়ে মাথা নুইয়ে রেখেছে যেনো গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত৷ ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দুতে আটকে থাকা জড়বস্তু সে।
“এলোকেশী?”
‘তাকবীরের ডাকে সম্বিৎ ফিরে এলিজাবেথের। দু’হাতের কুয়াশাভরা আদলা দিয়ে মুছে নিল চোখের কোণে জমানো কান্নার চিকচিক জলরাশি। কান্না চেপে রাখা ভাঙা গলায় মৃদু শব্দে প্রত্যুত্তর করে,
“আমি ঠিক আছি।”
‘তাকবীর নিস্পৃহ চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,”তুমি ঠিক নেই এলোকেশী।”
“আমার মম কোথায়?”
“হয়তো ওরাই তোমার মাকে কোথায়ও লুকিয়ে রেখেছে।”
‘এলিজাবেথ ঠৌঁট গোল করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ছেড়ে দিল ভেতরের জমানো আক্ষেপ গুলো। ভালোভাবে চোখের পানি মুখে রুষ্ট গলায় বলল,
“ওই লোক তার কর্মের শাস্তি পেয়েছে। আমি বোকার মতো স্বার্থপরদের জন্য নিজের সংসারের অশান্তি সৃষ্টি করে রেখেছি। আমি গড়ে তুলবো আমার সংসার। আমি আবারও মা হবো, ফিরিয়ে দিবো আমার স্বামীকে সমস্ত অধিকার। আজ থেকে আমার স্বামী ছাড়া এই দুনিয়াতে আর কেউ নেই, কেউ না।”
“আর আমি?”
‘এলিজাবেথ তাকাল তাকবীরের কাতর চোখজোড়ায়,বলল,
“আপনি আপনার মতো সুখে থাকবেন৷”
‘তাকবীর গা ঝাকিয়ে হাসল,”তোমাকে ছাড়া আবার কিসের সুখ? আমার জীবনটা তো ততক্ষণই সুন্দর, যতক্ষণ তুমি আছো৷”
“আমি আপনাকে কখনো ভালোবাসেনি।”
“আমি তো ভেসেছি,খুব করে ভেসেছি।”
‘এলিজাবেথ নিঃশব্দে মুখ ফিরিয়ে রাখে। তাকবীর আর এগিয়ে যায় না। তার গভীর চোখ দুটো আশ্লেষে জরিয়ে রেখেছে তার এলোকেশীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত। বুক ফেটে কান্না আসে লোকটার। ধুলোপড়া মেঝেতে মৃগী রুগীর মতো ছটফট করতে করতে লোকটা বলল কত কাতর গলায়,
“এলোকেশী গো একটু চাইয়া দেখো না মোর পানে। সুস্থ, স্বাভাবিক একটা মানুষ যে পাগল হইয়া যাইতাছে তোমার লাইগা।”
‘এলিজাবেথ বসল তাকবীরের সামনে। কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল,”পাগল না, আপনাকে মারার হাতিয়ার তৈরি করছি আমি৷”
‘তাকবীর থমকালো,”মানে?”
“যেদিন সত্যটা বের হবে, যেদিন আমার হাতে মরবেন আপনি।”
‘তাকবীর জানতে চাইল না কিসের সত্য। উল্টে সে স্বাচ্ছন্দ্য বলল,”তোমার হাতে যে মৃত্যুও কবুল এলোকেশী। যেখানে তোমার এক চিলতে হাসিতে ক্ষত-বিক্ষত হয় হৃদয়,সেখানে মৃত্যু তো তুচ্ছ।”
‘এলিজাবেথ ধৈর্যচ্যুত আঁখিপল্লব বাঁকাল। হাসতে থাকে তাকবীর। নিদারুণ হাসতে হাসতে বলে,
“এই চাহনিতে মৃত্যু মঞ্জুর।”
‘এলিজাবেথ বাকরূদ্ধ। হঠাৎ তাকবীর খামচে ধরল এলিজাবেথের হাত। এতোকিছুর পরেও লোকটা কিভাবে নির্লজ্জের মতো অবলীলায় বলে দিল,
“চল, খুব দূরে পালিয়ে যায়। ভালো বাসতে হবে না, সাথে থেকো শুধু। দুনিয়ার সব সুখ এনে দিব আমি তোমায়।”
‘এলিজাবেথ ঝাড়ি মেরে সরিয়ে নিল হাত,”এমন ভাবে জ্বলাবো, সমস্ত ভালোবাসা পালাবে।”
‘তাকবীর আহত চোখে তাকাল এলিজাবেথের দিকে। ভাঙা কণ্ঠে বলল,
“ভালোবাসা পালানোর আগে জান চলে যাক।”
“ভালে থাকবেন।” উঠে ঘুরে দাঁড়ায় এলিজাবেথ, চলে যাওয়ার উদ্দেশ্য।
“বাঁচা মুশকিল করে দিয়ে ভালো থাকতে বলছ?”
‘থামল না এলিজাবেথ। এগিয়ে গেল মাঝারি আকৃতির দরজার কাছে। পিছন থেকে তাকবীর আবার বলে উঠল,
“তুমি সবই পারলে, পারলে না শুধু আমার হতে।”
‘এলিজাবেথ এবার থামল। পিছন ফিরে শীর্ণ স্বরে বলল,
“অপেক্ষা করা আর বিদায় দেওয়া দুইটাই খুব ভয়ংকর।”
“অপেক্ষা করতে বলছ, বাকি বিদায় দিতে?”
“আমি ওনাকে খুব ভালোবাসি।”
‘তাকবীর শব্দ করে হাসল। সে বোকা না। খুব সহজেই বুঝতে পারে এলিজাবেথ কিসের কথা বলছে। সে ঘন মাথা নাড়িয়ে বলল,
“হুম হুম। তুমি ভালোবাসো ওনাকে, আমি ভালোবাসি তোমাকে। এই পৃথিবীতে সবার ভালোবাসার পূর্ণতা থাকলেও এই অধমের নেই। যাও দিলাম তোমায় বিদায়। সুখি হও তুমি। আমার সকল সুখ খোদা তোমাকে দিক, তোমার সমস্ত দুঃখ খোদা আমাকে দিক। আমি ধ্বংসের আগুনে পুড়ি, তুমি খোলা বাতাসে মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াও, আমি দূর থেকে দেখে খুশি৷”
‘তপ্ত শ্বাস ফেলল এলিজাবেথ। বুকের ভেতর ভারি কিছু অনুভব করল। সে আবারও পা বাড়াতেই তাকবীর
স্বগোতক্তিতে বিরবিড়ালো,
“যে যেতে দেয়,একমাত্র সেই জানে। কতটা চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিয়ে যেতে দিতে হয়!”
‘এলিজাবেথ কয়েক কদম এগোতেই শোনা যায় ভারি পায়ের শব্দ। থমকে যায় এলিজাবেথের পা। শিরদাঁড়া বেয়ে গড়িয়ে পড়ল শীতল ঘাম। এই পদযুগলের আওয়াজ যে খুব চেনা। এলিজাবেথ ছুটে যায় তাকবীরের কাছে। জবুথবু হয়ে কাঁপছে গড়ন, থরথর করে কাঁপছে কণ্ঠস্বর,
“উমি মেরে ফেলবে আমাকে, এখানে এসেছি জানতে পারলে।”
‘তাকবীর চমকে উঠল। পদযুগলের শব্দ ঘনিয়ে আসছে বজ্রের মতো। তাকবীর তড়িঘড়ি ইশারা করল এলিজাবেথকে পর্দার আড়ালে লুকাতে। এলিজাবেথ একটুও সময় না নিয়ে ছুটে গেল সেখানে। গন্ধে তার গা গুলিয়ে উঠে। ডগডগে পায়ে কক্ষপথ ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়ল গ্যাংস্টার বস। রিচার্ডের সমুদ্র-নীল চোখে আগ্নেয়গিরির লেলিহান আগুন। প্রচণ্ড অপ্রতিরোধ্য ভাবে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। বজ্রনিনাদ কণ্ঠে গর্জে উঠল রিচার্ড,
“হোয়ার ইজ মাই ওয়াইফ?”
‘রিচার্ড চলে যাচ্ছিল। কিন্তু অর্ধেক পথ পেরোনোর আগেই খবর এলো এলিজাবেথ ম্যানশনে নেই। লোকেশন ট্র্যাক করে দেখল এলিজাবেথ এখানেই আছে । সঙ্গে সঙ্গে হিংস্র হায়েনার মতো ছুটে ফিরে এসেছে মুখভর্তি ধুলোঝড় আর চোখে মরুভূমির খরতপ্ত ক্রোধ নিয়ে।
‘তাকবীর শান্ত গলায় বলল,”শি ইজ নট হিয়ার।”
‘রিচার্ড দাঁতে দাঁত চেপে, কাঁপতে থাকা কণ্ঠে বলল,”দ্যাটস ফাকিং বুলশিট। আই নো শি ইজ হিয়ার। রেড, তুমি বের হবে নাকি আমি আসব?”
‘ধ্বংস, পাপ, ও পিশাচী প্রবৃত্তির মধ্যে আটকে পড়া এই নারী জানে তার নীরবতার মূল্য হতে পারে ভয়াবহ। এক মুহূর্তের দোলাচল শেষে তটস্থ হয়ে পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো এলিজাবেথ। রিচার্ড তীব্র ক্ষিপ্রতায় ঝাঁপিয়ে গিয়ে ধরে ফেলল ওকে। আঙুলের নিঃসংশয় চাপে এলিজাবেথের বাহুতে গভীর ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা অসহায় অশ্রু। তাকবীর আর থাকতে না পেরে এক পা বাড়াতেই রিচার্ড হুংকার দিয়ে উঠল,
“ওখানেই দাঁড়িয়ে থাক!”
‘তাকবীর থমকে যায়। রিচার্ডের রাগে গাঢ় তামাটে গাত্রচর্মের শিরাগুলো ফুলে উঠেছে। প্রতিটি শিরায়, শিরায় বারুদের উত্তেজনা। অকুতোভয়ী হৃদয়ে গড়া এলিজাবেথ তার আগুনমাখা দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে যাচ্ছে একটি নাজুক পাখির মতো। রিচার্ড হঠাৎই খামচে ধরল ওর চুলের মুঠি। হিংস্র জন্তুর মতো গর্জে উঠল,”ছলনা? আবারও ছলনা!”
“তুই ভুল বুঝছিস ওকে।”
“চুপ!”এক নিমেষে পকেট থেকে রিভলভার বের করে তাকবীরের দিকে তাক করে তাকে থামিয়ে দিল রিচার্ড। এলিজাবেথ টনটনে যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠে। রিচার্ড এবার ওর চোয়ালে হাতের চাপ বাড়াতে বাড়াতে ফের গর্জে উঠল,
“বলেছিলাম, এই মনে আমি ছাড়া অন্য কারোর জায়গা নেই!”
‘ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে, ক্লান্ত ও ভগ্নস্বরে এলিজাবেথ বলল,
“কেউ নেই আপনি ছাড়া। বিশ্বাস করুন।”
‘রিচার্ড থেমে গেল। এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। তারপর ঠোঁটে বিদঘুটে হাসি টেনে রিভলভারটা এলিজাবেথের হাতে গুঁজে দিয়ে তাকবীরের দিকে ইঙ্গিত করে বলল,
“শুট হিম। প্রমাণ দাও, তোমার হৃদয়ে আমি ছাড়া আর কেউ নেই।”
‘এলিজাবেথ থমকে যায়। কণ্ঠ কেঁপে ওঠে,”কি বলছেন আপনি?”
‘রিচার্ডের চোখে আবার জ্বলে উঠল আগুন। পশুত্বের ঘনঘটা নেমে এলো তার চেহারায়। হুংকার তুলে বলল,
“হয় আজ তাকে মারতে হবে, নয় মরতে হবে।”
‘এলিজাবেথের হাত কাঁপছে থরথর করে। তার সামনে এখন দুই ছিন্নমস্তক সম্ভাবনা। ভেজা দৃষ্টিতে তাকাল তাকবীরের দিকে। তাকবীর চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে তার দিকেই তাকিয়ে। চোখে কোনো ভীতি নেই, কোনো অভিযোগ নেই। বরং গ্রহণযোগ্যতার এক অপার্থিব প্রশান্তি। সে নির্বিকাল উদ্ভাবনী উদ্ভাসিত নয়নে এলিজাবেথের দিকে তাকিয়ে থেকে মুক্ত পাখির মতো দু-হাত মেলে বুক বাড়িয়ে দিল। এলিজাবেথের চোখ বেয়ে কান্না গড়িয়ে পড়ছে। হাতের রিভলভারটাও যেন কয়েকশো কেজি ভারী হয়ে উঠেছে। ফুঁপিয়ে উঠল হঠাৎ করেই। রিচার্ড আবার গর্জে উঠল,
“আই সেইড শুট হিম!”
‘ঠাস! ঠাস! ঠাস! নিস্তব্ধতা। ধোঁয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে এলিজাবেথ। হাত এখনও কাঁপছে। তাকবীর চোখ খুলে অবিস্মরণীয় চোখে তাকাল এলিজাবেথের দিকে, পরপর তাকাল ছড়িয়ে, ছিটিয়ে থাকা ভাঙা কলসির দিকে। ক্রোধে মটমট করে উঠল রিচার্ডের চোয়াল। এগিয়ে এসে এলিজাবেথের হাত খামচে ধরে৷
“কাম অন বেবিগার্ল, ইউ আর লস্ট।”
‘এলিজাবেথ’কে টেনে নিয়ে যেতে চাইলে ছুটে যায় তাকবীর। সে যে বুঝতে পারে, তার এলোকেশী কত বড় ভুল করে ফেলেছে, এর পরিণতি কতটা ভয়াবহ হবে সে জানে৷ তাকবীর জাপ্টে ধরল রিচার্ডের পা। অর্গগল বলতে থাকে,
“ওকে কিছু করিস না। ও আমার জন্য আসেনি এখানে।”
‘আজ প্রথমবার নিজের রক্তকে স্বীকার করল তাকবীর।রিচার্ডের পা দু’হাতে জাপটে ধরে আকুল কণ্ঠে বলে,
“ভাই… আমি তোর বড়, তোর বড় ভাই আমি।
হার মানলাম এই দ্বন্দ্বে। তোর পায়ে পড়ি আমার এলোকেশীকে কিছু করিস না। আমি মরে যাবো যে। শুধু এই মুখটা দেখার আশায়ই তো বেঁচে ছিলাম এতদিন।”
‘এলিজাবেথ নিঃশ্বাস আটকে রেখেছে। রিচার্ড শক্ত চোয়ালে পা ছাড়াতে চাইছে। তাকবীর চারদিকের দেয়ালে আঘাত করে কাঁপা কণ্ঠে চিৎকার করছে,
“কে কোথায় আছো, বাঁচাও আমার এলোকেশীকে!
জানোয়ারটা ওকে মেরে ফেলবে আমার এলোকেশীকে৷ ইয়া রব, বাঁচাও আমার এলোকেশী’কে! আমায় এমন কঠিন মৃত্যু দিয়ো না খোদা!”
‘রিচার্ড এক লাথিতে তাকবীরকে সরিয়ে দেয়। হনহনিয়ে টেনে নিয়ে যায় এলিজাবেথ’কে। ভিতর থেকে ছুটে আসে গার্ডরা। তারা চেপে ধরে তাকবীরকে। কিন্তু থামাতে পারে না তার কান্না,
“ভাই তোর পায়ে পড়ি আমি! আমি আর আসবো না তোদের মাঝে। এই তাকবীর আর কখনো ডাকবে না তার এলোকেশীকে।মেয়েটা খুব কোমল। ওকে মারিস না। ওকে ছেড়ে দে পায়ে পড়ি তোকে।”
‘ক্ষীণ হয়ে আসে তাকবীরের কণ্ঠস্বর। গার্ড’রা তাকবীরের পিঠে হাঁটু বসিয়ে তাকে চেপে ধরে রেখেছে। বিচ্ছেদের গুমরে ওঠা স্বরে তাকবীর মেঝেতে হাত দিয়ে চাপড়াতে থাকে আর বলে,
“আমাদের সংসার হলো না গো এলোকেশী। এই দুনিয়া আমাদের একসাথে সংসার করতে দিলো না।”
‘আশেপাশের সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। শিথিল হতে থাকে ভাঙাচোরা শরীর। দাঁড়ি যুক্ত গাল লেপ্টে যায় ধুলোর সাথে। লম্বা, লম্বা শ্বাসের সাথে ধুলো যাচ্ছে মুখগহ্বরে। সে অবিরাম বলতে থাকে,
“ঘৃণা করি আমি এই দুনিয়া, ঘৃণা করি আমি আমার নিষ্ঠুর নিয়তিকে। ঘৃণা করি আমার সেই ভাগ্য’কে, যে-ই ভাগ্যে আমার এলোকেশী নেই।”
‘হ্যালুসিয়েশন হতে থাকে তাকবীরের। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সাদা কাফনে মোড়া একটা লাশ। সেই নরপিশাচ মেরে ফেলেছে তার এলোকেশীকে। কাঠের খাঁটিয়া করে নিয়ে যাচ্ছে তার এলোকেশী’কে সফরে রঙা পাঞ্জাবী পরা কিছু লোকজন। তাকবীর হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাই, সে ছুঁতে পারে না। তার চোখের সামনে ক্ষীণ হয়ে আসে আলো। চোখ বুজবার আগে সে শুধু বিরবিরিয়ে গেয়েছিল,
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬০ (২)
“কোন ভুলে তুমি শুলে বল
এই ফুলসজ্জায়
স্বপ্নের লাশ কাঁধে নিয়ে
ওরা কেন চলে যায়,,?”