ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৪

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৪
তাজরীন ফাতিহা

আজকে তিনদিন পর স্কুলে যাচ্ছে নিশাত। তিনদিন মারওয়ান যথেষ্ট খেয়াল রেখেছে তার। আজকে একটু স্বাভাবিক হয়েছে সে। এতদিন মানসিক একটা ট্রমার মধ্যে ছিল। সেদিনের কথাগুলো হজম করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তবে আল্লাহর অশেষ রহমতে নিশাতকে এই কয়দিন পূর্ণ সাপোর্ট দিয়েছে মারওয়ান আজাদ নামক বিড়ি’খোরটা। তার এই রূপ ভীষণ অবাক করেছে নিশাতকে। এবার বুঝি লোকটা একটু মানুষ হবে। রান্নাবান্না সারতে সারতে এসবই ভেবে চলছে নিশাত। আল্লাহ যদি তাকে সংসারের প্রতি এবার একটু মনোযোগী করে তাতেই আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া।
মারওয়ান আজকে ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠেছে। উঠেই বিড়ি টানা শুরু করে দিয়েছে। কয়েকদিন বিড়ি টানতে পারেনি এই শোকে আজকে আরও কয়েকটা বিড়ি বেশি টানবে বলে পণ করেছে। নিশাত রুমে ঢুকে মারওয়ানকে আয়েশ করে বিড়ি টানতে দেখে অবাক হয়ে তাকালো। মারওয়ান নিশাতকে এরকম হা হয়ে তাকাতে দেখে বললো,

“কি হলো? খাবে?”
হাতের সিগারেট নিশাতের দিকে বাড়িয়ে বললো। নিশাত মুখ কুঁচকে বললো,
“আপনার গায়ে কি আবারও ইবলিশ ভর করেছে?”
মারওয়ান নিজেকে ভালোভাবে দেখে বললো,
“কই না তো। তুমি দেখতে পাচ্ছো?”
নিশাত হাত ভাঁজ করে বললো,
“দেখতে পাওয়া লাগবে কেন? যার গায়ে শয়তান ভর করে সে খারাপ কাজ বেশি বেশি করে এতেই বোঝা যায় ভর করেছে নাকি করেনি।”
মারওয়ান হাতের ফাঁকে সিগারেট গলিয়ে মুখ থেকে ধোঁয়া ছেড়ে আয়েশ করে বললো,
“কি জানি। অতো হাদিস জানি না আমি। তুমি স্কুলে যাচ্ছো? যাও, সাবধানে যাবে কেমন।”
নিশাত হতাশ হলো প্রচুর। এই লোক ভালো হওয়ার নয়। ভেবেছিল বোধহয় ভালো হয়ে গেছে এখন দেখি আবার বিড়ি টানতে লেগে গেছে। তাহলে এই কয়দিন ঢং করছিল তার সাথে। সে বেশ শান্ত স্বরে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আপনি কি কাজবাজ কিছুই করবেন না?”
মারওয়ান খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে বললো,
“আসলে কাজ করতে আইলসেমি লাগে। যেদিন আইলসেমি কমবে সেদিন কাজ করবো পিংকি প্রমিজ।”
নিশাতের আর কথা বলতেই ইচ্ছে হলো না। ছেলেকে উঠাতে লেগে গেলো। তার ছানাকে খাইয়ে সে স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হবে। নাহওয়ানকে উঠিয়ে হাত মুখ ধুইয়ে দিলো নিশাত। বাচ্চাটা মাকে আকড়ে ধরে আছে। মুখ ধুয়ে এসে বাবাকে বসে থাকতে দেখে মায়ের কোলে থেকেই বললো,

“উইত্তো বাবা।”
বলেই ছোট্ট ছোট্ট দাঁত বের করে হাসলো। মারওয়ান ছেলেকে দেখে নজর সরিয়ে ফেললো। বাচ্চাটা বাবাকে চোখ সরিয়ে ফেলতে দেখে মুখ চুপসে ফেললো। বাবার দিকে চেয়ে কানে হাত দিয়ে ডলতে লাগলো। নিশাত ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো,
“নাস্তা খাইয়ে দিবো আব্বা?”
নাহওয়ান বাবার দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে এখনো। বাবা তাকে দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো কেন? বিষয়টা বাচ্চা হৃদয়ে আঘাত এনেছে। নিশাত ছেলেকে মারওয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেঁটে মারওয়ানের কাছে গেলো। বললো,
“ছেলেকে ধরুন।”
মারওয়ান হামি দিয়ে বললো,
“পারবো না। কোলে নিতে আইলসেমি লাগছে।”
নিশাত বললো,

“আমার স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে। আপনার এসব আলগা ঢংয়ের আলাপ অন্য কোথাও করবেন। আসছে ডায়লগ দিতে আইলসেমি লাগছে।”
বলেই ছেলেকে মারওয়ানের কোলে দিয়ে দ্রুত হেঁটে চলে গেলো। নাহওয়ান মায়ের যাওয়ার দিকে চেয়ে মাথা ঘুরিয়ে বাবার দিকে চাইলো। মারওয়ানও তার দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। বাচ্চাটা অবুঝের মতো বাবার দিকে চেয়ে আছে। মারওয়ান ভ্রু কুঁচকে রেখেই বললো,
“তুই যেভাবে ইনোসেন্ট মুখ করে থাকিস তুই তো এতো ইনোসেন্ট না পটলের বাচ্চা।”
বাচ্চাটা বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“পুটল কি?”
“জানি না। তোর সাথে রাগ করেছি।”
“লাগ কচ্চো?”
“হ্যাঁ।”
“কেনু?”
“তুই মাকে খুঁজিস শুধু, বাবাকে তোর কি দরকার?”

নাহওয়ান মাথা চুলকে বাবার শরীর বেয়ে উঠে ঘাড়ে মাথা ফেলে গলা জড়িয়ে ধরলো। মারওয়ান কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি খেলে গেলো তার। এটা তার বাচ্চা। ভেবেই জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। নাহওয়ান বাবার ছোঁয়া পেয়ে আরো সেটে গেলো। মারওয়ান ছেলেকে জড়িয়ে রেখেই বললো,
“এই বয়সেই ব্রিটিশ বুদ্ধি নিয়ে চলিস। কিভাবে বাপ, মাকে পটাতে হয় ভালো করে জানিস লিলিপুটের বাচ্চা।”
নাহওয়ান ফিচফিচ করে হেঁসে দিলো। মারওয়ান ছেলের নাকে নাক ঘষে আদর করে দিলো।

সকাল থেকেই ইহাব এবং ইমতিয়াজ ভুঁইয়া খুবই খোশমেজাজে আছে। গুরুত্বপূর্ণ খবর ইমতিয়াজ ভুঁইয়া ইহাবের পছন্দকে হ্যাঁ জানিয়েছেন। ইহাব বাবাকে ঠিক কি বলে রাজি করিয়েছে সেটা অজানা সকলের। খবরটা শুনে ভুঁইয়া বাড়ির একমাত্র কন্যা ইনাবা ভুঁইয়া শহর থেকে ব্যাগপত্র সবকিছু নিয়ে হাজির হয়ে গেছে। এসেই চিল্লাচিল্লি জুড়ে দিয়েছে সে। মায়ের কাছে গিয়ে বললো,
“আমার কি এই বাসায় কোনো গুরুত্ব নেই আম্মু? কিভাবে পারলে আমাকে ছাড়া ভাইয়ের জন্য পাত্রী পছন্দ করতে?”
উর্মি ভুঁইয়া গম্ভীর গলায় বললেন,
“এসব নিয়ে আমার সাথে উচ্চশব্দ করবে না। তোমার বাপ, ভাইকে জিজ্ঞেস করো গিয়ে। এসব সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। এসেছো রেস্ট নাও তবে খবরদার আমার সাথে এসব বিষয়ে কথা বলবে না। যাও হাত মুখ ধুয়ে রেস্ট নাও।”
বলেই পাশকাটিয়ে চলে গেলেন। ইনাবা হতবাক হলো কিছুটা। মায়ের এমন নির্লিপ্ততা তাকে ভাবাচ্ছে। সে দ্রুত গিয়ে বাবাকে বললো,

“পাপা কাহিনী কি? তুমি ফোন দিয়ে বললে ভাইয়ের জন্য পাত্রী দেখতে যাবে কিন্তু আম্মুর কোনো হেলদোল নেই কেন? ঘটনা কি?”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া হতাশ ভঙ্গিতে বললেন,
“তোমার আম্মুর সাথে ইহাবের পাত্রী দেখা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছে। যেই সেই কথা কাটাকাটি না একেবারে ভাংচুর করেছি। রাগ উঠেছিল প্রচুর। তোমার মায়ের সাথে তো চাইলেও রাগারাগি করতে পারিনা কিন্তু সেদিন মারাত্মক রাগ উঠে গিয়েছিল। কন্ট্রোল করতে পারিনি। সেইদিন থেকে এখনো একটা শব্দ আমার সাথে বলেনি তোমাদের আম্মু।”
ইহাব এবং ইনাবা উভয়ই হতাশ হলো। ইনাবা বাবার পাশে বসে বললো,
“এবার তুমি গেছো পাপা। তোমার ওরকম করার কি দরকার ছিল? আম্মুর রাগ সম্পর্কে তোমার ধারণা নেই? এখন কিভাবে আম্মুর রাগ ভাঙাবে দেখো?”
বলেই ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার গলা জড়িয়ে গালে চুমু দিয়ে উপরে চলে গেলো ব্যাগপত্র নিয়ে। ইহাব বাবার দিকে তাকিয়ে দুঃখী দুঃখী নজরে চেয়ে বললো,

“সো স্যাড পাপা।”
“তোমার জন্যই তো হলো এতো কিছু। তোমার প্ল্যানের কথা আগে জানলে নিশ্চয়ই আমি ভিমরুলের বাসায় ঢিল ছুড়তাম না।”
ইহাব মাথা নাড়িয়ে বাবাকে সহমত জানালো। স্বীকার করে নিলো দোষটা তারই। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া খুবই সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন,
“মেয়ে দেখতে কবে যাবো?”
“খুব শীঘ্রই গেলে ভালো হয় পাপা। এখন বাকিটা তোমার মন মর্জি। মেয়ের আবার পাত্রের অভাব নেই। যেকোনো সময় বিয়ে হয়ে যেতে পারে তাই আগেভাগেই আকদটা করিয়ে ফেললে ভালো হতো।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া বললেন,
“আচ্ছা ব্যাপারটা দেখছি আমি।”
“হ্যাঁ পাপা। প্ল্যান অনুযায়ী আগাতে হবে। এমনভাবে সবকিছু করবে যেন কেউ ধরতে না পারে আমরা কোনো নাটক করছি।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া ক্রুর হেঁসে বললেন,
“ওসব তোমাকে ভাবতে হবে না। নিশ্চিন্তে থাকো। সব সামলে নিবো। তাছাড়া চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে সম্বন্ধ যাচ্ছে কার সাধ্যি তা ফিরিয়ে দেয়।”

নিশাত স্কুলে যাওয়ার পর ছেলেকে নিয়ে তৈরি হয়ে বাসা থেকে বের হলো মারওয়ান। নাহওয়ান বাবার গলা জড়িয়ে আছে। মারওয়ান একটা গোডাউনের মতো জায়গায় এসে দাঁড়ালো। আশেপাশে নজর বুলিয়ে মাস্ক ঠিকঠাক করে নিলো। নাহওয়ানকে নিয়েই গোডাউনের ভিতরে ঢুকে পড়লো। বেশ কিছুক্ষণ পর ধীর পায়ে হেঁটে গোডাউন থেকে বের হয়ে এলো। কোলে বাচ্চাটা ঘুমিয়ে আছে। মারওয়ান ছেলেকে ঢেকে ওখান থেকে চলে গেলো।
বাসায় এসে ছেলেকে বিছানায় রেখে কিছু কাগজ কলম নিয়ে বসলো মারওয়ান। অনেকক্ষণ ধরে কি যেন আঁকাবুকি করলো। তার চেহারায় অসম্ভব রহস্য খেলা করছে। চোখ দুটো সংকীর্ণ হয়ে আছে। চোখের পাতা আন্দোলিত হচ্ছে। তারপর একসময় তার চেহারা স্বাভাবিক হয়ে গেলো। সে চুপচাপ জিনিসপত্র গুছিয়ে গোপনীয় স্থানে সবকিছু রেখে দিলো।
ছেলেকে দেখে গোসল করতে চলে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ গোসল সেরে বের হলো। নাহওয়ান উঠে গেছে। উঠেই কাউকে না দেখতে পেয়ে কান্না জুড়ে দিয়েছে। মারওয়ান ধীর পায়ে হেঁটে বললো,

“কি হলো?”
নাহওয়ান বাবার কণ্ঠ শুনে বিছানার উপর দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বললো,
“বাবা নাই।”
“এইতো বাবা।”
বলেই ছেলেকে কোলে নিলো। বাচ্চাটা বাবাকে পেয়ে কোলের মধ্যে গুটিয়ে গেলো। মারওয়ান গম্ভীর নয়নে চেয়ে আছে। কি যেন ভাবছে সে। বোঝা বড়ই মুশকিল। তাকে দেখলে যে কেউ অবাক হবে কারণ আগের মারওয়ানের সাথে এই মারওয়ানের বিস্তর ফারাক। সেই মারওয়ান ছেলের সাথে চঞ্চল আর এই মারওয়ান এতোটাই গম্ভীর যে মুখাবয়ব শক্ত কঠিন হয়ে আছে। নাহওয়ান বাবাকে ডাকলো,
“বাবা, বাবা।”
“জ্বিই।”
“কিডা লাগচে। কাবো।”
মারওয়ান ভাবনা থেকে বেরিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো,
“ভাত খাবি?”
নাহওয়ান ঘাড় নাড়িয়ে বললো,
“কাবো।”
ছেলের কথা শুনে মারওয়ান ভাবনাচিন্তা বাদ দিয়ে বললো,
“আগে গোসল করিয়ে দেই তারপর ভাত খাওয়াবো। চল।”

বলেই ছেলেকে নিয়ে গোসলে ঢুকলো। গোসল শেষে গায়ে বেবি লোশন মেখে দিয়ে ভাত বেড়ে নিলো। ছোট্ট ছোট্ট লোকমা তুলে খাইয়ে দিতে লাগলো। বাচ্চাটা পা ছড়িয়ে বসে খাচ্ছে চুপচাপ। মারওয়ান ছেলেকে খাইয়ে খেলনাপাতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলো। বাচ্চাটা খেলনা পেয়ে খেলতে লাগলো। মারওয়ান কিছু সরঞ্জাম নিয়ে অন্যরুমে চলে গেলো।
দরজায় টোকা পড়ায় মারওয়ান কিছুটা হকচকালো। হাতের কাজ বন্ধ করে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখলো। তারপর স্বাভাবিক হয়ে গেট খুলে দিলো। নিশাত দাঁড়িয়ে। নিশাত মারওয়ানকে দেখে কিছু বললো না এমনকি মারওয়ানও কোনো টু শব্দ করলো না। নিশাত চুপচাপ হেঁটে ঘরে ঢুকলো। বিরক্ত লাগছে তার সবকিছু। ব্যাগ রেখে স্কুলের পরীক্ষার খাতা টেবিলে রাখলো। মারওয়ান আজকে কিছু বলছে না। নিশাতও আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেনি।
নামাজ পড়ে দোয়া দুরুদ পড়ে উঠলো নিশাত। আজকে ঘরে কোনো আওয়াজ নেই। এরকম শান্ত কেন আজকে? তার ছানা আজকে কথা বলছে না তেমন। প্রতিদিন তো বাবা ছেলের কথোপকথনে ঘর মুখরিত থাকে আজকে এতো শান্ত কেন সবকিছু? মারওয়ানেরও সাড়া শব্দ নেই। নিশাত জায়নামাজ ভাঁজ করে পাশের রুমে গিয়ে দেখলো বাবা ছেলে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশাত আর ডাকলো না। খেয়েই ঘুমিয়েছে তার মানে। এসব ভেবে নিশাত খেয়ে নিলো। তারপর বিশ্রাম নিতে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ইস্তেগফার, দরুদ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেলো।

আসরের আজানের মধুর কণ্ঠে ঘুম ভেঙে গেলো নিশাতের। এখন একটু ফ্রেশ লাগছে। মন খারাপ থাকলে আল্লাহকে ডাকলে আল্লাহ বান্দার মন খারাপ খুব দ্রুতই ভ্যানিশ করে দেন বলে নিশাতের ধারণা। আজকে তার মন ভীষণ খারাপ ছিল। সংসার জীবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেজায় চিন্তিত ছিল সে। বাবা ফোন দিয়েছিল তাকে আজ।
বহুদিন পর বাবার ফোন পেয়ে নিশাত আপ্লুত হয়ে পড়েছিল। ফোন ধরতেই বাবার কণ্ঠস্বর শুনে জরজর করে কেঁদে দিয়েছিল সে। স্কুলের অফিস কক্ষে তখন কেউ ছিল না। বাবা নাসির উদ্দিন মেয়ের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছেন আজ। মেয়েকে আজও এই অলস, অকর্মা পুরুষের সংসার ছেড়ে আসতে বলেছেন। নিশাতকে সে পালতে পারবে বলে অনেক বুঝিয়েছেন। কিন্তু নিশাত কোনো প্রতিউত্তর করেনি। মায়ের সাথেও কথা বলেছে। তবে সবার এক কথা ছিল যদি মারওয়ান এরকমই থাকে তাহলে ঐ কাপুরুষের সংসার করার কোনো প্রয়োজন নেই।

নিশাত কিছু বলেনি শুধু শুনে গেছে। একটা ডিভোর্সি মেয়েকে এই সমাজ কি চোখে দেখে তা নিশাত ভালো করেই জানে। তাই তাদের কথায় সায় জানাতে পারিনি সে। আল্লাহ চাইলে মারওয়ান একদিন ভালো হবে। এটা তার দৃঢ় বিশ্বাস। ওই পুরুষটা আর যাইহোক তাকে কখনো আঘাত করেনি। তার ছেলের যত্ন করে, আগলে রাখে শুধু কাজই করতে আগ্রহী নয়। তার কাজের প্রতি প্রচুর অনিহা। এই অনিহার কারণ নিশাত জানে না। কেন তার এই অনাগ্রহ? কাজের প্রতি এতো বিতৃষ্ণা কেন এই পুরুষের?
নিশাত উঠে ওযু করে আসরের নামাজ পড়ে নিলো। পাশের রুমে গিয়ে দেখলো ছেলে, ছেলের বাপ কেউই বাসায় নেই। নিশাতের কপাল কুঁচকে গেলো। কোথায় গেছে এই সময়ে?
একটু পর দরজা খুলে মারওয়ান ঘরে ঢুকলো। বাচ্চার হাতে চিপস, চকলেট। নাহওয়ান মাকে দেখে হাতের চিপস, চকলেট দেখিয়ে মাথা নাড়িয়ে বললো,

“মুজা মুজা।”
নিশাত হেঁসে বললো,
“খান মজা।”
মারওয়ান ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে দিতেই বাচ্চাটা সবকিছু নিয়ে অন্যরুমে দৌঁড়ে চলে গেলো। নিশাত মারওয়ানের দিকে ভ্রু ভাঁজ করে চাইলো। মারওয়ান নিশাতের চাহনি দেখে বললো,
“কি?”
“আপনাকে অস্বাভাবিক লাগছে আজকে।”
“কই? আমি ঠিক আছি। চোখে সমস্যা তোমার।”
“আমার চোখ তো মিথ্যা বলে না। আমার দৃঢ় সন্দেহ আপনার মনে কোনো কিছু চলছে সেটা অবশ্যই জটিল কিছু।”
মারওয়ান কিছুটা চমকালো। পরক্ষনেই স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“তোমার ভুল ধারণ এটা।”
“উহু, ঠিক ধারণা।”
মারওয়ান রেগে তাকিয়ে বললো,

“আজাইরা কথা বলবি না। রাগ উঠাস কেন সবসময়? যতই ভালো বিহেভ করতে চাই ততই মেজাজ গরম করিয়ে দিস।”
নিশাত মারওয়ানের এই কথায় টললো বলে মনে হয়না। হাতের জিনিসটা মারওয়ানের সামনে ধরে বললো,
“আপনার কাছে এসব কি করে?”
মারওয়ান জিনিসটি দেখে ঘেমে উঠলো। কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“এটা কোথায় পেয়েছো?”
“আপনাকে আমার যথেষ্ট সন্দেহ হয়। এর আগেও আমি রুমে অস্বাভাবিক অনেক কিছুই দেখেছি। ওসব আমার বাসায় থাকার প্রশ্নই আসে না। আপনি কি করছেন লুকিয়ে লুকিয়ে সত্যি করে বলুন?”
মারওয়ান কিছুই বললো না। শান্ত কণ্ঠে বললো,
“এটা ছেলের জন্য এনেছি। ওর পিস্তল ভালো লাগে বলেছিল একদিন তাই আজকে একজন আর্টিস্টকে দিয়ে আঁকিয়ে এনেছি। এতো রিয়েক্ট করার কি আছে? এটা নাটক, সিনেমা না যে আমি বিরাট কিছু বের হবো। আমি অকর্মা অকর্মাই থাকবো। তবে তোমার যদি আমাকে নিয়ে উচ্চভিলাষী জল্পনা কল্পনা করার থাকে তাহলে যেকোনো কিছুই ভাবতে পারো। I don’t care.”

বলেই নিশাতের পাশ কেটে চলে গেলো। নিশাতের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করলো না কিন্তু অবিশ্বাস করতেও ইচ্ছে হলো না। নিশাত তো ঘরেই থাকে স্কুল বাদে। কই মারওয়ানকে তো তেমন অস্বাভাবিক লাগে নি কখনো? সারক্ষণ রুমে বসে সিগারেট টানে। তবে রাতে বাইরে বেরোয় কয়েক ঘণ্টার জন্য এটুকু সময়ের মধ্যে কিছু করা সম্ভব? নিশাত জানে পার্ট টাইম যে জব করতো ওটা ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ওটা ছেড়ে আবার কোনো কাজ ধরেছে কিনা সেটা নিশাত জানে না। নিশাতকে কিছুই বলেনি। কই ঘরের কোনো সওদাপাতির খরচ, বাসা ভাড়া কিছুই তো দেয়না। সিগারেট, ছেলের চিপস, চকলেটের খরচ আর বাসা ভাড়া তো শশুর আব্বাই দেন। কাজ যদি করতো তাহলে নিশ্চয়ই এসবের খরচ আব্বার কাছ থেকে নিতো না? ধুর উল্টাপাল্টা বেশিই ভেবে ফেলেছে সে। হয়তবা ছেলের জন্যই এটা এনেছে। তাই বেশি কিছু আর না ভেবে এটা টেবিলের উপর ভাঁজ করে রেখে দিলো। এসব নিয়ে ভাবার সময় তার নেই। আজাইরা চিন্তাভাবনা তার যত্তসব!

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৩

সকাল সকাল মাহবুব আলমের বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন চেয়ারম্যান ইমতিয়াজ ভুঁইয়া। খবরটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় নিলো না। মাহাবুব আলম কথা বলতে ভুলে গেছেন প্রায়। সে উঠোনের মাঝখানে চেয়ারে বসা ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার দিকে থতমত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন। মাহদী, মাহফুজ একপাশে বিব্রত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মায়মুনা বেগম ঘরের পর্দার ফাঁক দিয়ে সব কিছু দেখছেন। মানহা শক্ত হয়ে বসে আছে।

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৫