শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১৪
নূরজাহান আক্তার আলো
-‘আমার নামে নালিশ, হুম? চল একবার, বিপদের চৌরাস্তা থেকে যদি ঘুরিয়ে না আনি তো আমার নামও শুদ্ধ নয়।’
একথা বলে শুদ্ধ ঠোঁটে বাঁকা হাসি এঁটে ধীরে সুস্থে সিঁড়ি বেয়ে নামল।
সারা বাড়ি স্তব্ধ। হয়তো গভীর ঘুমে মগ্ন বাড়ির প্রতিটা সদস্য। ড্রয়িংরুম জ্বলজ্বল করছে কৃত্রিম আলোর ঝলকানিতে। গা ঝকঝকে আসবাবও চোখ কাড়ছে খুব সহজে। রাত বিরাতে ছেলে-মেয়েরা কখন পানি খেতে আসে বলা যায় না। অন্ধকারে যাতে ভয় না পায় তাই লাইটটা সারারাত জালানোই থাকে। তাছাড়া শখ একবার আঁধারে পড়ে গিয়েছিল তারপর থেকে শারাফাত চৌধুরীর আদেশে কেউ লাইট অফ করে না।
এতরাতে কারো দেখা পাবে না জেনেই মূলত বাইরে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিল শুদ্ধ। ইচ্ছে ছিল নতুন ল্যাব’টা ঘুরে আসা। সেখানকার কাজকর্ম কতদূরএগোলো দেখা দরকার। কিন্তু আজ আর যাওয়া হবে না বোধহয়। কারণ যাওয়ার আগে দেখা মিলল ব্যাঙাচির সঙ্গে। সে কি আর জানত ব্যাঙাচি দিনের মতো মধ্যেরাতেও টইটই করে ঘুরছে। একা একা প্লেট হাতে করে কিসব খেয়ে বেড়াচ্ছে। তাকে নিয়ে তো আর ল্যাবে যাওয়া যায় না। যদি নিয়ে যায় প্রশ্ন করতে করতে আধ’ম’রা করে ফেলবে? আধ’ম’রা হলেও ছাড় দেবে বলে না মনে না। বরং পাশে বসে ঘ্যানঘ্যান করবে, ‘ এই শুদ্ধ ভাই আধমরা কেন হলেন? এক্কেবারে শহীদ হলেও তো পারতেন।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শীতল একটু ঘাড়ত্যাড়া একথা তারও অজানা নয়। তাদের দাদীজান’ও এমন ছিল। শীতল চেহারাও পেয়েছে দাদীর মতো’ই। তার চেহারাখানা নাকি মন শীতল করার মতোই তাই দাদাজান নাম রেখেছিলেন ‘শীতল।’
তবে তার ভাষ্যমতে এটা মস্ত বড় ভুল করেছেন দাদাজান। কারণ স্বভাব ও চাল-চলন অনুযায়ী তার নাম রাখা উচিত ছিল; মাথা মোটা ব্যাঙাচি।চৌধুরী নিবাসে তারা মোট সাত ভাই-বোন। ছোটো ভাই-বোনরা সায়নের তুলনায় তাকে একটু বেশিই ভয় পায়। কিছু বললে মাথা তুলে তাকানোর সাহস করে না। বকলে কেঁদে কেটে একাকার তো করেই। এবং দূরে দূরে থাকারও চেষ্টা করে। অথচ ব্যাঙাচিকে কিছু বললে চোখ উল্টে তাকায়। একটু বকলে/মারলে সেই রেশ ধরে সুযোগ বুঝে শোধ তোলারও প্রচেষ্টা চালায়৷ যদিও শোধ নিতে পারেনি এখন অবধি। হয় ঘটনাটাই ভুলে যায় নতুবা চ্যালাকাঠের মারের ভয়ে নিজেকে দমিয়ে নেয়।
তবে কথা দিয়ে দু’একটা খোঁচা মারতে ভুল করতে না। তবে আজ একটা শিক্ষা দিলেও মন্দ হয় না। এমনিতে তার মর্জিমতো উড়ে-উড়ে, ঘুরে-ঘুরে, বেড়ানোর পনিশমেন্ট পাওনা রয়েছে। ধার রাখা কিংবা ফেলে রাখা কাজ একদমই পছন্দ নয় তার। সুযোগ যখন এসেছে’ই সুযোগ কাজে লাগানো যাক। সে এসব ভাবতে ভাবতে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত বাজে একটা।ল্যাবে শুকনো খাবার থাকায় কাজের ফাঁকে ফাঁকে সেসব’ই খেয়েছিল।
কিন্তু গোসলের পর ক্ষুধা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এখনই কিছু খাওয়া দরকার। এসব ভেবে হাতের হেলমেট চৌকো আকৃতির কাঁচের সেন্টার টেবিলের উপর রাখল। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল কিচেনের দিকে। ফ্রিজ খুলে দেখল পছন্দসই কিছু আছে কি না। গরুর মাংস আর ভাত দেখে সেটাই বের করল। তারপর ওভেনে গরম করে খাবার প্লেটে বেড়ে নিয়ে নিঃশব্দে চেয়ার টেনে খেতে বসল। প্রথম লোকমা মুখে পুরে বুঝল এই রান্নাটা তার মা সিঁতারা করেছেন। উনার হাতের রান্নার ঘ্রাণই বলে দেয় খাবার স্বাদ।
সে খেতে খেতে একবার সিঁড়ির দিকে তাকাল। শীতলের আসার নামার নেই। গাধীটা সাজতে বসল নাকি কে জানে! ধীরে সুস্থে খেয়ে এঁটো প্লেট ধুঁতে ধুঁতে ভাবল পাঁচ মিনিটের মধ্যে শীতল না এলে চলে যাবে। অযথা সময় অপচয় করা তার স্বভাবে নেই। সে সত্যি সত্যিই ঘড়ি ধরে অপেক্ষা করল। পাঁচ মিনিট পুরো হতে যখন মাত্র দেড় মিনিট বাকি তখন শীতল এলো। পরনে শুদ্ধর মতোই ব্ল্যাক জিন্স, জ্যাকেট। চুলগুলো পনিটেইল করা। গোলাপি ঠোঁটে মিষ্টি হাসি আঁটা। ওর পোশাকের ধরনে মনে হচ্ছে শুদ্ধকে কপি করেছে। শুদ্ধ তার আপাদমস্তক দেখে ধমকে উঠার আগে শীতল বলল,
-‘শুদ্ধর ড্রাইভিং পার্টনার শুদ্ধর মতো নাহলে চলে?’
কত বড় স্পৃহা! তার সামনে দাঁড়িয়ে তার নাম ধরে কথা বলছে। না, এর শিক্ষা পাওয়া ফরজ হয়ে গেছে। শুদ্ধ মুখে কিছু বলল না শুধু তাকিয়েই রইল। মুখভঙ্গি দেখে বোঝার উপায় নেই তার মনে কি চলছে। শীতলের খুশির অন্ত নেই। রাতের বেলা বাইকে করে ঘুরার আনন্দে ভুলে বসেছে বলির পাঠাকেও বলির আগে সেবা যত্ন করা হয়। তারপর এককো’পে..!
যদিও শুদ্ধ তাকে বলি দিতে পারবে না তবে আধমরা করাই যায়। শুদ্ধ ব’ক’ছে না দেখে সে আরেকটু সাহস পেল। দাঁত বের করে হেসে হাতের হেলমেট দেখিয়ে বলল,
-‘ মাথায় হেলমেট থাকবে কেউ চিনবে না, চলো যাই?’
-‘চেঞ্জ করে আয়!’
শান্ত কন্ঠে কঠোর আদেশ! তবুও শীতল দমল না বরং জেদ দেখিয়ে বলল,
-‘না।’
-‘ তাহলে রুমে যা।’
-‘সেইম সেইম হলে কি হয়?’
শুদ্ধ জবাব দিলো না। তবে ওয়ার্নিং ছাড়া দশ থেকে উল্টো করে গুনতে শুরু করল। অর্থাৎ দশের মধ্যে যেতে হবে নয়তো তার যাওয়া ক্যান্সেল। অগত্যা শীতল বাধ্য হয়ে রুমে গেল। তবে যেতে যেতে শুদ্ধকে কিছু গালি দিয়ে ধুঁতে ধুঁতে গেল। পরনের লেডিস টি-শার্ট বদলে ব্ল্যাক জিন্সের সঙ্গে ব্ল্যাক কুর্তি পড়ল। ম্যাচিং ওড়না গায়ে জড়িয়ে হেলমেটটাও মাথায় পরে বেজার মুখে বেরিয়ে এলো। এই হেলমেট খুলবেও না মুখও দেখাবে না। তাকে হেলমেট পরে আসতে দেখে শুদ্ধ কিছু বলার আগেই গটগট করে হেঁটে শুদ্ধর আগে পাকিং লটে গেল। শুদ্ধ তার পেছন পেছন গিয়ে লাইট অন করে বাইক বের করতে ভেতরে প্রবেশ করল। সেও গুঁটি গুঁটি পায়ে
এগোলো। ভেতরে পাশাপাশি দুটো বাইক রাখা। একটা সায়নের, একটা শুদ্ধর। সায়নেরটা সাদা, কালো সংমিশ্রনে হলেও শুদ্ধরটা পুরো কালো।
অপর পাশে শারাফাত ও সাওয়ান চৌধুরীর চার চাকার গাড়ি রাখা। তার
এককোনে শীতলের গোলাপি রঙ্গা সাইকেল। সাইকেলটা সময় অসময়ে সাম্য, সৃজনও চালিয়ে বেড়ায়। শুদ্ধ বাইক বের করছে দেখে শীতল চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ভেবেছে বেশি কথা বলবে না। সে কথা বললে কেউ কেউ তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে কি না! কিন্তু হঠাৎ’ই একটা চিন্তা মাথায় টোঁকা মারতেই সে ফট করে বলে বসল,
-‘ভাইয়া, বাইকের শব্দে বাড়ির সবার ঘুম ভেঙ্গে গেলে কি হবে?’
-‘চোর ভেবে তেড়ে আসবে। দু’ঘা বসাতেও পারে।’
-‘শব্দ ছাড়া বাইক বের করা যায় না?’
-‘যায়। এদিকে আয় বাইকটা তোর মাথায় তুলে দেই? তুই মাথায় করে গেট অবধি নিয়ে যা। এতে শব্দও হবে না, কেউ জাগবেও না।’
একথা শুনে শীতল মুখ ভোঁতা করে তাকিয়ে রইল। সব সময় বাঁকা কথা না বললে যেন শান্তি পায় না এই লোক। কথার পিঠে খোঁচা মারতেই হবে তার। খোঁচা না মারলে যেন জাত যায়! শীতল মুখে কুলপ আঁটতেই শুদ্ধ বাইক নিয়ে হেঁটে হেঁটে গেট অবধি গেল। দারোয়ান গেটের সঙ্গে লাগোয়া ঘরটাতে ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ গেট খোলার শব্দে উনি ধরফড়িয়ে উঠে শুদ্ধকে দেখে থেমে গেল। আর একটু হলেই ‘এই কোন শালা রে, বলে গালি দিয়ে বসতেন। উনার আবার কথার আগে মুখে গা’লি ছুঁটে। শুদ্ধ উনাকে গেট লাগাতে বলে নিজে বাইকে উঠে বসল। হেলমেট পরল। ফোনে কল এলে কথা শেষ করল। তারপর মূর্তির মতো দাঁড়ানো শীতলের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘তুই তাহলে থাক আমি নিমন্ত্রণ পত্র ছাপিয়ে আনি?’
-‘নিমন্ত্রণ পত্র? কার জন্য?’
-‘তোর জন্য। দেখে তো মনে হচ্ছে বাইকে ওঠার জন্য তোকে নিমন্ত্রণ পত্র পাঠাতে হবে।’
আবারও অপমান! তবে শীতল কথা বাড়াল না বিনাবাক্যে বাইকে চড়ে বসল। নড়ে চড়ে জামা-কাপড় ঠিকঠাক করে সুন্দর করে বসল। তখন শুদ্ধ বলল,
-‘লং ড্রাইভে বের হলে আমার যেদিকে দু’চোখ যায়, আমি যাই। আজও যাব। এখনও সময় আছে স’ম’স্যা থাকলে নেমে যা।’
-‘না, সমস্যা নেই।’
-‘সত্যি তো?’
-‘হুম, একদম সত্যি।’
-‘পরে বড় আব্বুর কাছে নালিশ করবি না তো আমি ভয় টয় দেখিয়েছি। অচেনা রাস্তায় নিয়ে গেছি, জোরে বাইক চালিয়েছি, হ্যান ত্যান কত কি।’
-‘ না, না, কোনো নালিশ করব না, প্রমিস।’
-‘ওকে।’
একথা বলে শুদ্ধ বাইক স্টার্ট করল। শীতল খুশিতে ডগডগ হয়ে শুদ্ধর কাঁধের উপর হাত রাখল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। অনেকদিন পর এভাবে বের হয়ে শীতল আশপাশ তাকিয়ে দেখছে। পাগলাটে সমীরণে উড়ছে তার পরনের ওড়না। হেলমেট থাকায় মুখভঙ্গি বোঝা যাচ্ছে না।তবে সে খুশি, ভীষণ খুশি। এর আগেও সায়নের সঙ্গে বের হয়েছিল। খুব মজা করেছিল দু’জন। কত কিছু খেয়েছিল। ইচ্ছেমতো ঘুরেছিল। ভাবুক শীতল ভাবনার জগতে ডুবে খেয়ালই করে নি বাইকের গতি ধীরে ধীরে বাড়ছে। হাইওয়ে দিয়ে শাঁ শাঁ করে ছুটতে তাদের বাইক। কোথায় যাচ্ছে জানা নেই। যেদিকেই যাক তাতেও সমস্যা নেই। আজ মন খুলে ঘুরবে। ঘুরতে ঘুরতে আনন্দ কুড়াবে। তবে এতক্ষণ চুপ থেকে তার পেটের মধ্যে কথারা যেন তাকে সমানে খোঁচাচ্ছে। খুব অশান্তি লাগছে। শুদ্ধ ততক্ষণে হাইওয়ে পেরেছি অচেনা পথের পথ ধরেছে। তার বাইকের গতিও আরো একটু বেড়েছে। যেন বাতাসের সঙ্গে উড়ে যেতে চাচ্ছে। বাইকের গতিটা এতক্ষণে খেয়াল করল শীতল। তাতে তার বুকের ধুকপুকানি শুরু হলো। ভয়ে দু’হাতে খামছে ধরেছে শুদ্ধর কাঁধের জ্যাকেট। সে ভয়ে ভয়ে এবার
জিজ্ঞাসা করল,
-‘আম..আমরা কোথায় যাচ্ছি ভাইয়া?’
-‘বিপদের চৌরাস্তায়।’
-‘এ আবার কেমন নাম? কোথায় এটা?’
-‘শশ্মান ঘাটের পাশে।’
-‘কিহ্! আপনি আমাকে শশ্মান ঘাটের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন?’
-‘হুম।’
-‘আমি যা..যাব না। বাইক থামান, নামব!’
-‘বাইক থামানো যাচ্ছে না।’
-‘ থামানো যাচ্ছে না মানে?’
-‘বাইকের ব্রেক ফেল!’
-‘ কিহ্! কি বলছেন এসব? এখন কি হবে?’
-‘কি আর হবে, ম’রে যাব। ম’র’তে ভয় পেলে ম’রা’র আগে আমাকে আঁকড়ে ধরতে পারিস। মৃ’তপথযাত্রী মা’রা যাচ্ছে ভেবে বে’য়া’দ’বি মাফ করে দেবো।’
শীতল হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে আছে। বাইকের ব্রেক ফেল মানে আজ তার ভবলীলা সাঙ্গ! কোন কুক্ষণে এসেছিল সে? বাইকের ব্রেক ফেল অথচ এই লোক এখনো এত শান্ত আছে কিভাবে? এর কি ম’রা’র’ও ভয় নেই?
বাইক চলছে দ্রুত গতিতে। গতি কমার নেই ধাপে ধাপে বাড়তেই আছে।
শীতল এবার কাঁদতে শুরু করল,
-‘যেভাবেই হোক বাইক থামান ভাইয়া। আমি এখনই ম’র’তে চাই না।’
-‘ম’র:ণ কি বলে আসে? আমি সরি রে শীতল, সত্যিই বাইক থামছে না।’
-‘একটা গাছের সঙ্গে দুম করে লাগিয়ে দেন। গুরুতর আহত হতে সমস্যা নেই কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ম’রা যাবে না..! ‘
-‘বাংলা সিনেমায় দেখিস নি, গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে স্মৃতি হারিয়ে টাল হয়ে পাবনায় যেতে হয়। তোরও যদি স্মৃতি হারিয়ে যায় তখন কি হবে? এমনিতে কথায় কথায় ভাই, ভাই, করে মুখে ফ্যানা তুলে হেদিয়ে মরিস।
স্মৃতি হারিয়ে আমাকে যে আব্বা ডাকবি না এর গ্যারান্টি কে দেবে, তুই নাকি তোর বাপ?’
-‘পাগল, স্মৃতিহারা হয়েও বাঁচতে যায় আমি। বাঁচান আমাকে। কে আছো বাঁচাও!’
শীতল ভয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। আর শুদ্ধ হেলমেটের আড়ালে হেসেই যাচ্ছে। এই মুহূর্তে সে টের পাচ্ছে হাসি চাপিয়ে রাখাও খুব কষ্টের কাজ। এদিকে শীতল বাঁচাও! বাঁচাও! করে সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। তবে নির্জন অন্ধকার রাস্তা বিধায় কেউ শুনছে না। তারা এমন এক রাস্তাতে এসেছে কোনো গাড়িও দেখা যাচ্ছে না। বাইকটা তখনো পূর্বের গতিতে চলমান।
এত জোরে বাইকটা চলছে শীতল তার ভারসাম্য বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এক্ষুণি হাত ফঁসকে পিচঢালা রাস্তায় আঁছড়ে পড়বে।
সে ভয়ে শুদ্ধর পিঠে মাথা ঠেঁকিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বিরবির করে সূরা পড়ছে। তার অবস্থা দেখেও শুদ্ধ বলল,
-‘শীতল বামে তাকা।’
শীতল সেভাবেই ঘাড় ঘুরিয়ে বামে তাকালে শুদ্ধ বলল,
-‘এটা হচ্ছে শশ্মান। অনেক পুরনো শশ্মান। এখানে কত মানুষের আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে কে জানে। কেউ গলায় ফাঁস দেওয়া, গলা কাটা, পা কাটা, হাত কাটা, কত ধরনের লাশ যে পোড়ানো হয়। এর আগেও শুনেছিলাম,
সিংহ রাশির এক পথিক এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় তার গায়ে ফাঁসির আত্মা ভর করেছিল। পরে সেই আত্মা নাকি পথিককে জ্যান্ত অবস্থাতেই জ্বলন্ত চিতায় দাঁড় করিয়ে পুড়িয়ে মে’রে’ছিল।’
একে তো ঘুটঘুটে অন্ধকার চারিপাশ। একদম লোকশূন্য এলাকা। শশ্মান শুনে গা ভার হয়ে আসছে। শীতল আরেকটু শক্ত করে শুদ্ধর জ্যাকেটটা খামচে ধরে চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো। ভয়ে ঘেমে উঠেছে তার হাতের তালু। গলা শুকিয়ে কাঠ। পায়ের তালুটাও কেন জানি শিরশির করছে। বাতাসের শো শো শব্দ অদ্ভুতুড়ে শোনাচ্ছে। তাকে এতটা নিশ্চুপ দেখে
শুদ্ধ নিঃশব্দে হাসল। তারপর হঠাৎ কিছু মনে পড়ার মতো করে বলল,
-‘শিট! আমি তো একটা কথা ভুলেই গেছি।’
-‘ক.. কি কথা?’
-‘তোর কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন? কাঁপছিস না কাঁদছিস?’
-‘ভা..ভাইয়া বাড়ি যাব।’
-‘যেতে পারলে আমিও খুশি হতাম। কিন্তু সেটা বোধহয় আর হবে না রে।
তোকে কতক্ষণ সেভ রাখতে পারব তাও বুঝছি না।’
-‘ক.. কক কেন?’
-‘আমি তো ভুলেই বসেছি আমারও সিংহ রাশি। এখন ওই আত্মারা যদি আমার গায়ে ভর করে? তুই আমাকে জ্বালাস। রাগাস। তোর উপরে খুব রাগ আছে আমার। আত্মার যদি সেই রাগ তুলতে তোকে আছাড় মারে? অথবা গলা চেপে ধরে মে’রে ফেলে? এরা নাকি রক্ত খায়। কচকচ করে মানুষের নাড়ি ভুড়ি খায়। তোর সঙ্গে যদি এসব কিছু হয় মাফ করে দিস। মনে করিস এখানে আমার হাত নেই, আমি নিষ্পাপ! আত্মার হাতে যদি তোর অপমৃ’ত্যু হয়ও তাহলে নিয়তি ভেবে ধরে নিস। কষ্ট রাখিস না মনে।
তোকে তো বাঁচাতে পারব না তবে আমি কথা দিচ্ছি তোর ফতরায় তোর পছন্দের জর্দা নিজের হাতে বিলাব সবাইকে।’
শীতল ঠোঁট ভেঙ্গে কাঁদছে। বার বার নাক টানছে। ভয়ে পরনের কুর্তিটা ভিজে উঠেছে। ঘা গা চ্যাটচ্যাট করছে। এখন যদি সত্যি শুদ্ধর গায়ে ভূত ভর করে তাহলে কি হবে? কার কাছে সাহায্য চাইবে? একথা ভাবতে না ভাবতেই তার ভয়ের মাত্রা বাড়াল। হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে আসল। তবে জ্ঞান হারিয়ে পড়ার আগেই শুদ্ধ তার হাতটা ধরে দ্রুত বাইকটা থামাল।
এতক্ষণ নজর রাখছিল শীতলের উপরে এজন্য ধরতে পেরেছে সহজে।
সে বাইকে বসা অবস্থায় শীতলকে কাছে টেনে হেলমেট খুলে দেখে তার মুখটা ঘামে ভিজে আছে। সে হাত দিয়ে ঘাম মুখে শীতলের গাল চাপড়ে ডেকেও সাড়া পেল না। পানি না থাকায় চোখে, মুখে পানি দিতে পারল না। তবে অবচেতন শীতলের মুখের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,
-‘ কেবল বিপদের চৌরাস্তা পার হলি। এখনো সর্বনাশের চিপাগলি পার হওয়া বাকি। এত তাড়াতাড়ি জ্ঞান হারালে হবে, হুম?’
ক’দিন ধরে’ই আবু সিদ্দিকের সঙ্গে নীরব দ্বন্দ চলছে সায়নের। এজন্য অবশ্য সায়নই দায়ি। আবু সিদ্দিক বার বার বারণ করেছিল ভুলেও যেন অংকনকে জানে না মারে। এখন অংকনকে মা’রলে দোষটা উনার ঘাড়ে চাপবে। এমনিতেই সময় খারাপ যাচ্ছে এখন এসব করা মানেই নিজের বিপদ বাড়ানো। কিন্তু সায়ন সেকথা শুনে নি। বরং সে অংকনকে নির্মম ভাবে জ’বাই করেছে। তারপর শুধু অংকনের মাথাটা পার্সেল করে তার বাবার কাছে পাঠিয়েছে। কোনো রাজনীতিবিদ ছেলের কাঁটা মাথা পেলে বসে বসে আঙ্গুল চুষবে না নিশ্চয়ই! অংকনের বাবাও বসে নেই। পাগলা কুকুরের মতো খুনিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। উপর মহলের আদেশে পুলিশও বসে নেই। আবু সিদ্দিককে দলে একমাত্র সায়নই এভাবে মানুষ মারতে পারে। মা’রে। এ সন্দেহের বশে পুলিশ আজ সিদ্দিকের কাছে এসেছিল।
শান্তভাবে হুমকি দিয়ে গেছে। সামনে’ই নির্বাচন। এখন যদি এসব কেস ঘাড়ে পড়ে জনগন কি ভোট দেবে? ভোটের আগেই তো জনগন আঙ্গুল তোলা শুরু করবে।
সায়নের এমন বাড়াবাড়িতে ভীষণ চটে আছে আবু সিদ্দিক। উনি এসব নিয়ে কথা বলতেই সায়নকে ইমেইল করেছে। স্বর্ণের কথায় ইমেইল চেক করে সায়ন পার্টি অফিসে এসেছে। পায়ের উপর পা তুলে বসেছে ঠিক আবু সিদ্দিকের মুখোমুখি। পাশে দাঁড়িয়ে আছে কনক। সায়ন যদি আবু সিদ্দিকের ডান হাত হয় তো কনক বাম হাত। তবে অঞ্জাত কারণে কনক সায়নকে সহ্য করতে পারে না। কারণ সায়নের থেকে সে বেশিদিন আবু সিদ্দিকের সঙ্গে আছে। অথচ সিদ্দিক তার কাজে মত নেওয়া দূর কিছু শেয়ারও করে না। এই রাগে সায়নের ভুল ধরে বার বার সিদ্দিকের কান পড়া দেয় সে। কিছুক্ষণ আগেও দিয়েছে। সিদ্দিক চেয়ারে বসে জলন্ত সিগারেটের দিকে তাকিয়ে আছে। সায়ন বসে বসে কাঁচা ছোলা খাচ্ছে। খোসা রাখছে চকচকে টেবিলের উপর। তার এহেন কাজে সিদ্দিক ঠান্ডা স্বরে বলল,
-‘কিছুদিনের জন্য গা ঢেকে দে সায়ন।’
-‘কার বা’ল ছিঁড়তে?’
-‘ কারোই না। আপাতত নিজের বা’ল বাঁচাতে গা ঢাকা দে। নয়তো তোর পুলিশ বাপ এসে তোর বাল উপড়ে নিয়ে যাবে।’
-‘আসুক। আমিও তাদের বাল ছিঁড়ে বোঝা বেঁধে হাতে ধরিয়ে দিবো।’
মুখে মুখে কথা বলায় সিদ্দিক বিরক্ত হলেও বুঝতে দিলে না। তবে মনে মনে সায়নকে গালি দিতেও ভুল করলেন না। সায়নের এমন দাপট দেখে কনকের গা পিত্তি জ্বলছে। এই ছেলে নিজেকে কি ভাবে কে জানে। তবে এই মুহূর্তে সে চুপ থাকতে পারল না। তাই দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-‘ মা’রা’র কি খুব দরকার ছিল? মা’র’লি মা’র’লি পার্সেল পাঠাতে গেলি কেন?’
-‘ওকে মারার ক্যাড়া উঠছিল তাই মে’রেছি। তাতে তোর বাপের কি?’
-‘সায়ন! বাপ তুলে কথা বলবি না।’
-‘বলব, যা পারিস করে নিস।’
তাদের তর্কে এবার ধমকে উঠলেন সিদ্দিক। টেবিলের উপর শক্ত থাবা বসিয়ে হিসহিসিয়ে বললেন,
-‘ তুই মে’রে’ছিস এসব ঝামেলা তুই সামলামি। এর একফোঁটা দায় যেন আমার ঘাড়ে আসে।’
একথা বলে উনি হনহন করে বেরিয়ে গেল। সায়ন পায়ের উপর পা তুলে তখনো কাঁচা ছোলা চিবাতে ব্যস্ত। পরনে টু কোয়াটার গ্যাবার্ডিন প্যান্ট ও টি-শার্ট। শারীরিক গঠন দেখে মনে হচ্ছে ভদ্র সভ্য কোনো চকলেট বয়।
যার মধ্যে হিংস্রতা নেই। রাগ ও ক্ষোভ শব্দের সঙ্গে পরিচিত নয় নে। সে শান্তিপ্রিয় শান্ত মানুষ। আজ আর বাসায় ফিরবে না। ইনসানের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ছেলেটা বড্ড বেশিই লাফাচ্ছে। পা না কা’টলে তার লাফাতে থামবে না বোধহয়। সমস্যা নেই তার ব্যবস্থাও সে নিজে করবে।
সিদ্দিক বেরিয়ে যাওয়ার পর কনকও বের হতে গেলে সায়ন বলল,
-‘আমার ফোনে উঁকি মারার সাহস আর দেখাস না। প্রথমবার ভুল বলে মাফ করলাম। দ্বিতীয়বার উঁকি মারা চোখটাই রাখব না। ভুলে যাস না, আমি ছেলে ভালো তয় মানুষটা খুব খারাপ।’
কনক মনের রাগ চেপে কথাগুলো শুনে চলে গেল। সায়ন পায়ের উপর পা তুলে এখনো ছোলা খেতে ব্যস্ত। কাঁচা ছোলা রোজ খায়। ভালোই লাগে তার। তখন তার ফোনে মেসেজ টোন বাজল। মেসেজ চেক করে দেখে স্বর্ণ একটা ঠিকানা দিয়ে মেসেজ করেছে, ‘বেস্ট অফ লাক।’
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১৩
সায়ন হাসল। বড়ই চমৎকার সেই হাসি। তারপর ছোলা চিবাতে চিবাতে প্যান্টের কোমর বরাবর হাত রেখে পিস্তলটা ঠিকঠাকভাবে গুঁজল। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়িতে সময় দেখে স্বর্ণকে রিপ্লাই করল,
-‘ধন্যবাদ হ্যাকার সাহেবা। আপনার কাজে আমি বিমোহিত। অভিভূত।
অপেক্ষা করুক বাসায় ফিরেই কড়া চুমু ট্রিট দিবো।’