শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১৬
নূরজাহান আক্তার আলো
খুনশুঁটি, ঝগড়া, করতে করতে সায়ন, স্বর্ণ এসে পৌঁছেছে একটি পুরনো মন্দিরের সামনে। এই মন্দিরে আগে কালীমূর্তির পূজা হতো। মন্দিরের পুরোহিত রামকৃষ্ণ চরণের কা’টা ম’ন্ডু পাওয়ার পর থেকে পূজো অর্চনা বন্ধ থাকে। এরপর নানান কুসংস্কার ছড়াতে ছড়াতে ধীরে ধীরে মন্দিরটি
একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। কালীমূর্তি সরিয়ে অন্যত্রে স্থানান্তর করা হয়। দিনে দিনে মন্দিরের পলেস্তারা খসে, অযত্ন-অবহেলায় মন্দিরটি সৌন্দর্য হারায়। কদর হারায়। বর্তমানে দিনেও নাকি এখানে আসার সাহস করে না কেউ। এলে নাকি গা মাথা ভার হয়ে আসে। ভয়ে শরীর শিউরে ওঠে।
তবে নিস্তব্ধ এরিয়া দেখে মাঝেমধ্যেই জুয়াখোরদের আনাগোনা দেখা যায়। দিনের বেলায় মন্দির থেকে দূরত্বে দলবেঁধে জুয়ার আসর বসায়।
তারপর সন্ধ্যার আগে আগে ফিরে যায়। এমনই এক জায়গায় স্বর্ণ আর সায়ন এসে দাঁড়িয়ে আছে। মশার কামড়ে হাত-পা জ্বলতে শুরু করেছে।
সায়ন এতক্ষণ শান্ত শিষ্ট থাকলেও এবার তার মুখ দিয়ে গালির ফোরায়া ছুঁটতে শুরু করল। একপর্যায়ে রাগে গজগজ করে পকেট থেকে ফোনটা বের করে কাউকে কল করে বলল,
-‘ওই আমার শা’উ’য়া’র বা’ল মশকরা মারাও আমার লগে? আমি কি তোমার শালা লাগি? পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসবি নয়তো আজ তোকে
এমন ঠা’প দেবো বাপ ডাকাও সময় পাবি না শা’লা ভ্যা’ড়া’চু’দা।’
ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটা কি বলল শোনা গেল না। শোনার ধৈর্য্যও নেই সায়নের। সে নিজের কথাটা শেষ করে কল কেটে হাত-পা ঝাড়ছে।
একদফা মশাকেও গালি ছুঁড়ল সে। তাকে গালি দিতে দেখে স্বর্ণ বিরক্ত মুখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। এই মানুষটা বাড়ি থাকাকালীন একরকম, বাড়ির বাইরে অন্যরকম। কতদিন বলেছে গালি না দিতে, কিন্তু শুনলে তো! তাকে এভাবে তাকাতে দেখে সায়ন আরেকটু কাছঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-‘ভয় লাগছে জান?’
-‘তোমার মতো ভূত সঙ্গে থাকতে ভয় কিসের?’
-‘তা ঠিক, তা ঠিক। কিছু খাবি, খিদে পেয়েছে?’
-‘ যদি বলি হ্যাঁ। এই জঙ্গলের মধ্যে কিছু এনে দিতে পারবে?’
-‘পকেটে কাঁচা ছোলা আছে খাবি?’
-‘না।’
-‘তাহলে আমাকে খা।’
স্বর্ণ মুখে বিরক্তিকর শব্দ করে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
-‘ সভ্য গা’লি দিতে খুব কষ্ট হয় তোমার?’
-‘গালি ভদ্র সভ্য হয় নাকি? মাথার চাঁদি গরম না হলে সেটা গালি বলে গণ্য করা হয় না জান। চিন্তা করিস না তোকেও শিখিয়ে দেবো। একদিন দেখবি, তুই আমার থেকেও বড় মাপের গালির মাস্টার হয়ে যাবি।’
-‘তোমার গা’লি রের্কড করে বড় মাকে শোনাব ভাবছি। ‘
-‘এভাবে কট খাওয়াস না জানপাখি। আমার মা সহ্য করতে পারবে না।’
একথা শুনে স্বর্ণ ঠোঁট কামড়ে ধরে নিঃশব্দে হাসল। তাকে হাসতে দেখে সায়ন শক্ত থাবায় দুই গাল চেপে ধরে ঠোঁটে শব্দ করে চুমু খেল। এরপর দু’গালে। স্বর্ণ তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে গাল, ঠোঁট মুছে কিছু বলার আগে সেখানে গাড়ি আসার শব্দ পেল। সায়ন স্বর্ণের হাত টেনে আড়ালে সরে উঁকি মেরে ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি আঁটল। তার ধারণায় ঠিক, সিদ্দিকের চ্যালা কনক এসেছে। ইনসানের সঙ্গে কি ঘটবে সেটার প্রমাণ হাতাতে স্ব-শরীরে উপস্থিত হয়েছে। প্রমাণ টমাণ কিছু পেলে সিদ্দিককে দেখিয়ে তাকে দল থেকে বাদ দেওয়ার চমৎকার ফন্দি। কিন্তু এত কাঁচা কাজ করার মানুষ সে নয়। কনককে একটু খেলানো যাক। একথা ভেবে সে স্বর্ণের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘জান, শালাকে কিছু দিয়ে আয় তো।’
-‘কি দেবো, চুমু টুমু কিছু?’
-‘একদম জানে মেরে দেবো আমার ভাগের জিনিস অন্যকে দিলে। এক কাজ করি, ওর ভবিষ্যতের উপর ঠা’ডা ফেলে আসি। যাতে সমন্ধির পো
বিয়ে পিরিতে বসেও নিজের পুরুষত্ব নিয়ে ভয়ে থাকে।’
-‘যাবে যাও, বলার কি আছে? তবে তাড়াতাড়ি এটাকে বিদায় কোরো আরেক পাখি যে কোনো সময় চলে আসতে পারে।’
-‘হুম। তুই এখানেই থাক আমি যাব আর আসব।’
-‘সাবধানে। ভুলেও বুঝতে যেন না পারে এটা তুমি। স্মরণে রেখো আসল কাজ এখনো বাকি।’
স্বর্ণের কথা শুনে সায়ন সম্মতি সূচক মাথা নাড়িয়ে একদৌড়ে কনকের গাড়ির কাছে গেল। কনক আশপাশ উঁকি মেরে কারো উপস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। বোকা কনক সায়নের সুবিধা করতে গাড়ির লাইটটা অফ করেই গাড়ি থেকে নেমেছে। এই সুযোগেই সায়ন কনকের মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে একের পর এক লাথি বসাল প্যান্টের চেইন বরাবর। আচমকা আক্রমনে কনক কিছু বুঝতে উঠতে পারল না। আর না নিজেকে সেইভ করার সুযোগ পেল। একের পর এক লাথিতে প্রচন্ড ব্যথায় গোঙ্গাতেই আরেকটা গাড়ি শব্দে সায়ন ছুটে পালালো। ওটা সায়নের গাড়ি ভেবে কনকও দেরি করল না। কোনোমতে মুখ থেকে ওড়না সরিয়ে গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। জান নিয়ে বেঁচে ফিরলে পরেও ব্যথাস্থানে হাত বুলানো শোক প্রকাশ করা যাবে।
এদিকে সায়ন কনককে ইচ্ছেমতো পিটিয়ে স্বর্ণের কাছে গিয়ে হাতের ইশারায় বোঝাল, আসল পাখি’ও এসে গেছে। ততক্ষণ ওই গাড়িটা এসে থেমেছে তাদের থেকে একটুদূরে। জুলিয়া নামের মেয়েটি ড্রাইভিং সিটে বসে ইনসানকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। মাল খেয়ে টাল হওয়া ইনসান জানতেও পারল না তার বর্তমান অবস্থান কোথায়। প্ল্যান করে জুলিয়া তাকে কোথায় নামিয়েছে। কেনই বা এখানে নামিয়েছে।
-‘এবার তোর কাজ হলো, বাবা-মাকে আমার জন্য পাত্রী দেখতে বলবি। জোর করে আমাকে যাতে বিয়ে দেয় এটাই বোঝাবি। উনারা আমাকে জিজ্ঞাসা করলে আমি সবার সামনে না, না, করব। রাগ দেখাব। চিৎকার টিৎকার করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে দেবে। তবুও তুই কাজ থামাবি না, যেভাবেই হোক সবাইকে রাজি করাবি, মনে থাকবে? যা বললাম পাই টু পাই করবি। যদি না করিস ছবিগুলো তিন চৌধুরী কর্তার ফোনে চলে যাবে।’
শুদ্ধর কথা ও কাজে শীতল আহাম্মক হয়ে তাকিয়ে আছে।সে আপাতত হতবাক, হতভম্ব। জবাবে কিছু বলার মতো শব্দ তার শব্দ ভান্ডারে নেই।
সে বিয়ের জন্য পাগল অথচ এতদিন এমন ভাব করত যে বিয়ে বিদ্বেষী।
না, যে করেই হোক আগে বাড়ি পৌঁছাতে হবে। এখন কিছু বললে সত্যিই যদি জোর করে সিগারেট খাইয়ে দেয়?নতুবা পুকুরে চুবায়? কোনোমতে
ঘাড়ত্যাড়াটার সঙ্গে তাল মেলানো যাক, পরেরটা পরে ভাবা যাবে। মনে একথা ভেবে শীতল শুদ্ধকে রাগাল না বরংতালে তাল মিলিয়ে দাঁত বের হাসল। বোকা বোকা হাসি আর কি! এছাড়া বাঁচার জন্য কোনো উপায়ও নেই। তারপর শুদ্ধর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আকাশের চাঁদের দিকে কিছুক্ষন তাকিয় ভাবল, শুদ্ধ ভাই হয়তো কাউকে পছন্দ করে। বিয়ে করতে চায়। লজ্জায় বিয়ের কথা কাউকে বলতে পারছে না তাই হয়তো বোঝানোর দায়িত্ব তাকে দিচ্ছে৷ কিন্তু বিশুদ্ধ পুরুষের লজ্জা আছে একথা ভাবতেও তার লজ্জা লাগছে৷ যে কারণে অকারণে অন্যের লজ্জার পিন্ডি চটকায় তার আবার লজ্জা! তাছাড়া সায়ন ভাই শুদ্ধ ভাইয়েরও বড়। বাড়ির বড় সন্তান হিসেবে সায়ন ভাইয়ের বিয়ে নাহলে শুদ্ধ ভাইয়ের পথ ক্লিয়ার না।
আবার সায়ন ভাই কোনো কারণে বিয়ে করতে রাজি না অর্থাৎ অপেক্ষা
আর অপেক্ষা। হলেও হতে পারে ভাবি হয়তো শুদ্ধ ভাইকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। বিয়ে না করলে হাত কেটে ফালা ফালা করার হুমকি দিচ্ছে। এজন্য হয়তো বিশুদ্ধ পুরুষ হঠাৎ বিয়ের জন্য এত উতলা হয়ে উঠেছে। তবে ভালোই হবে বাড়িতে একটা বিয়ের আয়োজন হলে। অনেকদিন ‘ই হলো বিয়ে বাড়ির রোস্ট, রেজালা, বোরহানি, খাওয়া হয় নি। তবে শুদ্ধ কিংবা সায়ন যারই বিয়ে হোক ওরা তিনবোন সেইম ডিজাইনের লেহেঙ্গা কিনবে। সাজগোজ করবে চোখ ধাঁধানোর মতো করে। মনে মনে এমন কথা ভাবতে ভাবতে তার মন খারাপ দূর হয়ে গেল। ভাবল শুদ্ধকে বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে বাড়ির সবাইকে খুব করে বোঝানোর চেষ্টা করবে। সে
যতই হোক চাচাতো ভাই, ভাইই তো! ছোটো বোন হিসেবে ভাইয়ের সব কষ্ট দূর করার দায়িত্ব আছে না? সেই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করবে সে। শুদ্ধ ভাইয়ের কষ্ট বুঝে সরলমণা শীতল কিছুক্ষণ আগে ঘটনা মাফ করে দিলো। তারপর নরম দূর্বাঘাস টেনে তুলতে তুলতে বলল,
-‘ভাবির ছবি দেখি।’
-‘কোন ভাবি?’
-‘আপনার বউ আমার ভাবি হচ্ছে না? সেই ভাবির ছবি দেখান।’
-‘ তোর ভাবির ছবি আমার কাছে থাকবে কেন?’
-‘ওমা, নিজের বউয়ের ছবি নিজের কাছে রাখবেন না?’
-‘না, রাখব না।’
-‘কেন রাখবেন না?’
-‘আমার ইচ্ছে।’
-‘ছবি রাখবেন না। তাকে দেখাবেনও না। তাহলে তাকে বিয়ের জন্য মরে যাচ্ছেন কেন?’
-‘বিয়ে জন্য মরে যাচ্ছি তোকে কখন বললাম?’
-‘বলতে হবে কেন? আপনার অবস্থা দেখে যা বোঝার বুঝে গেছি।’
-‘আমার শারীরিক সমস্যা আছে অথচ আমি জানি না, তুই জানিস। আমি বিয়ের জন্য মরে যাচ্ছি অথচ আমি মরার ফিল পাচ্ছি না, এটাও তুই নাকি পাচ্ছিস। কাহিনী কি, ঝেড়ে কাশ দেখি? তা কাজিন উপন্যাস পড়ে তুইও সেই কাহিনী রচনা করতে চাচ্ছিস নাকি?’
শুদ্ধর কথা শুনে রাগে দুঃখে শীতলের ইচ্ছে করল হেলমেটটা দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিতে। মাথা ফাটানোর পর কলার ঝাঁকিয়ে হিসহিসিয়ে বলতে, ‘আপনার মতো ঘা’ড়’ত্যা:ড়া, অ’ভ’দ্র, অ’স’ভ্য পুরুষকে নিয়ে কখনো কোনো কাহিনী রচিত করব না আমি। যদি করিও, তাহলে আমি ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের বউ।’
একথা মনে মনে বললেও শুদ্ধ আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে গমগমে সুরে জবাব দিলো,
-‘কান খুলে শুনে রাখ, বিয়ের অভাবে যদি ক’ঙ্কা’লসার হয়ে যাই তবুও তোকে বউ বানাব না। যে মেয়ে আমার কোলে হিসু করে দেয় আর যাই হোক সেই মেয়েকে আমার বউ বানানোর কথা ভাবতেও পারি না আমি।’
-‘এক খোঁটা আর কতদিন দিবেন?’
-‘ম’রা’র আগ পর্যন্ত।’
-‘তা ম’রবে’ন কবে? প্লিজ তাড়াতাড়ি ম’রে যান আমি আপনার অত্যাচার থেকে নিস্তার পাই।’
-‘ একা মরতে ভালো লাগছে না চল দু’জন একসাথে ম’রি?
শীতল অগ্নি দৃষ্টিতে শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু পারছে না শুদ্ধকে দাঁতে তলায় পিষতে। তাকে এভাবে তাকাতে দেখে শুদ্ধ মাথার নিচে হাত দিয়ে ঘাসের উপর শুয়ে উপর। তারপর যৌবনবতী পূর্নিমা চাঁদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে ফিচেল হাসি এঁটে বলল,
-‘ প্রায়দিনই স্কুল থেকে ফিরে দেখতাম ছোটো মা তোকে কোলে নিয়ে ভাত খাচ্ছে নয়তো অন্য কোনো কাজ করছে। না কারো কোলেও যেতি আর না দুদন্ড কাউকে শান্তি দিতি। রাত-দিন শুধু কান্না করতি। ছোটো মায়ের কষ্ট দেখে আমি জোর করে যদি বা একটু কোলে নিতাম অমনি হিসু করে দিতি।’
শীতলের আর সহ্য হলো না সে উঠে হাঁটা ধরল। ঘুরে ফিরে একই গল্প! ছোটো থাকতে সবাই এমন করে। তখন যদি জানত ওই কাজের জন্য বছরে ছত্রিশবার করে খোঁটা শুনতে হবে তাহলে জীবনেও তার কোলে যেতো না। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে থেকে তারা বড় হয়েছে। বাসায় ছোটো
বাচ্চা থাকলে সবাই কোলে নেবে, আদর করবে, সেই বাচ্চা কোলে উঠে হিসু করবে এটাই স্বাভাবিক। তার বেলায়ও এটাই কাহিনী। অথচ এই লোক সুযোগ পেলেই সেই গল্প জুড়ে দিয়ে মেজাজ খারাপ করে দেয়।
সে এখন বড় হয়েছে, বুঝতে শিখেছে। এসব শুনে তার কি লজ্জা লাগে না? তাও ওই একই কথা, একই গল্প। শীতল চলে যাচ্ছে দেখে শুদ্ধ ধীরে সুস্থে উঠল। ঠোঁটে বাঁকা হাসি এঁটে জামা কাপড় ঝেড়ে সেও পিছু পিছু গেল। হাঁটতে হাঁটতে যেখানে শুদ্ধর বাইকটা স্ট্যান্ড করা সেখানেই এসে শীতল থামল। একটুপরে শুদ্ধ এসে বাইকে বসে আরেকটা খোঁচা মারল,
-‘কিছু কিছু মানুষ আছে অন্যের কোলে হিসু করে বড় হয়। তারপর তার কর্মের কথা মনে করালে চোটপাট দেখায়। উপকার পেয়ে উপকারীকে যাচ্ছে তাই বলে এরা। আফসোস দিন দিন মানুষের বিবেক পঁচে যাচ্ছে।’
আবারও খোঁচা শুনে শীতল জ্বলে উঠল আপন শক্তিতে। সেও ঝগড়ুটে গলায় বলে উঠল,
-‘গ্যাদাকালে আমি মানুষের কোলে চড়ে হিসু করেছি, আপনি করেন নি?
-‘না করি নি। আমি কারো মতো এত বে’হা’য়া না যে, যার তার কোলে চড়ে হিসু করে ফোঁকলা দাঁত বের করে হাসব।’
-‘কি করলে হিসুর কলঙ্ক থেকে মুক্তি পাবো বলবেন প্লিজ! আপনার এই খোঁচামার্কা কথা শুনতে শুনতে আমার কানের পোকা বের হয়ে গেছে।’
-‘পোকা বের হয়ে গেছে মানে? তুই কানে পোকা পালতি নাকি? বাড়ির পেছনেই তো অনেক জায়গা পড়ে আছে।’
-‘দেখেন শুদ্ধ ভাই শুধু শুধু কথা প্যাঁচাবেন না। আপনার পায়ে পড়ি ছোটো বেলার কাহিনী থেকে আমায় মুক্তি দেন।’
একথা শুনে শুদ্ধ বাইকে বসা অবস্থায় এক পা এগিয়ে দিয়ে বলল,
-‘আগে পা ধর। পা না ধরে ‘পায়ে পড়ি’ বলে দাঁড়িয়ে থাকা একপ্রকার বে’য়া’দ’বি। একটা মানুষের কথার সাথে কাজেরও মিল থাকা জরুরি।’
-‘কি আশ্চর্য! আমি তো কথার কথা বললাম।’
-‘বললি যখন ধরতে কি সমস্যা? আর কলঙ্ক থেকে মুক্তির একটাই পথ আমার বিয়ের ব্যবস্থা করা। বিয়ের একমাস না পেরোতেই বাপ হবো। প্রতি বছর একটা করে ছানাপোনা ফুটাব। তারপর ছানাদের হিসু করাব তোর কোলে। আমার কোলে তুই হিসু করেছিস আমার ছানারা তোর কোলে হিসু করবে, হিসাব বরাবর।’
-‘ঠিক আছে তাই হবে। আমার জীবনে এখন একটাই টার্গেট আপনাকে বিয়ে করানো।’
একথা বলে শীতল গজগজ করতে করতে বাইকের পেছনে চেপে বসল।
তাকে বসতে দেখে শুদ্ধ বাইক ছুটল অজানা পথ ধরে। রাত বাড়ছে ধরা বাঁধা নিয়মে। অজানা পথ। অচেনা গন্তব্যে ছুটছে উদ্দেশ্যেবিহীন ভাবে।
কি মনে করে শীতল মাথা থেকে হেলমেট খুলতেই তার চুলগুলো অবাধ্য হয়ে উঠতে লাগল। শুদ্ধ ধমকে উঠলেও পাত্তা দিলো না। বরং প্রাণ ভরে শ্বাস নিলো। মুক্ত বাতাসে চোখ বন্ধ করে দুই হাত দু’দিকে প্রসারিত করে মিষ্টি করে হাসল। কোনদিকে বাইক যাচ্ছে সে জানে না। যেদিকে যাচ্ছে যাক, তার ভালোই লাগছে। এই রাস্তায় লাইট থাকায় তেমন ভয় লাগছে না। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর শুদ্ধ বলল,
-‘প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতে চাইলে আগে চুল বেঁধে হেলমেট পর। নয়তো এক্সিডেন্ট করে দু’জনের ভবলীলা সাঙ্গ হতে দেরি লাগবে না।’
শীতল শুনল না বরং টেনেটুনে শুদ্ধর হেলমেটটাও খুলে নিলো। বাতাসে উড়তে লাগল শুদ্ধর চুল। শুদ্ধ বেয়াদব, টেয়াদব, বলে ধমকালেও কিছু মনে করল না। কারণ এ তো আর নতুন কিছু না। এসব সে রোজ শুনে।
তাই আরেকটু সাহস দেখিয়ে পেছনে থেকে শুদ্ধর চুল টেনে দিতে দিতে বলল,
-‘ একটা কথা বলি?’
-‘না।’
-‘বলি না প্লিজ! না বললে পেট ব্যথা করবে আমার।’
-‘(…)’
-‘ কিছুদিন আগে সায়ন ভাইয়ার কাছে খুব সুন্দর দেখতে একটা ছেলে এসেছিল। আহনাফ নাম। ওই ভাইয়াটার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।
ভাইয়াটা শখ আপুকে পছন্দ করে। বিয়ে করতে চায়। আমার দুলাভাই হিসেবে খাপে খাপ তাই আমি আপুর নাম্বার উনাকে দিয়েছি। বলেছি, প্রেম করে আপুকে পটিয়ে নিতে।’
একথা শোনামাত্রই আচমকা বাইক থামাতেই তার পিঠের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল শীতল। নাকে ব্যথা পেয়ে নাক ডলার আগে বাঁজখাঁই গলায় শুদ্ধ বলল,
-‘ অচেনা একজন শখের নাম্বার চাইল আর তুই দিয়ে দিলি? এই মহৎ কাজ করতে কে বলেছে তোকে?’
-‘কেন, কি হয়েছে?’
-‘আবার জিজ্ঞাসা করছিস, কি হয়েছে? বে’য়া’দ’ব কোথাকার। থা’প্প’ড়ে দাঁত ফেলে দেবো তোমার।’
-‘শুধু শুধু বকছেন কেন? নিজে বিয়ে পাগলা তার বেলা? এদিকে সায়ন ভাইয়াও প্রেম করে বলেছি নাকি কাউকে?’
-‘কে কাকে পছন্দ করে। কে কাকে ভালোবাসে। এসব দেখা ছাড়া কাজ নেই তোর? এসব করতে পেলেপুষে বড় করা হচ্ছে তোকে?’
-‘ঘুরে ফিরে আমার চোখেই পড়ে এটাও কি আমার দোষ নাকি? প্রায় সবাই কথায় জানি শুধু আপনার টা বাদে। আপনার কাহিনী জানলেই ষোলো আনা পূর্ণ হবে।’
শীতলের দিকে বিরক্তচোখে তাকিয়ে শুদ্ধ বাইকটা টান দিয়ে টং চায়ের দোকানের সামনে থামাল।দোকানিকে চা দিতে বলে দোকানের সামনে থাকা ড্রাম থেকে একমগ পানি তুলে শীতলকে বলল চোখে-মুখে পানি দিতে। ঘুম ছুটাতে শীতল তাইই করল। দোকানি চা বানাচ্ছে দেখে শুদ্ধ আশেপাশে তাকিয়ে শীতলকে দাঁড়াতে বলে এগোলো জঙ্গলের দিকে।
কয়েক টা ধাপ এগিয়ে হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই ওমনি তার প্রশ্বস্ত বুকের সাথে শীতল বারি খেলো। ব্যথা পেয়ে নাক ডলতে ডলতে খ্যাক করে বলল,
-‘ আশ্চর্য তো, খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে গেলেন কেন?’
-‘তুই কোথায় যাচ্ছিস?’
-‘আপনার সঙ্গে।’
-‘আমি কোথায় যাচ্ছি?’
-‘আমি কি করে বলব?’
-‘জানিস না তো পিছু নিয়েছিস কেন?’
-‘ শুধু শুধু কথা প্যাঁচাবেন না। কোথায় যাচ্ছেন বলে গেলেই হয়।’
-‘মূত্র বিসর্জন দিতে, যাবি? গেলে আয়। গল্পে গল্পে কাজ সারি।’
-‘ ছিঃ! কিসব কথাবার্তা।’
-‘ছিঃ! এর কি হলো? মূত্র বিসর্জন দিতে চেয়েছি অন্যকিছু তো করতে চাই নি।’
-‘কোন মসজিদে জিলাপি বিলালে আপনার লাগাম ঠিক হবে বলবেন প্লিজ!’
একথা বলে শুদ্ধকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না সে। দোকানের সামনের বেঞ্চে বসল। দোকানিকে জায়গার নাম জিজ্ঞাসা করলে উনি জবাব দিলো। একটুপরে শুদ্ধ ফিরে এসে দাঁড়াতেই দোকানি জানতে চাইলেন,
-‘আব্বা, এডি আমাগো আম্মাজান লাগে?’
-‘ তাকে আমিও চিনি না কাকা। রাস্তায় পড়ে ছিল ধূলো ঝেড়ে সঙ্গে নিলাম। থাকতে চাইলে রেখে দেবো না যেতে চাইলে অজানা গন্তব্যে ছেড়ে দেবো।’
এ কথা শুনে শীতল ভ্রুঁ কুটি করে তাকালে দোকানি হো হো করে হেসে ফেলল। হাসল শুদ্ধও। তারা কেন হাসল বোধগম্য হলো না শীতলের।অতঃপর তারা চা পান করে পুনরায় ভবঘুরে হয়ে বাড়ি ফিরল ভোরের দিকে। শীতল কোনোমতে হেলমেট রেখে সেভাবেই ঘুম। একঘুমেই দুপুর পার।
একতলা বিশিষ্ট একটি বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মাঝবয়সী এক লোক। নাকের ডগার উপরে মোটা কাঁচের চশমা। পরনে কুঁচকে যাওয়া পাজামা-ফতুয়া। হাতে একটি ব্যাগ। ব্যাগে সম্ভবত কাগজপত্র রয়েছে।
তিনি চশমা ঠেলে ভ্রুঁ কুঁচকে একটু এগিয়ে এলেন। তারপর নেইম প্লেটে
বড় বড় অক্ষরে লেখা নামের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নামটা বিরবির করে
উচ্চারণ করলেন, ‘এডভোকেট শতরুপা চৌধুরী।’ অবশেষে তিনি সঠিক গন্তব্যে এসেছে। এতদূরে জার্নি করে আসা স্বার্থক হলো তবে। উনি কাঁপা হাতে কলিংবেল চাপতেই একজন যুবক দরজা খুলে হড়হড় করে বলল,
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১৫
-‘চটি খুলে, পদধূলি ঝেড়ে, হাগা-মুতা সেরে পাশের রুমে বসুন। একটু পরে মেডাম এলে, গলা ঝেড়ে, খানিকটা কেশে, নিজের সমস্যার কথাটা জানাবেন। আলোচনা চলাকালীন কৌষ্ঠকাঠিন্য রোগীর মতো কুঁতকুঁত
করবেন না। চুলকাচুলকি, মুচড়ামুচড়ি মেডাম একদমই পছন্দ করে না,
তাই এসব থেকে নিজেকে সংযত করবেন, ধন্যবাদ।’