শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১৮
নূরজাহান আক্তার আলো
বিকেল পেরিয়ে এখন সন্ধ্যা।অনিন্দ্য ধরণীর বুকে নেমেছে নিকষ কালো রাতের আঁধার। ব্যস্ত নগরীর মানুষগুলো ছুটছে আপন গৃহালয়ে ফেরার তাড়ায়। ফলস্বরুপ পথে_ঘাটে বেঁধেছে অসহ্যকর জ্যাম। জ্যামের চক্করে পড়ে আধাঘন্টার পথ আড়াই ঘন্টায় পার করে কিছুক্ষণ আগে’ই বাসায় ফিরেছেন শারাফাত চৌধুরী। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহে ফিরে ফ্রেশ না হয়ে’ই আগে শখকে রুমে ডেকেছেন। শুনেছেন, বিয়ের কথা শুনে থেকে মেয়ে মনমরা হয়ে বসে আছে। হ্যাঁ/ না কিছুই বলে নি মেয়েটা। মেয়ে যে এখন বিয়ে করতে চায় না একথা উনিও জানেন। কিন্তু আর কতদিন? কতদিন মেয়েকে ধরে বেঁধে রাখবেন। মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছে তাকে পরের ঘরে যেতেই হবে।
মোটকথা, শখ উনার বড্ড আদরের মেয়ে। দুই ছেলের পর খুব ইচ্ছে ছিল এবার একটা মেয়ে হোক। বাবা! বাবা! করে ডেকে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ুক। আদুরে আবদারে অতিষ্ঠ করে তুলুক। মিষ্টি সুরে শাষণ করুক। বকা দিক। পছন্দের কিছু না পেলে দু’গাল ফুলিয়ে বসে থাকুক। কিন্তু উনার মনের কথাটা সিঁতারাকে কখনোই বলা হয়ে ওঠে নি। কারণ সায়ন, শুদ্ধ হওয়ার সময় সিঁতারার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তাররাও হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। সহধর্মিনীর কথা চিন্তা করে মনের কথা চেপে’ই রেখেছিলেন। কিন্তু শুদ্ধ হওয়ার কয়েক বছর পরে, একদম অনাকাঙ্খিতভাবে শখের আগমন ঘটে। বুকে পাথর চেপে সিঁতারাকেও বলেছিলেন জীবনের ঝুঁকি না নিতে। কিন্তু সিঁতারারও মেয়ের শখ ছিল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এত বলে কয়েও উনাকে বাচ্চা নষ্ট করাতে রাজি করানো যায় নি। ফলে
দিন দিন প্রেগনেন্সির জার্নি আরো কষ্টকর হয়ে ওঠে। ডেলিভারির ডেট যতই ঘনিয়ে আসছিল উনিও নেতিয়ে পড়েছিলেন। শরীরের হাল বুঝে কাঁদতে কাঁদতে উনাকে দ্বিতীয় বিয়ের পারমিশন দিয়েছিলেন। তারপর সিঁতারাকে আবার ঝুঁকি নিতে হয়। মা ও মেয়ে দু’জনই জীবন যুদ্ধ জিতে একটা সময় স্বাভাবিক হয়। মেয়ের পুতুল মুখটা দেখে সব কষ্ট সহ্য করে নেন দু’জনই। এবং শখের মেয়ের নামটাও উনিই রাখেন, শানায়া চৌধুরী শখ। দিন যায় দিন আসে। দেখতে দেখতে সময় কাটতে থাকে। ছোটো শখও বড় হতে থাকে। উনার ছোটো ভাইদের ঘর আলো করে সন্তানরা আসে। একটা সময় চৌধুরী নিবাসও ভরে ওঠে প্রান্তবন্ত প্রাণদের চঞ্চল কলকলানিতে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তারাও বড় হতে পারে। একটা কথা না বললেই নয়, উনি বাবা হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে এটা বুঝেছেন, ছেলেরা যদি হয় বাবার শক্তি, মেয়েরা হয়; মায়া। কলিজার একাংশেই থাকে মেয়েরা। মেয়েদের মুখজুড়ে থাকে জান্নাতি সুখ তাই বাবারাও চুপ করে সয়ে যায়, এক পৃথিবী সমান দুখ।
এই মুহূর্তে বাবার সামনে মুখে হাসি এঁটে চুপটি করে বসে আছে শখ। সে
বরাবরই শান্ত স্বভাবের। কথাবার্তা বলে ছোটো ছোটো করে ধীরে_সুস্থে।
তার মুখে হাসি থাকলেও এই মুহূর্তে ডাগর ডাগর আঁখিজোড়া অশ্রুজলে টইটুম্বর। মনটাও অভিমানে পূর্ণ। মেয়ের মুখটা দেখে শারাফাত চৌধুরীর
বুক মোচড় দিলেও স্বাভাবিক রইলেন। কিছুক্ষণ মেয়ের মুখপানে চেয়ে আদুরে স্বরে ডাকলেন,
-‘মা!
বাবার স্নেহমাখা ডাক শুনে শখের চোখ থেকে জল গড়িয়ে গেল। বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে করল। কিন্তু এ কাজ কি আর সাজে? বড় হয়েছে এখন। হবু ডাক্তারও। এত আবেগী হলে তো চলে না।
তবে এত চেষ্টা করেও কোনোমতে চোখের জল আঁটকাতে পারল না সে।
গড়গড়িয়ে গাল বেয়ে জল গড়াতেই থাকল। কিছু বলবে গলা যেন চেপে ধরেছে কেউ। রুমজুড়ে পিনপতন নিরাবতা। বাবা ও মেয়ে দুজনেই চুপ।
কেউ যেন কথা খুঁজে পাচ্ছে না। বুকচাপা কষ্টে শব্দের জোড়াতালি দিতে
ব্যর্থ বাবা ও মেয়ে। বুকে জমা অভিমান থেকে শখের হঠাৎ বলতে ইচ্ছে করল,
-‘আমি কি বেশি খাচ্ছি বাবা? খুব বেশি বোঝা হয়ে গেছি তোমার? কেন পর করে দিচ্ছো? কেন চিরচেনা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছে? তবে কি আমাকে আর ভালোবাসো না, বাবা?আমাকে তোমাদের কাছে রেখে দাও না, বাবা? এতদিন যেভাবে স্নেহতলে আগলে রেখেছিলে সেভাবেই রেখে দাও আমায়।’
কিন্তু চাইলেও বুকের কথা মুখে বলা হলো না। শারাফাত চৌধুরী মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। তারপর মুখে হাসি এঁটে জবাবে বললেন,
-‘তুমি সারাজীবন শুয়ে বসে খেলেও আমার অর্থ ফুরাবে না, মা।মেয়েরা প্রাপ্ত বয়স্ক হলে পাত্রস্ত করা প্রতিটা বাবার গুরুদায়িত্ব।’
-‘(…..)’
-‘ সায়ন, শুদ্ধ, শখ, স্বর্ণ, শীতল, সাম্য, সৃজন এরা আমার বাগানের এক একটা জীবন্ত ফুল। এরা সামান্য ব্যথা পেলে তার দ্বিগুন আঘাত আমার বুকে এসে লাগে, মা। সেই আমি কিভাবে পর করব তোমাকে? পর করে আমি নিজে ভালো থাকব? তোমরা আছো বলেই তো আমার পৃথিবীটা এত সুন্দর।’
_(….)’
-‘আহনাফ ছেলেটা ভালো। সে নিজে এসে আমার কাছে তোমার হাতটা চেয়েছে। তোমার ভাইরা, চাচ্চুুরা, ছেলেটার খোঁজ নিয়ে খারাপ রিপোর্ট আনতে পারে নি। আমরা সবাই চায়, তুমি ভালো থাকো। আমার বিশ্বাস
ছেলেটা তোমায় সুখে রাখবে। খুব ভালো রাখবে। রাজি হয়ে যাও মা।’
শখ ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। মেয়েকে কাঁদতে দেখে উনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক কথায় বুঝিয়েছেন। শখ এবারও বাবার কথা নিশ্চুপ হয়ে শুনেছে। বাবার মুখ দেখে বুঝেছে এই বিয়েটা হলে বাবা খুশি হবে।
মা-চাচীরাসহ, বড় ভাইরাও খুব খুশি। সবার কথা ভেবে তার মতের কথা জানতে চাইলে সে সম্মতি সূচক মাথা নাড়িয়েছে। অর্থাৎ বিয়েতে রাজি। অথচ মুখে মুখে সম্মতি দিলেও তার মনটা অশান্ত হয়ে আছে। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বিয়ের রীতিনীতি একদমই পছন্দ নয় তার। কারণ বিয়ের ছলে সম্পর্কের রুপ বদলায়। ধরণ বদলায়। বিয়ের আগে বাপ-ভাইরা যতই বলুক সম্পর্কগুলো আগের মতোই ঠিকঠাক থাকবে।
আদৌ তা হয় না। বরং বিয়ের পর মেয়েদের বোঝানো হয় বাপের বাড়ির থেকে শশুড়বাড়ি আপন। তারাই আপন। তারাই তোমার প্রিয়জন। তারা মিটাবে তোমার সকল প্রয়োজন। সেখানেই যাও, সেথায় তোমার আপন ঠিকানা। রক্তের বন্ধনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আপন করে নাও অচেনা মানুষগুলোকে। কষ্ট হলেও কিছু করার নেই। বাঁধা দেওয়ার মতো জোর নেই। এটাই মেয়েদের ভবিতব্য। মানতেই হবে। যেতেই হবে শশুরবাড়ি।
এখন বাপের বাড়ির মেহমান তুমি। পেলেপুষে বিয়ে দেওয়ার পর বাপের বাড়ি থাকার সময় ফুরিয়েছে তোমার। অন্যের ঘরের ঘরণী তুমি। প্রদীপ হয়ে আলোকিত করো অন্যের জীবন। অন্যের সংসার। পুরনো সব মায়া ছেড়ে আঁকড়ে ধরে নতুন মায়াকে। সেই মায়াতেই বেঁধে রাখো সংসারের প্রতিটা সদস্যকে। তবেই না হবে তোমার নারী জীবন স্বার্থক।
স্বর্ণ লেপটপে কাজ করছে। বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে মনোযোগ সহকারে কি যেন করছে। তাকে মনোযোগী দেখে শীতল টাকা নেওয়ার
ধান্দায় দু’একবার খোঁচালেও কাজের কাজ কিছুই হলো না। তাই বকতে বকতে নিচে চলে গেছে। শখ পড়ার টেবিলে চুপ করে বসে আছে। দৃষ্টি
বইতে নিবদ্ধ থাকলেও পড়াতে মন নেই তার। মস্তিষ্কে নানান ভাবনা। মুখ শুকিয়ে চুপসে গেছে। কিছুক্ষণ আগে আহনাফ ফোন করেছিল তাকে।
বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে শুনে ছেলেটা খুব খুশি। মাত্রারিক্ত খুশিতে কথা বেরোচ্ছিল না মুখ দিয়ে। বারবার কথা আঁটকে আসছিল তার। কতবার শখকে ধন্যবাদ দিয়েছে সেও হয়তে জানে না। পছন্দের কাউকে পেলে এমনই হয় বুঝি? কি জানি, তার জীবনেএমন অনুভূতির কেউ আসে নি।
ঘটা করে কাউকে ভালোবাসি বলা হয় নি। মন দেওয়া-নেওয়া’ও হয় নি।
সে বাবার রুম থেকে এসে পড়ার টেবিলে বসেছে। নীরবে জানিয়েছে সে বিয়েতে রাজি। কিন্তু মনের তোলপাড় বন্ধ হচ্ছে না। হাত-পা অনবরত কাঁপছে। আর কিছুক্ষণ, কিছুক্ষণ পরে আহনাফরা চলে আসবে। হাতে রিং পড়িয়ে তাকে বউ হিসেবে চিহ্নিত করবে। দুই পরিবারে নতুন করে সম্পর্ক জুড়বে। সম্বোধনেও পরিবর্তন আসবে। এসব নানান কথা ভেবে
শখ বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে স্বর্ণের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘আমার কি বিয়েটা করা উচিত, স্বর্ণ?’
স্বর্ণ তাকাল না। শক্ত করে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে দ্রুত গতিতে টাইপ করছে সে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লেপটপের দিকে। শখের কথাটা শুনেও সাথে সাথে জবাব দিলো না। বরং একটু সময় নিয়ে হাতের গতি কিছুটা কমিয়ে এনে ধীরে সুস্থে উত্তর করল,
-‘উচিত।’
-‘কেন উচিত?’
-‘ তোমার হবু বর মানুষ হিসেবে পার্ফেক্ট। একজন পার্ফেক্ট মানুষই পারে পার্ফেক্ট পার্টনার হতে। নরম সরম মেয়েরা একা বাঁচতে পারে না। বাঁচতে চাইলে পৃথিবীর নিষ্ঠুর মানুষরা তাদের বাঁচতে দেয় না। হয় নারীখেঁকোরা কলঙ্কের কালি লেপ্টে দেয়ে নয়তো খুবলে খেয়ে পৃথিবী থেকে বিতাড়িত করে। এজন্য মেয়েদের নিরাপদ আশ্রয় দরকার। ছায়া দরকার। মন ভরে কাঁদার জন্য হলেও বিশ্বস্ত বুক দরকার। আহনাফ ভাই নিঃসন্দেহে ভালো মানুষ। তাকে নিয়ে সংশয় রেখো না বরং মেনে নাও। ভুলে যেও না,শুদ্ধ, সায়ন ভাইয়ের কলিজা আমরা তিনবোন। আমাদের জন্য তারা কি কি করতে পারে ধারণাও করতে পারবে না তুমি। সেই ভাইরা যার তার হাতে তোমাকে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিবে না। তাই নিশ্চিত থাকো, নিশ্চিয়ই আহনাফ ভাইয়ের মাঝে বিশেষ বিশেষত্ব আছে বলেই তারা তার সাথে তোমার বিয়ের কথা ভেবেছে।’
স্বর্ণের স্পষ্টভাষায় স্পষ্ট কথাগুলো শুনে শখ সত্যি সত্যিই অহেতুক চিন্তা বাদ দিলো। তাই তো, মাথার উপর বড় ভাইরা থাকতে এত ভয় কিসের?
তার ভাইরা তো আর পাঁচটা ভাইয়ের মতো না। এসব ভেবে সে মন মরা হয়ে বসে থাকল না বরং উঠে নিচে গেল। তাকে যেতে দেখে স্বর্ণ কেবল তাকিয়েই রইল। বাড়ির মূল ফটক দিয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে হাঁটতে হাঁটতে আসছে সাম্য, সৃজন আর শীতল। সাওয়ান চৌধুরীকে বের হতে দেখে তিনজন ধরেছিল আইসক্রিম কিনে দেওয়ার জন্য। উনি ওদেরকে আইসক্রিম কিনে দিয়ে বাড়ির গেটে নামিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেছে। ওরা
আইসক্রিম খেতে খেতে বাড়িতে প্রবেশ করল। ইতিমধ্যে ওরাও জেনেছে শখকে আজ দেখতে আসবে। কিছুদিন পর তার বিয়ে হবে। তারপর শখ তাদের ছেড়ে শশুরবাড়ি চলে যাবে। আপু চলে যাবে ভেবে কষ্ট লাগলেও সুদর্শন দুলাভাই পাবে বলে ভীষণ খুশি তারা। আহনাফকে পছন্দ হয়েছে কি না!
ড্রয়িংরুমে শারাফাত চৌধুরী, সায়ন সহ বাড়ির তিন গিন্নি এসে বসেছে।
বড়দের হাতে চায়ের কাপ। আহনাফরা নাকি লম্বা জ্যাম আঁটকে গেছে।
একটু আগে ফোন করে তাই জানিয়েছে। শারাফাত চৌধুরী ফিরে আগে এককাপ চা পান করেন নয়তো উনার মাথা ভার হয়ে থাকে। শারাফাত
চৌধুরীর জন্য শুধু চা না বানিয়ে সিঁতারা সবার জন্য বানিয়েছেন। প্রতি
সন্ধ্যায় তিন জায়ের চা না খেলে চলেই না। আহনাফদেরও আসতে দেরি হবে। এই ফাঁকে বাড়ির সকলে একদফা চা আড্ডা’ও হয়ে যাবে। শখকে ডেকে তার হাতে কাপ ধরিয়ে দিয়েছে সিমিন। কথাবার্তা বলে মেয়েটাকে সহজ করার চেষ্টা করছেন তারা। এদিন তাদের জীবনেও তো এসেছিলে বিধায় তারাও জানে এ মুহূর্তের কথা। তখনই বাড়ির তিনটে বিচ্ছু হইহই করতে করতে ড্রয়িংরুমে এলো। নিজেদের আইসক্রিম ভাগাভাগি করে নিলো। সবার জন্য আনা হয়েছে আইসক্রিম। যার যারটা তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো। বাটি আইসক্রিমের বাটি থেকে একবাটি আইসক্রিম নিয়ে
সৃজনকে দিয়ে শুদ্ধের কাছে পাঠিয়ে দিলো সিরাত। সায়ন চায়ের কাপ রেখে ভাই-বোনদের থেকে এক কামড় করে খাবেই। নিজে না দিলে সে জোর করে খাবে অগত্যা বাধ্য হয়ে দিতেই হলো। সাম্য হঠাৎ আইসক্রিম
খাওয়া থামিয়ে কিছু ভাবতে বসেছে। ভাবার পর্বে সমাপ্তি টেনে সে উঠে শারাফাত চৌধুরীর পাশে বসল। তারপর চিন্তিত সুরে বলল,
-‘বড় আব্বু? শখ আপুকে অচেনা কারো সাথে বিয়ে দিও না।’
এই কথা শুনে সবার দৃষ্টি পড়ল সাম্যের দিকে। সবাইকে তাকাতে দেখে সাম্য ভয় পেল না। ভড়কালোও না। সে ছোটো থেকেই এমন। যখন যা বলতে চাইবে পুরো কথাটুকু শেষ করেই থামবে। আর অপর মানুষটাকে বাধ্য করে তার কথা শুনতে। হঠাৎ এমন কথা বলায় শারাফাত চৌধুরী শুধালেন,
-‘কেন বাবা? দিলে কি হবে?’
-‘আমরা তো আপুর শশুড়বাড়িতে থাকব না। ওরা যদি আপুকে মা’রে, ব’কে?’
ছোটো ভাইয়ের চিন্তা বড় বোনের সেফটি নিয়ে। আহা, কি মধুর সম্পর্ক!
কিন্তু শখ হাসিটা মিলিয়ে গেল। পুনরায় তার চোখের কোণে অশ্রু জমে গেল। বুঝে ওঠার আগেই গাল বেয়ে অশ্রুঁফোটা গড়িয়েও গেল। সায়ন সেটা খেয়াল করে এবারের জবাবটা সেই দিলো,
-‘আমরা চার ভাই আছি কি করতে? আমাদের বোনকে মারবে, এতোই সোজা? শুধু মে’রে’ই দেখুক না, ওদের ছাপার নঁকশা চেঞ্জ করে দেবো।’
-‘তা নাহয় দেবো। কিন্তু…!’
-‘আবার কিন্তু কেন?’
-‘তিন আপুকে বাইরে বিয়ে না দিয়ে অন্য একটা কাজ করি। আমি শখ আপুকে বিয়ে করি। তুমি স্বর্ণ আপুকে বিয়ে করো। শুদ্ধ ভাইয়া শীতল আপুকে বিয়ে করুক। তাহলে আপুরা এই বাড়িতে থাকবে। কেউ বকতে পারবে না, মারতেও পারবে না।’
সাম্যের হিসেব দেখে সকলের চক্ষূ চড়কগাছ। সিরাত তো ভীষম খেয়েই ফেললেন। সিমিন গরম চায়ে ছ্যাকা খেয়ে ঠোঁট চেপে ধরে বসে আছেন।
সিঁতারা বেগম মুখ টিপে হেসে কিছু বলার আগেই শীতল নিজ শক্তিতে
জ্বলে উঠল। সে চট করে উঠে সাম্যের গালে চটাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-‘বে’য়া’দ’ব। নিজেরা ভালো ভালো বেছে নিয়ে আমাকে আপদ-বিপদ দিবি? আর আমি মুখ বুঁজে তা মেনে নেবো? কখনো না! দরকার হলে হাত কাঁটা ছেলেকে বিয়ে করব তাও আপদ বিপদকে ঘাড়ে ঝুলাব না।’
তার এহেন কান্ডে উপস্থিত সকলেই হতবাক। আপদ_বিপদ কে, শুদ্ধ?
এছাড়া কাকেই বা বলবে? শীতলের কথা শুনে শারাফাত চৌধুরীর কেন জানি ভীষণ হাসি পেল। মনে মনে ভেবেও নিলেন শুদ্ধ উপস্থিত থাকলে বেশ হতো। ছেলের মুখের অবস্থা কেমন হতো তখন? এসব ভেবে হাসি চওড়া হতে গিয়েও কোনোমতে নিজেকে সামলে নিলেন। সবার সামনে
হাসা ঠিক হবে না ভেবে গলা খাঁকারি দিয়ে হাসি গিলে উনি চায়ের কাপে চিমুক দিলেন। কিন্তু উনার অজানা রয়ে গেল সিঁড়ির মুখে শুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। পুরো ঘটনা দেখেছে, শুনেছে। স্বর্ণ হাতের কাজ সেরে রুম থেকে বেরোতেই শুদ্ধর মুখোমুখি হলো। চোখাচোখি হলো। শুদ্ধ তাকে দেখে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলল,
-‘অন্ধকে সাহায্য করা পূন্যের কাজ হলেও অন্ধের সঙ্গে চলতে গিয়ে অন্ধ সাজা বো’কা’মি। যা করছিস, শাহাদত চৌধুরী জানলে মঙ্গলজনক কিছু হবে না। তাই ফাস্ট এ্যান্ড লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম, বাকিটা তোদের ইচ্ছে।’
স্বর্ণ শুনল। তবে পেছনে ফিরে তাকাল না আর না কোনো জবাব দিলো।
শুদ্ধও যেতে যেতে যা বলার বলে রুমে ঢুকে গেল। সব দেখে। সব বুঝে।
তবে কাউকে কিছু বলে না। এখন চুপ আছে মানে সামনেও চুপ থাকবে এর গ্যারান্টি নিজেকেও দিবে না।
সন্ধ্যার পরে আহনাফদের আসার কথা থাকলেও জ্যামে আঁটকে তারা এলো রাত সাড়ে নয়টার দিকে। ড্রয়িংরুমে বসে বিয়ে নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত বড়রা। শখকে সাজানো হচ্ছে। স্বর্ণ নিজেই সাজাচ্ছে বড় বোনকে।
আহনাফ, বাবা-মা আর বোনের পাশে বসে উশখুশ উশখুশ করছে তখন থেকে। বারবার তাকাচ্ছে সিঁড়ির দিকে। নয়তো সময় দেখছে। অপেক্ষার প্রহর এত দীর্ঘ কেন? আসছে না কেন মেয়েটা? এত সাজা লাগে? আজ কি বিয়ে? তার মিষ্টি মুখটা দেখার জন্য বুকের ভেতর যে ছটফট করেছে মেয়েটাকে কি জানে না? বুঝে না? নাকি তাকে বউ করার শাস্তি দিচ্ছে এভাবে? আহনাফের উশখুশ ভাবটা শীতল এসে অবধি খেয়াল করছে।
দেখে হাসছে মিটিমিটি। আহা! কি ভালোবাসা। কি ভেবে শীতল দৌড়ে গিয়ে সিমিনের ফোন এনে চুপিচুপি বেশ ক’টা আহনাফের ছবি তুলল।
সবাইকে দেখাতে হবে তার দুলাভাই কত সুদর্শন। তাছাড়া এই ছবিগুলো দেখিয়ে শখের থেকে টাকা হাতাবে সে। মনে মনে শয়তানি বুদ্ধি এঁটে সে
ড্রয়িংরুমের এককোণে দাঁড়াল। বড়রা কথা বলছে দেখে শুদ্ধ’ও আস্তে করে উঠে অদূরে দাঁড়ানো শীতলের পাশে দাঁড়াল। তারপর নিচু কন্ঠে বলল,
_’ রুমে যা, শীতল।’
_’কেন?’
-‘আমি বলেছি তাই।’
-‘আপনি বললেই শুনতে হবে? আপনি কি আমার বাপজান?’
-‘আমি তোর কি জান পরে বুঝাচ্ছি। আপাতত হাঁটা ধর।’
-‘ না, থাকব এখানে। আপুর সঙ্গে আমারও একটা হিল্লে হয়ে যাক। আপনার অ’ত্যা’চা’র সহ্য হয় না আর।’
-‘চ্যালাকাঠটা বোধহয় সোফার নিচে রেখেছিলাম, তাই না রে?’
আবারও চ্যালাকাঠ! ইশ! প্রচুর লাগে। মা’রের কথা উঠেছে মানে বিশুদ্ধ পুরুষ কোনো কারণে রেগে আছে। তর্ক করলে সত্যি সত্যিই মে’রে দিতে পারে। তাই সে বোকা বোকা হেসে বলল,
-‘ইয়ে মানে মেলা পড়া বাকি আছে, যাই গা।’
একথা বলে শীতল সামনের সেন্টার টেবিলের উপরে থাকা শুদ্ধর ফোন
ওড়নার তলায় লুকিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। ফোনের লক জানে সে। কিছুক্ষণ আগেই আড়চোখে দেখেছে। মূল উদ্দেশ্য, সেদিনের সিগারেট খাওয়া ছবিটা ডিলিট করে শুদ্ধর দূর্বলতা খুঁজে বের করা। যেটা দেখিয়ে শুদ্ধকে হুমকি দেওয়া যাবে। কিন্তু সেটা হবে না বোধহয় কারণ যাওয়ার আগেই শুদ্ধ হঠাৎ বলে উঠল,
-‘ফোনটা রেখে যা।’
-‘আমি কি আপনার চাকর? নাকি আপনি আমার মালকিন যে, যখন যা বলবেন আমাকে তাই করতে হবে?’
-‘অহেতুক কথা বাড়াবি না নয়তো থাপড়ে গাল লাল করে দেবো, বে’য়া’দ’ব।’
-‘মে’রেই দেখুন বড় আব্বুকে বলে আপনকেও উচিত শিক্ষা দেওয়াব আজ। চুপ থাকি বলে সাপের পাঁচ পা দেখেছেন, তাই না?’
ড্রয়িংরুমে গেস্ট থাকায় শীতলের সাহস আজ আকাশচুম্বী। তার উপর বড় আব্বুও উপস্থিত আছে। সে জানে, বড় আব্বু উপস্থিত থাকাকালীন শুদ্ধনকিছু করবে না। এই সুযোগেই কোনোমতে ফোন হাতিয়ে ভাগতে হবে এখান থেকে। কিন্তু তার তর্ক করা দেখে শুদ্ধ তেড়ে যেতেই শীতল এক দৌড়ে মাঝ সিঁড়িতে উঠে দাঁড়াল। বড়রা তখনো নিজেদের কথায় ব্যস্ত। আশেপাশেও কেউ নেই। শুদ্ধ কাউকে ফোন ধরতে দেয় না। অর্থাৎ সে ফোনটা তাকেও নিতে দিবে না, এখন না নিলে চেক করাও হবে না।
একবার যখন হাতে পেয়েছে এই সুযোগ হাতছাড়া করাও উচিত হবে না। কথাখানা তার মস্তিষ্কে টোঁকা মারতেই সে কোনোকিছু না ভেবেই জামার ভেতরে ফোনটা ঢুকিয়ে নিলো। আপাতত এটাই যেন নিরাপদ জায়গা।
বিশুদ্ধ পুরুষ আর যাই হোক এবার আর কেড়ে নেওয়ার সাহস দেখাবে না। আর না নোংমির করতে এগিয়ে আসবে। এইটুকু বিশ্বাস তার আছে।
এদিকে তার কান্ডে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়েছে শুদ্ধ। এই মুহূর্তে বাকহারা সে। বিষ্ময় চোখে-মুখে। কিছু বলার আগে শীতল একদৌড়ে উপরে চলে চলে। এখান থেকে শোনা গেল দরজা আঁটকানোর শব্দ। আপাতত আজ আর বের হবে না সে। শুদ্ধ আর এগোল না, ঘুরে দাঁড়াল। মাথার ভেতর ভনভন করছে তার। মেয়েটা দিন দিন এত পাজি হয়েছে বলার বাইরে। না, একে সভ্য করা যাবে না বোধহয়। কয়েক ধাপ এগোতেই হঠাৎ তার
চোখ পড়ল সায়নের দিকে। দুই ভাইয়ের চোখাচোখি হলো। শুদ্ধ খেয়াল
করল সায়ন হাসছে। ঠোঁটজুড়ে যেন উপহাসের হাসি।
-‘পরিষ্কার দুটো থালায় তোমার খুব পছন্দের দুটো আইটেম রাখা। প্রায়
এক সপ্তাহের অনাহারী তুমি। পেটে ম’র’ণ ক্ষুধা। খাবারের ঘ্রাণে জিবটা লকলক করছে তোমার। খাবার দেখে ক্ষুধার মাত্রাও দ্বিগুন ছাড়িয়েছে।
সেই মুহূর্তে কি করবে তুমি? নোংরা হাত ধুঁয়ে মুছে সময় নষ্ট করবে নাকি আগেই সর্বগ্রাসী এক থাবা ব..সাবে?’
ফোনের ওপর পাশের লোকটি পুরো কথা শুনে খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল। কি বি’শ্রী হাসির শব্দ! ভয়ে গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতো
ভয়ংকর। তাকে এভাবে হাসতে দেখে এই পাশের লোকটি বিরক্ত হলো।মুখে বিরক্তিকর ‘চ’ জাতীয় শব্দ করে মনে মনে বিশ্রী গালি’ও ছুঁড়লো।
কোনোমতে হাসি থামিয়ে ইয়াসির নামের লোকটি এবার বলল,
-‘সাইন্টিস্ট ফমূর্লা দেয় নি বিধায় রেগে আছেন নাকি স্যার?’
-‘(…)।’
-‘ হা, হা। তা ভদ্র মহাশয়ের নামটা যেন কি?’
-‘শোয়াইব চৌধুরী শুদ্ধ।’
-‘বুঝলাম। তা আপনাদের ভদ্র লোকদের মাঝে আমার কাজ কি?’
-‘ সাইন্টিস্টকে তড়পাতে দেখার সাধ জেগেছে মনে, খেয়ে দাও।’
-‘ছ্যাহ্! কি বা’ল’ছা’ল কন এগ্লা? পোলা হইয়া পোলারে খামু? আমার রুচি এখনো এত নিচে নামে নাই স্যার। এই কাজ পারব না, অন্যরে দিয়া খাওয়ান।’
-‘তিনটেই কুমারি ফুল। দুই ভাইয়ের জন্য কড়া নজরের কারণে ভ্রুমর’ও তাদের কাছ ঘেঁষতে পারে নি। এবার তুমি দুটোকে খেয়ে যত্ন করে কলঙ্ক লাগাও দেখি।’
-‘উফফ, ইন্টেক মাল। তা এরা শোয়াইবের কে?’
-‘বোন।’
-‘ওহ। কিন্তু মাল সুন্দরী না হইলে মুড আসে না আমার। মুড না এলে কি খাওয়া যায়? আমি আবার আধপেটা খাওয়ার ছেলে না। পছন্দ হলে পুরোটাই খাই নয়তো ছুঁয়েও দেখি না।’
-‘তিনটেই চোখ ধাঁধানো সুন্দরী তবে ছোটোটা সবার থেকে এগিয়ে আছে।’
-‘নাম?’
-‘শীতল।’
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১৭
নাম শুনে ছেলেটা কল কেটে ফিচেল হাসল। তারপর ফোনটা অদ্ভুত কায়দায় পাঁচ আঙ্গুলের মাঝে ঘুরাতে ঘুরাতে মুখে উচ্চারণ করল, ‘শীতল রাণী, এবার আমি তোমায় খা..ব।’