শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১৯

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১৯
নূরজাহান আক্তার আলো

ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে টুকটাক কেনাকাটার জন্য বাজারে এসেছে স্বর্ণ। হাতে দু’টো শপিংব্যাগ। কড়া রোদে ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। মাঝারি সাইজের মোটা বেনুনিটা কাঁধের একপাশে অযত্নে ফেলে রাখা। বিরক্তিতে চোখ, মুখ কুঁচকে আছে। সরু নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম।
কড়া রোদের তাপে ফর্সা দু’গাল রক্তিমবর্ণ ধারণ করেছে।শখের পরীক্ষা থাকায় আজ একাই আসতে হয়েছে তাকে। নয়তো ঝামেলার কাজে খুব একটা জড়ায় না নিজেকে৷ এখন কতক্ষণে ঘুরে ঘুরে শীতলের জামার সঙ্গে ম্যাচিং করা ওড়না খুঁজে পাবে কে জানে। শুধু শীতলের নয় সিরাত তার ব্লাউজের ফলস আর সিঁতারা দিয়েছেন দুটো শাড়ি কিনতে, হালকা কালারের মধ্যে। শাড়ি দুটো অভাবী দুঃস্থ এক মাঝবয়সী মহিলার জন্য।

তাদের বড় মা প্রায় এভাবে দান করেন এ নতুন কিছু নয়। এইদিকে দিয়ে
মহিলার মন মানসিকতা অনেক ভালো। সে বাজারে যাবে শুনে সিমিনও
সুরে সুরে জানিয়েছে নরম দেখে রুমে পরা একজোড়া স্যান্ডেল আনতে।
ক’দিন ধরে উনার এক পার্ট স্যান্ডেল পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ধারণা করা যাচ্ছে, এই আকাম বাড়ির একমাত্র উড়নচন্ডী কন্যা শীতল’ই ঘটিয়েছে।
কারণ সে ইঁদুর, তেলাপোকা দেখলেই স্যান্ডেল দিয়ে মারতে যায়। মেরে ক্ষান্ত হলে ঠিক ছিল। কিন্তু না, সে ইঁদুর, তেলাপোকা মেরে সেটা আবার রেখে আসে যার উপর রাগ থাকে তার রুমের চিপায়। এটাই তার রাগের গোপন বর্হিপ্রকাশ’ও বলা চলে।
স্বর্ণের ঘুরে ঘুরে সবার কিছু কিনতে কিনতে দুপুর পেরিয়ে গেছে। ক্ষুধাও লেগেছে। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া বাইরের খাবার খায় না সে। এখনো খাবে না। একেবারে বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ভাত খেতে বসব। এসব ভেবে
চিপাগলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ব্যাগের ভেতরটা কেঁপে উঠল। ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে দেখে সে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কানে ধরতেই সায়ন বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘ জান, কোথায় রে তুই?’
-‘বাজারে এসেছি।’
-‘বাজারে কেন?’
-‘কাপড় চোপড় কেনার ছিল।’
-‘কেনা শেষ নাকি বাকি আছে?’
-‘প্রায়ই শেষ।’
-‘আসব আমি?’
-‘প্রয়োজন ছাড়া আসার দরকার নাই।’
-‘ ইয়ে জান শোন না? আমার জন্য দু’তিনটে শর্ট প্যান্ট কিনিস। বউয়ের পছন্দ করা শর্ট পরার ফিলিংস জেনে রাখা দরকার।’
-‘ লাল, নীল, হলুদ নয়তো গোলাপি কালার আনলে চলবে?’
-‘তুই আনতে পারলে আমিও পরতে পারব। পরে একেবারে তোর সামনে গিয়ে দাঁড়াব। এখন যা ভালো মনে করিস, আন। আমাকে সামলানোর দায়িত্ব তো তোরই, তাই না?’

-‘অ’স’ভ্য।’
-‘ধন্যবাদ। আচ্ছা শোন না জান, বাসায় ফিরে আগে ইনবক্স চেক দিস। কাঙ্খিত সারপ্রাইজ আছে।’
-‘ তুমি কি বাসায়?’
-‘বাসায় থাকলে কি হবে, দৌড়ে এসে চুমু দিবি?’
-‘ধরে নাও দিতাম।’
-‘বাসায় ছিলাম না তবে এখনই যাচ্ছি। তুইও তাড়াতাড়ি চলে আয় জান। তোর চুমুর অপেক্ষায় আমি।’

স্বর্ণ জবাব দিলো না খট করে কল কেটে দিলো। নয়তো এই পাজি ছেলে কথা বাড়াতেই থাকত। সে হাতের ব্যাগগুলো ধরে সামনে এগোতেই দৃষ্টি পড়ল একটি শাড়ির দিকে। ভীষণ সুন্দর শাড়িটি। কালো রঙা শাড়িটিতে গোল্ডেন পাড়। মেয়ে হলেও তার কেন জানি কেনাকাটা, সাজগোজ, খুব একটা পছন্দ নয়। যতটুকু না করলেই নয় ততটুকই করে। কারণ তার মতে, কেনাকাটা, সাজগোজ, শো অফ নিয়ে পড়ে থাকা ছাড়াও অনেক কাজ রয়েছে মেয়েদের জীবনে। সাজগোজ নিয়েই পড়ে থাকলে সফল হয়ে স্বপ্নছোঁয়ার আশায় এগোতে হবে না। যেখানে কষ্ট আছে, পরিশ্রম আছে, সেখানে সাফল্যও আছে শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।

সে শাড়িটার দিক থেকে নজর সামনে এগিয়েও ফিরে এলো। শখকে শাড়িটাতে বেশ মানাবে। মূলত শখের কথা মাথায় রেখে শাড়িটা কিনে নিলো সে। সঙ্গে নিলো ম্যাচিং ব্লাউজ। শখের চমৎকার গড়নের শরীরে শাড়িটি চমৎকার লাগবে। তাছাড়া এনগেজমেন্টের গিফ্ট হিসেবে কিছুই দেওয়া হয় নি বড় বোনকে। অথচ আহনাফ আর শখের এনগেজমেন্ট হয়েছে আজ প্রায় এক সপ্তাহ হতে চলল। সেদিন তাদের এনগেজমেন্ট করিয়ে দেড় বছর পর বিয়ের অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয় বড়রা। ততদিনে শখের পার্সপোট, ভিসাও রেডি হয়ে যাবে। অনুষ্ঠানের পরপরই আহনাফ শখকে নিয়ে চলে যাবে বাইরের দেশে। সেখানে গিয়েই শখ ডাক্তারী পাশ করবে। আহনাফ একথা জানালে সবাই পছন্দ হয় প্রস্তাবখানা। শখ অভিমান করে সম্মতি জানায়। মেয়ে রাজি দেখে বড়রা আর কিছু বলে না কারণ হাতে এখনো অনেক সময় আছে। এরমধ্যে যদি কারো মন পরিবর্তন হয় তাহলে অন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।

মোটকথা, ছেলে-মেয়ে দুটো যেভাবে ভালো থাকে দু’পরিবার সেভাবেই সিদ্ধান্ত নিবেন। এদিকে আহনাফেরও ছুটি শেষ।দুদিন পর তার ফ্লাইট। প্রতিবার দেশে এসে যাওয়ার সময় খারাপ লাগা কাজ করলেও এবার যেন দ্বিগুন খারাপ লাগছে তার। কষ্টও হচ্ছে। মনে হচ্ছে কলিজা ছিঁড়ে রেখে যাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে? শখের জন্য? মাত্রই ক’দিনের সম্পর্ক অথচ অনুভূত হচ্ছে তাকে ছাড়া এই জীবনই বৃর্থা। এই সপ্তাহের মধ্যে আরেকটা কাজ করা হয়েছে। আগে শখ আর স্বর্ণ একই রুমে থাকলেও এবার তাদের রুম আলাদা করা হয়েছে। আহনাফ রাত বিরেতে ফোন দেয়। কত কথা থাকে দু’জনের। বোনের সামনে কিছু কিছু কথা বলতে অস্বস্তি হয়। লজ্জা কাজ করে। অস্বস্তি থেকে বাঁচতে ফোন হাতে নিয়ে কখনো বাগানে যায় তো কখনো ছাদে। ব্যাপারটা সিঁতারাসহ
অনেকের নজরে পড়ে। পরে শুদ্ধ সরাসরি জানায় দু’বোনের একজনকে নিচ তলায় চলে আসতে। পরে শখ তল্পিতল্পাসহ চলে আসে নিচ তলায়।

এখন স্বর্ণ তার রুমে একাই থাকে আর এ কাজের ফায়দা উঠায় সায়ন।
সে রাত বিরেতে যখন তখন স্বর্ণের রুমে চলে আসে। তারপর লাটসাহেব হয়ে আদেশের ফোড়ারা ছুঁড়ে, এই জান পা জোড়া টিপে দে, মাথা টিপে দে, খেতে দে, আরো কত কি! কতবার বলেছে এভাবে যখন তখন রুমে না আসতে। কিন্তু তার কথা শুনলে তো? বারণ করলে উল্টে জেদ করে আসে।
নিত্যদিনের নানান ঘটনা ভাবতে ভাবতে শীতলের নাম্বার থেকেও ফোন এলো। কল রিসিভ করে কানে ধরতেই শোনা গেল তার চঞ্চল কন্ঠস্বর,

-‘এ্যাই আপু, আমার ওড়না পেয়েছো?’
-‘না, খুঁজছি।’
-‘আচ্ছা খুঁজো। আপু আমার জন্য একটা শাড়ি’ও এনো প্লিজ।’
-‘শাড়ি কি করবি?’
-‘পরব! আমি বাবাকে বলেছি বাবা এক্ষুনি তোমাকে বিকাশ করে দেবে।’
-‘আমি একটা শাড়ির ছবি পাঠাচ্ছি দেখ এমন ধরনের নিবি কি না?’
-‘দাও।’

শখের জন্য নেওয়া শাড়িটা শীতলকে দেখাতেই শীতল লাফিয়ে উঠল। ভীষণ পছন্দ হয়েছে তার। আবদার জুড়ে বসল তিনবোনের জন্য একই রকম শাড়ি কিনতে। তিনবোন একই শাড়ি পরে একসাথে ছবি তুলবে।
কিন্তু দুঃভাগ্যবশত কালো শাড়িটা স্টক আউট। অগত্যা শীতলের জন্য অনিয়ন কালার শাড়ি পছন্দ করল স্বর্ণ। তার ধারণা মতে, এই শাড়িতে শীতলকে ভীষণ আদুরে লাগবে। বোনের কথা শুনে শীতল লজ্জা পেল।
আবার বায়নাও ধরল, শাড়ির সাথে পরার জন্য চুড়ি, টিপ ম্যাচিং করে কিনে আনতে। স্বর্ণ বিরক্ত হলেও মেনে নিলো ছোটো বোনের আবদার। তারা কথা বলতে বলতে শাহাদত চৌধুরীর একাউন্ট থেকে টাকাও চলে এলো। স্বর্ণ শাড়ি পরে না। এ অবধি দু’একবার পরলেও কয়েক মিনিট পরে খুলে ফেলেছে। শাড়ি টাড়ি পছন্দ না তার। কিন্তু শীতলের জেদের কাছে হার মেনে তাকেও একটা শাড়ি নিতে হলো। সে নিলো ছাই রঙের
সুতি শাড়ি। তারপর টুকটাক আরো কিছু কেনাকাটা করে কয়েক ধাপ এগোতেই কনকের মুখোমুখি পড়ল। কনক তাকে দেখেই হাসি হাসি মুখে বলল,

-‘ভালো আছেন আপু?’
-‘হুম, আপনি?’
-‘আছি এক রকম।’
-‘কোথায় গিয়েছিলেন?’
-‘কাজ ছিল।’
-‘ওহ। কিছু কথা বলার ছিল আপু।’
-‘বলুন।’
-‘অংকন কোথায়?’
-‘অংকন কে?’
-‘হা,হা, সো ফানি। কড়া রোদে দাঁড়িয়ে ফান করতে ইচ্ছে করছে না যে আপু। অন্যদিন ফানের ফোরায় নিয়ে বসব নাহয়। আজ কাজের কথা বলি?’
-‘কাজ কিংবা অকাজ জানি না। সেই হিসাব করার সময়ও হাতে নেই।
তবে যার কথা জিজ্ঞাসা করছেন আমি তাকে চিনি না। তাই জানিও না উনি এখন কোথায়।’

-‘সায়ন ভাই তো জানে।’
-‘তাহলে সায়ন ভাইয়ের থেকে জেনে নিন, আসি। ‘
একথা বলে স্বর্ণ আর দাঁড়াল না। চোখ, মুখ শক্ত করে হাঁটা ধরল। তাকে যেতে দেখে কনক ঘাড় চুলকে শয়তানি হেসে বলল, শালি একটা চিজ বটে!’
একথা বলে হাসতে হাসতে প্রস্থান করল সে। স্বর্ণও সিএনজি ডেকে উঠে বসল তাতে। তারপর বাসায় ফিরে’ই ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই আঁটকা পড়লো কারো বাহুডোরে। পুরুষালি চেনা স্পর্শ পেয়ে নড়াচড়া করল না সে। বরং চুপটি করে সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। অনুভব করল একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষের ছোঁয়া। উন্মাদ পুরুষটিও সুযোগ বুঝে স্থির থাকতে পারল না। বরং নেশাগ্রস্তের মতো টেনে নিতে থাকল স্বর্ণের চুলের শ্যাম্পুর ঘ্রাণ, লতানো দেহের বিদেশী সাবানে ঘ্রাণ। হাতটা অবাধ্য হয়ে ঘুরতে লাগল কোমরে আশেপাশে। সিঁতারা, সিরাত, সিমিন চৌধুরী কিছুক্ষণ আগেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়েছে সিরাতার অসুস্থা মাকে দেখতে।

হঠাৎ মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে সিরাত কাঁদতে শুরু করে।সাফওয়ান
চৌধুরী মিটিংয়ে তার ফোনটা উনার কেবিনে। সাইলেন্ট অবস্থায় বেজে চলেছে। পরে মেজো জাকে সামলাতে উনারাও উনার সঙ্গে যান। উনারা রাস্তার মোড়ে যেতেই সায়নের সঙ্গে দেখা হয়। শখও চলে আসবে একটু পর। শীতল কলেজ থেকে ফিরে খেয়ে ঘুমিয়েছে বিধায় তাকে ডাকে নি।
বাড়ির গাড়িতে যাচ্ছে দেখে সায়ন সাবধানে যেতে বলে বাড়িতে ঢুকল। ড্রয়িংরুমে কেউ নেই দেখে উপরে চলে এলো। শীতলের রুমের দরজাটা
বন্ধ। পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে বোধহয় ঘুম কাতুরে পাগলিটা। আরেক কন্যা
কি ফিরেছে? নাকি বাজারেই রয়ে গেছে এখনো? স্বর্ণ ফিরেছে কি না দেখতে রুমে ঢুকে পানির শব্দ পেয়ে বুঝল সে ওয়াশরুমে। তাই অপেক্ষা করতে থাকল তার বের হওয়ার। দশ মিনিটের মাথায় বের হতেই স্বর্ণে আঁটকা পড়ল বাহুডোরে। গালে পেলে পুরুষালি ঠোঁটের স্পর্শ। গ্রাবীয় পেল খোঁচা খোঁচার দাড়ির খোঁচা। ধীরে ধীরে এই স্পর্শ গাঢ় হচ্ছে দেখে স্বর্ণ নিজেকে ছাড়াতে চাইল। কিন্তু সায়ন ছাড়তে অনিচ্ছুক। সে নিজের মতো করে স্বর্ণের শরীরে স্পর্শ লেপ্টাতে ব্যস্ত। স্বর্ণ জোরপূর্বক সায়নকে
নিজের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা চলমান রেখে বলল,

-‘সিগারেট খেয়ে আমার কাছে আসতে বারণ করেছিলাম না?’
-‘বারণ করলেই শুনতে হবে নাকি?’
-‘হুম, হবে।’
-‘উহুম, হবে না। বীর পুরুষরা সব সময় বউয়ের কথা শোনে না। শুনলে
অনেক ভুগতে হয়।’
-‘ক্ষুধা লেগেছে, ছাড়ো।’
-‘আমার’ও।’
-‘ফ্রেশ হয়ে এসো খাবার বাড়ছি আমি।’
-‘খাবার তো আমার হাতের মুঠোয়। কিন্তু খেতে আর পারছি কই? স্বর্ণ, জান আমার, চল না বিয়ে করে ফেলি?’
সায়নের হাল্কি গলায় বলা কথাশুনে স্বর্ণ নিজেকে ছাড়াতে জোরাজুরি শুরু করল। পাজি লোকটা আবার ফাজলামি শুরু করেছে। তাকে জোর প্রয়োগ করতে দেখে সায়ন ঠোঁট কামড়ে হাসল। স্বর্ণের পেট খামচে ধরে দুই গালে শব্দ করে চুমু খেল। তারপর কাঁধে মুখ ডুবাতেই রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে থমকে দাঁড়িয়ে গেল শখ। ওর ফোনের চার্জারটা নিতে এসেছিল আর এসেই যে এমন ঘটনার সাক্ষী হবে কল্পনাও করে নি সে।

রুমে তৃতীয় কারো উপস্থিতি টের পেয়ে স্বর্ণ, সায়ন, চোখ তুলে তাকিয়ে দ্রুতগতিতে ছিঁটকে দূরে সরে গেল। শখ নিজেও লজ্জা পেয়ে দৃষ্টিজোড়া রেখেছে মেঝের দিকে। একরাশ অস্বস্তিতে ডুবে কিছু বলার ভাষা পেল না শখ। দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি চলে যাবে বোধগম্য হলো না তার। আপন ভাইয়ের সঙ্গে চাচাতো বোনকে এমতাবস্থায় দেখে নিজেও বাক হারিয়ে ফেলেছে। এখন রুমে চলছে পিতনপতন নীরাবতা।কে কি বলবে বুঝতে উঠতে পারল না, তিনজনের কেউই। সায়ন বোনের কাছে ধরা খেয়ে চুপ
করে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাচ্ছে। আবার স্বর্ণের মুখ দেখে তার খুব হাসিও পাচ্ছে। সে আমতা আমতা করে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। এরপর মাথা চুলকে পাশ কাটিয়ে তার রুমে চলে গেল। ভাইকে যেতে দেখে শখ টেবিলের উপর থেকে চার্জারটা হাতে নিলো। একপলক তাকাল স্বর্ণের দিকে তারপর স্বাভাবিকভাবে বলল,

-‘আমি যা ভাবছি তাই?’
-‘হুম।’
অকপটে স্বীকার করে নিলো স্বর্ণ। না তার গলা কাঁপল আর না থতমত খেয়ে প্রসঙ্গ পাল্টানোর বৃথা চেষ্টা চালাল। শখও কথা বাড়াল না, হতেই পারে। যুগ আপডেট। কাজিন লাভ এখন কমন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারা যদি একে অপরের সঙ্গে ভালো থাকে থাকুক না, সমস্যা কি? তবে
বাড়ির লোক ব্যাপারটা কেমনভাবে নিবে এটা ভাববার বিষয়। তাছাড়া
শাহাদত চৌধুরী সায়নকে অপছন্দ করার কারণ খুঁজে পাবে বলে মনে হয় না। রাজনীতি করা নিয়ে একটু আপত্তি করলেও মনে হয় না রিজেক্ট করবে। মনে মনে একথা ভেবে ধরা খাওয়ার পর সায়নের মুখের বেহাল দশা স্মরণ করে ঠোঁপ টিপে হাসল শখ। বাড়তি প্রশ্ন করে আর কাউকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাইল না দেখে কথা বাড়ল না। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই স্বর্ণ ডাকল। ডাক শুনে সে ঘুরে তাকাতেই স্বর্ণ বলল,

-‘আপু, আপাতত কাউকে বোলো না।’
-‘কেন?’
-‘সময় হোক তখন নাহয় সবাইকে জানিও।’
-‘হুম।’

শুদ্ধ ঢাকা গেছে আজকে প্রায় চারদিন হচ্ছে। ঢাকা থেকে গত কালকের ফ্লাইটে গেছে সুইজারল্যান্ড। হঠাৎ সেখানে কেন, কি কাজ, কবে ফিরবে, এসবের কিছুই বলি নি সে। কথায় কথায় শুধু জানিয়েছে সেখান থেকে ফিরে একেবারে বাড়ি চলে আসবে। কিছুদিন পর রমজান মাস। পূর্বের দিনগুলো ঢাকায় থাকলেও এবারের পুরো রমজান পরিবারের সাথে’ই কাটাবে। পেশাগত দিক থেকে যা কাজ বাড়িতে থেকে সারবে। আপাতত আর কোথাও যাবে না।
একথা শুনে একজন বাদে খুশি বাড়ির সকল সদস্যা। সেই একজন আর কেউ নয় শীতল। কথাটা শুনে মুখ বাঁকিয়েছে। গালি দিয়েছে। আজকাল শুদ্ধ বাড়িতে ঘনঘন থাকছে যেটা ওর পছন্দ হচ্ছে না। পুরুষ মানুষ এত বাড়িতে থাকবে কেন? তারা বাইরে টইটই করবে নয়তো কাজে মশগুল থাকবে। তিনবেলা খেতে এলে এলো নয়তো কাজ সেরে একেবারে রাতে ফিরবে। যুগের পর যুগ পুরুষরা তো তাই করে আসছে। নারী থাকবে ঘর বন্দী আর পুরুষ থাকবে বাইরে। কারণ পুরুষতান্ত্রীক সমাজে পুরুষরাই সংসারের রাজা।
শখের বিয়ে ঠিকঠাক হওয়ার পর থেকে বাড়িতে আমেজ আমেজ ভাব।

খুশি খুশি রব চারদিকে। সুখ সমৃদ্ধি যেন ছড়ানো চৌধুরী নিবাসে প্রতিটি আনাচে-কানাচে। শখ প্রথম প্রথম অভিমান করলেও এখন সব মেনেও নিয়েছে। আহনাফের সঙ্গে কথা হয় রোজ। আহনাফ হুটহুাট করে দেখা করে চমকে দেয়। দু’জন ঘুরে। খায়। ছবি তোলে। সময় কাটায়। টুকটাক
কেনাকাটাও করে। তন্মধ্যে শীতল ইচ্ছেমতো শখকে পঁচায়। ছোটো হয়ে বড় বোনকে লজ্জা ফেলে দেয়। লজ্জার মাত্রা দ্বিগুন করতে কখন বলে আহনাফের বউ! একথা শোনামাত্রই শখ লাল হয়ে যায়। হাসি- আনন্দে এভাবেই তাদের দিনগুলো কাটছে। শুদ্ধ বাড়ি নেই, শীতল যেন মুক্তমণা পাখি। যার কাজ হচ্ছে স্বাধীন চিত্তে নেচে নেচে, ঘুরে ঘুরে বেড়ানো। এই ঘুরে বেড়ানোর খুশির সাধ ডাবল হয়েছে কারণ শুদ্ধ তার ফোনটা তাকে দিয়ে গেছে।

সেদিন শুদ্ধর ফোন ঘোঁটে তেমন কিছুই পায় নি। কয়েকটা ফাইল ছিল তাও লক করা। ছিল গ্যালারিতে শুদ্ধর ছবি, একঝাঁক সাদা ইঁদুরের ছবি, ল্যাবের জিনিসপত্রের ছবি, কিসব থিওরি টিওরি ছাড়া কিছুই পায় নি। পায় নি তার সিগারেট খাওয়া সেই ছবি টাও। অগত্যা আধাঘন্টা পর শুদ্ধর ফোনটা শুদ্ধর বিছানার উপর রেখে এসেছিল। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে শুদ্ধ যাওয়ার আগে তার রুমে এসেছিল। হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল,

-‘ধর।’
-‘কাকে দিবো?’
-‘রেখে তে।’
-‘কিহ্! আমাকে দিচ্ছেন? তাও আবার নিউ আইফোন? মাথা ঠিক আছে নাকি ভুলভাল কিছু খেয়েছেন, শুদ্ধ ভাই?’
একথা বলতে দেরি কিন্তু তার মাথায় গাট্টা পরতে দেরি হয় নি। শীতল ব্যাথায় মুখ কুঁচকে কিছু বলতে গেলে তাকে পুনরায় বলেছিল,
-‘কাজ কতদূর এগোলো আপডেট দিবি। ভুলেও যদি টিকটক করিস কিংবা টোকাই মার্কা বফ জুটিয়েছিস তোর খবর আছে।’
-‘সবই বুঝলাম। কিন্তু কিসের আপডেট দিবো?’
-‘আমার বিয়ের। ওই যে বিপদের চৌরাস্তার কথা ভুলে গেলি? পুনরায় মনে করাতে হবে?’
-‘না, না, মনে পড়ে গেছে। তা আপনি কি চলে যাচ্ছেন?’
-‘হুম।’
-‘কবে ফিরবেন?’
-‘বলতে পার়ছি না।’

শুদ্ধ চলে যাচ্ছে শুনে শীতলের চোখে মুখে খুশি ঝরে পড়ল। তার অবুজ মন খুশিতে ঝুমঝুম করে নেচে উঠল। একাধিচিত্তে গেয়েও উঠল, ‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।’ সে চাইলেও খুশির মাত্রা গোপন রাখতে পারল না গালভর্তি হেসে গদগদ হয়ে বলেই ফেলল,
-‘আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! যান, যান, সাবধানে যাবেন। এত তাড়াতাড়ি ফেরার দরকার নাই, কেমন? বয়স’ও তো হচ্ছে। এত ধকল নেওয়ার কি দরকার শুধু শুধু?’
শুদ্ধ ভ্রুঁ কুটি করে তাকাল। তার যাওয়ার কথা শুনে শীতলের খুশি যেন আর ধরে না। কত্ত বড় বে’য়া’দ’ব ভাবা যায়! কিন্তু তার এত খুশি শুদ্ধর সহ্য হলো না। মন চাইল থা’পড়ে গাল দু’খানা লাল করে দিতে। যাওয়ার
আগে মারল না তবে এত খুশিও দেখতে ইচ্ছে করল না। তাই সে হঠাৎ উৎফুল্ল বদনে দাঁড়িয়ে থাকা শীতলের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিলো।

ফোন কাড়তে দেখে শীতল আঁতকে উঠে চেঁচিয়ে বলল,
-‘আরে আরে নিয়ে নিলেন যে, এক্ষুণি না ফোনটা আমাকে দিলেন?’
-‘যার মধ্যে কৃতজ্ঞতা বোধ নেই তাকে কিছু না দেওয়াই উত্তম।’
একথা শুনে শীতল ভাবল শুদ্ধ বোধহয় হাসিমুখে বিদায় নিতে চাচ্ছে না। ফোনটা নিতে গেলে আগে বিশুদ্ধ পুরুষের মন গলাতে হয়। দরকার হলে কাঁদতে হবে, প্রচুর কাঁদতে হবে। কেঁদে কেঁদে ফোনটা হাতাতে হবে।
এদিকে নিচ থেকে সিঁতারার ডাক শুনে শুদ্ধ হনহন করে শীতলের রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ফোন হাতছাড়া হতে দেখে শীতলও পিছু পিছু গেল। তবে যাওয়ার আগে দুই চোখে গ্লিসারিন দিলো যাতে চোখে পানি আসে।

চোখের পানি সস্তা নাকি চাইলেই যখন তখন কাঁদা যায়! তারপর চোখ মুছতে মুছতে সে গিয়ে দাঁড়াল শুদ্ধর থেকে একটুদূরে। শব্দ করে নাক
টেনে কাঁদতে থাকল নিঃশব্দে। বাড়ির সবাই উপস্থিত হয়ে টুকটাক কথা বলছে। সিঁতারা পূর্বের মতো খাবার বেঁধে দিতে বক্স রেডি করছেন। এত বলে কয়েও উনাকে শুধরাতে পারে না শুদ্ধ। যতবার যাবে ততবার উনি বাঁধাবাঁধির ঝামেলা করবেই, করবে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ সিরাতের চোখ গেল শীতলের দিকে। শীতল এক কোণে দাঁড়িয়ে ওড়না দিয়ে চোখ মুছছে। চোখ, নাক লাল করে ফেলেছে কেঁদে কেঁদে।হেঁচকি উঠছে থেমে থেমে। মেয়েটাকে এভাবে কাঁদতে দেখে সিরাত বিষ্মিমিত সুরে বললেন,
-‘একি! কাঁদছিস কেন শীতল? কি হয়েছে তোর?’
-‘(….)’
-‘ পেট/মাথা ব্যথা করছে?’
-‘ন নাআ।’
-‘তাহলে এভাবে কাঁদছিস কেন মা? কিছু খাবি?’
-‘না।’
সকলের দৃষ্টি তখন শীতলের দিকে। একে একে কারণ জানতে এগিয়ে এসেছে তারা। পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইলে শীতল ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,

-‘শু শুদ্ধ ভাই চলে যাচ্ছে তাই আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতরটায় ধড়াস ধড়াস করছে।’
শীতলের মুখে একথা শুনে সকলে হতবাক। হতভম্ভ স্বয়ং শুদ্ধ’ও। একি আদৌও বিশ্বাসযোগ্য? যে মেয়ে কি না শুদ্ধর উপস্থিতি সহ্য করতে পারে না। বাড়ি এলে মনে মনে গালির ফোঁয়ারা ছুটায় সে কি না কাঁদছে শুদ্ধর জন্য! চোখের পানি দেখে বোঝার উপায় নেই মিথ্যা বলছে। কেন জানি সবাই সন্দেহের নজরে তাকাল শুদ্ধর দিকে। শুদ্ধ দুই ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে
দীর্ঘশ্বাস চাপল। কেউ বুঝুক না বুঝুক আসল কাহিনী বুঝেছে সে। তবুও কিছু বলার প্রয়োজনবোধ করল না। ড্রামা কুইন ড্রামা করবে এই আর নতুন কি! কিন্তু শীতলের কান্না দেখে সিরাত পুনরায় বললেন,
-‘স্বামী বিদেশ গেলেও তো কেউ এভাবে কাঁদে না।অথচ তুই কি না শুদ্ধর জন্য এভাবে কাঁদছিস? ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছে না মা।’

শীতল নাক টানল। চোখ মুছল। তারপর শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
-‘নিজের খেয়াল রাখবে। তাড়াতাড়ি ফিরবেন। ফোনটা দিয়ে যান খোঁজ খবর তো নিতে হবে নাকি?’
এবার সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। এবার কারোই বুঝতে বাকি রইল না আসল কাহিনী। সায়ন তো হো হো করে হেসেই ফেলল। অগত্যা শুদ্ধ সবার সামনে ফোনটা দিয়ে সাবধান করে দিলো,
-‘ফোন নিয়ে বাইরে যাবি না। টিকটক করার কথা মাথাতেও আনবি না।’
শীতল খপ করে ফোনটা নিয়ে ঘাড় কাত করে মুখভর্তি হাসল। অর্থাৎ সে
এসব কিছুই করবে না। তারপর শুদ্ধ সবার থেকে নিয়ে চলে গেল। ঢাকা গিয়ে শীতলের সাথে দু’একবার কথাও হয়েছে। শুদ্ধর জন্য মেয়ে দেখার ব্যাপারে সিঁতারাসহ সবাইকে ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কিছু বলেছে। কিন্ত
বাড়ির ছোটো সদস্য বলে তার কথা কেউ আমলে নেয় না। হেসে উড়িয়ে দেয়। ওদিক থেকে শুদ্ধ রোজ চাপ দিতে থাকে। ফোন দিয়ে কিছু বলার আগেই বলে, ‘বলেছিলি? মেয়ে দেখা শুরু করেছে?’ শীতল খুব বিরক্ত হয়। বিয়ে পাগল ছেলে নিজের বিয়ের কথা নিজে বলে না। অথচ তাকে
বাঘের মুখে ঠেলে দেয়। কিন্তু কি আর করার হাল ছেড়ে দিলে তো চলবে না গ্যাঁড়াকলে ফেঁসে গেছে সহ্য করতেই হবে।

দেড় ঘন্টার মতো ঘুমিয়ে বিছানা ছাড়ল শীতল। তারপর কিয়ারাকে বের হতে বলে নিজেও কোচিংয়ের উদ্দেশ্যে বের হলো। মুখে মিটিমিটি হাসি।
নতুন ফোন, নতুন সিম, নতুন ফেসবুক আইডি পেয়ে খুশি যেন ধরে না।
কোচিংয়ে গিয়ে সে সবার আগে কিয়ারের আইফোন দেখাল। ভাব নিয়ে ছবিও তুলল দুই বান্ধবী। তারপর কোচিং শেষে বের হয়ে দেখে কিয়ারার বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। কিয়ারার মামাতো বোনের জন্মদিন তাই এখান থেকে সোজা মামাবাড়ি চলে যাবে তারা। শীতলকে সাবধানে যেতে বলে কিয়ারা চলে গেল তার বাবার সাথে। শীতলও সাবধানে রাস্তা পার হলো।
সামনের মোড়ে রিকশা পাওয়া যাবে। সন্ধ্যা’ও ঘনিয়ে এসেছে প্রায়। সে মোড়ের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কিছু লোক তার পথ আঁটকে দাঁড়াল। অচেনা ছেলেপুলে দেখেও মিষ্টি করে হেসে শুধাল,

-‘কিছু বলবেন ভাইয়া?’
-‘শুদ্ধ ভাই আমাদেরকে পাঠিয়েছে আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।’
-‘কোথায় শুদ্ধ ভাই?’
-‘সামনের একটা রিসোর্টে উনার ফ্রেন্ডের বার্থডে পার্টি হচ্ছে তাই ভাই আপনাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে।’
-‘ঢপ মারছেন না তো?’
-‘কি যে বলেন না ছোটো আপু। সেই সাহস কি আর আমাদের আছে?’
-‘আপনারাও শুদ্ধ ভাইকে ভয় পান বুঝি?’
-‘তা তো একটু পাই।’
একথা শুনে শীতল খিলখিল করে হেসে উঠল। শুদ্ধকে ভয় পায় এমন লোক’ও আছে দেখে ভালোই লাগল। ছেলেগুলো তার সঙ্গে গল্প করতে করতে গাড়ির কাছে গেল। সামনে রাখা কালো গাড়িটায় উঠতে ইশারা করে বলল,
-‘আপু আপনি বসেন আমরা এক্ষুণি আসছি।’
-‘আচ্ছা ভাইয়া।’

ছেলেগুলো একটুদূরে দাঁড়িয়ে কাকে যেন ফোন করল। কল রিসিভ না করায় কল দিতেই থাকল। নিজেরা গুজুরগুজুর করে সামনের দোকান থেকে সিগারেট কিনলো। তাদের মতিগতি খেয়াল করে শীতলের কেমন যেন লাগল। কোথায় নিয়ে গেলে সায়ন, শুদ্ধ নিজে নিয়ে যায়। কখনো তো কাউকে পাঠায় না তাহলে আজ কেন? তাছাড়া তার জানামতে শুদ্ধ দেশের বাইরে আছে। দেশের বাইরে থেকে কিভাবে বার্থডে পার্টি এটেন্ড করবে? এসব ভেবে তার মাথা ঘুরতে লাগল। অজানা এক ভয়ে হাত পা
কাঁপতে থাকল। বিপদের আভাষ পেয়ে ছেলেগুলোর দিকে নজর রেখে ডাটা অন করে কল দিলো শুদ্ধর নাম্বারে। তিনবারের বেলায় শুদ্ধ কল রিসিভ করতেই শীতল হড়হড় করে বলল,

-‘শুদ্ধ ভাই, আপনি কি আমাকে নিয়ে যেতে লোক পাঠিয়েছেন?’
-‘কই না তো। আমি কেন লোক পাঠাব?’
-‘ তাহলে একদল ছেলে এসে যে আপনার নাম বলল। আপনি নাকি আমাকে নিয়ে যেতে তাদের পাঠিয়েছেন।’
-‘এখন কোথায় আছিস তুই?’
-‘একটা কালো গাড়িতে বসে আছি।’
-‘ চেনা নেই, জানা নেই, কার গাড়িতে উঠে বসেছিস? কেউ কিডন্যাপ করতে যায় নি তো আবার?’
-‘ কিড..ন্যাপ! কিডন্যাপ করবে মানে? কি বলছেন এসব? এখন উপায়? আমি কি তাহলে অজ্ঞান হয়ে যাব?’
-‘ অজ্ঞান হয়ে যাবি মানে?’
-‘ গুন্ডারা ধরতে এলে সিনেমায় নায়িকারা যেভাবে অজ্ঞান হয়ে যায় ওভাবে।’
-‘এটা বাংলা সিনেমা পাস নি। পালা বে’য়া’দব। এক্ষুণি গাড়ির দরজা খুলে দৌড় দে।’
-‘ওরা তো গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে।’

-‘যেভাবেই হোক তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যা শীতল।’
এতক্ষন ব্যাপারটা সহজভাবে নিলেও এবার শীতলের ঘাম ছুটে গেল।
শুদ্ধর কথা বলার ধরণই বলে দিচ্ছে সে মজা করছে না, লোকগুলোকে সে পাঠায়ওনি। অর্থাৎ পুনরায় নিজের বোকামি নিজেই ফেঁসে গেছে সে। কিন্তু এরা কারা? তাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়? সে ভয়ে ভয়েই বলল,
-‘ভ..ভয় লাগছে শুদ্ধ ভাই।’
-‘ভয় নেই। গাড়ির জানালা দিয়ে দেখ আশেপাশে লোকজন আছে কি না। যদি থাকে সেদিকে দৌড়ে যা। আমি এক্ষুণি ভাইয়াকে যেতে বলছি।

শুদ্ধর চিন্তিত কন্ঠস্বর। শীতলের ভয়ার্ত কন্ঠস্বর শুনে তার বুকের ভেতর কেমন করে যেন মোচড় দিয়ে উঠছে। কপাল বেয়ে সরু ঘাম ঝরতে শুরু করল। তবুও শীতলকে স্বাভাবিক রাখতে বলেই গেল,
-‘শীতল, হ্যালো, হ্যালো আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস? ফোন বন্ধ করিস না। যেভাবেই হোক ফোনটা যেন অন থাকে। প্রয়োজনে ফোন সাইলেন্ট করে সেদিনের মত সেইভ জনে লুকিয়ে রাখ।’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১৮

একথা বলতে না বলতে কয়েকজনের কথা শোনা গেল। বুঝল শীতলের সঙ্গে হাতাহাতি হচ্ছে ওদের। শীতল সমানে চেঁচাচ্ছে, ‘বাঁচান, শুদ্ধ ভাই! এরা সত্যি সত্যিই আমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছে। শুদ্ধ ভাই এরা আমাকে..!’
শীতলের পুরো কথাটা শোনা গেল না এরপরই ফোনটা অফ হয়ে গেল।
কোনোভাবেই না ফোনে কল ঢুকল আর না লোকেশন ট্র্যাক করা গেল।

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২০