শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২১

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২১
নূরজাহান আক্তার আলো

_’মেয়েটা কই?’
_’ গাড়িতেই আছে।’
_’কিছু করিস নি তো তাকে?’
_’না স্যার।’
_’আমার খাবার সে। ভুলেও টাচ্ করবি না ওকে।’
_’জি স্যার।’
_’ওর ফোন আর ওকে গাড়িতে রেখে পালা দেখি এবার।’
_’কেন স্যার? কুমিল্লা যাব না?’
_’ওর বাপ ভাইরা আসছে তোদের পেছনে বা’টা’ম দিতে। বা’টা’ম নিতে পারলে গাড়িতেই বসে থাক। বাই দ্যা ওয়ে, আমি কিন্তু চিনি না তোদের, বাই।’

একথা বলে কল কাটতে গিয়েও থেমে গেল ইয়াসির। কিছু একটা ভেবে
ঠোঁট কামড়ে হাসল। ছবিতে দেখা মেয়েটাকে মন ধরেছে। হাত নিশপিশ করছে ছুঁয়ে দেখতে। শরীরের গঠন অস্থির! দেখেই মনে হচ্ছে পুরুষালি হাত পড়ে নি লতানো দেহে। বাবা ভাই যে খুব আদরে বড় করেছে সেটা দেখেই বোঝা যায়। তবে নারী যখন হয়েছে পুরুষ তো ছুঁবেই। আদরের ছাপ পড়বেই তার সর্বাঙ্গে। পুতুলটাকে যখন খুবলে খাবে তখন কি আর
এমন স্নিগ্ধ রুপ থাকবে? থাকবে না রে, থাকবে না! এতদিন যত মেয়ের গায়ে তার হাত পড়েছে সেই মেয়েই মারা গেছে। কেউ বা মরেছে স’ঙ্গ’ম চলাকালীন কেউবা মাত্রারিক্ত র’ক্ত ক্ষরণে। এখানে তার তো দোষ নেই। সব দোষ মেয়েগুলোর। তারা কেন তার রুডলি আদর নিতে পারে না? মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছে পুরুষের আদর কেন নিতে পারবে না, কেন?
যারা পারে না তাদের ম’রে যাওয়াই ভালো। এত নরম সরম মানবীদের জন্য এই পৃথিবী নয়! তাকে চুপ থাকতে দেখে ছেলেটি ভয়ে ভয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

_’ওরা খোঁজ পেল কিভাবে, বস?’
_’ কাদের বাড়ির মেয়ে তুলেছিস খোঁজ নিস নি? না নিলে নিস নে। তবে
এটা কেবল ট্রেইলর ছিল সিনেমা এখনো বাকি। গা ঢাকা দে। যতদিন না আমি বলব ততদিন বাইরে বেরোস না। নয়তো সায়ন, শুদ্ধ তোদের একেকটাকে ধরে এমন ঠা’প দিবে বাপ বলাও সময় পাবি না।’
-‘সায়নকে নিয়ে ভয় আছে তবে শুদ্ধকে তো ওইরকম মনে হয় নি।’
-‘সায়নের থেকেও শুদ্ধ ডেঞ্জারাস। সায়ন প্রকাশ্যে খেলে আর শুদ্ধ চাল বুঝে দান ফেলে। মা’দা’র’চো’দ আরেকটা চিজ বটে।’
_’কথার কথা এক কথা আমরা ফেঁসে যাব না তো বস?’
_’আমি কি করে বলব? ফাঁসবি নাকি কি করবি তোরা জানিস। তবে হ্যাঁ আমার সাথে চা’লা’কি করতে যাস না। চা’লা’কি তোমাদের পেছন দিয়ে ভরে দেবো। ‘আউচ’ করারও সময় দেবো না। মনে রাখিস, আমি এসবে দারুণ এক্সপার্ট।’

একথা বলে ইয়াসির কল কেটে দিলো। ছেলেগুলো একে অপরের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত হয়। তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে ফাঁকতালে নিজেই কেটে পড়ছে। আবার শীতল কন্ঠে থ্রেট’ও দিচ্ছে নাম না বলার জন্য। এ লোক ঠান্ডা মাথার খুনি প্রথমে বুঝতে পারে নি। বোঝার উপায় নেই কারণ এই লোক ডিলার নয়। তাদের সাথে ডিল করেছে অন্যকেউ। ‘অন্যকেউ’ সেই মানুষটাকেও চেনে না। মোটকথা, টাকার পোকা তারা। যার থেকে টাকা পায় তার হয়েই কাজ করে। তাছাড়া কিডন্যাপ কেস এই প্রথমবার তাও নয়। পূর্বেও বহু জনকে করেছে। হাত-পা লুলা করে বাড়ির সামনে ফেলে এসেছে। কাউকে মে’রে গুম করে দিয়েছে। কাউকে বা টাকার বিনিময়ে প্রাণ ভিক্ষা দিয়েছে। এসব কাজ বহুবার করেছে বলেই চৌধুরী বাড়ির মেয়ে তুলতে এতকিছু ভাবে নি। এখন মনে হচ্ছে এবার চালে ভুল করে ফেলেছে। তাদের খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল। সায়ন পশু কুরবানি করার মতো মানুষ জবাই করে। শুদ্ধও নাকি কম না। এমন ভয়ংকর ভাইয়দের আদুরে বোনকে তুলেআনা উচিত হয় নি। এখন নিজেরাই না মারা পড়ে।
নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছে বড়লোকগুলো গিরগিটি হয়। সময়ে সময়ে রং বদলায়। ইয়াসিরের মতো নি’মো’কহা’রা’ম টাইপের হয়। কাজ করিয়ে পরে তাদেরকেই চিনতে পারে না। অগ্রিম টাকা নিয়েছিল বিধায় নয়তো টাকা ছুঁড়তো শা’লা ইয়াসিরের মুখে। এখন কিছুটি করারও নেই।

বাঁচতে চাইলে, চোখ বুজে জান নিয়ে পালাতে হবে।
বিরবির করে এসব বলতে বলতে তারা গাড়ি থেকে বের হলো। ফেনীতে ঢুকতে পারে নি এখনো। এটা কোন জায়গা ধারণা করতেও পারল না। আশেপাশে রাস্তা আছে বোধহয় গাড়ি চলাচলের শব্দ আসছে। পাঁচজন গাড়ি থেকে নেমে তাকাল অবচেতন শীতলের দিকে। থাপ্পড়ের আঘাতে
মেয়েটার ঠোঁট ফেটে র’ক্ত বেরোচ্ছে। কপালে কালশিটে। ফর্সা দুই গালে থাপ্পড়ের দাগ। দলের ছেলেগুলোর একজন শীতলকে পরখ করে দাঁত বের করে হেসে বলল,
_’মাম্মা, মাইয়া কিন্তু বহুত সুন্দরী। এমন জিনিস ফেলাইয়া যাইতে মন চাইতেছে না। খাইতে না পারি একটু চটকাতে তো পারি, তাই না ক?’

_’বা’ই’ন’চো’দ তুই চটকা। আমরা যাই গা। হের বাপ-ভাইয়ে আইতাছে। হের ভাইরে তো চিনো না শালা, সেই জল্লাদ। চোখের পলকে কল্লা কাটে। তর ক’ল্লা’ও কা’ই’ট্টা তোর মায়েরে তবারক হিসাবে পাঠাইয়া দেবে নে।’
-‘সব জাইন্না হের বুইনরে উঠাইছিলি ক্যান তাইলে? তর কথায় আইসা এহন দেখি সত্যি সত্যিই ম’র’তে হইব বা’ল।’
-‘আমিও জানতাম না পরে জানছি। তয় হের বড় ভাইয়ের রের্কড ভালো না। বহুত ডেঞ্জারাস আছে। হাতে পরলে জান শ্যাষ। মাম্মা হাঁটোন ধর। বাঁইচ্ছা থাকলে মেলা মাইয়া পাবি।’
একথা বলে থামতেই খেয়াল করল আরেকজন শীতলের আইফোন ধরে নেড়েচেড়ে দেখছে। চোখে লোভাতুর দৃষ্টি। একদম নিউ ফোন। মাইয়ার বাপে বোধহয় মেলা বড়লোক নাহলে এইটুকুন মাইয়ারে কেউ আইফোন দেয়? তারও মেলাদিনের শখ একটা আইফোন কিনার। আইফোন যা ছবি আসে না, পুরাই অস্থির!ওর মনের অবস্থা বুঝে পাশেরজন ফোনটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিলো। তারপর গাড়ি থেকে স্যানিটাইজার নিয়ে রুমালে মাখালো। এরপর রুমাল দিয়ে ফোনটা ভালো করে মুছে অন করে ছুঁড়ে মারল শীতলের দিকে। তখনই ফোনটার আলো জ্বলে উঠল। একের পর এক ফোনকল আসতে থাকল। কখনো বাবা, মা, সায়ন ভাই, বড় আব্বু, সবথেকে বেশি কল এলো বিশুদ্ধ পুরুষ নামে সেভ করা নাম্বারটি থেকে।

কলের বহর দেখে তারাও বুঝে নিলো এই নাম্বার ট্র্যাক হচ্ছে/হতে পারে।
এই কথা স্মরণে আসতেই তারা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে প্রাণপণে
ছুটতে শুরু করল। পাঁচজন ছেলে ছুটতে ছুটতে আঁধারে মিলিয়ে গেল।
আর অবচেতন শীতল সেভাবেই পড়ে রইল। একটা কালো বিড়াল এসে ঘুরঘুর করে গেল। দেখে গেল কারো বুকের ধন জ্ঞান হারিয়ে অন্ধকারে পড়ে আছে।
ওদিকে মেয়ের চিন্তায় সিমিন চৌধুরীর প্রেসার বেড়ে গেছে।কোনোভাবে প্রেসার কমছে না। অসহায় সুরে কেঁদেই যাচ্ছে আর দোষারোপ করছেন নিজেকে। কেন মেয়েটাকে সঙ্গে নিলেন না? কেন কোচিং যেতে বারণ করলেন না? কোথায় গেল মেয়েটা? কে নিয়ে গেল উনার জানপাখিকে? তারা কি কিছু খেতে দিয়েছে কিছু নাকি কষ্ট দিচ্ছে? এভাবে একের পর এক বিলাপ করেই যাচ্ছেন। উনাকে কোনোমতে থামাতে না পেরে শখ পরপর দুটো ইনজেকশন পুশ করে দিলো। সিমিন চৌধুরীও ধীরে ধীরে থেমে গেলেন। কিছুক্ষণ পর প্রেসার কনট্রোলে এলে উনার চোখেও ঘুম নেমে এলো। বাড়ির সকলে তখনো চিন্তায় অস্থির। বাঁচাল মেয়েটা ঘন্টা খানিক হলো বাসায় নেই তাতেই বাড়িটা যেন থমকে গেছে।

প্রায় আড়াই ঘন্টা পর একটি গাড়ি এসে থামল শীতলের গাড়ির পেছনে।
লোকেশন এখানেই শো করছে অর্থাৎ শীতলের ফোনটা এখানেই আছে।
সায়ন কোমরে পিস্তল গুঁজে গাড়ি থেমে নামল। একটাকেও যদি ধরতে পারে জান খুবলে খাবে। কত্ত বড় কলিজা ওজন করে দেখবে। গজগজ
করতে করতে সে খেয়াল করল পুরো জায়গাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। লোক শূন্য এরিয়া। শীতল ছোটো থেকে অন্ধকারে থাকতে পারে না। অন্ধকারে ফোবিয়া আছে তার। সে ফোনের ফ্ল্যাশ অন করে গেল গাড়িটির কাছে। আশেপাশে কেউ নেই। ঝোঁপের ঝাড়ে ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। গাড়ির দরজাও খোলা। হাতে পিস্তল নিয়ে খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে তাকিয়েই বুকটা ছলাৎ করে উঠল তার। আদরের বোনের এই অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে গেল সে। ছুটে গিয়ে বুকে আগলে নিলো শীতলকে। গাল চাপড়ে আদুরে সুরে ডাকতে লাগল,

_’শীতল! বোন আমার। এই জানবাচ্চা তাকা। তাকা আমার দিকে?’
_(…)’
_’বোন? শুনতে পাচ্ছিস? চোখ খোল না। ভাইয়া এসে গেছি। ভয় নেই।’
_ ‘(…)’
শীতলের কোনো সাড়া নেই। সায়ন এবার চেঁচিয়ে আজমকে বলল গাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি পানি আনতে। আজম পানি নিয়ে এসে পানির ঝাপটা দিলে। এবারও ব্যর্থ। ফোনের আলোতে আঘাতের চিহ্ন নজর এড়াল না তার। তখন আজম আমতা আমতা করে বলল,
-‘ভাই, আপুরে হাসপাতাল নিয়া যাওন লাগব। খা’ন’কি’র পোলাগোর বিশ্বাস নাই হেরা আপুরে কিছু খাওয়াতেও পারো। দেরি করন যাইব না চলেন, উঠেন, যাই গা।’
-‘হুম, হুম, তাই চল।’
একথা বলে উঠতে গেলে শীতলের পাশে থেকে ফোনের আলো জ্বলে উঠল। ফোনের ডিসপ্লেতে ভাসছে একটি নাম, ‘বিশুদ্ধ পুরুষ।’ সায়ন
ভালোই করে জানে কে সে। কলের বহর দেখে বুঝতে বাকি রইল না অপর পাশের মানুষটিও অস্থির। বিচলিত। চিন্তিত। তাকেও শান্ত করা জরুরি। তাই সে শীতলকে আগলে রেখে ফোনটা রিসিভ করল। তখন শুদ্ধর বিচলিত কন্ঠস্বর শোনা গেল,

_’হ্যালো! শী..শীতল, আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস? হ্যালো!’
_’শুদ্ধ, আমি ভাইয়া বলছি। ওকে পেয়ে গেছি। বাসার দিকে যাচ্ছি গিয়ে কথা বলছি।’
_’ও..ও ঠিক আছে ভাইয়া?’
_’হুম।’
_’সত্যিই ঠিক আছে? ওকে ফোনটা দাও।’
_’সেন্সলেস।’
একথা শুনে শুদ্ধ চুপ হয়ে গেল। এরপর থমথমে গলায় বলল,
_’সেন্স এলে পোর্ট্রেট আর্টিস্ট (যারা মানুষের মুখাবয়ব আঁকে )ডেকে স্কেচ করাবে। পাঁচ, দশ, যতজনই হোক তোমার বোনকে বলবে তাদের মুখাবয় মনে করে আর্টিস্টকে জানাতে। আমার স্কেচ চাই মানে চাই-ই।’
_’হুম।’
_’ওর শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে বাড়ির দিকে যাওয়ার দরকার নেই। আপাতত ফুপির বাসায় যাও। ফুপিকে আমি জানিয়ে রাখছি। ‘
_’রিলেক্স ভাই! দেখে মনে হচ্ছে, ওইরকম কিছু ঘটে নি। ভয়ে সেন্সলেস বোধহয়। আপাতত হাসপাতালের দিকে যাচ্ছি, রাখছি।’

একথা বলে সায়ন কল কেটে ফোনটা পকেটে রাখল। শীতলকে কোলে নিয়ে বের হলো গাড়ি থেকে। তার গাড়িতে বসে আজমকে বলল গাড়ি জোরে টান দিতে। আজম সায়নের কথামতো তাই করল। সায়ন তখনো শীতলের জ্ঞান ফেরাতে মুখ পানি দিচ্ছে। কখনো ডাকছে। না, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। তখন মনে হলো বাড়িতেও খবরটা জানানো দরকার। খুব টেনশনে আছে সবাই। তাই সে স্বর্ণকে অল্প কথায় মেসেজ করে জানিয়ে দিলো। তারপর ছুটল আশেপাশের কোনো হাসপাতালে। শীতলের আগে জ্ঞান ফেরানো দরকার। এদিকে সায়নের কথায় শুদ্ধের বুক থেকে যেন পাথর নেমে গেল। ধপ করে বসল বিছানায়। গা ঘেমে একাকার অবস্থা।

পরনের অ্যপ্রোণ খুলে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ সেভাবেই শুয়ে থেকে বুকের বাঁ পাশে হাত বুলিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলো। এতক্ষণ দমটা বুঝি গলায় আঁটকে ছিল। তবে ঘটনাখানা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারল না। কেন জানি তার মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছে করে কাজটা করল। সংকেত নতুবা সর্তকবার্তা দিতে। কিডন্যাপ করে নির্জনরাস্তায় নিয়ে গিয়ে ফোন অন করে রাখার ব্যাপারটা আরো বেশি অস্বাভাবিক লাগছে। এটাও তো দেখতে হবে, কার কলিজায় বার চড়েছে যে চৌধুরী বাড়ির মেয়ের দিকে হাত বাড়ায়, কে? ব্যাপারটা ছোট করে দেখলে হবে তো না। নিশ্চয়ই এর পেছনে কেউ আছে। তবে সে কে? কি বা তার উদ্দেশ্যে?
মেয়েকে পাওয়া গেছে শুনে শাহাদত চৌধুরী এই খবর জানিয়ে দিলেন। যেসব পুলিশ উপর মহলের আদেশে রাস্তায় নেমেছিল তারা ফিরে গেল।

ট্রাফিক পুলিশদের কাছে বার্তা পৌঁছে গেল। ঘন্টাখানিকের মধ্যে যেমন তৎপর হয়ে পড়েছিল তেমনি সবাই থেমে গেল। সবকিছু পাওয়ার। হাতে
পাওয়ার থাকলে সব সম্ভব, সব। যেখানে থানায় গেলে ২৪ ঘন্টার আগে মিসিং কেস নেয় না। সেখানে এক ঘন্টার মধ্যে ঢাকা থেকে ফেনীর রাস্তা ব্লক করে ফেলেছে পুলিশ/ট্রাফিক।
সায়নের অবস্থান জেনে উনিও ছুটলেন আদরের মেয়ের কাছে। সায়ন
ততক্ষণে শীতলকে একটা হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। রেপ কেস ভেবে ডাক্তারটা প্রথম হাত দিতে চাচ্ছিলেন না।

পরে ডাক্তারকে বোঝানো হয়েছে পারিবারিক ক্ষোভ মিটাতে কিড’ন্যা’প করা হয়েছে। রেপ কেস না, রাগের মাথায় আঘাত করা হয়েছে। ডাক্তার আরো কিছু বলতেন কিন্তু শাহাদত চৌধুরীর পরিচয় পেয়ে দমে গেলেন।
দ্রুত সেবা প্রদানের আধাঘন্টা পর শীতলের জ্ঞান ফিরল। নিজেকে পেল হাসপাতালের বিছানায়। উঠতে গেলে টান খেল হাতে। বা হাতে স্যালাইন চলছে। সে চোখ ঘুরিয়ে দেখল পুরো কেবিন। কে আনল এখানে? আর ছেলেগুলো কই? ফো..ফোনটা কই? ফোন হারালে শুদ্ধ আধমরা করে দেবে? অনেক কেঁদে কেঁটে ফোনটা হাতিয়েছিল সে। আশপাশ তাকিয়ে ফোন না পেয়ে নাক টেনে কাঁদতে লাগল। শরীরের আঘাতের চেয়ে তার ফোন হারানোর যন্ত্রণা সবচেয়ে বেশি। আঘাতের ব্যথা মেডিসিন নিলেই সেরে যাবে কিন্তু ফোন হারালে শুদ্ধর খোঁচামার্কা আজীবন শুনতে হবে।

ছোটো বেলায় অবুঝ শিশু ছিল। তখন কোলে হিসু করে দিতো এই নিয়ে এখনো কথা শুনতে হয়। এখন বড়বেলা। এবার আর রক্ষে থাকবে না।
সায়ন কি ভেবে কেবিনে উঁকি মেরে দেখে শীতল কাঁদছে। বোন কাঁদছে দেখে হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে ঢুকল সে। ব্যথা বেড়েছে? নাকি কাউকে না
দেখে ভয়ে কাঁদছে? আগে মেয়েটাকে স্বাভাবিক করতে হবে! কথা বলে ভয় কাটাতে হবে। তাই সে গালভরে হেসে বলল,

-‘কি রে ছুটকি কাঁদছিস কেন? ক্ষুধা পেয়েছে?’
-‘আমার ফোন কোথায় সায়ন ভাই?’
-‘আমার কাছে।’
-‘কই দেখি? উফ, বাঁচলাম! নাহলে শুদ্ধ ভাই আমাকে মেরে আধমরা করে দিতো।’
-‘কি আশ্চর্য! তুই এতক্ষণ ফোনের জন্য কাঁদছিলি?’
-‘হুম।’
একথা শুনে সায়নের হাসি পেলেও নিজেকে সামলে নিলো। তার পকেট থেকে ফোন বের করে শীতলের হাতে দিলো। ফোন পেয়ে শীতল কল দিলো শুদ্ধকে। শুদ্ধ যেন এই কলের আশাতেই এতক্ষণ। চট করে কল রিসিভ করে দেখতে পেল শীতলের মুখ। তীক্ষ্ণ নজরে দেখে গেল ঠোঁটের পাশ, কপালের কালশিটে। তখনই কানে এলো শীতলের চঞ্চল কন্ঠস্বর,

-‘শুদ্ধ ভাই! ফোন হারায় নি।’
তার কন্ঠে অবাধ খুশি। ফোন না হারানোয় যেন বিশ্বজয় করে ফেলেছে। শুদ্ধ চুপ করে দেখল সেই খুশি। আগে ছিল আধাপাগল আঘাত পেয়ে ফুল পাগল হলো নাকি কে জানে। নয়তো এই অবস্থায় ফোনের চিন্তা কে করে? তখন শীতলই বেশ গর্ব করে বলল,
-‘শীতলের থেকে ফোন কাড়া এত সোজা না, বুঝলেন?’
-‘বুঝলাম। তবে হারালে তোকে কি যে করতাম।’
-‘কি করতেন?’
-‘তোকে কুচিকুচি করে কেটে, ধুয়ে, মশলা মাখিয়ে বিরিয়ানি রান্না করতাম। নাম দিতাম ব্যাঙাচি বিরিয়ানি। তারপর বিলিয়ে দিতাম। ছোটো বাচ্চারা খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে আমার জন্য দোয়া করতো।’
-‘অ’ন্যা’য়! ঘোর অ’ন্যা’য়! আমার একটা নাম আছে শুদ্ধ ভাই। আপনি সেই নামকে এভাবে অপমান করতে পারেন না। দু’দুটো খাসি কেটে দাদু আকিকা দিয়ে নাম রেখেছে আমার। আর আপনি কি না সেই নাম গুম করে আমাকে ব্যাঙাচি নামে নামকরণ করলেন?’

-‘ তোর নামটা যেন কি?’
-‘ এ কি কান্ড! কপালে আঘাত পেলাম আমি আর স্মৃতি হারালেন আপনি?’
-‘থাপ্পড় না খেলে যা জিজ্ঞাসা করছি বল।’
-‘সুবহানা চৌধুরী শীতল।’
-‘শীতল মানে ঠান্ডা, উষ্ণতাহীন। তোর মাঝে কি ঠান্ডা, স্থির, বলে কিছু আছে? নেই। তোর দাদা পাগল বলেই ভুল মানুষকে ভুল নাম দিয়েছে।
যদিও তোর দাদা আমারও দাদা। নাতি হিসেবে দাদার ভুল শুধরানোর দায়িত্ব তো আমারই। তাই আজ সঠিক মানুষকে সঠিক নামে নামকরণ করলাম।’
-‘তাই বলে ব্যাঙাচি?’
-‘হুম, একদম খাপে খাপ।’
শীতল মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইল শুদ্ধর দিকে। ভিডিও কলে কথা বলছে তারা। ডিসপ্লেতে ভাসছে দু’জনের মুখ। নিজের ছবির দিকে নজর গেলে
শীতলের কান্না পেল। ইশ! মুখের কি অবস্থা তার। সে নিজের মুখে হাত
বুলিয়ে কান্নারত স্বরে বলল,

-‘ আগে ভাবতাম আপনি পাষাণ তাই পাষাণের মতো আমাকে মা’রে’ন। আজ বুঝলাম আপনার থেকেও বাইরের ওই ছেলেগুলো আরো পাষাণ, নিষ্ঠুর। নয়তো এতজোরে কেউ থাপ্পড় মারে?’
-‘কে মেরেছে?’
-‘ভ্রুঁ কাঁটা ওই ছেলেটা।’
-‘কপালে ব্যথা পেলি কিভাবে?’
-‘কি জানি, মনে নেই। তবে ওই ছেলেগুলোই কিছু করেছে।’
-‘মা’র’ল কেন তারা?’
-‘কথা বলেছি তাই।’
-‘হিজাব কি ওরাই খুলেছে?’
-‘হুম।’

এবার সে গড়গড় করে বলতে লাগল ঘটে যাওয়া ঘটনা। শুদ্ধ চুপ করে শুনল। ঠিক এই কথা শোনার জন্যই এতক্ষণ আবল-তাবোল বকছিল। কারণ সে জানে শীতলের পেট পাতলা। একবার কথা শুরু করলে পেটে যা আছে সব উগলাবে। অদূরে বসা সায়ন ঠোঁট কামড়ে হাসছে ভাইয়ের বুদ্ধিমত্তা দেখে। এই কাজ যদি সে করতো তাহলে শীতল রয়ে সয়ে মনে করে মনে করে বলতো। অথচ শুদ্ধকে এমনভাবে বলছে যেন মজার গল্প শোনাচ্ছে। শুদ্ধ তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে ক্যাচ করে নিলো ওই ছেলেগুলো পাঁচজন ছিল। তাদের ফেস কেমন ছিল, কে কানে কম শোনে, কার গায়ের ড্রেস কেমন ছিল, কে তাকে মেরেছে, কে গালি দিয়েছে, কে হিজাব খোলার দুঃসাহস দেখিয়েছে, সব বলল। আরো বলল, গাড়িতে মধ্যে একজনের সাথে বারবার কলে কথা বলেছিল।

কথা বলার সময় কলদাতাকে ভাই!ভাই! করে সম্বোধন করছিল। অর্থাৎ মেইন কালপিট একটা ছেলে। সব শুনে পাঁচজন ছেলের হুবুহু মুখাবয়ের বর্ণণা শুনে শুদ্ধ অন্য হাতে থাকা ফোনে রেকর্ডার অফ করল। কথা বলা অবস্থায় পাঠিয়ে দিলো অর্কের নাম্বারে। সঙ্গে ছোট্র একটা বার্তা,’আর্জেন্ট।’ অর্ক মেসেজ দেখে সেন্ড করল তার বড় ভাইয়ের কাছে। উনি আবার এসবের কাজ করে। সেও ভাইকে জানিয়ে দিলো আর্জেন্ট কেস। কারো উপরে ভরসা না করে শুদ্ধ এক জায়গায় বসেই কাজ চালিয়ে গেল। শীতলকে বার বার এই ঘটনার কথা মনে করতে যেন না হয় তাই এ কাজ করেছে সে। এরপর কিছুক্ষণ কথা বলে কল কাটল শুদ্ধ। শীতল এবার বকবক করতে লাগল সায়নের সাথে। পুরনো গল্প মনে করে খুব হাসল। শাহাদত চৌধুরীও তাল মেলাল তাদের সাথে। তারপর শীতলের স্যালাইন শেষ হলে সায়ন আর শাহাদত চৌধুরী তাকে নিয়ে রওনা হলো বাসার দিকে।

চৌধুরী নিবাসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেজে গেল ভোর চারটা। ড্রয়িংরুমে সবাই তাদের অপেক্ষায়। টেনশনে ঘুম নেই কারো।সায়ন ঘুমন্ত শীতলকে কোলে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল। ইশারায় বলল শব্দ না করতে। সবাই তাই করল। ফুলের মতো স্নিগ্ধ মুখে আঘাতের দাগ দেখে সবার বুক ভার হলো। কাঁদলেনও নিঃশব্দে। সায়ন বোনকে রুমে শুইয়ে নিচে আসতেই শারাফাত চৌধুরীর রোষানলে পড়ল। উনি সায়নকে সরাসরি বললেন,
-‘এই ঘটনা এবারই প্রথম। আমার মনে হয় না, এত বছরে এমন শত্রু তৈরি করেছি যারা আমার বাড়ির মেয়েদের দিকে হাত বাড়াবে। কত্ত বড় স্পৃহা! আমি আবারও বলছি নিজেকে শুধরে নাও। তোমার নাহয় মরার ভয় নেই। কিন্তু তোমার কাজের ফল আমার অন্য সন্তানের প্রাণ নাশের কারণ না হয়। তোমার কর্মে যেন তোমার বোন রা কখনো অসন্মানিত না হয়। আজ মেয়েটা বেঁচে গেছে বার বার বাঁচবে এমনটা নয়। আজ নাহয় শীতলের উপর হামলা করেছে কাল শখ, স্বর্নকে টার্গেট করবে না এটার গ্যারান্টি কে দেবে?’

সায়ন মেঝেতে দৃষ্টি রেখে বাবার কথাশুনে শুনল। বাবার কথার ধরণে স্পষ্ট, উনি ধরে নিয়েছে সায়নের জন্য এই ঘটনা ঘটল। বোন কি’ডন্যা’প হওয়ার পেছনে সেই দায়ী। যদিও জোর দিয়ে কিছু বলতেও পারবে না। কারণ রাজনীতিতে এসব কমন। হতেও পারে। রাজনীতিতে জড়ানোর পর বাবা ভালো কথা বলে না। এখন যেমন রুডভাবে কথাগুলো বললেন সেভাবেই বলে। এতদিন শুনতে শুনতে গা সওয়া হয়ে গেছে। তাই জবাব না দিয়ে সিঁতারাকে বলল খেতে দিতে। রান্নাবান্না করাই আছে কেউ কিছু মুখে তুলে নি। তাই উনি সবাইকে খেতে ডাকলেন। শাহাদত চৌধুরী ফ্রেশ হতে গেছে কাল দুপুরের পরপরই চলে যাবেন। সিমিন তো এখনো ঘুমে।
শারাফাত চৌধুরী, শখ এখন আর খাবে না চলে গেলেন যার যার রুমে।

সায়ন কোনোমতে হাত ধুয়ে খেয়ে চলল নিজের রুমে। যাওয়ার আগে একবার তাকাল স্বর্ণের দিকে। এই তাকানোর মানে স্বর্ণ বুঝে। এর অর্থ ‘জলদি রুমে আয়।’ স্বর্ণ বিরক্তিতে মুখ কুঁচকালো। তার মুখ দেখে সায়ন
বুঝল স্বর্ণ আসবে না। তাই মাঝ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
-‘ পেইন কিলার থাকলে রুমে দিয়ে যা। মাথা ব্যথায় ম’রে যাচ্ছি। দেরি করলে থাপ্পড়ে গাল লাল করে দেবো।’
ছেলের কথা শুনে সিঁতারা চৌধুরী খ্যাক করে উঠলেন। বললেন,
-‘ এটা কেমন ব্যবহার সায়ন? ছোটো বোনের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?’
-‘তো কিভাবে বলে?’
-‘সুন্দর করে বল। না বললে পাবি না পেইন কিলার।’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২০

সায়ন দীর্ঘশ্বাস চাপল। দুই আঙ্গুল কপালে ডলে স্বর্নের দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বলল,
-‘মার্জনা করুন চৌধুরী কন্যা। অনুগ্রহনপূর্বক একটা প্রতিষেধক দিয়ে আমাকে ধন্য করুন, প্লিজ।’
ছেলের কান্ডে সিঁতারা এবার হেসে ফেললেন। মাকে হাসতে দেখে সায়ন স্বর্ণকে শীতল চাহনি ছুঁড়ে হনহন করে চলে গেল। তাকে যেতে দেখে স্বর্ণ বিরবির করে বলল,
-‘মনভরে বাপের দো’চ’ন খেলো। বাপকে কিছু বলতেও পারল না। অথচ এখন সব রাগ উগড়াবে আমার ঠোঁটের উপর। বে’য়াদব, ন’ষ্ট পুরুষটাকে নিয়ে আমার হয়েছে যত জ্বালা।’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২২