শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৩

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৩
নূরজাহান আক্তার আলো

ঘড়িতে সময় তিনটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট।এলার্মের শব্দে একে একে ঘুম থেকে উঠেছেন তিন চৌধুরী গিন্নি। তিন জা কাজ গুছিয়ে হাতে হাতে গরম খাবার এনে রাখছেন ডায়নিং টেবিলে। মাঝে মাঝে ডাকছেন ঘুমে মগ্ন ছেলে-মেয়েদের। কিন্তু কারোই উঠার নাম নেই। ডাকাডাকিতে একে একে উঠে পড়েছেন শারাফাত ও সাওয়ান চৌধুরী। বসেছেন ড্রয়িংরুমে।

এভাবে বসে থাকলে সময় যাবে না তাই টিভি ছাড়তেই দেখলেন একটা চ্যানেলে বড় বড় পাহাড় দেখাচ্ছে।সেসব পাহাড়ে নবী ও সাহাবী কতদিন থেকেছিলেন, কেন থেকেছিলেন, সেসব দেখানো হচ্ছে। দুইভাই সোফায়
বসে মনোযোগ সহকারে তা দেখছেন। আজকে প্রথম সেহরি। সবাই এক সাথে সেহরি করলেও থাকছেন না শাহাদত চৌধুরী। ভাইয়ের কথা স্মরণ হতেই মন ভার হলো উনাদের। ভাইটা চাকরির কারণে থাকতে পারে না। সাওয়ান চৌধুরী আর না ভেবে কল দিলেন শাহাদত চৌধুরীকে। রিসিভ হতেই ফোনের ডিসপ্লতে ভেসে উঠল শাহাদত চৌধুরী হাস্যেজ্জ্বল মুখ। উনিও ফ্রেশ হয়ে ফোন হাতে নিয়েছিলেন ফোন দেওয়ার জন্য। ভাইয়ের
কল পেয়ে খুব খুশিও হয়েছেন বটে। উনারা কথা বলার মাঝে শখ গিয়ে দাঁড়াল। বাবার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে কথা বলল ছোটে চাচ্চুর সাথে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আবদার করল একসাথে ইফতার করল। শাহাদত চৌধুরী আদুরে সুরে জানালেন অবশ্যই চেষ্টা করবেন। তারপর তিনভাই আর কিছুক্ষণ কথা বলে কল কাটলেন। শখকে দেখে সিঁতারা বললেন বাকিদেরকে ডেকে আনতে। ঘুমে থেকে উঠে ছেলে-মেয়েগুলো ভাত গিলতে পারে না। ধীরে ধীরে খাবে নাহয়। এতবড় দিন কিছু না খেলে কীভাবে হবে? শখ মায়ের কথা শুনে দোতলায় গিয়ে স্বর্ণকে ডাকল। এরপর ঘুমকাতুরে শীতলকে।
শীতলকে ডেকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে এরপর ডাকল শুদ্ধ আর সায়নকে।
নয়তো দেখা যেতো পাজি মেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। দোতলায় একে একে সবাইকে ডেকে গেল গেস্টরুমে। রুবাব গেস্টরুমে ঘুমাচ্ছে। তাকে কয়েকবার ডেকে এরপর এসে বসল ডায়নিং টেবিলে। ডাকাডাকির পর ফ্রেশ হয়ে একে একে এসে বসল ডায়নিং টেবিলের চেয়ারে। শীতল মুখ ভোঁতা করে দেখল সবাই থাকলেও শুদ্ধ নেই। তাকে কী কেউ ডাকে নি?

এখন না উঠলে খেতে পারবে না ধীরে সুস্থে? এসব ভেবে ডাকার জন্য উঠতে গেলে দেখে শুদ্ধ নামছে সিঁড়ি দিয়ে। তার চোখ মুখে ঘুম জড়িয়ে আছে। গোসল দিয়েছে নাকি? চুল ভেজা কেন? ভোরবেলা গোসল দেয় কোন পাগলে? ল্যাবে কাজ করছিল বোধহয়। শীতল খুব মনযোগ দিয়ে দেখল পাষাণ মানুষটাকে। শুদ্ধ এসে বসল সৃজনের পাশে। অথচ তার পাশের চেয়ারটাও ফাঁকা। একটুপরে সেই চেয়ারে এসে বসল রুবাব। সে রুবাবকে দেখে মিষ্টি করে হাসতে গিয়ে হাসতে পারল না। আচ্ছা সে কী শুদ্ধ ভাইয়ের বসার আশা করেছিল? কিন্তু কেন? উত্তর খুঁজে পেল না শীতল। তাই মন খারাপ করে প্লেট টেনে নিলো নিজের দিকে। ততক্ষণে
যে যার পছন্দের খাবার নিয়ে খেতে শুরু করেছে। সাম্য, সৃজনের চোখে
এখনো ঘুম। তারা এখনো ঢুলছে। অথচ গতকাল সবাইকে বলেছে তারা রোজা থাকবে। এবার সব রোজা করবে৷ গতবার ছোট ছিল তাই করতে
পারে নি। এবার ত্রিশটা রোজাই করবে। তারাও দেখিয়ে দেবো তারা বড় হয়ে গেছে। ওদের কথা কথা শুনে সবাই হেসেছিল।

শারাফাত চৌধুরী খেতে হঠাৎ চোখ পড়ল শীতলের দিকে। শীতল মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে। প্লেটে শুধু সাদা ভাত আর চিংড়ি মাছ।
ঘুম থেকে উঠে আসায় চোখ মুখ ফুলে আছে। ঘুম থেকে উঠলে এভাবে চোখ ফোলার কথা তাহলে কী মেয়েটা কেঁদেছে? হয়তো। কারণ শীতল বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে বাবাকে পাশে পাওয়ার আশা করে। যখন পায় না তখন খুব কাঁদে। আজও বোধহয় বাবার জন্য কেঁদেছে মেয়েটা। সিমিনের মুখটাও মলিন লাগছে। উনি দীর্ঘশ্বাস চেপে কিছু বলার আগে দেখলেন রুবাব স্বযত্নে শীতলের প্লেটে সলেট মাংসের পিচ তুলে দিলো।
সায়ন খোসা ছড়িয়ে চিংড়ি তুলে দিলো। শখ পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো।

স্বর্ণ সাম্য, সৃজনের দুধভাত মেখে দিচ্ছে। শুদ্ধ মা-চাচীদেরও বসা পড়ার তাগাদা দিচ্ছে। কী চমৎকার সেসব দৃশ্য! টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছে। সবাই খাচ্ছে। যার যেটা লাগবে তুলে নিচ্ছে, তুলে দিচ্ছে। এরপরেও যেন কিছু একটা মিসিং। কি সেটা? আচ্ছা শীতল কথা বলছে না। হাসছে না। তার
মাঝে চঞ্চলতাও দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু কেন? শুদ্ধ আবার বকেছে নাকি মেয়েটাকে? মনে মনে একথা ভেবে উনি কপাল কুঁচকে তাকালেন শুদ্ধর দিকে। ছেলেটা আপনমনে খাচ্ছে। ছোটো ছোটো লোকমা তুলে খায় সে। খাওয়ার কায়দা দেখে বোঝা যায় পুরোই জেন্টেলম্যান! মুখভঙ্গি দেখে বোঝার উপায় নেই মনে কী চলছে।শুদ্ধর বাঁ পাশে রুবার আর রুবারের পাশে সায়ন। বলা বাহুল্য, চৌধুরী বাড়ির নজরকাড়া তিন সুদর্শন যুবক।

আজকাল ছেলেদের বিয়ের প্রস্তাব আসে। আজও এসেছে। আজকের প্রস্তাব এমন ছিল যে যৌতুক হিসেবে চেকে মর্জিমতো যত সংখ্যা বসিয়ে নিতে পারবে। তবুও শুদ্ধকে নাতী জামাই করবেন সেই লোক। যৌতুকের কথা শুনে রাগ হলেও উনি নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন। জানিয়েছেন ছেলে বিক্রি করবেন না। তবে ছেলের সাথে কথা বলে দেখবেন ছেলের মত থাকলে উনাকে জানাবেন।মূলত কথাটা বলেছিলেন এড়িয়ে বাঁচার জন্য। উনি খুব ভালো করেই জানেন শুদ্ধর কানে একথা গেলে জবাবে এমন কিছু বলবে যে পাল্টা জবাব দিতে কথার খৈই হারিয়ে ফেলবেন।
তবুও চুপ থাকলে হবে না কিছু বলতে হবে। ছেলেগুলোও বড় হয়েছে। বিয়েসাদী দিতে হবে। বাড়িতে বউ আনতে হবে। অন্যবাড়ির ছেলেরা এস.এস.সি না দিতেই বিয়ের জন্য লাফাতে শুরু করে। অথচ এদেরকে বিয়ের কথা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে যায়। বয়স কী বসে থাকে? বাপ হতে হবে না? এসব ভেবে মনে মনে কথা গুলিয়ে নিলেন। তারপর গলা খাঁকারি দিলে সবাই বুঝল উনি বিশেষ কিছু বলবেন তাই তাকাল। তখন তিনি বললেন,

-‘সায়ন, শুদ্ধ, রুবাব তিনজনকেই বলছি যথেষ্ট বড় হয়েছো। নিজেরাও যে যার মতো কিছু না কিছু করো। বয়স থেমে থাকে না। বিয়ে করতে হবে। বাড়িতে বউ আনতে হবে। আমার বিজনেস পার্টনারের মেয়েটা খুব লক্ষী। দেখতে শুনতে মাশাআল্লাহ্!’
এইটুকু বলে থামলেন। কথার মাঝে কথা বলে নি কেউ কারণ সবাই তার পরেরটুকু শুনতে চাই। উনি পরের কথাটুকু পেশ করলেন,
-‘আহনাফ আর ফিরলে শখের অনুষ্ঠান সেরে ফেলব। এরপর সায়নের। একে একে শুদ্ধ, রুবাব তারপর স্বর্ণ। ভেবেছি সায়নের জন্য মেয়েটাকে দেখতে যাব। কোনো সমস্যা আছে তোমার?’
শেষ কথাটা সায়নকে উদ্দেশ্য করে বললেন তিনি। সায়ন একমানে খেতে খেতে একবার চোখ তুলে বাবার দিকে তাকাল। তারপর বলল,

-‘সামনে নির্বাচন।’
-‘তো?’
-‘তো বিয়ে টিয়ে বাদ।’
-‘আমি আমার পার্টনারকে কথা দিয়েছি।’
-‘ভালো করেছ। এবার নিজে করো নয়তো শুদ্ধ কিংবা রুবারের ঘাড়ে ঝুলিয়ে দাও।’
সায়নের কথা শুনে রুবাব ভীষম খেলো। কোনোমতে পানি দিয়ে মুখের খাবার গিলে দুঃখী দুঃখী স্বরে জবাব দিলে,
-‘বিয়ে করতে আমার কোনো সমস্যা নেই বড় মামা। কিন্তু ঘাড়ের উপর বড় ভাইদের রেখে বিয়ে করলে লোকে কি বলবে? লোকে ভাববে না বড় ভাইয়ের কোনো সমস্যা আছে। ছোটো ভাই হয়ে এটা অন্যায় হয়ে যাবে না?’
তার কথা শুনে সায়ন ভ্রুঁ কুঁচকাল। তারপর ক্ষ্যাপাটে স্বরে জবাব দিলো,

-‘ কেউ কিছু বললে সে ‘কেউ’ টাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিবি। বেশি না কয়েক মিনিটে বুঝিয়ে দেবো সমস্যা আছে কী না । সেই শালার এমন অবস্থা করব এক সপ্তাহ হাঁটতে গেলে কুঁত পাড়বে।’
সাওয়ান চৌধুরী গলা খাঁকারি দিলেন। তবে উনার ঠোঁটে মিটিমিটিহাসি।তবে ছেলের কথা শুনে শারাফাত চৌধুরী বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে নিলেন। উনি আজকাল ভীষণ বিরক্ত সায়নের প্রতি। ছেলেটা ভীষণ লাগামছাড়া কথাবার্তা বলে। ইদানিং একটু বেশিই বলে। যার দরুণ বারংবার উনাকে অস্বত্বিতে পড়তে হয়। আর ছোটো ছোটো ভাই বোনদের সামনে এভাবে
কেউ কথা বলে? এখন কি ভদ্রতাজ্ঞান নতুন করে শেখাতে হবে? সায়ন নিজেও যেন বুঝতে পারল ব্যাপারটা তাই দাঁত কপাটি বের করে পুনরায় বলল,

-‘না মানে পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলে ফেলার কথা বলছি আর কি। ভাবো একবার কতবড় সাহস আমাদের নিয়ে ভুলভাল ভাবে।’
তার কথায় সাম্য ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে জবাব দিলো,
-‘পিঠের ছাল তুললে হাঁটতে কুঁত পাড়বে কেন ভাইয়া? তুমি দেখি কিছুই জানো না। স্যার যখন আমার পাছায় মারে তখন আমার হাঁটতে কষ্ট হয়। তুমি বরং তাদের পাছার ছাল তুলে নিও।’
একথা শুনে শখ, স্বর্ণ একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। হাসিতে ঠোঁট কোণ বেঁকে আসছিল তাদের। কারোই বুঝতে বাকি নেই সায়নের কথার ডাবল মিনিং। আপাতত প্রসঙ্গ বদলাতে শারাফাত চৌধুরী এবার শুদ্ধকে বললেন,
-‘আর তোমার? তোমার কি সমস্যা?’

-‘আমার কোনো সমস্যা। তোমরা গিয়ে দেখে আসতে পারো।’
একথা শোনামাত্রই শীতলের হাত থেমে গেল। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল শুদ্ধর দিকে। মানে কি? গতকালই না চুমু খেয়ে ভালোবাসার কথা বলল? আর আজই অন্যকে বিয়ের কথা বলছে তাও তারই সামনে?শুদ্ধ
ভাই তাহলে সত্যিই তাকে মেনে নেবে না? সায়ন ভাই তখন বলল মিশন সাকসেস। তাহলে কি সায়ন ভাই মিথ্যা বলেছিএ? তাকে বুঝ দিতে ওসব বুঝিয়েছিল? শীতলের মাথা কাজ করছে না। সে তাকিয়ে দেখছে তারই সামনে বসা নিষ্ঠুর মানুষটাকে। এত পাষাণ কীভাবে হতে পারে? শীতল তাকিয়ে আছে অনুভব করে শুদ্ধও হঠাৎ চোখ তুলে তাকাল। দু’জনের
চোখাচোখি হলো। বাঁধ ভাঙ্গা কান্নায় ঠোঁট ভেঙ্গে আসলেও সে নিজেকে সামলে নিলো। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। তার এই সামলানোটাই সহ্য হলো না শুদ্ধর। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে বলল,

-‘ কলিজায় তীর বিঁধেছে রক্তাক্ত হয় নি। রক্তাত্ত হলে চোখের জল গাল বেয়ে গড়াতো। গড়াচ্ছে না যেহেতু তাহলে কলিজা এফোঁড় ওফোঁড় হতে বাকি রয়ে গেছে এখনো। নো প্রবলেম, আই উয়িল ট্রাই মাই বেস্ট।’
মনে মনে একথা বলে সে ঠোঁটে কুটিল হাসি ফুটিয়ে বাবাকে বলল,
-‘মেয়ের গায়ের রং কুচকুচে কালো হোক। অশিক্ষিত হোক। গরীব হোক আমার সমস্যা নেই। শুধু তাকে সত্যবাদী হতে হবে। সর্বদা স্পষ্টভাবে যেন সবার সামনে সত্য কথা বলার সাহস রাখে। এইটুকু হলেই চলবে।’
-‘যতটুকু খোঁজ নিয়ে জেনেছি মেয়ে তেমনই। দেখতে শুনতেও ভালোই। মুখের আদল আমাদের শীতলের মতো খুব আদুরে।’
-‘বাহ্ তাহলে আর কি! আমি যেমন আমার সঙ্গী তো তেমনই হওয়া চাই।
বিশেষ করে অন্যের কথায় সিধান্ত নেওয়া মাথামোটাকে বউ করতে চাই না আমি। এরা বউ হিসেবে জঘন্য টাইপ হয়।’

-‘তাহলে এখানেই কথা বলি? ‘
-‘বলো। মনমতো মিলে গেলে শখের অনুষ্ঠানের আগে আমার বিয়েটা সারতে চাই।’
সাফওয়ান চৌধুরী এবার হাসতে হাসতে বললেন,
-‘কি রে বাপ বিয়ের জন্য এত পাগল হয়ে গেলি যে?’
-‘কুচক্রি মানুষের বদনজরে পড়েছি। জানোই তো নজর কতটা খারাপ জিনিস তাই বিয়েটা সেরে নজর কাটাতে চাচ্ছি। বলা তো যায় না, কে কখন কোন অপরাধে ফাঁসিয়ে দিলো।’
-‘হা, হা, দারুণ বললি তো।’
-‘মানুষ যা করে সেটা প্রকাশ করতে ভয় পায়। আমার আবার ওসব ভয় টয় কোনো কালে ছিল না আর এখনো নেই। তাই হয়তো অবলীলায সব কথা বলতে পারি।’

একের পর এক শুদ্ধর খোঁচামার্কা কথা শুনে সায়ন আড়চোখে শীতলের দিকে তাকাল। দেখল শীতলের চোখের কোণে অশ্রুতে চিকচিক করছে। শীতলও বুঝেছে শুদ্ধ তাকে মিন করে কথাগুলো বলেছে। হ্যাঁ, ভুল যখন করেছে তখন শাস্তি গ্রহনযোগ্য। তাই বলে এভাবে? শুদ্ধ ভাই কী বুঝছে না ছুরির থেকেও তার কথার আঘাত ধারালো হয়ে বুকপাজরে বিঁধছে? নাকি সেই আঘাত অদৃশ্য বলে দেখেও দেখছে না। বুঝেও বুঝছে না। সে
ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলল। সন্তপর্ণে মুছে নিলো। তখন শারাফাত চৌধুরী মাথা নাড়িয়ে এও বললেন,

-‘আরো একটা নম্র-ভদ্র মেয়ের সন্ধান আছে। মেয়ে বিসিএস ক্যাডার।
মেয়ের নানাজান যৌতুক হিসেবে চেকের পাতায় ইচ্ছেমতো এমাউন্ট বসানোর কথা জানিয়েছে। একে বিয়ে করতে তিন ভাইয়ের কে রাজি আছো স্পষ্টভাবে জানাও। তোমাদের সম্মতি পেলে এগোবো।’
যৌতুকের কথা শুনে সকলে হতবাক। চৌধুরী বাড়ির ছেলেরা যৌতুক নিবে? কিন্তু কিসে কম তারা? বাড়ি-গাড়ি, টাকা-পয়সা, নাকি অর্জিত মান সন্মানে? সায়ন চোখ মুখ কুঁচকে নিলো। ঠোঁটের কাছে গালিরা এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। কিন্তু সে তো বাড়িতে গালিটালি দেয় না। ওসবের জন্য চৌকাঠ পেরোতে হবে। কিন্তু কতক্ষণ আর শোনা যায়? তাই সে গপাগপ খাবার গিলে উঠতে উঠতে বলল,

-‘যৌতুকের মায়েরে আলাভু করলেও ওসব ছাঁইপাশ আমার লাগবে না। উঠছি আব্বাজান। আর হ্যাঁ মেয়ে খুব বেশি পছন্দ হলে তোমরা তিনভাই ভাগাভাগি করে নিতে পারো। একটা ক্যাডার আম্মা পেলে আমরা নাহয় ধৈই ধৈই করে নাচতে নাচতে বাসর সাজিয়ে দেবো।’
একথা বলে সায়ন একটা পানি বোতল নিয়ে রুমে চলে গেল। শারাফাত চৌধুরী খেঁকিয়ে উঠে কিছু বলতে গেলে সাফওয়ান থামিয়ে দিলেন। কী দরকার শুধু শুধু কথা বাড়ানোর। নিজের দিকে ঝড় ধেড়ে আসতে পারে
ভেবে রুবাবও কোনোমতে খেয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। দুভাই পালালো আরেকজন এখনো বাকি। সবাই যেন তার জবাবের আশায়। কিয়ৎকাল চুপ থেকে শারাফাত চৌধুরী পুনরায় শুদ্ধকে বলল,

-‘ওরা তো না বুঝেই পালিয়ে গেল। তুমি অন্তত কিছু বলো। লাগলে সময় নাও ভেবে পরে জানিও।’
-‘ভাবাভাবির কিছু নেই। সবই তো তোমার উপর নির্ভর করছে।’
-‘আমার উপর? যেমন?’
-‘ছেলে তোমার। জন্ম দিয়েছো তুমি। পড়ালেখা করিয়ে বড় করলে তুমি।ছেলেদেরও খু্ব ভালো করে চেনো তুমি। তাছাড়া বলতেই হয় তুখোড় বিসনেসম্যান তুমি। তাহলে হিসাব নিকাশ তোমারই ভালো বোঝা উচিত, তাই না? তুমিই নাহয় বলো তোমার ছেলেদের দাম কত? কত হলে ছেলে বিক্রি করবে?’
ছেলের কথায় শারাফাত চৌধুরী রাগলেন না বরং হাসলেন। তবে হাসিটা যেন ঠোঁটের কোণে অদৃশ্য রয়ে গেল। মূলত কথাটা বলেছেন ছেলেদের
মন পরীক্ষা করতে। যদিও জানতেন রেজাল্ট তবুও পরীক্ষা করতে মন সায় দিলো। এত কথা, এত গল্পের মাঝে কেউ খেয়াল করল না বাড়ির আদুরে কন্যার ছলছল চোখ। শীতল আর বসে থাকতে পারল না উঠে রুমে গেল। তাকে যেতে দেখে শুদ্ধ নিজেও উঠে হাত ধুতে ধুতে বাবার উদ্দেশ্যে বলল,

-‘নতুন কাজ ধরেছি বিয়ের ব্যাপারে ক’দিন পরে কথা এগিও বাবা। কিছু দিন যাক আমিই বলে দেবো তোমায়।’
শুদ্ধর কথায় এবার বড়রা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালেন। কেবল বলল পাত্রী মন মতো হলে শখের আগেই বিয়ে সারবে। এখন আবার বলছে কদিন পর। এই ছেলের মাথায় কখন কী ঘুরে কে জানে। উনাদের তাকাতে দেখেও
শুদ্ধ কারো দৃষ্টি পরোয়া করল না। সে ধীরে সুস্থে পানি পান করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে মনে মনে বলল,
-‘ভালোবাসি না বাসবোও না। কাছ ঘেঁষি না ঘেঁষতেও দেবো না। না নিজে কারো হবো না তোকে অন্যের হতে দেবো। যাতনা দিবি? দে! যন্ত্রণায় পোড়াবি? পোড়া! মনকে অন্তত বোঝাবে পারব আমার অভিলাষী আমার দহনের একমাত্র কারণ।’

একথা বলে শীতলের রুম পার হতে হতে শুনতে পেল শীতলের ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। সে নিঃশব্দে হাসল। যাক খোঁচাটা তাহলে ঠিকভাবে কাজ দিয়েছে। যাক শান্তি! কেমন লাগে বুঝ এবার। সে দাঁড়াল না নিজের রুমের দরজায় পার্স ইন করতে করতে বলল,
-‘তোকে ডুবতেও দেবো না হাত টেনে পাড়েও তুলব না। তোকে অথৈই জলে নাকানিচুবানি খাওয়াব।

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩২

তুই অন্যের কথায় আমার কাছে এসে সেই পথই বেছে নিয়েছিস। এখন তুই পুড়বি অভিলাষী। পুড়তে পুড়তে একটা সময় ঠিকই মুখ থেকে কথা বের হবে তোর। কতদিন চুপ থাকবি? কতক্ষণ চুপ থাকবি? কতবার নিজেকে সামলাবি? দেখি, আমিও দেখি।
কান্না করছিস,কর। তোর চোখের পানিই তোকে ভালোবাসা চেনাবে।’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৪