আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৩

আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৩
ইশিকা ইসলাম ইশা

থমথমে পরিবেশে সবার দৃষ্টি তখন দরজার দিকে। দরজায় সুন্দরী একজন মহিলা দাঁড়িয়ে।পড়নে লাল-খয়েরির মাঝে একটা গর্জিয়াস শাড়ি।বয়স হলেও রুপ লাবণ্য এখনো বিদ্যমান।দেখে মনে হচ্ছে কিছুটা বিদেশিদের মতো।সাদা ফর্সা।
রিদি সবার কথায় আহাম্মক এর মতো চেয়ে আছে!
এর মাঝেই তিরা চৌধুরী রুম থেকে বের হয়ে আসে। আরফিন আর মহিলাটিকে দেখে বলে,
কখন এলো তোমরা??
মহিলাটি এগিয়ে এসে বলল,
মাএই এসেছি।তবে এসে এতো বড় সারপ্রাইজ পাবো ভাবিনি।
তিরা আড়চোখে তাকালো রিদির দিকে।তিরা কিছু বলার আগেই মহিলাটি বলে,
কি জন্য ওকে নিয়ে এসেছেন আপনি আম্মা!!

নাজমা চৌধুরী একবার আরফিন এর দিকে চেয়ে বলল,
এই বাড়ির বড় নাত বৌ রিদিতা।তীব্র নিজে বিয়ে করে এনেছে তাকে।
সেটা তো আপনিই করিয়েছেন।না হলে তীব্রর জন্য কি মেয়ের অভাব পড়েছে।এমন মেয়ে কে তীব্র তাকিয়ে দেখবে কখনো!
রিদির চোখ থেকে টপটপিয়ে পানি পড়তে লাগল।এসবে তার কি দোষ? সবাই কেন তাকে নিয়ে এতো বাজে কথা বলছে।
রাইফা আরো কিছু বলতে গিয়েও আরফিন গম্ভীর কথায় থেমে যায়,
রাইফা তুমি হয়তো ভীষণ ট্রায়াড রুমে যাও!!
রাইফা নামের মহিলাটি এইটুকু কথায় আর কিছু আর হয়তো সাহস পেল না।তবে কটমট করে তাকালো রিদির দিকে।রিদি তখনো কাঁদছে!তার সাথে কি হচ্ছে কেন হচ্ছে!! তা তার ধারনার বাইরে।তবে রিদিরো আর দাঁড়িয়ে থাকার ইচ্ছে হলো না কাঁদতে কাঁদতে উপরে উঠে গেল।নাজমা রিদির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“”তোমারা কী শুধু আঘাত করতেই পারো”” আরফিন তাকালো মায়ের দিকে।তবে কিছু না বলে উপরে চলে গেল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সেদিনের পর কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন,
রিদি সেদিনের পর আর রুমের বাইরে যায় নি।যদিও রুপ এসে অনেকবার বলেছিল বাইরে যেতে। মায়ের ওভাবে বলার জন্য সরি ও বলেছে কিন্তু রিদি যাইনি।হয়তো আবারো কারো তিক্ত কথা শুনতে চাই নি।এমনিতেই তার জীবনটা তিক্ততায় ভরপুর।

সময়টা তখন অনেক রাত,
উদাস মনে রিদি তাকিয়ে আছে অদূর আকাশের দিকে। কোথায় ছিল? কোথায় এলো? কেন এলো?
এই প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা তার। তবে এটাতো এখানে এসে বুঝতে পেরেছে এই বাড়ি বা এই বাড়ির মানুষের সাথে তার মায়ের কোন পুরানো সম্পর্ক আছে। কিন্তু কি??কোন সম্পর্ক??রিদির মনে প্রশ্ন জাগলেও উওর নেই তার কাছে!!
এখন তার কি করা উচিত!! সেটাও জানা নেই তার।এক নরক থেকে মুক্ত হয়ে কোথায় চলে এসেছে।নাম না জানা রাজ্য।যে মানুষটার সাথে নাম জোড়া হয়েছে!!সে!! আদো সে মানুষ!! এতোটা খারাপ ভাবে আমেনাও তো আঘাত করেনি ?সেদিন তাকে পরপর যতটা আঘাত করেছে লোকটা!!

সব ভেবে রিদির চোখ ভিজে উঠল!!মা!!মা না থাকা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অভিশাপ।এই দুনিয়ায় মা ছাড়া কেউ আপন হয় না।কতো বছর কেউ তাকে আদর করে জরিয়ে ধরে নি।কেউ বলেনি আমি আছি তো ভয় পেয়ো না!! কেউ তার যত্ন নেই নি।কেউ মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দেয় নি।কেউ ঘুমালে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় নি। অসুস্থ হলে কারো বুকে মুখ গুঁজে দিতে পারেনি। ছোট বেলায় জ্বর হলে মায়ের বুকে মিশে থাকত রিদি।মা পরম আদরে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিত।এখন আর কেউ তার আঘাতে অস্থির হয় না। বরং এখন সবাই তাকে আঘাত করতে থাকে কারনে অকারণে।রিদি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
আম্মু!! তোমার মতো কেউ আমাকে কি কখনো ভালোবাসবে না??তুমি কেন ছেড়ে গেলে আম্মু!!কেন আমাকেও নিয়ে গেলে না। কেউ কেন আমাকে তোমার মতো ভালোবাসে না?? সবাই আমাকে বকে,মারে,কথা শুনাই ।তুমি থাকলে আমাকে কেউ কিছু বলতেই পারত না!ফিরে আসো না আম্মু!!প্লিজ!!!আমি এখানে থাকতে চাই না!! আম্মু ও আম্মু আমাকে নিয়ে যাও না তোমার সাথে!!!

বলতে বলতেই রিদি বেলকনিতে বসে পড়ল।পারলে সে চিৎকার করে কান্না করত!! কিন্তু ঐ যে মুখ চেপে কাঁদার অভ্যাস যে!!জোরে কান্নার আওয়াজ পেলে আমেনা তার পিঠের ছাল তুলে ফেলতো।তাই তো মুখ চেপে চেপে কান্না করা এখন তার অভ্যাস হয়ে গেছে।রিদি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে আবারো তাকালো দূর আকাশের মিটমিট করে জ্বলতে থাকা সেই তারার দিকে। অদ্ভুত ভাবে তারাটি নিজ স্থানে থেকে যেন খসে পড়তে শুরু করল।রিদি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল খসতে থাকা তারাটির দিকে।তারা টি ঠিক কোথায় গেল তা জানা নেই তবে প্যাঁচানো আর আর্কষনীয় তিনতলা বিশিষ্ট বিল্ডিং এর পেছনে চলে গেল।রিদি একই ভাবে অবাক হয়ে তাকালো সেই বিল্ডিং এর দিকে। অল্প জায়গায় তিনতলা বিশিষ্ট কাচের বাসাটা অনেক সুন্দর।তবে রিদি কখনো কাছে থেকে দেখেনি।যখন শুনেছে এই বাসা টা তীব্র চৌধুরীর!!তখন থেকেই ঐ বাসার দিকে ভয়েই তাকায় নি। বাসাটাকে তার গুহার মতো লাগে।তাকালেই যেন হিংস্র বাঘ বেরিয়ে আসবে।
রিদি চোখ সরিয়ে নিতে গিয়েও নিল না।অবছা আলোয় সিড়ি বেয়ে কাউকে উঠতে দেখে রিদি শুকনো ঢোক গিলল।ছায়া টা দানবের মত লাগলো তার কাছে। ভয়ার্ত রিদি দুয়া পড়তে পড়তে ছুটে রুমে এসে বন্ধ করে দিল দরজা।ভুত টুত বলে বেশ ভয় তার।রিদি দুঃখ ভুলে এখন ভয়ে জমে গেল।ঝটপট বিছানায় শুইয়ে কম্বলে মুড়িয়ে নিল নিজেকে।বিরবির করে দোয়া পড়তে থাকল।কান্নারত মুখখানায় এখন ভয় কাজ করছে।সে হয়তো বুঝল না কারো আগমন তার জীবনে দুঃখ ভুলিয়ে দিয়ে ভয় ঢেলে দিল।

আমাকে এই বাসার কেউ পছন্দ করে না দাদিমা!
নাজমা রিদির রুমে এসে বেশ কিছু শপিং ব্যাগ রাখতেই রিদির কথায় তাকালো তার দিকে,
কে বলল??
রিদি আমতা আমতা করে বলল,
না!আমি জানি!!
নাজমা রিদির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
অতীতের তিক্ত স্বাদ এখনো হয়তো যাইনি।
রিদি অবাক হয়ে বলল,
কি??
নাজমা আবারো রিদির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

তোমাকে সবার কথা ভাবতে হবে না।তুমি শুধু নিজের কথা ভাববে। পড়ালেখা করে অনেক বড় হতে হবে।কাল থেকে তোমার কলেজে ক্লাস শুরু হবে।তুমি কলেজে যাবে কাল থেকে। প্রয়োজনীয় সব কিছু এখানে আছে।বলে নাজমা চলে যেতে গেলে রিদি নাজমা বেগমের হাত ধরে।নাজমা রিদার ভয়ার্ত মুখটা দেখে বলে,
সব ভুলে নতুন জীবন শুরু করো রিদি।সামনে তোমার বিশাল জীবন পড়ে আছে।ভুলে যাও সেদিনের ঘটনা।ভুলে যাও তুমি কারো বৌ।তুমি এই বাড়ির মেয়ে হয়ে নিজের জীবনটা গুছিয়ে নাও।তুমি এখনো অনেক ছোট সব ভুলে নতুন জীবনের সূচনা করো।
রিদি নাজমা চৌধুরীকে জরিয়ে ধরলো। নাজমা পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিলেন মাথায়।

রিদি কলেজের জন্য তৈরি হয়ে বসে আছে।কলেজ ড্রেস পড়ে মাথায় হিজাব বাঁধা।দাদি রুমে এসে রিদিকে রেডি হয়ে বসে থাকতে দেখে বলে,
মাশাআল্লাহ!বেশ লাগছে তো!!চলো নিচে নাস্তা করবে।
রিদি ইতস্তত করে বলল,
মানে আমি এখানে নাস্তা……
নাজমা মিষ্টি গলায় বলল,
তুমি আজ থেকে নিচেই নাস্তা করবে। সবার সাথে।
কিন্তু!!
কোন কিন্তু না রিদি।এসো…..
রিদি নিচে নেমে আসতেই দেখে সবাই যার যার মতো নাস্তা করছে।রিদিকে দেখে রুপ বলল,

এসো রিদি বসো!আজ তোমার কলেজের প্রথম দিন। ভাইয়া আমাদের ড্রপ করে দিবে।
রিদি সবার দিকে একবার চেয়ে টেবিলে বসে। নাজমা রিদির প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে খেতে বলল।রিদি সবার দিকে একবার তাকিয়ে খাবার মুখে দিতেই হতদন্ত হয়ে ছুটে আসে লাবিব।
লাবিব কে দেখে সবাই চমকে উঠে।লাবিব সবার চমকানো মুখখানা দেখে বলে,
গুড মর্নিং!!সবাই আমাকে এভাবে দেখছেন কেন??
রুপ এক লাফে লাবিবের সামনে এসে বলে,
তীব্র ভাইয়া!! তীব্র ভাইয়া কোথায়??
তীব্র নামটা শুনেই রিদির খাওয়া থেমে গেল।ভয়ে ভীত হল সে।আটকে আসতে চাইল নিঃশ্বাস।
লাবিব হচকচিয়ে তাকাল রুপের দিকে!মেয়েটা অত্যাধীক সুন্দর!!আর তীব্র বলতে পাগল ও বটে!!ভালোও বাসে মেয়েটা। কিন্তু বসস!!এই বস তো!!ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
কি হল লাবিব ভাইয়া বলুন না তীব্র ভাইয়া কোথায়??

রুপের কথায় কিছুটা মুখে হাসি টেনে বলে,
আসলে বস তো তীব্র নিবাসে আছে।কাল অনেক রাতে ফিরেছে!!
কথাটা বলতে বলতেই কিছু ভাঙ্গার আওয়াজ এ সবার দৃষ্টি আটকালো রিদির দিকে।লাবিব অবাক হয়ে তাকালো রিদির দিকে!!মেয়েটা ভয়ে কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মায়াবী মুখটা চুপসে আছে ভয়ে।ইসস বাচ্চা একটা মেয়ে!! ভীষণ মায়াবতী!অথচ তীব্র তার বেলায়ও কতো নিষ্ঠুর!!
পানির গ্লাস টা ভেঙে পড়ে আছে নিচে। কাঁপা কাঁপা হাতটা দেখে সবাই হয়তো কিছুটা আন্দাজ করল!!নাজমা চৌধুরী রিদির কাছে এসে বলল,
তীব্র আসলেও এই বাড়িতে আসে না!!তুমি ভয় পেও না রিদি।রিদি চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে। তার ভেতরে চলছে তুফান।কানে বাজতে থাকল সেই দিনের কথাগুলো।

সবাই হয়তো বুঝল রিদির ব্যাপারটা তাই সবাই এবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকাল লাবিবের দিকে।সবার দৃষ্টি রিদির দিকে থাকাকালীন রুপ কিচেন থেকে কফি করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। প্রিয় মানুষটার দেখা পাওয়া তার কাছে ঈদের মতোই আনন্দদায়ক।কতো অপেক্ষা করে থাকে শুধু একনজর দেখার জন্য।পাথরের মত এই মানুষটিকে ছোট থেকেই ভীষণ পছন্দ করে রুপ।এই পছন্দ বা ভালোলাগা ধীরে ধীরে রুপ নিয়েছে ভালবাসায়।পাথর, হৃদয়হীন মানুষটাকে সে ভীষণ ভালোবাসে।যদিও মানুষটার মনে তার জন্য কোন অনূভুতি নেই।তবে সে ভালোবেসে জয় করতে চায় তাকে।
রুপের কফি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া দেখল লাবিব! মেয়েটার মন, অনূভুতি সম্পর্কে ধারনা আছে তার। কিন্তু এটাও জানে তীব্রর মনে এসব কিছু নেই।রুপের মতো এতো সুন্দরী মেয়ে যদি তার হৃদয় স্পর্শ করতে না পারে তবে সে নিঃসন্দেহে পাথর,হৃদয়হীন!!

আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ২

লাবিব আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকালো রিদির দিকে। শুধু নাম শুনেই কেমন কাঁপছে মেয়েটা। কাঁপবে না কেন! তীব্রর সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎকার তো ছিল ভয়ংকর!!
কিছু খাবে কি আমার ছেলেটা?আমি কি বানিয়ে দেব??
তিরা চৌধুরীর কথায় লাবিব তাকালো তিরার দিকে! ভদ্রতা সহিত বলল,
বস যদি কিছু খায় তবে রুপকে অবশ্যই বলবে।আমাকে শুধু কফি আনতে বলেছে!!
তিরা চৌধুরী নিরাশ চোখে তাকায়।নিজের সন্তানের সাথেও কতো দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তার!চোখের দেখাও দেখতে পায়না ছেলেটাকে।তিরা ছুটে গেল তীব্র নিবাসে।যদিও সে জানে তীব্র নিষ্ঠুর!!!

আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৪