শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৯

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৯
নূরজাহান আক্তার আলো

আজ চাঁদ রাত। পুরো একটামাস সিয়াম সাধনার পর আগামীকাল ইদ উদযাপিত হবে সারাদেশে। দেখতে দেখতে চোখের পলকেই যেন কেটে গেল দিনগুলো। প্রতি বছর শারাফাত চৌধুরী সম্পদের হিসাব অনুযায়ী
মোটা অংকের অর্থ যাকাত দেন। জামা-কাপড় বিতরণ করেন। বস্তির অসহায় মানুষদের সাহায্য করেন। মসজিদে মসজিদে ইফতার করান।
মসজিদ তৈরি কিংবা মেরামতের কাজে টাকা দান করেন। এতিম দুস্ত বাচ্চাদের ইদ রঙ্গিন করতে নানান ব্যবস্থা করে থাকেন। এ বছরে বিপদ যেন পিছুই ছাড়ছে না। অনাকাঙ্খিত বিপদের কারণে এই বছরে সেসব কাজ দেরিতে হলেও ভাই ও দুই ছেলেকে নিয়ে সেটা সম্পূর্নও করেছেন।

উনার একটা বিশেষ গুন উনি দানের কথা কখনোই কাউকে বলেন না।
কত দান করলেন। কাকে দিলেন। কেন দিলেন। কীভাবে দিলেন। যা দেন সব নিজের মাঝে রাখেন। শারাফাত, সাফওয়ান, শাহাদত, সায়ন, শুদ্ধ, রুবাব, এদের সবার আয়ের কিছু অংশ একত্রে বিরাট এমাউন্ট আসে। তখন দু’হাত ভরে দান করা যায়। যদিও ছেলেদেরকে কখনো দিতে বলে নি তারাই নিজে থেকে দেয়। চৌধুরী বাড়ির সেফটির কথা স্মরণে রেখে
জামা-কাপড় বিতরণের আয়োজন বাড়ির বাইরে করেন। মজার ব্যাপার হলো ইদ সম্মুখে এলে বস্তি এলাকায় ট্রাকভর্তি সামগ্রী নিয়ে যাওয়া হয়।
ইদের বাজার ও জামা-কাপড় তুলে দেওয়া হয় গরীব মানুষদের মাঝে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দিনভর সেগুলো বিতরণ করা হয়। তারা জানে না কে দেয়? যারা হাতে তুলে দেয় তাদের জিজ্ঞাসা করলেও জবাব মিলে না। বলে না। জোর করলে বলেন,’ যারা দেয় তারা দোয়া কুড়াতে দেয়। আপনারা মন থেকে দোয়া করুন।’ নরম মনের সরল মানুষটা সেটাই করেন। আর প্রতি বছর এভাবে আড়ালে থেকেই সাহায্য করে আসছেন চৌধুরী বাড়ির পুরুষরা।
যাদের মাঝে শো অফ করার লেমমাত্র নেই।
চাঁদ রাত বিধায় ইফতারে পরপরই হই-হুল্লোড় বেঁধেছে চৌধুরী বাড়িতে।

ছোটোরা কাড়াকাড়ি করে খেয়েছে ইফতারের সব খাবার-দাবার। এত খাবার। এত আইটেম। তবুও ভাই-বোনদের খাবার কেড়ে খাওয়ার স্বাদ যেন অমৃত। সায়ন শীতলের আলুর চপ কেড়ে খেয়ে নিয়েছে। এটা নিয়ে দু’জন ঘ্যানঘ্যান করে কেবল থেমেছে। তারা থামতেই সাম্য শখের হাতে থাকা খেঁজুর কেড়ে মুখে পুরে দিয়েছে। শখ রাগী চোখে তাকাতেই দুষ্টুটা খিলখিল করে হাসছে। শখকে তারা কেউই ভয় পায় না। কারণ তাদের শখ আপু কখনোই কাউকে বকে না। বরং মিষ্টি করে কথা বলে। আদুরে সুরে ‘এমন করে না সোনা ভাই। ওটা কেন করলি পাখি? কী লাগবে, মন খারাপ কেন আমার কলিজার ভাইজানের?’ শখ সর্বদা এভাবেই কথা বলে। কত কী বোঝায়।

ভাই-বোনের আবদার মিটাতে কত কিছু কিনে দেয় তাই বোনদের মধ্যে শখ আপু বেস্ট। আর বোনদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ শীতল। কারণ সে সবকিছুতে আগে ভাগে ভাগ বসায়। ইফতার সেরে সব ভাই-বোনরা ছাদে উঠেছে চাঁদ দেখতে। হইহই করে চাঁদ দেখে মাদুর পেতে বসেছে। সায়ন, শুদ্ধ, রুবাব,শখ, স্বর্ন, শীতল, সাম্য, সৃজন সব কটাই উপস্থিত এখানে। গল্প হচ্ছে। হাসাহাসি হচ্ছে। খুঁনশুটি মারধর হচ্ছে। রুবাব কখনো এটা ওটা বলে শীতলকে রাগাচ্ছে, কখনো সাম্য, সৃজনের পেছনে লাগছে। সায়নও তাদের সাথে মেতে আছে। আর শুদ্ধ রেলিংয়ে হেলান দিয়ে পকেটে দু’হাত গুঁজে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাশের ছাদে। সেখানে কয়েকজন ছেলে আড্ডা দিচ্ছে। বারবার এদিকে তাকাচ্ছে। সে ব্যাপারটা খেয়াল করে এবার ফোনটা বের করে কাউকে ফোন করল,

-‘শুদ্ধ বলছি।’
অসময়ে পাশের বাসার শুদ্ধ ভাইয়ের কল পেয়ে সৌরভ অবাকই হলো। সে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করল। শুদ্ধ পুরুষালি গুরুগম্ভীর কন্ঠে
সালামের জবাব দিয়ে বলল,
-‘ তোদের ছাদে ক’জন ছেলেকে দেখছি। দুই মিনিটের মধ্যে নিচে নামতে বলে।’
-‘কোনো সমস্যা ভাই? কিছু করেছে তারা?’
-‘না। তবে না নামলে কিছু হবে।’
-‘আচ্ছা আমি এক্ষুণি নামতে বলছি।’

শুদ্ধ কল কাটতেই ছেলেগুলোর মধ্যে একজনের কাছে কল এলো। ওরা এদিকে একবার তাকিয়ে শুদ্ধকে সালাম দিয়ে নিচে নেমে গেল। এদিকে এতকিছু ঘটল বাকিদের কারোই খেয়াল নেই। তারা নিজেদের গালগল্পে ব্যস্ত। শুদ্ধ সেখানে দাঁড়িয়ে দেখছে চৌধুরী বাড়ির চাঁদের হাট। আনন্দে ঝুমঝুম করা প্রতিটা প্রাণ চৌধুরী বাড়ির হাঁট। তারা নিজ নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে আলো ছড়ায়। সুখ বিলায়। এজন্যই চৌধুরী বাড়িতে এত সুখ। এত আনন্দ। সবার মাঝে হঠাৎ তার চোখ গেল সাম্য, সৃজনের হাসিমাখা মুখের দিকে। মাত্র কয়েকটা দিন হয়েছে ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে। বাচ্চা দুটো যেন নতুন করে বেঁচে উঠেছে। আবারও তাদের মধ্যে ফিরে এসেছে চঞ্চলতা। যদিও আগের তুলনার খানিকটা সুস্থও বটে। তবে ওষুধ চলবে আরো কিছুদিন। ওদিকে কথায় কথায় ভাইবোনদের মধ্যে সাম্যের ছোট বেলার একটা ঘটনা মনে করল সায়ন। হাসতে হাসতে ঘটনাখানা মুখেও বলল। সেটা স্মরণ করে একযোগে হেসে উঠল সবাই। হাসতে হাসতেই গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা তাদের। কথাও বলতে পারছে না কেউ হাসির চোটে। রুবাব মনে করতে পারছে না কারণ রুবাব ছিল না। তাই
সায়নও ঘটনাখানা বলতে লাগল,

একদিন সাম্য, সৃজন দুই ভাই খেলনা নিয়ে মারামারি লাগিয়েছে। দু’জন দু’জনাকে খামচি মেরে রক্তারক্তি অবস্থা। ওদের খামচাখামচি দেখে চুপ করে পেছন থেকে সিরাত এসে দুটোকেই আরেক ঘা বসিয়েছে। মায়ের মার খেয়ে একসাথে চিৎকার করে কাঁদছিল ওরা। শুদ্ধকে ভাই-বোনরা ছোটো থেকে একটু বেশিই ভয় পায়। আবদার করে তবে লিমিট রেখে।
সেদিন ঢাকা থেকে শুদ্ধও ফিরেছে ঘন্টা খানিক হয়েছে মাত্র। ফ্রেশ হয়ে
বাইরে যাওয়ার জন্য বের হতেই দেখে দুই বানর গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। তাদের চোখ, মুখ খামচানো। রক্ত বের হচ্ছে একটু একটু। তাকে দেখেই দুটোরই হঠাৎ কান্না বন্ধ হয়ে গেল। তবে ফোঁপানো বন্ধ হলো না। ওদের কান্নারত মুখ দেখে শুদ্ধ ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করেছিল,
-‘ কি হয়েছে? চোখ, মুখের এই অবস্থা কেন তোদের?’
তারা কিছু বলার আগে সিরাত পুরো ঘটনা তাকে জানায়। ওরা দুই ভাই
নিজেদের এ অবস্থা করেছে দেখে দুটোকে কান ধরতে বলে। তারা ধরে। ড্রয়িংরুম তখন ফাঁকা। সিরাত তখন বকতে বকতে যান এ্যান্টিসেপ্টিক আনতে। তখন শুদ্ধ বলে,

-‘বাইরের কাউকে পাস নি? ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি করেছিস কেন? এবার থেকে মারামারি করতে ইচ্ছে করলে বাইরে থেকে কাউকে মেরে আসবি। মারার পর আরো দু’ঘা বসিয়ে শাসিয়ে আসবি যাতে বাড়িতে বিচার নিয়ে না আসে। বোঝা গেল? তবুও আমি যেন না দেখি নিজেরা নিজেরা মারামারি করেছিস। মনে থাকবে?’
দু’জনই কান ধরে ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। তখন শুদ্ধ বলল,
-‘আজকের পর থেকে যদি শুনি নিজেরা মারামারি করেছিস দুজনকে উল্টো করে ঝুলিয়ে মারব। কিন্তু এখন ভুল যখন করেই ফেলেছিস তখন পানিশমেন্টও ফরজ হয়ে গেছে। ‘
একথা বলে সে সৃজনকে বলল বাবা-মায়ের সম্পর্কে কিছু বলতে। সৃজন বলল,
-‘আমি উমম আমার বাবা-মাকে উমম খুব ভালোবাসি। তারাও আমাকে উমমম খুব উম ভা..লোবাসে..!”
-‘এক বাক্যে কতবার উমম উমম করলি? স্মার্ট ছেলেরা এভাবে কথা বলে? স্পষ্টভাবে কনফিডেন্টলি আবার বল। এবার যতবার উম বলবি ততটা মার খাবি।’
মারের ভয়ে এবার উম ছাড়া সৃজন তার টাস্ক পূরণ করল। এবার এলো সাম্যের পালা। শুদ্ধ তাকে বলল নিজের সম্পর্কে বলতে। সাম্য বলতে শুরু করল,

-‘আমি সোহানুর চৌধুরী সাম্য। আমি একজন মানুষ। আমার দুটো চোখ, দুটো গাল, একটি মুখ, একটি নাক ও একটা সু-স্বাস্থ্যবান বাম আছে। বাম আমাদেরকে বসতে সাহায্য করে। প্রাণীদের বাম মানুষের মতো নয় তাই তারা মানুষের মতো করে বসতে পারে না। আ..ম..।’
সাম্যের কথা শুনে শুদ্ধ ফোন থেকে চোখ সরিয়ে বলল,’গদর্ভ একটা। তোর ইয়ে আছে সেটা গর্ব করে বলতে হবে?’
-‘তুমিই তো বললে নিজের সম্পর্কে বলতে। তাই আমার যা আছে তাই নিয়ে বললাম।’
এটাই ছিল সেই ঘটনা মনে করে আজ এত হাসাহাসি। তাদের আড্ডার মাঝে সাফওয়ান চৌধুরী একটা ছেলেকে নিয়ে ছাদে এলেন। ছেলেটার বয়স সতেরো কী আঠারো। হাতে ডাবের কাঁদি। অন্যহাতে ধারালো বটি। উনি ছেলেটাকে ইশারা করতেই ছেলেটা ডাব কেটে সব বাচ্চাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন। রোজা থেকে ডাবের পানি শরীরে এনার্জি আনে এজন্য মোড়ের দিকে গিয়ে ডাব বিক্রি করতে দেখে সবার জন্য এনেছেন। এসব করতে করতে বেজে গেছে রাত সাড়ে আটটা। হঠাৎ শীতল চেঁচিয়ে উঠে স্বর্ণকে বলল,

-‘মেহেদী দিবো কখন আপু? আয়, হায়, আমার তো মেহেদীর কথা মনে ছিল না। চলো চলো, দ্রুত চলো।’
একথা বলে শখ আর স্বর্ণকে টানতে টানতে নিচে নিয়ে গেল। ওদেরকে দেখে সাম্য, সৃজনও সুড়সুড় করে চলে গেল। ছাদে ছিল তখন তিনভাই। ওরাও এবার নিচে নেমে এলো। আজমের কল পেয়ে সায়ন গেল পার্টি অফিসে। আজ ফিরবে কী বলা যাচ্ছে না। তবে স্বর্ণকে ইশায় বলে গেছে হাতভর্তি করে মেহেদী পরতে। বাড়ি ফিরে যেন স্বর্ণের মেহেদী রাঙা দুই হাত দেখতে পায়। স্বর্ণ জবাবে কিছু না বললেও তার চোখজোড়া হেসে উঠেছে। মাঝে মাঝে সায়ন যখন তাকে শাড়ি পরতে বলে। চোখজোড়ায় মোটা করে কাজল পরতে বলে তখন মুখে বিরক্ত হলেও মনে মনে খুশি হয়। এখন যেমন সায়নের কথায় জবাব না দিলেও সে খুব খুশি হয়েছে।
এবং ব্যাক্তিগত পুরুষটাকে খুশি করতে মেহেদী পরবে। তবে হাতভর্তি করে নয় খুব সাধারণভাবে। তবুও সায়ন এসে মুগ্ধচোখে হাত নেড়েচেড়ে দেখবে। চুমু খাবে। মানুষটা বরাবরই বড্ড পাগল। বাইরে যেমনই হোক না কেন তাকে খুব যত্ন করে ভালোবাসে।

এদিকে বাড়ির গিন্নি কাল সকালে কী কী রান্না করবে সেসব আলোচনা করছে। আজ রাতেই কিছু কাজ এগিয়ে রাখছেন হাতে হাতে। মেয়েরা ড্রয়িংরুমে হইহই করে মেহেদী দিতে বসেছে। স্বর্ণ দিয়ে দিচ্ছে শীতলকে আর শখ দিয়ে দিচ্ছে সাম্যকে। সৃজন আপাতত গাল ফুলিয়ে বসে টিভি দেখছে। মেয়েদের মেহেদী দেওয়া কখন হবে কে জানে। সাড়ে দশটা তো বেজেই গেছে। তাই সিঁতারা বাকিদের টেবিলে খাবার দিয়ে বড় থালায় ভাত এনে সব কটাকে খাওয়াতে বসলেন। আর একটু রাত বাড়লেই না খাওয়ার বাহানা জুড়ে বসবে বাচ্চাগুলো। খাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও
সিঁতারার জোড়াজুড়িদে শুদ্ধ আর রুবাব অল্প করে খেলো। তারপর
হাঁটাহাঁটির কথা বলে বাগান পেরিয়ে বাইরে গেল। হাঁটতে হাঁটতে মোড় পাড় করে কিছুদূর গিয়ে যেতেই রুবাব একটা দোকান থেকে সিগারেট আর লাইটার কিনে আনল। একটা তার ঠোঁটে গুঁজে আরেকটা শুদ্ধর দিকে এগিয়ে দিলো। শুদ্ধ সেটা নিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে বলল,

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৮

-‘ঝগড়া করেছিস?’
একথা শুনে রুবাব একপলক তাকিয়ে পরপর দুটো টান মেরে জবাব দিলো,
-‘হয়েছে।’
-‘ঐশ্বর্যকে আনমনা হয়ে কাজ করতে দেখলাম।’
-‘(…)’
-‘আজ কিছু কাজে ভুল করেছে বকা খেয়েছে। হাতে ব্যান্ডেজ দেখলাম।’
-‘কি হয়েছে হাতে?’
-‘ রান্না করতে গিয়ে নাকি হাত পুড়িয়েছে।’
-‘ এখন একটা গালি দেই, দেই গালি? দেশে ফেরার পর থেকে একবারও দেখা করে নি। বিয়ের কথা বললেই ওর নাকি চাঁদি গরম হয়ে যায়। শালা শশুরডা মরেও না আমার পথও ক্লিয়ার হয় না।’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৪০