হ্যালো 2441139 পর্ব ২৯
রাজিয়া রহমান
সকালে রজনী ঘুম থেকে উঠে দেখে একটা লাগেজ গুছানো।আজ আবারও সিরাজুল ইসলামের কোনো অফিসিয়াল ট্যুর আছে না-কি!
এই লোকের এই এক স্বভাব, হুট করেই বলবে তার অফিসিয়াল ট্যুর আছে।
রজনী ভাবনা চিন্তা বা কথা বলার সময় পেলো না।তাকে দ্রুত চায়ের পানি বসিয়ে মহুয়া বেগমের জন্য রান্না করতে হবে।আগে মহুয়া বেগমকে খাইয়ে তারপর আবার সবার জন্য নাশতা বানাতে হবে।
রজনী রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। চা বানানো শেষ হতেই নার্গিস এলো চা নেওয়ার জন্য। তার চার ছেলেমেয়ে আর স্বামীর জন্য চা নিলো।
রজনী ডেকে বললো, “তোর ভাইজানের মনে হয় ট্যুর আছে, একটু রুটি গুলো বেলে দে এসে পারলে।”
নার্গিসের মুখটা থমথমে হয়ে গেলো। গম্ভীর হয়ে বললো, “ঝুনি কোথায়?ওরে বলেন রুটি বানাতে।”
“আম্মা কচুর তরকারি খাবেন বলেছেন, ঝুনি কচুর ডগা কা ট ছে।তুই তাহলে সেটা কর,ঝুনি রুটি বানাবে।”
নার্গিসের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। সবদিক থেকেই ধরা পড়ে গেলো না-কি!
কচু ধরলে হাত চুলকাবে।তার চাইতে রুটি বানানো ভালো। কিন্তু এতো রুটি বানালে আজকে আর নার্গিসের হাত হাতের জায়গায় থাকবে না।
ভেবেচিন্তে বললো, “আপনি রুটি বানান তাহলে, আমি চা নাশতা বানাই।”
রজনী অমত করলো না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রজনী রুটি বানাতে বসে।নার্গিস শাশুড়ীর জন্য অল্প তেলমশলা দিয়ে সবজি খিচুড়ি রান্না করে নরম করে।
রান্না করতে গিয়ে নার্গিস হিসাব করে ঠিক কতো বছর পরে সে হাতে হাতা খুন্তি নিয়েছে!
মহুয়া বেগমের সময় মতো খাবার না হলে তিনি অশান্তি করেন।তাই রান্না হতেই নার্গিস নিয়ে গেলো তার খাবার।
প্রতিদিন রজনী রান্না করে। রজনীর হাতের রান্নায় এই বাড়ির বড় থেকে ছোট সবাই অভ্যস্ত।
কেউ রান্না করে মায়া,মমতা,যত্ন মিশিয়ে আর কেউ রান্না করে বিরক্তি নিয়ে।
রান্না এমন একটা সেনসেটিভ টাস্ক যেখানে স্পষ্ট বুঝা যায় ভালোবাসা মিশ্রিত রান্না না-কি বিরক্তি।
মহুয়া বেগম এক চামচ মুখে তুলেই নার্গিসের দিকে তাকায়। তারপর জিজ্ঞেস করে, “কে রান্না করছে?”
নার্গিসের রাগ লাগে। এই মহিলা এতো নখরা করে সবকিছু নিয়ে সবসময়। কোন যুগে জমিদারি ছিলো এখনো সেই ঠাঁটে চলতে চায়।সবাইকে মনে করে তার কাজের লোক।
মহুয়া বেগম আবারও জিজ্ঞেস করলো, “কে রানছে?রজনী রান্ধে নাই?”
“আমি রান্না করছি।”
মহুয়া বেগম প্লেটে পানি ঢেলে দিয়ে বললো, “নিয়ে যাও এগুলো।এসব ছাইপাঁশ মহুয়া বেগম খায় না।কোনো কিছুই তো জানো না।ছোটলোকের ঘর থেকে মেয়ে আনছি ছেলের বউ করে। না আছে শিক্ষা আর না আছে কোনো গুণ। গুণের মধ্যে একটাই আছে,কেমনে কাম কাইজ না করে খাইতে পারে।যতই বলি রজনীর দোষ, রজনীরে ছাড়া সব অচল।”
নার্গিস তেতে উঠে বললো,”হ আমি ছোটলোক।ছোটলোকের মেয়ে দেখেই বেঁচে গেছেন।যদি রজনীর মতো হতাম তাহলে আপনাদের এতো নখরা সহ্য করতাম না।আমারে রজনী ভুলেও ভাববেন না।আমি নার্গিস,কাজের লোক না।”
নার্গিস প্লেট নিয়ে চলে গেলো।
কিছুক্ষণ পর শিরিন গিয়ে মিরাজুল ইসলামকে ডেকে আনলেন। নার্গিস তৈরি হয়েই ছিলো।আজকে সে ছেড়ে কথা বলবে না।
মিরাজুল ইসলাম আসতেই মহুয়া বেগম বললেন, “তোর বউ নিয়ে তুই আজকেই আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবি।আমার নাতি নাতনি কেউ যাবে না।তুই তোর বউ নিয়ে চলে যাবি।ছোটলোকের মেয়ের সাহস কতো! আমার মুখে মুখে কথা বলে। মহুয়া বেগমের সাথে তর্ক করে তোর বউ!আমি জমিদার বংশের মেয়ে,জমিদার বংশের বউ।ওর এই স্পর্ধা হয় কি করে! ”
নার্গিস দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। রুমে ঢুকে বললো, “এতো জমিদারি হইলে আমার মতো ছোট ঘরের মেয়ে আনলেন কেনো? কি ভাবছেন,ছোট ঘরের মেয়ে এনে কাজের লোকের মতো রাখবেন?
আপনার আর আপনার মেয়ের কথার নিচে রাখবেন?
পুতুলের মতো চলমু?
এতো সোজা না সবকিছু।
আমি ছোট ঘরের মেয়ে।আমার বাপ মা বড় ভাবীর মতো সমাজের নামীদামী মানুষ না,উচ্চবংশীয় না যে তার মতো আমার ও বাবা মা’য়ের মান ইজ্জতের চিন্তা করে দাঁত কামড়ে সব সহ্য করে যেতে হবে।আমাকে ওনার মতো বাঁদী বানাতে পারবেন না কখনো।উনি তো শিক্ষিত বাঁদী এই বাড়ির।
আমার এতো ঠ্যাকা নেই।থাকলাম না আপনার বাড়িতে।”
মিরাজুল ইসলাম নার্গিসের গালে সপাটে একটা থাপ্পড় বসালেন।নার্গিস হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই প্রথম স্বামী তার গায়ে হাত তুলেছে।
মিরাজুল ইসলাম গম্ভীর হয়ে বললো, “সবসময় বড় ভাবীকে টেনে কথা বলতে আমি নিষেধ করেছি।আমার মা বোনের চাইতে বড় ভাবী আমার কাছে অধিক সম্মানীয়।এই থাপ্পড়টা শুধু মাত্র বড় ভাবীকে অপমান করে কথা বলায় দিয়েছি।”
শিরিন অবাক হয়ে বললো, “তোর বউ যে আম্মার সাথে বেয়াদবি করতেছে,সেটা? ”
“আম্মার সাথে কোনো বেয়াদবি নার্গিস করে নি আপা।আম্মার কথার উত্তর দিয়েছে শুধু। আম্মা নিজেই যদি এমন প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলে যার উত্তরে তার অপমান হয় তাহলে কেনো বলেন এরকম কথা? আমি এই বাড়ি থেকে কোথাও যাবো না।এই বাড়ি আমার বাপ,দাদার বাড়ি।মায়ের বাপের বাড়ি না।হতে পারে আব্বা ওনার নামে লিখে দিয়েছে, তাতে কি?আমি কোথাও যাবো না।”
নার্গিস রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
মিরাজুল ইসলাম মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “আম্মা,এখন ভালো লাগছে না?আমি যখন বলেছিলাম আম্মা এখানে বিয়ে করবো না।বিয়ে হতে হয় সমানে সমানে অথবা ঊনিশে/বিশে।আপনি আমাকে বিয়ে করিয়েছেন দশে/বিশে ফারাক রেখে।কেনো আম্মা?শুধু মাত্র বড় ভাবী শিক্ষিত বলে,চাকরি করতে চায় বলে আপনি এরকম করেছেন।সবাই মানুষ, তবুও আমাদের কালচার, প্রেস্টিজ, সোসাইটি,ক্লাস আর আমার শ্বশুর বাড়ির সবটা একেবারে আলাদা।
যেই কথাগুলো আমাদের ফ্যামিলিতে আমরা মুখে আনতে ও দুই বার চিন্তা করি সেসব ওদের ফ্যামিলিতে ডালভাত।
আমরা এখনো আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে ভয় পাই,কিন্তু ওদের ফ্যামিলিতে ওরা বাবা মা’য়ের দিকে তেড়ে আসে ঝগড়ার সময়।
আপনি আমার কথা শুনেন নি।আপনার কাছে আপনার রাগ,জেদ,সিদ্ধান্ত সবকিছুর উর্ধ্বে।
এখন আমার কাছে বিচার দিয়ে লাভ হবে না আম্মা।আমি তো বিচার করবো না।নার্গিসের যেভাবে ভালো লাগে সেভাবেই চলবে ও।আমি আসি,আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। ”
বাড়ির পরিস্থিতি ভীষণ থমথমে। মহুয়া বেগম থম মেরে বসে আছেন নিজের রুমে।সবকিছু কেমন তার নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাচ্ছে। তিনি কি জীবনের শেষ পর্যায়ে চলে গেছেন?
এখন আর তার হাতে কিছুই নেই?
এরপর কি এই সংসার ও তার হাতছাড়া হয়ে যাবে?
জীবনের শেষ প্রান্তে বসে ও মহুয়া বেগম সংসারের চাবিকাঠি নিজের হাতে ধরে রাখতে চান।
দুপুরে খাওয়ার টেবিলে পিয়াসা আষাঢ়কে দেখে অবাক হয়। এই বান্দা তো এই সময়ে এখানে থাকার মানুষ না।সে তো রাত ছাড়া বাড়িতে আসার মানুষ না।
আষাঢ়কে দেখে পিয়াসার আজকে কোচিং এর কথা মনে পড়ে যায়। কোচিং এ একটা মেয়ে আজকে আষাঢ়কে একটা চিঠি আর ফুল দিয়েছে।
পুরো ক্লাসের আজকের হট টপিক ছিলো এটা।
হোয়াইট বোর্ডে বড় করে লিখা ছিলো, “143 আষাঢ় ভাইয়া।”
আষাঢ় তার নিচে লিখে দিয়েছে,”ধন্যবাদ খালাম্মা। আমি অলরেডি কমিটেড।”
পিয়াসা মনে মনে ভাবলো এই বন্য লোকের সাথে কার আবার সম্পর্ক করতে ইচ্ছে করছে? আর কে-ই বা সম্পর্কে আছে!
মানুষের রুচির এতো দুর্ভিক্ষ!
খাওয়ার পর আষাঢ় পিয়াসাকে বললো তার সাথে যেতে।
পিয়াসা বুঝতে পারলো না কেনো ডাকছে।রজনী রান্নাঘরে ব্যস্ত। পিয়াসা আর গেলো না।এই লোকটার সাথে তার কোনো কথা নেই।
কিছুক্ষণ পর আষাঢ় এলো পিয়াসার রুমে। পিয়াসার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো রজনীদের রুমে।
“আলমারিতে মা’য়ের কাপড় আছে।বর্ষা আপার সাথে গেছে। তুমি মা’য়ের লাগেজটা গুছিয়ে নাও।বাবা মা’কে নিয়ে ঘুরতে যাবে।মা জানে না এখনো। আমি তো জানি না কি কি দিতে হবে।তুমি একটু হেল্প করো।”
পিয়াসা শুনে খুশি হলো।মা’য়ের থেকে সবকিছু শুনেছে রজনী আন্টির কথা। আর এই বাড়িতে আসার পর থেকে তো স্বচক্ষে দেখছে।
বিকেলে আষাঢ় বললো, “মা চলো,বাবাকে আমরা পৌঁছে দিয়ে আসি।”
রজনী চা বসিয়েছে।
কোমরে কাপড় গুঁজে বললো, “আমার সময় হবে না রে।তুই যা না।”
আষাঢ় নাছোড়বান্দার মতো বললো, “না না,চলো।তুমি আর আমি যাই।”
“সন্ধ্যা হয়ে আসছে।তোর দাদীর জন্য রান্না বসাতে হবে।”
“মা সবসময় এতো ব্যস্ততা দেখিও না তো।”
রজনী এক মুহূর্ত ভেবে বললো, “আচ্ছা চল।তাহলে পিয়াসাকে ও নিই।ফেরার সময় ওকে রেস্টুরেন্টে খাইয়ে আনবো।ওদের বাড়িতে ওর বাবা মেয়েকে ফুলের মতো যত্ন করে। এখানে আসার পর তো একবারের জন্যও বাহিরে খাওয়াতে নিতে পারি নি।”
হ্যালো 2441139 পর্ব ২৮
আষাঢ় খুশি হলো।এতো সোনায় সোহাগা।
রজনী কাপড় চেঞ্জ করে নিয়ে পিয়াসাকে ডাকলো।
পিয়াসা বিপদে পড়ে গেলো।রজনী আন্টি তো জানে না ঘুরতে যাচ্ছেন তিনি সহ।এখন তো তাকে বলা ও যাবে না।আবার গেলে তো এই বন্যর সাথে একা আসতে হবে।
রজনী আন্টি যেভাবে বলতেছে না গিয়ে ও তো পারবে না।
কি এক যন্ত্রণা!