শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৪০
নূরজাহান আক্তার আলো
-‘ এখন একটা গালি দেই, দেই গালি? দেশে ফেরার পর থেকে একবারও দেখা করে নি। বিয়ের কথা বললেই ওর নাকি চাঁদি গরম হয়ে যায়। শালা শশুরটাও মরে না আমার পথও ক্লিয়ার হয় না।’
-‘তোকে না মেরে মরবে কেন?’
-‘সেটাই। ওরা বাবা-মেয়ে পয়দা হয়েছে আমার জীবন জ্বালানোর জন্য। নয়তো এমন খাপে খাপ হা’রাম’জা’দা’ বাপের হারামজা’দী কন্যা হয় কী করে? ইয়ে শুদ্ধ ভাই রে শোন না, হাত কি বেশি পুড়েছে?’
-‘হুম।’
-‘ডাক্তার দেখিয়েছে? কি বলেছে ডাক্তার?’
ঐশ্বর্যের হাত পোড়ার কথা শুনে রুবাবের উতলা ভাব দেখে শুধু মুচকি হাসল শুদ্ধ। এ পাগল দুটো, দু’জন দু’জনকে এত ভালোবাসে অথচ ভাব খানা এমন করে যেন কেউ কাউকে চেনে না। কখনো কথা হয় নি। কারণ
বাংলা সিনেমার মতো তাদের এক হওয়ার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে ঐশ্বর্যের বাবা রাশিয়ান সাইন্টিস্ট মিখাইল ইগর। ঐশ্বর্যের মা রেজিনা মাহতিমের
দ্বিতীয় স্বামী। মায়ের ভুল মানুষকে সঙ্গী করার মাসুল দিচ্ছে ঐশ্বর্য। ওই বেচারী পড়ে গেছে অথৈ সাগরে। রেজিনা যদি ইগরের প্রেমের জালে গা না ভাসাতেন তাহলে ঐশ্বর্যও স্বাভাবিক ভাবে লাইফ লিড করতে পারত।
কিন্তু সেটা হয় নি। কারণ ঐশ্বর্যের সৎ বাবা মিখাইল ইগর ঐশ্বর্যকে সব সময় হাতের পুতুলের মতো নাচিয়ে যাচ্ছে। উনি সাইস্টিস্ট হয়েও উনার আবিষ্কার ভুল পথে ব্যবহার করেন। এমনকি ঐশ্বর্যকে শুদ্ধর সঙ্গে কাজ করতে পাঠানো ছিল মিখাইলের একটি বড় প্ল্যানের অংশ। যেটা ঐশ্বর্য আগেই শুদ্ধকে জানিয়ে দিয়ে তার সাথে দেশে ফিরে এসেছে৷ ইগরের থেকে পালিয়ে বাঁচতে আছে শুদ্ধর গোপন ল্যাবে। সেখানেই রাত-দিন এক করে রিসার্চের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। খুব তাড়াতাড়ি তাদের একটি আবিষ্কার উন্মোচন করা হবে বিশ্ববাসীর কাছে। সেটা নিয়ে জোর কদমে কাজ চলছে। সে নিজেও কাজের মাঝে পড়ে থাকত ল্যাবে কিন্তু ইগরের লোক আর ইয়াসির আঠার মতো পেছনে পড়ে আছে। অলটাইম তার দিকে নজর রাখছে৷ নজর ফাঁকি দিয়ে ওই ল্যাবে যাওয়াটাও রিস্কি হয়ে যাবে বলে যাচ্ছে না৷ এমন ভাব করে চলতে হচ্ছে ঐশ্বর্যের কোনো খোঁজ সে জানে না। অথচ শুদ্ধর সাথে তার প্রতিনিয়ত কাজ নিয়ে কথা হয়। মেয়েটা সত্যিই মারাত্মক লেভেলের ট্যালেন্ট। তার কাজের ধরণ, ভাবনা, অবিশ্বাস্য রকমের সুন্দর। আর রুবাব কীভাবে যেন তারই প্রেমে পিছলে পড়েছে। প্রায় অনেকদিনই ঐশ্বর্যের পেছন লেগে থেকে তাদের সম্পর্কটা এক জায়গায় স্থির হয়েছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এটা জানার পর থেকে ইগরের অত্যাচার আরো বেড়ে গেছে। সে এখন পাগলের মতো ঐশ্বর্যকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। হাতের কাছে পেলে হয়তো ঐশ্বর্যকে শ্বাস নেওয়ার সময়টুকুও দেবে না। হাত পোড়ার কথা শুনে রুবাব পকেট থেকে ফোন বের করে কল দিলো ঐশ্বর্যকে। ঘাড়ত্যাড়া মেয়েটা কল রিসিভ করছে না। মানে হয় এসবের? কয়েকবার চেষ্টা করেও কাজ হলো না দেখে চোখ, মুখ, কুঁচকে থমথমে মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। রাগে মুখ থমথম করছে। তখন শুদ্ধ বলল,
-‘তোর শশুরকে খেলিয়ে দেশে আনতে হবে। গেম টা উনি শুরু করলেও সমাপ্তি টানার দায়িত্ব আমার। স্যার মানুষ বলে কথা এক্সট্রা সন্মান না দিলে চলে?’
-‘বা’লের শশুড় আমার। শালা আমার জীবনটাকে তেজপাতা বানিয়ে দিলো। ওইটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যা করার করে আমার বউটাকে আমাকে দে। নয়তো আমি মামাকে বলে দিবো তুমি শীতলের মন নিয়ে ছুঁ কিতকিত খেলতে শুরু করেছো।’
একথা বলে রুবাব একটু থামল। তারপর পুনরায় বলল,
-‘মাঝে মাঝে ঐশ্বর্যের ছেলেমানুষী আমার সহ্য হয় না। ও নিজেও জানে ওর হা’রা’ম’জা’দা বাপ কখনো আমাকে মেনে নেবে না। নিলে আরো দুই বছর আগেই নিতো। ওকে ভালেবাসি! সংসারটা আমি ওর সাথেই করব বলে এতদিন ধরে অপেক্ষা করছি। শুধু তার জেদের কারণে মা আমার সাথে কথা বলে না। আমি এখানে আছি বলে সেদিন এলো ঠিকই থাকল না। ঐশ্বর্যও জেদ ধরে আছে বিয়ে করলে নাকি ওর বাবা আমাকে মেরে দিবে। আমার ভালো জন্য আমাকে বিয়েটা করবে না। মানে বাবার হাতে মরতে দিবে না অথচ আমাকে দহনে পুড়িয়ে আধমরা করে রাখবে। এই নাকি আবার ভালোবাসা? এদিকে সমন্ধির পোলা ইগর তোর ফমূর্লা না পেয়ে পাগল কুকুর হওয়ার অবস্থা। না, সবকিছুতে প্যাঁচের উপর প্যাঁচ। মানে দিনকে দিন আমার জীবনটা প্যাঁচ লাগানো ইয়ারফোন হয়ে গেছে, বাল।’
নিশ্চুপ শুদ্ধ জবাব দিলো না। হাঁটছে দুভাই। সিগারেট টানছে ধীরে সুস্থে।
রুবারের ভেতরের অস্থিরতা যেন টের পাচ্ছে শুদ্ধ। নীরবে কিছুদূর গিয়ে সামনে দাঁড় করানো সায়নের বাইকের চাবিটা পকেট থেকে বের করে রুবাবের হাতে ধরিয়ে দিলো শুদ্ধ। রুবাব চাবি হাতে নিয়ে কিছু বলার আগেই শুদ্ধ বলল,
-‘এতদিন ঐশ্বর্য শুধু আমার দায়িত্বে ছিল। যতটুকু পেরেছি বড় ভাইয়ের মতো সব সময় সেভ করেছি। কিছুক্ষণের জন্য তোর দায়িত্বে ছাড়লাম, কাজেই সাবধান।’
-‘মানে?’
-‘এখানে একটু দাঁড়া জবাব পেয়ে যাবি।’
একথা বলে রাস্তার ওপর পাশে দাঁড় করানো কামরানের গাড়িতে উঠে বসল সে। চোখের পলকে শাঁ শাঁ করে চলে গেল গাড়িটা। রুবাব বিরক্ত
মুখে বাইকের উপর বসতেই উপলদ্ধি করল কেউ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ তুলে তাকিয়ে ঐশ্বর্য দেখে আর পলক ফেলল না। তারপর ঝট করে এশ্বর্যের হাত ধরে নাড়িয়ে ঘুরিয়ে দেখে বলল,
-‘শুদ্ধ যে বলল হাত পুড়িয়েছো, কই দেখি?’
-‘ আমার? কই নাতো। বরং ভাইয়া তো বলল তুমি নাকি হাত পুড়িয়েছো। এজন্যই তো রিস্ক নিয়ে বের হলাম। ”
এবার দু’জনের বুঝতে বাকি নেই এটা শুদ্ধর চালাকি। আসলে দুজনেই দু’জনকে কাছে পাওয়ার জন্য উতলা। অথচ পারিপাশ্বিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে দূরে সরে আছে। তবে দু’জন দু’জনকে সেভ দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। কিন্তু রুবাব বোধহয় ঐশ্বর্যকে স্বস্তি দিতে নারাজ। এক ঝটকায় সে ঐশ্বর্যকে নিজের আরো কাছে টেনে ঠোঁটজোড়া দখল করে নিলো। শুষে নিতে থাকল প্রিয়শী ওষ্ঠজোড়া। ঐশ্বর্য রুবারের বুকে ধাক্কা দিলে রুবাব একটা কামড় বসিয়ে দিলো। যেন বাঁধা দেওয়ায় বিরক্ত সে।
কিছুক্ষণ এভাবে থেকে রুবাব সরে গেল। ঐশ্বর্য ঠোঁট মুছতে মুছতে অন্য দিকে তাকিয়ে হাঁপাচ্ছে। অথচ খুব ভালো করে বুঝতে পারছে রুবাবের চঞ্চল দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ। বরাবরের মতোই ঐশ্বর্যের পরিপাটি লুক। পরনে কালো জিন্স আর সাদা লেডিস শার্ট। চুল পনিটেইল করে বাঁধা। হাতে স্মার্ট ওয়াচ। কানে ছোটো ছোটো দুটো টপ। ঠোঁটে চ্যাপষ্টিক আর
ভাসা কাজলহীন চোখ। মেয়েটার এই বেশে যেন ইনডিপেনডেন্স গ্রামার লুকটা ফুটে উঠেছে। রুবাব আপাতত বাইকের চাবি নিয়ে ঐশ্বর্যের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর বাইকে বসে তাকেও বসতে ইশারা করে বলল,
-‘আল্লাহ শুধু কবুল বলার তৌফিক দান করুন তারপর শায়েস্তা কাকে বলে হারে হারে যদি টের না পাইয়েছি তো আমিও রুবায়েত কবির নয়।’
ঐশ্বর্য একথা শুনে ঠোঁট টিপে হেসে বাইকের পেছনে উঠে বসল। কিছু বলতে হলো না বিনাবাক্যো মাথা রাখল রুবাবের কাঁধে। জোরে নিঃশ্বাস টেনে নিলো প্রিয় মানুষ গায়ের ঘ্রাণ। তাতেই মন খারাপের রেশ কোথায় যেন দৌড়ে পালিয়ে গেল। বেহায়া মন ঝুমঝুম করে গেয়ে উঠল। বলতে থাকল একনাগাড়ে, ‘কত্তদিন পর!
পার্টি অফিসের চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে ভ্রুঁ কুঁচকে সিগারেট ফুঁকছে সায়ন। ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। ব্যস্ত হাতে টাইপ করছে কাউকে। সে কেউটা আর অন্য কেউ নয় তারই স্বর্ণকোমল। তার কথামতো হাতে মেহেদী দিয়ে কয়েকটা ছবি পাঠিয়েছে স্বর্ণ। সায়ন সেটাতে লাভ রিয়েক্ট দিয়ে নানান দুষ্টুমার্কা কথা বলে চলেছে। স্বর্ণ সিন করলেও কিছু বলছে না। শুনছে পাজি প্রেমিকের কথা।
এদিকে অনেক্ষণ ধরে তারই পাশে দুহাতে মেহেদী লাগিয়ে বসে আছে আজম। কী যে খুশি ছেলেটা। চোখে, মুখে যেন অসীম আনন্দ ঝরে পড়ছে তার। বার বার চোখের সামনে হাত নিয়ে দেখছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। এইতো কিছুক্ষণ আগে সে কিছু জিনিসপত্র তার হাতে দিয়ে পাঠিয়েছিল চৌধুরী নিবাসে। বলেছিল সিঁতারার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে আসতে। সে গিয়ে শীতলদের মেহেদী দিতে দেখে নিজেও বসে পড়েছে হাতে মেহেদী পরতে। গল্পে গল্পে কত মজা যে করেছে সময়টুকুতে। অনেক দেরী হচ্ছে দেখে সায়ন কল করলে জানল সে বসে বসে মেহেদী পরছে। একহাতে শীতল মেহেদী পরাচ্ছে আরেক হাতে শখ। তার মেহেদী পরার কথা শুনে সায়ন বিরবির করে গালি দিয়ে কাজ শেষ করেই আসতে বলেছে। এতে আজম যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছে। সে ধীরে ধীরে মেহেদীর পরে রাতের খাবার খেয়ে তারপর এসেছে। বাড়ির সবাই নাকি বলেছে কাল যেন বেড়াতে যায়। শীতল বলেছে মেহেদী রং কেমন আসে তা দেখিয়ে আসতে। মেহেদী রং দেখলে নাকি বোঝা যায় মনে কতটুকু ভালোবাসা আছে। ভালোবাসা পরীক্ষা করানোর জন্য সে যেন অবশ্যই যায় চৌধুরী নিবাসে। একথা শুনে আজম ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়েছে। কিন্তু চাইলেই কী যাওয়া যায়? সায়ন না বললে তো যেতেই পারবে না। এসব ভেবে সে এবার সাহস করে বিড়াল সুরে ডাকল,
-‘ভাই?’
-“হুম।’
-‘শখ আপা, স্বর্ণ আপা, শীতল আপা, সাম্য, সৃজন হেগোরে আমি নিজ ভাই বুনের নজরে দেখি। হেগোর কিছু হইলে আমারও খুব বুক পুড়ে।’
-‘মেয়ে মানুষের মতো হুদাই কথা প্যাঁচাইয়া মেজাজ খাইন না আজম্য।’
-‘না মানে আমি যদি কাইলকা হেগোরে ইদ সেলামী দেই আফনে কী রাগ করবেন, ভাই?’
-‘হঠাৎ?’
-‘,আমার তো কোনো ভাই বুন নাই। কেউ ইদের দিন আমার থিকা টাকা পয়সা চাইতে আহে না। টাকার লিগা ঝগড়া করে না।’
একথা শুনে সায়ন চোখ তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে আজমের দিকে তাকাল। দুই কী একপল তাকিয়ে আজমের অস্বস্ত্বি ভরা মুখখানা দেখল। তারপর দৃষ্টি সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে একটা জরুরি কাগজ খুঁজতে খুঁজতে বলল,
-‘তোর ভাই-বোনদের তুই সেলামী দিবি আমি কেন রাগ করব?’
-‘এ্যাঁ?’
-‘এখনই তো বললি তারা কষ্ট পেলে তুইও কষ্ট পাস। তাহলে তারা যাতে খুশি হয় সেটা নাহয় কর এবার। এখানে আমার পারমিশনের প্রয়োজন নেই।’
-‘না মানে অল্প ট্যাকা দিলে হেগোরা মাইন্ড খাইব না তো?’
-‘যুগ হিসেবে আমার ভাই বোনরা সব সময় অল্পতে খুশি। তবে যে যেটাই দিক হাসি মুখে খুশি মনে দিতে হবে। নয়তো তারা লাখ টাকার বান্ডিলও ছুঁয়ে দেখবে না।’
-‘তাও কন না ভাই কত দিবো?’
-‘পাঁচ টাকা, দশ টাকা যা তোর সামর্থ্য তাই দিবি।’
-‘চারশ করি দেই?’
-‘দে।’
একথা শুনে আজম তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে হাত ধুঁয়ে এলো। ভালোই রং এসেছে। সে প্যান্টে হাত মুছে বেঞ্চের উপর বসে খাম আর কড়কড়ে
একশ টাকার একটা বান্ডিল নিয়ে ভাগ করতে বসল। সায়ন কাজ ফেলে আড়চোখে বার বার দেখতে লাগল আজমের খুশি। আজমের ভাই-বোন নেই। ইদে ভাইবোনদেরকে ইদ সেলামী দেওয়ার আনন্দ উপভোগ করতে পারে না। এবার সুযোগ পেয়েছে দেখে ছেলেটার ঠোঁটে হাসি যেন ধরছে না। তার চোখ মুখ বলে সে ভীষণ খুশি। কথা হচ্ছে, মাঝে মাঝে কারো খুশির কারণ হতে মন্দ লাগে না।’
_’ওই কিরে, কিরে?’
_’মধু, মধু।’
শীতলের প্রশ্নে সাম্যের জবাব শুনে একযোগে হেসে উঠল ভাই বোনরা সবাই। মেহেদী দেওয়া কেবল শেষ হলো। রাত তখন এগারোটা একুশ।
মা-চাচীসহ বাড়ির প্রত্যেকটা নারী/মেয়ের হাত মেহেদীতে রাঙা। সবার প্রথমে দেওয়ায় শীতলের হাতের মেহেদী শুকিয়ে গেছে অনেক আগেই।
তবুও গাঢ় রং পাওয়ার আশায় কেবলমাত্র হাত ধুয়ে দেখল চমৎকার রং এসেছে। ফর্সা হাতে মেহেদীর গাঢ় রং টা ফুটে উঠেছে। ফোন থাকলে রং ঢং করে ছবি তুলতে পারত। কিন্তু ফোনটাই তো নেই। ফোনের কথা মনে করে মনটা ভীষণ খারাপ হলো। পরক্ষণে মায়ের ফোনটা নিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে বাবাকে পাঠিয়ে দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহাদত চৌধুরীর রিপ্লাই এলো,
-‘আমার আম্মা! মাশাআল্লাহ্ খুব হয়েছে মা।’
বাবার কথা শুনে শীতল হাসল। আরো টুকটাক কথা বলল বাবার সাথে।
তারপর কী ভেবে তার মেহেদী রাঙ্গা হাতের ছবিগুলো সেন্ড করল শুদ্ধর What’s app এ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেও সিন হলো না দেখে ফোনটা রেখে রুমে চলে গেল। রুমে গিয়ে কাল কীভাবে সাজবে, কী পরবে সব বের করে গুছিয়ে রাখল। যাতে সকালে সবার আগে রেডি হয়ে সেলামী হাতাতে পারে। এবার কারো থেকে কম করে সেলামী নিবে না কারণ এই সেলামী দিয়ে আরেকটা ফোন কিনবে। এসব ভেবে সবচেয়ে সুন্দর ড্রেস বের করে আরেকবার গায়ে মেলে ধরল। বড় আব্বু, মেজো চাচ্চু, বাবা দিয়েছে মোট চারটা ড্রেস। রুবাব, সায়ন ভাইয়া দিয়েছে দুটো। তবে সে বড় মাকে বলতে শুনেছে শুদ্ধ এবার সবাইকে টাকা দিয়েছে, যার যার পছন্দমতো ড্রেস কিনে নিতে। কিন্ত কই তাকে তো কেউ টাকা দেয় নি। তার ভাগের টাকা কই? তারমানে কি শুদ্ধ ভাই তার টাকা মেরে দিলো?
একখা ভেবে সে টাকার খোঁজে ছুটতে গিয়েও থেমে গেল। বড় মা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে এতক্ষণে। এখন ডাকা বোধহয় ঠিক হবে না।কিন্তু টাকা?
কাল সকালে নাহয় শুদ্ধ ভাইয়ের থেকে টাকা বুঝিয়ে নেবে।একথা ভেবে
সে পুনরায় নিজের ড্রেস হাঁতাতে শুরু করল। সেসব বের করতে গিয়ে শুদ্ধর একটা টিশার্ট খুঁজে পেল। এটা চুরি করা কত নং টি-শার্ট মনে নেই তবে এগুলো শুদ্ধর সেটা মনে আছে। কারণ তার পরনের জামা কাপড় কিংবা ব্যবহার করা সুগন্ধি সবকিছুর মধ্যে স্পেশাল কিছু একটা থাকে।
জিনিস সাধারণ তবে দেখে মনে হয় অসাধারণ। এমনকি পছন্দ নিয়েও কিছু বলার নেই,জহুরী চোখে তাকিয়ে খুঁজে খুঁজে ইউনিক জিনিস খুঁজে বের করতে পটু সে। কিছু চাইলে টাকা নাই বললেও কানের কাছে একটু ঘ্যান ঘ্যান করলে সেটাই কিনে দেয়। তখন আর দাম কোনো ব্যাপার না।
বলা বাহুল্য,শুদ্ধ ভাই এমনিতে খুব ভালো কিন্তু কিছু করলেই চ্যালাকাঠ দিয়ে মারে, এই যা! এসব কথা ভাবতে ভাবতে ড্রেসিংটেবিলের সামনে
গিয়ে দাঁড়াল শীতল। চুল আঁচড়ে লম্বা বেনুনি গাঁথল। তারপর নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে লাজুক মুখে বিরবির করল ‘এত গ্লো করছি কেন?’
একথা বলে লজ্জা পেয়ে দুই হাতে মুখ ঢাকল। কিন্তু তার লজ্জার জান কবজ করতে তখনই আচমকা হেঁচকি উঠতে লাগল। একবার..দুইবার.
তিনবার..করে একের পর এক হেঁচকি উঠতেই থাকল বেচারীর। মানে হয় এসবের? কোনো কাজ করতে গেলে অঘটন ঘটিয়ে ঘটে বসে। এখন একটু লজ্জা পাবে তারও জো নেই মরতে মরতে এখনই হেঁচকি উঠতে লাগল। শুদ্ধ ভাই ঠিকই বলে সে কোনো কাজে না সে হচ্ছে ননীর পুতুল।
নির্দিষ্ট কারো রুমের শোভা বাড়ানো ছাড়া ওকে দিয়ে আর কিছু হবে না।
ধুর, ফুরফুরে মেজাজ একেবারেই বিগড়ে গেল। হেঁচকির ঠ্যালায় আগে ঢকঢক করে পানি গিলে শুয়ে পড়ল।
রাত বাড়ার সাথে সাথে স্তব্ধ চৌধুরী নিবাস। ঘুমে বিভোর চৌধুরী বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য। ঘড়িতে তখন রাত আড়াই টা। পায়ে হেঁটে মূল ফটক পেরিয়ে শুদ্ধ তখন বাড়ি ফিরল। রুবাব ফিরেছে অনেক আগে কয়েক ঘন্টা আগে কথা হয়েছে তার সাথেও। ঐশ্বর্যকেও ল্যাবে পৌঁছে দিয়েছে।
সায়ন ফিরবে কখন ঠিক নেই। সকাল হবে হয়তো। তার দলের একজন ছেলের বাবা মারা গেছে কিছুক্ষণ আগে। উনি নাকি প্রায় এগারো বছর ধরে বিছানাগত হয়ে পড়েছিলেন। অতঃপর চাঁদ রাতে মারা গেলেন। ইদ কিংবা ইদের আনন্দটুকু পুরোপুরিভাবে উপভোগ করতেও পারলেন না। খুব খারাপ লাগল কথাটা শুনে। কিন্তু মৃত্যু কি আর বলে আসে? চিরন্তন এই সত্যকে মেনে নিতেই হবে। মৃত্যু প্রভাবশালী, ধনী, গরীব দেখবে না। যখন যার দুয়ারে দাঁড়াবে তাকেই মৃত্যাুর স্বাদ গ্রহন করতে হবে। বাইরে এখনো পটকা ফুটছে। গান বাজছে। চাঁদ রাত উদযাপন করতে বাঙালি।
রাত অনেক হয়েছে তাই শুদ্ধ নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুলে
ভেতরে প্রবেশ করল। নিঃশব্দে দরজা আঁটকাল। তারপর ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে এগোলো রুমের দিকে। শীতলের রুম টা পার হতে গিয়ে দেখল দরজা আঁটকানো। সচারচর দরজা বন্ধ করে ঘুমায় না শীতল। ভয় করে। দরজা বন্ধ মানে এখনো ঘুমায় নি বোধহয় ব্যাঙাচি।
ইদের ড্রেস পরে এখনই সাজতে বসেছে নাকি কে জানে। সাজতে পারে। তার যা স্বভাব সে যদি এখন ইদের ড্রেস পরে ঘুরে বেড়ায় তাও অবাক হবে না। কারণ সে কাজগুলো করে ওই রকম। শুদ্ধ আর দাঁড়াল না রুমে
গিয়ে একেবারে শাওয়ার নিলো। রাতে ঘুমানোর আগে শাওয়ার নেওয়া তার বহুদিনের পুরনো অভ্যাস। শাওয়ার নিয়ে ঘুমালে নাকি ঘুমও ভালো হয়। শাওয়ার নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে এসে দাঁড়াতেই হঠাৎ তার নজর পড়ল আয়নার দিকে। মাথা থেকে হাত নামিয়ে হাত রাখল কানের দুই ইঞ্চি নিচে নরম মাংসে। কিছু মনে হতেই নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি খেলে গেল বোধহয়। দ্রুত হাত সরিয়ে তোয়ালে বেলকনিতে মেলে দিয়ে অনেকগুলো খাম আর কচকচে নতুন টাকার বেশ কয়েকটা বান্ডিল নিয়ে বসল। মা-চাচী থেকে শুরু করে এই বাড়ির দারোয়ান কাকার ছেলে মেয়েদের নামও তালিকাভুক্ত করে লিস্ট বানাল। বাদ গেল না ল্যাবে কাজ করা তার প্রত্যেকটা সহকারীদের নাম।
সবার জন্য একে একে সেলামী রেডি করে সব খাম একসাথে রাখলেও
একটা খাম সরিয়ে রাখল। এমন জায়গায় রাখল কেউ খুঁজে না পায়।
অতঃপর সব ঠিকঠাক করে শুয়ে পড়ল। ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে সদ্য একঘন্টা পেরিয়ে বোধহয়। তখন কেউ নিঃশব্দে প্রবেশ করল। পা টিপে
এলো বিছানার কাছে। চোখের উপর হাত নাড়িয়ে দেখল ঘুমিয়েছে কী না। সাড়াশব্দ না পেয়ে এবার আর একটু কাছে এলো। বুকের কাছটায় প্রাণভরে শ্বাস টেনে নিলে। উফ! সেই পাতালকরা ঘ্রাণ! এত টানে কেন? এত ভালো লাগে কেন? কী আছে এ ঘ্রাণে? এত পাগল পাগল লাগেই বা কেন? মন বলে ঘ্রাণের সাথে মানুষটাকেও কেড়ে নিতে। বুকের কাছটার শার্ট খাবলে ধরে চোখে চোখ রেখে বলতে ইচ্ছে করে, ‘এ্যাই যে বিশুদ্ধ পুরুষ খুব তাড়াতাড়ি আমার হয়ে যান না,প্লিজ! নাহয় এ বুকটা আমার নামে লিখে দিন। আপনার এই বুকে মুখ ডুবিয়ে দুনিয়াধারী ভুলতে চাই আমি। আমার পুরো পৃথিবীটাকে আমি শুদ্ধময় করতে চাই। শুদ্ধর তীব্র ভালোবাসায় ডুবে শীতল হতে চাই।’ একথা বলে সে আচমকা ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো শুদ্ধর বুকে। মুগ্ধ নজরে তাকাল ঘুমিয়ে থাকা সুদর্শন পুরুষটাকে।
দৃঢ় কপাল, বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখ, বাঁকা ভ্রু, টিকালো নাক, একজোড়া
পাজি ঠোঁট। যারা হাসতে জানে না। হাসলেও তা মেপেগুনে মানুষ বুঝে।
শীতল বিছানায় ভর দিয়ে গালে হাত দিয়ে মেঝেতে বসল। তারপর কিছু একটা ভেবে ফিক করে হেসে দ্রুত নিজেকে সামলে শুদ্ধর হাতটা টেনে নিলো। বাম হাতে লুকানো মেহেদী বের করে ধীরে ধীরে লিখল, ‘আমার বউ নাই। আমি এতিম।’ হঠাৎ বাঁ হাতের তালুতে শিরশিরে কিছু অনুভব করল শুদ্ধ। চট করে চোখজোড়া না খুলেও বুঝল কেউ তার হাতে কেউ ফুঁ দিচ্ছে। ততক্ষণে শীতলের মেহেদী দেওয়া শেষ। সে এখন ধীরে ধীরে
ফুঁ দিচ্ছে যেন তাড়াতাড়ি শুকায়। এভাবে বসে থেকে ফুঁ দিতে দিতে সে কয়েকবার হামি তুলল। রীতিমতো ঢুলছে। চোখের রাজ্যের ঘুম। কিছুটা সময় ঘুমের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শুদ্ধর হাতে দিকে তাকিয়ে হাসল।
সকালে কী হবে পরে দেখা যাবে এখন মন যখন যা যা বলেছে করেছে।
তারপর ওভাবে বসে থাকতে থাকতে একপর্যায়ে ওর চোখ লেগে গেল।
ধীরে ধীরে ঘুম গাঢ় হয়ে মেহেদীর উপর পড়তেই শুদ্ধ চট করে শীতলের মুখটা ধরে ফেলল। নয়তো হাতের মেহেদী শীতলের পুরো মুখে লেপ্টে যেতো। কিন্তু হাতে লিখলটা কি? সেটা দেখার জন্য নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে ফেলল। এসব কি? সে এতিম? বউ নাই বিধায় এতিম বানিয়ে দিলো এই মেয়ে? শুদ্ধ চোয়াল শক্ত করে শীতলকে দিকে একবার তাকিয়ে আবার তাকাল নিজের হাতের দিকে। তারপর বিছানা
থেকে নেমে শীতলের মাথাটা আগে ঠিকঠাকভাবে বিছানায় রাখল যেন ঘাড়ে ব্যথা না পায়। তারপর সে শীতলের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে মেহেদী তুলে ঘুমন্ত শীতলকে জিঞ্জাসা করল,
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৯
-‘আমি এতিম? আমার বউ নাই? কে বলল নাই? দেখবি আমার বউকে? উম তুই একা দেখলে হবে না যদিও। তবে চল এক কাজ করি বাড়িসুদ্ধ সবাইকে দেখাই? এতে তুইও খুশি, বড়রাও খুশি,তোদের খুশিতে আমিও খুশি।’
একথা বলে সে মেহেদীর টিউব তুলে নিয়ে পুনরায় নিজের হাতের দিকে তাকাল। তারপর মিটিমিটি হাসতে হাসতে শীতলের বাম গালে লিখে দিলো, ‘আমার বউ।’