ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩৮
তাজরীন ফাতিহা
৩ আশ্বিন, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ।।
চোখে কাপড় বেঁধে বাড়ির উঠানে খেলছে এক উচ্ছল চটপটে তরুণী। তার সখীদের ধরার জন্য উঠানের এ মাথা হতে ওমাথা দুরন্ত গতিতে ছুটছে সে। মাথায় ওড়না প্যাঁচানো থাকলেও দৌড়ানোর তালে তা মাথা থেকে খুলে পড়ে গেছে। ছুটতে ছুটতে সামনে বাধা পেয়ে ঝাপটে ধরে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
“ধরেছি ধরেছি।”
তারপর টান দিয়ে চোখের পট্টি খুলে ফেললো সে। সামনে নিজের পিতৃমহোদয়কে দেখে মুখ কালো করে ফেললো। মুখ ফুলিয়ে বলতে লাগলো,
“বাবা তুমি এই সময়ে?”
পিতা মহাশয় মুচকি হেঁসে বললেন,
“কেন আমি আসাতে মায়ের মন খারাপ হলো নাকি?”
মেয়েটি মুখ কালো করে বললো,
“না, আমি ভেবেছিলাম আমি এখন চোর থেকে ইস্তফা নেবো।”
পিতা মেয়ের মুখ কালো দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“এখন সন্ধ্যে প্রায় হয়ে এসেছে। পুকুরে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ফেলো যাও। আর খেলতে হবে না।”
মেয়েটি বাবার আদেশ শিরোধার্য করে হাত মুখ ধুতে পুকুরে চলে গেলো। ওযু করে উঠতে উঠতে চারপাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেছে। পাখিরা সব নীড়ে ফিরছে। সে ঘরে গিয়ে সব বাতি জ্বালিয়ে দিলো। মাগরিবের আজান দিলে আজানের উত্তর দিয়ে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে মনোযোগ দিলো। অন্যদিকে পিতা নামাজের জন্য মসজিদে চলে গেছেন।
নামাজ শেষে পিতা তার বাল্যকালের বন্ধুকে নিয়ে হাজির হলেন বাড়িতে। গুনগুন করে পড়ার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পিতা মহোদয় মেয়ের পড়ার আওয়াজ শুনে মেয়েকে আর ডাকলেন না বন্ধুকে নিয়ে তার ঘরে চলে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর মেয়েটির মা ডেকে উঠলো,
“এই নিশাত শুনে যা,,,,”
নিশাত বই বন্ধ করে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে হাটা দিলো। সে কেবল অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হয়েছে। নতুন নতুন বই পড়ার মজাই আলাদা। রাবেয়া খাতুন মেয়েকে কিছু নাস্তা বানিয়ে দিতে বললেন।
“পিঁয়াজ আর আলু কুচি করে দিয়েছি নুডুলস আর পাকোড়া বানিয়ে দে। আমি পাশের চুলায় সেমাই বসিয়েছি। তারপর চা বানাবো।”
নিশাত মায়ের কথায় সম্মতি জানিয়ে নাস্তা বানাতে লেগে গেলো। সেই ফাঁকে মায়ের কাছে বাবার বন্ধু মাহাবুব আলমের আসার খবরও শুনে ফেললো। নাজিয়া সবে ফাইভে পড়ে। বড় বোনের পিছু পিছু সেও রান্নাঘরের দাওয়ায় এসে বসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে নিশাত নুডুলস, পাকোড়া তৈরি করে ফেললো। সে বিকেলের নাস্তা টুকিটাকি করতে পারলেও ভারী রান্নাটা এখনও তেমন ভালো পারেনা। এদিকে রাবেয়া খাতুন সেমাই নামিয়ে চুলায় কেটলি বসিয়ে দিলেন। দুধের প্যাকেট ছিঁড়ে কেটলিতে দিয়ে দিলেন। একটু পর দুটো কাপে দুধ চা ঢেলে ট্রেতে সাজিয়ে দিলেন। নিশাত আগেই প্রিচে নুডুলস, পাকোড়া আর সেমাই সাজিয়ে দিয়েছে। নাসির উদ্দিন এসে ট্রে নিয়ে গেলেন।
নিশাত কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। পাশেই নাসির উদ্দিন ও রাবেয়া খাতুন বসা। রাবেয়া খাতুন বললেন,
“তুই কি এখনো বাচ্চা আছিস? বিয়ে তো একদিন করতেই হবে। এভাবে কেঁদে কুটে চোখ মুখের বারোটা বাজাচ্ছিস কেন?”
নিশাত মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে বললো,
“আমি বিয়ে করতে চাইনা। তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাবো না আমি।”
নাসির উদ্দিন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“এটা কখনো হয় মা? মেয়ে যেহেতু হয়েছো একদিন তো বিয়ে করতেই হবে। তাছাড়া মেয়েকে তো বেশি দূরে পাঠাচ্ছি না। এক জেলাতেই রাখছি। মনে পড়লেই টুপ করে দেখে আসা যাবে। তোমার মাহাবুব চাচাকে তো চেনোই। ছোট বেলায় যার কোলে বেশি থাকতে তার বড় ছেলের জন্য তোমাকে চেয়েছে। আমিও ভেবে দেখলাম ছেলে ভালো, কোনো দোষ নেই। মাহাবুবের ছেলে খারাপ হতেই পারে না। শিক্ষিত ধার্মিক পরিবার। আর তাছাড়া তোমার গায়ের রঙ কিংবা বেটে হওয়ার জন্য যারা বিয়ে ভেঙে দিতো, নাক ছিটকাতো এই বিয়ে হলে তাদের মোক্ষম জবাব দেয়া হবে। আমার মেয়ে একটু শ্যামলা আর খাটো বলে তারা অনেক অপমান, অপদস্ত করেছে এবার তাদের থেকেও শিক্ষিত, সুন্দর, ভদ্র ছেলেকে মেয়ে জামাই করে দেখিয়ে দেবো আমার মেয়ে কোনো ফেলনা নয়।”
সমাজের চোখে মাহাবুব আলমের বড় পুত্র মহাশয়ের দোষের পাল্লার চেয়ে গুণের পাল্লাই বেশি ভারী ছিল। ছেলে যেমন উচ্চশিক্ষিত তেমন সুদর্শন। গাম্ভীর্য ও আভিজাত্যে মোড়ানো বলিষ্ঠ গড়নের এক লম্বা পুরুষ কায়া। অপরিচিতা গল্পের অনুপমের মতো বলা যায়, কন্যার পিতা দেখা মাত্রই শিকার করিবে সে সুপাত্র। যেমন নাসির উদ্দিন করেছিলেন। নিশাত তাকে বিয়ের আগে এক ঝলক দেখেছিল। নিজের থেকে অত ফর্সা, লম্বা পুরুষ তার জীবনসঙ্গী হবে ভেবেই অস্বস্তি হচ্ছিলো আর লজ্জায় কান গরম হয়ে উঠছিল।
নিশাতকে যেদিন বিয়ে করতে এলো দিনটি ছিল ৫ আশ্বিন, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ। মারাত্মক চড়া মেজাজ ছিল লোকটার। মুখ দেখলে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে। নিশাতও পেয়েছিল অমন গম্ভীর খিটমিট মেজাজ দেখে। তার ধারণা নিশাতকে দেখে পছন্দ হয়নি বিধায় এমন খিটমিট করছিল আর একটু পর পর এর ওর সাথে গরম দেখাচ্ছিল তবে কবুল বলার পরে সেই ধারণা পরিবর্তন হয়েছিল। লোকটার মেজাজ খারাপের কারণ সে ছিল না বরং ছিল সুয্যি মামার তেজ। বিয়ের সময় নাম শুনেছে লোকটার। মাহাবুব আলমের বড় পুত্র মারওয়ান আজাদ।
বিয়ে দেয়া শেষ হলে নাসির উদ্দিন সবাইকে ডেকে এনে মেয়ে জামাইকে দেখাচ্ছিলেন। মারওয়ানকে দেখে অনেকেই মনে মনে হিংসা করছিল। কালো, বেটে মেয়ের অমন রাজপুত্রের মতো পুরুষ জুটবে কেন? নানারকম কানাঘুষা করতে লাগলো আশপাশের মানুষজন। এক প্রতিবেশী তো নিশাতকে বলেই বসলো,
“দেখিস বিয়ের পর জামাই যেন আবার পরকীয়ায় জড়িয়ে না যায়। তোর জামাইয়ের পাশে তোকে বড্ড বেমানান লাগছে। কম তো আর সম্বন্ধ ভাঙেনি এই বেটে হওয়ার জন্য। তার উপর জামাই জুটেছে লম্বা, তাগড়া, তোর থেকে উজ্জ্বল, শিক্ষিত, নায়কের থেকে কোনো অংশে কম নয়।”
সেই প্রতিবেশীর কথায় তাল মিলিয়ে আরেকজন বললো,
“তা যা বলেছো চাচী। ওরকম সুপাত্র ছেলে বাইট্টানিকে কেন বিয়ে করলো কে জানে? কোনো খুঁত টুত আছে নাকি কে জানে? চরিত্রে দোষ নেই তো আবার?”
“থাকতে পারে, চেহারা ছুরত তো খারাপ না। লাইন টাইন আছে সম্ভবত। দেখলি না কেমন মেজাজ দেখালো।”
এরকম নানা কটূক্তি, কথা যখন নিশাতের কর্ণকুহরে প্রবেশ করছিল তখন তার বুক এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছিলো যা আজীবন গেঁথে থাকবে হৃদয়ে। মানুষ খোঁচা দিতে ছাড়ে না। সমাজ কালো, বেটে, মোটা, শারীরিক কিংবা মানসিক ত্রুটিযুক্ত মানুষদের তিরস্কার করতে ছাড়ে না। যে যেভাবে পারে কথার বানে পিষে ফেলতে চায়। মানুষকে খোঁচানোতে সমাজের মানুষ এক পৈচাশিক আনন্দ পায়!
বিয়ের রাত নিয়ে মেয়েরা নানারকম স্বপ্ন দেখে। বাবার বাড়ি থেকে সব ছেড়ে ছুড়ে যেই মানুষটার হাত ধরে আগমন ঘটে শ্বশুরবাড়িতে সে মানুষটাকে নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা করে। প্রত্যেক মেয়ে কল্পনায় জীবনসঙ্গীকে নিয়ে একপ্রকার ফ্যান্টাসিতে ভোগে। বাস্তবে তেমন হয়না। পুরুষ মানুষের সাইকোলজি আর মহিলা মানুষের সাইকোলজি পুরোটাই ভিন্ন। আল্লাহ তায়ালা উভয়কে এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। তবে কিছু ক্ষেত্রে জীবনসঙ্গী বুঝতে চায় মেয়েটিকে, সময় দিতে চায় এই পরিবেশে মানিয়ে নিতে। তবে নিশাত ঠিক কোন ক্যাটাগরিতে মারওয়ান আজাদকে ফেলবে বুঝতে পারছে না। ঘরে ঢুকেই কোনো ভালো কথা নেই, কুশলাদি নেই ডাইরেক্ট বলে উঠলো,
“এই মেয়ে ঘোমটা দিয়ে আছো কেন? আর এসব জর্জেট পড়ে আমার সামনে থাকবে না। শরীর জ্বলে এসব দেখলে। গরমে পাগল হওয়ার দশা আরেকজন বস্তা গায়ে জড়িয়ে ঘোমটা টেনে রেখেছে। অসহ্য! বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াও, আমি বসবো।”
নিশাত ধমক শুনে ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। মারওয়ান ভ্রু কুঁচকে বললো,
“দাঁড়িয়ে আছো কেন? শাড়ি পাল্টে এসো। এসব ত্যানা পড়ে থাকলে ঘুম আসবে না আমার।”
নিশাত তার কথামতো শাড়ি পাল্টে একটা গোল জামা পড়ে আসলো। মারওয়ান নিশাতকে আগা গোড়া পর্যবেক্ষণ করে শক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কিসে পড়?”
নিশাতের অনেক অস্বস্তিবোধ হচ্ছিলো। একা রুমে একজন অচেনা পুরুষের সামনে থাকতে তার ভয় লাগছিল তার উপর লোকটার ধমক, জিজ্ঞেসায় অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে যাচ্ছিলো সে। বার বার ঘেমে উঠছিল। মারওয়ান জবাব না পেয়ে ফের ধমকে উঠলে নিশাত মিনমিন করে বললো,
“অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে।”
“দেখে তো মনে হচ্ছে না। সাইজ তো মনে হচ্ছে আমার হাঁটুর সমান। বয়স লুকিয়েছো নাকি?”
কথাটায় নিশাতের কেন যেন চোখে জল এলো। ঠোঁট চেপে বললো,
“জ্বি না। আমি একটু বেটেই তাই আপনার ওরকম মনে হচ্ছে।”
মারওয়ানের উত্তরটা কেন যেন পছন্দ হয়নি। সে আর কোনো কথা না বলে বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। নিশাত হতবুদ্ধির মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। এ কেমন বাসর রাত!
বিয়ের দুইদিনের মাথায় নিশাত বুঝতে পারলো মারওয়ান আজাদ নামক লোকটা মাকাল ফল টাইপ। উপরে ফিটফাট হলেও কাজকর্মে পুরাই ভাদাইম্মা, অলস প্রকৃতির। ঘর থেকে বেরোয় না বলতে গেলে। সারাদিন ঘুমায়। নিশাত নতুন বউ দেখে আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেসও করতে পারেনা লোকটা আদৌ কিছু করে কিনা? নাসির উদ্দিন এই নিয়ে প্রশ্ন করলে শ্বশুর মশাই তাকে জানিয়েছেন মারওয়ান বর্তমানে বেকার। কয়েকদিনের মধ্যে কাজ হবে। নাসির উদ্দিন বন্ধুর কথায় আশ্বস্ত হয়ে মেয়ের ওয়ালিমা খেয়ে মেয়েকে নিয়ে ফিরতি নাইওর আসেন। সেদিনও মারওয়ানের মেজাজ চড়া ছিল।
টেবিলের উপরে গামলা ভর্তি হলুদ দলা পাকানো বস্তুগুলোর দিকে তাকিয়ে মারওয়ান মায়মুনা বেগমের দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় শুধালো,
“এটা কি রেধেছো মা?”
মায়মুনা বেগম ছেলের কঠিন চেহারার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললেন,
“বিরিয়ানি।”
মারওয়ান পাতের হলুদ রঙের ভর্তা ভর্তা জিনিস গুলো হাতে নিয়ে বললো,
“এটাকে কোন স্টাইলের বিরিয়ানি বলে?”
“নিশাত স্টাইল বিরিয়ানি।”
একটু দূরে দাঁড়িয়ে নিশাত কাচুমাচু ভঙ্গিতে ফট করে বলে বসলো। মারওয়ান তার দিকে শক্ত মুখে একবার চেয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ইয়ার্কি হচ্ছে? এসব কি খাওয়ার যোগ্য? সারাদিন পর খেতে বসেছি নিশ্চয়ই এসব খেতে নয়। যে রাঁধতে জানে না তাকে দিয়ে রান্না করানোর মানে কি? রুচিই তো মরে গেলো।”
মায়মুনা বেগম তাড়াহুড়া করে বললেন,
“এভাবে বলছিস কেন? মেয়েটা পানির পরিমাণ বেশি দিয়ে ফেলেছে। তাই একটু ভর্তা ভর্তা হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে শিখে যাবে। নতুন একটু মানিয়ে তো নিতেই হবে। অমন করিস না।”
মারওয়ান ‘ধ্যাৎ’ বলে পাতের প্লেট ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চলে গেলো। নিশাত ফোঁপাতে ফোঁপাতে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকলো। বিয়ের পর প্রথম শ্বশুর বাড়ির মানুষের জন্য রাঁধলো এতেই গণ্ডগোল করে ফেলেছে। রান্নাটা ভালোভাবে আয়ত্ত করা উচিত ছিল তার। মায়মুনা বেগম নিশাতের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“কেঁদো না। ও ভালো খাবার না পেলে রাগারাগি করে। খাবারের বেলায় এদিক থেকে ওদিক হলে চেঁচামেচি করে। তুমি কষ্ট পেও না। কালকের একটু মুরগির গোশত আছে আর ডিম বেজে দিচ্ছি ভাতের সাথে খাবে। তুমি নিয়ে যাও।”
নিশাত ভয় পেয়ে বললো,
“আমাকে দেখে যদি মারে?”
“মারবে কেন?”
নিশাত চোখ নামিয়ে মিনমিন করে বললো,
“ঐযে বিরিয়ানি ভর্তা বানিয়ে তার খাওয়ায় অরুচি ধরিয়েছি সেজন্য।”
মায়মুনা বেগম নিশাতের থুতনি উপরে উঠিয়ে বললো,
“বোকা মেয়ে। ওর রাগারাগি চিল্লাচিল্লি, ভাংচুর পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। গায়ে হাত তোলার শিক্ষা আমরা দেইনি। তুমি খাবার নিয়ে যাও।”
নিশাত তবুও বললো,
“আম্মা আপনি নিয়ে যান। আমার ভয় করে।”
“ভয়কে জয় করতে হবে। যেহেতু সংসার করতে হবে সেহেতু এখন থেকেই ভয়কে টা টা বায় বায় করে দাও। ভয় পেলে চলবে না।”
শাশুড়ি মায়ের সেই কথা নিশাতের কানে এখনো বাজে। তারপর থেকে ভয়কে জয় করে কিভাবে কিভাবে যেন চারটা বসন্ত কাটিয়ে দিলো। পড়ালেখা শেষ করলো, নাহওয়ান এলো। ভাবতেই অবাক লাগে এই কাঠখোট্টা পুরুষের সাথে তার বিবাহিত জীবনের চার চারটে বছর শেষ। কয়েকদিন বাদে পাঁচ বছরে পদার্পণ করবে। অতীতের স্মৃতি মন্থন শেষে জানালা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখায় মনোনিবেশ করলো। নাহওয়ান ছোট্ট গুলুমুলু শরীরটা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে এসে হাতের আঙুল দেখিয়ে বললো,
“ইনদি বেতা।”
নিশাত ছেলের হাত মুখে ঢুকিয়ে ব্যথা কমানোর চেষ্টা করলো। খানিক পর ফোপানোর আওয়াজ পেলে নিশাত মুখ থেকে আঙুল বের করে বললো,
“কিভাবে ব্যথা পেয়েছো?”
“ডরজা চিপা ডিচে।”
“দরজা চিপা দেয় আবার কিভাবে? তুমি দরজার পাশে হাত কেন দিয়েছিলে?”
নাহওয়ান কোনো জবাব না দিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে দিলো। নিশাতের আবারও অতীতের কিছু খণ্ডাংশ চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
বিয়ের কিছুদিন পরেই নিশাত মারওয়ানের সাথে ঢাকায় ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করে। যেহেতু মারওয়ানের কোনো ইনকাম ছিল না সেহেতু মাহাবুব আলম সমস্ত খরচ নিজ কাঁধে তুলে নেন। নিশাতকে ভর্তি করান। গ্রাম থেকে ট্রান্সফার করিয়ে ঢাকার একটা সরকারি কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি করায় তার শ্বশুর। প্রতিদিন ক্লাস করা সম্ভব না হলেও চেষ্টা করতো উপস্থিত থাকার। তখন মারওয়ান আনা নেয়া করতো তাকে। সে যখন অনার্স তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল এক্সাম দেয় তখন বুঝতে পারে তার শরীরে আরেকটি প্রাণ বেড়ে উঠছে। মারওয়ানকে এই কথা জানালে অদ্ভুতভাবে লোকটা শিথিল হয়ে গিয়েছিল। কোনো প্রতিক্রিয়া জানায় নি।
কথায় কথায় মেজাজ দেখাতো না। কেমন যেন নিষ্প্রাণ, নির্লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। নিশাত ঠিক ঠাহর করতে পারছিল না সন্তান আসায় লোকটা খুশি নাকি বেজার।
যেদিন তার লেবার পেইন উঠলো সেদিন মারওয়ান আজাদের চোখে কি যেন একটা ছিল। ওই চোখ বেশিক্ষণ দেখতে পায়নি সে। রাত দেড়টা তখন গভীর রাত বলতে গেলে। ব্যথায় তার শরীর অবশ হয়ে গেছিলো। চিৎকার করতে করতে গলা ব্যাথা বানিয়ে ফেলেছিল সে। কাঠখোট্টা, রসকষহীন কঠোর মারওয়ান আজাদ কি করবে বুঝতে পারছিলো না। নিজের আরামের ঘুম বাদ দিয়ে তাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটেছিল। সেই রাতে গাড়ি পেতে কষ্ট হয়েছিল অনেক। বাইরে ছিল ঝুম বৃষ্টি। কারণ দিনটি ছিল ১০ই শ্রাবণ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। বৃষ্টিতে ভিজে অত রাতে কোত্থেকে গাড়ি জোগাড় করে এনেছিল নিশাত জানে না। গাড়ির মধ্যে যখন পানি ভাঙছিল নিশাতের ছটফটে দেহটা নিজের দেহের মাঝে চেপে ধরেছিল নির্লিপ্ত সেই পুরুষ যুবা। কানের কাছে শুধু বলে চলছিল,
“কিছু হয়নি, কিছু হয়নি…. আল্লাহ আছেন!”
নিশাতের তখন হুশ ছিল না। কাঁদতে কাঁদতে বেঁহুশ প্রায়। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে মারওয়ানের বুকে কত কিল যে দিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। তখন তার মস্তিষ্ক কাজ করছিল না। একজন মাই বলতে পারবেন লেবার পেইনের ব্যথা কত কষ্টের। প্রচলিত আছে একটি শিশু জন্ম দিতে গেলে একজন মায়ের ২০টি অথবা ২৭ টি হাড় ভেঙে ফেলার মতো যন্ত্রণা অনুভূত হয়। ব্যথায় পিঠ, তলপেট, পা এবং সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গিয়েছিল তার। এই অসহনীয় যন্ত্রণা দেখে মারওয়ান আজাদ তলপেটে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। হাসপাতালে ওটিতে ঢোকার আগ পর্যন্ত নিশাত হাত ছাড়িনি মারওয়ানের। যখন ওটি রুমে ঢোকানো হচ্ছিলো সে চিৎকার করে সেই হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বেহুশের মতো বলছিল,
“আমার সাথে থাকুন। আমার ভীষণ ভয় করছে।”
নার্স, ডাক্তাররা হাত ছাড়ানোর জন্য জোরাজুরি শুরু করছিলেন তখন মারওয়ান তার মাথায় হাত বুলিয়ে কানে বিড়বিড় করে বলেছিল,
“আল্লাহ ভরসা। আল্লাহ আছেন ভয় নেই।”
সেই দুই বাক্য এখনো নিশাতের কানে বাজে। বাক্য দুটিতে কি ছিল জানা নেই তবে একেবারে শক্ত হয়ে শান্ত হয়ে গিয়েছিল সে। আলহামদুলিল্লাহ দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টার কষ্টকে স্বার্থক করে চারিদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনির সাথে প্রতিধ্বনি হচ্ছিলো একটি নবজাতকের কান্নার। নিশাতের কোল জুড়ে আগমন ঘটে এক পুত্র সন্তানের। নরমাল ডেলিভারি হয়েছিল তার। জ্ঞান ফিরে শ্বশুরের কোলে একটা ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চা দেখেছিল সে। যে তখন হাত, পা ছড়িয়ে চিৎকার করায় ব্যস্ত। সেই অম্লান স্মৃতি এখনো জীবন্ত যেন।
প্রথম প্রথম বাচ্চাকে কোলে নিতো না মারওয়ান আজাদ তবে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। নিশাত জানে না কেন কোলে নিতো না। জন্মের সাত দিনের দিন যখন আকীকা করা হয় তখন নাসির উদ্দিন ও মাহাবুব আলম অনেক ভেবে চিন্তে মারওয়ানের সাথে মিলিয়ে বাচ্চার নাম রাখে নাহওয়ান। যার আরবি অর্থ জ্ঞানী, বুদ্ধিমান। নিশাতেরও ভীষণ পছন্দ হয় নামটি। কিন্তু মারওয়ানের সেই নাম পছন্দ হয়না। এই নাম রাখায় ভীষণ আপত্তি ওঠায় সে। তখন সবাই ক্ষেপে গেলে সে ফাইয়াজ নাম রাখার প্রস্তাব দেয়। অনেক বাকবিতণ্ডার পর শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বাচ্চার নাম হবে ফাইয়াজ নাহওয়ান। মারওয়ান এনিয়ে আর আপত্তি ওঠায় না।
ইসলামী বিধান অনুযায়ী বাচ্চার মাথা মুণ্ডন করে দুটি খাসি জবাই দেয়া হয়। নিজেদের জন্য কিছু গোশত রেখে বাকিটুকু গরীব ও আত্মীয় স্বজনদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হয়।
নাহওয়ানের বয়স যখন একমাস তখন মাহাবুব আলম জোর করে ছেলের কোলে নাতিকে উঠিয়ে দেন। মারওয়ান কোলে নিয়ে দেখে তুলোর মতো নাদুস নুদুস চেহারার একটা বাচ্চা তার দিকে চেয়ে আছে। তার কোলে দেয়া মাত্র দন্তবিহীন কি নির্মল হাসি! যেন এতদিন বাদে বাবার কোল উঠতে পেরে আনন্দ আর ধরে না। মারওয়ান খুবই মোলায়েমভাবে তার কোলের মাংসপিণ্ডটা আঁকড়ে ধরে তাকিয়ে ছিল। বাচ্চাটাও একদৃষ্টিতে তার জনকের দিকে চেয়ে ছিল। মাহাবুব আলম কিছু বলার জন্য জোর করলে মারওয়ান কি বলবে বুঝতে না পেরে অনেকক্ষণ বাদে মুখ খুলে ভারী গলায় বলে উঠেছিল,
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩৭
“এইটুকু আন্ডা বাপের চোখের দিকে তাকাস? চোখ নামা।”
বলা শেষ করতে না করতেই মারওয়ান ভিজে একাকার। সংবাদপত্র ছাপানো হলে নিশ্চয়ই হেডলাইন থাকতো,
“পিতার কথা অপছন্দ হওয়ায় পুত্রের মূত্র বিসর্জন।”