ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩৯

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩৯
তাজরীন ফাতিহা

তোমার ঘরে বাস করে কারা ও মন জানো না
তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা
একজনে ছবি আঁকে এক মনে ও ওমন
আরেকজনে বসে বসে রং মাখে
আবার সেই ছবি খান নষ্ট করে
কোন জনা কোন জনা
তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা
মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা..

খাটে শুয়ে শুয়ে গলা ছেড়ে লালনগীতি গাইছে মারওয়ান আজাদ। নিশাত রান্নাঘর থেকেই শুনতে পারছে। আহা মনে কি খুব আনন্দ! এখন যদি সে কোনো কাজের কথা বলে তখন চোখ মুখ কালো করে মরার মতো পড়ে থাকবে। এমন ভাব ধরবে কানেই শোনে নি। পৃথিবীর নম্বর ওয়ান বয়রা হয়ে যায় কাজের কথা শুনলে। নিশাতের কেন যেন ঐ লোকের ফুর্তি সহ্য হচ্ছে না। এসেই ছেলেকে নিয়ে চিৎপটাং হয়ে গলা ছেড়ে রেডিও চালু করেছে। রেডিও বলতে আবার গলা খারাপ না, কণ্ঠ ভালোই। এই কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করলে দারুন শোনাতো কিন্তু তা তো করবে না। যতসব খারাপ কাজ করায় ওস্তাদ এই পুরুষ। মাঝে মধ্যে বাতিক উঠলে এই গানটা প্রায়ই গায় সে। নিশাত রান্নাঘর থেকে রুমে এসে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“নাহওয়ান আঙ্গুর খাবে?”
বাবার বুকে শুয়ে থেকেই উত্তর দিলো,
“আঙুল কাবো না।”
“কেন? তুমি আঙ্গুর খাও দেখে নিয়ে আসলাম। এখন খাবে না কেন?”
“একন কাবো না।”
“আচ্ছা যখন মন চাইবে খেও।”
নিশাত চলে যেতে নিলে আবার পিছু ফিরে মারওয়ানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“শুনুন, ঘরে চাল নেই। চাল আনতে পারবেন? আমার আজ মনে ছিল না আনার কথা।”

কথা শেষ করে দেখে মারওয়ানের নাক ডাকার আওয়াজ আসছে। এই মাত্র চোখ বন্ধ করে ঠ্যাং দোলাচ্ছিল ছিল এখন কাজের কথা বলায় ভং ধরেছে। নাহওয়ান বাবার বুকের উপর শুয়ে হা করে নাক ডাকার আওয়াজ শুনছে। নিশাত হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নাহ, এই পুরুষ কোনোদিন ভালো হবে না। আচ্ছা এরমধ্যে কি আল্লাহ মন দেয়নি? পাথর কেন এমন? কোনো অনুভূতি নেই, সংসারের প্রতি উদাসীন। হৃদয় নামক বস্তুটি কি আল্লাহ তাকে দেয়নি? দিয়েছে। এই আলসে, ভ্যাগাবন্ড পুরুষটিরও একটা হৃদয় আছে। যার দরজা কোনো সময় না খুললেও ফাইয়াজ নাহওয়ান নামক গোল আলুর সময় ঠিকই উন্মুক্ত হয়।

নাহওয়ান যেদিন প্রথম বাবা ডাকলো সেদিন কঠোর, অনুভূতিহীন, উদাসীন মারওয়ান আজাদ প্রথমবারের মত কাঁদলো। চিৎকার করে কান্না নয় সেই কান্না ছিল চোখের কোল ঘেঁষে গড়িয়ে পড়া অশ্রু বিন্দুর এক নীরব নৃত্য। নিশাত জানে না দুনিয়া বিরাগী, নিরাসক্ত পুরুষটি কিসের জন্য সেদিন দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলেছিল। সে অবাক পানে শুধু চেয়ে দেখেছিল। হয়তবা এও ঠাহর করতে পেরেছিল মারওয়ান আজাদ নামক ভবঘুরে পুরুষটির দুর্বলতা তারই অংশ ওই নরম তুলতুলে মাংসল কায়াটি। কাঁপা গলায় নিজের বড় হাতের তালুর উপর চার মাসের ছোট্ট মোলায়েম প্রাণপিণ্ডের হাত মেলে রেখে যখন বিড়বিড় করে বলছিল,

“কি বললি? আবার বল দেখি?”
নাহওয়ান তখন অস্পষ্ট স্বরে আবার ডেকেছিল,
“বা..ব্বা.. বা।”
সেটাই ছিল নাহওয়ানের প্রথম বুলি।
(এই বয়সী বাচ্চারা কথা বলতে জানে না। শুধু অস্পস্ট শব্দ আওড়ায়। এটা বাচ্চাদের একধরনের খেলা। এত ছোট বাচ্চারা মূলত ব্যাবলিং করে। এগুলোকে বলা হয় pre-linguistic sounds। এই আধো আধো বুলিকেই মারওয়ান বাবা ডাক ধরে নিয়েছে।)

অতীতের স্মৃতিচারণ থেকে বের হয়ে নিশাত ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে। এই কথা মনে পড়লে নিশাতের দুঃখ প্রশমিত হয়। সামনে শায়িত পুরুষটির প্রতি রাগ পড়ে যায়। মারওয়ান আজাদের সেই দুফোঁটা চোখের জল তার সংসার জীবনের নড়বড়ে খুঁটি। নয়তো সংসার নামক খুঁটিটা বহু আগেই বোধহয় ভাঙতো। মাঝে মধ্যে খুব ইচ্ছে করে ওই রগ বাঁকা পুরুষটির কলার ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করতে,
“আমাকে বিয়ে করেছিলেন কেন? কিভাবে, কোন এঙ্গেলে কত ঘণ্টা ঘুমান তা দেখাতে?”

ইমতিয়াজ ভুঁইয়া মানহার উপর চেঁচামেচি করছেন। মানহা নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। নিজের শখের ফুল গাছ ভেঙে ফেলায় ইমতিয়াজ ভুঁইয়া ক্ষেপে গেছেন। মানহাকে মুখ নিচু করে কাঁদতে দেখে ধমকে বললেন,
“এই মেয়ে কান্না থামাও। কিছু বললেই কান্না শুরু। মহিলা জাতই বেজাত।”
উর্মি ভুঁইয়া চিৎকার চেঁচামেচি শুনে নিচে এসে দেখলেন ইমতিয়াজ ভুঁইয়া মানহার উপর মেজাজ দেখাচ্ছেন। তাই সেখানে গিয়ে এই কথা শুনে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“কি হয়েছে?”

ইমতিয়াজ ভুঁইয়া স্ত্রীর কণ্ঠ শুনে চুপ করে গেলেন। তারপর চোয়াল ঝুলিয়ে বললেন,
“গাছ ভেঙেছে আমার, কাঁদবো আমি তা না দুটো কথা শুনিয়েছি অমনি কেঁদে কুটে একসার।”
মানহা ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার কথা শুনে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করলো কয়েশ কথা শুনিয়ে বলে দুটো কথা শুনিয়েছি। তার বড্ড অভিমান হলো শাশুড়ির পাশে দাঁড়ানো ওই বুড়োটার প্রতি। তাকে খালি ধমকায়, দেখলেই খিটমিট করে। মানহার প্রতি তার কিসের এত বিদ্বেষ যে সবসময় চিরতার মতো আচরণ করে? তার শাশুড়ি আম্মু এমন চিরতার সাথে কিভাবে এত বছর সংসার করেছেন? উর্মি ভুঁইয়া মানহাকে ভেতরে যেতে বললেন। মানহা চোখ মুছে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো। উর্মি ভুঁইয়া চোখ ছোট করে স্বামীর পানে চাইলেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া কাচুমাচু করছেন।
“তো, আপনি আবার কবে থেকে গাছের প্রতি যত্নশীল?”

স্ত্রীর প্রশ্নে ইমতিয়াজ ভুঁইয়া থতমত খেয়ে বললেন,
“এভাবে বলছো কেন? সব সময়ই তো যত্নশীল।”
উর্মি ভুঁইয়া হাত ভাঁজ করে বললেন,
“তাই নাকি? কে যেন সপ্তাহে সপ্তাহে টবের গাছ ভাঙতো, বাগানের গাছ উগরে মাটি খাবলাতো?”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া গলা খাঁকারি দিয়ে মিনমিন গলায় বললেন,
“সেটা তো ছোট থাকতে। ছোটদের দ্বারা এসব ছোট খাটো ভুল হতেই পারে।”
“হ্যাঁ ত্রিশ বছরের দামড়া ফিডার খাওয়া ছোটদের দ্বারা ভুল হতেই পারে। ওগুলো কোনো ব্যাপার না। ছোট বলে কথা। আপনার কথা অনুযায়ী মানহা তো নবজাতক শিশু। ছোটদের ভুল ধরতে নেই আর নবজাতক শিশুর ভুল বুঝি ধরতে হয়? এগুলো তো তাদের খেলা।”

স্ত্রীর সূক্ষ্ম অপমানে মুখটা লটকে গেলো চেয়ারম্যান ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার। এভাবে কথার মারপ্যাঁচে ফেলবে কল্পনাও করতে পারেননি তিনি। না বুঝে কথা বলে সর্বনাশ করে ফেলেছেন। এখন কিছু বললে তার সোনার অতীত ধরে টান মারবে। না বাবা এখান থেকে মানে মানে কেটে পড়াই উত্তম। মুখ গম্ভীর করে উল্টো পথে হাঁটা দিয়ে দিয়েছেন এরমধ্যে। উর্মি ভুঁইয়া পিছন থেকে বললেন,
“ছোট বাবু কি গোসসা করলেন?”

মানহা মুখ কালো করে ফ্লাফিকে নিয়ে বসে আছে। ইহাব রুমে ঢুকে হাত ঘড়ি খুলতে খুলতে আয়নায় মানহার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মন খারাপ নাকি?”
মানহা ঘাড় নাড়িয়ে না জানালো। তোয়ালে ঘাড়ে নিয়ে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বললো,
“শোনো আগামীকাল ডক্টরের কাছে যাবো। সন্ধ্যায় রেডি হয়ে থেকো।”
“ডাক্তারের কাছে কেন? কার অসুখ হয়েছে?”
ইহাব চলন্ত পা জোড়া থামিয়ে বললো,
“তোমার প্যানিক অ্যাটাকের জন্য কাউন্সিলিং করাবো। এভাবে কতদিন? বিয়ে হয়েছে একমাসের মতো হয় অথচ বউয়ের ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারিনা এরকম আর কতদিন চলবে? তাই ঠিক করেছি তোমাকে কাউন্সিলিং করিয়ে সুস্থ করবো তারপর আমার হিসেব নিকেশ।”

মানহা আঁতকে উঠলো। কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় উল্টে পড়লো। ফ্লাফি মিঁউ মিঁউ করে ডেকে মানহার শরীরে উঠছে নামছে। ইহাব বোকার মতো চেয়ে থাকলো। তার কল্পনায় বাংলাদেশি মিডিয়া ভেসে উঠলো। যেখানে আজাইরা বট সাংবাদিকরা প্রচার করছে,
“স্বামী হিসেবে নিকেশ চাওয়ায় স্ত্রী সেন্সলেস।”
“স্বামীর কারণে স্ত্রী অ্যাটাক।”
ইহাব মাথা নাড়িয়ে বাস্তবে এলো। ভাগ্যিস বাংলাদেশি ইউটিউবার কিংবা সাংবাদিক এখানে উপস্থিত নেই। নাহলে আজকে তারা রসালো একটা শিরোনাম পেতো সাথে প্লাস পয়েন্ট হিসেবে সে জেলে বসে মশা মারতো। বাংলাদেশের মানুষরা তো আবার নারীঘটিত ব্যাপার এলে ডানে বামে তাকায় না ডিরেক্ট অ্যাকশনে চলে যায়।
পায়ে সুরসুরি পেয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলো ফ্লাফি জিহ্বা বের করে তার পা চাটছে আর মিঁউ মিঁউ আওয়াজ করছে। বোবা প্রাণীটা হয়তোবা মানহার কাছে যাওয়ার জন্য তাকে বলতে এসেছে। সে হতাশ ভঙ্গিতে বিছানার দিকে এগুলো। এই নারীর অ্যাটাক দেখতে দেখতে কোনদিন যেন সেও অ্যাটাকের শিকার হয়। প্যানিক অ্যাটাক না সে করবে হার্ট অ্যাটাক।

স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে নিশাতের মনে হলো কেউ তার পিছু পিছু আসছে। সে ঘুরে পিছনে তাকালো। কাউকে দেখলো না। একজন ভিক্ষুক থালা নিয়ে বসা রাস্তার পাশে। আরেকটু দূরে ঝালমুড়ি ওয়ালা ঝালমুড়ি বানাচ্ছে আর গলির মুখে একজন বেলুন ওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। চায়ের দোকানে বসে কয়েকজন চা খাচ্ছে। সন্দেহভাজন কিছুই চোখে পড়লো না। হয়তবা মনের ভুল। সে আবারও সামনে তাকিয়ে হাঁটা দিলো নিজ গন্তব্যে। বাসায় ঢুকে স্বস্তি পেলো। ভীষণ পিপাসা পেয়েছে। দুই গ্লাস পানি খেয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। বাচ্চা কাচ্চাদের পরীক্ষা আসলে অনেক চাপ পড়ে। ডিউটি করো, খাতা জমা দাও, খাতা কাটো। উফ একটা যুদ্ধ যেন।
নাহওয়ান মাকে দেখে মায়ের বুকে উঠে শুয়ে আছে। নিশাত জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তার ফলে বুকটা দ্রুত ওঠানামা করছে। নিশাত দেখলো বুকের উপর শ্বাসের ছন্দপতনে তার ছানার ছোট্ট শরীরটা ওঠা নামা করছে। সে নাহওয়ানকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললো,

“আমার ছানার কি হয়েছে?”
মারওয়ান টয়লেট থেকে বেরুতে বেরুতে বললো,
“তোমার ছানার ঘুম পেয়েছে।”
নিশাত উঠে বসে বললো,
“সেকি ওকে ঘুম পাড়াননি কেন?”
মারওয়ান গেঞ্জি খুলে শার্ট গায়ে জড়িয়ে বললো,
“ও তোমার সাথে খাবে দেখে বসে আছে। আজকে মুড অফ তাই বেশি ঘাটিনি।”
নিশাত চিন্তিত হয়ে ছেলের গালে কপালে হাত ছোঁয়ালো। নাহ জ্বর তো নেই তাহলে তার ছানার মুড অফ কেন? সে ছেলেকে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“ভাত খাবেন আব্বা?”
“কাবো না।”
বলেই মুখ চুপসে ফেললো। নিশাত মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“কেন? অন্য কিছু খাবেন?”
নাহওয়ান ছলছল চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে না জানালো। নিশাত গাল টেনে দিতেই ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। নিশাত ব্যস্ত হয়ে বললো,
“কি হলো? কাঁদছো কেন? কোথাও ব্যথা পেয়েছো নাকি?”
নাহওয়ান কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়ালো। ছেলের কান্নায় ইতোমধ্যে মারওয়ানও এদিকে তাকিয়েছে। নিশাত বললো,
“ব্যথা পাওনি, খুদা লাগেনি তাহলে কাঁদছো কেন?”
“বাবা মালচে।”

নিশাত এতই অবাক হলো যে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। সে কি ঠিক শুনেছে? মারওয়ান মেরেছে? পৃথিবী উল্টে গেলেও তো সে বিশ্বাস করবে না এটা। আবার ছেলে তো মিথ্যাও বলে না। সে ঘাড় ফিরিয়ে মারওয়ানের দিকে চাইলো যে বর্তমানে চোখ বড় বড় করে এদিকে তাকিয়ে আছে। মারওয়ান জোরে বলে উঠলো,
“কিহ!! এই পটলের বাচ্চা তোকে আমি কোন জন্মে মেরেছি?”
নিশাত শান্ত কণ্ঠে বললো,
“নাহওয়ান তো কখনো মিথ্যা বলে না।”

“কি মিথ্যা বলে না? আজকে দুধ খেতে গিয়ে আটার বয়াম খুলে আটা খেয়েছে। মুখে মাখিয়ে ভূত হয়েছে।মরিচের গুঁড়ার কৌটা খুলে হাত ঢুকিয়ে খাওয়ার সময় ভাগ্যিস আমি রান্নাঘরে গিয়েছিলাম। পুরো কুরুক্ষেত্র বানিয়ে ফেলেছিল। আমি ছিলাম শুয়ে এই পান্ডার সাড়াশব্দ না পেয়ে উঠে দেখি এই কাণ্ড। দিয়েছি ধমক সেই থেকে মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। কত্তবড় সেয়ানা মা আসার সাথে সাথে নালিশ দেয়া শেষ আবার বলে বাবা মারছে। তোকে না মেরেই ভুল করেছি। আলু ভর্তা করা উচিত ছিল আলুর বাচ্চা।”
বলেই ছেলের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো মারওয়ান। নিশাত ফোঁস করে দম ছেড়ে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। যাক সে ভুল ছিল না। সে এটা কিভাবে ভুলে গেলো নাহওয়ান তো বকা, মারা সবকিছুকে মাইর বলে। ছেলেকে আদর করে বললো,

“হয়েছে আর কাঁদে না। তুমি দুষ্টুমি করেছো কেন?”
নাহওয়ান গোলগোল চোখ করে বললো,
“ইট্টু ডুড কেয়েচি। মুজা না।”
মারওয়ান হাসতে হাসতে বললো,
“আটার গুঁড়া খেয়ে বলে দুধ খেয়েছি। আবার কয় মজা না। ঠিক হয়েছে অতি সেয়ানের গলায় দড়ি।”
নাহওয়ান বাবার দিকে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে বললো,
“টুমি পুচা। নানা টুমাকে ডিচুম ডিচুম মালবে।”
নাসির উদ্দিনের কথা শুনে মারওয়ান কটমট চোখে ছেলের দিকে চাইলো। নিশাত মুখ টিপে হাসছে। মারওয়ানের সহ্য হলো না। সে চিৎকার করে বললো,
“কি বললি ব্রিটিশের নাতি? আজকে তোর খবর আছে। ভর্তা করে পার্সেল করবো তোর হিটলার নানার কাছে।”
নাহওয়ান ‘ইননা’ বলে মুখ লুকিয়েছে মায়ের কোলে। নিশাত বাপ, ছেলের খুনসুটি উপভোগ করছে। তার বেশ মজা লাগছে এই ঠোকাঠুকি।

নেওয়াজ শাবীর টেবিলে ভর দিয়ে বললো,
“এই প্রফেশনে এসে যে আর কি কি করা লাগবে আল্লাহ মালুম। শেষ পর্যন্ত বেলুন বেঁচা লাগলো।”
সামনে ডিপার্টমেন্টের দুই এজেন্ট বসা। তাদের মধ্যে একজন মুখ কালো করে বললো,
“আর আমার যে ঝালমুড়ি বেঁচা লাগলো। মুনতাজির সাহেব অলওয়েজ বেঁচে যান। হয় ছুটিতে থাকেন নয়তো আসেন না আর নাহলে অন্য কাজে থাকেন। সব ঝড় জঞ্জাট আমাদের উপর দিয়ে যায়। জীবনে প্রথম একটা কেস নিয়ে এত লড়াই যাচ্ছে।”

অন্য এজেন্টটা মাথা নাড়িয়ে সহমত প্রকাশ করলো। জিনান আদহাম ল্যাপটপ টাইপিং করছে। তার নীলাভ চোখে ল্যাপটপের আলো পড়ে রিফ্লেক্স হচ্ছে। জ্বলজ্বল করছে মণি। সে ল্যাপটপে আঙুল চালাতে চালাতেই বললো,
“ওসব দুঃখ বিলাস বাদ দিন। মিশন সলভ হওয়াটাই মুখ্য। আমিও তো ভিক্ষা করেছি। তো কি হয়েছে? ভেবে দেখলাম ভিক্ষা করাও খারাপ না। এই মিশনে হারলে রোজ ভিক্ষার থালা হাতে ছদ্মবেশে নেমে যাবো। শুয়ে শুয়ে ইনকাম করার মতো শান্তি দুনিয়ায় আর কোথাও নেই। প্যারাও নাই আবার টাকাও আয় হলো। ভিক্ষার পয়সা এখনো কোটে ঝনঝন করছে। কবি বলেছেন, কোনো কাজকে ছোট করে দেখতে না। তাছাড়া বাংলাদেশের ভিক্ষুকদের ডিমান্ড হাই লেভেলের। তারা ভিক্ষায় নামে স্যুট, টাই, সানগ্লাস পড়ে। এদেশ আর কিছুতে এগোক আর না এগোক এই সেক্টরে উন্নতির শিখরে।”

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩৮

বলেই কোট ঝেড়ে পয়সার আওয়াজ শোনালো। উপস্থিত দুই এজেন্ট থতমত খেয়ে গেলো। গলা খাঁকারি দিতে লাগলো। নেওয়াজ উচ্চ শব্দে হেঁসে উঠে বলতে লাগলো,
“বড়লোক্স দেমাগি ভিক্ষুক ( যারা পরিপূর্ণ সুস্থ তবুও হাত পাতে) ও গুষখোরদের আইক্কাওয়ালা বাশ দিলো দ্যা গ্রেটেস্ট এজেন্ট জিনান আদহাম। আহ চমৎকারভাবে এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন বস!”
জিনান আদহাম রহস্যময় ভঙ্গিতে হেঁসে হাত চালাচ্ছে ল্যাপটপে।

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪০