ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪৪
তাজরীন ফাতিহা
নিশাতের স্কুল ছুটি হলো মাত্র। সে নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে স্টুডেন্টদের পরীক্ষার খাতা ব্যাগে ঢুকালো। এই স্কুলে প্রতি সপ্তাহে সপ্তাহে ক্লাস টেস্ট হয়। তাই প্রায়ই পরীক্ষার খাতা কাটার জন্য বাসায় আনতে হয় নিশাতের। ক্লান্ত মুখশ্রী ম্লান হয়ে আছে তার। স্কুল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় অবসন্ন ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে সকালের কথা মস্তিষ্কে ভেসে উঠলো। নাজমা ম্যাডাম কি রসিয়ে রসিয়েই না তার স্বামীর বদনাম করছিলেন অন্য কলিগদের কাছে। কথায় আছে, মেয়ে মানুষের পেটে কথা বেশিদিন থাকেনা। আর তা যদি হয় নাজমা ম্যাডামের মতো মহিলা মানুষ তাহলে তো কথাই নেই। নিশাতের এত খারাপ লাগছিল মনে চাচ্ছিলো তখনই রিজাইন দিয়ে চলে আসতে। এত এত মানুষের সামনে প্রতিনিয়ত করুণা, অবজ্ঞা, হেয় নজরে থাকার চেয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকাই তার কাছে শ্রেয়।
ভীষণ কান্না পাচ্ছিলো যখন সে প্রবেশ করা মাত্রই অফিসরুমের সব চোখ তার দিকে অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে ছিল। নিশাত কোনমতে তাদেরকে পাশ কাটিয়ে ক্লাসে চলে এসেছিল নাহলে ওখানে দুমিনিট থাকলে লজ্জা অপমানই বোধহয় সে মরে যেতো। এই সমাজের মানুষ শুধু কথা দিয়ে নয় চক্ষু দিয়েও মানুষ মারতে পারে।
বাসায় এসে আজকে একটা কথাও বললো না। নাহওয়ান মাকে দেখেই কোলে ওঠার জন্য ছটফট করছে। নিশাত আজ ছেলেকে কোলে নিলো না। এড়িয়ে গেলো। বেশ খানিকক্ষণ গোসল করে বের হলো। তারপর নামাজ পড়ে বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে পড়লো। মারওয়ান এতক্ষণ ধরে নিশাতের সব কর্মকাণ্ডই নীরবে দেখলো । নাহওয়ান তার পা পেঁচিয়ে বললো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“মা কুতা বলে না বাবা।”
মারওয়ান ছেলেকে কোলে নিয়ে বললো,
“মা ক্লান্ত। পরে বলবে। আয় ভাত খাইয়ে দেই।”
নাহওয়ান মাথা নাড়িয়ে বললো,
“মায়েল সাতে কাবো। মায়েল কাচে যাবো।”
মারওয়ান ছেলেকে খাটের উপরে উঠিয়ে দিলো। নাহওয়ান হেঁটে নিশাতের বুকের ভেতর ঢোকার জন্য কসরত চালাচ্ছে। নিশাতের চোখটা লেগে গিয়েছিল। নাহওয়ানের নড়াচড়ায় চমৎকার ঘুমটা ভেঙে গেলো। এমনিতেই সারাদিনের ধকল, সকালের সেই পরিস্থিতি, এখন আবার আরামের ঘুম ভাঙা সব মিলিয়ে মাথায় রাগ চেপে বসলো। নাহওয়ান মাকে চোখ খুলতে দেখে ফোকলা হেঁসে তাকিয়ে বললো,
“মা ভাতু কাবে না।”
নিশাত রাগ নিয়ন্ত্রণ করে কোনো জবাব না দিয়ে আবারও চক্ষু মুদলো। নাহওয়ান মাকে কথা বলতে না দেখে বুকে জোরে কামড় বসিয়ে দিলো। নিশাত উঃ শব্দ করে চেঁচিয়ে উঠে নাহওয়ানের পিঠে দুমদাম কয়েকটা লাগিয়ে ক্ষান্ত হলো। যেন সারাদিনের পুঞ্জীভূত ক্রোধের নিষ্পত্তি ঘটালো। কিল খেয়ে নাহওয়ানের মুখের হাসি নিভে গেছে। নিশাত রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,
“সবসময় ইতরামি তাইনা? বেয়াদব কোথাকার। একবার নিষেধ করেছি বুকে কামড়াবি না। সারাক্ষণ দুধ দুধ আর দুধ। কিছু না বলতে বলতে একেবারে মাথায় উঠে নাচছে।”
নাহওয়ান মায়ের অপ্রত্যাশিত মাইর, ধমকে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে ‘বাবা বাবা’ করতে লাগলো। নিশাত চোখ রাঙিয়ে ভেঙিয়ে বললো,
“একদম চুপ। সারাক্ষণ ব্যাবা ব্যাবা। তোর ব্যাবার কাছে গিয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর কর যা। অজাতের ঘরের অজাত পয়দা করেছি।”
নাহওয়ান চুপ না করে কান্নার স্বর আরও বাড়িয়ে দিলো। মারওয়ান নিশাতের চিৎকার আর নাহওয়ানের কান্নায় দ্রুত টয়লেট থেকে বেরিয়ে এলো। আঁধভেজা খালি গা। গলায় গামছা। কোকড়া চুল থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে গোসল থেকে তাড়াহুড়া করে বেরিয়েছে। ছেলেকে চিৎকার করে কাঁদতে দেখে এগিয়ে গেলো। নাহওয়ান বসে বসে কাঁদছে। পরনে সাদা সেন্ডুগেঞ্জি। সেটায় বারবার চোখ মুছছে। বাবাকে দেখেই ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠে এগিয়ে এসে গুলুমুলু হাত দুটো বাড়িয়ে দিলো। মারওয়ান ছেলেকে কোলে নিয়ে বললো,
“কি হয়েছে? তোদের মা, বেটার কি হলো আবার। দুই মিনিটও গোসল করতে দিলি না ক্যা কু শুরু করেছিস।”
নাহওয়ান আঙুল দিয়ে নিশাতকে দেখিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
“মাচ্চে। পিটে ডুম ডুম কিল ডিচে। উফ বেতা।”
বলেই আবারও চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগলো বাচ্চাটা। মারওয়ান কপাল কুঁচকে বিছানায় চাইলো। নিশাত ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে তাই তার মুখটা মারওয়ান দেখতে পারছে না। বাচ্চাটাকে মেরে কি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে পাষাণ নারী! সে সব সহ্য করতে পারলেও ছেলেকে মারা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারেনা। রাগ ওঠে তার। কিছু না বলে ছেলেকে কোলে নিয়ে কান্না থামিয়ে ভাত খাইয়ে দিলো। তারপর হাঁটতে হাঁটতে নাহওয়ানকে ঘুম পাড়ালো। বাচ্চাটা ঘাড়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত কান্নার ফলে হেঁচকি উঠে গিয়েছিল নাহওয়ানের। এখন ঘুমানোর ফলে হেঁচকি কমে গিয়েছে। সে ছেলেকে পাশের রুমে বালিশ দিয়ে বর্ডার করে শুইয়ে দিলো। নাহওয়ান ঘুমের ঘোরেই করুণ গলায় মারওয়ানের গেঞ্জি মুঠো করে অস্ফুটভাবে বললো,
“মাচ্চে, মাচ্চে। ইনদি বেতা।”
মারওয়ান ঘুমন্ত ছেলের কপালে, গালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। বাচ্চাটা ঠোঁট ফুলিয়ে ঘুমাচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক করে গম্ভীর মুখে নিজের রুমে প্রবেশ করে বিছানার দিকে চাইলো। নিশাত আগের ভঙ্গিমায় শুয়ে আছে। তার চোখের সাদা অংশ লালাভ হয়ে আছে। মুখের আদল কাঠিন্যতায় ছেয়ে গেছে। গটগট পায়ে হেঁটে বিছানার শোয়া ঘুমন্ত নিশাতকে হ্যাঁচকা টানে বসালো। নিশাত ভ্রুর ভাঁজে বিরক্তির রেখা টেনে মারওয়ানের দিকে চাইলো। মারওয়ান উগ্রভাবে নিশাতের বাহু চেপে ধরে বললো,
“কিসের তেজ দেখাও? এই বয়সে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে দেখে শরীরে শক্তি ভর করেছে? মনে প্রজাপতি উড়ছে? নতুন বিয়ের শখ জেগেছে মুখে বলতে পারছো না তাই সন্তানকে মেরে বিষ কমাচ্ছো?”
নিশাত কথার মানে বুঝে মারওয়ানের বুকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
“খবরদার ফালতু কথা বলবেন না। আমি আমার সন্তানকে বকবো নাকি মারবো সেটা আপনাকে বলে করবো না নিশ্চয়ই।”
মারওয়ান নিশাতের চোয়াল চেপে ধরে নিজ মুখের সামনে এনে বললো,
“আমাকে বলবি না তো কাকে বলবি? ওটা আমার সন্তান। তুই জাস্ট গর্ভে ধরেছিস আদারওয়াইজ সবকিছু আমার। রক্ত, বীজ এভরিথিং।”
নিশাতের কান্না পেলো কেন যেন। সবার এত এত কথা তারউপর ঘরের ভাদাইম্মা পুরুষের কথাও যদি শুনতে হয় তখন কেমন লাগে? কান্না পেলেও সেটা প্রকাশ করলো না। নিজেকে দুর্বল প্রমাণ কিছুতেই করবে না সে। মারওয়ানের চোয়ালে ধরা হাতটায় শক্ত করে নক দাবিয়ে বললো,
“সবকিছু আপনারই যেহেতু গর্ভে ধারণ করেও দেখাতেন। দেখতাম কত হেডম আপনার? মানে বিচার যাইহোক না কেন তালগাছ তার। নাই গাছের ছাল, পাড়ে খালি ফাল।”
মারওয়ান রুক্ষভাবে বললো,
“কথাবার্তা সাবধানে বলবি। ছাল আছে কি নেই সেটা নিশ্চয়ই তোকে দেখাবো না। এসব তেজ আমার সামনে দেখাবি না। এসব গোনার টাইম নেই আমার।”
“ইশরে আপনাকে গুণে যেন কে উল্টিয়ে ফেলছে? ভ্যালুলেস পুরুষের আবার বড় বড় কথা। ছাড়ুন আমাকে।”
“এই আমার বাসায় বসে গলা নাচাবি না।”
নিশাত হাসতে হাসতে বললো,
“এটা নাকি তার বাসা? জোকস অফ দ্যা ইয়ার। বহুদিন পর অনেক হাসলাম। বিনোদন আর বিনোদন।”
মারওয়ান চোখ গরম করে বললো,
“আমার বাসা না তো কার বাসা?”
“আমার শ্বশুর আব্বার।”
“আব্বাটা কার?”
“আমার।”
মারওয়ান চোয়াল শক্ত করে বললো,
“ফাইজলামি হচ্ছে? মেরে গুম করে রাখবো কেউ হদিশও পাবে না। সবাইকে বলে বেড়াবো নতুন নাগরের সাথে ভেগেছে।”
নিশাত রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,
“লাগাম টেনে কথা বলুন। নিজের মতো ইতর ভাবেন সবাইকে? আপনার নাগরী যে চিঠি দিয়েছিল সেটা কিন্তু ভুলিনি। আহা কি পিরিতি, আমার জাদ! ঢংয়ের প্যাঁচাল আমার সাথে পাড়বেন না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আপনার কুকীর্তি পুরো বংশে সাপ্লাই করবো।”
বলেই মারওয়ানের হাত ঝটকা দিয়ে ফেলে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। রাগে শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটছে। এমনিতেই সকাল থেকে মাথা ঠিক নেই বাসায় এসেও একটার পর একটা অশান্তি লেগে আছে। মারওয়ানও বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। নিশাত চলে যেতে নিলে তার খোলা চুলে টান পড়লো। মাথায় হাত দিয়ে ব্যথাসূচক শব্দ করলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো মারওয়ান তার চুল পেঁচিয়ে ধরেছে। নিশাত চোখ কুঁচকে মাথার নিম্নাংশ চেপে ধরে বললো,
“চুল ছাড়ুন। অসভ্যের মতো করছেন কেন? আগে তো একটা গুণ ছিল বউ না পেটানো। এখন কি সেটাও খুয়াবেন?”
মারওয়ান মুখ শক্ত করে চুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে নিশাতকে টেনে আনলো। নিশাতের চোখে পানি এসে গেছে ব্যথায়। অন্ধকার দেখছে চারিপাশ। মাথার পিছন চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো স্তব্ধ হয়ে। মারওয়ান হাত শিথিল করতেই নিশাত ঘুরে রাগে জিদে মারওয়ানের গেঞ্জি বুকের কাছ থেকে টেনে ছিঁড়ে ফেললো। তারপর ফোঁপাতে লাগলো। মারওয়ান তব্দা খেয়ে তার সুতির গেঞ্জিটার দিকে তাকিয়ে আছে। যেটার হাল বর্তমানে ছিঁড়ে বেহাল। হাত থেকে নিশাতের চুলের গোছা পড়ে গেলো। রক্তিম চোখজোড়া উঠিয়ে নিশাতের দিকে চাইলো। নিশাত ফোঁপাতে ফোঁপাতে মারওয়ানের ছিঁড়ে যাওয়া গেঞ্জির বুকের কাছটায় কামড় বসিয়ে দিলো। মারওয়ান উঠিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে বললো,
“এত তেজ কই থেকে আসে? গেঞ্জি ছিঁড়েও তেজ কমে না আবার কামড় দিচ্ছিস? স্বামী, সন্তানকে যেভাবে পারছিস মারছিস, কামড়াচ্ছিস শরীরে শক্তি বেশি হয়েছে?”
নিশাত কেঁদে উঠে মারওয়ান যে হাত দিয়ে থাপ্পড় মেরেছে সেই হাতে কামড় দিয়ে ধরে রাখলো। মারওয়ান চোখ বুজে কন্ট্রোল করছে নিজেকে। এই লিলিপুটের পাগলা রাগ উঠেছে। সে এখন যাই করবে এর বিপরীতে কামড়ে রাগ মিটিয়ে তবে দম নেবে। খানিকপর নিশাত মুখ উঠিয়ে মাথা চেপে ধরলো। অতিরিক্ত রাগ উঠলে মাথা ব্যথায় টনটন করে তার। নিশাত বাথরুমে গিয়ে মাথায় পানি ঢাললো বেশখানিকক্ষণ। মারওয়ান ছেঁড়া গেঞ্জি আর ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে ফোঁসফোঁস করছে। কিছু বলা যায়না অমনি আক্রমণ শুরু করে। বিষ পিঁপড়া একটা।
নিশাত বাথরুম থেকে বেরিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে নিজে নিজে বলতে লাগলো,
“তেজ দেখাচ্ছে? যে পুরুষের বউ, বাচ্চা পালার মুরোদ নেই সে এসেছে আমাকে শাসাতে। মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ কোথাকার।”
মারওয়ান সবই শুনলো তবে কিছুই বললো না। গেঞ্জি পাল্টে শার্ট গায়ে দিয়ে রুম থেকে বেরুতে নিলে নিশাত জোরে জোরে বললো,
“যেখানেই যাওয়া হয় নিজের বীজকে যেন সাথে নিয়ে যাওয়া হয়। আজ থেকে বীজ, বীজের বাপ কোনটার সাথে আমার সম্পর্ক নাই। বাপের কাছে নালিশ দিয়ে মাইর খাওয়ানো তাইনা? এই অজাত পেটে ধরেছিলাম? একে খাইয়ে বড় করছি? পেটে দশমাস শত্রুর বীজ বুনেছি সে তো শত্রুতা করবেই।”
মারওয়ান চোয়াল শক্ত করে ঘুমন্ত ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
মানহাকে খুবই মনোযোগ দিয়ে দেখছেন সাইকিয়াট্রিস্ট নাজনীন আনোয়ারা। মানহার শরীর আরও ভেঙে গেছে। গত পরশু ইহাব তাকে মানহার অজ্ঞান হওয়ার ব্যাপারে ইনফর্ম করেছিল। মানহার অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেই রাতে। ইহাব ভয়ে কথা বলতে ভুলে গিয়েছিল। তারপর ডাক্তার এসে জ্ঞান ফিরিয়েছে। এসব শুনে সে ইহাবকে মারাত্মক বকাঝকা করেছে। একটা প্যানিক অ্যাটাকের কাউন্সিলিং পেশেন্টকে ভয় দেখানোর কারণ কি? এমনিতেই তাদের হার্ট দুর্বল থাকে, এসময়ে যেকোনো কিছু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সবকিছু নিয়ে মজা করা উচিত নয়। নাজনীন আনোয়ারা মানহাকে দেখে বললেন,
“আফরিন, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি কিছু লুকাচ্ছো? দেখো মা এসব সেন্সিটিভ বিষয় লুকালে তোমার ভবিষ্যতে কিন্তু এর ইফেক্ট পড়বে। তুমি কি স্বাভাবিক একটা বিবাহিত জীবন চাও না?”
মানহার হাত কাঁপছিলো। কোনমতেই হাতটা স্বাভাবিক হচ্ছিলো না। মুখের কথা কেমন যেন আউলিয়ে যাচ্ছিলো তার। কোনরকম মুখ খুলে বললো,
“আমি একটা স্বাভাবিক জীবন চাই। তার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি কিন্তু হচ্ছে না। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। নিজেকে এখন পৃথিবীর আবর্জনা মনে হয়।”
বলে মাথা খামচে ধরে কেঁদে দিলো। নাজনীন আনোয়ারা মানহার কাঁপা হাতের উপর হাত ঠেকিয়ে বললেন,
“রিল্যাক্স আফরিন। তুমি না ব্রাভো গার্ল? এভাবে ভেঙে পড়লে তো চলবে না বাচ্চা। তুমি কিভাবে ফাইট করছো সেটা আর কেউ না জানলেও আমি জানি। দুনিয়ার সবাই তোমাকে ভুল বুঝলেও, খারাপ বললেও আমি জানি তোমার মতো রোগীদের মেন্টাল হেলথ কন্ডিশন কতটা ভঙ্গুর থাকে। ওইসব বিষাক্ত স্মৃতি, স্পর্শ মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলা কঠিন। সেই নরপশুদের কোনো শাস্তি হয়না তোমার মতো নিরীহ নিষ্পাপ ফুলগুলো আজীবন সাফার করে। তুমি কেন ঐসব পশুদের জন্য নিজেকে কষ্ট দেবে?”
মানহা মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আমার অপবিত্র শরীর কি করে তাকে স্পর্শ করতে দেবো বলুন? সে কাছে আসলেও কেন যেন ঘেন্নায় বমি পায়, ওই জঘন্য স্মৃতি বারবার ভেসে ওঠে। আমি ভুলতে চাই কিন্তু ভুলতে পারিনা। সেদিন যখন সে ভয় দেখালো আমার মনে হচ্ছিলো কিছু বিশ্রী বিষাক্ত হাত আমার শরীরে কিলবিল করছে, চুমু দিতে চাইছে। কয়েকবছর আগে ঠিক এভাবেই আমাকে চেপে ধরে চুমু খেয়েছিল, শরীরে নোংরা স্পর্শ করেছিল আমার স্কুলের স্যার। ছিঃ কি জঘন্য!”
বলেই মানহা মাথা চেপে ধরে গলগল করে বমি করে চেম্বার ভাসিয়ে ফেললো। নাজনীন আনোয়ারা উঠে এসে তাকে ধরলেন। কাঁপছে মানহা। তিনি লোক ডেকে এনে পরিষ্কার করালেন। তারপর মানহাকে রিল্যাক্স হতে দিয়ে তিনি আবারও বসলেন। মানহা একটু শান্ত হয়ে আবারও বলতে লাগলো,
“প্রায়ই ওই অপ্রত্যাশিত জঘন্য ছোঁয়ার শিকার হয়েছি। একদিন মাঠে খেলতে গিয়ে বেশ বেলা হয়ে গিয়েছিল দ্রুত বাড়ি ফিরতে নিলে আমার এক প্রতিবেশী কাকা আড়ালে নিয়ে আমার সমতল বুকটাকে কতক্ষণ যে মুদেছে হিসেবে ছাড়া। চিৎকার করতে পারিনি। মুখটা চেপে ধরে ছিল। আট বছরের একটা বাচ্চার মস্তিষ্কে এসব কেমন প্রভাব পড়ে বলতে পারেন ম্যাম? একটা বাচ্চার শরীরে তারা কি দেখেছিল? আরেকটু হলে রেপ হতাম ভাগ্যিস বড় ভাইয়া চলে এসেছিল নয়তো সেদিন খবর ছাপা হতো আট বছরের মেয়ের ধর্ষণে মৃত্যু। তারপর থেকে ওই বিষাক্ত স্মৃতি পুষে একেকটা দিন পার করেছি। কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারিনি। বাড়ির পাশের এক আপুকে ভীষণ ভালো লাগতো। আপুটা কি যে মিষ্টি ছিল! সারাক্ষণ তার কাছেই পড়ে থাকতাম।”
বলে একটু দম নিলো। কাঁদতে কাঁদতে তার গলা বসে গিয়েছে। আবারও বলতে লাগলো,
“বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে বাপের বাড়ি বেশি আসতে পারতো না। কালে ভদ্রে দুই একবার দেখা পেতাম। তাও যৌতুক নিতে আসতো। শ্বশুরবাড়ির লোককে খুশি করতে হবে তো। মুখে, শরীরে থাকতো অজস্র কালসিটে দাগ। জিজ্ঞেস করলে ফ্যাকাসে হেঁসে বলতো শ্বশুরবাড়ির আদর। যখন জিজ্ঞেস করতাম এ কেমন আদর? বিষাদ হেঁসে বলতো বিয়ে হলে বুঝবি তখন কলিজায় মোচড় মারতো।
পুরুষ মানুষ মানেই আমার কাছে আতঙ্কে রূপ নিলো। সেই সুন্দর মিষ্টি আপুটার যেদিন নীল জখমযুক্ত লাশ বাড়িতে এলো আমি পাথরের মতো জমে গিয়েছিলাম ঐ নীল মুখটা দেখে। ততদিনে পুরুষের প্রতি ঘৃণার পারদ আমার সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে গিয়েছিল আহারে সুন্দর মেয়েটাকে কিভাবে মেরে ফেলেছে জালিমের দল। পুরুষ মানুষই খারাপ এরকম আরও নানা কথা।
আমি খেতে পারতাম না, কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারতাম না। এমনকি ঘুমালেও ওইসব বিষাক্ত স্মৃতি আমাকে তাড়া করতো। কতবার যে ঘুম থেকে চিল্লিয়ে উঠতাম হিসেব ছাড়া। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হতো। পরে আম্মু আমার সাথে থাকা শুরু করলো। এরপর থেকে পুরুষ দেখলেই আমার ট্রমা কাজ করে। আমি যে কিছুতেই ভুলতে পারিনা। আমাকে মেরে ফেলুন। এত ট্রমা নিয়ে বাঁচতে ভালো লাগেনা। আমিও অভিশপ্ত। চারপাশের মানুষকেও আমার অভিশাপের জালে জড়িয়ে রেখেছি।”
বলেই ঢুকরে কাঁদতে লাগলো। সাইকিয়াট্রিস্ট নাজনীন আনোয়ারা কথা হারিয়ে ফেললেন। কি বলবেন তিনি? মেয়েটাকে কাউন্সিলিং করিয়ে তিনি যতটুকু না ঠিক করতে পারবেন তার চেয়ে বেশি পারবে তার সঙ্গী। মানহাকে টিস্যু এগিয়ে দিয়ে তিনি ওয়েটিং রুমে গেলেন। সেখানে ইহাব আগে থেকেই বসা ছিল। তার চোখ দুটি লাল হয়ে আছে কানে ইয়ারপড। মানহার বলা সব কথাই সে শুনেছে। নাজনীন আনোয়ারা বললেন,
“ওকে নিয়ে যাও। কিছু মেডিসিন দিয়েছি সময় মতো খাইয়ে দিও। আর শোনো তুমি যেহেতু সব শুনেছো তাই আমি চাইবো ওকে তুমি সর্বোচ্চ সাপোর্ট দেবে। এসব ভীতি দূর করবে। আর আমি তো আছিই সপ্তাহে সপ্তাহে থেরাপি দেয়ার জন্য।”
ইহাব মাথা নাড়িয়ে তার পিছুপিছু গেলো। চেম্বারে ঢুকে দেখলো মানহা এখন স্বাভাবিক। একটু আগের বলা কথাগুলো যে সেই বলেছে কেউ বিশ্বাস করবে না। একটা মানুষ মনে এত কষ্ট, ট্রমা, নিকৃষ্ট অধ্যায় পুষে রেখে আদৌ বাঁচতে পারে? পারে বোধহয় নাহয় মানহার তো মরে যাওয়ার কথা।
রাত বারোটা। মারওয়ান এখনো বাসায় আসেনি। নিশাত অনেকবার ফোনে কল দিয়েছে প্রত্যেকবার বন্ধ পেয়েছে। কান্না করতে করতে গলা ব্যথা করছে। লোকটা তার ছানাকেও নিয়ে গেছে। সেতো রাগের বশে নিয়ে যেতে বলেছিল। সত্যি সত্যি নিয়ে যাবে জানলে কখনোই বলতো না। তার ছানাটা তাকে ছাড়া কেমন আছে? দুপুরে কিভাবে পাষাণের মতো মারলো সে? কত কাঁদলো একটাবার ধরলো না পর্যন্ত। এই ভেবেই কেঁদে চলেছে নিশাত। দরজায় টোকার আওয়াজে বিছানা থেকে দ্রুত উঠে দরজা খুলে দিলো সে। ওড়না মাটিতে লুটিয়ে আছে। দরজা খুলেই ছেলেকে দেখে হুহু করে কেঁদে উঠে মারওয়ানের কোল থেকে বাজের মতো একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে গালে কপালে চুমু দিতে দিতে বললো,
“আব্বা, আব্বা রে আপনি কোথায় ছিলেন? মায়ের সাথে এত রাগ?”
নাহওয়ানের দুই হাত ভর্তি চকলেট, চিপস। মায়ের আদর পেয়ে আরও গুটিয়ে গেলো। সারাদিন পরে মায়ের ওম পেয়ে চুপচাপ পড়ে রইলো। মারওয়ান ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ছেলেকে নিশাতের থেকে কেড়ে নিয়ে বললো,
“আমার বাচ্চাকে যেন ধরা না হয়।”
নিশাত ছলছল চোখে নাহওয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। নাহওয়ান বাবার দিকে তাকিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। মারওয়ান ছেলের হাত, মুখ ধুইয়ে দিয়ে গামছা দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে বিছানায় বসিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। নিশাত এই ফাঁকে ছেলেকে কোলের মধ্যে ঢুকিয়ে অজস্র চুমু খেলো। পিঠে হাত বুলিয়ে বললো,
“ব্যথা পেয়েছেন আব্বা?”
নাহওয়ান ঠোঁট ফুলিয়ে হেঁসে বললো,
“বেতা নাই।”
নিশাত আবারও ছেলেকে কোলে ঢুকিয়ে আদর করতে লাগলো। মারওয়ান বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে মা, ছেলের কাণ্ড দেখতে লাগলো। নাহওয়ান বাবাকে দেখে বললো,
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪৩
“ইট্টু মাল কুলে উটচি।”
“কেন উঠেছিস? এক্ষুনি নাম।”
“ইট্টু তাকি।”
মারওয়ান গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে নিশাতের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বললো,
“শত্রুর বীজ পেটে নিয়ে গর্ভ নাকি দূষিত হয়ে গেছে? শত্রুর বাচ্চার সঙ্গে কিসের মিত্রতা আবার? বহুরূপী।”