আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৫৭
ইশিকা ইসলাম ইশা
ভিআইপি রুম।চারদিকে আধুনিক যন্ত্রে ঘেরা।মাঝে সাদা ফকফকা একটা বেড সেখানেই ঘুমাচ্ছে তীরা চৌধুরী।এসির হালকা বাতাসে চারদিকের পরিবেশ ঠান্ডা ঠান্ডা।একদম নিরব শান্ত পরিবেশ হলেও রিদির মন আজ অশান্ত,মনে চলছে ঝর, তুফান। উদয় হয়েছে অনেক প্রশ্ন!যার উওর না জানা অব্দি শান্তি নাই তার।
একদম নিস্তব্ধ রুমের কোনায় রাখা সোফায় বসে আছে রিদি।এই মুহূর্তে রিদির সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে তীব্র কে।রিদি জানে না কিভাবে? কিন্তু তীব্র তার জীবন হয়ে দাঁড়িয়েছে।তার সকল কষ্টের একমাত্র শান্তিময় স্থান তীব্রর প্রসস্থ বুক।এই যে এই মুহূর্তে রিদির মনে হচ্ছে তীব্রর বুকটা তার জন্য শুধু শান্তিময় নয় বরং সবচেয়ে প্রিয়। যেখানে মুখ ডুবালে কোন চিন্তা আসে না।ভাবনা আসে না। শুধু শীতলতায় ছেয়ে যায় মন মস্তিষ্ক। তীব্র যেন ম্যাজিক জানে! মূহুর্তের মধ্যেই তার মন ভালো করতে পারে।তার চিন্তা,ভাবনা সব ম্যাজিক করে দূর করতে পারে।রিদি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
একটু পরেই রুমে ঢুকে বেশ বয়স্ক একজন লোক।সাথে একজন সুন্দরী রমনী। রিদি বয়স্ক লোকটাকে দেখে সালাম দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।সে চিনে না এদের তবে আসার সময় লাবিব বলেছে এখানে তীব্রর নানু বাড়ির লোকজন আছে।রিদির ধারনা তীব্রর নানু বাড়িরই কেউ হবে।
তুমিই তবে তীব্রর বৌ!!
রিদি হচকচিয়ে গেলেও মাথা নেড়ে সম্মতি দিল,
জি!!
আমি কে জানো??
রিদি না সূচক মাথা নাড়াতেই লোকটা হাসল।একটু থেমে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আমি তোমার নানা শ্বশুর হই!মানে তীব্রর নানু!চল ঐ দিকটাই বসি।তীরার ঘুমের ডিস্টার্ব হবে হয়তো!!
রিদি ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সম্মতি দিয়ে বড় রুমটার জানালা বরাবর রাখা অরেক সোফার দিকে এগিয়ে গেল।মেয়েটাও তাদের সাথেই এগিয়ে এলো!
শুনলাম একাই নাকি কানাডা থেকে এসেছ!!
জি না!তীর ভাইয়াও সাথে এসেছে!!
তীব্র তোমাকে আসতে দিয়েছে এটাই তো বড় ব্যাপার!!
আসলে ওনি আমাকে আসতে দিতে চাইনি!আমি ওনাকে না বলে….. বলতে পারেন ফাঁকি দিয়ে এসেছি!
লোকটা রিদির কথায় হাসলো!রিদি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে!হাসিটা কিছুটা যেন তীব্রর মতো!রিদি ভালো করে দেখল ৭০ উর্ধ্বে বয়স হলেও বেশ শক্তিশালী বলা চলে।যৌবনে যে বেশ তারগা যুবক ছিলেন তা দেখেই বোঝা যায়।
তীব্র কে ফাঁকি!!কিভাবে সম্ভব নাতবৌ!
জি আসলে!!!
বুঝেছি!!ভালোই কলকাঠি নেড়েছো!
রিদি মাথা নিচু করে নিল।একটু পর বলল,
আম্মুর কি হয়েছে??
বৃদ্ধা লোকটা সোফায় বসলেন।কথার উত্তর না দিয়ে বলল,
শুনলাম ডাক্তারি পড়ছ!! তোমার বর যে ডাক্তার সেটা জানো নিশ্চয়!!
জি!!
এই হসপিটালের মালিক কে এটা জানো??
রিদি ফ্যালফ্যাল করে তাকালো তীব্রর নানুর দিকে!এই হসপিটালের মালিক কে?এটা জেনে সে কি করবে? তবুও উওরে মাথা নেড়ে না বলতেই ওনি বলল,
তীব্র চৌধুরী!!
রিদি আহাম্মক এর মতো তাকালো লোকটার দিকে! তীব্র চৌধুরী!!মানে তীব্র!এটা কিভাবে সম্ভব!! তীব্র কখনো তো এসব ব্যাপারে তাকে জানাই নি।রিদি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।এই তীব্র চৌধুরীর মধ্যে এতো রহস্য কেন??
ভাবছ…. তীব্র যদি এই হসপিটালের মালিক হয় তবে সে কেন এখানে থাকে না!আই মিন কেন হসপিটাল দেখাশোনা করে না!!সে নিজেও একজন ডক্টর!
রিদি আনমনেই বলল,
না।আমি তো ভাবছি এই তীব্র চৌধুরীর মধ্যে আরো কতো রহস্য লুকিয়ে আছে!হাহ
বৃদ্ধ লোকটি হাসল।রিদি ওনার হাসি দেখে অবাক হল। হওয়ার কথা নয় কি?ওনার মেয়ে হসপিটালের বিছানায় শুয়ে আছে আর ওনি হাসছে!তীব্রর নানু রিদির অবাক হওয়া চেহেরা দেখে বলল,
ভাবছ মেয়ে অসুস্থ আর আমি হাসছি তাই না??
রিদি চমকালো !ভরকালোও বটে। আমতা আমতা করে কিছু বলার আগেই লোকটি আবারো বলল,
তোমার বয়স হয়তো বেশি না!বুঝতে সময় লাগবে!
রিদি ফ্যালফ্যাল করে আবারো তাকালো।এই লোকটার থেকে তীব্র তীব্র লক্ষন পাওয়া যায়।বলতে যাই এক বলে এক।কোন কথা থেকে কোন কথাই চলে আসে। এদেরকে বোঝা মুশকিল!রিদি কিছু বলার আগেই নানু মুখটা গম্ভীর করে বলল,
বুঝলে মেয়ে!বয়স অনেক হয়েছে!এই বয়সে টেনশন নিয়ে সবাইকে টেনশনে রাখতে চায় না।
রিদি তাকালো তীব্রর নানুর দিকে।হাসিটা যে নকল হাসি সেটা বুঝতে সময় লাগল তার।হয়তো কষ্ট লুকাতে হাসিটাকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।নানু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারো বলল,
জানো তো খুব আদরের মেয়ে ছিল সে আমার। ৪ পিরির পর ও ছিল বংশের প্রথম মেয়ে। খুব আদর আর স্বাধীনতা দিয়ে বড় করেছি ওকে। যা চেয়েছে দিয়েছি।তবে সেই আদর, স্বাধীনতা সে নিজ হাতে খুন্ন করেছে।
একবার না দুবার না বহুবার আমি ওকে বুঝিয়েছি। কিন্তু মেয়েটা একদম জেদি।অধিক জেদি। সে যা একবার বলবে সেটাই করবে।সে তার লক্ষ্য পৌঁছাতে সব করতে রাজি ছিল। স্বামী, সংসার, সন্তান সব ছেড়ে নামডাক এর পিছু ছুটেছে। কিন্তু এটা বুঝেনি নামডাক তখনি সুখের হয় যখন পাশে স্বামী, সন্তান থাকে নয়তো সব বৃথা।
শেষবার ওকে বুঝাতে গিয়েছিলাম যখন ও তীব্র কে নিয়ে কোট পর্যন্ত গিয়েছিলো।কয় মাসের বাচ্চা তখন তীব্র!হয়তো ৪-৫ মাসের!!সেই বাচ্চাকে নিয়েও সে কম ড্রামা তো আর করে নি।তীব্র কে এই জন্য তার চাই না যে তার বাচ্চা কে চায়,সে বাচ্চর মা।বরং এই জন্য চাইত যাতে সে আমিরের কাছে জিততে পারে।তবে সেই বার আমিরের জেদ ও ছিল অধিক।কোনমতেই সে তার সন্তান তীরার কাছে দিতে প্রস্তুত নয়।সে তীরা থাকা সত্ত্বেও তিশা কে একপ্রকার জোর করেই বিয়ে করে। পরিপূর্ণ পরিবার হওয়াই তীব্রর কাস্টাডি পেল আমির।তিশা তীব্র কে নিজের কাছে রাখতেই অবশ্য এই বিয়েতে রাজি হয়েছিল।কারন তীব্রর প্রতি ছিল অগাধ মায়া আর ভালোবাসা।তীরার কাছে তীব্র কখনোই ভালো থাকবে না ভেবেই রাজি হয়েছিল।
সত্যি বলতে তীরার এসব ব্যবহার আর উগ্রবাদী আচরণে আমি নিজেও চাইনি ছোট্ট বাচ্চাটা তীরার কাছে থাকুক।আমি নিজেই সাপোর্ট করেছিলাম আমির কে।কারন তীরা মা হওয়ার চেয়েও হয়েছিল এক জেদি আর অহংকারী নারী।নিজের জীবনকে নিয়ে গিয়েছিল এক ধ্বংসাত্মক পর্যায়ে।
এরপর কেটে যায় অনেকটা বছর।তীরা তীব্র কে ফেলে নিজের জীবনের দিকে এগিয়ে যায়। তীরা যখন দেশ ছেড়ে আমেরিকা চলে যায় তখন তীব্রর বয়স ৫ বছর।সে তখনো জানত না তার জন্মদাত্রী মা তাকে ছেড়ে পারি জমিয়েছে দূর দেশ।এরমাঝে তীব্রর সাথে তার কোন যোগাযোগ ছিল না।শুনেছিলাম আমেরিকান কোন ছেলেকে বিয়ে করেছে সে।আমি এটা তো চাইনি তবে ভাগ্য মেনে নিয়েছিলাম।
এরপর সময় যেতে থাকে সেই সাথে তীব্রও বড়ো হতে থাকে।একটা সুন্দর ছোট সংসার হয়ে উঠে চৌধুরী পরিবারে। আমির আর তিশা মিলে গড়ে তোলে সুখের রাজ্যে।আমির আর তিশার সম্পর্ক স্বাভাবিক হতেও বেশ সময় লাগে।
তীব্রর যখন ১৪ বছর।তীরা আবারো ফিরে আসে আমির আর তিশার জীবনে। শুনেছিলাম আমেরিকান ছেলের পক্ষের একটা ছেলে হয়েছিল তবে কারন বশত ছেলেটা কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।তীরার মাতৃত্ব হৃদয় হয়তো তখন তীব্রর কথা মনে করাই।যে তার আরও একটা ছেলে আছে!!
এইটুকু বলেই থামলেন তিনি। হাঁপিয়ে উঠেছেন যেন এতো কথা বলে। এদিকে রিদি শুধু শুনেই যাচ্ছে আর ভাবছে একটা মা এতোটা নির্দয় কিভাবে হতে পারে!সে আবারো তাকালো নানুর দিকে।তিনি গভীর একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আবারো বলল,
চৌধুরী পরিবার তখন সুখেই দিন কাটাচ্ছে তীব্র,তীর কে নিয়ে। কিন্তু তীরার ফিরে আসা তাঁদের জীবনে একটা ঝর নিয়ে আসে।তীরা তখন মাতৃত্বের টানে ফিরে আসে। প্রথমেই সে আমার সাথে দেখা করতে মিজান মঞ্জিলে।আমি প্রথমে দেখা করতে না চাইলেও সে জেদি ছিল।আমার সাথে দেখা না করে সে কিছুতেই যাবে না।বাধ্য হয়ে সেদিন ১৪ বছর পর দেখা হলো আমাদের।আমার কাছে মাফ চাইল।সব কিছুর জন্য ক্ষমা চাইল। আমেরিকার সেই স্বামী সন্তান হারিয়ে সে নিঃস্ব!সে ফেরত পেতে চাইল আমির আর তীব্র কে!আমি সেদিন একটাই কথা বলেছিলাম।
“আমির আর তিশার সাথে তাদের ছেলেদের সম্পর্ক এতটাও ঢুনকো নই যে তোমার মতো তীরা তা ভাংতে পারবে।এতটুকুর গ্যারান্টি আমি দিচ্ছি”
সেদিন সে ফিরে গেছিল।আমি ফোন করে সেদিনই আমিরকে সবটা জানাই।আমি চাইতাম না ছোট্ট প্রাণবন্ত তীব্র হারিয়ে যাক।এসব কিছু এখুনি ওর মাথায় ঢুকুক। তাছাড়া একটা সুন্দর পরিবার নষ্ট হয়ে যাক।এরপর থেকে তীব্রর সিকিউরিটি বাড়িয়ে দেয় আমির। বাইরের কারো সাথে দেখা করার সুযোগ দেয় না।যাতে তীরা তীব্র কে কোন ভুল কিছু না বোঝায় বা ওর সাথে দেখা না করে। এদিকে তীরা তীব্র কে দেখার জন্য রোজ তার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত।সে তো তীব্র কে চিনত পর্যন্ত না।একদিন আমির কে তীব্র আর তীরের সাথে দেখে বুঝতে পারে এই দুই ছেলের মধ্যেই একজন হয়তো তার সন্তান।সে ছুটে যায়। কিন্তু ততক্ষণে গাড়ি চলতে শুরু করে।ছুটে আসার কারনে তীরার রোড এক্সিডেন্ট হয়। সুস্থ হতে বেশ সময় লাগে। সুস্থ হওয়ার পর সে আবারো তীব্রর সাথে দেখা করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। একদিন শপিং মলে দেখা হয় তার তীব্রর সাথে। সেদিন সে চেহেরা না দেখলেও শপিং মলে দেখায় তীব্র কে চিনে ফেলে সে।কারন আমির আর তীব্রর চোখের মনি এক নীলাভ বর্ণের। সেদিন তার মনে হিংসার জন্ম হয়।দুই ছেলে আর গর্ভবতী স্ত্রীর সাথে আমির কে দেখে হিংসা হয়,জেদ চেপে ধরে। তার তিশাকে সরিয়ে সেই পরিবার চাই ই চাই।
তীরা এবার আমির কে হুমকি দেয় হয়তো তীব্র কে তাকে দিয়ে দিতে নয়তো তিশাকে ডিভোর্স দিয়ে তাকে তিশার জায়গা দিতে।নয়তো সে তীব্র কে সবটা বলবে। কিন্তু আমির কিছুতেই এই দুটোর একটাও করতে রাজি হয়নি।সে না তীব্র কে দিবে আর না তিশাকে ডিভোর্স দিবে।এক লড়াই চলতে থাকে তাদের মাঝে। একদিন তিশার সাথে দেখা হয় তীরার।সে তিশাকে সবটা বলে আর হুমকি দেয় তীব্র কে তাকে দিতে নয়তো সে সব শেষ করে ফেলবে।তিশা কিছুতেই তীব্র কে তীরার কাছে দিতে রাজি হয় না।
সেদিন ছিল শুক্রবার।প্রায় শুক্রবার করে তিশা মিজান মনজিল এ আসত তীব্র কে আমাদের সাথে দেখা করাতে।আমরাও তীব্র কে দেখতে যেতাম চৌধুরী বাড়িতে।ভালোই তো চলছিল সবকিছু।সেদিন শুক্রবার এ তিশা ৫ মাসের পেট নিয়ে এসে আমাকে সবটা বলে কেঁদে উঠলো।সে তীব্র কে কিছুতেই তীরা কে দিতে প্রস্তুত না।আমি আগে থেকেই সবটা জানতাম কারন আমার নজর ছিল তীরার উপর।আমি কোন উপায় না দেখে সেদিন তীর আর তীব্র কে সবটা বলি অতীতের সবটাই বলি।বুঝার বয়স তখন হয়েছে তাদের। তবুও তারা ছোট মানুষ।আমি ভেবেছিলাম হয়তো অনেক রিয়্যাক্ট করবে। কিন্তু সেদিন তীব্র বলেছিল,
“আমি আমার আম্মু কে অনেক ভালোবাসি নানু।আমার আম্মুর ছেলে তো আমার ভাই ই হচ্ছে তাই না নানু!!
আমি তীর কে ভাই কম বন্ধু বেশি ভাবি।আম্মু আমাকে বলেছিল ভাই-বোন ছেড়ে চলে যাই কিন্তু বন্ধু কখনো ছেড়ে যায় না।আমি তীর কে কখনো ছেড়ে যাব না নানু। আমি তো ওর বন্ধু।আমি,আব্বু, আম্মু,তীর, ছোট্ট বোনুদের সাথে থাকতে চাই নানু”
আমি সেদিন ভীষণ অবাক হয়েছিলাম! সত্যি বলতে আমি সেদিন শকড্ ছিলাম। ছোট তীব্রর মুখে কথাগুলো শুনে আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না।আমার মনে হলো তীরা শুধু গভে ধারন ই করেছে। মানুষ তো তিশা করেছে।তার গুন তো থাকবেই।সেদিন আমার কাছে চিরন্তন সত্য বলে একটা কথা প্রমাণিত হল
“জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না ”
এর মাঝে কেটে গেল কয়েকটা মাস।তিশা তখন ৮মাসের গর্ভবতী।মাঝে মাঝেই তারা ফ্যামিলি নিয়ে প্রায়ই ঘুরতে বের হতো!সেদিন বিকেলে ঘুরতে বের হয়েছিল তারা।আর সেই ঘুরাই ছিল শেষ ঘুরা।গাড়ির ব্রেকফেল হওয়াই গাছের সাথে বাড়ি খায় গাড়িটি। স্থানীয় লোকজন সবাই কে হসপিটালে নিয়ে যায়।আমরা যখন পৌঁছায় তখন জানতে পারি,
আমিরের স্পট ডেথ হয়েছে।অনেক আগেই মারা গেছে আমির।পরিবার কে বাঁচাতে গিয়ে হয়তো নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে।তিশাকে তখন অপারেশন রুমে নিয়ে গেছে।তিশার অবস্থাও খারাপ।পেটে বাড়ি খাওয়াই তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।তীর আর তীব্র কে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়াই দুইজনেই হালকা আঘাত পেয়েছে। গুরুতর আহত হয়নি কেউ।
১ ঘন্টা পার,
তিশার তখনো অপারেশন চলছে।আমিরের মৃত্যুর খবর,আর তিশাকে অপারেশন থিয়েটারে মৃত্যুর সাথে লড়তে দেখে তীর হাউমাউ করে কান্না করলেও তীব্র ছিল নিশ্চুপ, স্তব্ধ, শান্ত। তবে নিলাভ চোখজোড়া ছিল লাল।তীব্রর নিশ্চুপতা দেখে সেদিন আমরা ঘাবরে গেছিলাম। ভেবেছিলাম তীব্র হয়তো কোন ট্রামাই চলে গেছে।আমরা তীব্র কে বার বার কাদানোর চেষ্টা করলাম। বললাম কতোবার ,
তীবু কাঁদো নানুভাই!!
তীব্র তখন শান্ত কন্ঠে বলেছিল,
“আমি কাঁদলে কি আব্বু ফিরে আসবে নানুভাই!!বলনা নানু আমি কান্না করলে কি আব্বু চলে আসবে!”
আমি অবাক হলাম আবারো।বলার মতো শব্দ তখন ছিল না আমার।
তীব্রর দাদু তখন তীব্র কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।একদিকে ছেলের মৃত্যু অন্যদিকে তিশার মৃত্যুর সাথে লড়াই।খুব ভেঙে পড়েছিলেন তিনি।
এরপর ঠিক ৪০ মিনিট পর অপারেশন রুমের লাইট অফ হয়ে যায়।সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে যায় সেদিকে। ডক্টর বের হতেই সবার দিকে একবার তাকায়।কারো মুখে কথা নেই কিন্তু চোখে একটাই প্রশ্ন তিশা আর বাচ্চার কি খবর!
ডক্টর সবার চাউনি লক্ষ্য করল হয়তো।তিনি মুখটা নত করে বলল,
আমরা বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারি নি।সি ইজ নো মোর! এইটুকু বলে থামলেন তিনি!একটু পর আবারো বললেন,
তিশা!!ওনার হাতে সময় খুব কম।ওনার ঙ্গান আছে। ওনি তীব্র আর তীর নামে কারো সাথে যেন দেখা করতে চাইছেন।
তীর মায়ের কাছে ছুটে গেলেও তীব্র খুব ধীর পায়ে রুমে ঢুকল।তীর ততক্ষণে মাকে জড়িয়ে কাঁদছে।তিশা তীরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
আব্বু আমার কাঁদে না!আম্মুর হাতে সময় খুব কম তীর।আমাকে একটা প্রমেস করো তুমি যেকোনো পরিস্থিতিতে কখনো তীব্র কে ছেড়ে যাবে না।তীর মাথা ঝুঁকিয়ে হ্যাঁ বলার ততক্ষণে তীব্র এসে দাঁড়িয়েছে তিশার সামনে।তিশা তীব্রর মাথায় হাত রেখে বলল,
তীবু তুমিও কখনো তীর কে ছেড়ে যাবে না।আমাকে প্রমেস করো।
তীব্র বিনা বাক্য ব্যয়ে তিশার হাতে হাত রাখে।তিশা মুচকি হাসল।একটু থেমে আবারও বলল,
তীব্র তোমাকে আরও একটা দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি।একটা ছোট্ট পুতুলের দায়িত্ব।দেখে রেখো ওকেও।
তীব্র এবারো বিনা বাক্যে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো। তিশা বেশ কিছুক্ষণ তীব্রর মুখের দিকে চেয়ে একহাত অতিকষ্টে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
আম্মু কে শেষ বার জরিয়ে ধরবে না তীব্র!
তীব্র ধীর পায়ে এগিয়ে এসে তিশার পাশে একটু জায়গায় শুয়ে পড়ল। খুব ধীরে তিশাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। এতোক্ষণ পর অভিযোগের সুরে বলল,
তুমি,আব্বু,বোনু আমাদের ছেড়ে কেন চলে যাচ্ছ আম্মু!আম সরি আম্মু!আম তোমার কথা শুনিনি।আমাকে মাফ করে দাও!!
তিশা তীব্রর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
এতে তোমার দোষ নেই তীব্র!এটা আমাদের ভাগ্য!তুমি তোমার তীরা আম্মুর সাথে থেকো তীব্র।সে হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।কখনো তার সাথে খারাপ আচরণ করো না।মনে রেখো সে তোমাকে জন্ম………………
ব্যাস কথাটুকু শেষ করার আগেই তিশা চুপ হয়ে যাই। তীব্র তিশার বুক থেকে মাথা তুলে তিশার চোখজোড়া বন্ধ করে দেয়। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকা তীর কে উঠিয়ে শক্ত গলায় বলে,
“আম্মু ঘুমাচ্ছে তীর!এভাবে কাঁদতে নেই।”
এরপর!! এরপর একদিনে তিনটা দাফন সম্পন্ন করা হয়।যে বোনের জন্য দুই ভাই কতোই না বায়না ধরেছিল সেই বোনকে মাটিতে শুইয়ে দিতে গিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তীব্রর চোখ বেয়ে।তীর তখন অসুস্থ! অতিরিক্ত কান্নার ফলে সেন্সলেস হয়ে গেছিল।অথচ তীব্র ছিল শক্ত।তিন তিনটা জীবন হারানোর পরেও তাকে কাঁদতে দেখা যায়নি।আমি সেদিন তীব্রর কঠোরতা দেখে আবাক হয়েছিলাম।
এরপর সময় চলতে থাকল।তীর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল।তবে প্রাণবন্ত তীব্র একদম নিশ্চুপ হয়ে গেল।শান্ত হয়ে গেল। কথা কম বলত। একদিন তীরা তীব্র কে নিতে চৌধুরী বাড়িতে আসলে তীব্রর দাদা দাদি তীরাকে বের হয়ে যেতে বলে।তারা কখনো তীব্র কে তীরার কাছে দিবে না। কিন্তু তীব্র সেদিন বলেছিল,
আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৫৬
“আপনি আমাকে না নিয়ে গিয়ে বরং চৌধুরী বাড়িতেই থাকুন!কারন আমি কখনো আপনার সাথে যাব না।”
প্রথমে তীব্রর কথা কেউ মেনে না নিলেও পরে তীরা কে থাকার পারমিশন দেয়।এরপর থেকে তীরা চৌধুরী বাড়িতেই থাকে। তীব্রর সো কলড মা হিসেবে। তীব্র তিশার কথা রেখেছে। সে মাকে সন্মান, মর্যাদা দিয়েছে তবে মা বলে হয়তো কখনো মানেনি বা ডাকেনি।