ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪৮
তাজরীন ফাতিহা
নিশাত মারওয়ানের আলাপ স্থগিত আজ তিনদিনে পড়েছে। শুধু আলাপ স্থগিত ব্যাপারটা সেখানেই সীমাবদ্ধ নেই একজন আরেকজনের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। বন্ধ অবশ্য হয়েছে নিশাতের পক্ষ থেকেই। মারওয়ান ঘরে থাকলে নিশাত অন্যরুমে দরজা আটকে রাখত আর বাইরে গেলে বের হয়ে রান্নাবান্না করত, ছেলেকে সময় দিত।
নিশাত সকাল আটটায় স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। মারওয়ান তখন ঘুমে। নাহওয়ানকে নাস্তা খাইয়ে মারওয়ানকে জাগাতে বলে বেরিয়ে পড়েছে সে।
আজকে স্কুলে গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে। ওটা শেষ করে বাসায় আসতে লেট হবে। এসব ভাবতে ভাবতে স্কুলে পৌঁছে গেছে সে। গেট দিয়ে ঢোকার সময় নাজমা ম্যাডাম ডেকে উঠলেন। নিশাত সেদিকে তাকিয়ে দেখল নাজমা ম্যাডাম তার হাজব্যান্ডের বাইক থেকে নামছেন। নিশাত তাকাতেই তিনি হাত নাড়িয়ে তাকে থামতে ইশারা করলেন। তারপর হেলমেট খুলে হাজব্যান্ডের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে কিছু হাজার টাকার নোট গুণে নিজের পার্সে ঢুকালেন। মানিব্যাগ পকেটে রাখতে রাখতে স্বামীর গালে চুমু খেয়ে নিজের গাল এগিয়ে দিলেন। নিশাত এক নজর সেদিকে তাকিয়ে সৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনে তাকিয়ে রইল। খানিক পর নাজমা ম্যাডাম এসেই বললেন,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“আজকে লেট হয়ে গেল। আর বলবেন না আপনাদের স্যার আমাকে ছাড়া একদমই কিছু বোঝে না। আমি বললাম আজ গাড়ি করে যেতে ইচ্ছে করছে না বাইকে যাব। অমনি নানা লেকচার শুরু করেছে। যদি দুর্ঘটনা হয় আমি পড়ে যাব, ব্যথা পাব হেন তেন। লোকটা এত্ত কেয়ারিং আমার নিজেরই মাঝে মধ্যে মনে হয় একটু কম কেয়ারিং হলে কী এমন ক্ষতি হতো? আপনিই বলুন।”
নিশাত নিশ্চুপ হাঁটছিল। নাজমা ম্যাডামের ছোড়া প্রশ্নে একটু ইতস্তত করে বলল,
“আমি কী বলব?”
প্রতিউত্তরে নাজমা ম্যাডাম বললেন,
“তাইতো আপনি কী বলবেন। আপনার তো এসব বিষয়ে অভিজ্ঞতা নেই।”
বলেই ঠোঁট বেকিয়ে হাসলো। কথাটায় নিশাত টিটকারীর আভাস পেল। তবে কিছুই বলল না। নাজমা ম্যাডাম যে তাকে কটাক্ষ করে কথাটা বলেছেন সেটা সে স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছে। এরকম কটাক্ষ তিনি নিশাতকে প্রায়ই করেন। আগে একা করলেও এখন আরও কয়েকজন কলিগের সাথে মিলে জোট বেঁধে করেন। নিশাতের প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন আর গায়ে লাগে না। যার স্বামীর ঠিক নেই তার স্ত্রী হয়ে এরকম দু’চারটা কটাক্ষ, টিটকারী হজম করতে না পারলে কেমন স্ত্রী সে।
অফিসকক্ষে প্রবেশ করা মাত্রই নাজমা ম্যাডাম তার সঙ্গী সাথীদের সাথে মিশে গেলেন। নিশাতের দিকে বিশেষ ভ্রুক্ষেপও করলেন না। এমনভাবে এড়িয়ে গেলেন যেন এখানে নিশাত নামের কারো কোনো অস্তিত্বই নেই। রুবি ম্যাডাম সবকিছু লক্ষ্য করে নিশাতের দিকে এগিয়ে গেলেন। এসেই নিশাতের পাশে চেয়ার টেনে বসলেন। নিশাত তাকে দেখে সালাম দিল। রুবি ম্যাডাম সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কেমন আছেন?”
নিশাত মুচকি হেঁসে জবাব দিল,
“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?”
“আমি তো আলহামদুলিল্লাহ ভালোই থাকি। আচ্ছা আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?”
নিশাত ঘড়িতে সময় দেখে বলল,
“জ্বি করুন।”
রুবি ম্যাডাম চেয়ারটা এগিয়ে নিশাতের পাশাপাশি আনল। তারপর খুব ধীরস্থির কণ্ঠে নমনীয় গলায় বলল,
“আপনার খারাপ লাগে না?”
“খারাপ লাগবে কেন?”
“এইযে আপনার হাজব্যান্ডকে নিয়ে এত গসিপ হয়, আপনাকে ঠাট্টা তামাশা করা হয় এজন্য?”
নিশাত শান্ত গলায় জবাব দিল,
“সত্যি বলতে মানুষের ন্যাচার অনুযায়ী প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন আর লাগেনা। সবকিছু সয়ে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ এভাবেই ভালো আছি। যত সইতে পারব জীবন ততই সুন্দর।”
“যদি কোনোদিন সহ্য শক্তি কমে যায়?”
“সেদিন নাহয় আবারও আল্লাহর সাথে বন্ধুত্ব করব।”
“ক্লান্ত হন না?”
“হই তবে রবের সঙ্গে কথা বললে ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।”
“রবের সঙ্গে কথা বলা যায়?”
“যায়, আমি তো প্রতিদিন বলি।
“এতটা মানসিক শক্তি কিভাবে অর্জন করলেন?”
“আল্লাহর সাথে কথা বলে।”
নিশাতের প্রতিউত্তরে রুবি ম্যাডাম হতবাক হলেন। এরকম উত্তর তিনি আশা করেননি। এত ধৈর্য, এতটা! সে থাকলে নিশ্চয়ই এতটা দৃঢ় মনোবলের সহিত জবাব দিতে পারত না। আল্লাহর উপরে তার কত অগাধ বিশ্বাস, ভরসা! চেহারায় একবিন্দু অসন্তুষ্টির ছায়া নেই। শুধু ক্লান্তি রয়েছে। রুবি ম্যাডাম হৃদয়কুঞ্জে নীরবে আওড়ালেন,
“আল্লাহ তোমার এই ধৈর্যশীল বান্দাকে তুমি নিরাশ করো না। তাকে সুখে রেখ। তোমার উপরে ভরসার প্রতিদান হিসেবেও সে অনেক অনেক ভালো থাকা ডিজার্ভ করে।”
ঘণ্টার আওয়াজ পড়ায় যে যার ক্লাসে চলে গেল।
নাহওয়ান রান্নাঘরের ফ্লোরে বসে খুব আয়েশ করে চিনি খাচ্ছে। এসেছিল দুধ খেতে তবে দুধের বয়াম না পেয়ে চিনির বয়ামে হাত ঢুকিয়ে কব্জি, কুনুই, মুখ ভরিয়ে ফেলেছে। বাবাকে বারবার ডাকার পরেও বাবার পাত্তা না পেয়ে নিজে নিজেই নিজের কার্য হাসিল করছে। মারওয়ান ঘুম ঘুম চোখে রান্নাঘরে এসে নাহওয়ানের এই হাল দেখে চোখ কপালে তুলে দাঁড়িয়ে রইল। চিনি শুধু মুখেই ভরায়নি আশেপাশে ফেলে একেবারে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা করে রেখেছে। মারওয়ানের রাগ উঠল। বাচ্চাটা এত জ্বালায়। নিজের কপাল ঘষে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“কি করছিস পোটকার বাচ্চা?”
নাহওয়ান ঘাড় ঘুরিয়ে বাবাকে দেখে ফোকলা হেঁসে বলল,
“ইট্টু মুজা মুজা কাই।”
মারওয়ান দাঁত কিরমিরিয়ে বলল,
“তোর মুজা মুজা খাওয়া বের করছি, দাড়া। পুরো রান্নাঘরের অবস্থা বেহাল করে ফেলেছে পাজি, হতচ্ছাড়া পটলের বাচ্চাটা। ওর মা জ্বালাতে পারেনা দেখে এটাকে রেখে যায় আমার জীবন ভাজা ভাজা করতে। লিলিপুট, লিলিপুটের ছাও দুটোই সেয়ানা।”
কথাগুলো বলতে বলতে মারওয়ান এগিয়ে এসে নাহওয়ানের হাত ধরে টেনে তুলল। গেঞ্জি, প্যান্ট থেকে চিনি ঝেড়ে বয়াম উপরে উঠিয়ে রাখল। তারপর রান্নাঘর ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করল। নাহওয়ানকে নিয়ে বাথরুমে গেল গোসল করাবার উদ্দেশ্যে। বাচ্চাটা পানি নিয়ে দাপাদাপি করছে। মারওয়ান ঠোঁট চেপে বলল,
“এই চুপচাপ দাড়া লিলিপুটের ছাও। সেদিন তোর মা আমাকে বুড়ো বলেছে। বুড়ো তো তোর কারণে হচ্ছি ব্রিটিশের নাতি।”
নাহওয়ানের প্যান্ট খুলে দেয়ায় তার পরনে শুধু সেন্ডুগেঞ্জি। সে সেন্ডুগেঞ্জি তুলে ধরে বলল,
“টুমি বিটিস?”
মারওয়ান মুখ গম্ভীর করে বলল,
“আমি ব্রিটিশ হতে যাব কেন? তুই, তোর মা, তোর নানা ব্রিটিশ। বুঝেছিস?”
“বুজেচি। আমি, টুমি, মা, নানু বাই চবাই বিটিস।”
মারওয়ান হতভম্ব গলায় বলল,
“কত বড় বদ, ভাবা যায়!”
নাহওয়ান হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল,
“বড নাই।”
“চোপ, লেংটু কোথাকার।”
নাহওয়ান গেঞ্জি ছেড়ে তার গুলুমুলু দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বলল,
“লিংটু বলো কেনু? চলম চলম।”
মারওয়ান মগ হাতে নিয়ে বলল,
“ওরে কত শরম! শরম একেবারে বেয়ে বেয়ে পড়ছে। লজ্জা নাই বাপের সামনে উদোম হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস?”
নাহওয়ান এবার চোখ থেকে হাত নামিয়ে নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল,
“নজজা নাই।”
মারওয়ান আর কথা না বাড়িয়ে পানি মগ ভর্তি করে নাহওয়ানের গায়ে ঢেলে দিল। গায়ে পানি পড়ায় নাহওয়ান মুখ হা করে ফেলল। মুখ দিয়ে বুদবুদ বের করতে লাগল। মারওয়ান ছেলের মাথা মেরিল বেবি শ্যাম্পু দিয়ে ধুইয়ে দিল। বেশ খানিক বাদে বাপ, ছেলে গোসল করে একেবারে পরিপাটি হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। মারওয়ান নাস্তা খেয়ে ছেলেকে তৈরি করল। নিজেও তৈরি হলো। দুই বাপ, বেটা ফিটফাট হয়ে বাসা থেকে বেরুলো।
আকাশে আকাশচর মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় ডানা ঝাপটে বেড়াচ্ছে। মাঝে মধ্যে ‘পদ্মালয়’ কুঞ্জে এসে বসে কিচিরমিচির শব্দ করে চলছে। তাদের কলতানে প্রকৃতিতে সৃষ্টি হচ্ছে সুরের মূর্ছনা। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া স্টাডি টেবিলে বসে কিছু লিখছিলেন। উর্মি ভুঁইয়া শুয়ে শুয়ে তাকে সূক্ষ্ম নজরে পর্যবেক্ষণ করছেন। বেশ খানিক পর এপাশ ওপাশ করে বললেন,
“শুনুন, আপনার ছেলে কি বাসায় আছে?”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া লিখতে লিখতেই জবাব দিলেন,
“থাকলেও তোমার কাছে আসবে না। তাই যা বলার আমাকে বলো। আমি বলে দেবো তাকে।”
“বউয়ের আঁচলের তলায় ঢুকে আছে?”
জবাব এলো,
“হ্যাঁ যেমন তোমার আঁচলের তলায় আমি ঢুকে আছি।”
উর্মি ভুঁইয়া রাগান্বিত স্বরে বললেন,
“মশকরা করবেন না আমার সাথে, বিরক্ত লাগে। আর আমার আশেপাশে কম থাকবেন। আপনাকে সহ্য হয়না।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া কলম রেখে বললেন,
“সহ্য হয় কাকে?”
উর্মি ভুঁইয়ার খিটখিটে উত্তর,
“কাউকে না।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন,
“তোমার মুড যেভাবে পরিবর্তিত হয় গিরগিটির রূপও এতো দ্রুত পরিবর্তন হয়না। এই বয়সে এসে আবারও পাগলামি শুরু হয়েছে।”
“কিসের পাগলামি? আমি একদম সুস্থ।”
“হ্যাঁ তার নমুনা তো দেখতেই পাচ্ছি।”
উর্মি ভুঁইয়া কপাল কুঁচকে বললেন,
“আপনি আমাকে ইনডাইরেক্টলি পাগল বলছেন?”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া কলম হাতে নিয়ে বললেন,
“ইনডাইরেক্টলি বলার কিছু নেই তুমি পাগলই।”
উর্মি ভুঁইয়া দাঁতে দাঁত পিষে চোখ মুখ কঠিন করে ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার দিকে চেয়ে রইলেন। যেন এক্ষুনি ভস্ম করে দেবেন সামনের পাঞ্জাবি পরিহিত পুরুষটিকে।
মানহা সকালের নাস্তা বানিয়ে টেবিলে সাজিয়ে রাখছে। ইহাব জগিং করে এসে মানহার পিছুপিছু ঘুরছে। মানহা বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না। ইহাব সেসব দেখে মনের দুঃখে গাইল,
“ও টুনির মা, তোমার টুনি কথা শোনে না।
রান্নার সাথে ডেটিং করে আমায় চেনে না।”
মানহা চোখ রাঙিয়ে বলল,
“এসব কি?”
ইহাব ঠোঁট উল্টে বলল,
“দুক্কো।”
“উফ সব সময় আপনার ইতরামি না করলে চলে না?”
“কোথায় ইতরামি করলাম? শুধু গেয়েছি।”
মানহা কোমরে এক হাত রেখে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“কি গেয়েছেন?”
ইহাব গলা খাঁকারি দিয়ে আবারও গেয়ে উঠল,
“ও টুনির মা, তোমার টুনি কথা শোনে…”
“থামুন থামুন।”
“কি হলো?”
“আপনার কাছে গান শুনতে চাইনি।”
“তোমাকে শোনাচ্ছিও না। জাস্ট কি গাচ্ছিলাম সেটা প্রাক্টিক্যালি দেখাচ্ছি।”
“উফ্ ভালো লাগছে না সরুন।”
“আমার ভালো লাগছে। খালি সরুন সরুন করো কেন? থাকুন থাকুন করতে পারো না?”
“না।”
ইহাব মানহার কাঁধে দুই হাত রেখে মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলতে লাগল,
“করেছি একটা বিয়ে
এতগুলো টাকা দিয়ে
মেয়ে হলো আনরোমান্টিক
আমি হলাম রোমান্টিক।
কাজের বেলায় বুম্বাস্টিং
আমার বেলায় ডিজগাস্টিং।”
“ধ্যাত্তেরি।”
নিশাত ক্লাসরুমে ক্লাস করানো অবস্থায় খবর পেল স্কুলে নাকি আইনের লোক এসেছে। বেশ চিন্তিত হলো সে। উড়ো উড়ো খবর পেল নাজমা ম্যাডামের নিকট তাদের আগমন ঘটেছে। কোনরকম ক্লাস শেষ করে তড়িঘড়ি করে ছুটলো অফিসকক্ষের দিকে। সেখানে পৌঁছে দেখল অফিসরুমের সামনে অনেক ভিড় ও জটলা বেঁধে আছে। ভিতরে কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে উৎসুক ও উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশিরভাগ মেয়ে কলিগরাই ভিড় করে রেখেছে। নিশাত আর গেল না সেদিকে। ভিড় না থাকলে একবার দেখার চেষ্টা করত। সে আর না দাঁড়িয়ে নিজের পরবর্তী ক্লাসে চলে গেল। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করার মানে নেই। মানুষ একটা কিছু পেলেই হলো। যেন অমূল্য রত্ন পাবার আশায় এমন চাতক পাখির ন্যায় ক্লাস ট্লাস
ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। নিশাত মনে মনে, “আল্লাহ সহজ করুন সব।” বলে প্রস্থান করল।
ক্লাসের মাঝেই পিয়ন এসে নিশাতকে জানাল অফিসকক্ষে যেতে। তাকে জরুরি ভিত্তিতে ডাকা হয়েছে। নিশাতের বুকে কামড় দিয়ে উঠল। তাকে আবার কেন ডাকা হয়েছে? এমনিতেই তার দুশ্চিন্তার কমতি নেই এখন আবার আইনের লোকেদের জবাবদিহিতা করা লাগবে। যতটুকু শুনেছে নাজমা ম্যাডামের স্বামীর ইনকাম সোর্স জানতে এই ভয়ংকর লোকদের আগমন ঘটেছে। নিশাতের কাছে আইনের লোক মানেই ভয়ংকর। ছোট থেকেই এদের ভীষণ ভয় পায় সে। আচ্ছা কোনোভাবে মারওয়ানকে নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবে না তো? যদি সে বলে তার হাজব্যান্ড কিছু করেনা তখন সন্দেহ করবে না? তখন তো আরও বেশি সন্দেহ করবে। এরা সাধারণ মানুষদের সব তথ্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করে। নিশাতের হাত পা কেন যেন কাঁপছে। কোন বিপদ আবার তার ঘাড়ে আসতে চলেছে সে বুঝতে পারছে না। হার্টবিট ফাস্ট চলছে।
অফিসকক্ষের দরজার সামনে দুরুদুরু বুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিশাত। এখন আর ভিড় নেই। সে দরজা অল্প ঠেলে ভিতরে এক নজর চাইল। মুখে মাস্ক পরিহিত বেশ কয়েকজন লোক বসা। একজন সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। সামনেই নাজমা ম্যাডাম বসা। তার চোখ মুখ ফোলাফোলা। এতক্ষণ যে কান্না করেছে তা বোঝা যাচ্ছে। নিশাতের বুকে কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। ম্যাডাম কান্না করছেন কেন? কি ঘটেছে ভিতরে? নাজমা ম্যাডামের সঙ্গী পারভিন ম্যাডাম, ফরিদা ম্যাডাম, খালেদ স্যার, ফয়সাল স্যার, আকরাম স্যার সকলেই মুখ কালো করে পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। লামিয়া আর রুবি ম্যাডাম তাদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। নিশাত ভিতরে ঢুকবে কী ঢুকবে না এসব ভেবে দোনামোনা করছে। তার ভীষণ ভয় করছে। অফিসকক্ষে কেমন গুমোট পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নিশাতকে দেখে রুবি ম্যাডাম বললেন,
“স্যার নিশাত ম্যাডাম এসেছেন।”
জিজ্ঞাসাবাদকৃত পুরুষটি থেমে গেলেন। হাত দিয়ে ঢোকার পারমিশন দিলেন। নিশাতের উল্টো দিকে বসা সে। নিশাত ঢোক গিলে ধীর পায়ে ঢুকলো। কয়েকজনের মধ্যে একজন উঠে এসে বললেন,
“ম্যাম আমরা আইন বিভাগের লোক। আপনার সম্পর্কে একটু তথ্য নেব তারপর ছেড়ে দেব। আশা করি আপনি কোঅপারেট করবেন?”
রুমের মধ্যে পিনপন নীরবতা। নিশাত ঢোক গিলে বলল,
“জ্বি বলুন।”
“স্যারের সামনে গিয়ে বসুন প্লিজ।”
নিশাতের বলতে ইচ্ছে করল, দাঁড়িয়েই প্রশ্ন করুন। কারো সামনে বসে উত্তর দিতে পারব না। কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বের করতে পারল না। ক্লান্ত ভঙ্গিমায় দুরুদুরু বুক নিয়ে নাজমা ম্যাডামের পাশের চেয়ারে বসল। চোখ নামিয়ে বারবার নিজের ঘেমে ওঠা হাতের তালু ঘষতে লাগল। যে লোকটি বসতে বলেছিল সে একটা বিরাট খাতা আর কলম এনে প্রশ্ন করল,
” আপনার এবং আপনার হাজব্যান্ডের নাম?”
নিশাত খুবই আস্তে বলল,
“জ্বি আমার নাম ফৌজিয়া নিশাত। হাসব্যান্ডের নাম মারওয়ান আজাদ।”
লোকটি খচখচ করে লিখে প্রশ্ন ছুড়লো,
“বাসা কোথায়?”
“উত্তরটেক।”
“গ্রামের বাড়ি?”
“চাঁদপুর।”
“আপনার হাজব্যান্ড কি করেন?”
নিশাত হাত ঘষতে ঘষতে বলল,
“তিনি কিছু করেন না।”
লোকটি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল,
“কিছু না করলে সংসার চলে কিভাবে?”
“শ্বশুর এবং আমার টাকায়।”
লোকটি কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
“সন্দেজনক স্যার। তাকে নজরে রাখতে হবে। তার নামের পাশে দাগ দেব?”
সামনের পুরুষটি এতক্ষণ পর মুখ খুলল,
“প্রয়োজন নেই। ছেড়ে দাও তাকে।”
“কিন্তু..”
“কোনো কিন্তু নয়। যা বলেছি করো।”
লোকটি নিশাতকে চলে যেতে বলল কিন্তু নিশাতের এদিকে মনোযোগ নেই। সে সামনের পুরুষটির দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে মাস্ক আছে যদিও তবুও এই কণ্ঠ সে চেনে। খুব ভালো করে চেনে। ভুল শোনার প্রশ্নই আসেনা। এতদিনে এই কণ্ঠের মালিককে মুখস্ত হয়ে গিয়েছে তার। চোখ দুটোও ভীষণ পরিচিত ঠেকছে। নিশাত শক্ত হয়ে বসে রইল। কিছু হিসেব মিলাচ্ছে সে। নাজমা ম্যাডাম সম্ভবত কিছু বলার জন্য তক্কে তক্কে ছিলেন। তিনি বললেন,
“আমার হাজব্যান্ড সম্পর্কে সব তথ্য দেয়ার পরেও আমাকে হেনস্থা করা হচ্ছে আর তার হাজব্যান্ড কিছু করেনা, সন্দেহজনক হওয়ার পরেও তাকে ছেড়ে দেয়া হবে? এ কেমন না ইনসাফী?”
যে লোকটি দাঁড়িয়ে ছিল সে তৎক্ষণাৎ বলল,
“বাড়াবাড়ি করবেন না? আমরা আপনার হাজব্যান্ডের জন্যই মূলত এখানে এসেছি। বাকিদের শুধু তালিকাবদ্ধ করে নিচ্ছি। তাই স্যারের সঙ্গে বেয়াদবি করবেন না। আপনি এখনো কথা বলছেন কোন মুখে? হাজব্যান্ড অবৈধ ব্যবসা করে তার ফুটানি দেখিয়ে ঘুরেন। এখন আবার গলাবাজি করছেন? এতো দেখি চোরের মায়ের তালগাছের সমান গলা।”
কথা শেষ হতেই লামিয়া ম্যাডাম এবং রুবি ম্যাডাম ফিক করে হেঁসে দিয়েছেন। হাসির শব্দ শোনা যাওয়ায় দুজনে মুখে হাত চেপে ধরেছেন। আজ বড্ড খুশি তারা। এই মহিলা আর মহিলার সাঙ্গপাঙ্গ বহু জ্বালিয়েছে। মানুষের পিছে পিছে গসিপ করত, গীবত গাইত, হাসাহাসি করত। এবার বুঝুক ঠেলা। নিশাত আজ একের পর এক অবাক হয়েই যাচ্ছে। এসব কি শুনছে সে? নাজমা ম্যাডামের হাজব্যান্ড অবৈধ ব্যবসা করেন? তার মাথা ধরে গেছে এত কাহিনী দেখে। খালেদ স্যার পিছন থেকে বললেন,
“যদিও উনি দোষী তবুও তার কথা কিন্তু একেবারে ফেলে দেয়ার মতো নয়? নিশাত ম্যাডামের হাজব্যান্ডের উপরে নজরদারি রাখা উচিত, আমি মনে করি।”
বাকিরাও সহমত জানালো। স্যার সম্বোধনকৃত লোকটি খালেদ স্যারের দিকে তীক্ষ্ণ নজর ফেললেন। খালেদ স্যার একটু কাঁপছেন। মনে মনে ভাবছেন, এই কথা বলে আবার তার বিপদ ডেকে আনলেন না তো? সামনের লোকটি কিছু ইশারা করতেই সকলকে রুম থেকে বের করে দেয়া হলো। নাজমা ম্যাডাম এবং খালেদ স্যার লোকটির মুখোমুখি বসা। লোকটি মাস্ক খুলে নাজমা ম্যাডামের দিকে চাইলেন। নিশাত তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে অস্ফুট গলায় বলল,
“মারওয়ান আজাদ!!”
নাজমা ম্যাডাম হা করে বললেন,
“আপনি নিশাত ম্যাডামের হাজব্যান্ড না?”
লোকটি কেমন করে হেঁসে বলল,
“হলে কি করবেন?”
নাজমা ম্যাডাম ঢোক গিলে বললেন,
“আপনি আইনের লোক?”
রহস্যময় হেঁসে জবাব এলো,
“না আমি বেআইনের লোক।”
খালেদ স্যার বললেন,
“এসব কি বলছেন মিস? ওনার হাজব্যান্ড নাকি ভাদাইম্মা, কোনো কাজ করেন না তাহলে ইনি তার হাজব্যান্ড হয় কিভাবে?”
“আমি জানি না ভাই। কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে সব আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। তবে ইনি নিশাত ম্যাডামের হাজব্যান্ড এতে কোনো সন্দেহ নাই।”
সামনের লোকটি রুক্ষ গলায় বলল,
“যাইহোক এই রুমে কি ঘটেছে, কি দেখেছেন সেসব যেন ভুলে যাওয়া হয়। মনে থাকবে?”
উভয়ই কাঁপা গলায় বললেন,
“জ্বি মনে থাকবে।”
লোকটি বাঁকা হাসল। সবাইকে বের করে দিয়ে নিশাতের সামনে দাঁড়িয়ে কোটটা খুলে বলল,
“ভালো আছেন মিসেস?”
নিশাত প্রতিউত্তর করতে পারল না। শার্টের বুকের উপরে লোগোতে লেখা,
এজেন্ট (IMF),
কোড নম্বর 2356xAC।
কোমরের হিপ হোলস্টারে পিস্তল রাখা। চোখের সামনে তুড়ি বাজানোর শব্দে নিশাতের ঘোর কাটল। কেমন গলায় বলল,
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪৭
“আপনি মারওয়ান আজাদ?”
“উহু আজারাক সাইফার।”
নিশাত আর ভারসাম্য রাখতে পারল না। চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল।