তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ১৩

তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ১৩
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

অনুকে জড়িয়ে ধরে রায়ান ভাই আঁতকে উঠে বলল,
“তোর তো অনেক জ্বর!”
অনু এই কথার কোনো জবাব দিল না। নিরবে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। রায়ান ভাই বলল,
“বাড়িতে চল।”
“না।”
“না মানে? কেন যাবি না?”
“আমার এক্সাম আছে।”
“এখন কীসের এক্সাম?”
“ক্লাস টেস্ট।”
“ঠিক আছে। আমি অপেক্ষা করছি।”
“প্রয়োজন নেই।”
“জেদ করবি না অনু।”

অনু এতক্ষণ রোমিওর দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল। এবার সরাসরি রায়ান ভাইয়ের চোখের দিকে তাকাল। সানগ্লাসের জন্য অনু রায়ান ভাইয়ের চোখ দেখতে না পারলেও; অনুর গভীর ও তীক্ষ্ণা চাহনি দেখে সাময়িক সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল রায়ান। চোখ দুটোই বলে দিচ্ছে, রায়ানের প্রতি ঠিক কতটা ক্ষোভ, জেদ, অভিমান অনু জমিয়ে রেখেছে।
অনু নিস্তেজ কণ্ঠে বলল,
“আমি যাব না। আপনি চলে যান।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অনুর জেদের মাত্রা বোঝা হয়ে গেছে রায়ান ভাইয়ের। সে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে বলল,
“বাড়িতে ছোটো ফুপি এসেছে। রিয়াদ ভাইয়ার জন্য মেয়ে দেখতে যাবে। বাড়ির সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে। বাড়ির বাকি সদস্য তোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ না হলেও মেজ চাচ্চু আর চাচিমনি নিশ্চয়ই তোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ? তোর জ্বরের কথা জানার পর থেকে চাচ্চু অসুস্থ। চাচিমনিও। এখনো কি তুই যাবি না?”
অনু নরম হলো। বাড়ির সবার গুরুত্ব আছে অনুর কাছে। সবাইকে সে ভালোবাসে। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় নিজের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য হলেও কঠোর হতে হয়, স্বার্থপর হতে হয়। তাই বলে এই নয় যে, সে তার বাবা-মায়ের ক্ষেত্রেও এরকম কঠোর মনোভাব নিয়ে থাকবে। অনু রাজি হয়ে গেল। রায়ান ভাইকে বলল,

“আমি ক্লাস টেস্ট শেষ করে আসছি।”
“ঠিক আছে।”
রোমিওকে রায়ান ভাইয়ের কাছে দিয়ে শাপলাকে নিয়ে অনু ভার্সিটিতে গেল। শাপলা তখন জিজ্ঞেস করল,
“ঐটা কি তোমার কুকুর?”
“হ্যাঁ।”
“আমি তো প্রথমে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। যেভাবে ঝাঁপিয়ে এসে তোমার পা পেঁচিয়ে ধরল!”
অনু মৃদু হেসে বলল,
“রোমিও ভীষণ ভালো। কাউকে কা’ম’ড় দেয় না, আঘাত করে না।”
“ওর নাম রোমিও?”
“হ্যাঁ।”

“আর ওনি কে? যার সাথে এতক্ষণ কথা বললে?”
“আমার কাজিন। বড়ো চাচ্চুর ছেলে।”
“দারুণ হ্যান্ডসাম কিন্তু! তোমাকে ভালোটালো বাসে নাকি?”
অনু তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল,
“আকাশ-কুসুম কল্পনা! আমি ক্লাসে ঢুকব এখন।”
“যাও। তোমার সঙ্গে বোধ হয় আজ আর দেখা হবে না। কবে আসবে?”
“বলতে পারছি না। ফোনে জানাবো।”
“অপেক্ষা করব। মিস করব ভীষণ। জলদি চলে আসবে কেমন?”
অনু হেসে বলল,
“ঠিক আছে।”

রোমিওকে রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাইয়ে দিচ্ছে রায়ান। রোমিও নিজেও লেজ নাড়িয়ে খুব আরামে খাচ্ছে। ওকে আজ খুশিও লাগছে বেশ। হয়তো এতদিন পর অনুর সাথে দেখা হয়েছে তাই। রায়ান কপাল কুঁচকে রোমিওর খাওয়া দেখছে আর একটু পরপর ঘড়িতে সময় দেখছে। সময় পার করতে রোমিওর সাথে কথাও বলছে। রায়ান বলল,
“তোর মালকিন কেমন বদলে গিয়েছে দেখেছিস? তোকে দেখেও ওর মন গলল না। কীরকম মুখের ওপর না করে দিয়েছিল যাবে না বলে!”
রোমিও সাড়া দিল না। খাচ্ছে চুপচাপ। রায়ান বিরক্ত হয়ে বলল,
“খাওয়া-দাওয়া ছাড়া আর কিছু বুঝিস না? কথার রেসপন্স করিস না কেন? নাকি তোরও তোর মালকিনের মতো ভাব বেড়েছে?”

এবারও রোমিওর সাড়া নেই। রায়ান বিরক্ত হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখতে পেল, অনু ব্যাগ টেনে টেনে নিয়ে আসছে। রায়ান জলদি গাড়ি থেকে নেমে অনুর কাছে গেল। ব্যাগটা এক হাতে নিয়ে অন্য হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার হাত ধরে হাঁট।”
অনু হাত ধরল না। একা একাই হেঁটে গাড়িতে উঠল। রায়ান দাঁতে দাঁত পিষে মনে মনে বলল,
“ঘাড়ত্যাড়া একটা!”

পুরো পথেও অনু কোনো কথা বলেনি রায়ান ভাইয়ের সাথে। রায়ান ভাইও বলেনি। এমনিতেই আজ সে অনেক অপদস্থ হয়েছে অনুর কাছে। আর নয় আজ! মেয়েটা এভাবে ওকে এড়িয়ে চলছে! রায়ান বিশ্বাসই করতে পারছে না।
বাড়িতে গিয়ে অনু দেখল হুলস্থুল কাণ্ড। সবাই উঠানে বসে গল্প-গুজব করছে। মাঝখানে অনেক খাবার। তার মা-ও বসে আছে। সে নাকি অসুস্থ! তাহমিনা বেগম ছুটে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। চুমু খেলেন। শরীরের তাপমাত্রা অনুভব করে আঁতকে উঠলেন। বাড়ির পারিবারিক ডাক্তারকে খবর দিতে বললেন জলদি। অনু মাকে শান্ত করে বলল,

“আমি ওষুধ এনেছি, মা।”
“থাকুক। আবার ডাক্তার দেখাবো।”
বাড়ির সবাই অনুকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মুহূর্তেই। কী খাবে, কী খেতে ইচ্ছে করছে এসব নিয়ে ব্যস্ত সকলে। অনু সবাইকে শান্ত করতে ব্যর্থ হয়ে বাবার রুমে গিয়ে দেখা করল। আলমগীর চৌধুরী মেয়েকে কাছে পেয়ে অর্ধেক সুস্থ হয়ে গিয়েছেন। ডাক্তার এসে দুজনকেই দেখে গেলেন, মেডিসিন দিয়ে গেলেন। অনু খেয়ে-দেয়ে বাবা-মায়ের রুমেই ঘুমাল দুপুরে।
তাহমিনা বেগম স্বামীর জন্য গরম স্যুপ নিয়ে এসে দেখেন, আলমগীর চৌধুরী এক ধ্যানে ঘুমন্ত অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি স্যুপের বাটি এগিয়ে দিলে, আলমগীর চৌধুরী ইশারায় টেবিলের ওপর রাখতে বললেন। তাহমিনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,

“কী দেখো?”
“আমার চাঁদকে।”
“এত দেখা লাগবে না।”
“কেন? আমার চাঁদকে বেশি দেখলে কি নজর লাগবে, তাহমিনা?”
“কী জানি! লাগতেও পারে। সত্য নাকি কুসংস্কার তা তো জানি না।”
“তাহমিনা, আমার চাঁদটার এত জেদ কেন বলো তো?”
“তোমারও তো কম না।”
“উঁহুম! আমার চাঁদ, তোমার জেদ পেয়েছে।”
“এখন দোষ আমার?”

“দোষ না তো! চাঁদ এবং চাঁদের মায়ের দুজনের জেদই আমার ভালো লাগে। যদিও ভীষণ পো’ড়া’য়!”
আলমগীর চৌধুরী অনুর পায়ের পাতায় চুমু খেলেন। ছোটোবেলায় অনুর ভীষণ পছন্দ ছিল পায়ে চুমু দেওয়া। আলমগীর চৌধুরী অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে যখন অনুকে কোলে নিয়ে আদর করতেন, তখন অনু পা বাড়িয়ে দিত চুমু খাওয়ার জন্য। আলমগীর চৌধুরীও আহ্লাদে তার চাঁদের পায়ের পাতায় চুমু খেতেন। এখনো তিনি অনুর পায়ের পাতায় চুমু খান। কিন্তু অনু জানে না। অনু ঘুমিয়ে পড়লে তিনি চুপিচুপি রুমে গিয়ে অনুর কপালে, পায়ের পাতায় চুমু খেয়ে চলে আসতেন।
রায়ান দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। পায়ে চুমু খেতেও দেখেছে। কিন্তু অবাক হয়নি। কারণ আর কেউ না জানলেও, রায়ান জানে এই ঘটনা।

রায়ানকে দেখতে পেয়ে আলমগীর চৌধুরী বললেন,
“কীরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয়।”
রায়ান ভেতরে গিয়ে চেয়ারে বসল। আলমগীর চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন,
“কিছু বলবি?”
“অনুর জ্বর কমেছে?”
“কিছুটা।”
“আচ্ছা ও তো এখন সুস্থ না, আমরা মেয়ে দেখতে দুদিন পর গেলে কেমন হয় চাচ্চু?”
“বেশ ভালো হয়। কিন্তু কাকলী কি মানবে?”
“ছোটো ফুপিই তো আমাকে বলল এই কথা।”
“তাহলে ভালোই হয়েছে। অনু সুস্থ হোক তারপর যাই।”
“ঠিক আছে চাচ্চু। এখন রেস্ট করো। পরে কথা হবে।”
“ঠিক আছে।”

সন্ধ্যায় ঘুম ভাঙল অনুর। আলমগীর চৌধুরী এতক্ষণ ওর ঘুম ভাঙার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“শরীরটা কি এখন একটু ভালো লাগছে, মা?”
অনু মলিন হাসি দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ।”
“চলো তাহলে নিচে যাই। সবাই অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। চায়ের আড্ডা বসেছে।”
“চলো।”

অনু ফ্রেশ হয়ে বাবার সাথে নিচে নামল। অনুকে পেয়ে আরেক দফা হইচই শুরু হলো নিচে। ছোটো ফুপি অনুকে টেনে নিজের কাছে বসালেন। মাথায়, শরীরে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“এখন কেমন লাগছে সোনা?”
“আগের থেকে একটু ভালো। মেয়ে দেখতে যাবে না ফুপি?”
“যাব তো! তুই একটু সুস্থ হয়ে নে আগে। রায়ান বলল, বাড়িতে প্রথম বিয়ে আর তুই মেয়ে দেখতে যেতে পারবি না এটা কেমন না?”
আলমগীর চৌধুরী বললেন,
“হ্যাঁ, রায়ান বলেছে। তুই অনুর জন্য দুদিন ডেট পিছিয়েছিস।”
“আমি না তো! রায়ান বলেছে।”

অনু রায়ানের দিকে তাকাল। রায়ান ভাই ধরা খেয়ে থতমত খেতে লাগলেন। ফুপি বললেন,
“রায়ানই তো অনুর কথা ভেবে ডেট পেছাতে বলল। আর ঠিকই তো বলেছে। আমার অনুকে ছাড়া মেয়ে দেখা পরিপূর্ণ হবে নাকি?”
অনু আবার রায়ান ভাইয়ের দিকে তাকালে, রায়ান এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি আসছি একটু ওয়াশরুম থেকে।”
ফুপি বললেন,
“আসার সময় রিয়াদকে নিয়ে আসিস তো। মেয়ে মানুষের মতো এমন লুকিয়ে বসে আছে কেন ঘরে বুঝি না!”
“আচ্ছা।”

রায়ান ভাই ওপরে গিয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। কী দরকার ছিল ফুপির, তার নাম নেওয়ার! বারান্দায় উঠে দেখল রিয়াদ বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে আছে। রায়ান বলল,
“এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছিস? নিচে চল। সবাই ডাকছে।”
রিয়াদ গম্ভীর কণ্ঠে নাম ধরে ডাকল,
“রায়ান?”
রায়ান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। রিয়াদ বলল,
“আমি আর কারো থেকে কিছু আশা করি না। কারণ কেউই কিছু জানে না। কিন্তু তুই তো জানিস। তুই সব জেনেও কেন বাড়ির সবার কথাতে সায় দিচ্ছিস?”

তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ১২

রায়ান দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বারান্দার রেলিঙের ওপর দুহাত রাখল। তার দৃষ্টি গেল উঠানে। সবার মধ্যমণি হয়ে বসে আছে অনু। আয়ান ওকে জোর করে চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে। অনু খেতে চাচ্ছে না। তমাল অনুর দুহাত তাই মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে রেখেছে। আলমগীর চৌধুরী জোর করে খাওয়াতে নিষেধ করছেন। কিন্তু দুই ভাই মানতে নারাজ। আদরের বোনকে এতদিন পর কাছে পেয়ে ঠুসেঠুসে খাওয়াচ্ছে। আয়ান অনুর কপালে চুমু খেয়ে বলছে,
“এই একটা বিস্কুট খেলেই হবে, পাখি। আর খাওয়াব না জোর করে।”
অনু খেতে নারাজ। এই বুঝি কেঁদে ফেলবে। অনুকে দেখে রায়ানের দীর্ঘশ্বাস ভারী হলো আরো।

তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ১৪