প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১৭
সাইয়্যারা খান
চিরপরিচিত এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পৌষ অপলক তাকিয়ে রইলো। ঘাটের পাশেই রাস্তা। মেইন সড়ক থেকে এই রাস্তা দিয়েই গাড়ি ঢুকে। ছোট থেকে তো পৌষ দেখেই এলো। আজ নিজেও চলে এলো। এমন না এখানে একদমই আসা হয় নি। ঝাপসা স্মৃতি তো বলে এসেছিলো পৌষ। সাদা রঙের তিনতলা বাড়ীটায় উপরেই গোটা অক্ষরে লিখা ‘তালুকদার বাড়ী’। বড় গেটটা বন্ধ। সামনে থেকে সামনে হলেও এই দুই মিনিটের রাস্তা তৌসিফ গাড়ি দিয়েই বউ এনেছে। নতুন বউ হুট করে হাঁটিয়ে বা রিক্সায় আনার মতো কাজ সে করে নি।
চাইলেই পথটা ছোট করে মসজিদের সামনে দিয়ে আসা যেতো, তাতে তাহমিনাদের বাড়ীর উপর দিয়ে আসতে হতো কিন্তু মসজিদের সামনে কিছু মানুষ তো থেকেই যায়। জিকিরের শব্দ শোনা যায় রাত দশটা অব্দি। পৌষের হাতটা তখনও তৌসিফের শক্ত হাতের মুঠোয়। পৌষ দেখলো মূল গেটটা বন্ধ, পকেট গেট দিয়ে ওরা ভেতরে ঢুকলো। বাড়ীর চারপাশে লাইন জ্বলছে কিন্তু ঘাটটা অন্ধকার। এসএসের গেট পেরিয়ে বাকি পথ টুকু হাঁটতে হলো ওদের। নিচ তলায় কোন ফ্ল্যাট নেই। ড্রাইভার আর দারোয়ান থাকে নীচ তলার বাম পাশে, সামনেই গ্যারেজ। ডানপাশে পুরোটা জুড়ে অফিসকক্ষ তৌসিফে’র। সিঁড়ি দিয়ে ওরা উঠে এলো তৌসিফের ফ্ল্যাটে। তাহমিনা আসে নি। সে বাড়ী গিয়েছে। মীরা, তিয়াশা আর তাহিয়া এসেছে সাথে। তুরাগ আর তুহিন একটু পর আসবে দেখা করতে। ফ্ল্যাটে ঢোকা মাত্রই বিশাল বড় ড্রয়িং রুম। দুই সেট সোফা বিছানো সেখানে। বিস্তর এক জায়গা। তাহিয়া তৌসিফের দিকে তাকিয়ে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ওকে এখানে বসাও ভাই। আমি বুয়াকে খাবার দিতে বলি।”
তৌসিফ বোনের দিকে তাকিয়েই বললো,
“তোমরা থাকো এখানে। ওকে ঘরে নিচ্ছি। যথেষ্ট ক্লান্ত ও।”
তাহিয়া কথা বাড়ায় না তবে তিয়াশা টিটকারি ছুঁড়ে। এটা তার অভ্যাস। বাড়ীর সবচাইতে ছোট মেয়ে, তার দাবিদাওয়াও একটু বেশি।
“মেঝ ভাই, বউ নিয়ে ঘরে ঢুকবে তা কি এতই সোজা? আগে কিছুটা গা ঝাড়া দাও তারপর নাহয় ঢুকো।”
তৌসিফ দাঁড়ি চুলকে শুধালো,
“ঘর সাজিয়েছেন? গা নাহয় ঝাড়া দিতাম কিন্তু ঘরে তো ফুল নেই।”
তাহিয়া শান্ত স্বভাবের। হালকা হেসে শুধু বললো,
“তাজা গোলাপ তোমার সাথে। আর ফুল দিয়ে কি হবে?”
তাহিয়ার কথায় তৌসিফ হাসলো। কথা সত্যি। একশত ভাগ সত্যি। তৌসিফ পৌষকে বসিয়েই সাইডে গেলো। হাজার টাকার কতগুলো নোট ছড়িয়ে পাখার মতো করে দুলিয়ে বললো,
“এটা নিয়ে বিদাও হউ। রাতে অবশ্যই খেয়ে যাবে।”
তিশা তাত্ক্ষণিক ভাবে বলে ওঠে,
“এত কম? মেঝ ভাই, আপনার থেকে মানা যায় এসব?”
” অনেক আছে। নাও তারাতাড়ি।”
মীরা মাঝখানে একপ্রকার খোঁচা দিয়েই বললো,
“আমরা মুঠ ভরে নেই। কখনো গুনে নিতে দেখেছেন? মুঠ ভরে দিন আজ। বিয়ে করিয়ে আনলাম।”
পৌষর চোখ দুটো আপনাআপনি উঠলো মীরার দিকে। যাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলা হয় তার গায়ে ঠিক লাগে। পৌষর মনে হলো মীরা তাকেই উদ্দেশ্য করে কথাটা বলেছে। জীবনের এলোমেলো এই ক্ষণটায় পৌষ ভিন্ন ভাবনায় ততটা সময় দিতে পারলো না। ও কি শোকাহত, এই প্রশ্নটাও নিজেকে করা হলো না। এই প্রথম বোধহয় পৌষ একদমই অমানুষ হয়ে গেলো, নাহলে কোন অনুভূতি কেন কাজ করছে না? মানুষ হলে আবেগ-অনুভূতি কোথায় গেলো? নিজেকেই যেন পৌষ চিনতে পারছে না। এই যে এত ঘটনা, এসবের মাঝে নিছক এক উদ্ভট বস্তু বলে মনে হচ্ছে নিজেকে।
ওদের কথা-কাটাকাটি বোধহয় শেষ হয়েছে। তৌসিফ পুণরায় পৌষ’র হাত ধরে। আস্তে করে বলে,
“উঠে এসো।”
চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে পৌষ পা মিলালো তৌসিফের পেছনে। বড়সড় একটা দরজা খুলে তৌসিফ ভেতরে ঢুকলো পৌষ’কে নিয়ে। পৌষ’র বুকটা তখন আচমকাই বেইমানি শুরু করলো। বিনা নোটিশে ওরা ধুকপুক শব্দ বাড়িয়ে দিলো। কোন এক অপরিচিত ভয় ওকে জেঁকে ধরেছে একদম আষ্টেপৃষ্টে। নিজের ভেতরের ভাবখানা কিছুতেই মুখে ফুটতে দিলো না পৌষ। তৌসিফ সুইচ চেপে দিতেই সোনালী আলোয় ঘরটা ঝলমলিয়ে ওঠে। বিশাল বড় এক কক্ষ। পৌষ যতটুকু এই সোনালী আলোয় দেখলো তাতে বিনাবাক্যে সে বলতে পারবে সরাসরি কখনো এমন কামড়া ও দেখেনি। দেখার কথাও না। মধ্যবিত্তদের চোখ এসব টিভি ছাড়া দেখে না সচরাচর। তৌসিফ ওকে ডিভানে বসিয়ে নিজ থেকেই মাথার ঘোমটা নামিয়ে দিলো। এসি ছেড়ে দিয়ে শুধু বললো,
“বসো। আসছি আমি।”
তৌসিফ বেরিয়ে দরজা চাপিয়ে গেলো। পৌষ আটকে রাখা দমটা ফোঁস করে ছাড়লো। হায় হায়, এ কোথায় এলো পৌষ? ভেতরে রাগ চেপে বিরবির করে বললো,
“আসা লাগবে না তোর। শা’লা খাটাস একটা।”
নজর ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে পৌষ। ঘরটার মাঝে বিশাল বড় এক খাট। অল্পসংখ্যক আসবাবপত্র দিয়ে চমৎকার করে সাজানো গোছানো এক রুম। আধুনিকতার ছোঁয়া যেন সবকিছুতে। চোখ জুড়িয়ে এসব একবার দেখতেই সুন্দর কিন্তু থাকার জন্য সুন্দর সেই কাঠের খাটের শক্ত তোশক। অন্তত পৌষর কাছে সেটাই আরাম। এতবড় ঘরটায় এই সোনালী আলো ওকে যথেষ্ট জ্বালাতন করছে। আলো থাকবে সাদা, চকচক করবে চারপাশ কিন্তু নাহ, বড়লোকের বিরাট কারবার থাকতেই হবে। হলুদ বাত্তি জ্বালিয়ে এরা নিজের বড়লোকি ভাব বজায় রাখছে।
হাতটা অজান্তেই গলায় গেলো ওর। ঘাড়, গলা চুলকাচ্ছে। এভাবে শাড়ী পরে এতক্ষণ থাকাটা ঝামেলার। শ্রেয়া সুন্দর করে পরালেও গাড়িতে ওঠানামার দরুন কুচি গুলো একটু এলোমেলো হয়েছে। তাহমিনা ওর গলায় এই স্বর্ণের চেইনটা পরিয়েছে বিয়ের পর। পৌষর ভীষণ অস্বস্তি লাগলো কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারলো না। বিরক্তিতে মুখটা পাংশুটে হয়ে আসলো।
তৌসিফ বেরিয়েই বুয়াকে ডেকে বললো,
” রান্না শেষ?”
“জি, মামা।”
“টেবিলে দাও আর এক গ্লাস গরম দুধ দিও রাতে ঘরে।”
“জি, মামা।”
বলেই তৌসিফ ড্রয়িং রুমে গিয়ে তিয়াশাকে ডেকে বললো,
“তিশা, তোমার বর আসবে?”
“জি, ভাই।”
তাহিয়াকে জিজ্ঞেস করার আগেই তাহিয়া স্বভাব সুলভ হেসে বলে,
“উনি বাসায় ফেরার সময় নিতে আসবে। আমিও চলে যাব।”
“আজ থেকে যেতে।”
“আবার আসব।”
তিশা কটাক্ষ করে বললো,
“বউ নিয়ে কোথায় লুকিয়ে এসে। ননদ, ননাসকে ভালোমতো চিনবে না?”
“সময় হোক চিনে নিবে।”
তৌসিফ কথা বাড়ায় না। মীরাকে শুধু বলে,
“বড় ভাইকে ডাকুন ভাবী। খাবার তৈরী।”
মীরা মাথা নাড়ে। তুহিনকে ফোন দিয়ে তৌসিফ বললো,
” খেতে আয়।”
“ভাই…”
তৌসিফ চোখে হাসে। তুহিন বউ পাগল, অন্তত বড় ভাই এটাই মানে। পলককে রেখে আসাটা একটু কষ্টদায়ক বোধহয় কিন্তু এখন পলক আসলে ঝামেলা হবে। বড় ভাই এক টেবিলে খাবে বলেও মনে হয় না। তৌসিফ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
” খেতে আয়।”
“আসছি ভাই।”
তুহিন মেঝ ভাইয়ের উপর কথা বাড়ালো না। গায়ে টিশার্ট জড়াতেই পলক পেছন থেকে টেনে ঠিক করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,
“মেঝ ভাইয়ার ওখানে খাবে?”
“হুঁ।”
“আমি নতুন বউ দেখব না?”
তুহিন খুব সামান্য আহত হলো। কণ্ঠে ত্যাড়ামি ধরে রেখেই বললো,
” জানি না।”
“আমি চলি সাথে?”
তুহিন কথা বললো না। এক টানে পেছন থেকে পলককে সামনে এনে জড়িয়ে ধরলো। খুব শক্ত হলো তাদের এই বন্ধন। পলকের মাথায় চুমু খেয়ে তুহিন শুধু বললো,
“খুব কি ক্ষতি হতো যদি তুমি আজকের অবস্থানে না থাকতে? পলক চৌধুরী, তুমি খুব কঠিন।”
“ভাঙতে তো কম চেষ্টা করছো না তুমি।”
“আমি? আমি ভাঙব? সেই সাধ্য আছে আমার?”
“আপনি একদিন আমাকে ভাঙবেন। সেদিন আমি মুক্ত হব। আপনিও শান্তি পাবেন।”
“আমার শান্তি হোক পলক কিন্তু তোমার মুক্তি কখনো না হোক। আমার ভেতর জ্বালানো কষ্ট তোমাকে ছাই করুক কিন্তু উড়ে যেতে না দিক।”
“উড়ে যাওয়ার হলে কবেই যেতাম।”
“জানে মে’রে দিতাম।”
তুহিন ওকে ছেড়ে গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো। পলক সেই দিকে তাকিয়ে রইলো। আয়নার সামনে বসে নিজেকে দেখলো।
একসাথে খেতে বসেছে সকলে। তৌসিফ গোসল করে বেরিয়ছে একেবারে। আগের মতোই এক ভঙ্গিতে বসা পৌষ। এক পা এগিয়ে এসে তৌসিফ দাঁড়ালো ওর সামনে। মাথায় হাত রাখতেই পৌষ ঝাড়া দিয়ে দাঁড়ালো। তৌসিফ কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করে,
“কি হয়েছে?”
“ম’রা মরেছে।”
নিজের নব্য বিবাহিত বউয়ের মুখে বিয়ের পর প্রথম বুলি হিসেবে এই দুটো শব্দ তৌসিফের পছন্দ হলো না। ম’রা মরেছে কেমন শব্দ? কপাল কুঁচকে রেখেই তৌসিফ এগিয়ে আসে। দুই পা পেছায় পৌষ। নাকের পাটা ফুলিয়ে রেখেছে। তৌসিফ হঠাৎ ওর নাক টেনে ধরে। আস্তে করে বলে,
“খুবই পঁচা জিনিস এটা। নাক ফুলায় না।”
পৌষ নিজের নাক ছাড়িয়ে নিতেই তৌসিফ ঘড়ি দেখে বললো,
“খেতে এসো। তার আগে ফ্রেশ হয়ে এসো। গোসল করবে? ভালো লাগবে তাহলে।”
“না।”
তৌসিফ ভাবলো হয়তো গোসল করবে না তাই বললো,
“হাতটা অন্তত ধুয়ে এসো। সবাই অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।”
“কেন? আমার জন্য অপেক্ষা করার কি আছে? আমি কি সবাইকে মুখে তুলে খায়িয়ে দিব?”
তৌসিফ জানে বউটা বেয়াদব। ওর যথেষ্ট বেয়াদবি তৌসিফ দেখেছে। তেমন কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে তৌসিফ ধৈর্য নিয়ে বললো,
” একসাথে খাবে এসো।”
“যাব না৷”
“আশ্চর্য! এটা কেমন ব্যবহার?”
“বলেছি না যাব না? বারবার কেন ডাকছেন হ্যাঁ? এটাই আমার ব্যবহার। দেখেই তো এনেছেন আমাকে নাকি? আপনার তিন বোন আর ভাবীকে জিজ্ঞেস করুন গিয়ে। তারাই দেখে এনেছে। ব্যাবহার দেখে নি শুধু।”
তৌসিফ এবার পরিষ্কার হয়ে গেলো কেন ক্ষেপেছে এই মেয়ে। যথেষ্ট আদর কণ্ঠে বললো,
” আচ্ছা, এ বিষয়ে পরে কথা বলব আমরা ঠিক আছে? এখন খাবে।”
“খাব না৷”
কথাটা বলতেই ওর চোয়াল চেপে ধরে তৌসিফ ডান হাতে। পৌষ সাথে সাথেই খামচে ধরলো তৌসিফের টিশার্ট পেটের দিকে। তৌসিফ নমনীয়তা মিশিয়ে বললো,
“এভাবে দাঁত চেপে কথা বলতে নেই। পঁচা জিনিস এটা।”
চোয়াল ছেড়ে পুণরায় বললো,
“বাইরে কোনরূপ বেয়াদবি দেখাবে না। যা দেখানোর আমাকে দেখাবে। ঠিক আছে?”
“না, ঠিক নেই।”
“যথেষ্ট কথা বলো তুমি। ঠিক তোতাপাখির মতো।”
“*লের পাখির মতো।”
ধৈর্যটা তৌসিফ খুব করে ধরে রেখেছিলো যা বারংবার ভাঙছে পৌষ। তৌসিফ ওর মুখে গালি শুনেই এবার শক্ত কণ্ঠে বললো,
“চুপচাপ চলো। গালি দিবে না।”
পৌষ’র হাত ধরেই তৌসিফ বাথরুমে ঢুকে হাত ধোয়ালো। ওভাবেই ওকে নিয়ে এলো বাইরে। টেবিল ভর্তি মানুষের মাঝে পৌষকে নিয়ে তৌসিফ বসে। ওরা আসতেই খেতে লাগে সবাই। পৌষ চুপ করে বসেই আছে। বরাবর বসা একটা মেয়েকে দেখে কিছুটা কপাল কুঁচকে তাকায়। দেখতে আদিত্যর মতো। বেচারা আদিত্য, কই গিয়ে ম’রলো কে জানে। একবার পেলে পর উষিপুষি ছুটাবে পৌষ। এখন পর্যন্ত কোন আতাপাতা নেই ওর।
“মেঝ চাচি খাচ্ছো না কেন?”
অদিতি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করতেই পৌষ চট করে বুঝে নিলো এটা আদিত্যর বোন৷ ওকে দেখেছে পৌষ কিন্তু ততটাও না যে এক দেখায় চিনবে। তৌসিফ নিজে খাবার বাড়লো পৌষ’র জন্য। পৌষ চুপ করে বসে আছে। তাহিয়া আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে পৌষ? খাচ্ছো না কেন? খায়িয়ে দিব তোমাকে?”
পৌষ এক পলক তাকাতেই বাম হাতের তালুতে চাপ বোধ করে। তৌসিফ আড়ালেই যেন খেতে বললো। পৌষ কারো কথার উত্তর না দিয়ে রোস্টে হাত দিলো। ওটাই নাড়াচাড়া করলো। গলা দিয়ে খাবার নামবে বলে মনে হচ্ছে না৷ নিজেকে এই মূহুর্তে খুব হাস্যকর কিছু মনে হচ্ছে। তৌসিফ তুহিনের পাতে ইলিশ ভাজা তুলে দিতেই তুহিন বললো,
“মেঝ ভাই, কথা ছিলো একটু।”
” খাওয়া শেষ কর আগে।”
তুরাগ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে একপলক দেখেও কিছু বললো না। সবাই উঠে গেলেও পৌষ একাই বসে রইলো। তৌসিফ ওর হাত টেনে এবার গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“ওঠো।”
পৌষ উঠতেই ওকে রুমে পাঠিয়ে দিলো তৌসিফ। ততক্ষণে তাহিয়া আর তিয়াশার বর এসেছে। তাদের খেতে দিয়ে তৌসিফ নিজেই তদারকি করলো। বউ দেখার কথা উঠতেই তৌসিফ শুধু বলে,
“ঘুমাচ্ছে বোধহয়। আপনারা তো আসছেনই আবার। দেখে যাবেন।”
তাহিয়ার বরটা অতিশয় ভদ্র, নম্র একজন পুরুষ। যেমন শান্ত তেমনই নরম। একটা সন্তান থাকলেই ঘরটা পরিপূর্ণ হতো কিন্তু আফসোস তিনি কখনোই করেন না। তাহিয়াকে ভালোবাসেন, এতে যে যা বলার বলুক। তাহিয়া কখনো মা না হোক তবুও তার তাহিয়াকেই চাই। আজও থাকতে দিলেন না। রাত একটা নাগাদ সকলে বিদায় নিলো। বুয়াকে সব গোছাতে দিয়ে তৌসিফ বললো,
” দুধ আর খাবার রুমে পাঠাও।”
“জি মামা।”
তৌসিফ ঘরে ঢুকেই পৌষকে ডাকলো,
“পৌষরাত?”
নিজের নাম খুব একটা পৌষরাত শোনা হয় না। পৌষর যেন ঘোর লেগে গেলো এই ডাকে। গম্ভীর পুরুষ কণ্ঠে এক ডাক। মুখ তুলে তাকাতেই তৌসিফ এগিয়ে আসে। বরাবর সম্মুখে বসতেই নজর কাড়ে পৌষর গলাটা। লাল হয়ে আছে। হাত বাড়াতেই পৌষ সরতে যায় কিন্তু আটকে নেয় তৌসিফ। লাল হওয়া স্থানে হাত দিতেই পৌষ ব্যথাকাতুর শব্দ তুলে।তৌসিফ কপাল কুঁচকে বলে,
“কিভাবে হয়েছে এটা?”
“জানি না।”
“দেখি? তোমার সমস্যা হচ্ছিলো বললেই হতো।”
গলার চেইনটা খুলে দিলো তৌসিফ। ড্রয়ারে রেখেই বললো,
“চুপ করে উঠে এসো।”
পৌষ কপাল কুঁচকে তাকালো অতঃপর দৌড়ে বাথরুমে ঢুকলো। বাইরে থেকেই তৌসিফ শব্দ পেলো। বমি করছে পৌষ। খালি পেটে বমি। পৌষর মনে হলো নারীভুরী গলা দিয়ে চলে আসবে। দরজা ধাক্কায় তৌসিফ। ডাকে,
“পৌষরাত? পৌষরাত। দরজা খুলো।”
হিচকি তুলে পৌষ কুলি করলো। শরীর দূর্বল লাগছে ওর। মাথাটা ঘুরছে। রাত হলেই ক্ষুধা লাগে। আজ প্রথম ক্ষুধার উপর রাগ হলো। কেন পেটে ক্ষুধা লাগবে। কেন এত খেতে হবে?
পরণের শাড়ী ভিজেছে সামনের দিকে। দরজা খুলতেই তৌসিফ বললো,
“এবার গোসল করো।”
“কাপড় নেই।”
“আছে। আমি দিচ্ছি। তুমি যাও।”
পৌষ কথা না বলে গোসল করে নিলো। শরীরটা ভালো লাগছে একটু। দরজায় ঠকঠক করে তৌসিফ ওকে টাওয়াল সহ কাপড় এগিয়ে দিয়ে গিয়েছে। পাজামা আর কুর্তি পরে মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে পৌষ বেরিয়ে আসে। তৌসিফ ওকে দেখেই বলে,
“এখানে এসো। খাবে।”
“মিথ্যা বলো না। আমি দেখেছি। কাম ফাস্ট।”
পৌষর পেটটা তখন চু করে ডেকে ওঠে। লজ্জায় গিয়ে বসতেই পোলাও মেখে তৌসিফ নিজেই ওর মুখে ধরলো। লজ্জার মা-বাপকে দুটো গালি দিয়ে পৌষ খাবার গিলে। রাত হলেই পেটে সুরঙ্গ হয় ওর। যত ঢালবে ততই যেন ঢুকবে। দুধ দিতেই পৌষ নাক কুঁচকে বললো,
“এসব ছাইপাঁশ আমি খাই না।”
“দুধ ছাইপাঁশ?”
তৌসিফ যেন অবাকই হলো। পৌষ কথা বলে না। তৌসিফ জোর করে মুখের সামনে নিয়ে বললো,
“যথেষ্ট দূর্বল তুমি পৌষরাত। একটু খেয়ে নাও।”
“আলগা পিরিত দেখাতে হবে না। এসব ঢং দেখানোর কোন দরকার নেই। ঠ্যাকায় পরে বিয়ে করেছেন। খুব বড় উদ্ধার হয়েছে আমার। ঢং দেখানোর দরকার নেই। এসবে বদহজম হয় আমার।”
“মুখের ভাষায় খুব সমস্যা তোমার পৌষ। এসো ঘুমাবে।”
“খবরদার উল্টাপাল্টা করবেন না।”
তৌসিফ চোখে হাসলো যা দেখে পৌষ তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। চোখ দুটো ছোট ছোট করে হাসে তৌসিফ। পৌষর মাথায় হাত দিয়ে বলে,
“করব না উল্টাপাল্টা। এসো তুমি।”
পৌষ টাওয়াল থেকে চুল ছাড়াতেই তৌসিফ তাকিয়ে রয়। ঘন লম্বা চুল। কালো কুচকুচে। ফাঁকা এক ঢোক গিলে ও। মনে পরে এক অতীত।
হেমন্তর শরীর খারাপ হয়েছে। ডাক্তার এসে প্রেশার মেপে গিয়েছে। উচ্চরক্তচাপ তার। শ্রেয়ার চোখমুখ ফুলে উঠেছে। নিজের মা-বাবাকেই হেমন্ত ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না। জৈষ্ঠ্য আর চৈত্রই করছে যা করার। হেমন্তের গা মুছালো দুই ভাই। হেমন্ত শ্রেয়ার দুই হাত ধরে আছে। একবার বললো,
“তুমি বাবার বাড়ী যাবে শ্রেয়া? ছোট চাচ্চুকে দিয়ে পাঠাই? কাল, পরশু নিতে আসব আমি।”
শ্রেয়ার কান্না পায়। তা চেপে রেখে শুরু বলে,
“যাব না৷ কোথাও যাবে না।”
“তুমি এসব ডিজার্ভ করো না শ্রেয়ু। আ’ম স্যরি।”
“চুপ করুন হেমন্ত। ঘুমানোর চেষ্টা করুন।”
লেবু পানি কোনমতে একটু খায়িয়ে হেমন্তকে শুয়িয়ে রেখেছে। পাখা চলছে অবিরত। এসি ছেড়ে রেখেছে শ্রেয়া। হেমন্তের পায়ের কাছে তিন বোন বসা। এই যে, এই পরিস্থিতিতে যেই বোনটাকে সবচাইতে বেশি দরকার ছিলো সেই নেই। হেমন্ত তাকে হারিয়ে ফেলেছে। রাত বাড়তেই হেমন্ত কান্নার শব্দ পায়। ওর মা কাঁদছে বাইরে। কাঁদুক৷ হেমন্তও তো কাঁদে, তাকে কে দিবে সান্ত্বনা। পায়ের কাছে ইনি, মিনি ঘুমিয়ে। কারো খাওয়া হয় না৷ হেমন্ত আস্তে ধীরে উঠে চৈত্রকে বলে,
“নিচে গিয়ে খাবার নিয়ে আয়।”
দুই ভাই খাবার আনতে যায়। বাড়তে হয় না অবশ্য। ছোট চাচি নিজেই গুছিয়ে পাঠায়। দুই মেয়ে নিয়ে চিন্তা নেই তার, হেমন্ত আছে সাথে।
দরজাটা আটকে দিতেই হেমন্ত পায়ের কাছ থেকে ছোট্ট পরী দুটোকে কোলে তুললো। আস্তে ধীরে উঠালো ঘুম থেকে। ভাইয়ের বুকেই লেগে আছে দু’জন। একবার ঘুমের মাঝেই আপাকে খুঁজলো। ওদের আগে খায়িয়ে দিয়ে হেমন্ত বললো,
“ছোট চাচির কাছে দিয়ে আয়।”
ঘুমে ঝিমুতে থাকা দুই বোন নড়ে না। হেমন্তের গলা জড়িয়ে থাকে। মানে তারা যাবে না। হেমন্ত জোর করে না। পিহা সহ জৈষ্ঠ্য, চৈত্রকে খায়িয়ে যখন শ্রেয়ার মুখে তুলে দিলো শ্রেয়ার চোখ দিয়ে তখন টুপটাপ পানি পরলো। হেমন্ত মুছার আগেই পিহা মুছে ওকে জড়িয়ে ধরলো।
প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১৬ (২)
এক পৌষ গিয়ে নিঃস্ব করে গিয়েছে ছয় ভাই-বোনকে। হেমন্ত বুকে নিয়েই রাখে ইনি, মিনিকে। নিচে জৈষ্ঠ্য আর চৈত্র ঘুমাচ্ছে। বয়ঃসন্ধিতে পা দেওয়া ছেলে দুটো আজ লাজলজ্জা ভুলে কেঁদেছে। ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। হেমন্তর চোখ দুটো পুণরায় কাঁদে। তার পাশেই পিহার গুমরে কান্না থামাচ্ছে শ্রেয়া। মায়া জিনিসটাই খারাপ। একবার লেগে গেলে ছাড়ানো মুশকিল। খুব কষ্টসাধ্য।