শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫১

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫১
নূরজাহান আক্তার আলো

ব্যস্ত রাস্তার বুক চিঁড়ে শাঁ শাঁ শব্দে কুঁচকুঁচে কালো রঙ্গের একটা গাড়ি চলেছে দ্রুতগতিতে। একের পর এক চলন্ত গাড়িকে ওভারটেক করছে গাড়িটি। যেন ভীষণ তাড়া সবাইকে টপকে এগিয়ে যাওয়ার। যাবে যাক, তবে এভাবে কেন? এক্সিডেন্টের ভয় ডর নেই নাকি গাড়ির মালিকের?

তাছাড়া সিগনাল ভঙ্গ করার দায়ে ট্রাফিক কেস ঠুকে দিলে? রাস্তাপথে এসবও তো মাথায় রাখতে হয় নাকি? বলা বাহুল্য, নিজের জানের কথা স্মরণ করবে না? করলে অবশ্য এভাবে মৃত্যু হাতে নিয়ে গাড়ি টানত না।
মোদ্দাকথা, এসব কথা ভাবার একদমই সময় নেই এ গাড়ির মালিকের। কারণ সে আছে আপন ভাবনায়! আপন চিন্তায়। তার লক্ষ্য তাকে প্রাণ পণে ছুটতে হবে। পৌঁছাতে হবে নিজের গন্তব্যে। এভাবে চলতে চলতেই
গাড়িটা হাইওয়ে পেরিয়ে কিছুদূর গিয়ে থামল ‘ জননী’ নামের পেট্রোল পাম্পের সামনে। গাড়ির জানালা বন্ধ। জানালাতেও কালো কাঁচ বিধায় দেখা যাচ্ছে না ভেতরের কোনোকিছু। গাড়িতে পেট্রোল ভরতে সাহায্য করা ছেলেটা জানালার কাঁচে দু’টোকা দিলেও সাড়াশব্দ করল না কেউ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অগত্যা বিরবির করতে করতে চলে গেল ছেলেটি। খেঁকিয়ে উঠে বলে গেল পেট্রোল না নিলে জায়গা ফাঁকা করতে। নয়তো দেখা যাবে ভিড় লেগে যাবে। ছেলেটার কথা শুনে গাড়ির হর্ণ বাজল দু’বার। এরপরপরই সেই গাড়িটির পাশে আরেকটি কালো গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়ির নাম্বার, কালার, ডিজাইন একইরকম। বোঝার উপায় নেই আলাদা করার। গাড়ি
একই ডিজাইন হতে পারে কিন্তু নাম্বার? ব্যাপারটা অদ্ভুত না? তবে কেউ সেটা খেয়াল করল না। পাম্পে এলেও কেউ পেট্রোল নিলো না নিচেও নামল না। বরং কিছুক্ষণ পর সেভাবে থেকে একইসাথে সামনে রাস্তায় উঠে পাশাপাশি পথ চলতে শুরু করল। তাদের একসাথে দেখে এবার পেছনে থাকা একটি গাড়িতে বসা বিশু নামের ছেলেটি খেঁকিয়ে উঠল। ছুঁড়ল বাংলা গালি। কারণ তারা সাবধনতা অবলম্বন করে শুদ্ধকে ফলো করছিল এতক্ষণ ধরে। এখন গাড়ি একইরকম বিধায় গুলিয়ে ফেলেছে।

তবুও থামাল না, গাড়ি দুটোকে আগের মতো ফলো করতে লাগল। হঠাৎ আরেকটা গাড়ি আসায় কেমন খটকা লাগল তাদের। এমন তো হওয়ার কথা না তাই ছেলেটি ফোন দিলো তার মালিককে। মালিক ফোন ধরল না, ধরল তার সহকারী। তখন বিশু নামের ছেলেটি বলল,
-‘ছ্যার, একখান ঝামেলা বাইধ্য গ্যাছে। সব ঠিকঠাকই আছিল কুন্তু হঠাৎ
আরেকখান গাড়ি হান্দায় পড়ছে। এহন বুঝতেছি না কুনডা শুদ্ধ, কুনডা আরেকটা কেডায় জানি।’
-‘দুটোকেই ফলো করো।’
-‘করতাছি স্যার। আমগো সামনে দুইডা গাড়িই ফুল স্পিডে যাইতাছে। ‘
-‘ যেদিকে যাচ্ছে তোমরাও যাও। শুদ্ধর গাড়ি কখন, কোথায় যাচ্ছে, সব আপডেট জানাবে আমাকে।’
-‘জ্বে ছ্যার।’

-‘সায়নকেও ফলো করতে বলেছিলাম লোক লাগিয়েছো?’
-‘হ ছ্যার, চাপ নিয়েন না, হেরা দুই ভাইই আমাগো নজরবন্দি।’
-‘চাপ এমনি এমনি নিচ্ছি না যার কাজ করছো তার নাম মনে রেখো। সে কাউকে তার কাজে লাগানোর আগে সেই ব্যক্তির কলিজা নিজের কাছে জিম্মি রাখে। যাতে বেইমানি করলেই কেটে টুকরো টুকরো করতে পারে। আর সে ব্যক্তি অন্য কেউ না, ইয়াসির খান!’
-‘মুনে আছে ছ্যার।’
-‘গুড। আবারও বলছি, শুদ্ধ চট্টগ্রামের রাস্তা ধরলে সাথে সাথেই ইনফর্ম করবে। ওকে দক্ষিণের চা-বাগানের আশেপাশের আসতে দেওয়া যাবে না।’
-‘জ্বে ছ্যার।’

একথা বলে ছেলেটি কল কেটে তাকাল সামনের গাড়ি দুটোর দিকে। হ্যাঁ, সমানতালে এখনো ছুটে চলেছে গাড়ি দুটো। তারাও কোনোদিকে আর না তাকিয়ে ছুঁটল পিছু পিছু। হঠাৎ গাড়ি দুটো দু’দিকের পথ ধরল। এবার ছেলেগুলো ঘাবড়ে গেল কারণ তারা কেউ জানে না শুদ্ধ কোন গাড়িতে আছে। জানলে গুলিয়ে ফেলেছে একই রঙের গাড়ি ও নাম্বার হওয়ায়।
জানে না বিধায় কোন গাড়ির পেছনে ছুটবে বুঝে উঠতে পারল না। তারা
উপায় না পেয়ে পুনরায় ইয়াসিরের নাম্বারে কল দিলো। কিন্তু কেউ কল রিসিভ করল না। কয়েকবার কল দিতে দিতে কলটা বেজে বেজে কেটে গেল। অতঃপর নিজেরা আলোচনা করে ডানদিকের পথ ধরা গাড়িটার পেছনে গেল। কিন্তু নজরে পড়ল না দেখে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে সামনে
এগোতেই দেখে গাড়ি দুটো ঠিক পূর্বের মতো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে।

এবার তাদের মাথা এলোমেলো হওয়ার অবস্থা। মানে কি এসবের? দুই রাস্তায় গিয়েও আবার একসাথে হলো কিভাবে? চৌধুরীর পুত্ররা মাইন্ড গেম খেলছে বুঝতে বাকি রইল না তাদের। চলন্ত গাড়িতে বসেই অকথ্য ভাষায় গালি দিতে দিতে ছুটতে লাগল গাড়ির দুটোর পেছনে।
এদিকে তিনটে গাড়ি যখন শাঁ শাঁ করে চলে গেল শুদ্ধ তখন ধীরে ধীরে
বেরিয়ে এলো রাস্তার পাশে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভরা জঙ্গল থেকে। রাস্তায় উঠে তাকাল ডানে-বামে। আশেপাশে কারো চিহ্ন নেই। নির্জন চারিপাশ।

সে এক পা দু’পা করে এগোতেই ঠিক তার সামনে এসে ব্রেক কষল সাদা রঙের চারচাকার একটি গাড়ি। সেকেন্ডের মধ্যে খুলে গেল গাড়ির অপর পাশের দরজা। শুদ্ধ আর কোনোদিকে না তাকিয়ে গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়িটা বিপরীত পথ ধরে ছুঁটতে শুরু করল। গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসা
অর্ক একবার তাকাল শুদ্ধর মুখের দিকে । শুদ্ধ সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে অনড় হয়ে বসে আছে। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তার ভেতরকাল হালচাল। সে মাঝেমধ্যে ভেবে পায় না একটা ছেলে এতটা
অনুভূতিহীন কিভাবে হতে পারে ? সেও তো ছেলে..কিন্তু মাঝেমধ্যে সেও হাল ছেড়ে দেয়। সৌভাগ্যগুনে ক’টা বন্ধু পেয়েছে কষ্ট পেলেই ভেতরকার হাহাকার উগলে দেয় তাদের সামনে। অথচ শুদ্ধ এমনই! তার পরিবর্তন নেই। স্বভাব আগে যেমন ছিল এখনো একই রকম। আচ্ছা শুদ্ধ কখনোই কী তার স্বভাবের বাইরে বের হতে পারবে না? কখনোই কি ভালো লাগা, মন্দলাগা মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারবে না? শীতল নিঁখোজ, এখন কি শুদ্ধর উচিত না পাগলের মতো করা? অথবা একটু কাঁদা? চুপিচুপি তো কাঁদতে পারে। কিন্তু কাঁদছে না। কাঁদছে না নাকি কাঁদতে পারছে না সে?

এই না পারাটা কি তার জীবনের ব্যর্থতা নয়? বন্ধুর মনের অবস্থা বুঝেও মনে হলো এখন কথা বলা উচিত। কথা বললে কিংবা মনোযোগ সরালে মানুষ বিপদের মাঝেও সমাধান দ্রুত খুঁজতে পারে। এজন্য সে বলল,
-‘জিপিএস অন দেখাচ্ছে না?’
বন্ধুর কথা শুনে শুদ্ধ একবার তাকিয়ে থমথমে মুখে ছোট্ট করে জবাব দিলো,
-‘হুম।’
-‘কোথায় দেখাচ্ছে? ‘
-‘চট্টগ্রামের চা-বাগানের আশেপাশে।’
-‘ শীতল কি জানে ওর রিং-এ জিপিএস সিস্টেম করা?’
-‘না।’
-‘ তুই দিয়েছিস রিং টা এজন্য তোর ব্যাঙাচি আঙুল থেকেই খুলবে না, মিলিয়ে নিস? রিং না খুললে খুঁজে পেতেও সময় লাগবে না।’

শুদ্ধ আর কোনো কথার জবাব দিলো না সিটে গা এলিয়ে দিয়ে তাকিয়ে রইল আকাশপানে। আকাশের বুকে তারা আছে, চাঁদ আছে। আকাশের
কত গর্ব, কত সুখী, তাই না? তার তো চাঁদও নেই, তারাও নেই, যে আছে সে আপাতত নিঁখোজ। আচ্ছা, শীতল কি তাকে ডাকছে, খুঁজছে? আগে ভয় পেলে তো কেঁদে কেঁটে একাকার করত। এখনও কি খুব ভয় পাচ্ছে?
রাতে ভূত টূতের ভয় দেখালে আদুরে বিড়াল ছানার মতো ভয়ার্ত চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়াত। যদিও এখন সাহসটা বেড়েছে,

এখন ভয় দেখালে সোজা তার বুকে এসে হামলা করে। বুকে মুখ লুকিয়ে উল্টে তাকেই বলে, ‘ভূত টূত আবার কি? ভূতনীর ভূত থাকলে আমারও একটা বিশুদ্ধ পুরুষ আছে। আর খাব খাব লুক নিয়ে তাকাবেন না, ভয় পাচ্ছি না মোটেও। আর আমরা না লুকোচুরি প্রেম করছি? প্রেম করলে গফকে কেউ মারে? বকে? শুধু শুধু এত ধমকায়? জানেন তো শুদ্ধ ভাই, আপনি হচ্ছেন পৃথিবীর সবচেয়ে বে-রসিক প্রেমিক।’
এ কথাটা অবশ্য মানে। কারণ সে অনান্য দায়িত্বের বোঝা নিঁখুতভাবে
পালন করলেও কখনো বোধহয় প্রেমিক হতে পারবে না। কারণ প্রেমিক হতে গেলে সময় অসময়ে গফের প্রশংসা করতে হয়। ভালোবাসি বলতে হয় একাধিকবার। অন্যায় হলেও ন্যায় বলে গফের মন রক্ষা করতে হয়।

এসব তার দ্বারা হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, সে কখনো কারো মন রক্ষা করে চলতে পারে না। মনে এক কথা চেপে রেখে মুখে অন্য কথার বুলি আওড়াতে পারে না। এতসব না, না, ভিড়ে অন্যসব করতে পারবে৷ এই যেমন, শুধু তার ব্যাঙাচির চিরসঙ্গী হতে পারবে! অঘোষিতভাবে তার বুকজমিন তার নামে খোদাই করতে পারবে। বুকে করে আগলে রাখতে পারবে। ঠিকঠাকভাবে লুকোচুরি প্রেম করতে না পারলেও সবার সামনে
ব্যবহার দিয়েে বোঝাতে পারবে, কে তার কি হয়। ঢাকঢোল পিটিয়ে সে
আয়োজন করে ভালোবাসা প্রকাশ করতে না পারলেও..আড়ালে গিয়ে শখের নারীর ঠিক কপালে আদর এঁকে দিতে পারবে। খুব করে পারবে
শাষণ করে পরে তার টুকরো টুকরো আবদার মেটাতে। বিরক্তের সাথে
মাঝে মাঝে চোখের কাজল, চুড়ি, আলতা কিনতে এনে দিতে পারবে।

এগুলোতে হবে না? এগুলো কি ভালোবাসার অংশ না? তার ব্যাঙাচি কি এসবে খুশি হয়ে সুখী থাকতে পারবে না? সুখী হতে আর কী কী লাগে? টাকা? টাকা দিয়ে একমুঠো সুখ, ভালোবাসা, বিশ্বাস কেনা যায়? গেলে, কোন বাজারে যায়? প্রয়োজনে ব্যাঙাচির জন্য সে সেই বাজারেরই সুখ কিনতে যাবে। যত টাকা লাগে লাগুক অসীম সুখ এনে ব্যাঙাচির পায়ে অর্পন করে বলবে, ‘চল ব্যাঙাচি ভালো-থাকা ভাগাভাগি করি? আমার সবটুকু সুখ তোর আর তোর সবটুকু দুঃখ আমার। তুই সুখে ভাসবি আর আমি বুকে দুঃখ নিয়েও তোর হাসিতে তাল মেলাব। তোর সঙ্গের সঙ্গীর হবো। বিনিময়ে আমার থাকিস। আর তোর মনে একটুখানি ঠাঁই দিস।’

আচ্ছা এসব কি আদৌও বলতে পারবে? সময় কি সেই সুযোগ দিবে?
এসব ভাবতে ভাবতেই শুদ্ধর মনে হলো বুকের ভেতরে চিনচিনে ব্যথাটা সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে যাচ্ছে। উফ! অসহনীয়, অবর্ণণীয় এই ব্যথা। সময় যেন কাটছে না। সে কখন পৌঁছাবে সেখানে? কখন দেখবে সুস্থ অবস্থায় তার ব্যাঙাচিকে? সে সুস্থ থাকবে তো? খারাপ কিছু ঘটনার আগে সে সেখানে
পৌঁছাতে পারবে তো? তার বোকাফুলটাকে কলঙ্কের কলিমা থেকে মুক্ত করতে পারবে তো? যদিও না পারে? সময় যে এখন উল্টো পথে হাঁটছে,
বারবার কী ভাগ্য তার সঙ্গে দেবে?

কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাদের গাড়ি থেকে কয়েকহাত দূরে ফাঁকা স্থানে
একটা প্রাইভেট জেট এসে থামল। জেটে হাসান বসা। এটা হাসানোরই আপন চাচার জেট, যখন প্রয়োজন হয় কাজে লাগায়। আর এখন বন্ধুর বিপদে এগিয়ে আসবে না তা কি হয় নাকি? হাসান শুদ্ধকে দ্রুত আসতে বললে শুদ্ধ অর্কের দিকে তাকালে অর্ক তাকে জড়িয়ে ধরল। হাসি মুখে কাঁধ চাপড়ে যেতে ইশারা করলে শুদ্ধ আর দাঁড়াল না বীরের মতো হেঁটে জেটে উঠে বসল। জেটের দরজা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই ঘুরে উড়তে লাগল আকাশ পথে। অর্ক সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল ‘শুদ্ধ, ভাই আমার, তোকে আমি বিজয়ীর বেশে দেখে অভ্যস্ত। এবারও প্রাপ্তি নিয়ে হাসি-মুখে ফিরে আসিস ভাই। ইয়া আল্লাহ, আমার কলিজার বন্ধু সহায় হইয়ো। অবুজ মেয়েটাকে সন্মান নিয়ে ফেরার তৌফিক দান কোরো।’
একথা বলে জেট চোখের আড়াল হতেই সেও গাড়িতে উঠে রওনা হলো চৌধুরী বাড়ির দিকে। সেখানে তার কিছু কাজ আছে।

-‘ ছোটো মা আর চুপ করে থেকো না এবার অন্তত মুখ খোলো।তোমাকে এত এত কথা শুনতে দেখতে পারছি না আমি। অনেক তো হলো এবার সত্যিটা বলো সবাইকে।’
একথা বলে সে হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে আবার বলল,
-‘বাবা-মা ড্রয়িংরুমে ক্যামেরা লাগিয়েছে আহনাফ। শুধু ড্রয়িংরুমেই না
আমাদের তিনবোনের ওয়াশরুমেও ক্যামেরা লাগানো। এবং.. এবং তিন বোনের..তিনবোনের..গোসলের ভিডিও আহনাফের কাছে আ..ছে।’
একথা বলে শখ লজ্জায় মুখ ঢেকে শব্দ করে কেঁদেই ফেলল। উপস্থিতি সকলে তখনো হতবাক চোখে তাকিয়ে আছে শখের দিকে।একথায় যেন
বিনামেঘে বজ্রপাত হলো চৌধুরী নিবাসের ড্রয়িংরুমে। স্তব্ধ হলো সবাই।
মেয়ের কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারলেন না। বলা বাহুল্য, বলার মতো ভাষা খুঁজে পেলেন না। কিছুক্ষণ পর সিঁতারা সিমিনের উদ্দেশ্য বলল,

-‘ভিডিও নিয়ে আহনাফ তোকে হুমকি দিয়েছে? এজন্য বাড়ি ছেড়েছিস তাহলে?’
বড় বোন প্রচন্ড রেগে শাষণ করলে ছোট বোনরা যেমন মাথা নত করে থাকে, ঠিক তেমনভাবে সিমিনও মাথা নত করে আছে সিঁতারার সামনে। সিঁতারার প্রশ্নে উনি উত্তর দিতে পারল না কেবল না সূচক মাথা নাড়াল।
উনাকে না বলতে দেখে সিঁতারার রাগ বাড়ল। উনি ঠান্ডা মাথায় আবার বললেন,
-‘যা ঘটার ঘটেছেই! তোর চুপ থাকায় বা বাড়ি ছাড়ায় কিছুই থেমে থাকে নি। থামাতেও পারিস নি। মেয়ের ভিডিও দেখে হুমকি দিয়েছে? এ ভয়েই পালালি ছোটো? এজন্য আমার সংসারের ভিড়টা নড়বড়ে করে দিলি?
আমাকে বললেই বা কি হতো? এ তুই আমাকে বড় বোন ভাবিস? এখন যদি শীতলের গায়ে বদনাম লাগে তখন কি করবি তুই? চুপ থেকেও কি পারলি মেয়েটাকে বাঁচাতে?কেন তুই বারবার নিজের করা ভুলে আমার শুদ্ধটাকে পোড়াচ্ছিস তুই? আমার ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে তোর কি মায়া হয় না রে? এখন যে আমার তিনটা মেয়ের গায়েই কলঙ্ক লেপ্টে গেল। এবার কি করব? এমন বোকামি কেন করলি রে ছোটো? আমার মেয়েরা জানলে কিভাবে তাদের বুঝ দেবো? কিভাবে তাদের সামলাব?’

জায়ের কথায় সিমিন স্থবির হয়ে বসে রইল। লজ্জায় ঘৃনায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার৷ তাকে এবারও চুপ থাকতে দেখে শখ বুঝল ছোটো মা জীবনেও একথা মুখে আনতে পারবে না। তাই লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে সে বলল,
-‘আম্মু, সবার আড়ালে যা যা ঘটেছে সেসব সবার সামনে মুখে আনার মতো না।’
-‘তোরা কি সোজা কথা বলতে পারিস না? কি হয়েছে, কি ঘটেছে সেটাই তো জানতে চাচ্ছি। কথা কি গলা দিয়ে বের হচ্ছে না তোদের? আর কী কী জানার বাকি আছে আমাদের? কথা যখন উঠেছেই সবটাই বলবি তোরা।’
মায়ের বকুনি শুনে শখ কুঁকড়ে গেল। বুঝল আজকে মুখ খুলতেই হবে তাই সে বাবার দিকে একবার তাকিয়ে ছোটো মার দিকে তাকাল। তখন সিমিন হঠাৎ কল কেটে দিলো। উনাকে কল কাটতে দেখে সিঁতারার খুব ইচ্ছে করল ছোটো বোনের মতো ছোটো জায়ের গালে দু’থাপ্পড় লাগিয়ে দিতে। ছোটো মাকে কল কাটতে দেখে শখ কাছে ব্যাপারটা যেন সহজ হলো। সে থুতনী গলার সাথে মিশিয়ে বলল,

-‘আসলে ভাইয়াদের জামাতা হিসেবে মেনে না নেওয়াটা ছোটো মায়ের কাছে অজুহাত ছিল মাত্র। ভাইয়াদের বুক আগলে মানুষ করেছে ছোটো মা। সন্তানের মতো ভালোবেসেছে। সেই সন্তানদের দিকে আঙুল তুলতে উনার বুকটাও ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে পালিয়ে বাঁচার জন্য ভাইয়াদের কষ্ট দিতে হয়েছে।’
এইটুকু বলে থামল শখ। তারপর ঢোক গিলে পুনরায় বলল,
-‘আহনাফের কাছে ভিডিও আছে একথা আহনাফ ছোটো মাকে নিজে জানিয়েছে। কারণ আহনাফের প্ল্যান ছিল আমাকে টোপ হিসেবে বিয়ে করে চৌধুরী বাড়ির জামাই হওয়া। তারপর সমাজের চোখে ভালো হয়ে
শীতলের দিকে বদনজর দেওয়া।’

একথা বলে শখ আবার থামল। কথাগুলো বলতে বলতে হাঁপিয়ে গেছে সে। সিরাত শখকে ধরে সোফায় বসাল। মাথায় হাত বুলিয়ে দ্রুত আগে পানি এনে খাওয়াল। শখের কথাগুলো এলোমেলো লাগছে। কেমন যেন
অদ্ভুত শোনাচ্ছে সবার কাছে। আহনাফ ভিডিও করল, সেসব সিমিনকে জানিয়ে ব্ল্যাকমেইল করল, সিমিন বাংলা সিনেমার মতো সেসব কাউকে না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। গেল তো গেল, ছেলে দুটোকের দিকে আঙুল তুলে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বেরিয়ে গেল। সিমিনের সাথে জায়ের ভালো সম্পর্ক, সে কি কোনোভাবে ব্যাপারটা সিঁতারাকে জানাতে পারত না? কাউকে জানাল না মানা গেল, নিজের স্বামীকে? শাহাদতকে অন্তত জানাতে পারত। ড্রয়িংরুমে নাহয় ক্যামেরা ছিল বাকি রুমগুলোও উড়ে গেছে? শখের অর্ধেক কথা শুনে আগেই কেউ কোনো মন্তব্য করলেন না।
তবে সিরাত এবার শখের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

-‘মা, একটু খোলাখুলি করে পুরো ঘটনাটা বল আমাদের? এই সামান্য কারণে ছোটো এত বড় সিদ্ধান্ত নিলো? নাকি আরো কিছু আছে? সবটা বল সোনা।’
-‘মেজো মা, ছোটো মা মূলত বাবার সামনে থেকে পালাতেই অজুহাতটা দেখিয়ে চৌধুরী বাড়ি ছেড়েছে। কারণ ছোটো মা বাবাকে বড় ভাইয়ের আসনে বসিয়েছে। সেভাবেই সন্মানও করে। কিন্তু একদিকে আহনাফের
ভিডিও আরেকদিকে Ai দিয়ে বাবা আর ছোটো মাকে নিয়ে নোংরা পিক
বানিয়েছে আবু সিদ্দিক। মূলত সায়ন ভাইয়ার দল ছাড়ার রাগ চৌধুরীর বাড়ির সন্মান ধূলোয় মিশিয়ে দিয়ে প্রতিশোধটা নিতে চেয়েছিল। ছোটো মা এসব সহ্য করতে না পেরে ভাইয়াদের জানাতে চাইলে ওরা বলেছিল, ওয়াশরুমের ভিডিও আর বাবা আর ছোটো মায়ের নোংরা ছবি ভাইরাল করে দেবে। আমাদের পাঁচ ভাইদের কলিজা ছিঁড়ে কুকুরকে খাওয়াবে। ছোটো চাচ্চুকে মিথ্যা অপবাদে চাকরিচ্যুত করাবে। এক কথায় চৌধুরী নিবাসের সন্মান ধূলোয় মেশাবে।’

এবারও সকলে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন শখের দিকে। কি বলছে এই মেয়ে? এর মাথা ঠিক আছে? অন্য সব মানা যায় কিন্তু বড় ভাসুরের সাথে সিমিনের নোংরা ছবি..এটা ধৈর্য্যের বাইরে চলে গেল না? এজন্য তাহলে ছোটো বাড়ি ছেড়েছে? ছোটো বোন তুল্য ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে
এসব শুনে শারাফাত চৌধুরী প্রথমবারের মতো মাথা নত করে নিলেন।
প্রথমবারে মতো মনে হলো উনার মরে যাওয়ায় উচিত। এখনই বোধহয় মৃত্যুটাকে বরণ করার সঠিক সময়। মৃত্যাুর আলিঙ্গনই পারবে উনাকে অপমান থেকে বাঁচাতে।

এদিকে গাড়ি দুটো চলতি পথে হঠাৎ থেমে গেছে। না সামনে এগোচ্ছে না পেছনে যাচ্ছে। একদমই স্থির। গাড়ির ভেতরে লাইট অফ থাকায় বোঝা যাচ্ছে না ভেতরে কে বা কারা আছে। এখানে থামল কেন বোঝা যাচ্ছে না। পেছনে থাকা গাড়িটাও ফলো করতে করতে এসে থেমেছে তাদের থেকে কিছুটা দূরে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হলেও চাঁদের আলোয় সবটা পরিষ্কার। কানে বিঁধছে ঝিঁঝি পোকার চিঁ চিঁ ডাক। এসব কিছুকে ছাপিয়ে হঠাৎ গাড়ির ভেতর থেকে লাউডস্পিকারে গান বেজে উঠল,
“Kab Too Aayega Itna Bata De
Mujhko Bula Le Ya Apna Pata De
Tere Liye Baithee Hu Palke Bichhake
Aana Hai Toh Aaja Mujhe Le Ja Udake
Challa Challa Challa Challa, Challa Challa Challa
Aana Hai Toh Aaja Mujhe Le Ja Udake
Mahee Mahee Mahee Mainu Challa Pawan De
Khich Meree Photo Te Batwe Jala De
Mahee Mahee Mahee Mainu Challa Pawan De.”

এর পরপর দুটো গাড়ি থেকে দুটো ছেলে নেমে গানের সাথে তালে তাল মিলিয়ে উড়াধুরা নাচতে শুরু করল। কোনোদিকে তাকানোর নামগন্ধও নেই তাদের, একমানে নাচতেই আছে। কেন নাচছে? কি কারণে নাচছে কে জানে!এদিকে তাদের নাচ দেখে পেছনের গাড়িতে থাকা ছেলেগুলো
হতবাক। তাদের মধ্যে রুবেল নামের ছেলেটাকে গুঁতিয়ে আরেকজন
বলল,
-‘কি রে ভাই হেরা নাচে ক্যান? ওগোরে না বুইন কিডন্যাপ হইছে?’
-‘বুইন টুইন রাখ শালা। ওরা কেরা আগে এডি দ্যাখ?’
-‘ভাই, এডি তো সায়ন।’
-‘সায়ন? হেরে না তোফাজ্জ্বল নজরে রাখছে তয় হেই এইহানে ক্যা?’
-‘কে জানি? আপনে যেহানে আমিও তো সেকানেই তাইলে আমি জানমু কেমনে?’
একথা শুনে আরেকজন আঁতকে উঠে বলল,

-‘ভাই? এইহানে তো সায়ন আর রুবাব তাইলে শুদ্ধ কই? বস না কইছে শুদ্ধকে নজরে রাখতে? আমরা এতক্ষণ এগোরে নজরে রাখছিলাম?’
এবার গাড়িতে থাকা প্রত্যেকের হুঁশ ফিরল। তারা গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে কাছে গিয়ে দেখল সত্যি সত্যি সায়ন আর রুবাব। এদিকে দুজনে সমান তালে নাচতেই আছে। এতগুলো ছেলে দেখে সায়ন নাচতে নাচতে বলল,
-‘এ্যাই কে রে তোরা? ডাকাত টাকাত নাকি? আমার আবার ডাকাতের সাথে নাচার খুবববব শখ। যাক আজ তাহলে শখটা পূরণ হয়েই যাবে।’
-‘ভাই আপনেরে নাচতেছেন ক্যান?’

-‘আরে ভাই আর বলিস না, হঠাৎ করে কোমরের রগ চড়াৎ করে উঠল। তারপর আর সোজা হতেও পারছি না চিৎ-কাতও হতে পারছি না। কিহ্ মুসিবত ভাব তো? পরে আমার ভাই বলল নাচানাচি করলে নাকি ঠিক হয়ে যাবে, তাই নাচতেছি। একা একা নাচতে কি আর ভালো লাগে? তাই ছোটো ভাইটাকে সঙ্গে নিয়ে নাচতেছি..তোরা যখন এসে গেছিস তোরাও জয়েন কর। প্যারা নাই, এমনি এমনি নাচাব না আগে নেচে নি তারপর একসাথে গাঁজা টানব নে।’
সায়নের কথা শুনে ছেলে গুলো চোখ মুখ কুঁচকে পিছিয়ে গেল।

তারপর দৌড়ে গাড়িতে উঠে চলে গেল শুদ্ধকে খুঁজতে। কারণ শুরু যদি চট্টগ্রাম পৌঁছেও যায় তাহলে তাদেরও বেঁচে থাকার মেয়াদ শেষ। কারণ ইয়াসির পইপই করে বলে দিয়েছিল কড়া নজরদারি করতে। কিন্তু কোন ফাঁকে শুদ্ধ বেরিয়ে গেছে বুঝে উঠতেই পারল না তারা। সায়ন আর রুবাবকে দেখে এখন স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। তাদের হেলেদুলে নাচা দেখে মনে হচ্ছে নেশা করেছে। এখন এই নেশাখোরদের সঙ্গে মাতলামি করে সময় কাটানোর মানেই হয় না। অথচ তারা যদি আর একবার ঘুরে তাকাতোও তাহলে দেখতে পেতো, কিভাবে সায়ন আর রুবাব ক্ষীপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সায়নের ফোনে কল এলো। দ্রুত কলটা রিসিভ করতেই শুনতে পেলো সিঁতারার কান্নাস্বর। শখের বলা কথা সায়নকে জানালেন সিঁতারা। সব শুনে সায়ন বলল,
-‘থাক, মরা মানুষের নামে ক্ষোভ পুষে রেখো না আম্মু, বাদ দাও এসব।’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫০

ছেলের কথা শুনে সিঁতারা প্রচন্ড অবাক হলেন। বিষ্ময়ভরা কন্ঠে বলল,
-‘মরা মানুষ মানে? কার কথা বলছি বুঝিস নি বাবা? আমি আহনাফ….. ওই আহনাফের কথা বলছি।’
-‘আমিও।’
-‘আহনাফ মারা গেছে? কবে?’
-‘ওই যেদিন ওর যমদূত ওর পাপকর্ম সম্পর্কে জেনেছে।’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫২

1 COMMENT

  1. আপু আপনার লেখা কিন্তু দারুণ আমি আপনার রেগুলার পাঠক আর এটা আমার ফাস্ট কমেন্ট আপু আপনি সত্যি খুব ভালো লেখেন আপনার লেখা গল্পটা আমার পড়া পল্পের মধ্যে বেস্ট যে কয়েকটি গল্প আছে তার মধ্যে অন্যতম আপনার এই “”শেষ চৈত্রের গ্রাণ”” গল্পটি আপু আমি আপনার কাছে ছোটোবোন হিসেবে ছোট্ট একটি রিকুয়েষ্ট করছি গল্পগুলো তাড়াতাড়ি দিবেন আসলে আমার কোনো বড় আপু নেই একজন ছিল নাম আলো ছিল আমাকে খুব অদর করতো আপুর কাছে কোনো কিছু চাইলে দিয়ে দিতো আমার কিছু কিছু সৃতি মনে আছে আপনার কাছে অনুরোধ আপনি আমার বড় আপুর মতো আপনি আমাকে পাগল ভাবলে ভাবতে পারেন আসলে আমি এরকমই আলো নামের কাউকে পেলেই বড়আপু বানাই আসলে আমার আপু আমাকে রেখে না ফেরার দেশে চলে গেছে।।।।।।

Comments are closed.