তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ২১
মুন্নি আক্তার প্রিয়া
রায়ান ভাই অনুর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। কণ্ঠস্বর গম্ভীর রেখে বলল,
“ঘরে যা।”
অনু হতাশ হয়ে তাকিয়ে আছে। সে বলল,
“আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।”
“আমি আর ভুল, সঠিক কোনো কিছুই বুঝতে চাই না, অনু। তোর যা ইচ্ছে হয় তুই করতে পারিস।”
অনু নির্বাক। রায়ান ভাই বলল,
“যা এখন।”
অনুর অভিমান হলো ফের। সে যেচে এসে রাগ ভাঙাতে চাইল, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চাইল অথচ রায়ান ভাই তাকে কোনো সুযোগই দিল না। তাকে বিশ্বাস করল না। ঠিক আছে, থাকুক সে তার জেদ নিয়ে। অনুও আর আসবে না তার রাগ ভাঙাতে।
“দাঁড়িয়ে আছিস কেন এখনো? যা!” ধমক দিয়ে বলল রায়ান ভাই।
অনু ভয়ে চমকে উঠল ধমক খেয়ে। চোখ দুটো ছলছল করছে তার। অপমানে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে গেল রুম থেকে। বাইরে অপেক্ষা করছিল শাপলা। সেও পিছু পিছু এলো। কিছু কথা কানে এসেছিল অবশ্য। বিশেষ করে শেষের ধমকটা। রায়ান ভাই কেন এভাবে ধমকালো?
শাপলা অনুর কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কী হয়েছে আপু?”
অনু খাটের ওপর বসে আছে। নিরবে পানি পড়ছে তার চোখ থেকে। সে হাতের উলটো পিঠে চোখ মুছে বলল,
“কাউকে ভালোবাসার মতো কষ্ট আর কিছুতে হয় না, শাপলা। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় তখন, যখন সেই ভালোবাসার মানুষটাই ভুল বোঝে, অবিশ্বাস করে।”
“ভাইয়া তোমার কথা বিশ্বাস করেনি?”
“বিশ্বাস করার প্রয়োজনই মনে করেনি। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে।”
শাপলা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“থাক, যে বুঝতে চায় না তাকে আর বোঝাতে যেও না।”
বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। রুমে নীল রঙের ডিম লাইট। লিলিফুলের রুম স্প্রে ও ফুলের ঘ্রাণে পুরো রুম ভরে আছে। স্নিগ্ধা বসে আছে খাটের মাঝখানে। ফুলেদের রানি হয়ে। রিয়াদ গিয়েছে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে। কিছুক্ষণ বাদেই রিয়াদ রুমে এলো। স্নিগ্ধার বুক দুরুদুরু কাঁপছে। শরীরে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। কিছুটা ভয়ও লাগছে কেমন যেন। রিয়াদ এসে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসল। স্নিগ্ধার দিকে তাকায়নি একবারও। কিছুক্ষণ রুমে পিনপতন নিরবতা বজায় থাকার পর রিয়াদ নিজেই বলল,
“আপনি ফ্রেশ হবেন না?”
স্নিগ্ধা এতক্ষণ ধরে এই ভারি শাড়ি পরে আছে শুধুমাত্র রিয়াদের জন্য। সে মন ভরে দেখবে, প্রশংসা করবে। কিন্তু উলটো বলছে ফ্রেশ হওয়ার কথা! তাহলে এতক্ষণ কার জন্য সে সেজেগুজে বসে আছে সে? নিজেকে ধাতস্থ করে মিহি স্বরে স্নিগ্ধা বলল,
“আমি আগেই ফ্রেশ হয়ে নিয়েছি।”
“ওহ। তাহলে এখন ঘুমিয়ে পড়ুন। আপনি নিশ্চয়ই অনেক ক্লান্ত? সারাদিন তো অনেক ধকল গিয়েছে। এখন রেস্ট করুন।”
স্নিগ্ধা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। রিয়াদ পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। আর কোনো কথা বলল না। স্নিগ্ধার মায়া হলো। নিশ্চয়ই সে ক্লান্ত অনেক। তাছাড়া সত্যি বলতে স্নিগ্ধাও ক্লান্ত। ঘুমে দু-চোখ বুজে আসছে। তবুও ভেবেছিল আজকের সময়টা, আজকের রাতটা হয়তো একটু অন্যরকম কাটবে। রিয়াদের সাথে রাত জেগে গল্প করবে, মনের অনেক না বলা কথাগুলো বলবে। রাতশেষে রিয়াদের বুকে মাথা রেখে ঘুমাবে। কিন্তু! স্নিগ্ধা মৃদু হাসল। ব্যাপার না। সময় তো আর চলে যাচ্ছে না। এখন থেকে সে আর রিয়াদ তো একসাথেই থাকবে। প্রতিদিন এই মানুষটাকে দেখে সে ঘুমাবে আবার ঘুম থেকে উঠেও এই মানুষটার মুখই সে দেখবে। এরচেয়ে সুখ ও আনন্দের বিষয় আর কী-ই বা হতে পারে?
রিয়াদ অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে থাকলেও, স্নিগ্ধা রিয়াদের দিকে মুখ করেই শুয়েছে। খুব ইচ্ছে করছে রিয়াদকে জড়িয়ে ধরতে একটাবার। কিন্তু এটা সম্ভব নয়। লজ্জা বলতেও তো একটা কথা আছে। রিয়াদ নিজে থেকে না আগালে তো আর সে আগ বাড়িয়ে সাড়া দিতে পারবে না। ক্লান্তিতে স্নিগ্ধা শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। এদিকে রিয়াদের দুচোখে ঘুম নেই। সে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে চুপচাপ।
সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকেই অনু দেখল, বাড়ির সবাই ভীষণ ব্যস্ত। কারণ আজকে বউভাতের অনুষ্ঠান আছে ওদের বাড়িতে। রিয়াদ ভাইয়ার রুম থেকে বেশ হইচই এর আওয়াজ আসছে। অনু আর শাপলা গিয়ে দেখল, কাজিনরা সবাই স্নিগ্ধার সাথে গল্প করছে, হাসাহাসি করছে। অনুকে দেখে স্নিগ্ধা বলল,
“আরে অনু যে, এসো ভেতরে এসো।”
অনু ভেতরে গেল। স্নিগ্ধার পাশে বসে রুমে চোখ বুলাল একবার। স্নিগ্ধা বলল,
“ঘুম ভাঙল তাহলে?”
অনু মৃদু হাসল। জুঁই বলল,
“আর বলবেন না ভাবি! অনু যা ঘুমকাতুরে হয়েছে। খুব ঘুমায়। বাড়িতে অনুষ্ঠান বলে একটু তাড়াতাড়ি উঠল।”
অনু বলল,
“হয়েছে, তোমাকে আর আমার বদনাম করতে হবে না ভাবির কাছে।”
সবার গল্প-গুজবের মাঝেই ছোটো চাচি এলেন পার্লারের দুজন মেয়েকে নিয়ে। সবার উদ্দেশে বললেন,
“সবাই বের হ রুম থেকে। স্নিগ্ধাকে এখন সাজানো হবে। তোরাও গোসল করে ঝটপট তৈরি হয়ে নে যা।”
সবাই ছোটো চাচির কথামতো রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অনুবনিজের রুমে যাওয়ার সময় রায়ান ভাইও তার রুম থেকে বের হচ্ছিল, সেই সময়ে দুজনের দেখা হয়ে যায়। দুজনই একপলক তাকিয়ে দুজনের দৃষ্টি সরিয়ে নিল। যেন কেউই কারো অস্তিত্ব বুঝতে দিতে চাইছে না। বিষয়টা খুব সূক্ষ্মভাবেই ধরা দিয়েছে শাপলার চোখে।
আস্তে-ধীরে মেহমান আসতে শুরু করেছে। স্নিগ্ধাদের বাড়ি থেকে সবাই এসেছে। স্নিগ্ধকে দেখে অনু কিছুটা আড়াল হয়ে গেল। সে চাইছে না, স্নিগ্ধর সাথে তার কথাবার্তা আগাক। বিষয়টা স্নিগ্ধ ঠিকই খেয়াল করেছে। হঠাৎ করেই সে অনুর পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,
“এভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন?”
আচমকা স্নিগ্ধর উপস্থিতিতে অনু ভয় পেয়ে গিয়েছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“আশ্চর্য! পালাব কেন? আমি কি চোর নাকি?”
“হ্যাঁ, চোর-ই তো।”
পাশ থেকে শাপলা বলল,
“অনু আপু কী চুরি করেছে শুনি?”
স্নিগ্ধ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
“আমার মন।”
“রসিকতায় তো আপনি ১০০ তে ১০০।”
“ভালোবাসার ক্ষেত্রেও সেইম। তোমার অনু আপু তো বোঝে না।”
এসব কথাবার্তা অনুর ভালো লাগছিল না। তাই কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে বলল,
“ফাইজলামি বাদ দিয়ে খেতে বসুন যান।”
“জান? এখনই জান হয়ে গেলাম?”
“জান বলিনি, যান বলেছি। যেতে বলেছি। খেতে বসুন।”
“আপনিও আসুন।”
“না, আমি পরে খাব।”
“আপনাকে ছাড়া আমি কীভাবে খাব?”
অনু এবার রাগ লুকিয়ে রাখতে পারল না। মেজাজ দেখিয়ে চলে গেল স্নিগ্ধার কাছে। পাশে বসে ফিসফিস করে বলল,
“ভাবি, আপনার ভাই আমাকে অনেক জ্বালায়। আমার ভালো লাগে না।”
স্নিগ্ধা হেসে বলল,
“ভাইয়া এরকমই। একটু দুষ্টু। মজা করে। তুমি কিছু মনে কোরো না।”
অনু তবুও গাল ফুলিয়ে বসে রইল। স্নিগ্ধা জানে, তার ভাইয়া দুষ্টু। কিন্তু তারপরও কেন জানি মনে হচ্ছে, এই দুষ্টুমির আড়ালেও ভালোলাগা লুকিয়ে আছে। নয়তো স্নিগ্ধার ননোদ তো আরো আছে, সবাইকে রেখে সুযোগ পেলেই কেন শুধু অনুর পেছনে পড়ে থাকে স্নিগ্ধ?
অনু ভ্রু কুঁচকে, গাল ফুলিয়ে যখন বসে ছিল তখন রায়ান ভাই এসে উপস্থিত হয়েছে। তার সাথে রয়েছে আরো পাঁচ জন। তিন জন মেয়ে এবং দুজন ছেলে। রায়ান ভাই এসে স্নিগ্ধার সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিল। অন্তর, মাসুদ, শিলা, পিংকি এবং হিয়া। এরা সবাই রায়ান ভাইয়ের এক্স কলিগ। অর্থাৎ রায়ান ভাই আর উনারা ঢাকায় একই অফিসে কাজ করতেন। আজকে দাওয়াতে এসেছেন সবাই।
রিয়াদ ভাইয়ার সাথেও পরিচয় করিয়ে দিল। অথচ ওদের সাথেই অনু বসে ছিল। ওর সঙ্গে একবারও পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। এটা খুবই গায়ে লাগল অনুর। পরিচয় পর্ব সেড়ে রায়ান ভাই তাদেরকে নিয়ে খেতে বসেছে। অনু না চাইতেও তার চোখ বারবার ওদের দিকে চলে যাচ্ছিল। বিশেষ করে মেয়েগুলোকে পরখ করছে সে। হিয়া নামের মেয়েটা রায়ান ভাইয়ের পাশে বসেছে। মাঝে মাঝে হেসে আবার গায়েও গড়িয়ে পড়ছে। রায়ান ভাইও হাসছে। এটা কি স্বাভাবিক নাকি অনু একটু বেশিই ভাবছে?
রায়ান ভাই হিয়ার প্লেটে মাংস, সালাদ সার্ভ করে দিচ্ছিল। স্নিগ্ধ খাওয়া শেষ করে এসেছে তখন। এসেই বলল,
“চারজনে একটা ছবি তুলি।”
অনুর উঠে যাওয়ার উপায় নেই। একই তো অভদ্রতা দেখাবে, আর দ্বিতীয়ত স্নিগ্ধা ওর হাত ধরে বসে আছে। তাই না চাইতেও ছবি তুলতে হবে। সে মুখ গোমড়া করে বসে ছিল। স্নিগ্ধ বলল,
“আরে, হাসুন একটু।”
অনু জোরপূর্বক মেকি হাসি দিল।
হিয়া ওর প্লেট থেকে খাবার নিয়ে রায়ানের মুখের সামনে ধরে বলল,
“হা করো। খাবারটা এত মজা হয়েছে!”
রায়ান বিনয়ের সাথে বলল,
“সমস্যা নেই। তুমি খাও। আমি খাচ্ছি আমার প্লেট থেকে।”
“কেন? আমার হাতে খেলে কী হবে? ঘেন্না করো নাকি মান-সম্মান চলে যাবে?”
“এমন কিছুই না হিয়া। জাস্ট একটু আনইজি লাগে আরকি…”
কথা বলতে বলতে রায়ান স্টেজের দিকে তাকাল। স্নিগ্ধর সাথে হাসিমুখে ছবি তুলছে অনু। হিয়া মন খারাপ করে খাবার নামিয়ে নিতে গেলে রায়ান ওর হাত ধরে বলল,
“খাইয়ে দাও।”
হিয়া খুশি হয়ে রায়ানকে খাইয়ে দিল। ছবি তোলার মাঝেই দৃশ্যটি দেখতে পেল অনু। তার খারাপ লাগছে কিন্তু প্রকাশ করার ভাষা নেই। সেই সঙ্গে কাজ করছে প্রবল জেদও। রায়ান ভাই কি ওর ওপর প্রতিশোধ নিল? অনু স্নিগ্ধর হাতে খেয়েছিল বলে?
স্নিগ্ধ অনুর উদ্দেশে বলল,
“আপনার সাথে কি একা একটা ছবি তুলতে পারি?”
অনু তখন রায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। রায়ানও ওর দিকে তাকাল। দুজনের চোখে-মুখেই রাগের বহ্নিশিখা দাউদাউ করে জ্বলছে। অনু দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“অবশ্যই।”
তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ২০
এরপর সে স্নিগ্ধর সাথে একা হাসিমুখে ছবি তুলতে লাগল। স্নিগ্ধ ওর ফোনটা স্নিগ্ধার কাছে দিয়ে বলল,
“শুধু বউ সেজে বসে থাকলে হবে? আমাদের একটা ছবি তুলে দে।”
স্নিগ্ধা হাসিমুখে ওদের ছবি তুলে দিতে লাগল। ছবি তোলা শেষে হাসিও মুখ থেকে উধাও হয়ে গেল অনুর। কেবল সেই কাজলকালো চোখদুটিতে রয়েছে জেদ এবং জেদ। একইসাথে অপরপাশের যুবকটির চোখেও সেই একই জেদ ও রাগের স্ফুলিঙ্গ জ্বলছিল।