ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫১+৫২

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫১+৫২
তাজরীন ফাতিহা

এই মুহূর্তে নিশাত পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখার ভঙ্গি করে সামনে তাকিয়ে আছে। সামনে মারওয়ান ঘুম ঘুম ফোলা চেহারায় দরজা ধরে দাঁড়িয়ে। নিশাতের বিষয়টা এখনো মাথায় ঢুকছে না। যেই লোকের সঙ্গে একটু আগে কথা হলো, কফি খাওয়া হলো, হেঁটে আসা হলো সেই লোক এত দ্রুত বাসায় পৌঁছায় কী করে? নাকি কোনোভাবে ঢপ দিচ্ছে তাকে। কেন যেন মনে হচ্ছে সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে চিনতে এখনো অনেক বাকি তার। মারওয়ানের কপাল বিরক্তিতে গোটানো। নিশাত হতবম্বতা কাটিয়ে বলল,

“আপনি এখানে? এত দ্রুত?”
মারওয়ান রাগী গলায় বলল,
“আশ্চর্য লুঙ্গি ছেড়ে কথা বলো। দরজা খোলার সাথে সাথে এমন উজবুকের মতো লুঙ্গি চেপে ধরেছ কেন? এক ফ্ল্যাট মানুষের সামনে বেইজ্জত করতে?”
নিশাত বিব্রত হয়ে লুঙ্গি ছেড়ে দিল। আসলে এতই অবাক হয়েছে যে সামনে কী ধরেছে সেটা খেয়াল করেনি। বিস্ময়ে কিছু চেপে ধরেছ তবে সেটা লুঙ্গি ছিল বুঝতে পারেনি। মারওয়ান নিজের লুঙ্গি ছাড়া পেতেই রুমে চলে গেল। নিশাত উত্তেজিত হয়ে গেট বন্ধ করে কিনে আনা জিনিসপত্র রেখে মারওয়ানের পিছু পিছু প্রশ্ন করতে করতে এলো। মারওয়ান ঠোঁটের উপর আঙুল দিয়ে ‘হিশশশ্’ শব্দ করে নিশাতকে চুপ করিয়ে দিল। নিশাত থেমে গিয়ে খাটে তাকিয়ে দেখল নাহওয়ান ঘুমিয়ে আছে। সে ব্যাগ মারওয়ানের হাতে দিয়ে পা টিপে টিপে বিছানার কাছে গিয়ে নুয়ে ঘুমন্ত ছেলের ফুলো ফুলো গালে চুমু খেল। ইশ বাচ্চাটার টেনশনে তার মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন চোখের সামনে দেখে মারাত্মক শান্তি পাচ্ছে। ধীর স্বরে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আমার মানিক, আমার আব্বাটা।”
নাহওয়ান নড়েচড়ে উঠল। ইতোমধ্যে মারওয়ান নিশাতের ব্যাগ ঢিল দিয়ে টেবিলের উপরে ফেলেছে। মহিলার মাথায় বিরাট গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে নাহয় তার কাছে ব্যাগ দেয় কোন বুঝে আল্লাহ জানে? সে নিশাতকে উঠিয়ে চোখ রাঙিয়ে আস্তে করে বলল,
“মাথার তার কী ছিঁড়ে গেছে? আমার ছাওয়ের ঘুম ভাঙলে তোমার খবর করব লিলিপুট।”
নিশাত জিভে কামড় দিয়ে মারওয়ানের হাত শক্ত করে ধরে পাশের রুমে নিয়ে এলো। উত্তেজিত গলায় বলল,
“আপনি একটু আগে বাইরে গিয়েছিলেন তাই না?”
“তোমার মাথায় আসলেই গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। একবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করো এখন আবার জিজ্ঞেস করছ। আসলে তোমার সমস্যাটা কী বলো?”
“খবরদার নাটক করবেন না। নাটকে আপনি খুবই পটু জানি তবে নিজ চোখে দেখা ঘটনাকে অবিশ্বাস করার প্রশ্নই আসেনা।”
মারওয়ান ভ্রু কুঁচকে বলল,

“কী নাটক করলাম?”
নিশাত বোরকা, নিকাব খুলে হা করে শ্বাস নিচ্ছে। খোঁপা করা চুলগুলো ঘামে ভিজে গেছে। বিছানায় বসে খোঁপা খুলে ফ্যানের বাতাসে সেগুলো শুকাতে দিল। অস্থির লাগছে। সামনের পুরুষটিকে রহস্যময় মনে হচ্ছে। নিশাত এতদিন সংসার করেও সেই রহস্য ধরতে পারেনি। কোনরকম নিশ্বাস টেনে বলল,
“আমি আপনার সঙ্গে কফি খেলাম, একটু হাঁটলাম তারপর আপনি রিক্সায় তুলে দিলেন। তারমানে আপনি আমাকে তাক লাগিয়ে দেয়ার জন্য আগে আগে কোনোভাবে পৌঁছে গেছেন। আচ্ছা, আমি তো অবাক হয়েই গেছি তাহলে এখন এমন অভিনয় করছেন কেন?”
মারওয়ান নিজের ঘুম পরিপূর্ণ না হওয়ায় বেজায় বিরক্ত তার উপর নিশাতের এসব কথাবার্তা অসহ্য লাগছে।

“আমি বাইরে গেলে তোমাকে জানাতাম না?”
নিশাত ওড়নায় ঘাড়, গলা মুছে ফ্যানের দিকে মুখ উঁচিয়ে বলল,
“আপনাকে আমি এক বিন্দুও বিশ্বাস করিনা। আপনার মতো ছলনা এই পৃথিবীতে আর কেউ করেনি আমার সাথে। যে পুরুষ এতটা বছর তার কর্মের কথা গোপন রাখতে পারে তাও আবার এত বড় পদের তার দ্বারা সব সম্ভব। লিসেন, আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা ভুলেও করবেন না। আমি ফৌজিয়া নিশাত ভাব দেখাই বলদ বলদ আদতে কিন্তু আমি আপনার চেয়েও বেশি বুদ্ধি নিয়ে চলি। তাই একবার ঘোল খাওয়াতে পারলেও দ্বিতীয়বার সেই সুযোগ আপনি পাবেন না মিস্টার হাফ টাইম ভবঘুরে অ্যান্ড হাফ টাইম অফিসার।”
মারওয়ান বুকে দুই হাত গুঁজে বলল,

“বাহ্, তুমি এখনো এখানে কী করো? তোমার তো আইনের পেশায় যোগ দেয়ার কথা। কি বুদ্ধী, ভাবা যায়! তোমার বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না মিসেস লিলিপুট উইথ ব্রেইন।”
নিশাতের নিজেকে আসলেই বুদ্ধিমতি মনে হলো। মারওয়ান আজাদের চাল একেবারে মাঠে মেরেছে। বোকা লোক। ভেবেছে এবারও তার সঙ্গে গেইম খেলে পার পেয়ে যাবে। তার মতো স্বয়ং দেখতে লোকটা মারওয়ান আজাদ ছাড়া আর কেইবা হবে। মারওয়ান বলল,
“জেনেই যেহেতু গিয়েছ এবার কি আমি ঘুমাতে যেতে পারি মিসেস বুদ্ধিমতি?”
নিশাত মনে মনে বলল, লোকটা বুঝল কি করে আমি নিজেকে বুদ্ধিমতি ভাবছি? সে মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“অবশ্যই। তবে যাওয়ার আগে বলে যান এতক্ষণ নাটক করছিলেন কেন?”
মারওয়ান হামি দিয়ে বলল,

“তুমি আসলে আমার যোগ্য বউ কিনা সেটা একটু বাজিয়ে দেখলাম।”
নিশাত কৌতূহলী হয়ে বলল,
“বাজিয়ে কী পেলেন?”
“ঢোল, তবলা।”
“মজা করবেন না। আমি সিরিয়াস।”
“তো আমি কি আনসিরিয়াস?”
নিশাত দাঁড়িয়ে বলল,
“আপনার কথাবার্তায় তো সেটাই প্রকাশ পাচ্ছে।”
মারওয়ান নিশাতের দিকে তীর্যক দৃষ্টি ফেলে বলল,
“তাই?”
“ইয়েস।”

মারওয়ান আচমকা ঘুমে ঢুলু ঢুলু করতে করতে নিশাতকে সরিয়ে বিছানায় ঢলে পড়ল। নিশাত ভ্যাবাচেকা খেয়ে জোরে বলল,
“কি হলো আপনার?”
মারওয়ান উবু হয়ে মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল,
“উম, ডোন্ট শাউট।”
নিশাত বেক্কলের মতো তাকিয়ে বলল,
“নেশা টেশা করেছে নাকি?”
তারপর ফোঁস করে দম ছেড়ে বলল,
“এনাকে বোঝা আমার কর্ম নয়।”

একটা জটিল সমীকরণে দাঁড়িয়ে চিঠিটা লিখছি। ব্যাপারটা হলো, আজকে একটা অঘটন ঘটেছে। অঘটন ঘটিয়েছে সেলিমের দল। তার দায়ভার পড়েছে আমার উপর। এখন কি করব ঝটপট একটা সলিউশন দে। মাথা কাজ করছে নারে। সম্ভবত মাথার এন্টেনা গুলো এদিক ওদিক হয়ে গেছে। ঘটনা সংক্ষেপে বলি। আমাকে তিনদিনের সময় দিয়েছে এমন একটা জিনিসের নাম বলতে যার শুরু নেই কিন্তু শেষ আছে। আমি অনেক ঘেটেও কোনো সদুত্তর পাইনি। ভাই এটা কেমন প্রশ্ন? প্রথমে সহজ ভেবে সেলিমের বাচ্চায় ওদের ফাঁদে পা দিয়েছে। এখন দেখি প্রশ্নের আগামাথা নেই। আচ্ছা নম্বর ওয়ান, ওরা আমাদের ঘোল খাওয়াতে ভুলভাল প্রশ্ন করেনি তো? ভাই এইটার উত্তর যদি পরশুর মধ্যে না দিতে পারি আমি শেষ। পুরো কলেজের সামনে মুরগি হতে চাইনা। কিছু একটা কর ভাই? আমাকে উদ্ধার কর নম্বর ওয়ান।

পত্রত্তোর:
হাব,
লিখতে বিরক্ত লাগছে তবুও তোর জন্য এই মাঝরাতে নিজের আরামের ঘুম বাদ দিয়ে লিখতে হচ্ছে। যাইহোক বেশি প্যানপ্যানানিতে যাব না। এনার্জি নেই। তোর প্রশ্নটা আসলে তোর মতোই তারছিড়া। এর কোনো ভিত্তি জাগতিকভাবে নেই। এই পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যার শুরুই নেই কিন্তু শেষ আছে। তবে গণিতের কিছু টার্মে এমন প্রতিবন্ধী প্রশ্নের উত্তর থাকলেও থাকতে পারে। যেহেতু গণিত একটা প্রতিবন্ধী সাবজেক্ট সেহেতু এমন প্রশ্নের উত্তর তার কাছে থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না। চল ব্যাটাকে একটু ঘেঁটে দেখি,
বাস্তব সংখ্যার অন্তরাল (Real Number Intervals) নামে একটা বিষয় আছে যেটা সেট থিওরি এবং ম্যাথম্যাটিকাল ফাংশন অ্যান্ড লিমিটসের অন্তর্ভুক্ত। সেখানে Beginningless but finite এর একটা ধারণা পাওয়া যায়। যেমন,
(-∞, 1] এটি বামে অসীম পর্যন্ত যায় (শুরু নেই), কিন্তু ডানে ১ এ এসে থামে (শেষ আছে)।
আবার সংখ্যাতত্ত্ব শাখার পূর্ণসংখ্যার সেটেও Beginningless but finite এর বিষয়টা লক্ষ্য করা যায়। যেমন,
{…, -3, -2, -1, 0} এখানে কোনো প্রথম সংখ্যা নেই (শুরু নেই), কিন্তু 0 হলো শেষ বা সর্বোচ্চ উপাদান।
যদিও আপাত দৃষ্টিতে এসবের শুরু শেষ দুটোই আছে তবে গাণিতিক ভাষায় এর শুরু নেই কিন্তু শেষ আছে বলে ব্যাখ্যা করা যায়।
ইতি

পুনশ্চ: নিজের নাম লিখতে আলসেমি লাগছে। শোন উত্তর শুনে তোর প্রতিপক্ষ ছাগলটার রিয়েকশন কি হয় বলিস তো। এই ধরনের ভিত্তিহীন প্রশ্ন করার দায়ে গাধাটাকে জেলে ঢুকিয়ে দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। আমি হান্ড্রেট পার্সেন্ট শিওর গাধাটা আন্দাজে প্রশ্নটা করেছে। এর উত্তর ওর কাছেও নেই।
পড়া শেষ হতেই ইহাব ফিক করে হেঁসে দিল। আসলেই রাজিব গাধাটার কাছে প্রশ্নের উত্তর ছিল না। উল্টো তার উত্তর শুনে মুখটা একেবারে দেখার মতো হয়েছিল। ইহাব যে এই আগামাথাহীন প্রশ্নের উত্তরও নিয়ে আসবে সে বোঝেনি। ইহাবের উত্তর হয়নি, এই সেই বলে চেঁচিয়ে পুরো কলেজ একত্র করে ফেলেছিল। পরে গণিত শিক্ষক কার্তিক সাহা স্যারের বদৌলতে এই উত্তর সঠিক জানানো হয়। কলেজের মাঠে সকলের সামনে কান ধরে উঠবস করানো হয় রাজিব ও তার দলবলকে। এর একটা ছবি মারওয়ানকে ফিরতি চিঠিতে পাঠিয়েছিল সে।

চিঠির কাগজটা একেবারে নেতিয়ে গেছে। মারওয়ানের চিঠি লেখার ধরনটা ভিন্ন। চিঠির শুরুতেই ইহাবের প্রশ্নের অংশটুকুর ফটোকপি লাগিয়ে তারপর নিজের চিঠি লিখত। এখানেও মেইন অংশটুকু ফটোকপি করে কেটে আঠা দিয়ে লাগানো। এই নেতিয়ে পড়া কাগজটা কতবার যে পড়া হয়েছে হিসেব ছাড়া। ইহাব বেশ যত্ন করে রেখেছে চিঠিগুলো। সন্তাহে একদিন হলেও এগুলো পড়ে সে। তখন দারুন আনন্দ অনুভূত হয়। এই চিঠিটা কলেজ লাইফের। তার কলেজ, ভার্সিটি সবই ঢাকায়। কিন্তু মারওয়ানের ভার্সিটি ঢাকায় হলেও তার কলেজ লাইফ কেটেছে গ্রামে। কলেজ জীবনের দুই বছর ছিল তাদের বন্ধুত্বের ক্ষুদ্র বিচ্ছেদ। সেই সময় কত যে পাগলামি করা হয়েছে কল্পনাতীত। মোবাইল থাকা শর্তেও কাগজে চিঠি আদান প্রদানে এক আলাদাই মজা ছিল। অবশ্য এটা ইহাবের জোরাজুরিতেই বাস্তবায়িত হয়েছিল। মারওয়ান এসব ঢংয়ে নিমরাজি ছিল। তার কাছে এগুলো ঝামেলা বৈ আর কিছু মনে হতো না। তবে ইহাব কোনো না কোনোভাবে ঠিকই রাজি করিয়ে ফেলত।

মারওয়ানকে নম্বর ওয়ান বলার পিছনেও একটা ঘটনা আছে। তুখোড় ব্রেইন ছিল মারওয়ানের। যেসব জটিল প্রশ্নের উত্তর ক্লাসের কেউ দিতে পারত না সেসব প্রশ্নের উত্তর মারওয়ান খুব সহজেই দিয়ে ফেলত। তারপর তার নামের শেষে ওয়ান থাকায় ইহাব একদিন ফট করে নম্বর ওয়ান ডেকে ফেলেছিল। সেই থেকেই বন্ধুদের মাঝে, ক্লাসে, টিচারদের মুখে মুখে নম্বর ওয়ান নামটার চর্চাই বেশি হতো। মারওয়ান প্রচুর বই পড়ত। দেশি, বিদেশি বিভিন্ন লেখকদের অসংখ্য বই তার কালেকশনে ছিল। এসব অবশ্য পিতা মাহাবুব আলম থেকেই রপ্ত করেছিল সে। তার শ্বশুর মাহাবুব আলম এক কালে শিক্ষকতা করতেন।

অনেক মেধাবী হওয়া শর্তেও মারওয়ান কখনো মেধা তালিকায় প্রথম হতো না। প্রথম হওয়া তো দূরের বিষয় দশের মধ্যেই রোল থাকত না তার। টিচাররা তাকে ব্যঙ্গ করে আইনস্টাইনের বংশধর ডাকত। কারণ আইনস্টাইনের মাথাও তুখোড় ছিল তবে পড়ালেখায় ডাব্বা মারত। মারওয়ানের এসব গায়ে লাগত না। যখন এসএসসি ও এইচএসসি তে পুরো চট্টগ্রাম বোর্ডে ৫ম এবং ১০ম হয়েছিল টিচার থেকে স্টুডেন্ট সকলের মুখ একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেসময়ে সকলের কাছে মারওয়ান আজাদ ওরফে নম্বর ওয়ান চাঁদপুরের গর্ব হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল।

তবে সেও যে একেবারে খারাপ স্টুডেন্ট ছিল তা না কিন্তু মারওয়ানের মতো অতটা মেধাবী বলা যায়না তাকে। সে পরিশ্রমী ছিল। এইচএসসিতে বেশ ভালো গ্রেড পয়েন্ট পেয়ে ঢাকা বোর্ডে ৫৪তম হয়েছিল। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া সেবার মারাত্মক ক্ষেপা ক্ষেপেছিলেন। মারওয়ান গ্রামে পড়ে এত ভালো রেজাল্ট করতে পারলে সে ঢাকার সুনামধন্য নামকরা কলেজে পড়ে কোন মহৎ কার্য সাধন করেছে? এ নিয়ে প্রায়ই খোঁটা শুনতে হতো তাকে। আচ্ছা কোনোভাবে মারওয়ানের এই সাফল্যকে কি ইহাব হিংসা করত? অচেতনে কি মারওয়ানের উপর অসন্তুষ্ট ছিল সে? কেন তাদের এত চমৎকার বন্ধুত্বে ফাটল ধরেছিল? ওই ঘটনা কেন ঘটেছিল? ইহাব কিসে প্রভাবিত হয়ে বন্ধুত্বের এমন শক্ত গাঁটছড়া একেবারে ছিঁড়ে ফেলেছিল?

নাসির উদ্দিন আজ মাহাবুব আলমের বাড়িতে এসেছেন। মাহদি দু’হাত ভর্তিবাজার করে এনেছে। গেট দিয়ে ঢোকার সময় নাসির উদ্দিন ডেকে উঠলেন,
“এই টাউটের ভাই এদিকে আসো।”
মাহদি থতমত খেয়ে বলল,
“জ্বি আমাকে বলছেন?”
নাসির উদ্দিন নিজেই এগিয়ে এসে বললেন,
“এই অত্র গ্রামে তোমার ভাইয়ের মতো টাউট আর একটাও আছে?”
মাহদি প্রত্যুত্তর না করে ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আসলে কি উত্তর দেয়া যায় তা মিলাতে পারছে না। নাসির উদ্দিন মুখ শক্ত করে বললেন,

“কথা বলো না কেন?”
“ইয়ে মানে হ্যাঁ মানে না।”
নাসির উদ্দিন টুথপিক দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বললেন,
“তাহলে বলো টাউটের ভাই কে?”
মাহদি মাথা নামিয়ে বলল,
“জ্বি আমি।”
“তোমার পরিবারের সবাই ভালো তবে টাউটটা ছাড়া। কথা ঠিক না ভেজাল আছে?”
“না ভেজাল নেই।”
“ভেজাল যে নাই সেটা আমি জানি। কথা হলো গিয়ে তোমার আব্বা তোমার মতো ভালো ছেলেরে বিয়ে না দিয়ে ওই টাউটটাকে বিয়ে দিল কোন বুঝে বলতে পারবে?”
মাহদি ঘাড় নাড়িয়ে বলল,
“জ্বি না, বলতে পারব না।”
নাসির উদ্দিন উদাসীন কণ্ঠে বললেন,
“বলতে না পারা ভালো। তোমার বড় ভাই কথা কম বলে তবে টাউট এটাই সমস্যা। তার কারণে তোমাদেরও বদনাম হচ্ছে।”

মাহদি অনেকক্ষণ ধরে একটা কথা বলবে বলবে করে উশখুশ করছে। নাসির উদ্দিন বললেন,
“কিছু বলবে?”
মাহদি গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“জ্বি টাউট মানে তো যারা ধাপ্পাবাজি করে, দালালি করে। কিন্তু আমার ভাইয়া তো টাউটের কাতারে পড়ে না। একটু কাজ করেনা এই যা। এমনিতে তো কারো সঙ্গে কখনো টাউটগিরি করেনি।”
নাসির উদ্দিন বাজখাঁই গলায় বললেন,
“তোমার ভাই ধাপ্পাবাজি করেনি? সবচেয়ে বড় ধাপ্পাবাজি তো আমার মেয়ের সাথেই করেছে। আমার মেয়েটার জীবন রসারসা করেও বলছ টাউটগিরি করেনি? আমার মেয়েকে ভুলভাল বলে বিয়ে করেছে এটা কি টাইউটারি নয়?”
মাহদি আস্তে করে বলল,

“জ্বি।”
“জ্বি বলে আবার ভাইয়ের পক্ষে পল্টি মারো কেন?”
“জ্বি আর মারব না।”
“ঠিক আছে, যাও। মাহাবুবের সাথে কথা বলে তোমার একটা ইয়ের ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখি।”
“জ্বি?”
“এত জ্বি জ্বি করছ কেন? ইয়ে মানে বোঝো না? ইয়ে মানে বিয়ে।”
মাহদি গলা খাঁকারি সালাম দিয়ে দ্রুত প্রস্থান করল। নাসির উদ্দিন মাহদির যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলল,
“ছেলেটার আদব, লেহাজ আছে। খুবই ভালো ছেলে।”
তারপর গলা শক্ত করে বললেন,
“টাউটটার থেকে কোটি কোটি গুণ ভালো।”

কিলার জাদ একটু পর পর সাইফারের দিকে চেয়ে নির্লজ্জ হাসি দিচ্ছে। আজারাক সাইফার চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসা। কিলার জাদ ওরফে আমজাদ পাঠান জেলের চার দেয়ালে আয়েশ করে বসেছে। একটু আগে সাইফার তাকে বসিয়ে হাত, পা বেঁধে দিয়েছে। আজারাক সাইফার চেয়ার টেনে কিলার জাদের মুখোমুখি হলো।
“তোর খোঁজ নিতে তোর আব্বা তো আসলো না? চুক চুক চুক, ভেরি স্যাড।”
কিলার জাদ বেহায়ার মতো হাসতে হাসতে বলল,
“আসবেও না। আমার মতো চুনোপুঁটি ধরে রাঘব বোয়ালের স্বাদ পেতে চাস?”
সাইফার গ্লাভস পড়তে পড়তে বলল,
“মাঝে মধ্যে চুনোপুঁটি টেস্ট করা উচিত। সবসময় রাঘব বোয়াল ধরতে ভালো লাগেনা।”
কিলার জাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“কী করতে চাস।”
সাইফার বাঁকা হেঁসে কোট থেকে ম্যাচলাইট বের করে জ্বালিয়ে ছুরি গরম করতে লাগল। আমজাদ পাঠান ঢোক গিললো। ছুরির মাথা লাল লেলিহান শিখার মতো না জ্বলা পর্যন্ত গরম তাপ দিতে লাগল। সেঁক দেয়া শেষে কিলার জাদের দিকে চাইল। তার হাত, পা উভয়ই বাঁধা। সাইফারকে বাজের মতো তাকাতে দেখে ঢোক গিলে খুব কষ্টে পিছু হটে বলল,
“উল্টাপাল্টা কিছু করবি না বলে রাখলাম।”
সাইফার ঘাড় কাত করে জ্বলন্ত দৃষ্টি ফেলে হিমকরা এক হাসি দিয়ে তার পায়ে গেঁথে দিল উত্তপ্ত ছুরিটি। অমনি আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে এক ভয়ঙ্কর চিৎকারে কেঁপে উঠল জেলখানা।
“আশ্চর্য চিল্লাছিস কেন?”

সাইফারের বজ্রকণ্ঠে কিলার জাদ বাস্তবে এলো। সামনে তাকিয়ে দেখল সাইফার সেই ভয়ানক দৃষ্টি ফেলে তার পানে চেয়ে আছে। হাতে সেই জ্বলন্ত ছুরি। সে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল পা ঠিকই আছে। অর্থাৎ এতক্ষণ সে কল্পনা করছিল এসব। সাইফারকে ছুরি গরম করতে দেখে বলল,
“এটা দিয়ে কী করবি?”
সাইফার কথা বলল না। ছুরি গরম শেষে প্লাস্টিকের বোতল কাটল। সেগুলো কেটে নিজের কোট থেকে গ্লু বের করে কিলার জাদের বসার পিছনের দেয়ালে লাগিয়ে দিল। চোখা অংশ পিঠ বরাবর দিল। এখন আর দেয়ালে হেলান দিতে পারবে না হারামীটা। ওর আরাম করে দেয়ালে হেলান দেয়া এবার বের হয়ে যাবে। ভেবেই সাইফারের পৈচাশিক আনন্দ হলো। কিলার জাদ বুঝতে না পেরে বলল,

“কী করতে চাচ্ছিস তুই? ওহ্, মা!”
হেলান দিতে গিয়ে বোতলের ধারালো চোখা অংশ লেগে গেঞ্জি ফেড়ে পিঠ কেটে গেছে তার। পিঠে তীব্র জ্বলন হচ্ছে। সাইফার ছক্কা মারার ভঙ্গি করে বলল,
“একটুপর পুলিশ এসে যেসব প্রশ্ন করবে তার উত্তর যেন সঠিক এবং দ্রুত দিস তারজন্য আমার তরফ থেকে ছোট্ট একটা উপহার।”
বলেই সাইফার চলে যেতে নিলে আমজাদ চিল্লিয়ে বলল,
“তুই এমন করতে পারিস না। তুই পুলিশ নস যে এসব শাস্তি আমাকে দিবি? জেলে এমন করার কোনো নিয়ম নেই। এর শাস্তি শীগ্রই পাবি বলে রাখলাম। বিপদ আসবে দেখিস, কঠিন বিপদ।”
সাইফার আর পিছনে না তাকিয়ে বেরিয়ে গেল। সে পুলিশদের সাথে কথা বলেই এই ব্যবস্থা নিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলেই ওগুলো খুলে ফেলা হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত হাত, পা বাঁধা অবস্থায় একটু প্লাস্টিকের থ্যারাপি খাক।

মারওয়ান কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে। নিশাত এই রাতের বেলা ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে। নাহওয়ান পুরো ঘর ময়লা করে ফেলেছে। বাসায় বাচ্চাকাচ্চা থাকলে ঘর সবসময় নোংরা হয়। নাহওয়ান বাবার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘর ঝাড়ু দিতে দিতেই নিশাত একটা ঘড়ি পেল। যেটা নিচে পড়ে কাঁচ ফেটে গেছে। উঠিয়ে দেখল ছেলেদের ঘড়ি। মারওয়ানের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“এই এটা না আপনাকে মানহা দিয়েছে? কাঁচ ভাঙলেন কী করে?”
মারওয়ান কপাল থেকে হাত সরিয়ে চোখ মেলে কিছুক্ষণ ঘড়িটার দিকে চেয়ে বলল,
“ফেলে দাও। এসব কাঁচে নাহওয়ানের হাত কাটতে পারে।”
নিশাত অবাক হয়ে বলল,

“কি সুন্দর ঘড়িটা! বেশ দামী মনে হচ্ছে। ফেলে দেব কেন? আপনার বোন কত শখ করে দিয়েছে ও শুনলে ভীষণ কষ্ট পাবে। একদিনও পড়েননি এটা।”
মারওয়ানের বিরক্তকর গলা,
“এটা মানহা দেয়নি। এত আদিখ্যেতা দেখানোর কিছু নেই।”
“মানহা দেয়নি তো কে দিয়েছে? আমার সামনেই তো ও দিল।”
“ওর জামাই ওকে দিয়ে দেইয়েছে। এত দামী ঘড়ি মানহা পাবে কই?”
নিশাত এবার বুঝল কেন এত অনিহা এই ঘড়ির প্রতি। পুরো কাঁচ ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেছে। এভাবে ভাঙলো কিভাবে? মনে হচ্ছে ঘড়িটাকে কেউ আছাড় মেরেছে। এটাকে বাসায়ও রাখা যাবে না। নাহওয়ান সব জিনিসে হাত দেয়। ভীষণ খারাপ লাগছে তার। রেখে দিলে পরে মারওয়ান চিল্লাচিল্লি করবে। কি করবে বুঝতে পারছে না সে। মারওয়ান নিশাতকে এমন দোটানা করতে দেখে বিছানা থেকে উঠে এসে ঘড়িটা নিয়ে দরজার পাশের ঝুড়িতে ফেলে দিল। অমনি দরজায় করাঘাত পড়ল। মারওয়ান বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই ইহাবকে দেখতে পেল। এত রাতে ইহাবকে দেখতে পেয়ে বেশ বিরক্ত হলো। চোখ মুখ কুঁচকে বলল,

“কী চাই?”
ইহাব মারওয়ানকে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“একটু বসতে দিন শ্লা ব্রো। দরজা খুলেই মুখের উপর কী চাই বলা শুরু করেছেন কেন?”
মারওয়ান কপাল গুটিয়ে দরজা আটকে বলল,
“এত রাতে এখানে কী কাজ তোর? সময়ে অসময়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করে এখানে আসিস কেন? তোর মন চাইলো আর চলে আসলি? ম্যানার্স নেই কোনো? বাড়িতে মহিলা মানুষ আছে জানিস না?”
ইহাব একটু ধাক্কার মতো খেল। মারওয়ানের সব কথা হাসিমুখে হজম করলেও আজকের কথাটা কেমন বুকে গিয়ে লাগল। বেশ বিব্রত হলো। মিষ্টির প্যাকেট আর ঝুড়িটা মারওয়ানের দিকে ধরে বলল,
“নাহওয়ানের জন্য মিষ্টি আর বিড়ালের বাচ্চা এনেছিলাম। মানহা বলল ওকে দিতে।”
মারওয়ান চিল্লিয়ে বলল,

“বিড়ালের বাচ্চা দিতে এত রাতে তোকে আসতে হবে কেন? আর ইউ ক্রেজি?”
ইহাব মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলল,
“তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? আমি তো থাকতে আসিনি শুধু এগুলো দিতে এসেছি।”
“জাস্ট শাট আপ। তোর কাছে কেউ বিড়ালের বাচ্চা চায়নি। ফারদার যদি রাতের বেলা এসব নিয়ে আর আসিস আমার থেকে খারাপ কেউ হবেনা।”
বলেই মিষ্টির প্যাকেট ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। ঝুড়িটা অন্য হাতে ছিল বিধায় সেটা অক্ষত আছে। নিশাত পর্দার ফাঁকে মারওয়ানের এমন পাষাণ কার্যক্রম দেখে বেশ কষ্ট পেল। এসব শুনলে মানহা কি মনে করবে? বড় ভাইয়ের থেকে ওর জামাইয়ের এমন অপমান মেয়েটা কিভাবে মেনে নেবে?
ইহাব বহু কষ্টে ঝুড়িটা রেখে বাসা থেকে বের হতে নিলে দরজার পাশে ময়লার ঝুড়ির ভেতরে তার দেয়া ঘড়িটা দেখল। বুকে অজস্র ব্যথা কিলবিল করছে। মারওয়ানের দিকে একবার তাকিয়ে সেই ভাঙা রিস্ট ওয়াচটা হাতে তুলে বলল,

“তোর হাতে অনেক মানাতো। বিদেশ থেকে অনেক খুঁজে তোর জন্য কিনেছিলাম। এতটা অবহেলা না করলেও পারতি।”
মারওয়ান মুখের উপর বলল,
“এসব জিনিস দিয়ে আমাকে গলাতে এসেছিস? হাহ্! তোর এসব ন্যাকামি অন্য জায়গায় দেখাস প্লিজ। এসবে আমার যায় আসেনা।”
ইহাব মুখটা একটু প্রসারিত করে বলল,
“একটুও যায় আসেনি?”
মারওয়ান হেঁসে বলল,
“যেখানে তোর থাকা না থাকায়ই কিছু যায় আসেনা সেখানে সামান্য ঘড়িতে আমার কী যায় আসবে?”
ইহাব খুবই কাতর গলায় বলল,

“একবার হাব বলে ডাকবি?”
“অমাবস্যায় চাঁদ খুঁজতে থাক।”
ইহাব একটু মুচকি হেঁসে বলল,
“খুঁজলে পেতেও পারি। ভালো থাকিস।”
“ওটা তুই না বললেও থাকব।”
ইহাব কিছু না বলে চলে গেল। মারওয়ান দরজা আটকে দিল। যত্তসব! নিশাত বেরিয়ে এসে বলল,
“আপনি এমন বিহেভ করলেন কেন?”
“আমার ইচ্ছা।”
“আপনার ইচ্ছা হলেই তো হবেনা। সে এখন আপনার বোন জামাই।”
“তো এখন কি কোলে উঠিয়ে নাচতাম।”

“আশ্চর্য কোলে উঠিয়ে নাচবেন কেন? তাকে অ্যাপায়ন করবেন, থাকতে বলবেন তা না করে এ কি ব্যবহার? মিষ্টির প্যাকেটটা অমন ফেলে দিলেন কেন? এতে আপনার বোনের অপমান হলো না? আপনার বোন যখন জিজ্ঞেস করবে ভাইয়া আপনাকে কী খাইয়েছে তখন?”
মারওয়ান গম্ভীর গলায় বলল,
“তোমাকে এত ভাবতে কে বলেছে? যা খেয়েছে সেটাই বলবে।”
“কী খেয়েছে?”
“অপমান।”
নিশাত চোখ মুখ লাল করে বলল,
“আপনি আসলেই একটা পাষাণ। হৃদয় বলতে আপনার কিচ্ছু নেই। আগাগোড়া একটা পাথর আপনি।”

সকাল সকাল নাহওয়ান রান্নাঘরের ফ্লোরে হাত পা ছড়িয়ে বিড়ালের বাচ্চা নিয়ে খেলছে। ঘুম থেকে উঠে বিড়ালের বাচ্চা দেখে বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল সে। ইহাব তার জন্য বিড়ালের বাচ্চা এনেছে শুনে সে বেশ খুশি হয়েছে। নাহওয়ান বিড়াল ছানাটাকে টিপ দিয়ে ধরে বলল,
“মা, বিল্লু চুমু পুপা এনেচে।”
নিশাত রাঁধতে রাঁধতে মাথা নাড়ালো। ইহাব নাহওয়ানকে চুমুর থ্যারাপি দেয়ার পর থেকে বাচ্চাটা তার নাম চুমু পুপা রেখেছে।
“নলম নলম।”
নিশাত মুচকি হেঁসে বলল,

“জ্বি আব্বা নরম। আপনি এভাবে টিপ দিয়ে ধরেছেন কেন? ব্যথা পাবে তো?”
নাহওয়ান গোলগোল চোখে তাকিয়ে বলল,
“বেতা পাবে?”
“হুম। তোমাকে জোরে ধরলে যেমন ব্যথা পাও সেও তেমন পায়। তুমি আমার ছানা আর সে বিড়াল ছানা। দুটোই নরম তুলতুলে আদুরে ছানা।”
নাহওয়ান ফোকলা হেঁসে একবার নিজের দিকে আরেকবার বিড়ালের দিকে আঙুল তাক করে বলল,
“মায়েল চানা, বিল্লু চানা।”
মারওয়ান লুঙ্গি ধরে রান্নাঘরে এসে বলল,

“হ্যাঁ তুই তোর মায়ের ছানা আর আমি তো দুধভাত।”
নাহওয়ান মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল,
“ডুড ভাট মুজা, মুজা।”
মারওয়ান ঝাড়ি মেরে বলল,
“চুপ কর। তোর দুধভাতের মজা আজকে বের করব দাড়া।”
নাহওয়ান ‘উলি বাবা’ বলে মায়ের পা ধরে মুখ লুকালো। মারওয়ান ওকে ধরতে নিলে পকেটে ফোন ভাইব্রেট হতে লাগল। মানহার নম্বর দেখে পরে কথা বলবে ভেবে ফোন কেটে দিল। এরকম দুইবার কল কেটে দেয়ার পর আবারও কল আসায় নিশাত বিরক্ত হয়ে বলল,

“ফোনটা ধরতে সমস্যা কোথায়?”
মারওয়ান রাগান্বিত হয়ে ফোন কানে নিয়ে মানহাকে ধমক দিতে নিলে তার কান্নার আওয়াজে কান ভারী হয়ে এল। মানহা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ভাইয়া আমি কী বিধবা হয়ে যাব?”
মারওয়ান ঢোক গিলে বলল,
“কী বলছিস? জোরে বল শুনতে পারছি না।”
মানহা হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,
“উনি নাকি এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি। প্রচুর ব্লিন্ডিং হয়েছে, বাঁচার সম্ভাবনা নাকি নেই। আমরা পথে। তুমি আসো ভাইয়া। ঢাকা সেন্ট্রাল মেডিকেলে আসো। আমি কিচ্ছু জানি না। আল্লাহ!”
মানহার চিৎকারে ফোন কেটে গেল। মারওয়ানের কানের কাছে কি যেন ঝিরঝির করছে। মনে হচ্ছে, অসংখ্য বোলতা হাল ফুটিয়ে দিচ্ছে। নিশাত মারওয়ানকে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে?”

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫০

মারওয়ান এই জগতে নেই। কোনো কথা তার কানে প্রবেশ করছে না। নিশাত দেখল মারওয়ানের শরীর কাঁপছে। পা দুটো টলমল করছে। নিশাত দ্রুত ঝাঁকিয়ে বলল,
“এই আপনার কী হয়েছে? আম্মা, আব্বা ওনারা ভালো আছেন?”
মারওয়ান ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে বিড়বিড় করল,
“এসব মিথ্যা, সবই মিথ্যা। হাব…”

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫৩

1 COMMENT

Comments are closed.