শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫৩
নূরজাহান আক্তার আলো
-‘প্রয়োজনে শুদ্ধকে মেরে দেবো তবুও তোমাকে আমি ছাড়ছি না বাবুই পাখি। একদমই ছাড়ছি না!’
একথা শুনে শীতলের হাসির বেগ যেন দ্বিগুন বাড়াল। সে হাসতে হাসতে
জবাব দিলো,
-‘আমি ততক্ষণ পর্যন্ত বোকা যতক্ষণ আমার আপনজনরা সুস্থ, নয়তো আমি কিন্তু চৌধুরীদেরই রক্ত! কি যেন বললেন, আমার বিশুদ্ধ পুরুষকে মারবেন? মারা তো দূর, শুধু হাত বাড়িয়ে দেখুন হাতটা হাতের জায়গায় রাখি কী না!’
-‘বয়স কত তোমার? সিক্সটিন, সেভেনটিন অর এইটটিন?’
-‘বয়স যতই হোক ফিডার খাওয়ার বয়স অন্তত পেরিয়ে এসেছি।’
-‘আমার তোতাপাখি এত কথা বলে জানতাম না তো?’
-‘প্যারা নিয়েন না ফিরে যাওয়ার আগে আরো অনেক কিছু জানবেন।’
-‘ফিরতে দিলে তো।’
-‘আমি ফিরবোই! বাবা-মায়ের চিন্তা আমি করি না কারণ আমার বোন
সব সামলে নেবে। কিন্তু ওই যে একজন মুডি পুরুষ আছে না? তার জন্য হলেও আমাকে ফিরতে হবে।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-‘জানো আমার একটা বন্ধু ছিল। তাকে আমি খুব বিশ্বাস করতাম। খুব ভালোবাসতাম। সেও আমাকে ভীষণ ভালোবাসত। একদিন করল কী; আমাকে ডেকে হুমকি দিলো তাকে আমার ব্যবসার শেয়ার দিতে হবে। নয়তো সে নাকি সব ফাঁস করে দেবে। আমিও রাজি হয়ে তাকে বাসায় ডাকলাম। দু’জন ব্রান্ডের ওয়াইন পান করে ঘুমিয়ে গেলাম। তারপর কী হলো জানো বাবুই? সকালবেলা আমি ঘুম থেকে উঠলাম ঠিকই কিন্তু সে আর উঠলই না। কত করে ডাকলাম আমার ডাক শুনলোই না। প্রশান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে ভেবে আমিও বিরক্ত না করে চলে গেলাম সুদূর নিউইয়র্ক।
এক সপ্তাহ পর ফিরে দেখি সে তার বাড়ি চলে গেছে। টানা চারদিন নাকি মরার মতো ঘুমিয়েছে। ঘুমানোই স্বাভাবিক ওয়াইনের সাথে সেদিন কড়া ডোজের ঘুমের মেডিসিন মিশিয়েছিলাম কী না! হয়তো সেও বুঝেছিল।
এরপর খবর এলো আমার গোপন কিছু ডিলের কথা পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছে। বন্ধুরা দুষ্টুমি করবে স্বাভাবিক তাই না? দুষ্টামি ভেবে মাফ করে দিলাম। এরপর দেখি আবার আমার কাজে বাঁধা হচ্ছে সে, পরে ভুলিয়ে ভালিয়ে আমার ডেরায় আনলাম। কত সুন্দর করে বোঝালাম এসব না করতে। কিন্তু সে আমার কথা শুনলোই না। পরে যত্ন করে তাকে বালির
মধ্যে গলা অবধি বালিতে পুঁতে শিরোচ্ছেদ করলাম। চমৎকার হয়েছিল ওর শিরোচ্ছেদ করা। শিরোচ্ছেদ কি বুঝো তো বাবুই?’
-‘হুম।’
-‘বলো তো কি?’
-‘মাথা কেটে ফেলা।’
-‘আরে বাহ্, তুমি তো দেখি খুব ইন্টেলিজেন্ট গার্ল।’
-‘কিন্তু এই ঘটনা আমাকে কেন শোনালেন? আমরা তো কেউ আপনার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় নি। বরং আপনিই শুরু থেকে আমাদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। চৌধুরী বাড়ির অশান্তির কারণ হয়েছেন।তাহলে আমাদের উচিত না আপনার নিয়ম অনুযায়ী আপনাকেও বালিতে পুঁতে শিরোচ্ছেদ করা?’
-‘ভদ্র মেয়েরা এভাবে কথা বলে না বাবুই এবার কিন্তু রাগ হচ্ছে আমার।’
-‘রাগ হচ্ছে? ওমা কেন? আচ্ছা রাগ কমানোর মলম আবিষ্কার হয়েছে?
হয় নি, তাই না? আপনি নাকি সায়েন্টিস্ট একটা আবিষ্কার করে ফেলুন না, সমশের ভাই? সাধারণ জনগণের অনেক উপকার হবে কিন্তু। ধরেন, কেউ রেগে গেল ফট করে তার বাড়ির লোক রাগের মলম তার কপালে লাগিয়ে দিলো, ব্যস রাগ চলে গেল। কি দারুণ ব্যাপার তাই না?’
-‘ আমি কোনো সায়েন্টিস্ট না বাবুই আমি মাফিয়া। মাফিয়া কাকে বলে জানো?’
-‘জানি তো। এটাও জানি আপনি স্মাগলিং, অস্ত্র ব্যবসা, মানি লন্ডারিং এর কাজ করেন। বাংলাদেশে আপনার কয়েকটা সিক্রেট ডেনও আছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, সেসব জায়গার একটা জায়গায় আমরা এখন আছি।’
-‘ওহ লাভলি! ব্রাভো বাবুই, ব্রাভো! আর কি জানো আমার ব্যাপারে?’
-‘আর? আর..আর ওহ হ্যাঁ মনে পড়েছে আপনার প্রিয় খাবার নারীদেহ।
সুন্দরী নারী খুব যত্ন করে খান আপনি। দোয়া করি, আপনার সঙ্গী যেন ঠিক আপনার মতোই হয়। সেও যেন হাজার জনের বিছানা ঘুরে এসে আপনার সঙ্গের সঙ্গী হতে পারে।’
ইয়াসির হাসল। তবে হাসতে হাসতে শক্ত হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে এমন একটা থাপ্পড় দিলো শীতলের ঠোঁটের সাথে দাঁত লেগে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এলো। আচমকা আক্রমণে প্রতিরোধ করার সময়টুকুও পেল না শীতল। তবে নোনতা ভাব অনুভব করে বুঝল ঠোঁট কেটেছে, জিহবাটাও কেটেছে। সে কাটা ঠোঁট চেপে ধরে হাসল। আবার প্রমাণ হলো পৃথিবীতে হাজার হাজার সুদর্শন পুরুষ থাকলেও শুদ্ধর মতো কেউই হতে পারবে না। কেউ তার অহেতুক বকবক শুনবে না। রাগও দেখবে না। অভিমানও বুঝবে না। যেমন ইয়াসির তাকে এখানে আনার পর থেকেই কত আদুরে সুরে কথা বলে যাচ্ছিল। ডাকের কী বাহার! বা..বাবুই! কিন্তু একপর্যায়ে হাল ছেড়ে তো ঠিকই তাকে রক্তাক্ত করল। এক নিমিষেই আদর শেষ।
তবে তাকে দূর্বল ভেবে কাজটা করলেও শীতলও যে চৌধুরীদের জাত এটা ভুললে চলবে না। সে ওড়নায় দিয়ে রক্ত মুছে বলল,
-‘ মারলেন কেন?’
-‘ইচ্ছে হলো তাই।’
-‘ইচ্ছে হলে মারতে হবে? আমি আমার বাবার হালাল কামাই খেয়ে বড় হয়েছি আপনার মতো মাফিয়ার হারাম টাকা নয়। তাহলে আপনি কেন রক্তাক্ত করলেন?’
একথা বলে শীতল তড়িৎ কাঁটা চামচ তুলে ইয়াসির হাতে গেঁথে দেওয়ার আগে ইয়াসির খপ করে হাতটা ধরে নিলো। বিদ্যুৎ গতিতে ওর পুরুষালি শক্তপোক্ত শরীর দিয়ে শীতলকে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরল। শীতলের আর ক্ষমতা নেই নিজেকে ছুঁটানোর। এখন নড়তেও অক্ষম সে।
তার এই হাল দেখে ইয়াসির শব্দ করে হেসে উঠল। এইটুকু একটা বাচ্চা সে কি না তাকে আক্রমণ করতে আসছে, ভাবা যায়! ব্যাপারটা তার কাছে মজাই লাগল। তারপর সে একহাতের মুঠোয় শীতলেন দুহাত চেপে আরেকটা হাত দিয়ে শীতলের মুখের সামনে আসা চুলগুলো সরাল। লম্বা বিনুনিটা নেড়ে চেড়ে দেখল। এরপর বিনুনির আগা ধরে সেটা সাপের মতো করে টেনে এনে শীতলের গালে ঠেঁকিয়ে মুখ বলল, ‘ফুঁস!’ একাজ করে নিজে হো হো করে হেসে শীতলের মসৃন কাঁধে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িওয়ালা থুতনি ঠেঁকাল। এই পিচ্চির রাগও আছে? সে তো আলাভোলা ভেবেছিল। তবে মানতেই হয় এই মেয়েও চালাক, প্রচুর চালাক। সে আসলে বোকা সেজে থাকে। একথা ভেবে সে শীতলের রক্তাক্ত ঠোঁটে দৃষ্টি ফেলে বলল,
-‘কোথায় লেগেছে, দেখি?’
শীতল নিজেকে ছাড়ানোর বৃর্থা চেষ্টা করে রাগে হিসহিসিয়ে জবাব দিলো,
-‘ছাড়ুন। অসভ্যের মতো জড়াজড়ি না করে দূরে সরে ভদ্রভাবে কথা বলুন। অসহ্য লাগছে কিন্তু আমার। ছাড়তে বলেছি!’
-‘অসভ্য মানুষ অসভ্যতামি করবে এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?’
শীতল জবাব দিলো না ঘৃণার দৃষ্টি ছুঁড়ে অন্যদিকে তাকাল। রাগে শরীর রি রি করছে তার। এত সুদর্শন হয়ে কী লাভ যদি পারসোনালিটি ফিরো লেভেল পার করে! তখন ইয়াসির তার রক্তাক্ত ফোলা ঠোঁটে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,
-‘রাগ করলে সোনা? আচ্ছা সরি আর মারব না। বাড়ি যাবে? চলো দিয়ে আসি?’
একথা শুনে শীতলের ছটফটানি থেমে গেল, সে এবার অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল। ইয়াসিরের হাসি-হাসি মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করল সত্যি নাকি মজা। তাকে এভাবে তাকাতে দেখে ইয়াসির এবার নিষ্পাপ মুখে বলল,
-‘আমি ভ্যাম্পায়ার নই তবুও রক্তের তৃষ্ণা পাচ্ছে, কি করে বলো তো?’
-‘ এখন কি আমার হাত কেটে আপনাকে রক্ত গেলাতে বলছেন?’
-‘উহুম, সেসব কিছু করতে হবে না। শুধু একটা কাজ করবে তাহলেই বাড়ি যেতে পারবে, করবে?’
-‘হেয়ালি না করে বলুন নয়তো ছাড়ুন। আপনার পারফিউমের গন্ধে গা গুলাচ্ছে আমার।’
-‘আমি একপ্রকার জানোয়ার হলেও আমার রুচি সর্বদা হাই লেভেলের স্নো হোয়াইট। আমার পোশাক থেকে শুরু করে সব ব্রান্ডের। আর আমি
জানি আমার পারফিউমের সুগন্ধে তোমার পাগল পাগল লাগছে তাই একথা বলছো।’
-‘পাগল-পাগল না ছাঁই। আপনার পারফিউমের থেকে শুদ্ধ ভাইয়েরটা আরো বেশি জোশ। একদম খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। আসছে,,’আমার সবকিছু ব্যান্ডের।’
শেষের কথাটা তাচ্ছিল্য করে টেনে বলতেই ইয়াসির হাতের বাঁধন এতটা শক্ত করল যে শীতল ছটফটিয়ে উঠল। তবুও ইয়াসির ছাড়ল না। যখন কেঁদে ফেলল তখন ঠান্ডা সুরে বলল,
-‘ কেউ আমাকে ছোটো করতে চাইলে আমি তাকে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে ফেলি। যেন পরবর্তীতে একাজ করার সুযোগ না পায়। কিন্তু তুমি এসে অবধি বারবার এটাই করছো। আমার কিন্তু পছন্দ হচ্ছে না বাবুই পাখি। একদমই পছন্দ হচ্ছে না। আমাকে রাগিও না, রাগের ফল আমার জন্য তৃপ্তিদায়ক হলেও তোমার জন্য হবে না।’
শীতল এবার আর টু শব্দও করল না। কারণ সে ইয়াসিরের কথার মানে বুঝেছে। তাকে চুপ হতে দেখে ইয়াসির বলল,
-‘ যাবে বাড়ি? গেলে বিনিময়ে শুধু একটা কাজ করে দেখাও।’
শীতল মুখে জবাব দিলো না তবে চোখ তুলে তাকাল। তখন ইয়াসির আরেকটু গা ঘেঁষে কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
-‘বিনাবাঁধায় তোমার ঠোঁটের স্বাদ নিতে দাও। প্রমিস, ছেড়ে দেবো। ‘
একথা বলতে না বলতেই ইয়াসিরের হাতের ঘড়িটা পিক পিক শব্দ করে উঠল। সে ভ্রুঁ কুঁচকে আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে না পেয়ে সন্দেহের দৃষ্টি ছুঁড়ল শীতলের দিকে। ইয়াসির শীতলকে চেপে ধরলে শব্দটা যেন আরো জোরালো হচ্ছে। সে শীতলকে ছেড়ে দু’পা পিছিয়ে আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে বলল,
-‘তোমার কাছে কি লুকিয়ে রেখেছ বের করো বলছি। বাবুই রাগিও না আমাকে, তোমাকে বারবার আঘাত করতে খারাপ লাগবে আমার।’
শীতল তার কথা বুঝলেও গোঁ বেচারা মুখ করে তাকিয়ে রইল। তারপর নিজে নিজের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘খালি হাত-পা নিয়ে আপনিই তো আমাকে তুলে নিয়ে এসেছেন। আমি আবার কি লুকিয়ে রাখব? যাই হোক, আপনি কি আমার চোর বলতে চাচ্ছেন?’
ইয়াসির শীতলের কথার ফাঁদে পা দিলো না বরং ভূতগ্রস্তের মতো তার হাতটা টেনে শরীর চেক করতে লাগল। শীতল বাঁধা দিতে গেলেও শুনল না। একপর্যায়ে ইয়াসির কামিজে হাত দিতে গেলে হাতের ঘড়িটা আবার শব্দ করতে লাগল। ইয়াসির এবার তাকিয়ে দেখল হাতের রিং যতবার তার ঘড়িতে লাগছে ততবারই তার ঘড়িটা শব্দ করতে উঠেছে। সে রিং খুলতে গেলে শীতল কিছুতেই খুলতে দেবে না। এবার কেঁদে ফেলল সে। কত আকুতি-মিনুতি করল তবুও ইয়াসির ছাড়ল না। রিং খুলে চেক করে দেখে তার সন্দেহই সঠিক। রিং এ Gps কানেক্টে করা। তারমানে এখানে থাকা ঠিক হবে না। ধারণা মতে, এতক্ষণ কেউ তাদের লোকেশন ট্র্যাক করে ফেলেছে। সে এবার রাগের বশে শীতলকে আরেকটা থাপ্পড় মেরে হিসহিসিয়ে বলল,
-‘কি ভেবেছিলি আমাকে ফাঁকি দিবি? পরে দেখছি তোকে আগে এখান থেকে বের হই।’
একথা বলে শীতলের হাত ধরে টানতে টানতে তাকে বাইরে নিয়ে গেল।
যেতে যেতে এতক্ষণ লুকানো ফোনটা বের করে তার সহকারীকে বলল নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার জন্য। গাড়ি করে ইয়াসির এবার শীতলকে নিয়ে গেল আরেকটা ডেরায়। সেখান থেকে পাড়ি দেবে দেশের বাইরে।
এদিকে চারদিকে ফজরের আজান দিচ্ছে। শুদ্ধ আর হাসান জেট থেকে নেমে হেঁটে যাচ্ছিল চা বাগানের দিকে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে পুরনো চা বাগান আছে। লোকেশন আপাতত সেদিকেই শো করছে। হঠাৎ ট্র্যাক করা লোকশন আর শো ই করছে না। রিং যেখানে থাকবে লোকেশনটাও সেখানেই স্থির। কিন্তু গোল চিহ্নের লাল দাগ দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ রিং এর জিপিএস কেউ ডিসকানেক্ট করে দিয়েছে। ফোনের দিকে তাকিয়েই
হাঁটতে হাঁটতে শুদ্ধ এবার থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তার হার্টবিট যেন থমকে গেছে। শীতল জান থাকতে কখনোই রিং খুলবে না। তাহলে কি ধরা পড়ে গেল? নাকি ইয়াসির ধরে ধরেছে? তা নাহলে লোকেশন শো করছে না কেন? শুদ্ধকে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে হাসান ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
-‘ কি রে চল?’
শুদ্ধ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হাতে থাকা ফোনের দিকে। তবে কি সব শেষ? তার মুখ দেখে হাসানের ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে গেল। সে শুদ্ধর নজর অনুসরণ করে ফোনে উঁকি মারতেই দেখে লোকেশন শো করছে না। সে হতবাক হয়ে কিছু বলার আগে শুদ্ধ আকাশের দিকে তাকাল। চারদিকে তখনো ঘুটঘুটে গাঢ় অন্ধকার। দূরে কোনোমসজিদ থেকে আজান ভেসে আসছে। শুদ্ধর জানে না আজ তার কি হলো! বুকের ভেতরটা এ করছে কেন। মনটাই বা কু-ডাকছে কেন। চোখ বন্ধ করলেই শীতলের ব্যথাতুর, কান্নারত মুখখানা চোখের পাতায় ভাসছে কেন। সে শুকনো ঢোক গিলে পুনরায় আশপাশে তাকাল। তারপর জোরে জোরে শ্বাস টেনে বুকের বাঁ পাশে হাত রাখল। এখন অবধি কোনো পরিস্থিতি তাকে কাবু করে পারে নি। সে সর্বদা শান্ত, নিশ্চল। কিন্তু এখন কেন জানি অজানা একটা ভয়ে মনটা বড্ডব্যাকুল হয়ে উঠেছে। সে কিছু ভেবে আকাশের দিকে তাকাল।
তারপর থেমে থেমে শুধু এইটুকু উচ্চারণ করল,
-‘ইয়া আল্লাহ্, হয় ওকে সহি সালামতে পাইয়ে দাও নয়তো আমার মৃত্যুও এখানেই লিখে রেখো।’
একথা শুনে হাসান ছলছল চোখে তাকাল শুদ্ধর দিকে তারপর শুদ্ধর কাঁধে হাত রেখে বলল,
-‘কিচ্ছু হবে না বন্ধু, আল্লাহ ভরসা।’
শুদ্ধ নিশ্চুপ। পরপর ক’বার ঢোক গিলে পুনরায় তাকাল ফোনের দিকে।
না, কোনোভাবেই কাজ হচ্ছে না। ওদিকে অর্ক, কামরান নজর রাখছিল
ল্যাবে বসেই। কিন্তু লোকেশন শো না করায় তারাও অনবরত ফোনকল দিতে থাকল শুদ্ধকে। তারা সঙ্গে না এলেও বুঝেছে এখন শুদ্ধের মনের অবস্থা। কিন্তু শুদ্ধ কল রিসিভ করল না দেখে ওরা কল করল হাসানকে। হাসান কল রিসিভ করে জানাল সত্যি সত্যি লোকেশন ট্রেস করা যাচ্ছে না। একথা শুনে সবার চিন্তা বেড়ে গেল। হঠাৎ শুদ্ধ ভোরের আকাশের
দিকে তাকিয়ে মুখের কাছে হাত রেখে উচ্চশব্দে ডেকে উঠল,’ হেল্প মি
এঞ্জেলিকা! প্লিজ হেল্প!’ পরপর তিনবার ডাকতেই হঠাৎ’ই “কুঁ….কুঁকুঁ…” স্বরে সাড়া দিলো সাদা ধবধবে একটা পায়রা। পুরো শরীরই সাদা। এক কথায় চমৎকার তার রুপ! শুদ্ধর ডাক শুনেই চিলের মতো দূর আকাশ থেকে তাকে নিচে নেমে আসতে দেখা গেল। নিজের মালিক ডাকমাত্রই
সাড়া দিতে পেরে সে খুশিতে পাখা ঝাপটাতে-ঝাপটাতে একের পর এক
ডিগবাজি মারতে মারতে উড়ে এলে বসল শুদ্ধর বাড়িয়ে দেওয়া হাতের উপর। তারপর অনবরত ডাকতে থাকল,
“কুঁ… কুঁকুঁ…।”
শুদ্ধ তার মাথায় হাত বুলালে সে তালুতে মাথা রাখল। অর্থাৎ তার আরো আদর চায়। কিন্তু এখন হাতে একদমই সময় নেই। তাই শুদ্ধ তার মাথায় চুমু এঁকে ফোন থেকে শীতলের সুস্পষ্ট ছবি দেখাতেই এঞ্জেলিকা হঠাৎ
ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে গেল। উড়তে উড়তে একবার পেছনে ঘুরে তাকাল
শুদ্ধর দিকে। তারপর ডান দুটো ঝাপটে ধীরে ধীরে আরো উপরে উড়তে লাগল। একটুপরেই শুদ্ধর ফোনে পরপর নোটিফিকেশন আসতেই বুঝল
এঞ্জেলিকার কাছে থাকা ড্রোনে সব দেখা যাচ্ছে।ফজরের আজান পরও
অন্ধকার থাকায় আকাশ থেকে নিচের তেমন কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।
শুদ্ধ হাসানের দিকে তাকাতেই হাসান সম্মতি সূচক মাথা নাড়িয়ে হাসল কেবল। কারণ এঞ্জেলিকা থাকলে শুদ্ধ ঠিক পাবে শীতলের খোঁজ। আর
মালিকের মতোই জেদি এঞ্জেলিকা শীতলের খোঁজ না নিয়ে ফিরবে না।
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫২
নোটিফিকেশন যখন আসছেই দাঁড়ানোর সময় নেই তাই তারাও দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। জেট থেকে নেমেই স্যান্ডি গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল তাদের। ততক্ষণে সকালের নরম আলো ফুটতে শুরু করেছে।
এঞ্জেলিকার ড্রোনে দেখা যাচ্ছে সে কোনদিকে যাচ্ছে। যেতে যেতে দেখা গেল পুরনো এক বিল্ডিংয়ের উপরেই চক্রাকারে ঘুরছে। শুদ্ধ জুম করে
দেখল কেউ একজন কাউকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে ওই বিল্ডিংয়ের
ভেতর। এঞ্জেলিকাও দূর আকাশ থেকে মাটির দিকে ধীরে ধীরে নামছে। তারমানে সে নিশ্চয়ই শীতলকে দেখেছে!