শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫৪
নূরজাহান আক্তার আলো
_’ভালো হচ্ছে না কিন্তু ছাড়ুন বলছি, ছাড়ুন।’
_’এত সহজে না।’
একথা বলে শীতলের হাত ধরে টানতে টানতে ইয়াসির বাইরে বেরিয়ে এলো। সকালের ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। মাথার উপর স্বচ্ছ সুনীল আকাশ। দু’একটা কাক হেঁড়ে গলায় ডাকতে ডাকতে উড়ে যাচ্ছে নিজের গন্তব্যে। এখান থেকে কয়েক মিনিট হাঁটলে দেখা মিলবে একটি নদী। শান্ত নদী ছোটো ছোটো স্রোতে বয়ে নিয়ে চলেছে নিজস্ব নিয়মে। সম্ভবত এটা মেঘনা নদীরই শাখা। তবে জায়গাটা একেবারেই সুনশান।
এখান থেকে লোকালয় আরো অনেক দূরে। ইয়াসির শীতলের হাত ধরে
টেনে নিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। এবং শীতলের হাতটা ছেড়ে দিয়ে পেছনে ঘুরে মুচকি হাসল। ছাড়তে দেখে শীতল এবার বিষ্ময় নিয়ে তাকালে ইয়াসির বলল,
-‘আচ্ছা আমি ভিতুর মতো পালাচ্ছি কেন? ভয় পায় নাকি ওই শুদ্ধকে?
মোটেও না! তাহলে শুধু শুধু পালানোর মানেটা কি? উফ! বুঝলে বাবুই
তোমার বোকা হওয়ার রোগটা বোধহয় আমার উপরে ভর করেছে। তা নাহলে আমি ইয়াসির খান এমন করার তো কথা না।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-‘শুদ্ধ ভাই? কই শুদ্ধ ভাই?’
ব্যাকুল সুরে কথাটা বলে শীতল এদিক-ওদিক তাকাল। খুঁজতে লাগল অনেক আশা নিয়ে। কান্নাভেজা কন্ঠে ডাকতেই লাগল করুন সুরে। ওর এই ব্যাকুলতা সহ্য হলো না ইয়াসিরের। সে শীতলকে নিয়ে ফিরে যেতে
যেতে বলল,
-‘চলো ভেতরে গিয়ে অপেক্ষা করি? দেখি কখন আসে তোমার শুদ্ধ ভাই? আর আমিও রেডি হই তাকে স্পেশালভাবে স্বাগত জানানোর জন্য।’
ইয়াসিরকে পাল্টি খেতে দেখে শীতল বাকহারা হয়ে তাকিয়ে রইল শুধু।
ভয়ংকর কোনো পরিকল্পনা করছে সেটাও বুঝতে বাকি রইল না। ভয়ে দুরুদুরু বুকে আল্লাহকে ডাকতে লাগল সে। এতক্ষণ গাড়ি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে ইয়াসিরকে বের হতে না দেখে সেখানে বুরাকও উপস্থিত হলো। জলদি বের হওয়ার তাগাদা দিলো। কিন্তু ইয়াসির গোঁ ধরে রইল
সে কোথাও যাবে না। লুকোচুরি খেলা নয় এবার যা হবে সামনাসামনি।
এমন পরিস্থিতিতে ইয়াসিরের কথা শুনে বুরাক এক কোণে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল। টেনশনে দরদর করে ঘামছে সে। খুব ভালো করে বুঝতে পারছে তার জীবনের অন্তিম মুহূর্ত চলে এসেছে। পালাতে গেলে ইয়াসির তাকে শুঁট করবে; না পালালে শুদ্ধর হাতে মরতে হবে। মনে মনে এসব ভেবে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে সাইকো ইয়াসিরের কান্ডখানায় দেখতে লাগল।
এদিকে ইয়াসির শীতলকে সোফায় বসিয়ে খাবার এনে মুখোমুখি বসল।
টেনশনে চুপসে যাওয়া শীতলের দিকে খাবার এগিয়ে দিয়ে খেতে ইশারা করল। কিন্তু শীতল মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালে পুনরায় বলল,
-‘খাও।’
-‘গলা দিয়ে নামবে না।’
-‘পানি দিয়ে গিলো, তবুও খাও।’
-‘বলছি তো খাব না।’
-‘খাবে,,খেতে হবেই।’
একপর্যায়ে ইয়াসিরের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে শীতল মুখে খাবার নিল, তারপর কান্নাভেজা সুরে বলল,
-‘ছেড়ে দিন না আমাদের? কি ক্ষতি করেছি আমরা? কেন আমাদের পেছনে পড়েছেন আপনি? ‘
-‘আমার ব্যাপারে এতকিছু জানলে কিভাবে?’
-‘(…..)’
-‘কিছু জিজ্ঞাসা করছি? মুখ খোলো বাবুই। আমি তোমাকে ব্যাড টাচ্ করতে চাই না। আমার কাছে অহেতুক জেদ করে নিজের সর্বনাশ ডেকে এনো না।’
শীতল বুঝল মুখ না খুলে উপায় নেই তাই বলল,
-‘স্বর্ণ আপু আপনার ব্যাপারে অনেক কিছু জানে। সেগুলো নোট করে ফাইলে রেখেছিল। ফাইলটা একবার ধরতে গেলে আপু বারণ করেছিল। বারণ করা কাজ করতে ভালো লাগে আমার। কি এমন আছে যে ধরতে বারণ করল সেটা দেখতেই চুপিচুপি ফাইলটা নিয়ে পড়েছি। আর সায়ন ভাইয়া একদিন রেগে আপনাকে গালি দিচ্ছিল আপুকে ‘অগ্নিকন্যা’ নামে ডাকায়। সেটা শুনেছি। সেই ফাইলে আপনার আবছা ছবিও ছিল সেটা দেখে রেস্টুরেন্টে প্রথমে চিনতে পারি নি তবে পরে চিনতে পেরে আপুর ভয়ে আর কিছু বলি নি। কারণ আপু তখন মারাত্মক রেগেছিল।’
-‘তারমানে তোমার বোন আমাকে চিনতে পেরেছিল সেদিন?’
-‘হুম। পাবলিক প্লেসে সিনক্রিয়েট করবে না ভেবেই মূলত চুপ ছিল।’
-‘ আচ্ছা বাবুই, এখন যদি শুদ্ধ আসে চলে যাবে আমাকে ফেলে?’
-‘হুম।’
-‘ খারাপ লাগবে না?’
-‘না, কারণ আপনি আমাকে মেরেছেন। যারা আমাকে মারে, বকে তারা আমার শত্রু। শত্রুর কাছে থাকার ইচ্ছে নেই আমার।’
-‘আমি আদরও করতে পারি। করে দেখাই?’
-‘ (…)’
-‘ধরো শুদ্ধ এখানে এলো এসে তোমার সামনে দাঁড়াল। দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল। আমি শুঁট ফুঁট কিছুই করলাম না তাও মারা গেল। তখন পথ ক্লিয়ার তবুও তুমি আমার হবে না, বাবুই? একটু ভেবে বলো তো?
কেন জানি তোমার সাথে জোরাজুরি করতে ইচ্ছে করে না আমার। যদি করত তাহলে বসে থাকার অবস্থাতেই রাখতাম না তোমায়। জীবনে এই প্রথম কোনো মেয়ের সঙ্গে ভালো করে কথা বলার চেষ্টা করছি। তোমার জেদের কারণে তবুও মার খেলে। জেদ করে বড় বড় বুলি না আওড়ালে মার টা খেতে না পাখি।’
একথা বলে ইয়াসির প্রায়ই জোর করে ইয়াসির শীতলকে খাওয়াল। খুব কাঁদল তবুও একপ্রকার খাইয়েই ছাড়ল। খাওয়ানোর পর ফিচেল হেসে বলল,
-‘আপন জনের মৃত্যুতে কাঁদার জন্য হলেও শরীরে এনার্জি থাকা জরুরি। একটু খেলে এবার দেখবে মন ভরে কাঁদতে পারবে।’
একথা বলে ইয়াসির হাত ধুয়ে এসে বুরাককে বলল কী কী করতে হবে। সেই অনুযায়ী বুরাক কাজ করতে লাগল। এদিকে এঞ্জেলিকার দেখানো মানুষটা ভুল ছিল। একজন যুবক তার গর্ভবতী বউকে কোলে করে নিয়ে
যাচ্ছিল হাসপাতালের দিকে। দূর থেকে এঞ্জেলিকা সেই কাঙ্খিত মানুষ ভেবেছিল। কিন্তু যখন দেখল ভুল তখন আবার উড়তে লাগল। সংকেত পেয়ে হন্ন হয়ে খুঁজতে লাগল ডানা ঝাপটিয়ে ঝাপটিয়ে।
এদিকে চলন্ত গাড়িতে বসা শুদ্ধর ফোনে তখন আচমকা লোকেশন শো করল। অবাক হলেও আর অপেক্ষা করার সময় নেই। তখন ইয়াসিরের সিক্রেট ডোনে কাছেই ছিল তারা। এবার গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে খুব দ্রুত
সেখানে পৌঁছাল। বাকি বন্ধুদের এ্যালার্ট করল হাসান। শুদ্ধ গাড়ি থেকে নেমে এগোতে এগোতে কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তলটা হাতে নিতে ভুলল না। এটাতে সাইলেন্সার লাগানো এবং তার নিজের নামে লাইলেন্স করা।
তার ক্ষিপ্ত হাঁটার গতি আর থমথমে মুখ দেখে রাগের মাত্রা বুঝতে কষ্ট হলো না হাসানের। কিছু বললে যে হিতে বিপরীতও হবে তাও খুব ভালো করেই জানে সে। তবুও শুদ্ধর হাতটা টেনে ধরে থামাল। তারপর আমতা আমতা করে বলল,
-‘ভাই থাম। এত হাইপার হোস না, আমাদের মাথায় রাখতে হবে শীতল এখনো ওদের কাছে। একটা ভুল শীতলের বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না।’
-‘(….)’
-‘ যা করার সাবধানে করতে হবে আমাদের। মনে রাখতে হবে তীরে এসে তরী ডুবানো যাবে না।’
শুদ্ধ থমথমে মুখে চোয়াল শক্ত করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঢুকল বাড়িটার ভেতরে। কারো পায়ের পদধ্বনি শুনে ইয়াসির মুচকি হাসল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল হাত-মুখ বেঁধে মেঝেতে ফেলা রাখা শীতলের দিকে। শুদ্ধ পৌঁছে গেছে তার লোকরাও তাকে জানিয়েছে। তবুও ওর চোখে মুখে আতঙ্কের লেশ মাত্র নেই। শুধু একবার বুরাকের দিকে তাকালে বুরাক হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল। অর্থাৎ তার আদেশ মোতাবেক কাজ সম্পূর্ণ করা হয়েছে।
ঠিক তখনই সেখানে শুদ্ধ উপস্থিত হলো। গেট পেরিয়ে গটগটিয়ে ঢুকল।
শীতল এক বুক আশা নিয়ে এতক্ষণ দরজার দিকেই তাকিয়ে ছিল। তার বিশুদ্ধ পুরুষকে দেখে কান্নার বাঁধ ভাঙল। ইচ্ছে করল দৌড়ে গিয়ে বুকে লুকিয়ে পড়তে। কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না তাই অশ্রুভেজা চোখেতাকিয়ে রইল শুদ্ধর দিকে। হাত-মুখ বাঁধা শীতলকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে শুদ্ধর বুকে যেন ঢস নামল। সে এগোতেই শীতল বারবার মাথা নাড়াতে লাগল। গোঁ গোঁ শব্দ করে কাছে যেতে বারণ করল। হঠাৎ এমন করাতে
শুদ্ধ কিছু একটা আন্দাজ করে শান্ত চাহনিতে তাকাল ইয়াসিরের দিকে। টিগার চেপে পিস্তল তাক করতেই ইয়াসিরই বলল,
-‘কিরে থামলি কেন? বুকে পাঁটা থাকলে প্রাণ নিয়ে ফিরে যা।’
-‘ফিরব তো অবশ্যই তবে তোর হিসাব বরাবর করি।’
শুদ্ধ রক্তচক্ষূ নিয়ে তাকালে ইয়াসির দুই হাতে হাততালি দিয়ে হঠাৎ হো হো হাসল। শুদ্ধকে উস্কে দিতে আরো কিছু বলল। শুদ্ধ পুনরায় এগোতে গেলে শীতলের ছটফটানি বেড়ে গেল। অঝর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে সে অনবরত মাথা নাড়াতে লাগল। শুদ্ধ শুনল না বরং শীতলের কাছে যেতে
এগোতেই হাসান খেয়াল করল শুদ্ধর পায়ের কাছে কারেন্টের তার পড়ে আছে। বিনাকারণে তার ফেলে রাখবে কেন?
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫৩
এমন না যে কোনো কাজ চলছে। তার সন্দেহ হলে একটু এগিয়ে দেখল সত্যি সত্যি ওটা কারেন্টের
তার। হতে পারে এটা ইয়াসিরের আরেকটা চাল। হতে পারে তার দিয়েই
কোনো ফাঁদ পেতেছে। হাসানের ধারণা তখন সত্যি প্রমাণ হলো বুরাকের দিকে তাকিয়ে। ওই ছেলেটাও তাকিয়ে আছে শুদ্ধর পায়ের দিকে, শুদ্ধ কখন তারে পা পাড়িয়ে যাবে আর কারেন্টের শক খাবে। এমন শক যে বাপ ডাকারও সময় পাবে না। অতঃপর শীতলের চোখের সামনে মরবে শীতলের বিশুদ্ধ পুরুষ।
Next part