হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৭
তোয়া নিধী দোয়েল
সকাল থেকে জুবাইরার শরীর ভালো না। প্রেসার হাই হয়েছে। তাই, সে আজ তুর্কির সাথে কলেজে যেতে পারবে না। ফারুক কে কল দিয়ে বলেছে কাল আসবে। ঘুম থেকে দেরি করে উঠায় তুর্কি তাড়াহুড়া করে বাড়ি থেকে বের হয়। তারপর রিকশা করে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছায়। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
অনেক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা বাস আসে। তুর্কি বাসে উঠতে গেলে হেলপার তাকে বলে ‘আপা সিট নাই। আর ভাড়া কইলাম বিশ টাকায় দিতে হবে’।
তুর্কি হেলপারের কথা উপেক্ষা করে বাসে উঠে পরে। এরা এত পাজি কিছুতে-ই স্টুডেন্ট উঠাতে চায় না।
তুর্কি বাসে উঠে দেখে সত্যি বাসে কোনো সিট নেই। অনেক লোক-ই দাঁড়িয়ে আছে। হেলপার সবাই-কে পিছনে যেতে বলে৷ তুর্কি পিছাতে পিছাতে একদম বাসের শেষ প্রান্তে দাঁড়ায়। একটা সিটের উপরের অংশ ধরে দাঁড়ায়। সিটিটার মধ্যে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ঘুমাচ্ছে। তাঁর পাশে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী ও আছে। যার পরনে নীল শাড়ি। লোকটার কানে ইয়ারবারড। পরনে ক্যাজুয়াল নেভি ব্লু শার্ট। কপালের উপর কিছু চুল বাতাসের জন্য নাচ্ছে। চুল গুলোর মধ্যে দুই কি তিনটা সাদা চুল আছে। বুকের উপর দুই হাত ভাঁজ করা। ডান হাতে সিলভার রোলেক্স ঘড়ি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তুর্কি লোকটার সাদা চুল দেখে একটু হাসি পেলো। মুখ চেপে হাসি থামিয়ে লোকটার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জানালার দিকে নেয়। তুর্কির হাসি দেখে ওপাশে থাকা নারীটি ভ্রুকুঞ্চন করে তাকায় ওর দিকে। তারপর লোকটার ডানে হাতের বাহুর উপর মাথা ঠেকায়। তুর্কির আরো হাসি পায়। মনে মনে ভাবতে থাকে ❝এই বুড়ো লোকটার বউ হয়তো এটা। ইসস বেডি ভাবেছে তাঁর বুইড়া জামাইরে আমার ভালো লাগছে। কিন্তু, লোকটা জিতছে। এমন বুড়ো হয়ে ও এত সুন্দর একটা বউ পেয়েছে। বেডার কপাল খুব ভালো❞ ও ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের দিকে তাকাতে-ই বাস জোরে ব্রেক কষে। ঝোঁক সামলাতে না পেরে তুর্কির ডান হাত সিট থেকে খসে যায়। পেছন দিকে হেলে পড়ে যেতে-ই দ্রুত সিট টেনে ধরার জন্য উদ্যত হয়। কিন্তু, সিটের জায়গায় সিটে বসে থাকা লোকটার মাথার তালুর চুল টেনে ধরে, নিজেকে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচায়। লোকটা সজোরে চুলের টান খাওয়ায় চোখ মুখ কুঁচকে তাকায়। লোকটার পাশে থাকা নারীটি বলে উঠে,
-এই এই মেয়ে, চোখে দেখতে পাও না? চুল ছাড়ো।
তুর্কি লোকটার চুল ছেড়ে দেয়। নারীটি দ্রুত কণ্ঠে বলে,
-রাজ ব্যথা পাসনি তো? লোকটা কোনো উত্তর দেয় না। সে ভ্রু কুঁচকে তুর্কির দিকে তাকিয়ে আছে। তুর্কি এতক্ষণ চুপ ছিলো। কিন্তু, মুহুর্তে হওয়া ঘটনা ওকে খুব হাসাচ্ছে। অনুতাপ হওয়ার পরিবর্তে ও লোকটার অবস্থা দেখে হো হো করে হেসে উঠে। ব্যাপার টা কেমন হলো! সিট ধরতে গিয়ে বেচারার চুল গুলো-ই টেনে ধরেছে! তুর্কি কিছু-তেই হাসি থামাতে পারছে না। বাসে থাকা বাকি লোক তুর্কির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে; সঙ্গে নারীটি-ও। নারীটি কিছু বলার আগে-ই লোকটা হাতের ইশারায় থামিয়ে দেয়। তারপর কান থেকে ইয়ারবারড খুলে পকেটে রাখে। রাগী স্বরে ধমকে উঠে,
-স্টুপিট!
তুর্কি হাত দিয়ে মুখ চেপে হাসি থামিয়ে বলে,
-সরি আংকেল। সরি সরি।
পর-পরি হাসিতে ফেটে পরে। মুখে হাত দিয়ে হাসি থামানোর চেষ্টা করে। লোকটার পাশে থাকা নারীটি বলে,
-ম্যানারলেস। একে তো অন্যায় করেছো তার ওপর আবার এই ভাবে দাঁত বের করে হাসছো কেনো?
-সরি সরি আন্টি। আই এম রেলি সরি। আমি পড়ে যেতে গেছিলাম। সিট ধরতে গিয়ে ভুলবশতঃ কাজটি করে ফেলেছি। সরি সরি।
লোকটা বিরক্ত চোখে তুর্কির দিকে তাকায়। পাশ থেকে নারীটি বলে,
-ইটস ওকে, রাজ। কাম ডাউন। ছেড়ে দে বাচ্চা মানুষ।
লোকটা দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। এই সব ফালতু আন্নেসেসারী জিনিস দেখার সময় তাঁর কাছে এমনিতে-ও নেই। লোকটা আবারো সিটের সাথে হেলান দেয়। তুর্কি একটু পর-পর লোকটার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। লোকটার পাশে থাকা নারীটি একটু পর-পর চোখ গরম করে তাকাছে। কিন্তু, তুর্কির তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
হেল্পার ভাড়া নিতে আসলে তুর্কির সাথে এক প্রকার যুদ্ধ বেঁধে যায়। নরমাল ভাড়া বিশ টাকা। আর স্টুডেন্ট ভাড়া দশ টাকা। কিন্তু, হেল্পার কিছুতে-ই দশ টাকা নিবে না। আরও পাঁচ টাকা চাচ্ছে। তুর্কি আর হেল্পারের তর্কা-তর্কি শুনে সিটে বসে থাকা লোকটা আবারো বিরক্ত মুখে তাকায়। হেল্পারের দিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-আচ্ছা, ভাই থামুন এবার। যা দিয়েছে তাই রাখুন।
হেল্পার আর কোনো কথা না বাড়িয়ে দশটাকা নিয়ে-ই চলে যায়। সিটে বসে থাকা লোকটার আবারো চোখ বুঝে। তুর্কি তৃপ্তির হাসি হাসে। বাসে ভাড়া নিয়ে হেল্পার ঝামেলা করলে, যদি বড় কেউ পাশে থাকে তখন খুব আনন্দ হয়।
বাসে জায়গা না থাকা সত্ত্বেও হেল্পার আরও যাত্রী উঠাচ্ছে। এই নিয়ে বাসে দাঁড়িয়ে থাকা লোক গুলো এক নাগারে বকে যাচ্ছে। বেশি যাত্রী হওয়ার দরুন সবাই খুব নিকটে নিকটে দাঁড়িয়েছে। তুর্কির ব্যাগ বাম কাঁধে রাখা। দুই হাত দিয়ে বাসের সিট ধরে রেখেছে। ভিড়ের মধ্যে একটা হাত এসে তুর্কির ডান পাশের কোমড় স্পর্শ করে। আতকে উঠে ও। বাম পাশ থেকে ব্যাগ এনে বুকের মধ্যে রেখে জড়িয়ে ধরে। ঢোক গিলে আশে পাশে তাকায়। কিন্তু, যে হাত দিছে তাকে খুঁজে পায় না।
বাস একটু ব্রেক চাপতেই তুর্কি ভয়ে ভয়ে কাপা সিটের উপরে রাখে। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর সেই হাত টা আবারও এসে তুর্কির কোমড়ে হাত রেখে জোরে চাপ দিয়ে ছেড়ে দেয়। তুর্কি ভয়ে ❝ওমা
❞ বলে সিটে বসে থাকা সেই লোকটার চুল টেনে ধরে। লোকটা এই বার বেশ চটে যায়। সাথে নারীটি-ও। বার বার একই ভুল করায় লোকটা দাঁড়িয়ে চ্যাঁচিয়ে ওঠে।
-এই তোমার প্রব্লেম কি? এই রকম করছো কেনো?
তুর্কি যেনো কথাটা শুনেনি। ও আশে পাশে তাকিয়ে ওই আগন্তুককে খুঁজতে থাকে। লোকটা আবারো চ্যাঁচিয়ে উঠে।
-হেই ননসেন্স। টেল মি, হোটা’স ইউর প্রব্লেম? বার বার একই ইস্যু ক্রিয়েট করছো কেনো?
তুর্কি হাত দিয়ে মুখ মুছে। ঢোক গিলে ডান ডাশে আঙুল উচিয়ে বলে
-ওই যে ওই আর কি… আসলে
লোকটা ওর দিকে সুরু চোখে তাকিয়ে আছে। আজ তুর্কি উত্তর দিতে না পারলে ও-কে গিলে খাবে। তুর্কি কি বলবে ভেবে পায় না। সম্মানে আঘাত করেছে এই কথা ও মুখে কি ভাবে আনবে! তুর্কি মিধ্যে হাসি হেসে বোকা হয়ে বলে,
-নো….নো.. প্রব্লেম আংকেল। আসলে আপনার মাথার পাকা চুল গুলো খুব বাজে দেখাচ্ছে। তাই উঠাতে চায় ছিলাম আর কি।
লোকটা রেগে গিয়ে আরো চ্যাঁচিয়ে উঠে
-আমাকে দেখলে তোমার আংকেল মনে হয়?
তুর্কি নিজের বোকা প্রশ্নের জন্য নিজেকে গালি দেয়। ক্ষণকাল পর বলে,
-চুল পাকা বুড়ো মানুষকে দেখলে আংকেল মনে হবে না তো, কচি খোকা মনে হবে?
লোকটার পাশে থাকা নারীটি বলে,
-এই বেয়াদব মেয়ে। পাকা চুল উঠাচ্ছো মানে? তোমার কি শিক্ষা-দীক্ষা নেই?
বাসের প্রায় যাত্রী ওদের দিকে কেমন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। লোকটা আড় চোখে সবার দৃষ্টি দেখে তার পাশে থাকা নারীটি কে বলে,
-কাম ডাউন কোহেলি।
তারপর লোকটা বাঁকা চোখে তুর্কির দিকে তাকায়। ওর বাম পাশ দিয়ে তার এক হাত পেছনে দিকে একটু ঝুঁকে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
-জাস্ট সেটাপ। আইম নট ইউর আংকেল। আর একটা বাজে কথা বললে খুব খারাপ হয়ে যাবে।
তারপর তুর্কির ডান হাত ধরে টান দিয়ে তার সিটে বসায়। নারীটি চ্যাঁচিয়ে উঠে,
-রাজ, এটা তুই কি করলি। তুই ওকে টাচ কেনো?
তুর্কি চোখ বড় বড় করে তাকায় লোক-টার দিকে। এই লোকটা এত খারাপ! তাহলে একটু আগে এই লোকটা-ই ওর সম্মানে আঘাত করেছিলো। কত বড় সাহস! আল্লহা! কি ভাবে ওর ছিহ!!! আর ভাবা যাচ্ছে না। ওর গা গুলিয়ে উঠে। বউ থাকা সত্ত্বেও! কান্নারা দল বেঁধে হাজির হয় চোখের কোটরে। ও কি চিৎকার করে বাসে থাকা সব লোক গুলোকে বলবে?
-আপনার সাহস হলো কি ভাবে আমাকে টাচ করার?
লোকটা বা পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল করে। তুর্কি আরও কিছু বলার আগে-ই বাস স্ট্যান্ডে এসে থামে। সবাই একে একে বাস থেকে নামতে থাকে। লোকটা তুর্কির পাশ থেকে সরছে না। যার জন্য ও নামতে পারছে না। ওর ভয় হচ্ছে সবাই চলে যাওয়ার পর যদি লোকটা আবার ওর সম্মানে আঘাত করে।
-এই আপনার সমস্যা কি? সরছেন না কেনো? আমি আমি…কিন্তু চিৎকার করবো…।
লোকটা তুর্কির দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। তুর্কির পাশে থাকা নারীটি বলে,
-এই অসভ্য মেয়ে চিৎকার করবে কেনো? নামো আগে।
তুর্কি রাগী চোখে তাকিয়ে বলে,
-নিজের বুড়ো জামাইকে খুব ভালো মনে হয় আপনার? আপনার বুড় স্বামী একজন অসভ্য। স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও আমার গাঁয়ে হাত দিছে। আমি আপনাদের ছাড়বো না। তাই তো বলি লোকটা এত বুড় হওয়া সত্ত্বেও এমন সুন্দরী মেয়ে পটালো কি ভাবে।
তুর্কি উঠে দাঁড়ায়। ততক্ষণে লোকটা সহ সবাই নেমে গেছে। বোধহয় তুর্কির কথা গুলো শুনেছে। তাই ভয়ে পালালো। তুর্কি ও ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। ভয় পেলে চলবে না। সব কিছু সহ্য করা যায় কিন্তু, সম্মানে আঘাত করা নয়। ভালো-মানুষের মুখস পড়ে ঘুরে বেড়ানো ও আজ বের করবে। ও দাঁড়িয়ে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
-এই আপনি সত্যি কথা বলুন এই বুড় লোকটা সত্যি আপনার বর তো? নাকি আপনার উপর কোনো টর্চার করে বিয়ে করেছে? আপনি ভয় পাবেন না। আমি আছি আপনার পাশে আপনি সত্যি কথা বলুন।
মেয়েটা রাগে ফোস ফোস করতে করতে বলে,
হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৬
-আর ইউ ক্রেজি? কি আবল-তাবল বলছো। আর ও আমার হাসবেন্ড নয়। উডবি।
-ওই হলো। কোনো টর্চার করেছে কিনা বলুন।
-সেট-আপ। আপরা দুজন দুজন কে ভালোবাসি।
-আল্লাহ্! লোকটা পালিয়ে গেলো….. আমি ওকে কিছুতেই পালাতে দিবো না।
ও দৌড়ে বাস থেকে নামে।