ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৩

ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৩
মাহিরা ইসলাম মাহী

আকাশ আজ ভীষণ পরিষ্কার। সেখানে নেই আজ কোনো ধোঁয়াশার খেলা।
মাহরিসা ক্লাসে বসে আছে উদাস ভঙ্গিতে। আকাশ পরিষ্কার হলে কি হবে তার মনের মাঝে যে বিষন্নতার ঘনঘটা।
“ভাউউউ”
রোশনীর হঠাৎ আক্রমণে খানিকটা চমকে উঠলো মাহরিসা।
সে ভ্রু কুঁচকে প্রত্যুত্তর করলো,
“ কি ভাই।এভাবে ভয় দেখায় কেউ?মেরে ফেলবি নাকি।”
রোশনী কাঁধের ব্যাগটা নিচে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল,

“ পাঁচ মিনিট ধরে যে আমি তোর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম সে হুশ ছিল তোর? শোন একটা গুড নিউস আছে।”
“ কিসের গুড নিউস? ক্লাস শুরু হয়েছে দশ মিনিট আগে অথচ কিবরিয়া স্যারের এখনো আসার নাম গন্ধ নেই।এর থেকে বয়াড নিউস কি হয়।”
“ আরে সেটাই তো তোকে বলছি। ওই টাকু স্যারের ক্লাস বাদ। নিউ ডাক্তার এসেছেন। তিনি এই ক্লাস নেবেন আমাদের। “

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ ভালো।”
“ ধুর ভালো বলছিস কি আসল কথা তো তোকে বলাই হয় নি।শুনলাম ক্লাসের বাহিরে কিছু মেয়েরা বলাবলি করছিলো স্যার নাকি ভীষণ হ্যান্ডসাম দেখতে।”
মাহরিসা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
“ তো হ্যান্ডসাম দিয়ে কি সরবত গুলিয়ে খাবো নাকি।আমাদের লাগবে এক্সপার্ট টিচার।কিবরিয়া স্যারের মত ফটফটানি না হলেই হয়।বগলবাজি না করলেই হয়।”
“উহু সেটা নয়।স্যারের সঙ্গে নাকি একজন ডাক্তার ম্যাম ও এসেছেন।তিনিও আমাদের ক্লাস নেবেন। দুজনেই কানাডার প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ডাক্তার।
দুজনের কথার মাঝেই একজন রমণী তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো।
“হাই আমি সৃজনী”

ভার্সিটির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যুবতী রমণী নিজের চোখের কালো ফ্রেমের চশমাটা আর একটু উপরে উঠিয়ে ভীতু চোখে আশে আশে চোখ গোল গোল করে চাইলো।
ভার্সিটির সামনে এত শোরগোল দেখে রমণী শুষ্ক
ঢোক গিললো।
আজ তার এই বিশাল ভার্সিটিতে প্রথম দিন।
তীব্র আনন্দের উত্তেজনার সঙ্গে সামান্য ভয়ে তার বুক মাঝে ধুকপুক ধ্বনি ঘন্টা বাজিয়ে যাচ্ছে সমান তালে।
রমণী ভার্সিটির সামনের বিশাল মাঠটার দিকে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রয়।
এত বড় মাঠে করা হয় টা কি।
রমণী গেটের মাঝ খানে দাঁড়িয়ে। মাত্রই সে কদম বাড়িয়ে ভেতরে পা ফেলবে, মুহুর্তেই সাঁইসাঁই করে কয়েকটা বাইক ঝড়ের বেগে তার পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
হঠাৎ কান্ডে রমণীর আত্মারাম খাঁচা ছাড়া।

চোখ দুটল খিচিয়ে কোনো রকমে দাঁড়িয়ে রইলো সে
এই বুঝি তাকে পিসে দিয়ে গেল।ওও গড।
একজন তো একদম পায়ের কাছে এসে টার্ন নিলো।
রমণী সঙ্গে সঙ্গে চমকে তাকালো।
বাইকের উপর থাকা যুবকটি চুইংগাম চিবুতে চিবুতে ঠোঁট কামড়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“ হেই ব্লাক চশমিশ। গেটের মাঝে দাঁড়িয়ে কি মাছি তাড়াচ্ছো।ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন এখানে একটা মাছির ম ও খুঁজে পাবে না।
সামনে থেকে সরে দাঁড়াও ইডিয়েট।”
বাইকে বসা যুবকের মুখশ্রী দৃশ্যমান নয় পুরোটাই হেলমেট দ্বারা আবৃত।গায়ে জড়ানো তার লাল জ্যাকেট।
যুবকের অদ্ভুত সম্মোধনে রমণী কপাল কুঁচকে তাকায়। ততক্ষণাৎ প্রতিবাদ করে,
“ আশ্চর্য মানুষের সমস্যার জন্য কেউ চশমা চোখে পরতেই পারে।তাই বলে কি তাকে চশমিশ ডাকতে হবে আশ্চর্য। “

“ হেই তুমি জানো আমি কে? কত্তবড় সাহস মুখে মুখে তর্ক করো মেয়ে।”
“ তো আপনি আমাকে যাচ্ছে তাই বলবেন আর আমি তা মেনে নেব ভেবেছেন?”
“ আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইন্টারেস্টেড নই।সো সামনে থেকে সরে দাঁড়াও।
“ হাউ ফানি। তো আপনাকে কে বলল আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে ইন্টারেস্টেড? আপনি কি কোনো সেলিব্রিটি যে আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমি তলপিতলপা গুটিয়ে চলে আসবো।”
যুবকটি বাঁকা হাসলো।
“তুমি সামনে থেকে সরে দাঁড়াবে নাকি তোমার ওপর দিয়ে চালিয়ে দেব?”
বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলল যুবতী রমণী। বাকিদের মতো সেও তো পারে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে তা না করে এত প্যাচালের কি আছে ।আশ্চর্য।অভদ্র, ইতর একটা।
“ কেন আপনি পাশ কাটিয়ে যেতে পারছেন না?”
“ তোমার সরতে প্রবলেম কোথায়?”
যুবকটি এবারে সত্যি সত্যিই দেখা গেল তাকে পিসে পেলার ধান্ধায় নেমেছে।
রমণী সঙ্গে সঙ্গে সরে দাঁড়ালো।
মুহুর্তেই যুবকটি বাইক নিয়ে তূফানের বেগে ক্যামপাসে প্রবেশ করলো।
বাতাসের ঝাঁপটা যুবতী রমণীর চোখে মুখে এসে আঁচড়ে পড়লো।
তার ইচ্ছে হলো ছেলেটার দিকে পায়ের জুতো খুলে মারতে। অসহ্য। কোথা থেকে আসে এরা। পাগল ছাগল।ভার্সিটিতে এভাবে কেউ বাইক চালায়।
বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে সে ভেতরে ঢুকলো।

মাঠ পেরিয়ে বিশাল বিল্ডিংয়ের সামনে এসে থামতেই চারপাশে আশ্চর্য হয়ে চাইলো সে।
রমণী লক্ষ্য করলো তার সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করা লাল জ্যাকেট পরিহিত যুবকটি মাঠের ওপাশে থাকা বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আরো কয়েকজন মেয়ে-ছেলের সঙ্গে আড্ডায় মশগুল।
কয়েকজন কি সব ফিসফিস গুঞ্জন করতে করতে তার পাশ কাটিয়ে চলে গেল দ্রুত গতিতে।
অধিকাংশ কে দেখা গেল ছেলে মেয়ে গুলোর দিকে উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখতে।
রমণী ভেঙচি কেটে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে নিলো।
তবে কারো কৌতুহলী কন্ঠের জিজ্ঞাসা বাদে তাকে থেমে যেতে হলো।
“হেই ফাস্ট ইয়ার?”
রমণী চমকে উঠে ভিতু চোখে তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা মেয়ে দুটোর দিকে চাইলো।এরা সিনিয়র নয় তো? মন তার সংশয় প্রকাশ করে।
রমণী মিহিস্বরে বলল,
“ জ্বী আপনারা?”
দুজনের মাঝে একজন মৃদু হেসে বলল,

“ আরে আরে রিলাক্স এত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই।আপনি বলতে হবে না। আমরা তো সেম ব্যাচ। হাই আমি অদিতি রহমান, আর ও আমার ফ্রেন্ড কাশফি।তুমি?”
রমণী হাফ ছেড়ে সেও মৃদু বলল,
“ ওহ! আমি নাওমী। মুশফিকা নাওমী।”
অদিতি বলল,
“ ওয়াও। সো কিউট।আজই প্রথম?”
নাওমী মাথা দুলালো।
কাশফি জিজ্ঞেস করলো,
“ কোন ডি..ডিপার্টমেন্ট? “
নাওমী চোখ পিটপিট করে চাইলো কাশফির কথা বলার ভঙ্গিতে।
কাশফি সংকুচিত কন্ঠে বলল,
“ আসলে আমার কথা বলতে একটু….
নাওমী তাকে থামিয়ে বলল,
“ আচ্ছা আচ্ছা কোনো সমস্যা নেই আমি বুঝতে পেরেছি।আমি কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের তোমরা?”
দুজনে দাঁত কেলিয়ে হেঁসে সুধালো,

“ সেম।”
নাওমী কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করলো,
“ মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়ে গুলো কি সিনিয়র অদিতি? সবাই ওমন করে উঁকি ঝুঁকি মারছে কেন ছ্যাঁচড়ার মত? আশ্চর্য। “
অদিতি ফিসফিস করে বলল,
“ এই আস্তে বলো।উঁকি ঝুঁকি মারা ছেলে মেয়ে গুলোও কিন্তু আমাদের সিনিয়র।শুনতে পেলে এসে চুল ছিড়ে দিয়ে যাবে।
আর ওই যে মাঠে যাদের দেখছো ওনারাও আমাদের সিনিয়র মাস্টার্সের আপু ভাইয়ারা।”
নাওমী কপাল কুঁচকে বলল,

“ কেন কেন, সত্যি কথা বলতে পারবো না কেন? ওনারা চুল ছিঁড়তে আসলে আমরা কি ছেড়ে দেব নাকি?আমরা তাদের টাক করে দিবো হাতের এক লহমায়।ওতো ভোলাভালা সেজে কি হবে।”
“ তুমি জানোনা তাই বলছো। ওই যে লাল জ্যাকেট পড়া ছেলেটাকে দেখছো ওটা নীবিড় ভাইয়া, নীল জ্যাকেট পড়া সাদাফ ভাইয়া,আর ইয়োলো জ্যাকেট নীলাদ্র…
বাকি কথা বলার আগেই তিনজন লক্ষ্য করলো তাদের কথা বলার মাঝে বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেপেলে গুলো তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
অদিতি বিরবির করে বলল,

“ এরা আমাদের দিকে কেন আসছে। “
ওদের ভাবনার মাঝেই ওখান থেকে সরার আগে ঝড়ের বেগে সকলে ওদের পাশ কাটিয়ে হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।
নীবিড় প্যান্টের পকেটে দুহাত রেখে উপরে উঠতে উঠতে একপলক নাওমীর দিকে চাইলো।
দুজনের চোখে চোখ পরতেই নীবিড় সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে উপরে উঠে গেল সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে।
নাওমী ভেঙচি কাটলো।

ইশশ ডং দেখ।কেমন চোরের মত তাকায়।কেন রে চুরি করেছিস নাকি তুই।
নাওমী কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো “এরা যে গেল সবাই কি ফ্রেন্ড? সেম ব্যাচ? “
“ উহু।সেম ব্যাচ বাট আমি এই কদিনে যতটুকু জেনেছি তারা দুটি দলে বিভক্ত।
যে কোনো কাজে একজন অপরজনকে বাঁধা দিতে আসে।
তাদের মাঝে কি শত্রুতা আমি তা জানিনা ঠিকঠাক।
নাওমী আশ্চর্য হয়ে বলল,
“ মানে?”
“ মানেটা খুব সোজা। ক্যান্টিনে চল তোদের দুজন কেই সব খুলে বলছি? সকালে খেয়ে আসি নি পেটের ভেতর ইঁদুর দৌঁড়াচ্ছে ভাই।আর কিছুক্ষণ থাকলে আমি উপরে চলে যাবো।”
“ কাশফি জানেনা?”

নাওমীর প্রশ্নে অদিতি দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে হেসে বলল,
“ উহু ও তো তোর মতোই আজকে আমার ফ্রেন্ড হলো।বাই দ্যা ওয়ে।তোরা দুজন কিন্তু আজ থেকে আমার ফ্রেন্ড হলি।পরে আবার পাল্টি খাস না কেমন।তুই বলছি কিন্তু ডোন্ট মাইন্ড ডিয়ার। “
কাশফি নাওমী দুজনেই হাসলো।
নাওমী বুঝতে পারলো মেয়েটা বড্ড কথা বলতে পছন্দ করে।সঙ্গে ছেলেমানুষী ভাব বিধ্যমান মিশুকে।
ক্যান্টিনে তিনজনে একটা টেবিলে বসে পরলো।
সিঙ্গারা আর ছমচা অর্ডার দিয়ে অদিতি যুৎ করে বসেতে বসতে বলল,

“ আমিও সবাইকে চিনি না।তবে যতটুকু বুঝতে পারলাম।মাস্টার্সের সিনিয়র আপু ভাইয়ারা সব দুটো দলে বিভক্ত।
একদলে বোধহয় তোকে তখন বললাম না ওই সাদাফ ভাইয়া আর নীবিড় ভাইয়া আছে,আরেকজন আপু বোধহয় নিস্তব্ধতা। হ্যাঁ ওনারা তিনজনই বোধহয় লিডার।
আর ওপর দলে বোধহয় নীলাদ্র,সাফওয়ান ভাইয়া আর একটা মেয়ে আছে তিয়াশা নাম করে একনম্বরের বেয়াদব।চেহারা সুন্দর হলে কি হবে, মেয়েটার মনের ভেতরটা একদম কুৎসিত।
উচ্ছৃঙ্খল, দেখলিনা কেমন ছোট ছোট জামা পরে আসে।
অসহ্য।

তিয়াশা শয়তানটা সেদিন আমায় র‍্যাগিংয়ে গান গাইয়ে ছেড়েছে।
কি যে ভীষণ কান্না পাচ্ছিলো আমার। কি গান গাইয়েছিল জানিস?আবার ভিডিও করে ও রেখেছিলো।
দুজন কৌতুহলী দৃষ্টিতে চাইতেই
অদিতি মুখ কাচুমাচু করে ওদের সেই গান শোনালো।
“ ওরে কোকিলারে কাকের বাসায় ডিম পাড়ে জানে নারে কাক জানেনা।”
নাওমী আর কাশফি খিলখিল করে হাতে লাগলো।
“ দোস্ত তোরা আমার দুঃখের কথা শুনে হাসছিস।”
নাওমী হাসতে হাসতে বলল,
“ সিরিয়াসলি দোস্ত হাসা ব্যতীত আর কোনো ওয়ে দেখছি না ।”
সাদাফ কাশফির ভাই কাশফি সেটা পুরোপুরি চেপে গেল।
অদিতি আবারো বলল,
“ওই তিয়াশা নাকি সাদাফ ভাইয়া কে পছন্দ করে। পুরো ভার্সিটি জানে তা। কিন্তু দুই দুইবার রিজেক্ট হয়েছে তার থেকে।
নিস্তব্ধতা আপুর জন্য সে সাদাফ ভাইয়ার কাছে ঘেসতে পারে না।
নিস্তব্ধতা আপু আর তিয়াশার মাঝে সাপে নেউলে সম্পর্ক সেটা সবাই জানে।কি জন্য জানিনা।
তিন জনে গল্প করতে করতে অনেকটা সময় কাটালো হাসি ঠাট্টায়।

ক্লাস শেষে কাশফি গেটের কাছে আসতেই আঁতকে উঠলো।
বোধহয় আজ আর সে বেঁচে ফিরতে পারবে না। অদিতি বার বার করে যাদের থেকে সাবধানে থাকতে বলেছিল এখন তাদের গুহায়ই তাকে ঢুকতে হবে।ইয়া আল্লাহ।
তিয়াশা নামের মেয়েটা তার জন্য বরণ ডালা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দুরুদুরু বুকে কাশফি কাছে এগিয়ে যেতেই
সঙ্গে সঙ্গে কাফি নামের একটা ছেলে ডেকে উঠলো তাকে।
কাশফি চোখ খিঁচে দাঁড়িয়ে পড়লো।সর্বনাশ।
অদিতি আর নাওমী টাও চলে গিয়েছে।এখন একা সে কি করবে।
“ কি খুকি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে।
দেখি দেখি টুকটুক করে এগিয়ে এসো তো।”
কাশফি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল।
তিয়াশা তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে ধমকে বলল,

“ সিনিয়রদের দেখলে সালাম দিতে হয় জানো না? সালাম দাও।”
“ আসসালামু আলাইকুম। “
“ কি নাম তোর?”
কাশফি ভ্রু কুঁচকায় বেয়াদব মেয়ে এভাবে কাউকে তুই বলে।
কাশফি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সুধালো,
“ কা..কাশফি ইফতিসাম। “
তনয়া হাসতে হাসতে বলল,
“ কিরে তিয়াশা এতো দেখি তুতলারাণী আমাদের। তো কি বলিস তোরা তুতলা রাণীর কন্ঠে একখানা ঝাকানাকা গান হয়ে যাক? “

সবাই সায় জানালো।
কাশফি আঁতকে উঠলো গানের কথা শুনে।অদিতির মতো তাকেও ওমনগান গাইতে হবে না তো।
কাশফি আড় চোখে সকলের দিকে চেয়ে দেখলো। অদিতির চিনিয়ে দেওয়া নীলাদ্র নামের ছেলেটার এদিকে মনোযোগ নেই।সে গম্ভীর মুখে ফোনে কিছু করছে।
রাফসান বলল,
“ কি খুকি গান গাও।”
তিয়াশা বাঁকা হেসে বলল,
“ আরে এত সহজে গান গাইলে হবে নাকি।দেখি ফোন বার কর।ক্যাপচার করতে হবে তো। তোতলা শিল্পী গান গাচ্ছে বলে কথা।”
কাশফির চোখ অশ্রুতে টলমল করে উঠলো।
আগে কখনো তাকে এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি।এভাবে কেউ তাকে কখনো তুতলা বলে অপমান ওও করে নি।
সাফওয়ান বলে উঠলো ,

“ এই কাজল তোর সেই স্পেশাল ডিপজলের গাওয়া বিখ্যাত গানটা গেয়ে শোনা তো ওকে।তারপর ও একটু গেয়ে আমাদের মনোরঞ্জন করুক।”
“জ্বী ভাই এখুনি গাচ্ছি।”
বলেই সে তাইতে লাগলো,
পুত কইরা দিমু আমি পুত কইরা দিমু।পুততত, পুতত, পুততত।”
কাজলের গান শুনে সবার হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা।
কাশফি চোখ বড় বড় করে চাইলো।
মনে মনে সে আসতাগফিরুল্লাহ পড়লো।
এই অদ্ভুত গানটা তাকে গাইতে হবে অসম্ভব।
কিন্তু সকলের জোড়াজোড়ি তে কাশফি মাথা নিচু করে ছলছল চোখে গাইতে লাগলো,
ওরা হাতে তালি দেওয়ার ভঙ্গিমা করলো।
“পু..পু.পুত কইরা দিমু আমি।”

কাশফি আর বলতে পারলো না। কাশফির ইচ্ছে করছে সবগুলোর গালে কষিয়ে কতগুলো থাপ্পড় মারতে।কিন্তু সিনিয়র হওয়ায় সেটাও পারছে না। সে নিজে্কে শক্ত করে বলে উঠলো,
“ দেখুন ভাইয়া, আপুরা আমি এখানে পড়াশোনা করতে এসেছি কারো মনোরঞ্জন করতে নয়।আমার এটা দ্বারা সম্ভব নয়। আপনারা অন্য কাউকে খুঁজে নিন।”
নীলাদ্র ফোন হতে মাথা তুলে এবারে কাশফির পানে চাইলো।তার আপাদমস্তক চোখ বুলালো।
তিয়াশা হাসতে হাসতে বলল,
“ সে কিরে নীলাদ্র দেখলি মুরগির মুখে দেখছি খই ফুটছে। কত্তবড় সাহস সিনিয়রদের মুখে মুখে তর্ক করা।”
নীলাদ্র গরম স্বরে প্রশ্ন করলো,
“ ফাস্ট ইয়ার? কোন ডিপার্টমেন্ট?”
“কেমিস্ট্রি। “
নীলাদ্র হাতের ফোনটা পকেটে রেখে বাইক থেকে থেকে লাফ দিয়ে নেমে প্যান্টের পকেটে দুহাত গুঁজতে গুঁজতে কাশফির উদ্দেশ্যে বলল,

“ ওকে। নাউ গো।”
তিয়াশা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলে উঠলো,
“ এমনি এমনি কি করে ছেড়ে দিই।একটু মশলা মাখিয়ে ছাড়ি।”
তিয়াশা কাশফির গায়ে হাত তুলতে নিতেই দুটো শক্তপোক্ত পুরুষালী হাত তার হাত চেপে ধরলো।
তিয়াশা সাদাফের মুখশ্রীর পানে আর হাতের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো,আবার নীলাদ্র হাতের পানে তাকালো।
নীলাদ্র সঙ্গে সঙ্গে নিজের হাতটা সরিয়ে নিলো।
সঙ্গে গম্ভীর স্বরে বলল,
“ বেশি বেশি হচ্ছিলো তিয়াশা।”
সাদাফ বজ্রকন্ঠে বলল,
“ ওর গায়ে হাত তোলার অনুমতি তোকে কে দিয়েছে?এত সাহস কোথায় পাস তুই?”
কাশফির দিকে চেয়ে বলল,
“ বাসায় যা।কি হলো যা।”

কাশফি একপলক নীলাদ্র’র পানে চাইলো।দেখলো ছেলেটা তার পানেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে সে ওখান থেকে এক দৌঁড়ে চলে এল ভার্সিটির গেট পেরিয়ে বাহিরে।
তিয়াশা সাদাফের চোখে চোখ রেখে বলল,
“ সাহসের কি দেখেছিস তুই?”
সাদাফ ঠাস করে তিয়াশার গালে চর বসিয়ে দিলো।
তিয়াশা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সাদাফের পানে।
নীলাদ্র এবারে হাতে তালি দিয়ে কৌতুক করে বলল,
“ বা..বাহ এত দূর? তা কি লাগে মেয়েটা তোর?
গার্লফ্রেন্ড নাকি?”

“ একদম বাজে কথা বলবি না নীলাদ্র।”
“ ওও এখন বুঝি বাজে কথা হয়ে যাচ্ছে। তা কটা লাগে তোর? পাশে একটা আরেকটা…।“
নিস্তব্ধতা তিয়াশা দুজন দুজনের দিকে অগ্নি চোখে চেয়ে আছে।
যেন চোখ দিয়েই দুজন দুজন কে ভষ্ম করে দিবে।
“ শাটআপ আর একটা সাউন্ড করবি না তুই নীলাদ্র।”
সাদাফ আর নিস্তব্ধতা হনহন করে হেঁটে চলে গেল ওখান থেকে।
বাইক স্টার্ট দিতে দিতে সাদাফ নিস্তব্ধতার উদ্দেশ্যে বলল,
“ রিক্সায় করে বাড়ি ফের।”
নিস্তব্ধতা চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“ তুই আমায় দিয়ে আসবি কি না বল।”

“ আ’ম সো সরি। আমার অনেক কাজ আছে। তোর পেছনে টাইম ওয়েস্ট করতে পারবো না।”
নিস্তব্ধতা সঙ্গে সঙ্গে বাইকে বসানো চাবি জোড়া খপ করে নিজের কব্জায় নিয়ে বলল,
“ ওকে ফাইন। যা বাসায় যা।”
“ আশ্চর্য চাবি না দিলে আমি যাবো কেমন করে?”
“ সেটা আমি কি করে জানবো।বাই।”
সাদাফ নিস্তব্ধতার বাহু টেনে ধরলো।
নিস্তব্ধতা সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে সরে বলল,
“ একদম মেয়ে মানুষের মত গায়ে পরবি না।
একদম ছুবি না আমায় সজনেডাঁটার বাচ্চা। “
সাদাফ হঠাৎ শ্বাস ফেলে বলল,
“ পেছনে বস।”

“লাগবে না। তুই বাসায় যা না ভাই।তোর বাসায় কত হাতি ঘোড়া মহিষ পালিস তুই তাই না।তাদের জন্য ঘাস কাটতে হবে তো তোর যা। বাসায় যা ভাই বাসায় যা।”
“ এই একদম ভাই ভাই করবি না তো ফালতু মহিলা।”
“ আমি ফালতু মহিলা? ওকে টাটা।”
নিস্তব্ধতা আবারো হাঁটা ধরলো।সাদাফ কপাল ঘসে তার পিছু পিছু বাইক হাত দিয়ে টেনে নিতে নিতে বলল,
“ ঠিকআছে আমায় ক্ষ্যামা দে মা উঠ।তোকে দিয়ে আসছি।”
নিস্তব্ধতা দাঁত কেলিয়ে হাসলো।বলল,
“ আমায় চালাতে দিবি? তবে চাবি দেব?”
সাদাফ অসহায় কন্ঠে বলল,

“ জেদ করিস না নীরু। একবার বাইক থেকে পড়ে হাত পা ভেঙে শিক্ষা হয়নি তোর? তোর কি মনে হয় আমি তোকে পুনরায় একই ভুল করতে দেব? তাছাড়া আঙ্কেল জানলে আমায় আস্ত রাখবেনা।বাপকে দিয়ে আমার নামে মামলা ঠুকে দেবে।”
তাদের পাশ দিয়ে তিয়াশা বাইক ছুটিয়ে চলে গেল।
নিস্তব্ধতা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ কিচ্ছু ভুলে যাইনি আমি সাদাফ।আমার সাথে করা অন্যায়ের জবাব আমি ওদের ঠিক দেব।”
সাদাফ উত্তর করলো না বাঁকা হাসলো।
নিস্তব্ধতা বাইকের পিছনে চেপে বসলো।

ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ২

“ ভালো করে ধরে বস।”
সাদাফ বাইক ছুটিয়ে তিয়াশাকে ওভারটেক করে হাইওয়ের রাস্তা ধরতেই নিস্তব্ধতার মুখে হাসি ফুটলো।
লুকিং গ্লাসে রমণীর মুখের হাসি দেখে সাদাফ ও মুঁচকি হাসলো।

ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৪