হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ২৪
তোয়া নিধী দোয়েল
-আরে ভাই, কেনো বুঝছেন না আমি বিবাহিত! আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
আজ কলেজে আসার পর, একটা ছেলে তুর্কিকে প্রোপজ করেছে। ছেলেটা অনেক্ষণ যাবৎ, ও-কে বলে চলেছে, সে নাকি অনেক দিন ধরে ওকে পছন্দ করে।
-আমি জানি তুমি মিথ্যে বলছো।
-আরে ভাই, আপনার সাথে মিথ্যে বলে আমার লাভ আছে? ঠিক আছে, আদনান স্যারকে চিনেন না? উনি হচ্ছে আমার হাসবেন্ড। বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞাসা করে আসুন।
এর পর সোফিয়ার উদ্দেশ্যে বলে,
-দোস্ত আয় তো।
-বাহ্ দোস্ত! তোর এক্টিংটা কিন্তু, সেই ছিলো। ছেলেটাকে ভাগাতে তোর অপছন্দের স্যাররের নাম বললি? কত না বলতি, অসহ্য লাগে স্যার কে৷ বুড়ো স্যার। দেখলি তো, তুই ও শেষ-মেশ স্যারকে পছন্দ করতে শুরু করলি?
তুর্কি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে৷ সোফিয়াকে বলবে বলবে করে আর বলা হয়নি।
-ঘোড়ার মাথা পছন্দ করি।
-আরে করছ৷ তাই তো, স্যারের নাম বললি।
-আরে ভাই, সত্যি স্যারের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।
তুর্কির কথা বিষ্ময় দৃষ্টি নিয়ে তাকায় সোফিয়া। অবাক কণ্ঠে বলে,
-মানে?
-তোকে সব বলছি দাঁড়া।
-তুই আর কথাই বলিছ না। হারামি! যা সর।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এই বলে সোফিয়া হাঁটতে শুরু করে। তুর্কি ওর পেছন পেছন আসতে আসতে বলে,
-দোস্ত দোস্ত, শোন আগে আমার কথা। রাগ করিস না। আসলে…
-কী আসলে? তোর বিয়ে হয়েছে! তাও আবার আদনান স্যারের সাথে! আর সেই খবর, এত দিন পর আমি জানতে পারলাম?!
-দোস্ত শোন। বিয়েটা জাদু করে হয়েছে। সে জন্য তোকে বলতে পারেনি। প্লিজ রাগ করিস না।
সোফিয়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে,
-জাদু করে মানে!
-আরে বিয়েটা লাভ ম্যারেজ ও না, আবার আ্যরেঞ্জ ম্যারেজ ও না। ওই অসভ্য, ফাজিল লোকটা আমার মা-কে জাদু করে, বশ করে, আমাকে তুলে নিয়ে গেছে। আমি নিজেই তো জানিনা ওই লোকের সাথে আমার বিয়ে। বিয়ের রাতে প্রথমে, দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। ভেবেছি তোকে বলবো, কিন্তু, পরে আর বলা হয়নি। আই এম সরি।
-মিথ্যে বলার জায়গা পাস না? তুই জানতি স্যারকে আমার ভালো লাগে। তারপরও কি ভাবে পারলি এইটা?
সোফিয়া দুই হাত বুকে ভাঁজ করে অন্য দিকে তাকায়। ও ভেবেছে আদনান স্যার তো বরাবরই কলেজে জনপ্রিয়। হয়তো তুর্কির ও স্যারকে ভালো লাগে তাই, ছেলেটাকে ভাগাতে এই কথা বলেছে। কিন্তু, একটু আগে তুর্কির কাছ থেকে জানতে পেরেছে, কোনো এক জাদু মন্ত্ররের জন্য ওদের বিয়েটা হয়েছে। মানে আজগুবি কথার একটা লিমিট থাকে! স্যারের বয়ে গেছে ওকে বিয়ে করতে।
-দোস্ত।
-সর।
-এমন করিস না।
– ছোট বেলা থেকে তোর সাথে সংসার করে আসছি। আর এত বড় একটা ঘটনা আমার কাছ থেকে লুকিয়ে গেলি?
-দোস্ত দোস্ত। ওই অসভ্য লোকটাকে আমার কোনো দিন ও পছন্দ না। সব সময় আমাদের মধ্যে ঝামেলা বেঁধে থাকে।
-তো বিয়েটা কেন করলি?
-আরে দোস্ত। এইটা লম্বা কাহিনী। ওই অসভ্য লোকের একটা অসভ্য ভাই আছে। ওই ভাইটার জন্য আজ এই পরিণতি। তা না…
সোফিয়া তুর্কির দিকে ঘুরে বলে,
-কী স্যারের ভাই ও আছে? সে দেখতে কেমন রে? নিশ্চয়ই স্যারের মত সুন্দর?
তুর্কি ভ্রু কুঁচকে বলে,
-হ্যাঁ। ভালোই। তবে…
-এত কিছু শুনতে চাই না। দোস্ত যা আদনান স্যার তোর। তুই তোর দেবর টাকে পটিয়ে আমাকে দিয়ে দে প্লিজ।
তুর্কি ভ্রু কুঁচকে বলে,
-আমি ওই ফাজিলের সাথে কথা বলিনা। আর তুই…(কিঞ্চিৎ রাগী স্বরে) তোকে আর কী বলবো। সর এখান থেকে।
কলেজ ক্যাম্পাসের রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আদনান আর রেজাউল করিম স্যার। গন্তব্য ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে। পাশের কাঠ-বাগানে বসে রয়েছে অনেক কাপাল। মাঝে মাঝে আবার চোখ পড়ছে, কিছু কিছু ছেলে-মেয়েরা গোল হয়ে বসে গান গাইছে। কেউ কেউ একাকিত্ব বই পড়ছে। রেজাউল করিম বসে থাকা ছেলে-মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকায়। রাগান্বিত স্বরে বলে,
-দেখেছো সারফারাজ, দেখেছো? পোলাপানের কি শিক্ষা-দীক্ষা? চলো তো ওই দিক চলো।
আদনান রেজাউলের হাত টেনে বলে,
-আরে স্যার, আসুন তো। পোলাপান এই বয়সে প্রেম করেবে না তো বুড়ো বয়েসে প্রেম করবে? পৃথিবীতে প্রেম-ভালোবাসা আছে বলেই পৃথিবী টিকে আছে। প্রতিটা জিনিসের প্রতি প্রতিটা জিনিসের মায়া আছে বলেই পৃথিবী টিকে আছে। আর সেই প্রেমকে টিকে রাখতে, ওরা আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এতে বাধা দেওয়া অন্যায়। আসুন আপনি।
আদনানের কাছ থেকে এই রকম উত্তর ছাড়া আর কিছু আশা করা যায় না। আদনান যে স্বাধীন চেত্তা মানুষ, সেটা কলেজের সবাই জানে। প্রফেসর, প্রভাষক থেকে স্টুডেন্ট সবাই। ওর মতে, সবাই সবার মত করে বাঁচার অধিকার আছে। কারো কাজে হস্তক্ষেপ করা উচিত না। মানুষ ভুল করলেই তো শিখবে। যত ভুল হবে তত শিখবে। তত ভুল পথ ছেড়ে সঠিক পথে আসতে পারবে। রেজাউল আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে,
– তুমি খামোকা ফিজিক্সর মত জটিল সাবজেক্ট নিয়ে পড়তে গেছো কেন? প্রেমের সাবজেক্ট নিয়ে পিএইচডি করতে।
-ফিজিক্স এর সাথে, প্রেম সৃষ্টি হয়েছে বলেই তো ফিজিক্স নিয়ে পড়েছি।
রেজাউল চোখ বড় বড় করে বলে,
-চাকরির পাশা-পাশি, একটা প্রেমের ক্রোচিং সেন্টার ও খুলে ফেলো। তাতে অনেকের উপকার হবে। মাঝে মাঝে আমি ও তোমার ভাবি কে নিয়ে যাবো। সাথে আশে পাশে সবাইকে আসার জন্য উৎসাহিত করবো।
-আমি প্রেমের ক্রোসিং সেন্টার খুললে, কাউকে উৎসাহিত করে আনতে হবে না। সবাই এমনিতেই আসবে।
রেজুয়ানের কথা শোনা মাত্র, সেই থেকে সোফিয়া তুর্কির মাথার পোঁকা নাড়িয়ে দিচ্ছি। ও রেজুয়ানের সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু, ও কীভাবে বোঝাবে ওই বজ্জাতের সাথে তুর্কির ভালো সম্পর্ক না। ক্লাসে বসে ও সোফিয়া এক কথা বলছে৷ তুর্কি, ব্যাগের উপর মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। যদি ওই অসভ্য লোকটার সাথে ওর বিয়ে না হতো তাহলে, প্রতিদিন এই রকম কলেজে আসতে হতো না। ইসস কেনো যে ওই লোকের সামনে ও পরেছিল। কি জাদু যে মাকে করলো, ও ভেবে পায় না।
-এই দোস্ত।
তুর্কি বিরক্ত নিয়ে উঠে বলে,
-ধুর, আরেকটা বার আমাকে ডাকলে লাত্থি খাবি।
-দোস্ত দেখ, এই স্যার টা ও কী সুন্দর!
তুর্কি হতাশার শ্বাস ফেলে সামনে তাকায়। ক্লাসে স্যার লেকচার দিচ্ছি। ও ঘাড় ঘুরিয়ে সোফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
-তো যা, একে পটাতে। নেক্সট টাইম যদি আমাকে বিরক্ত করস তোর এক দিন কি আমার এক দিন।
তুর্কি আবারো ব্যাগে মাথা দেয়। সোফিয়া ওর পিঠে হাত দিয়ে নাড়া দিয়ে বলে,
-বা*ল তুই প্রতিদিন ক্লাসে এসে ঘুমাস কেন? সামনে বুধবার বসন্ত উৎসব। চল একটু প্লান করি।
-সর তুই। ব্যাডা মানুষের প্যাঁচাল ছাড়া তুই, অন্য কোনো প্যাঁচাল পারছ? জ্বলাবিনা আমাকে। তোর আজিরা প্যাঁচাল শুনতে আমার ভালো লাগে না।
-তুই আগে বল তুই প্রতিদিন ক্লাসে এসে ঘুমাস কেন? ও বুঝেছি। নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে, আদনান স্যারের মত এত সুন্দর একটা জামাই পাইছো। রাতে আর ঘুম আসার টাইম পাইবা কেমনা? তাইতো ক্লাসে এসে পড়ে পড়ে ঘুম আসো তাইনা?
তুর্কি নাক মুখ কুঁচকে ব্যাগ থেকে মাথা তুলে, দুম করে এক কিল বসায় সোফিয়ার পিঠে। সোফিয়া কিল খেয়ে পিঠ বাঁকিয়ে ফেলে। তুর্কি দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– ওই লোক, পড়া-লেখা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। উনার মাথায় সব সময় ফিজিক্স ঘুরে। সব সময় আমার ঘাড় ধরে পড়তে বসায়। সেই জন্য ক্লাসে ঘুম আসে আমার। যদি আর একটা বার উল্টা-পাল্টা কিছু বলছ…।
-এই পেছন কী হচ্ছে?
তুর্কির মারের শব্দ শোনে, পুরু ক্লাস ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। তুর্কি গলা পরিষ্কার করে বলে,
– সরি স্যার। এমনি। কিছু হচ্ছে না।
-এই দিকে খেয়াল করো।
কাঠ-বাগানে সিমেন্টের তৈরি বসার জায়গায়, বসে আছে রেজুয়ান। সাথে অভ্র শিপু। আজ আদনানের পরিক্ষার গার্ড আছে, তাই তুর্কিকে বাসায় নিয়ে যেতে বলেছে। ও তুর্কির ক্লাস শেষে হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
-তোদের যে বলেছিলাম, কাঠগোলাপের খোঁজ নিতে। নিয়েসিছ?
অভ্র ফোনে গেম খেলতে খেলতে বলে,
-প্রিন্সিপালের মেয়ে।
-কোন কলেজের?
অভ্র ঠোঁটের এক পাশে জিহ্বার মাথা বের করে ফোন নাড়িয়ে নাড়িয়ে গেম খেলছে৷ সাথে শিপু ও। উত্তর না পাওয়ার দরুন রেজুয়ান অভ্রর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলে,
-বা*ল খেলে। যা জিজ্ঞাসা করছি বল।
-আরে বা*ল তোর জন্য মরলাম।
-তুই বলবি? নাকি ফোন আছাড় দিবো?
-আরে আমাদের কলেজের প্রিন্সিপালের মেয়ে।
– নাম্বার আনিতে বলেছিলাম এনেছিস?
-হো আমার মায়ের পেটের বোন তো। নাম্বার চাইলেই দিবো।
-তোর বোন হলে, আর অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করতাম না। ছোট বেলায়ই তুলে নিয়ে আসিতাম।
শব্দ তুলে রেজুয়ানের ফোন বেজে উঠে। স্কিনে ভেসে উঠে আদনানের নাম্বার। বোধয় তুর্কির ক্লাস শেষে।
ক্লাস শেষে করে বের হয় তুর্কি। পাশে সোফিয়া। বসন্ত উৎসব নিয়ে কথা বলছে দু’জন। অনেক ভিড়। অনার্সের পরিক্ষা আছে আজ। ক্লাস থেকে ভিড় ঠেলে বের হয়। কয়েক পা এগনোর পর, পেছন থেকে তুর্কির ব্যাগ কেউ টেনে ধরে। ও সজোরে টান খেয়ে কারো বুকের সাথে ধাক্কা খায়। চোখ মুখ কুঁচকে, ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। আদনানের মুখশ্রী দৃশ্যমান হতেই রাগীস্বরে বলে,
-এই ভাবে কেউ টান দেয়? যদি পড়ে যেতাম?
-অনেক ভীড়, ব্যাগ সামনে নেও।
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-আপনি এখানে এসেছেন কেনো?
– এই ভীড় ঠেলে বের হতে প্রব্লেম হবে। তাই। তাড়াতাড়ি করো আমার পরিক্ষার গার্ড আছে।
-গার্ড আছে তো ভাব করতে এসেছেন কেনো? অসভ্য লোক।
তুর্কি পিঠের ব্যাগ ঘুরিয়ে সামনে আনে। দুই হাত দিয়ে বুকের সাথে ঝড়িয়ে ধরে। আদনান পেছন থেকে ওর দুই বাহু, দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে। আদেশের স্বরে বলে,
-চলো।
আদনানের ধরা দেখে চোখ বড় বড় করে তাকায় তুর্কি। এক অদ্ভুত অনুভূতি ছড়িয়ে যায় সর্বাঙ্গে। ও আড় চোখে তাকায়। তবে আদনান কে দেখতে পায় না। ও আগে আগে পা ফেলতে থাকে। পেছন থেকে একই ছন্দে, ওর দুই বাহু ধরে হাঁটতে থাকে আদনান। ভীড় ঠেলে সামনে এগোতে থাকে। আশে পাশের অনেক মেয়েরা ওদের দেখছে। অনেক ছেলেরা এসে আদনানের সাথে কথা বলছে। মাঝে মাঝে মেয়েরা ও বলছে। তুর্কি মুচকি হেসে হাঁটেছে। ওর কেমন যেনো আনন্দ হচ্ছে, এই যে মেয়েরা ওদের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আদনান সবার সাথে চমৎকার করে হেসে কথা বলছে। তবে, না চাইতে ও কেনো যেনো ওর একটু বিরক্ত লাগছে, আদনানের এই সব মেয়েদের সাথে কথা বলতে দেখে। কিছু মেয়ে ওদের দিকে এগিয়ে এসে বলে
– স্যার, এইটা কি আপনার বোন?
কপালে ভাঁজ ফেলে তাকায় তুর্কি। ওদের দেখে ভাই-বোন মনে হচ্ছে? এতক্ষণ ধরে ও সহ্য করেছে সব। আর করবে না। যদিও লোকটাকে ওর একটু ও পছন্দ না। কিন্তু, সবাই ভাই বোন কেনো বলবে? নাহ্, এই ভাবে যাওয়া যাবে না। আদনান কিছু বলতে গেলে তুর্কি ওর হাতে সরিয়ে, আদনানের এক বাহু জড়িয়ে ধরে। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে,
-নো। হি ইজ মাই হাসবেন্ড। আপনারা এবার আসতে পারেন।
অবাক চোখে তাকায় মেয়ে গুলো। আদনান মুচকি হেসে তুর্কির দিকে তাকায়। মেয়ে গুলো সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে চলে যায়। তুর্কি ওদের উদ্দেশ্যে মুখ বাঁকায়। কত বড় সাহস। মানলো ও এই লোকটাকে ওর ভালো লাগে না। কিন্তু, তাই বলে, ভাই বোন কেনো বলবে? আদনান ফিসফিসিয়ে বলে,
– জেয়ালার্স ফিল করছে?
সঙ্গে সঙ্গে আদনানের জড়িয়ে ধরা হাত, ছেড়ে দেয় তুর্কি। মুখ বাঁকিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
-মোটে ও না।
এরপর ধাপ ধাপ করে শব্দ তুলে, হেঁটে আগে আগে চলে যায় ও। আদনান ঠোঁটের হাসি দীর্ঘ করে ওর পিছু পিছু হাঁটতে থাকে।
নিচতলায় নেমে আদনান রেজুয়ানকে কল করে। রেজুয়ান আদনানের অবস্থান জেনে সেখানে আসে। আদনান রেজুয়ানকে বলে,
-সাবধানে নিয়ে যাবি। আর কোনো প্রব্লেম হলে আমাকে জানাবি।
রেজুয়ান মিনমিনে বলে,
-প্রব্লেমই তো নিয়ে যাচ্ছি। এত বড় প্রব্লেম থাকতে আবার প্রব্লেমে পড়তে যাবো কেনো?
তুর্কি ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকয়ে থাকে।
-কী বললেন?
-কিছু না ভাবিজান। আসুন।
আদনান ফের কঠিন স্বরে বলে,
-ও যদি কোনো রিপোর্ট দেয় তোর নামে, তাহলে তো বুঝছই। তোর অবস্থা আমি কি করবো।
-তোমার বউকে বলে দেও, আমার সাথে যেনো ঝগড়া না করে।
-ও করলেও তুই করবি না। চুপ চাপ সাবধানে নিয়ে যাবি।
-শুধু এক বার বিয়ে করে নেই। তারপর আমার বউকে, আমার হয়ে ঝগড়া করার জন্য লাগিয়ে দেবো।
-কী বললেন?
-আরে কিছু না আসুন আপনি।
আদনান আবারও চোখ রাঙিয়ে বলে,
-যদি কোনো বিচার দেয় আমার কাছে তাহলে….
-আরে চিন্তা করো না। তোমার বাচ্চা বউকে সাবধানে নিয়ে যাবো।
-এই, কাকে বাচ্চা বললেন আপনি?
-আপনাকে বলে নি। দুই দিন পর আমার ভাইস্তা-ভাস্তি আসবো তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেছি। আপনি ঠিক থাকলে তো তাঁরা ভালো থাকবে।
তুর্কি রেগে বলে,
-যেমন অসভ্য আপনি, তেমন অসভ্য আপনার ভাই।আমি যাবো না আপনার ভাইয়ের সাথে।
-মীম (ধমকের স্বরে) আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুই ফাজলামি বাদ দিবি, নাকি আমি কাঠগোলাপের বিয়ে অন্য জাগায় ঠিক করবো?
-সরি সরি ভাই৷ সরি ভাবিজান। আসেন আসেন। আপনার জন্য আমার বিয়ে ভেঙে যাবে। আসেন তাড়াতাড়ি।
-আরেকটা বার শুধু উল্টা-পাল্টা কিছু বললে আপনার এক দিন কি আমার এক দিন।
রেজুয়ান-তুর্কি কলেজ ক্যাম্পাস দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মেইন রোডের দিকে যাচ্ছে। রেজুয়ান চুপ চাপ যাচ্ছে। ওর আর ইচ্ছে নেই, নিজের পায়ে কুড়াল মারার। এই মেয়ের মাথায় সমস্যা আছে৷ ক বললে আদনানের কাছে কলকাতা বানিয়ে ফেলে। তাই, এখন চুপচাপ যাওয়াই ভালো৷ হঠাৎ তুর্কি হাঁটা থামিয়ে দেয়। রেজুয়ান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে,
-থামলেন কেন?
-আপনার ভাইয়ের কাছে যাবো।
-এত জামাই জামাই করেন কেন? জামাইকে ছাড়া দেখি থাকতেই পারেন না। তাহলে আবার ঝগড়া করেন কেনো?
তুর্কি রাগী স্বরে বলে,
-তাতে আপনার কী?
-কিছুই না। কিসের জন্য যাবেন?
-বুধবার নাকি বসন্ত উৎসব। আমার কোনো ভালো লিপস্টিক নেই। সেটা কেনার জন্য কিছু টাকা আনতে যাবো।
রেজুয়ান পকেটে হাত দিয়ে বলে,
-ভাই তো পরিক্ষার হোলে চলে গেছে। আমার কাছে টাকা আছে। চলুন।
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-আমি আপনার টাকা দিয়ে কিনবো না।
এই বলে উল্টো ঘুরে হাঁটতে থাকে। রেজুয়ান ওর পিছু পিছু আসতে আসতে বলে,
-বলেন যে, জামাইকে দেখতে ইচ্ছা করছে। জামাই ছাড়া এক সেকেন্ড ও থাকতে পারেন না।
-তাতে আপনার কি?
-আমার বউকে একটু ট্রেনিং দিয়ে দিয়েন তো, ভাবিজান। যাতে সারাক্ষণ জামাই জামাই করে।
তুর্কি দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– অবশ্যই। এমন ট্রেনিং দেবো, যাতে উঠতে বসতে আপনাকে পেটায়।
-ইসস! আমার ভাই কত ভালো। তিন বেলা মাইর খাওয়ার পর ও বউকে কত ভালোবাসে।
-ভাই মাইর খাই মানে?
-আপনি তো জামাই মারার ট্রেনিং প্রাপ্ত। একটু আগে বললেন। তাই তো আমার বউকে দিবেন।
তুর্কি দাঁতে দাঁত চেপে চুপচাপ হাঁটতে থাকে। এই দুই ভাইয়ের সাথে কথা বলা দায়। এত অসভ্য এরা বলার বাইরে।
আদনান, ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে নতুন ভবনের দিকে যাচ্ছে। পাঁচ হাজার তিন রুমে ওর গার্ড। পেছন থেকে কোহেলি ডেকে উঠে,
-রাজ।
আদনান ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। কোহেলি হাতে ব্যাগ নিয়ে হেলে দুলে এই দিকে আসছে। ওর কাছে এসে লম্বা করে হেসে বলে,
-তোর বউ কেমন আছে?
-হুম ভালো।
-কোন রুমে গার্ড তোর?
-পাঁচ হাজার তিনে। তোর?
-চার হাজার দুইয়ে। চল এক সাথে যাওয়া যাক।
-ফুপুর কী হয়েছে রে? মা কল করলে কল ধরে না?
-এমনি। মা সময় পায় না।
আদনান কোহেলি মামাতো, ফুপাতো ভাই-বোন। কোহেলি আদনানকে পছন্দ করতো। সেই জন্য ওর মা, ভাইয়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ছিলো। কিন্তু, আদনানের মায়ের এতে ঘোর আপত্তি ছিলো। আদনান ও কোনো দিন ও বোনকে বউ বলে মেনে নেবে না। তাই, কথা ওইখানে ইতি টেনে যায়। ভাইয়ের সাথে কথা বলা ও বন্ধ করে দেয়। তবে কোহেলি আদনানকে এখনো পছন্দ করে। আদনান বোঝে, তবে, কিছু বলে না। এক দিন ঠিক হয়ে যাবে।
কিচ্ছুক্ষণ হাঁটার পর কোহেলির হিলের বেল্ট ছুটে যায়। ও দাঁড়িয়ে পড়ে। হাতে ব্যাগ থাকার জন্য এক হাত দিয়ে বেল্ট লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে৷ ও হাতের ব্যাগ আদনানের হাতে দিয়ে বসে হিলের বেল্ট লাগাতে থাকে।
ও দূরে থাকা তুর্কির দৃষ্টিতে ধরা দেয় এই দৃশ্য। আদনান কারো ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তুর্কি চোখ ছোট ছোট ভালো ভাবে দেখতে থাকে। রেজুয়ানের উদ্দেশ্যে বলে,
-আপনার ভাইয়ের পাশে ওই মেয়েটা কে?
-মনে হয় ভাইয়ের এক্স।
রাগান্বিত দৃষ্টি নিয়ে তাকায় তুর্কি।
-এক্স মানে?
-সরি। মনে হয় আমার বোন। কোহেলি আপা।
রেজুয়ান আড়চোখে দেখে তুর্কিকে। আজ ওকে বাগে পেয়েছে। সব সময় ওর জন্য আদনানের কাছে বকা খায় ও। আজ সময় এসেছে। রাগে কিরমির করছে তুর্কি। রেজুয়ান এক বাটি ঘি ঢেলে দেয় আগুনে।
-ভাবি দেখছেন, আমার ভাই কত বড় চিটার? আপনি থাকতে ও অন্য মেয়ের ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে?
তুর্কি রাগে ফোসতে থাকে। পরপরই শান্ত হয়ে যায়। ওই বুড়ো লোক যার সাথে ইচ্ছে থাকুক তাতে ওর কি। ওর তো এমিতেই ওই বুড়ো লোকটাকে পছন্দ না। রেজুয়ান তুর্কির কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে আবারও বলে,
-আচ্ছা ভাবি, ভাইয়ের কি সত্যি পরিক্ষার গার্ড আছে? নাকি কোহেলি আপার সাথে কোথায় ও যাবে?
রাগী স্বরে তুর্কি বলে,
-আপনার জন্যই তো এই সব হলো। অসভ্য লোকের অসভ্য ভাই।
রেজুয়ান ভ্রু কুঁচকে বলে,
-আমার জন্য মানে?
-বিয়ের ঘটকালি কে করেছিলো?
রেজুয়ান খুস খুস করে কেশে বলে,
-আরে, আমি কি জানতাম আমার ভাই এমন। জানলে…
-সরুন সামনে থেকে। আজ আপনার ভাইয়ের এক দিন কি আমার এক দিন। উনি কি ভেবেছে উনার জন্য আমি জেয়ালার্স ফিল করবো। উনার মত বুড়ো একটা লোকের জন্য! উনি মেয়েদের সাথে রং করে বেড়াবে, আর আমি অন্য মেয়েদের মত ঢাল-তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করতে যাবো৷ কোনো দিন ও না।
এই বলে উল্টো ঘুরে তুর্কি। রেজুয়ান কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-কই যাচ্ছেন?
-যেথাই ইচ্ছা সেথায়!
তুর্কি লাল টকটকে একটা গোলাপ কিনে, কলেজ ক্যাম্পাসে ঠোকে। এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘুরিয়ে কাউকে খুঁজতে থাকে। বেশ অনেক্ষণ খোঁজা খুঁজির পর কাঙ্ক্ষিত মানুষের দেখা মেলে৷ তুর্কি লম্বা করে হেসে সেই দিকে এগিয়ে যেতে থাকে৷
সকালে যে ছেলেটা ওকে প্রপোজ করেছিলো; সেই ছেলেটার সামনে গিয়ে তুর্কি হাতের লাল গোলাপটা তুলে ধরে। মৃদু হেসে বলে,
-সকালের প্রপোজাল টা একসেপ্ট।
ছেলেটা হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থাকে। আশে পাশে অনেকে মানুষ ওদের দেখছে। ছেলেটার চাওনি দেখে তুর্কি লজ্জা পাওয়ার ভান করে বলে,
-আরে নেও নেও। সকালে বলছিলে না আমাকে পছন্দ করো। অনেক দিন ধরে পছন্দ করো। নেও তোমার প্রপোজাল একসেপ্ট।
-আরে বেগম সাহেবা, ফুলটা আরেকটু উপরে ধরতে হয়। ঠিক এই বরাবর।
তুর্কি বাড়িয়ে দেওয়া হাতের কবজি ধরে, আদনান আরেকটু উপরে তোলে হাত। আদনানের কণ্ঠস্বর শুনে ধক করে উঠে বুক। পরপরই ক্রোধ ছড়িয়ে যায় সর্বাঙ্গে। একটু আগে এক্সের সাথে ঢং করে, এখন আবার ওর কাছে এসেছে। তুর্কি এক ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নেয়৷ রাগে কটমট করতে করতে বলে,
-এখানে কী করছেন আপনি? দূর হোন এখান থেকে। আপনার এক্সের কাছে যান। এখানে এসেছেন কেনো?
-আগে প্রপোজ করো। ছেলেটা তো অপেক্ষা করছে।
-করবো না। তাতে আপনার কী?
-কিছুই না।
-ভাইয়া, আপনি যান এখান থেকে।
ছেলেটা ওদের কথোপকথন শুনে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করে। আদনান রেজুয়ানের উদ্দেশ্যে বলে,
-মীম, ওকে ধর। ও আরো অনেক বার আমার বউয়ের পিছু নিয়েছে। আমি আমার বউকে বাড়ি দিয়ে আসছি।
তুর্কি রাগে কটমট করতে করতে বলে,
-আমি আপনার সাথে কোথায় ও যাবো না। আপনি একটা অসভ্য লোক।
এই বলে ও কাঠ-বাগানের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকে। আদনানকে পিছু পিছু আসতে দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে, হাঁটার গতি চলমান রাখে।
-আপনি, কেনো আসছেন আমার পেছনে?
-সামনে দেখে হাঁটো, তা না হলে পড়ে যাবে।
– হাঁটবো না। চলে যান এক্সের কাছে।
-সামনে তাকাও।
-তাকাবো…আ…
কাদা মাখা একটা ছোট গর্তে পা পড়ে, উবু হয়ে পড়ে যায় তুর্কি। কাদা ছিটে শরীরে লাগে। দুই পা কাদায় মাখামাখি হয়ে যায়। তুর্কি পা ধরে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। আদনান তুর্কির কাছে এসে বলে,
– বড়দের কথা না শুলে এটাই হয়।
এই বলে তুর্কিকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। কোলে নিয়ে ক্যাম্পাসে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে। তুর্কি ভয়ে আদনানের গলা জড়িয়ে ধরে। ওর হাতে লেগে থাকা কাদা আদনানের শার্টের কলারর লাগে। তুর্কির সর্বাঙ্গে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে যায়। পরীক্ষা শুরু হওয়ার দরুন ক্যাম্পসে লোকজন কম। তুর্কি কম্পিত কণ্ঠে বলে,
-আপনি কী করছেন? আমাকে নামিয়ে দিন। সবাই দেখছে।
আদনান ধমকের স্বরে বলে,
-এক দম চুপ। অনেক্ষণ ধরে তোমার ফাজলামি সহ্য করছি। আর না। এখন আমি যা বলবো তাই শুনবে।
তুর্কি কিছু বলে না। আদনান ও-কে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কলেজের পুকুরের সামনে এসে থামে। পুকুরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলে,
-তোমার শাস্তি হিসেবে, তোমাকে এই পুকুরের পানিতে ডোবাবো আমি।
তুর্কি ভয়ে আদনানের গলা আরও শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে।
ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে,
-না..না স্যার…। আমি আর কোনো দিন ও ওই রকম করবো না।
-যখন করেছিলে তখন মনে ছিলো না?
শেষ সিঁড়িতে এসে থামে আদনান। তুর্কি ভয়ে চোখ মুখ খিঁচে ফেলে। এই লোক সত্যি সত্যি না ওকে ফেলে দেয়। আদনান তুর্কিকে কিঞ্চিৎ নিচু হয়ে নামে দেয়। তুর্কি আদনানের কোল থেকে নেমে জোরে শ্বাস নেয়৷ ছুটে পালাতে গেলে আদনান খপ করে ওর হাত ধরে ফেলে। কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-কই যাচ্ছো? চুপ চাপ দাঁড়াও এখানে।
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-শুনবো না আপনার কথা।
-কথা শুনতে হবে না। চুপ চাপ দাঁড়াও। হাতে-পায়ে কাদা লেগে আছে।
-তাতে আপনার কী?
প্রত্যুত্তরে আদনান কিছু বলে না।
তুর্কি দ্রুত বসে পুকুরের পানিতে হাত-পা ধোয়। বোরকায় লেগে থাকা কাদা আদনান ধুয়ে দেয়। পুকুরের পানি সবুজ। পাঁচটা হাস মনের আনন্দে সাঁতার কাটছে। তুর্কি হাত ধুয়ে আদনানের দিকে তাকায়। হাতে কিছু পানি নিয়ে আদনানের দিকে হাত বাড়ায়। আদনান ভ্রু কুঁচকে বলে,
-কী?
তুর্কি মিনমিনিয়ে বলে,
-আপনার শার্টে কাদা লেগেছে।
এই বলে তুর্কি হাতের পানি দিয়ে ওর শার্টের কলার ধুয়ে দেয়। তবে কাদের দাগ ভালো ভাবে উঠে না।
-উঠো। মলে যাবো।
-কেনো?
-বোরকায় কাদা লেগে আছে।
-তো?
আদনান তুর্কির হাত ধরে বলে,
-তো?
তুর্কি ভ্রু কুঁচকে বলে,
-মানে?
আদনান ও বলে,
-মানে?
তুর্কি রেগে গিয়ে বলে,
-আপনি আমাকে কপি করছেন কেনো?
-আপনি আমাকে কপি করছেন কেনো?
তুর্কি উল্টো ঘুরে বলে,
-আমি যাবো না আপনার সাথে। আপনি এক নাম্বারের অসভ্য লোক।
-আবারও কোলে তুলবো নাকি তাহলে?
-আচ্ছা ফাজিল লোক তো আপনি। একে তো আমাকে কপি করছেন আবার বলছেন কোলে তুলবেন। অসভ্য মার্কা খারাপ লোক।
-বুঝেছি, আমার বউ আবারো কোলে চড়তে ইচ্ছা হয়েছে।
আদনান তুর্কির দিকে এগোলে তুর্কি ভয়ে পিছিয়ে যায়। আদনান তুর্কির ভয় দেখে ঠোঁট টিপে হাসে৷ তুর্কি রাগে গজগজ করতে করতে আগে আগে হেঁটে চলে।
তৃপ্তি প্লাজারে গিয়ে আদনান তুর্কিকে নতুন বোরকা কিনে দেয়৷ তুর্কি চেঞ্জিং রুম থেকে চেঞ্জ করে আসে। মল থেকে নামতে নামতে বলে,
-কী হয়েছে?
তুর্কি কঠিন স্বরে বলে,
-কিছু না।
তুর্কি আর কিছু না বলে চলে যায়।
রাতে সবাই এক সাথে খাবারের টেবিলে বসেছে। হুমাইরা, রচনা, তুর্কি খাবার পরিবেশন করছে। বাড়ির পুরুষেরা আগে বসেছে। সাথে মোহোনা সূচনা। সবাই খোশগল্পে মত্ত। মুমিনুল ব্যাবসা নিয়ে কথা বলছে। আদনান কথার ফাঁকে ফাঁকে, ওর বউটার দিকে তাকাচ্ছে। কলেজ থেকে আসার পর বউটার সাথে, একবার ও কথা হয়নি। যতই ঝগড়া হোক, বউটার সাথে কথা না বললে যে ওর ভালো লাগে না, সে কথা একে কি ভাবে বোঝাবে?
আদনানের উপর দৃষ্টি পড়তেই তুর্কি দ্রুত মুখ বাঁকিয়ে, দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। কলেজের ওই ঘটনার পর আর ওদের মাঝে কথা হয়নি।
এই লোককে ওর দেখতে ইচ্ছা করছে না। এই লোক এক নাম্বারের ধান্দাবাজ। ঘরে বউ থাকা সত্ত্বেও অন্য মেয়েদের সাথে রং-ঢং করে বেড়ায়। আবার ঘরে এসে ওর সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে৷ এই লোকের মিষ্টি কথায় ও আর ভুলবে না।
পুরুষেরা খাবার খেয়ে উঠে যায়। আদনান হাত ধুতে ধুতে রান্নাঘরের দিকে উঁকি দেয়। তুর্কি উবু হয়ে, কি যেনো বাড়ছে। ও গলা ঝেড়ে বলে,
-পায়ের ব্যথা কি কমেছে?
তুর্কি না ঘুরে জবাব দেয়
-হুম।
-খাওয়া শেষ হলে রুমে এসো। কথা আছে।
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-আমার আপনার সাথে কোনো কথা নেই। চুপ চাপ চলে যান।
-কথা নেই এইটাই অনেক কথা। সব শুনবো আমি। খাওয়া শেষ হলে সোজা রুমে এসো।
এই বলে আদনান চলে যায়। তুর্কির মাছের বাটি হাতে নিয়ে দাঁড়ায়। বয়ে গেছে ওর ওই লোকের কথা শুনতে অসভ্য একটা লোক।
রচনা, তুর্কি, হুমাইরা পাশাপাশি বসে খাবার খাচ্ছে। তিনজনে মিলে বিভিন্ন খোশগল্পে করছে। তুর্কির পরনে হুমাইরার শাড়ি। তবে, আজ কুচি ছাড়া পড়েছে। মাছের বাটিতে মাছ আছে দুই পিস। হুমাইরা একটা পিস রচনার প্লেটে দেয় আরেকটা তুর্কির প্লেটে৷ নিজে বেচে যাওয়া কিছু ঝোল আর সবজি নেয়। হুমাইরার প্লেটে মাছের পিস না দেখে তুর্কি ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,
-মা, তোমার প্লেটে মাছ কই?
হুমাইরা খাবার চিবাতে চিবাতে বলে,
-আমি বুড়া মানুষ। আমার এত মাছ খেতে হবে না। তোরা খেলেই হবে।
-এইটা কোন ধরনের কথা? কিসের বুড়ো হয়েছো? আমার মা-রা কখনো বুড়ো হবে না।
তুর্কি নিজের প্লেট থেকে অর্ধেক মাছ ভেঙে হুমাইরার প্লেটে দেয়। হুমাইরা কিছু বলতে গেলে তুর্কি বলে,
-কোনো কথা না। চুপ চাপ খাও। মা বলে সব সময় মিলে মিশে থাকতে। চুপ চাপ শেষ করো।
-আমার পাগল মেয়ে।
ড্রেসিং টেবিল গোছাচ্ছিলো হুমাইরা। আর অনর্গল বকে চলেছে আলামিন কে। এই ঘর সে বার বার গোছায়। আর আলামিন বারবার অগোছালো করে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে মুছার সময় পেছন থেকে আদনান হুমাইরা খোঁপায় একটা ফুল গেঁথে দেয়। হুমাইরা অবাক হয়ে আয়নার দিকে তাকায়। খোঁপায় হাত দিয়ে ছেলের উদ্দেশ্যে বলে,
– কিরে? কি দিলি?
আদনান হুমাইরার কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বলে,
-আমার জীবনের প্রথম ফুলকে, একটা ফুল দিলাম। কী অপরুপ লাগছে!
হুমাইরা মুচকি হেসে ছেলের মাথায় আলতো করে চড় দিয়ে বলে,
-এখন কি আমাকে ফুল দেওয়ার সময়? আমার মেয়েটাকে দে। তোরা খুশি থাকলে আমি খুশি।
আদনান মুচকি হেসে বলে,
-আমার জীবনে দুইটা ফুল। প্রথম ফুল আমার মা। দ্বিতীয় ফুল আমার বউ। তোমরা দুই জনি আমার কাছে ভীষণ দামী।
এখন একটা সুই-সুতা দেও তো।
হুমাইরা ভ্রু কুঁচকে বলে,
-সুই-সুতা দিয়ে কী করবি?
আদনান মায়ের কাঁধ থেকে মাথা উঠিয়ে বলে,
-তোমার মেয়ের জন্য একটা মালা গাঁধবো।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আলামিন বলে,
-লাভ নেই বাবা, লাভ নেই। মেয়ে মানুষের রাগ ওতো সহজে ভাঙানো যায় না। কী নিয়ে রাগ করে সেটা ও বলে না। আবার কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলে কিছু হয়নি। এই যে তোর মায়ের রাগ ভাঙ্গাতে ভাঙ্গাতে কবরে যেতে চললাম; কিন্তু, আজ ও সঠিক ভাবে জানতে পারলাম তার রাগের কারণ।
হুমাইরা সুই-সুতার বক্স নিয়ে আসে৷ আলামিনের উদ্দেশ্যে চোখ রাঙিয়ে বলে,
-ছেলের সামনে কী সব কথা-বার্তা? বুড়ো হয়ে গেলে তবু ও লজ্জা-শরম হলো না।
আলামন এগিয়ে এসে বলে,
হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ২৩
-আরে, আমার ছেলেকে একটু ট্রেনিং দিচ্ছি। নতুন নতুন বিয়ে করেছে। ওর একটু জানা উচিত মেয়ে মানুষের রাগের সম্পর্কে । শোন বাবা, তাড়াতাড়ি যা। বেশি দেরি হলে আবার দেখবি, রণচণ্ডী কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিয়েছে।
এই বলে দুই বাপ বেটা হো হো করে হেসে উঠে। হুমাইরা ভ্রু কুঁচকে দুই বাপ ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে।