ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ১৬

ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ১৬
মাহিরা ইসলাম মাহী

অবশেষে তাসফি সকল কাজ পাশ কাটিয়ে আটঘাট হয়ে বসলো কিছু বলার উদ্দেশ্যে।
তার মুখচোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে সিরিয়াস কিছু বলবে তা নিশ্চিত।
তাসফি আর সুজন দুজনে কিছু ফিসফিস করে বলছে।
নিস্তব্ধ কান খাড়া করে তা শুনতে চেষ্টা চালালো তবে সফল হলো না বোধহয়। তাই তো তার মুখে বিরক্তি আভা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
নিস্তব্ধ বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো এই পর্যায়ে।

“ তুমি কি কিছু বলবে? নাকি রুমে যাবো? কোনটা?”
তাসফি নিস্তব্ধ’র পানে ভ্রু কুঁচকে চায়। আহাঃ কি তেজ।এই বয়সে এসেও তার ডাক্তার সাহেবের তেজের ঘাটতি নেই।
সুজন উঠে এসে নিস্তব্ধ’র কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
“ আর ইউ জেলাস ভাই?”
“ হোয়াট..?”
সুজন নিস্তব্ধকে নিজের পাশে বসিয়ে দিলো।
বলল,
“ জেলাস হলেও কিছু করার নেই বন্ধু। এই তাসফি শুরু করো তো ছেলে মেয়ে কে কতক্ষণ বসিয়ে রাখবে।পাকা কথা সাড়তে হবে তো নাকি।”
সাদাফ, নিস্তব্ধতা একে অপরের দিকে আঁড় চোখে চাইলো।চোখে চোখ পরতেই ছিটকে সরিয়ে নিলো। যেন বড্ড ভুল কিছু করে ফেলেছে দুজনে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ শুনুন ডাক্তার সাহেব, মেয়ের পক্ষ থেকে আমি,শ্বাশুড়ি মা আর ছেলে পক্ষ থেকে সুজন আমরা ঠিক করেছি এবারে আমাদের সাদাফ আর নীরুর দুই হাত এক করে দেব বুঝলেন।”
নিস্তব্ধ’র রিয়েক্ট করার আগে সাদাফ আর নিস্তব্ধতা এক প্রকার আঁতকে উঠলো,
“ অসম্ভব। “
দুজনের মুখে একই বুলি।
নিস্তব্ধ সহ সুজন, তাসফি ছেলে মেয়ের দিকে চোখ ছোট ছোট করে চাইলো।
তাসফি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাদাফকে জিজ্ঞেস করলো,
“ তুই আমার মেয়েকে পছন্দ করিস না?”
“ হ্যাঁ..না মানে. না.।”
সাদাফ থতমত খেল।
তাসফি পুমরায় জিজ্ঞেস করলো,

“ হ্যাঁ কি না তে উত্তর দে? আমার মেয়েকে পছন্দ করিস না তুই?”
সাদাফ উঠে দাঁড়িয়ে চোখ টালু মালু করে আমতা আমতা করে বলল,
“ কি যে বলো না আন্টি, আমার কি বিয়ে করার বয়স হয়েছে বলো?”
তাসফি নিস্তব্ধ’র পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বলল,
“হ্যাঁ সেটাই তো। তোর বিয়ে করার বয়স হয় নি,তোর আঙ্কেলের শ্বশুর হওয়ার বয়স হয়নি।শুধু আমার মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে আর আমার শ্বশুড়ি হওয়ার তাই না বল?”
সাদাফ মুখ কাচুমাচু করলো।
নিস্তব্ধ বউয়ের টিটকারিতে থতমত খেল।
সুজন অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

“ তুই আমার এই হতভাগা পান্ডা কে পছন্দ করিস না মা?”
নিস্তব্ধতা দিশেহারা বোধ করলো।
“ তোমার ছেলে কি আমায় পছন্দ করে বলো আঙ্কেল? তবে আমি কেন তোমার বাউণ্ডুলে, হতভাগা ছেলেকে পছন্দ করতে যাবো বলো তো?”
সাদাফ, নিস্তব্ধতা দুজন দুদিকে হাঁটা দিলো।
একসঙ্গে একে অপর কে ক্রস করতে গিয়ে ধাক্কা খেল জোড়ছে।
নিস্তব্ধতা রক্তচক্ষু বদনে চাইলো সাদাফের পানে।
যেন চোখ দিয়েই তাকে ভষ্ম করে দেওয়ার পায়তারা।
সাদাফ মুখ কাচুমাচু করে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলো।
নিস্তব্ধতা ওও উদ্যত হলো পাশ কাটাতে।
পুনরায় ধাক্কা খেল কাঁধে কাঁধে।

নিস্তব্ধতা এবার অসম্ভব রেগে হনহন করে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।
সাদাফ কোনো রকমে মুখ বাঁচিয়ে পালালো সদর দরজা খুলে।
ড্রয়িংরুমে উপস্থিত, নিস্তব্ধ, তাসফি, সুজন, আশা, অনিমা বেগম সহ নিলয় সাহেব চোখ পিটপিট করে চেয়ে দুজনের কার্যকলাপ অনুধাবন করতেই ব্যস্ত।
তাসফি, সুজন দু’জন দুজনের দিকে হতভম্ব হয়ে চাইলো।
তাদের চোখে বিস্ময়।
মিয়া বিবি রাজি তো ডাকো গিয়ে কাজি।
কিন্তু এখানে তো খাটছে উল্টো প্রবাদ।
“যাদের বিয়ে তাদের খবর নাই পাড়া পড়শির ঘুম নাই।”
আশ্চর্য। আশ্চর্য।
কেস টু জমে ক্ষীর হওয়ার আগে পেঁকে হলুদ হয়ে জন্ডিস হয়ে গেল।

উত্তপ্ত সকালে সূর্য্যিমামার আগমন ধরণীতে ভীষণ নাটকীয় ভঙ্গিমায়।
এই তো মাহরিসা দেখলো সকাল সাতটা বাজে আকাশে মেঘের আস্তরণ।
অথচ ঘন্টা খানেক কাটতেও বৃষ্টি বাবাজীবনের হদিশ পাওয়া বৃথা চেষ্টা চালালো।
কিন্তু আকাশ বাবাজীবন সে ঠিক গিরগিটির ন্যায় রঙ পাল্টে পুনরায় নিজেকে আকাশী রঙে আচ্ছাদিত করে নিয়েছে।
মাহরিসার মেজাজ খারাপ হচ্ছে।
কলেজে না যাওয়ার পায়তারা করে লাভ হলো না। এবারে তাকে যাওয়ার যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে।
কলেজে আজ সে পৌঁছালো হাঁফাতে হাঁফাতে।
রোশনীর পাশে গিয়ে বসলো কোনো রকমে, ক্লাসের টাইম হয়ে গেছে।
তাও আবার কার ক্লাস তার আদু ভাইয়ের।হাহ।
অসহ্য লোক।শুধু তাকে ধমকায়। কেন সে তার কোন ক্ষেতের ফসল সাঁফ করেছে শুনি।
রোশনী মাহরিসার কাঁধে হাত রাখে।
ফিসফিস করে বলে,

“ এই জানিস আজ কি হলো?”
“ তুই না বললে জানবো কেমন করে রসুনের খোসা?”
“ মারু অফ যা প্লিজ দোস্ত।আস্ত রসুন বল, অন্তত খোসা বলে অপমান করিস না প্লিজ।”
মাহরিসা দাঁত কেলিয়ে হাসলো।
রোশনী উত্তেজিত ভঙিতে বলল,
“ আদ্রিত স্যারের সঙ্গে ডাঃস্মৃতি এসেছিলেন দেখিস নি?”
“ দেখেছি তো?”
“ স্যারকে কিন্তু মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করতে দেখা যায় না। “
“ তো স্যার কি তার ছাত্রীর সামনে মেয়ে নিয়ে ঘুরবে?”
রোশনী বোঝানোর তাগিদে আরো ফিসফিস করে বলল,

“ তুই বুঝতে পারছিস না মারু।আমি বলতে চাইছি আদ্রিত স্যার কিন্তু স্মৃতি ম্যামের সঙ্গে ভালোই মেলামেশা করেন। সেদিন তাদের শপিংমলেও দেখলাম একসঙ্গে। ওনারা কি রিলেশনে আছেন নাকি বলতো?”
মাহরিসার মেজাজটা হঠাৎ আরো বিগড়ে গেল।
আদ্রিতের রিলেশনের কথা শুনে তার মেজাজ কেন গরম হবে? হোয়াই?
মাহরিসা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ তোর আদ্রিত স্যারের রিলেশন স্মৃতি ম্যামের সঙ্গে না স্মৃতি হারা ম্যামের সঙ্গে সেটা আমি জানি?
তোর কি মনে হয় আমি পড়ালেখা চাঙ্গে তুলে তোর আদ্রিত স্যারের পেছনে স্পাইগিরি করে বেড়াই? তিনি কখন ডেটে গেল না কার সঙ্গে রিলেশন করলো?”
মাহরিসা রাগ করে উঠে দু বেঞ্চ পিছনে গিয়ে বসলো।
রোশনী হতভম্ব বোদনে চেয়ে রইলো মাহরিসার পানে। সে কি এমন বলল? তার বোকা মারু হঠাৎ এত রিয়েক্ট করলো কেন। আশ্চর্য।

আদ্রিতের ক্লাসে আগমন ঘটলো যথা সময়ে।
আদ্রিত ক্লাসে প্রবেশ করার পরেও সকলের ন্যায় মাহরিসা আজ উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালো না।
জেদ করে বসে রইলো। মাহরিসার পরনে আজ ব্লু ফ্রক।উপরে এপ্রোন।
আদ্রিত ভ্রু কুঁচকে চাইলো মাহরিসার পানে।
থমথমে কন্ঠে মাহরিসার দিকে আঙুল তাক করে বলল,
“ মিস ব্লু? ভদ্রতা শেখেন নি? স্টান্ড আপ।”
মাহরিসা দাঁড়ালো না জেদ করে আরো চেপে বসে রইলো।
তার চিৎকার করে আদ্রিতের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলতে ইচ্ছা হলো,
“ ভদ্রতা তোর গালফেন্ড কে গিয়ে শেখা রে হাঁদা আমায় তোর ভদ্রতা শেখাতে হবে না। আমি দাঁড়াবো না, দাঁড়াবো না, দাঁড়াবো না। তাতে তোর কি। হুহ। তোর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে এই মাহরিসার বয়েই গেছে।”
“ স্টান্ড আপ।”

এবারে আদ্রিতের ধমকে কেঁপে উঠে মাহরিসা পড়িমরি করে উঠে দাঁড়ালো।
আদ্রিত ধমকে বলল,
“ আউট, আউট।”
মাহরিসা হন হন করে বেরিয়ে গেল।
বিরবির করতে করতে আদ্রিতের গুষ্টি উদ্ধার করলো।
“ পারিস ই তো শুধু আমার মতো ছোট্ট খাট্টো বাচ্চা মেয়েকে ধমকাতে।আর তোর গালফেন্ড নিয়ে ডেটে যেতে। শপিং করতে।হতচ্ছাড়া। বেয়াদব। ফেল্টুস, আদু ভাই কোথাকার।”
মাহরিসার ভেতরকার সত্তা তার উপর তীর্যক হেসে বলে, তোর আদু ভাই ফেল্টুস আদু ভাই হলে কি করে ডাক্তারী পড়াচ্ছে তোদের বল দেখি?
বাহিরে এসে দাঁড়াতেই মাহরিসার ফোনের মেসেজ টোম বেজে উঠলো।
সঙ্গে সঙ্গে জিভে কামড় দিলো সে। ইশশ আজ ফোন সাইলেন্ট করতেই ভুলে গেছে।
ফোন বের করে সাইলেন্ট করতে নিতেই আদ্রিতের কেবলের দেওয়া মেসেজ চোখে বাঁধলো।
তাতে তার মেজাজ আরো বিগড়ালো,

“ তোর বাপের কি টাকা পয়সার অভাব পরেছে? যে তাই সেলাই খোলা, ফাটা এপ্রোন পরে চলে এসেছিস? বাসায় যা। তোর ক্লাস করতে হবে না। খবরদার যদি এপ্রোন খুলে প্রত্যেকটা ক্লাস করেছিস শুধু জামা পড়ে ওই এপ্রোন খুলে আমি তোর গলায় বাঁধবো।”
মাহরিসা চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলো।
একসঙ্গে রাখা দুটো এপ্রোনের তাড়াহুড়োয় ভুল করে ভুলটাই শেষমেষ পরিধান করে এসেছে সে।
মাহরিসা বাড়ি গেল না। আর না তো এপ্রোন খুললো।
দেখাক লোকটা জেদ। সে ও দেখাতে পারে।
মাহরিসা আর ভয় পাবে না আদ্রিতের ধমকে।
তার ভেতরকার সত্তা হাসতে হাসতে তিরস্কার করে বলে,

ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ১৫

“ তুমি ভয় পাবে না তোমার আদু ভাইয়ের ধমকে তা কি হয় বলো? মনে নেই ছোট সময়ে কেমন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে। এত সহজে বদলাতে পারবে? পাল্টে ফেলতে পারবে পুরোনো অভ্যাস?”
মাহরিসা নিজেকে ভীষণ করে শাসায়।
ক্লাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাহরিসা আজ আদ্রিত কে দেখিয়ে দেখিয়ে ছুটে যায় তার সদ্য হওয়া ছেলে বন্ধুদের কাছে। এর পরিণতি সে জানতে চায় না।

ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ১৭