হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ২৬
তোয়া নিধী দোয়েল
সন্ধ্যার পর মুহূর্ত। পশ্চিম দিগন্তে জ্বলজ্বল করছে ছোট শুকতারা। পাখিরা যার যার নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। পরিবেশে নামছে নিস্তব্ধতা। ধীরে ধীরে অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে পরিবেশ।
আদনান বাসায় নেই। তাই তুর্কি রাণী, নামাজ আদায় করে মুক্ত ফড়িং এর মত তিড়িং বিড়িং করছে। আগামীকাল কলেজে বসন্ত উৎসব। সেই আনন্দে নাচ্ছে ওর মন। কীভাবে সাজবে, কোন শাড়ি পরবে তাই ভাবছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ওর নিজের শাড়ি বলতে বিয়ের শাড়ি আর আদনানের দেওয়া সেই লাল শাড়ি আছে। বিয়ের শাড়ি তো আর পড়া যাবে না। রইলো পরে আদনানের শাড়ি। ওর ঐ রকম লাল টকটকে শাড়ি পড়তে ইচ্ছে করছে না। তাই ও ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে উঠে, হুমাইরার ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। শাশুড়ী মায়ের এত শাড়ি থাকতে ও কিনা কোন শাড়ি পড়বে তাই নিয়ে ভাবিছে!
হুমাইরা মাগরিবের নামাজ আদায় করে, তসবিহ্ পড়ছিলেন। তুর্কি দরজা দিয়ে ইঁদুরের মত মাথা বের করে, হুমাইরার অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে। তারপর এক পা এক পা করে ধীর গতিতে হেঁটে আসে। হুমাইরাকে পেছন থেকে জরিয়ে ধরে, কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বলে,
-কী করছো?
হুমাইরা এক হাত দিয়ে তুর্কির মাথায় হাত দেয়। তসবিহ্ পড়া শেষ করে চুমু দিয়ে পাশে রাখে। তারপর, তুর্কিকে দুই হাত দিয়ে সামনে এনে বসায়। মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করে,
-কিরে কিছু বলবি?
তুর্কি কুণ্ঠাবোধ করে। ও উপরে নিচে মাথা নাড়ায়। হুমাইরা তুর্কির দিকে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। তুর্কি গলা ঝেড়ে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-কাল কলেজে বসন্ত উৎসব। আমার কোনো শাড়িই নেই। তোমার শাড়ি গুলা দেও না!
হুমাইরা কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-আমার তো সব আদিম যুগের শাড়ি। আর কাল কলেজে অনুষ্ঠান। পুরানো শাড়ি কেউ পড়ে?
-কি করবো বলো। আমার বিয়ের শাড়ি ছাড়া আর তো কোনো শাড়ি নেই। আর ওই সব তো অনুষ্ঠানে পড়া যায় না।
হুমাইরা কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলে,
-রাজ কোথায়?
-জানিনা। বিকেলে তো বাজারে গেয়েছিলো। এখন বোধহয় মসজিদে।
হুমাইরা বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে,
-আই তো আমার সাথে। এতক্ষণে বোধহয় এসেছে।
তুর্কি ভ্রু কুঁচকে বলে,
-উনাকে দিয়ে কী করবে?
-আরে আয়। কথা বাড়াস না।
হুমাইরার কথা বোধগম্য না হলে ও, মনে দ্বিধা নিয়ে হুমাইরার পিছু পিছু যেতে থাকে তুর্কি।
আদনান স্টাডি টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কি যেনো খুঁজছিলো। দরজা খোলা ছিলো৷ হুমাইরা আগে প্রবেশ করে। তার পেছন পেছন আসে তুর্কি।
-রাজ!
মায়ের ডাক শুনে পেছনে তাকায় আদনান। হুমাইরার কণ্ঠস্বর শনে তুর্কি কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে যায়৷ ও হুমাইরার পেছনে দাঁড়িয়ে আদনানের দিকে তাকায়। আদনান সম্পূর্ণ মায়ের দিকে ঘুরে বলে
-কী হয়েছে মা? কিছু বলবে?
হুমাইরা বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
-কী হয়েছে তোর? সমস্যা কি?
আদনান ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তুর্কি ও ভ্রু কুঁচকে তাকায় হুমাইরার দিকে। ওদের মধ্যে তো কিছু হয়নি। তাহলে মা এই কথা বলছে কেনো? আদনান তুর্কির দিকে দৃষ্টি নিয়ে বলে,
-কই? কিছু না তো।
হুমাইরা আবারও গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
-সত্যি কিছু না?
আদনান ডানে বামে মাথা নাড়ায়। কী হবে ওর? নাকি তুর্কি কোনো কথা বলেছে ওর নামে? কিই বা বলবে? ওদের মধ্যে তো কোনো ঝগড়া হয়নি।
হুমাইরা তুর্কির দিকে তাকিয়ে বলে,
-যদি কিছু নাই হয়ে থাকে, তাহলে আমার মেয়েকে কেনো একটা নতুন শাড়ি কিনে দিস নি? ওর নাকি কাল কলেজে উৎসব।
মায়ের কথা শেষ হতে, আদনান তুর্কির দিকে কপালে ভাঁজ ফেলে তাকায়। ওর যে শাড়ি লাগবে, এমন কিছু তো ওকে বলে নি। ও জোরে শ্বাস ছাড়ে। ঐ দিন যে শপিং এ গিয়েছিলো, কই কিছু তো বললো না। অথচ এখন মায়ের কাছে বিচার নিয়ে গেছে! এই মেয়েটাকে নিয়ে ও কি করবে! ও কি শাড়ি চাইলে মানা করতো! আদনান মায়ের দিকে দুই পা এগিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
-তোমার মেয়ের যে শাড়ি লাগবে, ও কি এক বার ও আমার কাছে বলেছে?
তুর্কি ও অবাক হয়ে যায় হুমাইরার কথা শুনে। ওর তো নতুন শাড়ির প্রয়োজন নেই! একটা শাড়ি হলেই হলো। ও দ্রুত হুমাইরার হাত ধরে বলে,
-মা মা আমার তো নতুন শাড়ির প্রয়োজন নেই। তোমার একটা….
তুর্কির কথা শেষ হওয়ার আগেই হুমাইরা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
-থাম! প্রয়োজন নেই মানে। অবশ্যই আছে।
তারপর আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-তোর কি এখন কোনো কাজ আছে? না থাকলে ওকে নিয়ে টাউনে যা একটু। সুন্দর থেকে একটা শাড়ি কিনে এনে দে।
আদনান তুর্কির দিকে তাকায়। এ মেয়ে এমন কেনো? এত ভালোবাসা দেই তবু ও বোঝে না। কিঞ্চিৎ অভিমানী স্বরে বলে,
-তোমার মেয়ে আমার কাছে বলেই পারতো। অযথা, তোমাকে বিরক্ত করতে গেছে।
এরপর ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলে,
-রেডি হতে বলো।
হুমাইরা তুর্কির দিকে তাকিয়ে বলে,
-যা মা। সুন্দর থেকে শাড়ি নিয়ে আসবি৷ কলেজে উৎসব পুরনো শাড়ি কেনো পড়বি৷ তাড়াতাড়ি যা।
-আম্মু…।
-তাড়াতাড়ি কর।
এই বলে চলে যায় হুমাইরা। তুর্কি হুমাইরার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে। কি থেকে কি হয়ে গেলো! আদনান ওকে কি না কি ভাবছে। ওর তো নতুন শাড়ির প্রয়োজন নেই। ক্ষণ মুহূর্ত পর ওয়াশরুম থেকে বের হয় আদনান। তুর্কি কে ঐ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
– টাইম ওয়েস্ট করার মত টাইম নেই আমার। যাঁর যাওয়ার দরকার সে যেনো একটু ফাস্ট করে।
ঘাড় ঘুরিয়ে আদনানের দিকে তাকায় তুর্কি। আদনান ততক্ষণে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে৷ ওর কণ্ঠ স্বর অন্য রকম লাগায় তুর্কির বুকের ভেতর কেমন যেনো করে উঠে। আদনান কি রাগ করলো! ও আদনানের দিকে এগোতে চাইলে, গম্ভীর কণ্ঠে আবারো ভেসে আসে,
-ফাস্ট!
আদনানের গম্ভীর কণ্ঠ শুনে থেমে যায় তুর্কি পা যুগল। আর সাহস পায়না সামনে এগোনোর। যদি আরও কিছু বলে!
মত্ত থেকে মানিকগঞ্জ টাউন বেশি দূরে নয়। মাত্র ২০ থেকে ৩০ মিনিটের মত সময় লাগে। দুইজন পাশাপাশি একটা রিকশায় বসে যাচ্ছে। অথচ, কেউ কোনো কথা বলছে না। তুর্কি আড়চোখে আদনানকে দেখছে। লোকটা কেনো কথা বলছে না? অন্য সময় হলে তুর্কি একাই কথা বলে ফেনা তুলে ফেলতো। কিন্তু, এখন ওর কেমন যেন লাগছে। নিজেই যেন কথা বলতে জড়তা অনুভব করছে! কিছুক্ষণ এইভাবেই পার হওয়ার পর তুর্কি অধৈর্য হয়ে যায়। লোকটা কেনো ওর সাথে কথা বলছে না। ও খুস খুস করে কেশে আদনানের মনযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু, ফলাফল শূন্য৷ আদনান কিছুই বলে না। যদি ও আড় চোখে তাকিয়ে ছিলো, যা দৃষ্টিগোচর হয়নি তুর্কির৷ তুর্কি শান্ত কণ্ঠে ডাকে,
– স্যার!
ততক্ষণে ওরা গন্তব্যে পৌঁছিয়ে গেছে। আদনান ওর ডাক শুনে ও কিছু বলে না। চুপচাপ রিকশা থেকে নামে। রিকশাওয়ালাকে ভাড়া চুকিয়ে তুর্কির দিকে তাকায়। ও ঠায় ওখানেই বসে আছে। আদনান ভ্রু কুঁচকে, কণ্ঠে কিঞ্চিৎ বিরক্তি এনে বলে,
-নামনা কেনো?
তুর্কি শোধবোধ ফিরে পেয়ে, দ্রুত রিকশা থেকে নামে। আদনান ওকে ইশারা করে সামনে এগিয়ে যেতে।
-হাঁটো।
তুর্কি অন্য দিকে তাকিয়ে মিনমিনেয়ে বলে,
-স্যার, আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।
কোনো উত্তর না পেয়ে তুর্কি পাশে তাকায়। ততক্ষণে আদনান দোকানের ভেতরে চলে গেছে। তুর্কিকে আশে পাশে না দেখতে পেয়ে আদনান পেছন ফিরে তাকায়। ওকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-আসো না কেন?
আদনানের কথা শুনে, তুর্কি হতাশার শ্বাস ফেলে দোকানে ঢোকে। এই লোকতো ওর কথাই শুনছে না। ও কি ভাবে বলবে, ওর শাড়ির দরকার নেই। শাড়ি বিক্রেতা এক এক শাড়ি বের করে তুর্কিকে দেখাতে থাকে। আদনান তুর্কির পেছনে দাঁড়িয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। তুর্কি একটা টুলের উপর বসে শাড়িতে হাত দিয়ে দেখছে। কিন্তু, ওর কোনো শাড়িই পছন্দ হচ্ছে না। ওর মাথায় শুধু একটাই চিন্তা, আদনান রাগ করেছে! এত শাড়ির মধ্যে ও যখন ওর কোনো শাড়িই ভালো লাগছে না, তখন ও ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,
– স্যার, কোনটা নেবো?
আদনান শাড়ি গুলোকে এক পলক দেখে বলে
-তোমার যেটা ভালো লাগে।
তুর্কি মিনমিনিয়ে বলে,
-আপনি একটু পছন্দ করে দিন না। আমি পারছি না।
আদনান বুকে থেকে হাত নামিয়ে, এক হাত দিয়ে কয়েকটা শাড়ি উলটিয়ে পালটিয়ে দেখে একটা লাল শাড়ি এগিয়ে দেয়।
-এইটা নিতে পারো।
তুর্কি লাল শাড়িটার দিকে তাকয়ে ভ্রু কুঁচকায়। এই লোকের এত লাল জিনিস পছন্দ কি ভাবে হয়? অন্য সময় হলে তুর্কি কখনই নিতো না। কিন্তু, এই মূহুর্তে ওর এটাই ভালো লাগছে৷ যেহেতু আদনান পছন্দ করে দিয়েছে। তুর্কি আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-এই লাল টা।
আদনান উপরে নিচে মাথা নাড়ায়।
-হুম।
তুর্কি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ঐ-টাই প্যাক করতে বলে। দুইজন শাড়ি কিনে বের হয়। আদনান তুর্কির উদ্দেশ্যে বলে,
-আরও কিছু লাগবে নাকি বলো। পরে আবার মায়ের কাছে বিচার নিয়ে যেও না।
তুর্কি দ্রুত কণ্ঠে বলে,
– স্যার, আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।
-কী?
-আমি আম্মুর কাছে কোনো বিচার দেইনি। আম্মু একাই আপনাকে বলেছে।
আদনান অন্য দিকে ফিরে বলে,
-কথাটা বিচার দিয়ে না। আমি মায়ের কাছে কতটা নিচু হলাম দেখেছো? মা কি ভাবিছে, যে আমি তোমার অভাবে রাখি। তোমার কোনো প্রয়োজনীয় কোনো কিছু দিতে চাই না।
তুর্কি আদনানের বাহু চেপে ধরে বলে,
– স্যার! এই রকম কিছু না। কসম, আমি আম্মুর কাছে শাড়ি আনিতে গিয়েছিলাম। আমার বিয়ের শাড়ি ছাড়া আর কোনো শাড়ি নেই। সেইজন্য।
তুর্কির কণ্ঠ একটু ভেজা শোনায়। আদনান দ্রুত ওর দিকে ঘোরে। মেয়েটা কি কান্না করছে! হায় আল্লাহ্! আদনান দ্রুত ওর হাত চেপে ধরে বলে,
-আরে, এই মেয়ে কান্না করছো নাকি।
তুর্কি ওর চোখে হাত দেয়। ও কি কান্না করছে! না ও তো কান্না করতে চাইনি৷ শুধু আদনানকে বোঝাতে চেয়েছে৷ চোখে পানি আবার কই থেকে চলে আলো। ও কিঞ্চিৎ অভিমানী স্বরে বলে,
-কী করবো। আপনি রাগ করেছেন। আমার সাথে কথা বলেন না। আমাকে বিশ্বাস ও করেন না।
-ওকে ওকে! থামো। আমি রাগ করেনি।
তুর্কি কিঞ্চিৎ তেজি স্বরে বলে,
-তাহলে আমার সাথে কথা বলেন না কেনো? আমাকে বিশ্বাস করেন না কেনো? আমি সত্যি আম্মুর কাছে কোনো বিচার দেইনি৷ আম্মু একাই এসেছে।
-হ্যাঁ হ্যাঁ! বিশ্বাস করেছি। আমারই ভুল হয়েছে। তোমাকে আগেই শাড়ি কিনে দেওয়া উচিত ছিলো।
-আবার রাগের কথা বলছে?
আদনান স্মিত হেসে বলে,
-না। আমার খেয়েল নেই যে আমার পিচ্চি বউয়ের শাড়ি নেই। উফফ! কি ভাবে যে ভুলে গেলাম। যাইহোক, কি খাবে এখন বলো।
তুর্কি মিনমিনিয়ে বলে,
-সত্যি আর রাগ নেই তো?
আদনান আবারও মৃদু হেসে ডানে বামে মাথা নাড়ায়। তুর্কি ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে,
-ফুসকা আর আইসক্রিম খাবো।
-ওকে চলো।
সকাল থেকে রেডি হচ্ছে তুর্কি। লাল শাড়ি পড়ে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এক মনে শাড়ির কুচি করে যাচ্ছে। কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে হুমাইরা এখনো আসছে না। মোহোনা সূচনা ও বাসায় নেই। শাড়ির কুচি কে ধরে দিবে। ও কুচি করা শেষ করে দরজার দিকে যায়। হুমাইরা কে ডাকে। কিন্তু, সে কোনো উত্তর দেয় না। তুর্কি বিরক্ত নিয়ে আবারও আয়নার সামনে যায়। আদনান পাঞ্জাবির হাতা ভাঁজ করতে করতে ভেতরে ঢুকে৷ তুর্কি কে লাল শাড়িতে দেখে নিচের ঠোঁট উলটায়। জাহিদ মাস্টার ঠিকই বলেছিলো, লাল শাড়িতে সত্যি মেয়েদের বেশি সুন্দর লাগে!
তুর্কি আদনানের পদশব্দ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। ও শাড়ির কুচি ধরে বলে,
– স্যার, কুচি ঠিক করতে পারছি না। একটু ধরে দিন না।
আদনান ওর দিকে এগিয়ে এসে হাঁটু গেরে শাড়ির কুচি ধরে দেয়। তুর্কি সম্পূর্ণ শাড়ি পরা শেষ করে আয়নার দিকে তাকায়। পাশ থেকে চিরুনি নিয়ে লম্বা চুল এক পাশ এনে আঁচড়াতে থাকে। আদনান ওর পাশে লেদার ডিস্কে বসে। ওর দিকে দৃষ্টি স্থির করে। তুর্কি চুল খোঁপা করে। স্কার্ফ করে। আদনানের উদ্দেশ্যে বলে,
– স্যার, যাওয়ার সময় গাঁদা ফুলের গাজরা নেবো৷ হাতে বাঁধার জন্য।
আদনান কোনো উত্তর দেয় না। তুর্কি কাঁধে পিন লাগয়ে আদনানের দিকে তাকায়।
-কি বলেছি শুনেছেন?
আদনান উপরে নিচে মাথা নাড়ায়। তুর্কি আলমারি থেকে ছোট ব্যাগ বের করতে করতে বলে,
-তাহলে উত্তর দিলেন না যে।
-তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে!
আদনান কথা শুনে আড় চোখে তাকায় তুর্কি। এ লোক এত সহজে ওর প্রশংসা করছে? ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না।
– স্যার, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আবার ফুলের দোকানে ও তো যেতে হবে তাড়াতাড়ি আসুন।
– কই যে রাখলাম।
আদনান টেবিল থেকে ফোন, মানি ব্যাগ আরও যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস পকেটে ভরে। কয়েক পা এগিয়ে এসে আলমারি থেকে ব্যাগ বের করে দিয়ে বলে,
-এত সুন্দর কম্পলিমেন্ট দিলাম। একটা থ্যাংকস তো বলতে পারো?
তুর্কি আদনানের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে ওর দিকে তাকায়। আদনানকে পুরোপুরি ভালো ভাবে দেখে বলে,
-আপনার মুখে নিজের প্রশংসা শুনে একটু সেন্টি খেয়েছি। তাই চুপ করে রয়েছি। যাই হোক, আপনাকে ও ভীষণ সুন্দর লাগছে।
আদনান ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।।
রিকশা এসে থামে ফুলের দোকানের সামনে। তুর্কি আগে আগে নেমে ফুলের মালা দেখতে থাকে। একটা মালা ফুল বিক্রেতা কে দেখিয়ে বলে সেটা দিতে। ফুলের দোকানের ছেলেটা সেটা বের করে, হাতের গাজরার মাপ করে কেটে দেয়। তুর্কি আদনানের দিকে আড় চোখে তাকায়। কি দরকার ছিলো রিটার্ন কম্পলিমেন্ট দেওয়ার। ছেলেটা তুর্কির হাতে গাজরা দিতে গেলে আদনান ওর দিকে দিতে বলে৷ ছেলেটা আদনানের হাতে দিয়ে দাম নেয়। আদনান একটা গাজরা তুর্কি হাতে দিয়ে; অন্যটা ওর অন্য হাতে বেঁধে দেয়। বাঁধা শেষ হলে আবার ওইটা নিয়ে অন্য হাতে বাঁধে। এর পর তুর্কির উদ্দেশ্যে বলে,
-আরও কোনো ফুল নিবে?
তুর্কি একটু ভেবে বলে,
-হ্যাঁ, একটা গোলাপ ও দিন।
আদনান ভ্রু কুঁচকে বলে,
-একটা?
-হ্যাঁ। একটাতেই হবে।
আদনান গোলাপ ভর্তি একটা বালতি উঠিয়ে ছেলেটার উদ্দেশ্যে বলে, বালতির সব গুলা ফুল বেঁধে দিতে। আদনানের কথা শুনে তুর্কি চোখ বড় বড় করে তাকায়।
– স্যার, এত গোলাপ দিয়ে আমি কি শাক রান্না করে খাবো? এত নিচ্ছেন কেনো?
-গোলাপ আমার পছন্দের!
-তো, এত গুলা দিয়ে কী করবো?
আদনান কিছু বলে না। ছেলেটা ফুল গুলো বেঁধে দেয়। আদনান ফুল গুলো নিয়ে দাম চুকায়। তারপর তুর্কির দিকে ফুল গুলো এগিয়ে দিয়ে বলে,
-যত্ন করে রেখে দিও।
তুর্কি ফুলগুলো নিয়ে বলে,
-এত গুলার প্রয়োজন ছিলো না। একটা দিলে ও যত্ন করে রাখতাম। যেভাবে আপনাকে রাখবো।
আদানান ঘাড় বাঁকিয়ে বলে,
-আচ্ছা!
-হুম। কারণ বলবো না।
-কেনো?
-এমনি।
একটু থেমে আবার বলে ‘সোফিয়া’।
তুর্কি আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে,
– স্যার, আমি যাই। আপনি আসুন।
কলেজ প্রাঙ্গন আজ মেতে উঠেছে বসন্তের রঙে। নতুন ভবনের সামনে বিশাল বড় স্টেজ করা হয়েছে। চার পাশে পিঠার স্টোল। বসন্ত বরণ আর পিঠা উৎসব এক দিনেই। সাদা, হলুদ, লাল শাড়ি পরিহিত প্রায় মেয়েরা। আর ছেলেরা পাঞ্জাবি। মানুষে মানুষে গমগম করছে পরিবেশ।
স্টেজের সামনে চেয়ারে বসে রয়েছে তুর্কি আর সোফিয়া। অনুষ্ঠান শুরু হবে আর কিছু মূহুর্ত পর। তুর্কির পেছনে কখন রেজুয়ান এসে উপস্থিত হয়েছে তা ওর জানা নেই। সৈনিকের মত পাহারা দিচ্ছে তুর্কিকে। পাহারা দেওয়ার জন্য ওকে পাঠিয়েছে আদনান। ও ফোন বের করে মুজাহিদকে ফোন করে। কিন্তু, মুজাহিদ ফোন তোলে না। সোফিয়া তুর্কির হাত থেকে ফুলে তোরা নিতে গেলে তুর্কি বাধা দিয়ে বলে,
-ছুবিনা। দূরে যা।
সোফিয়া দুই ভ্রুর মাঝে ভাঁজ ফেলে বলে,
-কেনো?
-এই গুলো ছোঁয়া যাবে না। এই গুলা ভীষণ স্পেশাল।
-কে দিছে?
-জামাই।
সোফিয়া মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-ঢং! জামাই দিছে বলে ছোঁয়া যাবে না?
-না।
-একটা দে।
-একটা ও না। এই সব গুলাতে স্পেশাল কিছু জিনিস আছে। তাই দেওয়া যাবে না।
-স্পেশাল কিছু মানে?
-বুঝবি না।
তুর্কি যে ওকে ফুল দেবে না। তা ও ভালো করেই জানে। তাই এই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বলে,
-অনুষ্ঠান শুরু হতে অনেক দেরি। চল ঐ দিকে গিয়ে পিক তুলে আসি।
-সর এখন উঠলে, পরে চেয়ার পাবো না?
-আরে পাবো। চল তুই। পুকুর পারে ভীষণ সুন্দর করে ডেকোরেশন করেছে। চল না দোস্ত।
সোফিয়ার অনেক রিকোয়েস্টে তুর্কি চেয়ার ছেড়ে উঠে। পিছন ঘুরতেই সাক্ষাৎ হয় রেজুয়ানের সাথে। ও ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে,
-আপনি এখানে কি করছেন?
রেজুয়ান বুকে হাত ভাঁজ করে বলে,
-শয়তানের মাকে পাহারা দিতে আসছি। কই যাচ্ছেন?
রেজুয়ানের কথায় স্বভাবতঃ রেগে যায় তুর্কি। এই ছেলে এক নাম্বারের অসভ্য। ও রেজুয়ান কে উপেক্ষা করে সোফিয়ার হাত ধরে হাঁটতে থাকে। রেজুয়ান ও ওদের পিছু পিছু আসতে থাকে। সোফিয়া রেজুয়ানকে দেখে বলে,
-দোস্ত, ছেলেটা কে রে? তোকে পছন্দ করে?
তুর্কি কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে শুধায়,
-শয়তানের বংশধর।
-মানে?
-এত মানে বুঝতে হবে না। চল তুই।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে পুকুর পারে চলে আসে। ওরা শেষ সিঁড়িতে গিয়ে ছবি তুলতে থাকে। রেজুয়ান ফোন স্ক্যান করতে থাকে। এ জন্মে ওর এই পাহারাদের কাজ ব্যতিত অন্য কোনো কাজ নেই। সোফিয়া বার বার রেজুয়ানের দিকে তাকাচ্ছে। এতে তুর্কি পোজ দিয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। ও বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
-নটকা, তুই ছবি তোলা বাদ দিয়ে কি দেখোস?
-দোস্ত, ছেলেটা কি সুন্দর। তোর কি হয় রে?
-আমার মাথা হয়। চল তুই এখান থেকে। বেডাবাজ কোথা কার। ও নাকি এখানে ছবি তুলতে এসেছে। ফাজিল।
সোফিয়া তুর্কির দিকে তাকিয়ে বলে,
-ওকে দোস্ত, রাগ করিস না। আয় তুলে দেই।
তুর্কি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলে,
-তুলবো না আমি আর। সর।
তুর্কি ক্যাম্পাসের রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করে। ওর পেছন পেছন আসে রেজুয়ান। তুর্কি উদ্দেশ্যে বলে,
-এত হাঁটা বাদ দিয়ে বসতে পারেন না এক জায়গায়। আপনার পেছন পেছন ঘুরতে ঘুরতে, আমার জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে।
তুর্কি তেজ নিয়ে বলে,
-কে আসতে বলেছে। দূর হোন এখান থেকে।
-হ্যাঁ, তারপর আপনার জামাই আমার গর্দান নিক।
প্রতি ডিপার্টমেন্ট থেকে পিঠা-পুলির স্টোল দেওয়া হয়েছে। উপমা আর সূচি পিঠা হাতে ওদের স্টোলের উদ্দেশ্যে আসছিলো। দূরে তুর্কি কে খেয়াল করে, একটা ছেলের সাথে হেঁটে যাচ্ছে। ও কপালে ভাঁজ ফেলে দাঁড়িয়ে যায়। ভালোভাবে পরখ করে, যে ওটা তুর্কিই নাকি। তুর্কি যখন সম্পূর্ণ ঘুরে স্টেজের দিকে যায় উপমা তখন চোখ বড় বড় করে তাকয়ে থাকে। হ্যাঁ, তুর্কিই তো! আবার ছেলেটা ওর পাশে গিয়ে বসেছে। হাতে পিঠে থাকার কারণে ও এগিয়ে যেতে পারছে না। কত বড় সাহস, কলেজে উঠতে না উঠতেই, ছেলেদের সাথে ঘুরছে। তুর্কির মাকে জানাতে হবে। সূচি অনেক দূর এগোনোর পর দেখে উপমা দাঁড়িয়ে আছে। ও উপমাকে ডাকে। উপমা সূচির ডাকে সারা দিয়ে স্টোলে চলে যায়।
উৎসব শুরু হয়ে গেছে। প্রথমে শুরু হয়েছে নাচ। একটু দেরিতে আসার কারণে সামনের চেয়ের হারিয়েছে তুর্কি। তাই পেছনের চেয়ারে বসেছে। পাশে বসেছে রেজুয়ান। তুর্কিকে জ্বালানোর জন্য বলে,
-ভাবি, চলেন আমরা পাংখা পাংখা গানে একটা নাচ দেই।
তুর্কি ভ্রু কুঁচকে বলে,
-আপনার মাথার মধ্যে শয়তানি বুদ্ধি ছাড়া ভালো কিছু আসে না তাইনা?
-যে সারাক্ষণ শয়তানের মায়ের আশে পাশে থাকে, তাঁর মাথায় ভালো বুদ্ধি কি ভাবে আসবে?
তুর্কি দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
-দূর হোন এখান থেকে। এখানে আপনাকে আসতে বলেছে কে?
রেজুয়ান কিছু বলার আগে ওর বেজে উঠে। আদনান কল করেছে। ও ফোন রিসিভ করে কথা বলতে শুরু করে।
-ফুপু কেমন আছো?
ফোনের উপাশ থেকে জুবাইরার কণ্ঠ ভেসে আসে।
-হ্যাঁ, রে মা ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?
-এই তো। কি করো।
-এই তো রান্না করি।
-ভুলেই তো গিয়েছো। কথায় বলো না।
-আরে মা সময় পায় না। একা মানুষ। বাড়ির সবাই কেমন আছে?
– হ্যাঁ, ভালো। আচ্ছা শোনো, কামরুন কই?
তুর্কির সাথে জুবাইরার তেমন কথা হয় না। ওর ফোন ও বন্ধ থাকে সব সময়। যা একটু কথা হয় তাও আদনানের ফোনে।
-কেনো শ্বশুর বাড়ি।
উপমা ভ্রু কুঁচকে বলে,
-শ্বশুর বাড়ি মানে?
জুবাইরা স্মিত হেসে বলে,
-আর বলিস না রে মা। ওর বিয়েটা এমন ভাবে হয়েছে যে, কাউকে জানাতে পারি নি। রাগ করিস না।
উপমা দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করে
-ওর হাসবেন্ড এর নাম কি? কোথায় থাকে?
– সারফারাজ আদনান। দেবেন্দ্র কলেজের প্রভাষক।
উপমা অবাক হয়ে বলে,
-কি!! কিন্তু, তোমার মেয়েকে তো মাত্র অন্য একটা ছেলের সাথে দেখলাম। কলেজে আজ অনুষ্ঠান। দেখলাম কার সাথে যেনো হেঁটে যাচ্ছে। আমি শিওর ওইটা আদনান স্যার না।
বিষ্ময় কণ্ঠে জুবাইরা বলে,
-কি! কার সাথে ঘুরছে?
-জানিনা। তবে ওইটা স্যার না।
জুবাইরা দ্রুত ফোন কেটে দেয়৷ এত সুন্দর ভালো জামাই থাকতে মেয়েটা কার সাথে ঘুরছে? এই কথা যদি আদনান জানিতে পারে? হায় আল্লাহ্! এই মেয়েকে আজ মারে তক্তা বানাবে। জুবাইরা দ্রুত আদনানের ফোনে ফোন দেয়।
অনেক খোঁজ খুঁজির পর সোফিয়া তুর্কিকে খুঁজে পেয়েছে। পাশাপাশি বসে অনুষ্ঠান দেখছে দু’জন। তবে, দূরে বসার কারণে বেশি ভালো ভাবে দেখা যাচ্ছে না। তার উপর গানের তালে তালে ছেলে মেয়েরা যার যার জায়গায় থেকে দাঁড়িয়ে নাচা নাচি করছে৷ রেজুয়ান সেই কখন ফোনে কথা বলতে বেরিছে আর এই দিকে আসে নাই। না আসলেই ভালো। অসভ্য ছেলে। দূরে থাকাই ভালো।
তুর্কির চঞ্চল মন খুঁজে যাচ্ছে আদনানকে। স্টেজে ও তো দেখলো না। লোকটা গেলো কই। এক বার ও দেখা করতে আসলো না। তুর্কি গোলাপ গুলো বুকে জড়িয়ে চেয়ারে হেলান দেয়। চোখ বুজে আদনানের সাথে কাটানো সুন্দর মূহুর্ত গুলো ভাবতে থাকে। নিজের করা কর্ম কাণ্ডের কথা ভেবে আনমনে এসে উঠে। হঠাৎ, মাঠে উপস্থিত সবাই ভীষণ উচ্ছ্বাসের সাথে চিৎকার করে উঠে। তুর্কি ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। স্টেজে কে যেনো গিয়েছে। যাকে দেখে এমন করছে। সোফিয়া নিজের জায়গা থেকে উঠে স্টেজে থাকা লোকটা কে দেখার চেষ্টা করে। কেউ এক জন গান গাইবে। সেই উচ্ছ্বাসে মুখরোচিত পরিবেশ। সবার মাঝে ভীষণ উত্তেজনা বিরাজ করছে। স্টেজ থেকে ভেসে আসে গিটারের টুং টাং শব্দ। সাথে আরো ইন্সট্রুমেন্ট এর শব্দ। কেউ এক জন গান গাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে৷
তুর্কি বিরক্ত হয়ে আবারও চেয়ারে হেলান দেয়। যাঁর ইচ্ছা সে গান করুক। তাতে ওর কি? ও ফুল গুলো আবারো বুকে জড়িয়ে চোখ বুজে। এক পুরুষালী কণ্ঠ থেকে ভেসে আসে গানের প্রথম দুই লাইন‚
‘আমি তোমাকে আরো কাছে থেকে
তুমি আমাকে আরো কাছে থেকে’
অতি পরিচিত কণ্ঠ স্বর কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্র, তুর্কির সারা অঙ্গ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে। ও কি ভুল শুনলো! ও কি সত্যি আদনানের কণ্ঠ শুনলো! নাকি কল্পনা করছে! ও দ্রুত চোখ মেলে তাকায়। ক্যাম্পাসের প্রায় সব ছেলে মেয়ে গানের প্রথম দুই লাইন শোনার পর, আবারও উচ্ছ্বাসের সাথে চিৎকার করে উঠে। আবারও ভেসে আসে‚
‘আমি তোমাকে আরো কাছে থেকে
তুমি আমাকে আরো কাছে থেকে
যদি জানতে চাও
তবে ভালবাসা দাও, ভালবাসা নাও
ভালবাসা দাও, ভালবাসা নাও।’
না সত্যি আদনানের কণ্ঠ!! মাঠে উপস্থিত প্রায় মেয়েরা ও গেয়ে উঠে, ‘ভালোবাসা দেও, ভালোবাসা নেও।’
পাশ থেকে সোফিয়া ও উচ্ছ্বাসের সাথে চিৎকার করে। তুর্কির সারা শরীর কাঁপছে। সত্যি আদনান গান গাচ্ছে! কিন্তু ও তো দেখতে পাচ্ছে না। ও অনেক পিছনে। ও আদনানকে দেখার জন্য চেয়ারের উপরে উঠতে যায়। রেজুয়ান এসে বাধা দেয়।
– এই এই কি করেন। পড়ে যাবেন।
তুর্কি কম্পিত কণ্ঠে বলে,
-কে গান গাচ্ছে?
-আপনার জামাই। বসেন এখানে। চুপ চাপ শোনেন। আপনার জন্য এতক্ষণ সব কিছু এরেঞ্জ করে আসলাম।
তুর্কি উচ্ছ্বাসের স্বরে বলে,
-আমি দেখতে চাই।
রেজুয়ান সামনে তাকা-তাকি করে বলে,
-সামনে আরও ভিড়। যাওয়া যাবে না।
-না আমি দেখবো।
রেজুয়ান কিচ্ছুক্ষণ ভেবে বলে,
-আচ্ছা চেয়ারের উপরে দাঁড়ান, আমি চেয়ার ধরছি।
তুর্কি দ্রুত হাতের ফুল রেজুয়ানের হাতে দিয়ে চেয়ারের উপরে দাঁড়ায়। রেজুয়ান এক হাত দিয়ে ফুল ধরে, অন্য হাত দিয়ে চেয়ার শক্ত করে ধরে। তুর্কি চেয়ারে উঠে স্টেজে দেখতে পায় কাঙ্ক্ষিত মানুষ টাকে! যে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরে স্টেজে বসে গান গাচ্ছে।
‘নদী কেন যায় সাগরের ডাকে?
চাতক কেন বৃষ্টির আশায় থাকে?
যদি বুঝতে চাও-
আমি তোমার ঐ চোখে চোখ রেখে
তুমি আমার এই চোখে চোখ রেখে
আমি তোমার ঐ চোখে চোখ রেখে
তুমি আমার এই চোখে চোখ রেখে
স্বপ্ন দেখে যাও
(সবাই এক সাথে গায়)
তবে ভালবাসা দাও, ভালবাসা নাও
ভালবাসা দাও, ভালবাসা নাও ।’
আবারও ভেসে আসে ইন্সট্রুমেন্টের সুর। তুর্কির মাঝে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। অনুভূতিরা ভীষণ চঞ্চল হয়ে যাচ্ছে। ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে দেখে যাচ্ছে, ওর অবচেতন মনের রাজত্ব করা রাজা কে! ওর বিশ্বাস হচ্ছে না আদনান গান গাইছে। আচ্ছা আদনান কি ওকে দেখতে পাচ্ছে! ইসস ও যদি কাছে গিয়ে গান গাইতে পারতো! কখন যে মুজাহিদ এসে ওর চেয়ার ধরেছে তা ও খেয়াল করে নি। ও এক মনে দেখে যাচ্ছে ওর প্রিয় পুরুষকে। রেজুয়ান ফুলের তোরা মুজাহিদের হাতে দিয়ে বলে,
-এত দেরি করলা কেনো, বাপের ভাই?
-আরে স্কুল থেকে বের হতে দেরি হয়ে গেছে।
মুজাহিদ কে খোঁচা মারার জন্য বলে,
-বাপের ভাই, আজ অন্তত লজ্জা শরম বানাও। ছেলে গান গাচ্ছে, আর ছেলের বউয়ের চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছো। এবার অন্তত বিয়ে টা করো।
মুজাহিদ পা দিয়ে রেজুয়ানের পায়ে লাথি দিয়ে বলে,
-চুপ ফাজিল। আশে পাশে মানুষ আছে।
-হ্যাঁ, মানুষ একটু জানুক আমার বাপে এখনো বিয়ে করে নাই।
মুজাহিদ চোখ মুখ কুঁচকে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
-তোর, ঠোঁট যদি আজ বাড়ি গিয়ে সেলাই না করছি আমার নাম ও মুজাহিদ না। বেলাজার বংশ।
-নতুন নামের সাথে আনম্যারিড যোগ কইরো। শুনতে ভালো লাগবো।
সুর শেষ হলে পরের কলি ভেসে আসে,
‘কাছে এলে যাও দূরে সরে
কতদিন রাখবে আর একা করে?
মনে টেনে নাও
আমি তোমার ঐ হাতে হাত রেখে
তুমি আমার এই হাতে হাত রেখে
আমি তোমার ঐ হাতে হাত রেখে
তুমি আমার এই হাতে হাত রেখে
এসো এগিয়ে যাও-
(এক সাথে সবাই গেয়ে উঠে)
শুধু ভালবাসা দাও, ভালবাসা নাও
ভালবাসা দাও, ভালবাসা নাও ।
গানের প্রতিটি লাইন তুর্কিকে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করছে৷ এক অদ্ভুত অনুভূতি রাজ্যে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে৷
আমি তোমাকে আরো কাছে থেকে
তুমি আমাকে আরো কাছে থেকে
যদি জানতে চাও
তবে ভালবাসা দাও, ভালবাসা নাও
ভালবাসা দাও, ভালবাসা নাও।
গান শেষে সবাই উচ্ছ্বাসের সাথে হাত তালি চিৎকার করতে থাকে। তুর্কি ও আনমনে হাসতে হাসতে হাত তালি দেয়। আদনান গান শেষ করে বলে,
-এই গানটি ডেডিকেট করলাম আমার সহধর্মিণীকে। লাভ টু ওল।
আদনানের কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যায় তুর্কি। মাথা নিচু করে ফেলে। আদনান স্টেজ থেকে নামে। রেজুয়ান তুর্কির উদ্দেশ্যে বলে,
-হইছে নামেন এখন। গান শেষ।
রেজুয়ানের কথায় শোধবোধ ফিরে পায় তুর্কি। ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখে মুজাহিদ ও এসেছে। মুজাহিদ কে দেখে ওর আরও লজ্জা লাগে৷ মুজাহিদ কি এতক্ষণ এই ভাবে চেয়ার ধরে ছিলো। রেজুয়ান তুর্কিকে খোঁচাতে আবারও বলে,
-কত ভালোবাসা। জামাই কে দেখার জন্য এক দম আকাশে উঠতে চাচ্ছে।
-থামবি তুই?
-কেনো থামবো? এত রোমান্টিক একটা জামাই খুঁজে দিছি, তবু ও সারাক্ষণ আমার সাথে যুদ্ধ করে৷ এত বেইমান জানলে কোনো দিন ও আমার ভাইয়ের জন্য আপনাকে পছন্দ করতাম না।
রেজুয়ান কথা শুনে তুর্কি মুখ বাঁকায়। মুজাহিদ রেজুয়ানকে ধমক দেয়। তারপর তুর্কির উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দেয়৷ যাতে ও ভালো ভাবে নামতে পারে। তুর্কি এক হাত দিয়ে কুচি ধরে, অন্য হাত দিয়ে মুজাহিদের হাত ধরে নামে। মুজাহিদ ফুলের তোরা ওর হাতে দিয়ে বলে,
-ও কে আর কি বলবো। এক নাম্বারের ফাজিল।
তুর্কি রেজুয়ানের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-শুধু ফাজিল। আস্তো একটা শয়তান।
-দেখছো যার জন্য চুরি করলাম, সেই বলে চুর। আর কোনো দিন যদি আপনাগো জামাই-বউয়ের জন্য কিছু করছি।
প্রত্যুত্তরে তুর্কি কিছু বলে না। মুজাহিদ আদনান কে কল করে ওদের স্থানে আসতে বলে। কিছু সময় পর উপস্থিত হয় আদনান। রেজুয়ান মুজাহিদের উদ্দেশ্যে বলে,
-চলো বাপের ভাই। ওরা প্রেম করুক আমরা মেয়ে খুঁজি।
রেজুয়ানের কথা শুনে অন্য দিকে মুখ ঘুরাই তুর্কি। আদনানের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় আদনান রেজুয়ানের কান টেনে ধরে।
-আহ্! ভাই।
-বাসায় চল আজ। তোর মেয়ে খোঁজা বের করবো
-এতক্ষণ তোমার বউকে পারাহা দিছি, এর বিনিময়ে একটা মেয়ে খুঁজে দিতে পারো। তা না করে মারতেছো।
আদনান কিছু বলতে গেলে মুজাহিদ রেজুয়ানের ঘাড় ধরে নিয়ে যায়। আদনান ঘাড় ঘুরিয়ে তুর্কির দিকে তাকায়। তুর্কি অন্য দিকে ফিরে আছে। আদনান ওর দিকে এগিয়ে বলে,
-অনেক দিন প্রাকটিস নেই। তুমি সে দিন বললে আবার আজ সবাই জেঁকে ধরলো। তাই একটু চেষ্টা করলাম।
-অনেক…অনেক সুন্দর হয়েছে। আমার জানা ছিলো না, আপনি এত সুন্দর গান গাইতে পারেন।
আদনান মৃদু হেসে বলে,
-যাক। যার জন্য গেয়েছি তার যখন ভালো লেগেছে আর কি চাই। আসো।
আদনান তুর্কির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে। তুর্কি আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-কোথায় যাবো?
-চলো ঘুরে আসি। দিনটা ভীষণ সুন্দর! সাথে পরিবেশ টা ও। সব সময় তো নিস্তব্ধ পরিবেশ উপভোগ করি। আজ এই কোলাহলময় পরিবেশ উপভোগ করি এক সাথে।
তুর্কি মৃদু হেসে ডান দিকে মাথা নাড়ায়। ওর ডান হাত বাড়িয়ে দেয়। আদনান শক্ত করে ধরে। পাশাপাশি হাটতে থাকে দুইজন।
-রেজুয়ান কিছু বলেছে?
হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ২৫
তুর্কি ডানে বামে মাথা নাড়ায়। ওর সেই অদ্ভুত অনুভূতিরা আবার জেঁকে ধরেছে ওকে। তাই অন্য কোনো কিছু মাথায় ঢুকছে না। ও আদনানের ধরা হাতের দিকে তাকায়। মৃদু হেসে আরও শক্ত করে চেপে ধরে। আদনান ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকায়৷ দুজনের দৃষ্টি সংযোগ হলে তুর্কি নরম করে হাত। আদনানের দৃষ্টি দেখে, ও অন্য দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকে। আদনান মৃদু হেসে শক্ত করে চেপে ধরে হাত।