শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫৭

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫৭
নূরজাহান আক্তার আলো

প্রচলিত কথায় বলে বিপদের বন্ধু নাকি প্রকৃত বন্ধু। প্রকৃত বন্ধুর গায়ে অবশ্য সেই ‘প্রকৃত’ ট্যাগ লেখা থাকে না। থাকে তার কর্মে। তার বিবেকে। তার ব্যবহারে ও বন্ধুর প্রতি তার ভালোবাসার ধরনে। প্রতিটা মানুষের জীবনে পালাক্রমে দুটো কালের নিয়ম নির্ধারিত থাকে; সুখকাল কখনো বা দুঃখকাল। সময় নির্ধারিত করে দেয় সেই কালের হিসাব। জীবন সেই কালের উপর ভর দিয়ে ধীরে ধীরে বয়ে যায় নিজ নিয়মে, নিজ গতিতে।

বর্তমানে শুদ্ধর সময়টা বোধহয় দুঃখকালের কবলে। নতুবা একসাথে এত খারাপ সময় তার জীবনে কখনো আসে নি। কখনো এত দিশেহারা বোধ করে নি। এতটা অস্থির হতে দেখে নি। আর তার খারাপ সময়টাতে তার বন্ধুরা অদৃশ্যভাবে আগলে রাখতে উঠে পড়ে লেগেছে। তারা যখনই শুনেছে শুদ্ধর ল্যাবে হামলা হয়েছে তখন থেকে ফুঁসে উঠেছে। এমনিতে তাদের একসাথে দেখে মনে হয়, এরা তো হাসি-আড্ডাতে সময় কাটায়, এরা কাজ করে কখন? এদের মধ্যে সিরিয়াসনেস নেই এরা কিভাবে কী আবিষ্কার করবে? তারা একসাথে থাকলে তাদের খুনশুঁটি দেখলে মনেও হয় না তারা সায়েন্টিস্টের মতো পেশাতে সংযুক্ত। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে
তারা ফ্রেন্ডলি খোলস সাইডে রেখেছে। প্রত্যেকজন কঠিন রুপে নিজের অবস্থান, ক্ষমতা দেখাতে ব্যস্ত। যেসব ক্ষমতা থাকা পরেও তারা কখনো শো অফ করে তারা আজ তারাই প্রত্যেকে সেই ক্ষমতা কাজে লাগাচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কেননা শুদ্ধর তীলে তীলে গড়া পরিশ্রম প্রাণ থাকতে এই দেশের বাইরে যেতে দেবে না। দেবে না মানে;কোনোভাবেই না। আর এজন্য সর্বপ্রথম ইগরের দেশের বাইরে যেতে না পারার সব ব্যবস্থা করেছে। ল্যাব থেকে বেরিয়ে যে রাস্তা ধরে ইগরের লোক গেছে ফুটেশ কালেক্ট করে তাদের ধরেছে। কারণ তাদেরকে ধরলে জানা যাবে তাদের লিডারের অবস্থান।
গতকাল রাত থেকে অর্ক, স্যান্ডি, কামরান আর তাদের সাথে রয়েছে শুদ্ধর আরেক ছায়া সায়ন। যার কাছে পৃথিবী উল্টো যাক তার পরিবার, তার ভাই-বোনরা ভালো থাক। যখনই তার কানে পৌঁছেছে শুদ্ধ এতবড় ক্ষতির কথা তখন থেকে সে যেন ক্ষ্যাপা ষাঁড়। মুখের ভাষা লাগামছাড়া।

রাগ আকাশচুম্বী। ইগরকে গুঁতিয়ে সমস্ত ফমূলা না হাতানো অবধি সেও থামবে না। তবে শীতলের কথা শুনে ছুঁটে গিয়ে একবার দেখে পুনরায় ফিরে এসেছে। হাসানকে শুদ্ধর কাছে থাকতে বলে অর্ক, স্যান্ড, সায়ন, কামরান এই চারমূর্তি গোপনে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। শুদ্ধর ল্যাবে থাকা প্রতিটা জিনিস তারা সরিয়ে ফেলেছে। ইগর শুধু বেশি বাজেটের ফমূলা হাতিয়েছে আরো আছে যেগুলোর খবর সে জানে না। শুদ্ধ বিপদে সেও জানে এবং আবার ফিরে আসতে পারে। বাঙালি কিংবা অবাঙালি রক্তে মাংসে গড়া মানুষ তো মনে লোভ থাকবেই। আর এই লোভ কারো বিপদ মানা দূর বরং আরো বিপদে ফেলে তার সার্থ হাসিলে উঠে পড়ে লাগবে।

যেটা ইয়াসিরকে কাজে লাগিয়ে ইগর করতে চাচ্ছে। শীতলকে কিডন্যাপ
শুদ্ধর উদ্ধার করা এসব এক একটা প্ল্যানের অংশ। যাতে শুদ্ধ শীতলের দিকে ব্যস্ত থাকে আর এ সুযোগে ইগর তার ফমূলা হাতিয়ে সরে পড়তে পারে। এ অবধি তাদের দুটো প্ল্যানই সাকসেস এখন দেশের বাইরে যেতে
পারলে শুদ্ধরও আর কিছুই করার থাকবে না। কিন্তু শুদ্ধ তো একা নয়! শুদ্ধ যেমন কারো বিপদে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে পাশে থাকে তেমনি তার বন্ধুরাও। তারাও দেখিয়ে দেবে শুদ্ধ একা নয়; তার বন্ধুরা ছিল, আছে, দেহে প্রাণ থাকলে ভবিষ্যতেও থাকবে। এদিকে তারা যে এসবই করছে শুদ্ধ জানে না। কারণ সকাল থেকে শুদ্ধ হসপিটালের একদিকটা সামাল দিচ্ছে। শীতলের বর্তমান অবস্থা তাকে দিশেহারা করে তুলেছে। ঐশ্বর্যের চিকিৎসা নিয়ে আপাতত চিন্তা নেই কারণ তাকে বেস্ট চিকিৎসার সমস্ত ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। এখন ঐশ্বর্যের যদি জীবনআয়ু থাকে, তার চার আঙুলের কপালে যদি সুখ থাকে, রুবাবের ভালোবাসায় যদি জোর থাকে তাহলে তারা ফিরবে; ফিরতে তাদের হবেই।

সকাল পেরিয়ে দুপুর আর দুপুর পেরিয়ে হলো সন্ধ্যা। পরিবারের সকলে
এখনো সেভাবেই বসে আছে। কারো দেহে যেন প্রাণ নেই। চোখের কোল ভেজা। অসহায় মুখ। শীতলকে ওটি থেকে বের করে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। পেশেন্টের অবস্থা যখন গুরুতর হয়ে যায় তখনই সেখানে রাখা
হয়। শীতলের ক্ষেত্রেও তাই করা হয়েছে। মাগরিবের আজানের পরপর হাসান এসে শুদ্ধর পাশে দাঁড়াল। তারও কপালে ব্যান্ডেজ। মুখজুড়ে বড় ছোট আঘাতের চিহ্ন। সে শুদ্ধকে এখনো আগের বেশে দেখে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ল। হাতে থাকা শপিং ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বলল,

-‘ ফ্রেশ হয়ে আয়।’
শুদ্ধ আইসিইউ এর সামনে থাকা চেয়ারে বসেছিল। তাকে জোর করেও কেউ কিছু খাওয়াতে পারে নি আর না বাড়িতে পাঠাতে পেরেছে। শুদ্ধ উঠছে না দেখে হাসান জোর করে দাঁড়িয়ে করিয়ে ধরে ঠেলে ফ্রেশ হতে পাঠাল। হাসান চেঁচিয়ে বলল একেবারে শাওয়ার নিতে তাহলে শরীরটা হালকা লাগবে। শুদ্ধ হ্যাঁ না কিছুই বলল না শুধু হাসানকে এখান থেকে নড়তে বারণ করে ফ্রেশ হতে গেল। সে যেতেই হাসান শখ, স্বর্ণ, সাম্য, সৃজনকে ডেকে কিছু যুক্তি পরামর্শ করে যে যেভাবে ছিল সেভাবেই বসে পড়ল। শুদ্ধ যত দ্রুত সম্ভব শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে ফিরে এলো। এসে বসতেই সাম্য সৃজন গিয়ে শুদ্ধর গা ঘেঁষে বসল। শুদ্ধ তাকাতেই সৃজন
মলিন মুখে মাথা নিচু নিলো। তাদের শুকনো মুখ দেখে শুদ্ধ বলল,

-‘কিছু খেয়েছিস?’
তারা দু’জনই না বোধক মাথা নাড়াল। তারপর মিনমিন করে বলল,
-‘ না, তুমি খাইয়ে দাও।’
-‘আজকে নিজে হাতে খা ভাই বাড়ি গিয়ে আমি খাইয়ে দেবো,,প্লিজ।’
সাম্য সৃজন দু’জন দুজনের দিকে তাকিয়ে সম্মতি সূচক মাথা নাড়িয়ে খাবার খেতে চলে গেল। হাসান শুদ্ধর সাথে কথা বলছিল তখন হঠাৎ তারা এসে দু’পাশে দাঁড়িয়ে ছোটো ছোটো খাবারের লোকমা বানিয়ে
শুদ্ধর মুখের সামনে বাড়িয়ে দিয়েছে। শুদ্ধ মলিন হেসে ওদের বলল,
-‘আমি পরে খাব তোরা খা।’
তখন সাম্য জবাব দিলো,

-‘বড় মা বলে কেউ খাবারের লোকমা এগিয়ে দিলে ফিরিয়ে দিতে নেই তাহলে ভাত রাগ করে। তারপর মরে গেলে সেই ভাত ভেমরুল হয়ে হুল ফুটিয়ে দেয়।’
সাম্য কথা শেষ করতেই সৃজন তার লোকমা আর একটু বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-‘শীতল আপুই কি শুধু তোমাকে ভালোবাসে? আমরাও তো বাসি। খাও না ভাইয়া,,একটু খাও।তুমি না খেলে শীতল আপু সুস্থ হয়ে যখন জানতে পারবে তোমাকে খাওয়াতে পারি নি তখন আমাদেরকে খুব রাগ করবে।’
শুদ্ধ চুপ করে আছে দেখে সিঁতারা এগিয়ে এলেন। ছেলের মাথার, বুকে, পিঠে হাত বুলিয়ে কান্নারত স্বরে খেতে বললেন। শুদ্ধ লালবর্ণ চোখে চুপ করে বসে মাথা নিচু করে বসে আছে। এদের কিভাবে বোঝাবে ভাতের লোকমা তার গলা দিয়ে নামবে না। কিন্তু সাম্য সৃজন আবারও আদুরে সুরে বলল,

-‘ভাইয়া একটু খাও।’
একথা বলে সৃজন ফট করে বলল,
-‘সাম্য হাত ধোঁয় নি আমি হাত ধুঁয়েছি আমারটা খাও।’
একথা শুনে সাম্য প্রতিবাদ করে বলল,
-‘ মিথ্যে বলছি সৃজন আমিও হাত ধুঁয়েছি ভাইয়া আমারটা খাবে।’
একথা বলে সে ছোটো ছোটো শুদ্ধর গাল ধরে কি যে মিষ্টি করে বলল,
-‘ওহ ভাইয়া খাও।’
শুদ্ধ আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজেকে সামলানোর। বড় হয়ে সে কবে কারো সামনে কেঁদেছে মনে পড়ে না। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে নিজেকে সামলাতে পারবে না। আর এ দুটোকে এখন ফিরিয়ে দিলে নিজেরাও খাবে না বরং কেঁদে ভাসাবে। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

-‘ আমাকে না জ্বালালে তোরা কেউ শান্তি পাস না তাই না? একজন তো আমার ঘুম হারাম করে আরামের ঘুম ঘুমাচ্ছে। আমার প্লেটের খাবার না খেলে নাকি তার পেট’ই ভরে না। তাকেও ডাক,,এসে আমার খাবারে ভাগ বসাক। তাকে এটাও বলিস সে ভাগ না বসালে আমার গলা দিয়েও কিছু নামতে চায় না।’
একথা বলে থেমে সে পুনরায় বলল,
-‘এখন তোদের পাজিটা বোন নেই এজন্য তোরা এসে জ্বালাছিস? কেউ শান্তি দিবি না আমাকে, তাই না? এত জ্বালালে চলে যাব আর ফিরব না বলে দিলাম।’

শুদ্ধর কান্নাভেজা কন্ঠস্বর শুনে পুনরায় সকলের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে গেল। ছেলেটার যে বুকটা ফেটে যাচ্ছে বুঝতে বাকি নেই কারো। শুদ্ধ থামতেই শখ ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-‘কোথায় যাবে শুনি? আমরাও তোমার পেছন পেছন ঠিক চলে যাব।’
একখা শুনে শুদ্ধ এবার শখের দিকে তাকাল। শখের কান্নারত লাল হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকাতেই চোখ পড়ল স্বর্ণের দিকে। স্বর্ণ ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। সে সবার মতো মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। চৌধুরী নিবাসে ভাই-বোনদের মধ্যে মুখচোরা স্বভাবের হচ্ছে শুদ্ধ আর স্বর্ণ। শুদ্ধ চারজনের দিকে তাকিয়ে দেখে চারজনই প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে এবার সাম্যের হাতের খাবারটা মুখে নিলো। চিবানোর আগে
চোখ থেকে ঝরঝর করে অশ্রু ঝরে গেল। সৃজন সেই অশ্রু হাতে ছোটো হাতে মুছে দিয়ে তার লোকমা বাড়িয়ে দিলো। সেটা শুদ্ধ মুখে নিতেই শখ এগিয়ে এলো। ভাইয়ের দিকে লোকমা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

-‘শীতলকে কৌফিয়ত দিবে হবে তো না কি? আমি কিন্তু মিথ্যা বলতে পারব না।’
হাসান অদূরে দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে আছে। বেচারা শুদ্ধ না পারছে ভাত গিলতে না পারলে ভালোবাসা মেশানো ভাত উগলে দিতে। সে পানির বোতল এগিয়ে দিলে শুদ্ধ পানি দিয়ে ভাত গিলল শুধু। তারপর নিলো শখের বাড়িয়ে দেওয়া লোকমা। স্বর্ণ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে তার হাতেও ভাতের লোকমা। তবে সবার মতো সে এগিয়ে আসে নি দেখে শুদ্ধই বলল,

-‘সবাই যে যেমন পারছে অত্যাচার করছে তুই বাদ যাবি কেন,,আয়।’
স্বর্ণ এগিয়ে এসে সেও ভাইয়ের মুখে ভাত তুলে দিলো। বাকিদের মতো সে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে পারে না। যদি পারত তাহলে ছোটো বোনটার জন্য সে প্রাণভরে কাঁদত। সে এগিয়ে শুদ্ধর মুখে লোকমা দিলো তবে কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারল না। শুদ্ধ অনেক কষ্ট খাবার গিলে ওদের খেতে বলল। কেও ঠিকঠাক খেতে পারল না তবে দু’একবার মুখে দিয়ে রেখে দিলো। এরপর চার ভাই-বোন শুদ্ধর পাশ ঘেঁষে কাঁধে মাথা রেখে বসল। চুপ করে পাঁচ ভাই-বোন তাকিয়ে আছে আইসিইউ রুমের দরজার দিকে। অপেক্ষা করছে কখন শীতল উঠে দৌড়ে এসে বলবে,
‘হসপিটালে মানুষ থাকে নাকি? তোমরা আমাকে ওখানে রেখে এখানে কী শলা-পরামর্শ করছো? যা করেছো বেশ করেছো আবার প্রথম থেকে শুরু করো।’ কিন্তু আফসোস সে আসবে না। উঠে আসার ক্ষমতায় তার নেই। সেভাবে বসে থেকে অনেকক্ষণ কেটে গেল। সারাদিন যেমন তেমন গেলেও সাম্য,,সৃজন শুদ্ধর হাত আঁকড়ে ধরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেছে।

শুদ্ধ দু’হাত বাড়িয়ে দুপাশ থেকে বুকে আগলে রাখল খুব যত্ন সহকারে।
সেখানে যাওয়া-আসা করতে থাকা নার্স ডাক্তাররাও মুগ্ধ হলেন তাদের ভাই-বোনদের এমন ভালোবাসা দেখে। বেশ কিছুক্ষণ পর নার্স জানাল শীতলের হার্টবিট স্বাভাবিক হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে খু্ব তাড়াতাড়ি তার জ্ঞান ফিরবে। সত্যি সত্যিই তার জ্ঞান ফিরল। ছটফট করে খুঁজল লাগল শুদ্ধকে। বাড়ির সবাই একে একে দেখা করে গেল। তবে শীতলের চোখ খুঁজে চলেছে তার বিশুদ্ধ পুরুষকেই। যেই তার সাথে দেখা করতে গেছে তাকে জিজ্ঞাসা করেছে শুদ্ধর কথা। শুদ্ধ শুনল ঠিকই তবে গেল না। সে যাচ্ছে না দেখে হাসান বলল,

-‘যাচ্ছিস না কেন?’
-‘এতক্ষণ আমাকে টেনশনে আধমরা করে এখন ডাকলেই আমায় যেতে হবে? যাব না।’
একথা শুনে হাসান এবার হেসেই ফেলল। এদিকে রাত অনেক বেড়েছে।
হসপিটালেও ভিড় বেড়েছে। ওটি কিংবা আইসিইউর সামনে এতজনকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যরা এই নিয়ে ঝামেলা করছে। পরে বাধ্য হয়েই ম্যানেজার শুদ্ধকে একথা জানাল। শুদ্ধ শুনে শারাফাত চৌধুরীকে বলল সবাইকে নিয়ে চলে যেতে। হাসান থাকবে, সায়ন থাকবে কোনো সমস্যা হবে না। সায়নের কথা উঠতেই শারাফাত চৌধুরী বললেন,

-‘ তা সে কোথায়? কি এমন রাজকার্য করে বেড়াচ্ছে যে বিপদের দিনেও ভাইয়ের কাছে এসে বসার সময় পাচ্ছে না। তাকে ডাকো। ডেকে বলো যেখানেই থাকুক এক্ষুণি যেন উপস্থিত হয়।’
উনার কথা শুনে স্বর্ণ জানাল রাস্তায় আছে চলে আসবে। যদিও মোটেও তা নয়। আসলে কথা বললেই কথা বাড়বে তাই একথা বলে থামাল সে।
তারপর শীতলকে আইসিইউ রুমথেকে ভিআইপি কেবিনে নেওয়া হলো।

আরেকদফা সবার সাথে দেখা হলো শীতলের। শুদ্ধ আবার তাড়া দিতেই উনারা যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেও সিমিন চুপ করে বসে রইল শীতলের হাত ধরে। সবার যাওয়ার কথা শুনে শীতলের হাসিটুকু মুছে গেল। শক্ত করে মায়ের হাত আঁকড়ে ধরল। বড় মার দিকেও করুণ চোখে তাকাল। অনেক কষ্টে বড় আব্বুকে অনুরোধ করল তাকেও নিয়ে যেতে। এখানে একা থাকতে পারবে না হসপিটালে থাকতে ভালো লাগে না তার। এসব অবান্তর কথায় সময় যাচ্ছে দেখে শুদ্ধ কেবিনে এলো। শীতলের দিকে না তাকিয়ে সবাই আরেকবার তাড়াও দিলো। শীতল বুঝল শুদ্ধ থাকবে। তাই সে কথা কোনো কথা বাড়াল না বরং সবার যাওয়ার পরপরই শুদ্ধর বুকে হামলে পড়ার অপেক্ষায় রইল। বাকিরা একে একে গেলেও সিমিন
এখনো স্থির হয়ে বসে আছেন। মায়ের মন যেতে সায় দিচ্ছে না। উনাকে বসে থাকতে দেখে তখন শুদ্ধ অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,

-‘ শরীর খারাপ করলে মাকে সামলাব নাকি মেয়েকে? এরচেয়ে বাড়িতে যাওয়া উচিত।’
একথা শুনে সিমিন ফোলা চোখ তুলে তাকালে শুদ্ধ পুনরায় বলল,
-‘আমাকে বিশ্বাস করতে না পারলে থাকতে পারেন। আলটার অল, আমি পরের ছেলে আপনার তো আর কেউ না। হতেও পারি নি কখনো।’
সিমিন আর কিছুই বলতে পারলেন না আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে সবার সাথে বেরিয়ে গেলেন। শুদ্ধ একবার শীতলের তাকিয়ে নিজেও বেরিয়ে গেল। তারপরে নার্স এলো স্যালাইন বদলে সেই স্যালাইনেই ইনজেকশন পুশ করে টুকটাক কথা বলল। শীতল জবাব দিলো না শুধু শুনেই গেল।

কথার বলার মাঝে পূর্বের মেডিসিনের প্রভাবে চোখে আবার ঘুম নেমে এলো। শারাফাত চৌধুরীদের বাড়ি পাঠিয়ে কেবল কেবিনে প্রবেশ করল শুদ্ধ। সারাটাদিন সবাইকে চিন্তায় ফেলে আবারও শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে বেয়াদবটা। তার জন্য কয়েক মিনিট একটু অপেক্ষা করাও গেল না। এ আবার নাকি খুব ভালোবাসে তাকে। মনে মনে এসব ভেবে সে কেবিনের দরজা আঁটকে এগিয়ে গেল শীতলের দিকে। বসল শীতলের শিঁয়রে। তারপর শীতলের গালে একহাত রেখে তাকিয়েই রইল একদৃষ্টিতে। ইশ! আদুরে মুখটা শুকিয়ে আছে। চোখের নিচের বিষণ্নতার ছাপা। সে একটু এগিয়ে যত্ন করে আদর এঁকে দিলো শীতলের কপালের ঠিক মাঝখানে।

ব্যাঙাচি আজ তাকে দূর্বল করে দিয়েছে। এতদিনের গড়া শক্ত খোলসটা নড়বড়ে করে দিয়েছে। সে কপালে কপাল ঠেঁকাতেই বেহায়া অশ্রু ঝরে পড়ল শীতলের বন্ধ চোখের পাতায়। কেঁপে উঠল শীতল, তবে সে চোখ খুলে তাকাল না। অন্যসময় হলে হয়তো খুব লজ্জা পেতো নতুবা খুশিতে লাফিয়ে উঠত। পরিস্থিতি এমন যে মেডিসিনের প্রভাবে এখন চোখ খুলে তাকাচ্ছে না। তার এই নিশ্চুপতা সহ্য হচ্ছে না শুদ্ধর, তাই বিরবির করে বলল,
-‘ নীরাবতাকে অস্ত্র করে আমার ভালো থাকার অধিকারটুকু কেড়ে নিস না ব্যাঙাচি। বিশ্বাস কর, আমার পুরো পৃথিবী থমকে গেছে। ফিরে আয়, আগের মতো চঞ্চলতা নিয়ে জেগে উঠ। ‘ভালোবাসি’ বলে একবার বুকে লাফিয়ে পড়। নিভিয়ে দে উত্তপ্ত আগুনের ন্যায় জ্বলতে থাকা অসহ্যকর যন্ত্রণা।’

এইটুকু বলতেই কেবিনের দরজায় নক পড়তেই শুদ্ধ থেমে গেল। পেছন ফিরে চোখ মুছে দরজা খুলে দেখল নার্স দাঁড়িয়ে আছে। সে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাতেই নার্স জানাল তাকে এক্ষুণি ডাক্তাররুমে ডাকছে। জরুরি কথা বলবেন। শুদ্ধ পেছন ফিরে একবার শীতলকে দেখে কেবিনের দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে নার্সকে বলল এখানেই থাকতে। সে না আসা অবধি যেন কোথায় না যায়। নার্স সম্মতি জানাতেই শুদ্ধ চলে গেল চারতলায়। যে ডাক্তার শীতলকে দেখছে উনি এখন আছেন চারতলায়। সে লিফ্টে ঢুকে যেতেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে ইয়াসির প্রবেশ করল কেবিনে। শীতলের মুখ পানে তাকিয়ে দিকশূন্য হয়ে রাগে হিসহিসিয়ে করতে করতে চেপে ধরল শীতলের গলা অন্য হাতে চেপে ধরল নাক। আচমকা শ্বাস নিতে না পেরে ছটফটিয়ে উঠল শীতল। চোখ খুলে ইয়াসিরকে দেখে তার চোখের কোণ বেয়ে জল গড়াতে লাগল। তাকে কাঁদতে দেখে ইয়াসিরের হাতটাও থেমে গেল। সে শীতলের মুখটা আগলে ধরে আচমকা সারা মুখে একের পর এক চুমু এঁকে ব্যাকুল সুরে কাঁদতে কাঁদতে লাগল। শীতল হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কোনো পুরুষ এভাবেও কাঁদতে পারে? আর কাঁদছেই বা কেন? এত অল্পদিনেও কাউকে এতটা ভালোবাসা যায়? বাসা কি সম্ভব?

মাফিয়ারা নাকি নির্দয়, নিষ্ঠুর তাদের পাষাণ মনে কি ভালোবাসা জন্মে?
তাকে এভাবে তাকাতে দেখে ইয়াসির শীতলের ক্যানেলা লাগানো হাতটা
আলতো করে ধরল। তারপর সেই হাতে নিজের কপাল ঠেঁকিয়ে কান্নার স্বরে বলল,
-‘ এ্যাই বাবুই এত পাষাণ কেন তুই? তখন বুক কাঁপল না গুলির সামনে
দাঁড়িয়ে যেতে? এত সাহস কোথায় পেলি, হুম? কেন পাগলের মতো ওই শুদ্ধকে ভালোবাসিস ? ওর জন্য মরতেও দ্বিধা করিস না? কই,,আমাকে তো কেউ এভাবে ভালোবাসে না? কেন রে আমাকে কী ভালোবাসা যায় না? কেন যায় না? আমার তো এ পৃথিবীতে কেউ নেই, কেউ না। আমার জন্য কেউ গুলির সামনেও দাঁড়ায় না। আমাকে বাঁচাতে পাগলের মতো কাঁদেও না। ওই,ওই শুদ্ধর তো সবাই আছে। মা আছে, বাবা আছে, বাড়ি ভর্তি সবার ভালোবাসা পায় সে। না খেয়ে থাকলে ভাই-বোনরা কৌশলে খাওয়ায় তাকে। কই আমিও তো সারাদিন ধরে না খেয়ে আছি কেউ তো ছোটো ছোটো হাতে আমার মুখের সামনে শুকনো রুটিও ধরল না। কেউ কেঁদে কেঁদে আদুরে সুরে বলল না,’ভাইয়া খাও।’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫৬

শোন বাবুই শুদ্ধর জন্য সবাই আছে, সব আছে। এতজনের মধ্যে তুই যদি না থাকিস ওর কিচ্ছুই হবে না। বাবুই,,পাখি আমার, ওকে ভুলে যা, করুণ করে হলেও আমাকে ভালোবাস,, একটু,, সামান্য একটু। আমার ভীষণ হিংসে হচ্ছে শুদ্ধকে। মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ও তোকে হসপিটালে নিয়ে এলো বলে সেটা ভালোবাসা হয়ে গেল? দেখ না,,,,দেখ,,আমিও গাভর্তি জ্বর নিয়ে তোর কাছে ছুটে এসেছি। গুলি আমার পায়েও লেগেছে ইচ্ছে করে নি সেটা বের করার। শুধু তোকে দেখতে সেই সকাল থেকে চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করেছি। একা একা ছটফট করছি তোর কষ্ট দেখে। আমার টা কি ভালোবাসা না? ভালোবাসা কোনটা,,,,কাকে বলে ভালোবাসা, হ্যাঁ? বল, বল না কিভাবে ভালোবাসতে হয়? তুই আমাকে শিখিয়ে দে নাহয়, আমি সেভাবেই সেই নিয়মেই ভালোবাসব তোকে। প্রমিস, সেই নিয়মের অবাধ্য হবো না, একটু না, একফোঁটাও না।’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫৮

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here