ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫৬
তাজরীন ফাতিহা
তিমির ফুরিয়ে ঊষাকালের ঘনঘটা। অরুণোদয়ের মিষ্টি সুবাস অনিলে ছড়াচ্ছে দিকবিদিক। মহান রবের প্রার্থনা শেষে মানহা বারান্দায় পাতা চেয়ারে আসন পেতেছে। দৃষ্টি তার প্রভাতের আলো ছায়াময় গগনে। ইদানিং শরীরের অবনতি দেখা দিয়েছে তার। খাবারে অরুচি, নিদ্রাহীন জীবন, সবকিছুর প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা, হুট করেই মেজাজের অনিয়ন্ত্রতা এবং মানসিক টানাপোড়ন। সবমিলিয়ে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে বিবাহ পরবর্তী জীবনে। ইদানিং বেশিরভাগ সময় নিজ রুমে বন্দী জীবনযাপন করছে সে। ইহাবের সঙ্গেও দুরুত্বের সৃষ্টি হয়েছে হাসপাতালের ঘটনার পর পরই। জরুরী আলাপ ছাড়া একটা টু শব্দও হয়না এই দাম্পত্যজীবনে। সেও প্রায় এক মাসের কাছাকাছি। তার কাছে মনে হচ্ছে সময় থমকে আছে। একটা কৃষ্ণবর্ণ গহ্বরে আটকে গেছে সে। একমাত্র তার অস্তিত্ব ব্যতীত সেখানে আর কেউ নেই।
আজ হুট করেই মানহার তার বিবাহের কথা স্মরণ হচ্ছে। এই বিয়ে করায় মোটেও আগ্রহী ছিল না সে। পিতা মাহাবুব আলম সেদিন তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে একান্তে শুধু একটা কথাই বলেছিলেন। সে কথাটা এখনো তার কানে বাজে। না এই বিয়ে করতে মাহাবুব আলম তাকে মোটেও জোর করেননি আর নাতো কোনো ব্ল্যাকমেইল করেছেন। তার সম্পূর্ণ মতামতেই বিয়েটা সেদিন হয়েছিল। বাবার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাতেই বোধহয় এই মতামত দিতে একটুও কার্পণ্য করেনি সে। কিন্তু মানহার একটা হিসেবে গড়মিল লেগেই যায়। বাবা বড় ভাইয়ের সম্পূর্ণ কাহিনী জেনেও এই লোকটাকে তার যোগ্য সঙ্গী ভাবলেন কি করে? যদিও মানহাকে যে অসুখী রেখেছে তা নয় তবুও শ্বশুর এবং জামাইয়ের এই সম্পর্ক স্থাপনে কি কারণ থাকতে পারে যা সকলের থেকে গুপ্ত?
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
মানহার মনে আছে, বিয়ের প্রথম রাতেই লোকটা তার স্বল্প ভাগ দেনমোহর শোধ করে দিয়েছিল। ঐ রাতে দেনমোহর পরিশোধের অভিনয় করে তাকে একেবারে অজ্ঞান করে ফেলেছিল লোকটা। সেদিন উপরে উপরে ভয়হীন দেখালেও ভিতরে ভিতরে একদম ভয়ে সিটিয়ে ছিল সে। বিয়ের দেনমোহর ধার্য করা হয়েছিল আট লক্ষ। বিয়ের রাতে দুই লক্ষ পরিশোধ করে তার মাস চারেক পরে বাকি ছয় লক্ষ পরিশোধ করে দিয়েছিল ইহাব। টাকাগুলো এখনো সযত্নে আলমারিতে তোলা আছে। সেখান থেকে মানহা এক টাকাও খরচা করেনি। মূলত খরচ করার প্রয়োজন পড়েনি। তার ভার্সিটির সমস্ত খরচ ইহাবই দেয়। আর টাকা খরচ করার মতো কোনো প্রয়োজন এখনো পড়েনি। বিয়ের পর পর উর্মি ভুঁইয়ার মতো শাশুড়িকে পেয়ে মানহা মহাখুশি হয়েছিল। সবকিছুতে মায়ের মতো আগলে রাখতেন অথচ সেই তারই ভয়ঙ্কর রূপের সাথে পরিচিত হয়ে সে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেয়েছিল। উর্মি ভুঁইয়ার এমন সীমাহীন পরিবর্তন তার মস্তিষ্ক এখনো ধারণ করতে সক্ষম হয়নি।
মানহার ভাবনা চিন্তার অন্ত ঘটলো চেয়ার টানার শব্দে। বুঝল তার পাশে চেয়ার এগিয়ে কেউ বসেছে। মানহা সেদিকে চাইল না। দৃষ্টি নিবদ্ধ তার অদূরের বৃক্ষরাজির কুঞ্জে। ইহাব বেশ কয়েকবার গলা খাঁকারি দিল। মানহা শেষে বিরক্ত হয়ে মুখ খুলল,
“কিছু বলার হলে বলুন, অহেতুক কানের কাছে খুচুরমুচুর করছেন কেন?”
ইহাব মানহার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে শুধায়,
“ওহে প্রভাতরাগিণী, মন কেন বিষন্ন তোমার?”
মানহা এর কোনো জবাব দিল না। তাকে চুপ থাকতে দেখে ইহাব মলিন বদনে বলল,
“আজ ডাক্তারের কাছে নেব তোমায়। তৈরি থেকো।”
“কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। যেদিন ভালো লাগবে সেদিন যাব।”
ইহাব দৃঢ় গলায় বলল,
“তোমার ভালো লাগেনা দেখেই নিতে চাইছি।”
মানহা এই কথারও জবাব দিল না। অদূরে চেয়ে রইল নির্মিশেষ। ইহাব মানহার বিরক্তিবোধ বুঝতে পেরে উঠে চলে যেতে নিলে মানহার কথায় থমকে দাঁড়াল।
“জানেন বিয়ের আগে বাবা আমাকে একান্তে কিছু কথা বলেছিলেন।”
ইহাব উল্টো ঘুরেই দাঁড়ানো। পিছনে ঘুরল না। মানহাও সামনে দৃষ্টি স্থির রেখেই বলে চলল,
“এরমধ্যে একটি ছিল, আপনি নাকি আমার যোগ্য জীবনসঙ্গী। কথাটা আমি একটুও বিশ্বাস করতে চাইনি তবে বাবাকে অবিশ্বাস করার ক্ষমতাও আমার ছিল না।”
এবার মানহা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ইহাবের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
“বাস্তবিকই বাবার কথাটা একটুও মিথ্যা ছিল না। আপনি জীবনসঙ্গী হিসেবে নিখুঁত হলেও মানুষ হিসেবে জঘন্য ত্রুটিযুক্ত।”
বলেই মানহা রুমে চলে গেল। ইহাব ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল অনিমেষ।
নাস্তার টেবিল বমি করে ভাসিয়ে ফেলেছে মানহা। খেতে খেতেই আচানক বমির উদ্গীরণ ঘটেছে। উর্মি ভুঁইয়া, ইমতিয়াজ ভুঁইয়া হুলস্থূল করে দাঁড়িয়ে গেলেন। মানহার পাশের চেয়ারেই ইহাবের শরীর মাখামাখি হয়ে আছে। সে কোনরকম নাক ও চোখ বন্ধ করে শক্ত হয়ে বসে আছে। উর্মি ভুঁইয়া চেঁচিয়ে বললেন,
“এই মেয়ে, তুমি দেখনি আমরা খাচ্ছি। বমি পেলে বেসিনে যেয়ে করতে পারতে। সকলের খাওয়া নষ্ট করলে কেন? দিনদিন একটা অসহ্যে পরিণত হচ্ছ। ইয়াক আমারও বমি পাচ্ছে। এখানে এক সেকেন্ড থাকলে আমিও সব বের করে দেব। রাবিশ!”
বলেই গটগট পায়ে উপরে চলে গেলেন তিনি। পিছুপিছু ইমতিয়াজ ভুঁইয়াও গেলেন। এখানে থাকা তার জন্যও পসিবল নয়। পুরো ডায়নিং রুম এখন ফাঁকা। সার্ভেন্টরা এসে টেবিল পরিষ্কারে লেগে পড়ল। মানহা পাথরের মতো নির্জীব ভঙ্গিতে বসে রইল। ইহাব কিছুই বলল না। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে মানহাকে ধরতে নিলে মানহা একদম শক্ত হয়ে বসে থাকল। নড়ল না একবিন্দু। ইহাব রাগান্বিত স্বরে বলল,
“জিদ দেখালে এতগুলো সার্ভেন্টের সামনে কঠিন থাপ্পড় খাবে।”
কথা শেষ করে মানহাকে কাঁধে তুলে নিচের ওয়াশরুমে নিয়ে এল। যেখানে যেখানে বমি লেগেছে সব পানি দিয়ে পরিষ্কার করে দিল। মানহা বারবার বারণ করলেও তার নিষেধাজ্ঞা মানল না। নিজেকেও পরিষ্কার করে ফের আবার মানহাকে কাঁধে তুলে উপরে নিয়ে এল। মানহা অহেতুক চেঁচালেও বিশেষ ফায়দা হলো না। রুমে এনে ওয়াশরুমে নামিয়ে বলল,
“শরীর থেকে বমির গন্ধ আসছে, শাওয়ার নিয়ে ফেল।”
মানহা ত্যাড়ামি করে বলল,
“পরে করব।”
“ওকে।”
বলেই ইহাব রুম থেকে দুজনের জামাকাপড় এনে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে দিল। মানহা চিল্লিয়ে বলল,
“আপনি গোসল করলে করুন। আমাকে বের হতে দিন।”
“নোপ, আজকে একসঙ্গে অঙ্গধৌত হবে।”
মানহা চোখ রাঙিয়ে বলল,
“অশ্লীল কথা বলবেন না, বের হন বলছি।”
ইহাব মানহার কথা গ্রাহ্যই করল না। বাথটাবে পানি ভর্তি করতে লাগল। মানহা এই ফাঁকে বেরিয়ে যেতে নিলে ইহাব খপ করে তাকে ধরে ফেলল। মানহা চেঁচাতে চেঁচাতে গলা ব্যথা বানিয়ে ফেলেছে। ইহাব মানহাকে ধরে রেখে বলল,
“এত হাউকাউ করো না, কানের পর্দা ফাটার জন্য নড়াচড়া করছে। সো, ডোন্ট শাউট।”
বাথটাব ভর্তি হয়ে গেলে এক হাত দিয়ে নিজের পরনের শার্ট খুলতে নিলে মানহা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ইতোমধ্যে ইহাব অর্ধেক শার্ট খুলে ফেলেছে। মানহার কান্না শুনে বলল,
“ঢং করবে না রিন পাউডার। মনে হচ্ছে এই প্রথম আমাকে উদোম দেখছ?”
সম্পূর্ণ শার্ট খুলে মানহাকে নিয়ে বাথটাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
নিশাত বিড়াল ছানাকে দুধ দিয়ে টাকা উঠাতে বাইরে গেল। নাহওয়ান বিড়াল ছানার সামনে উপুড় হয়ে মনোযোগী দৃষ্টিতে খাওয়া দেখছে। পাশেই তার অর্ধ খাওয়া গুড়ো দুধের বাটি। মারওয়ান দরজা আটকে ছেলের পাশে এসে বসল।
“কিরে কি করিস কবুতরের ছাও?”
নাহওয়ান দুহাত গালে ঠেকিয়ে বাবার দিকে চেয়ে বলল,
“বিল্লু চানা ডুডু কায়।”
“হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি।”
নাহওয়ান ফিচফিচ করে হেঁসে বলল,
“আমিও ডুডু কাই, বিল্লু চানাও কায়।”
মারওয়ান রসিকতার সহিত বলল,
“বাহ্! এখন দুজনে গলায় গলা মিলিয়ে ফেল।”
নাহওয়ান বাবার কথা রাখতে বিড়াল ছানাটাকে টিপ দিয়ে ধরল। মারওয়ান নিষেধ করে বলল,
“ওকে রাখ। চল একটা খেলা খেলি।”
নাহওয়ান উৎসাহী হয়ে বলল,
“চলো কেলি।”
মারওয়ান ফ্লোরে আসন পেতে বলল,
“খেলার নাম লুকোচুরি।”
নাহওয়ান বিস্মিত গলায় বলল,
“লুকোচুলি!”
“হুম, দাড়া তোকে শিখিয়ে দেই।”
মারওয়ান এবং নাহওয়ান লুকোচুরি খেলার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। মারওয়ান অন্তত ধৈর্যের সহিত ছেলেকে গত একঘন্টা ধরে শিখিয়েছে কিভাবে লুকোচুরি খেলতে হয়। সে সিরিয়াস ভঙ্গিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“রেডি?”
নাহওয়ান লাফাতে লাফাতে জানান দিল,
“লেডি লেডি।”
মারওয়ান কোমরে দুই হাত ঠেকিয়ে বলল,
“চোর হবি তুই আর আমি কিন্তু পুলিশ। এক থেকে দশ অবধি গুনব এরমধ্যে লুকিয়ে পড়বি। একদম গোপনীয় জায়গায়, বুঝলি?”
নাহওয়ানও বাবাকে দেখে সিরিয়াস হয়ে অনবরত ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। মারওয়ান নিজেদের রুমে গিয়ে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে খুবই ধীর গতিতে জোরে জোরে এক থেকে দশ অবধি গুনল। প্রায় পাঁচ মিনিট লাগিয়ে গুণে উঠে মন্থর গতিতে পা ফেলে ফেলে ছেলেকে খুঁজতে রুম থেকে বেরুল। রুম থেকে বেরুতেই চোখের সামনে তাদের নতুন ফ্রিজ দর্শিত হলো। তাকিয়ে দেখল ফ্রিজের কোণায় নাহওয়ান উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে চোখের উপরে আঙুল দিয়ে। মারওয়ান কটিদেশে হাত ঠেকিয়ে সেদিকে দৃষ্টি স্থির করে বলল,
“এই পটলের বাচ্চাটাকে কি শিখিয়েছি গত এক ঘন্টা? এটাকে কেমন লুকানো বলে? পুলিশের মুখের সামনে পশ্চাৎ দেখিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।”
এগিয়ে এসে রাগান্বিত গলায় বলল,
“ঐ তোকে না লুকোতে বললাম?”
নাহওয়ান পূর্বের অবস্থায় থেকেই বলল,
“লুকিয়েচি, কুজো কুজো।”
“কী খুঁজব?
“আমাকে কুজো।”
“এটাকে লুকোনো বলে?”
নাহওয়ান নিজের নেত্রে গুলুমুলু আঙুল গুলো আরও দাবিয়ে বলল,
“হুম, কিচু ডেকতে পাচ্চি না। চব কালু কালু। টুমিও ডেকতে পাবে না।”
মারওয়ান হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে না পেরে বলল,
“বাহ্ কি চমৎকার বুদ্ধি!”
নাহওয়ান গর্বের সহিত চোখ ঢেকেই বলল,
“চমটকাল বুড্ডি।
মারওয়ান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“হ্যাঁ, নাসির উদ্দিন ওরফে ব্রিটিশের নাতি মিস্টার বুদ্ধিউদ্দিন।”
নাহওয়ান তবুও পিছু ঘুরল না। মারওয়ান তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে বলল,
“পুরো খেলা বাংচাল করে দিয়েছিস আন্ডার বাচ্চা।”
নাহওয়ান হেঁসে বলল,
“আচ্চা, আবাল আবাল।”
“না তোর সাথে খেলে মজা নেই, তুই লুকাতে জানিস না।”
নাহওয়ান বাবার কথায় ঠোঁট ফুলিয়ে ফেলল। মারওয়ান ছেলের মন খারাপ বুঝতে পেরে আবারও খেলতে আগ্রহী হলো। সে আবারও এক থেকে দশ অবধি গুণে এসে পুরো রুমে খুঁজেও আর নাহওয়ানকে পেল না। এরমধ্যে দরজার করঘাতে মারওয়ান দ্রুত দরজা খুলে আবারও ছেলেকে খুঁজতে লেগে পড়ল। নিশাত ঢুকেই বলল,
“নাহওয়ান কই? আজকে ওর টিকার ডেট একদম ভুলে বসে আছি। ওকে নিতে আসলাম। ছেলেকে ডাকুন, ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?”
বলতে বলতে নিশাত ফ্যান ছেড়ে বিছানায় বসল। মারওয়ান উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
“ওকে খুঁজে পাচ্ছি না। পুরো ঘর খোঁজা শেষ। এই মিনিট কয়েক আগে লুকোচুরি খেলার জন্য লুকোতে বললাম এখন কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।”
নিশাত তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল,
“কী বলছেন এসব? কোথায় যাবে? ভালো করে খুঁজে দেখুন আছে আশেপাশে কোথাও। ঘর তো আমাদের বড় নয় যে খুঁজে পেতে সমস্যা হবে?”
মারওয়ান অধৈর্য কণ্ঠে বলল,
“আরে সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। ডাক দিচ্ছি সাড়াও দিচ্ছে না।”
নিশাত অস্থির হয়ে সম্পূর্ণ ঘর খুঁজল। কোথাও বাচ্চাটার চিহ্নটুকু পর্যন্ত নেই। সে মারওয়ানের শার্ট খামচে ধরে বলল,
“এই মারওয়ান আজাদ আমার ছেলেকে এনে দিন বলছি। আপনি নিশ্চয়ই নাটক করছেন? প্লিজ এসব করবেন না। আমার দম আটকে আসছে, নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। আমার বুকের মানিক কোথায় বলুন?”
মারওয়ান নিজেও ভিতরে ভিতরে বেশ অস্থির হয়ে আছে। উপরে শক্ত দেখালেও ছেলের চিন্তায় অসুস্থ অসুস্থ লাগছে। গলা শুকিয়ে গেছে। তীব্র পিপাসায় পানির অভাববোধ করল। দ্রুত ফ্রিজ খুলে পানি নিতে গেলে দেখল নাহওয়ান ফ্রিজে ঢুকে বসে আছে। মারওয়ান দ্রুত কোলে নিয়ে বলল,
“তুই এটার মধ্যে কী করিস রে ফাইয়াজ?”
নিশাত পিপাসার্ত জননীর মতো মারওয়ানের কোল থেকে ছেলেকে ছিনিয়ে এনে বুকের মধ্যে চেপে রাখল অনেকক্ষণ। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিল। ফ্রিজে থাকায় হালকা শরীর ঠান্ডা হয়েছে। ভাগ্যিস নরমালে ঢুকেছিল ডিপ ফ্রিজে ঢুকলে তার মানিককে আজ বোধহয়.. নিশাত আর ভাবতে চাইল না। হুহু করে কেঁদে দিল। নাহওয়ান মাকে কাঁদতে দেখে দাঁত বের করে বলল,
“ইট্টু লুকাইচি।”
মারওয়ান এগিয়ে এসে বলল,
“আর লুকানোর জায়গা পাসনি?”
নাহওয়ান বাবার দিকে চেয়ে বলল,
“টুমিই টো বলচো?”
মারওয়ান তড়িঘড়ি করে জবাব দিল,
“এই আমি বলেছি মানে? তোকে আমি লুকাতে বলেছি, ফ্রিজে লুকাতে বলিনি। উল্টাপাল্টা কথা বললে জাস্ট উড়িয়ে ফেলব।”
বাবার চোখ রাঙানি দেখে নাহওয়ান চুপসে গেল। মায়ের কোলে গুটিয়ে গেল। নিশাত ছেলেকে নিয়ে তৈরি হয়ে টিকা দিতে চলে গেল। মারওয়ানের সঙ্গে কোনো কথা বলল না। মারওয়ান মনে মনে বলল,
“আরেকটুর জন্য কেস খাইয়ে দিচ্ছিল পান্ডাটা।”
নিশাত টিকা দিয়ে বের হতেই রাস্তার ওপারে মারওয়ানকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখল। একমনে সিগারেট টানছে। এদিকে ধ্যান নেই। পরনে সেই কালো কোটটা। নিশাত মনে মনে বলল,
“ঠিকানা জেনেছে কিভাবে? আজকে তো বলেও আসেনি।”
নিশাত এগোবে না ভেবে আবার কি মনে করে যেন এগোলো। কিছু কেনাকাটা করতে হবে। লোকটা সাথে থাকলে সুবিধা হবে। ছেলেকে ধরিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বাজার করা যাবে। নাহওয়ান বাবাকে দেখেই হাত বাড়িয়ে ডাকতে লাগল। মারওয়ান চাইল। নিশাত ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে দিতেই নাহওয়ান দৌঁড়ে এসে বাবার পা জড়িয়ে ধরল। সিগারেট মুখে রেখে মারওয়ান ছেলেকে কোলে তুলে নিল। নিশাত এগিয়ে এসে বলল,
“কিছু কেনাকাটা করতে হবে। ওকে নিয়ে আসুন।”
মারওয়ান মুখ থেকে সিগারেট ফেলে দিয়ে নিশাতের দিকে চেয়ে কেমন করে যেন হাসল। নিশাত সামনে তাকিয়ে ছিল বিধায় তেমন খেয়াল করল না। সামনে এগিয়ে যেতেই ব্যাগে ফোন বাজতে লাগল। নিশাত ফোন বের করে দেখল মারওয়ানের নম্বর থেকে কল আসছে। তার ভ্রু কুঁচকে গেল। ঘুরে দেখল মারওয়ান ছেলেকে নিয়ে দাড়িয়ে তার পানে চেয়ে আছে। নিশাত বুঝল না লোকটা সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ফোন দিচ্ছে কেন? সে কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মারওয়ান বলল,
“তোমরা কোথায়? এবারের টিকা এসএম স্কুলে দিচ্ছে না? আমি আসছি, চলে যেও না আবার।”
নিশাত ফোন কানে নিয়ে ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার পানে চাইল। ওপাশ থেকে মারওয়ানের হ্যালো হ্যালো শব্দ কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না তার। মনে হচ্ছে, সে টাইম লুপে আটকে গেছে। আশপাশের কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছে না সে। শুধু পিয়ানোর সুরের মতো একটা শব্দই খালি মস্তিষ্কে পিনের মতো বাজছে। মারওয়ানের অজস্র প্রশ্নের বিপরীতে অনেকক্ষণ পর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুল,
“আপনি আমার সামনে না?”
এবার ওপাশ থেকে পিনপতন নীরবতা। খানিক পর জবাব এল,
“কেন তোমার সামনে কি আমাকে দেখতে পাচ্ছ?”
“হ্যাঁ, ঐযে ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমার দিকে চেয়ে।”
মারওয়ান ওপাশ থেকে গর্জে উঠে বলল,
“নিশাত কি করেছ তুমি? ওটা আমি নই। ছেলেকে ওর কাছ থেকে নাও, ওটা একটা ভ্রম।”
নিশাত কেমন যন্ত্রের মতো বলল,
“ভ্রম?”
“কোথায় আছ দ্রুত বলো?”
“এসএম স্কুলের পিছনের রাস্তার শপিং মলের সামনে।”
নিশাত এগিয়ে আসতে নিলে একটা গাড়ি সাঁই করে এসে লোকটার সামনে দাঁড়ালো। মারওয়ানীয় ভ্রমটা নিশাতের দিকে ঘাড় কাত করে চেয়ে পিছন থেকে প্রাণপণে ধেয়ে আসা মারওয়ানের দিকে বিদঘুটে নজরে চাইল। মুখ থেকে কূটধোঁয়া ছড়িয়ে দিয়ে নাহওয়ান সমেত গাড়িতে উঠে বসল। নিশাত অনেকটাই কাছে চলে এসেছে। গাড়ির দরজা আটকাতে আটকাতে লোকটা বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গিতে রূঢ় হেঁসে ফ্যাসফেসে গলায় বলল,
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫৫
“গুড বায় মিস্টার অ্যান্ড মিসেস সাইফার। ধন্যবাদ ফৌজিয়া নিশাত সাইফারের জিয়ন কাঠি আমার হাতে তুলে দেয়ার জন্য। আলবিদা, গুলে গুলে, আরিভেদার্চি।”
চোখের পলকে গাড়িটি উধাও হয়ে গেল। নিশাত অন্তঃসারশূন্য দৃষ্টিতে ধূলো উড়ানো গাড়িটির চলে যাওয়া দেখল।