তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩১
নীল মণি
এক মুহূর্ত,শুধু একটামাত্র মুহূর্তেই যেন সবকিছু উলটে গেল ইউভির ভেতরে।চারদিকটা হঠাৎ কেমন ঝাপসা হয়ে এল,ঘরটা যেন ঘুরে ঘুরে কানের পাশে একটা ভারি গুঞ্জন তুলে চলেছে।তাজা সন্ধ্যার বাতাসটাও এখন কেমন ঘন হয়ে বুকের উপর চাপ দিচ্ছে।চোখ বড় বড় হয়ে গেছে ইউভির,কিন্তু তাতেই যেন গর্জে উঠছে এক অজানা ভয়। ভয়ে বার বার ঢোক গিলছে।
কুঁকড়ে যাচ্ছে এই ভেবেই অয়ন বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। হায় আল্লাহ যেই খানে কোন ছেলের নিঃশ্বাস ও আমার বোনের আসে পাশে আসা বারন,
সেই খানে বিয়ের প্রস্তাব তাও আবার ওই ব্যাটা অয়ন।
চারপাশের আলোটাও এখন কেমন কালচে লাগছে,
যেন একসঙ্গে হাজারটা মেঘ এসে তার মাথার উপর ঢেকে দাঁড়িয়ে গেছে।
মাথার ভেতর কেবল শব্দ বাজছে—-
“অ অ অয়ন… তিয়াশা… বিয়ে… প্রস্তাব…। আমি স্যাস”
” আমার হৃদায়পাখি রে নিয়ে পালায় যাবো? ভাইয়া যদি জানে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে তাহলে আর আমার
শরিরে জান থাকবে না । ভাইয়া দেখবে না কে পাঠালো ? কি করে আসলো ?
উনি তো শুধু দেখবে আমি থাকতে বাড়ি পর্যন্ত এই প্রস্তাব আসলো কি করে ? ও আল্লাহ আমারে বাঁচাও।
এইটা বিয়ের খবর না, এইটা তো আমার জীবনের জানাজা পড়ানোর খবর। খুশি হইছিলাম পরিবার এর
খুশি দেখে , হা********দা অয়ন নিজে তো মরবিই সঙ্গে
আমারেও মারলি। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তোর কি হয় বলতো, এরকম বিষম খাস মাঝেমাঝেই?”
রূহেনা বেগমের কথায় হঠাৎই ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে এলো ইউভি।
নিজেকে সামলে নিয়ে, একটু সাহস সঞ্চয় করে মৃদু স্বরে বলল–
“এই বিয়েটা… হতে পারে না বড় আম্মু।”
তার মুখ থেকে এই কথা শুনে ঘরে নেমে এলো এক গভীর নিস্তব্ধতা।সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকালো– কি বলছে ইউভি?
মেহজাবীন বেগম বিস্ময়ে জড়িয়ে গিয়ে বললেন–
“কি বলছিস তুই? কেন হতে পারবে না বিয়ে? সমস্যা কোথায়?”
ইউভি গিলে ফেলল নিজের হৃদয়ের তোলপাড়,সমস্যা যে আমার ই বড় ভাই তোমারই ছেলে, বড় আম্মু।
কিন্তু এই কথা বলার সাহস তো তার নেই ।
তবুও ঠোঁটে তুলে নিলো একটা অজুহাত–
“বনু অনেক ছোট। এখনো তো ভার্সিটি শেষ করতে পারে নাই বড় আম্মু , এখনো ওর বিয়ে দেওয়ার সময় হয় নি ।”
পাশে দাঁড়িয়ে অনন্যার মুখ ও কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো তিয়াশার বিয়ের কথা শুনে।নিঃশব্দে ড্রয়িং রুম ছেড়ে উপরে চলে গেলো তিয়াশার রুমের দিকে ছুটে।
আর ঠিক তখনই গর্জে উঠলেন প্রণয় সাহেব–
“হ্যাঁ ভার্সিটি তো শেষ করাতেই হবে, নইলে আরেক জনের মত পরিবারের মুখে চুনকালি মাখাতে পারে।”
এই কথার ভিতরে ছিল চাপা রাগ, তিক্ততা, আঘাত।
কিন্তু ইউভি আর চুপ থাকল না।রক্তে যেন আগুন উঠে বলল—
“কি বলছো আব্বু এসব? একজন করেছে বলে বনুও করবে,এরকম কোনো কথা নেই।”
এইসব দৃশ্য দেখে প্রান্তিক সাহেব আর চুপ রইলেন না এবার গম্ভীর স্বরে বললেন–
“তোমার অনুমতি চায়নি ইউভি।তুমি মেজো আম্মুর ভাই, জানা প্রয়োজন তাই জানিয়ে দিলাম।বাকি বোঝার জন্য তোমার এই বড় আব্বু আছে। আর মেজো আম্মুর পড়া শোনা বিয়ের পর ও হতে পারে।”
প্রান্তিক সাহেবের এই কথায় ইউভি শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথায় হাত দিয়ে মনে মনে ফিসফিস করে বলল–
“বড় আব্বু, আপনি নিজেই জানেন না এই সিদ্ধান্ত কত বড় ঝড় নিয়ে আসবে।”
ঠিক তখনই সবার কানে পৌঁছলো তাহসান সাহেবের গলা—
“সমস্যা কোথাও নেই বড় ভাবি।অয়ন খুব ভালো ছেলে। চট্টগ্রামে বসে এতদিন ব্যবসা সামলেছে। বাড়ির সবার খুব ভালো খেয়াল রাখে । আর তার থেকে বড় কথা অয়ন তোমার ভাইপো । তিয়াশা খুশি থাকবে ওর সঙ্গে।”
ইউভির মুখ কালো হয়ে গেল।আর কিছু না বলে বলল—-
“তোমরা যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছো, তখন আমাকে এসব জানিয়ে কোনো লাভ নেই।”
এই বলেই সে গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে চলে যেতে লাগলো …..
যেতে যেতে সিঁড়ির মাঝখানেই কানে ভেসে এলো প্রান্তিক সাহেবের গলা–
“পরশু শুক্রবার। সবাই বাসায় থাকবে, রহমত তার ফ্যামিলি নিয়ে আসবে। সব ঠিক থাকলে ওই দিনই আকদ করে দেব। বাসায় যেন থাকা হয় । আর পারলে
তোমার বড় ভাই কে জানিয়ে দিও সে তো আমাদের কল টা পর্জন্ত ধরে না।
কথাটা শুনে ইউভি থমকে দাঁড়াল,তারপর আবার রওনা দিল নিজের ঘরের দিকে,চোখে মুখে অসহায় রাগের ছাপ।
ছেলের এই বিয়ে তে বিরক্তি দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল রূহেনা বেগম আর মেহজাবীন বেগমের।একটুখানি কান্না যেন ঝুলে রইল চোখের কোণায়।
ওপাশে, তিয়াশা নিজের ঘরের বুকশেলফে বই গুছাচ্ছিল।
” তিউ আপু ……”
আরোহীর গলা শুনতেই তিয়াশা পেছন ফিরে তাকালো।তাকিয়ে দেখলো আরোহী দড়জার কাছে। দাড়িয়ে হাঁপাচ্ছে —
তিয়াশা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল —
” কি রে হাঁপাচ্ছিস কেন এই ভাবে ? ”
আরোহী রুমে ঢুকেই বলে উঠলো —
” তুমি জানো বাসায় কি চলছে ?”
” কি ?”
” তোমার বিয়ের কথা ।”
প্রথমে তো বিশ্বাস ই হলো না এই কথা টা , হেসে বলতে লাগলো —
মজা করার জন্য আর কোন কথা পাচ্ছিস না তাই না ? একটা গাট্টি দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে ।”
এই বলে আবার বই গুলো গুছাতে লাগলো।
কিন্তু আরোহীর এবারের কথায় যেন তার কিছুই মিথ্যে মনে হলো না–
” আল্লাহর কসম তিউ আপু , অয়ন ভাইয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ের কথা চলছে ।”
কথাটা শোনা মাত্রই সেই যেন বজ্রপাতের মত নেমে এলো তার চোঁখে,তিয়াশার হাতে থাকা বইগুলো মেঝেতে পড়ে গেল, তার দৃষ্টি শূন্য, শ্বাস ভারী, ঠোঁট কেঁপে উঠল।
মুখ দিয়ে একটাই শব্দ বের হলো—-
“কি-ই-ই-ই!”
আরোহী সঙ্গে সঙ্গেই তিয়াশার হাত ধরে তাকে খাটে এনে বসালো।
তিয়াশার সমস্ত শরীরে যেন এক অজানা কম্পন তৈরি হয়েছে ,হৃদয়ে এক অস্থিরতা, শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে এক অনিশ্চিত আতঙ্ক।
সে কখনোই ভাবেনি এমন খবর একদিন তাকে শুনতে হবে, শুনে বুকের ভেতর এমন ঝড় উঠবে।এই ‘বিয়ে’ শব্দটা তো সে কল্পনা করেনি, ভুলেই গেছিল একদিন তার পরিবার তার বিয়ের কথা ঠিক আলোচনা করবে।ভাবনায়ও আনেনি, বরং প্রতিটি দিন সে শুধু অপেক্ষা করছিল—
তবুও পরিবারের সবাই এই সিদ্ধান্তে সম্মতি জানাচ্ছে, অথচ কেউ একবারও তার মনের ভেতরটা জানার চেষ্টা করল না।
আর যে নামটা উঠে আসছে–অয়ন, সেই অয়ন
যাকে নিয়ে এত ভুল বোঝাবোঝির সামনে দাঁড়াতে হয়েছে , এখন ও দাড়িয়ে আছে । ভুল বোঝাবুঝির কারণেই তো তাকে তার নিজের ভালোবাসার মানুষ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে থাকতে হচ্ছে।
যার প্রতি তার অনুভুতি বেড়েছে ছাড়া কমেনি, গভীর গভীর অনুভবে আঁকড়ে ধরে আছ তাকে ।যাকে ছুঁয়ে পাওয়ার পরেও হারিয়ে ফেলেছে।
তার ভালোবাসা এখন শুধু অনুভবের মধ্যে বাঁধা এক মানুষ,যার জন্য সে রোজ চুপিচুপি কান্না করে, চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে,যেন একদিন… হ্যাঁ, একদিন সেই মানুষটা আবার ফিরে আসবে… কেবল তার জন্য। আর একবার সে যদি এইসবের কথা জানতে পারে এবার সত্যি সত্যি তাকে মেরেই ফেলবে।
তিয়াশার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো, ঠোঁটের কোণে নিঃশব্দে জমে থাকা কান্নার ফোঁটা কাঁপতে কাঁপতে গড়িয়ে পড়ল খাটের চাদরে , এই সবের মাঝেই অনন্যা
এমন কিছু বলে উঠলো , যা শুনে তার চোঁখ মুখে আবার ও যেন বজ্রপাতের ছায়া নেমে এলো —
“জায়ন ভাইয়া যদি জানে এইসব… তাহলে কি হবে, ভাবতে পারছো আপু?”
তিয়াশা চমকে উঠলো। তার মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ, চোখে জ্বলে উঠলো অজানা আতঙ্কের ছায়া। কণ্ঠটা কেঁপে উঠলো–
“মা… মা মানে?”
“মানে জায়ন ভাই জানলে কি হবে তাই ভাবছি।”
“কে… কেন…?”
“আপু, আমি সব জানি। তাই এখন আর ‘মানে কেন’ করে লাভ নেই।”
তিয়াশা ঘাবড়ে গেল। তার ছোট বোন সব জানে!
তার গলার স্বর একটু কঠিন করে বলল–
“কি জানিস তুই?”
অনন্যা এবার মুখে এক গভীরতা নিয়ে বলল—
“যেদিন বৃষ্টি আপুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না তো, আমি তোমায় ডাকতে উপরে গেছিলাম। তুমি তখন রুমে ছিলে না, ফিরে আসছিলাম… তখন হঠাৎ জায়ন ভাইয়ার রুম থেকে খুব জোরে একটা আওয়াজ আসে।
আমি ভয়ে-আশঙ্কায় এগিয়ে যাই। ভাবছিলাম কি হয়েছে। কিন্তু… যা দেখলাম, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। জায়ন ভাই কাদছিল । ভাবা যায় আপু জায়ন ভাইয়ের মত কঠিন মানুষ তোমার সামনে কাদছিল দেখে একটু দাঁড়িয়েই রইলাম তারপর সব শুনলাম আর এটাও জানি জায়ন ভাই কেন চলে গেছে । শুধু ভয়ে তোমায় কিছু বলতে পারিনি না জিজ্ঞেস করতে পেরেছি । ”
তিয়াশা কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। আবার ও অনন্যা বলে উঠলো —
” খুব ভালোবাসো ভাইয়া কে তাই না তিউ আপু?”
তিয়াশা অনন্যার দিকে তাকিয়ে ছিল নিস্তব্ধ চোখে।
হঠাৎই যেন সমস্ত আবেগ বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এলো।
সে অনন্যাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল।
“খুব ভালোবাসি রে বনু… ওনাকে একবার দেখার জন্য মনটা পুড়ে যায় আমার…
রোজ রাতে ঘুমোতে গেলেই কেবল একটাই মুখ মনে পড়ে, শুধু একটাই নাম হৃদয়ে বাজে—জায়ন ভাইয়া…”
তার কণ্ঠে ছিল এক বিষাদে পোড়া স্বীকারোক্তি।
অনন্যাও আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, সে শক্ত করে বোনকে আঁকড়ে ধরল।
এরপর যেন দু’বোনের মাঝখানে এক দীর্ঘ নীরবতা নেমে এলো ,কিন্তু সে নিস্তব্ধতাও ছিল কান্না আর স্বস্তির, জমে থাকা হাজারো অপ্রকাশিত অনুভবের।
দু’জনে ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করল–মনের গভীর থেকে উঠে এল না বলা অনেক গল্প, কষ্ট, দুঃখ, আশা, আর ভালোবাসার না ফুরোনো চিঠির মতো একেকটি বাক্য।
এদিকে…
ইউভির মাথায় যেন আগুন জ্বলছে,এদিকে ভয়ে অবশ হয়ে উঠছে ,সে পায়চারি করতে করতে ফোন লাগাল আকাশকে।
কল রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে আকাশের স্বাভাবিক কণ্ঠ ভেসে এলো–
“হ্যাঁ ভাইয়া বলো?”
ইউভি বিরক্ত স্বরে বলল,
“কি আর বলব রে… আমি শ্যাস রে আকাশ… শ্যাস রে ভাই… আর মনে হয় অনু রে নিয়ে আমার বসন্ত বিলাস হবে না।”
আকাশ হেসে বলল,
“আরেহ বাবা, এরকম ফ্যাচফ্যাচ করছো কেনো? ঠিক করে বলো তো কী হয়েছে?”
ইউভি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“অয়ন এর সঙ্গে তিয়াশার আকদের দিন ঠিক করা হয়েছে। পরশুদিন।”
আকাশ প্রথমে বুঝতে না পারায় –
” ওহ এই ব্যাপার।
কিন্তু যখন বোধগম্য হলো —
” কি ই ই — কি ই শোনালে ভাইয়া তুমি । মানে আমার ও আর হলো না আমার জলপরি কে নিয়ে সমুদ্র সৈকত।
“এখন নিজেই ফ্যাচফ্যাচ করতেছিস? একটু আগেও তো বাণী ঝরাচ্ছিলি।”
এপাশ থেকে ইউভি ও শুনতে পাড়ছে আকাশ এর ঢোক গেলার আওয়াজ, ওদিক থেকে ভয়ে কাপা কন্ঠে বলে উঠলো—
“তো করবো না, ওই কাগজের কথা মনে নেই । ওখানে তো আমার নাম ও ছিল। জায়ন ভাই তিয়াশার নাম টা পর্যন্ত শুনতে চায় না । আমি একদিন বলতে গেছিলাম
আমায় প্রায় ৩ মাস ব্লক রেখেছিল , কিন্ত আবার তিয়াশা র জন্য লম্বা লিস্ট দিয়ে গেছে । ভাবতে পারছো তুমি যদি এই কথা জানে কোন ভাবে আমাদের গর্দান দেবে বড় ভাইয়া?”
” আমি কি একবার বলার চেষ্টা করবো ? ভাইয়া কে বলি আমরা জানি না বাড়ি দিয়েই ঠিক করেছে ?”
আকাশ ওদিক থেকে ঠোঁট উল্টে বলে উঠলো —
” কি যে বলো ভাইয়া , তুমি বলতে যাবে তিয়াশার নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে কল কেটে তোমায় ব্লক দেবে। পুরো কথা তো ব্যাটা শুনবে না । উনি তো ঠিক ভেবে বসে আছে ওনার জিনিষ সিন্দুকেই আছে ।”
ইউভিড় চিন্তায় কপালে নোনাজল দেখা যাচ্ছে , ভিজে উঠেছে পরণের শার্ট টাও —
” পরে জানলে তো গর্দান দেবে ।”
আকাশ একটু ভেবে বলল —
” আচ্ছা সাগর ভাই , আহান ভাই , পলাশ ভাই কে জানালে হয় না ।”
ইউভি আর দেরি না করেই একসাথে তিনজনকে গ্রুপ কলে নিয়ে নিল। সঙ্গে ছিল আকাশও।
গ্রুপ কল রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে সাগর বলে উঠলো–
“ওই দেখ, ছোট ভাই রা একসাথে… নিশ্চয়ই কোনো গ্যাঞ্জাম বাঁধাইসে!। গ্রুপ কল দিছো।
ইউভি ঠাণ্ডা গলায় বলল–
“ঝামেলা এখনো হয়নি, তবে হবেই। আর সেই ঝামেলায় তোমরা সবাই এক এক ফোঁটা করে পাবে… প্রস্তুত থাকো।”
পলাশ একটু চমকে উঠে বলল—
“মানে কী ভাই? এমন গম্ভীর গলা কেন?”
আকাশ তখন মাথায় হাত দিয়ে বিরক্তভাবে বলল–
“মানে জিজ্ঞেস করো না পলাশ ভাই। আসল ঝড়টা এখনো উঠেইনি, তবে আমরাই মাঝখানে পড়বো।”
আহান ইতোমধ্যে বিরক্ত হয়ে গিয়ে বলে উঠল–
“তোরা কেউ সোজা কথা বলবি না বুঝি? ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাটক করছিস সরাসরি বল কী হইছে?”
ইউভি আর দেরি না করে পুরো ঘটনাটা খুলে বলল–
সেই নীরবতা ভাঙল পলাশ।
রীতিমতো গর্জে উঠল–
“শালার বাচ্চা,নিজে তো বিদেশে তেজ মেরে গেছে, সঙ্গে আমাদের জন্য কুয়া খুঁড়ে গেছে।এখন আবার আকদ রেডি? এতো তেজ আসে কোই দিয়ে আল্লাহ জানে । সাগর, ব্যাটা কে ফোন দে তুই,একবার বল গিয়ে ওর প্রিয় রত্ন হাতছাড়া হইতে চলেছে। এদিকে রত্নর নাম শুনতে চায় না কিন্তু নিজের সিন্ধুকে গুইজা রাখতে
চায়।
সাগর ঢোক গিলে বলল–
“আমি কেন? তুই কর।”
পলাশ এবার একটু মাথা চুলকে বলল–
“আমি করব? ভাই, আমার ফোনে তো ব্যালেন্সই নাই!”
আকাশ তখন হেসে বলল–
“ভাইয়া, বড় ভাইয়ারে এখন ফোন করতে ব্যালেন্স লাগে না, নেট লাগে। আর তুমি এই মুহূর্তেই তো নেটে ঝুলতেছো।”
সবাই যখন একে অন্যকে ঠেলাঠেলি করছে, তখন আহান একটু রাগ করেই বলে উঠল—
“কারোরই করতে হবে না, আমি করছি। সব গাঁজাখুরি ছাড় তোরা।ভীতুর দল কইকার। কালকে সকালেই কল করবো।”
আহান জানে, এদের ভয়টা অমূলক নয়।
কারণ জায়ন এমন এক পুরুষ, যার চোখের দৃষ্টিতেই যেন আগুন জ্বলে। আর তার হাতে আছে এমন কিছু, যা মুহূর্তেই কাউকে তছনছ করে দিতে পারে।
তবু কাউকে তো এগোতে হবে।
মার্চের প্রথম দিক শিকাগো শহরটা এখনো ঠান্ডায় মোড়ানো, তবে তুষারপাত কিছুদিন হলো থেমে গেছে। রাস্তায় বরফের সাদা চাদর আর নেই, কিন্তু বাতাসে এখনো হাড়-কাঁপানো ঠান্ডার ছোঁয়া। গাছে পাতাঝরা, শীতল বাতাসে হঠাৎ হঠাৎ গাছের শুকনো ডালগুলো কাঁপতে কাঁপতে শব্দ তোলে –যেন নিস্তব্ধ শহরের নিঃশব্দ আর্তনাদ।
রাত দশটার দিকে জায়ন ফিরলো নিজের অ্যাপার্টমেন্টে।তাকে দেখে বোঝা যায় সারাদিনের ক্লান্তি কাঁধে ঝুলে আছে। অফিসের টাইটা একহাতে খুলে, দরজাটা ঠেলে ঢুকে পড়লো তিন বেডরুমের এই আধুনিক অ্যাপার্টমেন্টে। পুরো ফ্লোরটাই তার।
বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই অটোমেটিক লাইট জ্বলে উঠলো , ফ্যাকাশে উষ্ণ আলোয় ভরে উঠলো পুরো ঘরটা।
দেয়ালে নিঃশব্দ আর্ট পেইন্টিং, জানালায় সাদা পর্দা, একপাশে লম্বা স্লাইডিং গ্লাসের দরজা ।বাইরে থেকে শহরের আলো-আঁধারি দেখা যায়। বসার ঘরে ধূসর সোফা সেট, তার পাশে একটা গ্লাস টপ সেন্টার টেবিল। দেয়ালের পাশে বইয়ের র্যাক, আর নিচে ছোট্ট হিটার চলতে চলতে উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। রান্নাঘর আধুনিক, মিনি বার ক্যাবিনেট আর এক কোণে রাখা কফি মেশিনটা সারাদিনের অপেক্ষায় ক্লান্ত।
জায়ন সোফায় গা এলিয়ে দিল।একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলো।চোখ বুজে ভাবল —
“এই শহর, এই নিঃসঙ্গতা… আর কতদিন?”
তারপর হাতের ঘড়িটা খুলে পাশে রাখা ট্রে-তে রাখলো , রাখলো নিজের ফোনটাও। নিঃশব্দে একটা মদের বোতল খুলে, গ্লাসে ঢাললো একটুখানি। বাইরে থেকে নিউ জার্সির আলো ঝলমলে শহরটা যেমনই হোক, এই বাড়ির ভেতরে জায়ন যেন এক নিঃশব্দ যুদ্ধের সৈনিক, যাকে কেউ দেখে না, বোঝেও না।
এর মধ্যেই বেজে উঠল ফোন টা , স্ক্রীন এ নাম উঠেছে
মা —
না চাইতেও কল টা রিসিভ করলো —
” হুমম মা বলো।”
ওপাশ থেকে মেহজাবীন বেগম বলে উঠলেন —
” বাসায় ফিরেছ?
” হ্যাঁ কিছুক্ষন আগে , শরীর ঠিক আছে ? মেজো মা , ছোট মা কেমন আছে ?”
” সবাই ভালো আছি বাবা , খেয়েছিস ? ওখানে তো এখন রাত ।”
” জী খেয়েই এসেছি । আচ্ছা পরে কথা হবে , আমি খুব টায়ার্ড মা ।”
” শোন বাবা একটা কথা ছিল জরুরী। ”
” হুমম বলো।”
” কাল তো মেজো আ…
বলা হলো না তার আগেই জায়ন বলে উঠল
মা একটা জরুরী কল আসছে । পরে কথা বলছি “”
এই বলে কল টা কেটে দিলো এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে।দেহটা যেন আরও একটু ভারী হয়ে উঠলো, চোখদুটো হালকা লালচে।
টেবিল থেকে হুইস্কির গ্লাসটা তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে গেল জানালার পাশে।গ্লাসের ভেতরের সোনালি তরলটা হালকা কাঁপছে তার আঙুলের কাপে, আর জানলার কাঁচে এসে ঠেকতেই ঠান্ডা জমাট কুয়াশার ছোঁয়া পেলো হাতটা।
জানলার ওপাশে শিকাগোর নিঃশব্দ রাত।
রাস্তার আলো নিঃশব্দে জ্বলছে, দূরের গাড়িগুলো নিঃশব্দে চলাফেরা করছে –আর তার ভেতরে যেন অনবরত চলতে থাকা এক যুদ্ধ, এক হাহাকার।
জায়নের ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠলো এক ফাঁকা হাসি।
” ছুতে ইচ্ছা করে , নিজের বুকে জড়াতে ইচ্ছা করে ।
কিন্তু শুধু ঐ রাত মনে পরে । নিজের ভালোবাসা যদি অন্য কাউকে না দেখাতি তাহলে প্রতিরাতে তোর চিৎকার শুনতে পেতাম , যেই চিৎকার এর কারন হতাম শুধু আমি যার মাঝে ডুবে যেতাম আমি , এতো দিনে তোকে আমার ব্ল্যাড লাইন ও গিফ্ট করতাম জান। কিন্তু তোর তো অন্য পুরুষের ছোঁয়া চাই ,
দেখ এবার কোন ছেলের নিঃশ্বাস ও যদি পড়তে দেই। এই তিন বছরে দেই নি এখনো দেবো না কিন্তু তোকে যে আমিও ছোঁবো না জান। বেঁধে রাখবো নিজের জালে ।”
এই ভাবনার মাঝেই আবারো ফোন টা বেজে উঠলো,
দাঁতে দাঁত পিষে বলল —
” বালের ফোন শালা পাষাণ টারে নিয়ে ভাবতেও দেবে না । শালা লাইফ এর …..”
স্ক্রীন এ আহান এর নাম দেখে মটকা টা চোটে গেল —
” বাল ফোন করার সময় পাশ না । এত রাতে কি বাল ছিঁড়তে ফোন করেছিস ?”
আহান কান এর পাশ থেকে ফোন টা সরিয়ে দিয়েছিল
যখন বুঝেছে জায়ন এর গালি দেওয়া শেষ হয়েছে
তখন বলল —
” ভাই এত গালি দিশ না , সকালে নাস্তা সারি নাই তোর ওই গালি খেয়ে পেট ভরতে চাই না। আর তোর ওখানে রাত আমার তো সকাল ভাই ।”
” ভাট না বকে বলবি কি কি হয়েছে।”
এবার আহান ও আমতা আমতা করছে। সাহস নিয়ে বলতে তো এসেছিল কিন্তু এখন আর বলতে পারছে
না। আহান এর পাশে রয়েছে সাগর , পলাশ , ইউভি ও আকাশ ও।
এর মধ্যেই —
” তোর পাশে কে রে আহান ?
হঠাৎ জায়ন এর গম্ভির গোলা আহান এর কানে এসে লাগলো । আহান আবারো আমতা আমতা করে
বলল —
” ক ক কৈ কেউ না। ”
” এ বাল ফোন রাখ তো , মাথা খারাপ করে দিচ্ছিস ।”
” আরে ভাই একটা ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে ।”
” তোর ইম্পর্ট্যান্ট কথা পরে বলবি। আমি এখন কোন ডিস্টারবেন্স চাই না।”
এই বলে ফোন টা কেঁটে দিলো ।
“বেশ তো বলতে গেছিলিশ তো বললি না কেন?”
সাগর হেসে হেসে বলে উঠলো।
আহান রাগে গাল ফুলিয়ে জবাব দিলো—
“আমি পারবো না বলতে বাবা রে। আমি তো তাও বলতে গেছি। তোরা বল দেখি?”
এই নিয়ে কিছুক্ষণ চললো ওদের মধ্যে খানিকটা ঠাট্টা আর খুনসুটি।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে সবার বুকেই যেন জমে উঠছিল এক অজানা টেনশন।
তিয়াশা মনমরা হয়ে বসে আছে ব্যালকনির দোলনায়।
হাওয়ার ঝাপটায় দোলনাটা হালকা করে দুলছে, কিন্তু তিয়াশার মন যেন একটুও নড়ছে না।
চোখ দুটো লাল, ফ্যাকাশে মুখ, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে ।
কাল থেকে অনন্যার থেকে বিয়ের খবরটা শোনার পর, নিজের মুখটাই আয়নায় সহ্য করতে পারছে না সে।
চুপচাপ বসে আছে, কিছু বলছে না, কারো সঙ্গেও আর চোখাচোখি করছে না।
বাড়িতে কীভাবে মুখ ফুটে কিছু বলবে, সে সাহসও আর নেই তিয়াশার। যে ভালোবাসা এতদিন বুকের গভীরে রেখে দিন গুনে গুনে অপেক্ষা করেছে ।।
তাকে একবার কেউ জিজ্ঞেস পর্জন্ত করলো না, তাকে কি একবার জিজ্ঞেস করা যেত না , যে সে এসব এ রাজি কিনা।
বরং বলছে, অন্য কারো নাম, অন্য কারো সঙ্গে তার নতুন জীবনের গল্প সাজিয়ে ফেলেছে সবাই।
বাতাসে যেন হঠাৎ করে কাঁপন ধরলো —
তিয়াশার বুকের ভিতরেও এক অদৃশ্য ঝড় বইছে,
যার শব্দ কেবল সে নিজেই শুনতে পাচ্ছে।
“এরকম মুখ করে বসে আছিস কেন?”
রূহেনা বেগমের গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠে যেন কেঁপে উঠল তিয়াশা।
ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে ধীর গলায় বলল–
“কিছু না, আম্মু।”
“যাই হোক, শুনে রাখো কাল অয়নদের বাড়ি থেকে তোমাকে দেখতে আসবে। নিজের এই মুখটা ঠিকঠাক করে, ভদ্রভাবে যেন সামনে আসা হয়।”
রূহেনা বেগমের মুখে এই কথা শুনে তিয়াশা একবার তার দিকে তাকাল। চোখে জমে থাকা একরাশ কান্না চেপে রেখে মনে মনে ভাবল–
একবারও কি জিজ্ঞেস করা যেত না? জানতে চাওয়া যেত না সে আদৌ এসব চায় কি না?
কিন্তু না–
নিজের মায়ের সামনে বলতে পারা সাহসই কি সহজ কথা? তবুও বুকের গহীন থেকে সাহস টেনে নিয়ে বলল সে–
“আম্মু… আমি এখন বিয়ে করতে চাই না।”
রূহেনা বেগম এই উত্তর আশা করেই এসেছিলেন। কিন্তু তাঁর মনে ভয়,যদি আবার একবার সেই ঘটনা ঘটে যদি বৃষ্টির মতোই তিয়াশাও…?
না এবার আর কোনও ভুল সহ্য করব না।
গলা শক্ত করে বললেন–
“যা বলা হয়েছে, তাই করো। আমি তোমার পারমিশন নিতে আসিনি।”
এই বলে তিনি ঘুরে চলে গেলেন। পিছন ফিরে আর একবারও দেখলেন না নিজের মেয়ের বিমর্ষ মুখটা।
তিয়াশার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। বুক ফেটে যাচ্ছে। নিঃশব্দে ফিসফিস করে বলল সে—
“তোমার বাঘিনীকে অন্য কারো হাতে তুলে দিচ্ছে সবাই… শুনতে পাচ্ছেন না আপনি?জানেন এটা, তবুও ফিরবেন না? সত্যিই কি… আপনি আর আমাকে ভালোবাসেন না?”
সন্ধ্যা রাতে ইউভি তার রুমেই ছিল , মনের মধ্যে এক ভয় । এক কঠিন পরিস্থিতির সামনা সামনি হওয়ার ভয়ে কুড়ে খাচ্ছিল নিজেকে , অনেক সাহস জাগিয়ে জায়ন কে ফোন করল সে —
কিন্তু ফোন টা বেজেই চলেছে কিন্তু তুলছে আর না , একবার না ৩,৪ বার কল দিল কিন্তু কোন রেসপন্স পেলো না। এর মধ্যেই এক কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো —
” ভাইয়া আসবো ?”
ঘুরে তাকিয়ে বলল —
” আয় বনু ।”
রুমে ঢুকেই চুপ করে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে তিয়াশা, বোনের এরকম চেহারা দেখে বুঝতে অসুবিধা হয়নি তার বোন কেন কি কারনে এখানে এসেছে —
” কিছু বলবি ?”
তিয়াশা চোঁখ তুলে উপরে তাকাতেই দেখল তার বোনের চোখের জল নিঃশব্দে বয়ে চলেছে , ইউভি
আর সহ্য করতে না পেরে জরিয়ে ধরলো বোন কে —
” কাঁদে না সোনা বোন আমার , প্লীজ আমার সামনে এই ভাবে কাদবি না ।”
” আমি এই বিয়ে করতে চাই না ভাইয়া । করতে চাই না”
” জনিত আমি , কিন্তু তুই তো জানিস এই বাসায় তোর এই ভাইয়ের কথা শোনার মত কেউ নেই। যে ছিল সে তো হাজারো মাইল দূরে বসে আছে।”
” ওনাকে একটু আসতে বলো না ভাইয়া, উনি কি আমায় ভুলে গেছেন? ”
” অনেক বার চেষ্টা করেছি ফোন টাই তুলছে না।”
কেউ আর কোন কথা বললো না।
আর কেউ কিছু বলল না ——
সকালটা আজ চৌধুরী বাড়িতে অন্যরকম।
ঠাণ্ডার হালকা হাওয়া বইছে আজ যেন অস্বস্তিকর এক উত্তেজনার বাতাস বইছে।সাদা তুলোর মত রোদ উঠেছে ঠিকই, কিন্তু চৌধুরী পরিবারের বুকের ভেতরটা যেন রোদে নয়, ধোঁয়ায় জড়ানো।
ঘড়ির কাঁটা এগোর টা ছুঁই ছুঁই করছে, রান্নাঘরে বেজে উঠেছে প্রস্তুতির ব্যস্ততা।
বাড়ির গিন্নি রা একে-অপরের দিকে তাকানো, কাজের লোকের অকারণে হাঁটাহাঁটি,সব মিলিয়ে বাতাসেও যেন এক চাপা গুঞ্জন। আয়েশা বেগম ও এসেছে আজ নিজের পরিবারের সঙ্গে।
কারণ আজ অয়ন ও তার পরিবার আসবে তিয়াশাকে দেখতে।
ডাইনিং টেবিলে লাল মখমলের টেবিল ক্লথ, রুপার বাটি সাজানো হয়েছে।বৃষ্টির নাম যেন কেউ মুখেও আনছে না, যেন সে কোনো নিষিদ্ধ ছায়া,
সবাই খুব সচেতন, আজ যেন কিছুতেই কোনও ঝামেলা না হয়।
মেহজাবীন বেগম রুহেনা বেগম সুরাইয়া বেগম আজ অনেক ভোরেই উঠেছেন, বার বার সব গুছিয়ে দেখছেন ঠিক হয়েছে কি না। কর্তারা ড্রইং রুমের এক কোণে বসে চুপচাপ চা খাচ্ছেন ।
তিয়াশার রুমে বাতাসও যেন থমকে আছে।
আজ যে তাকে দেখতে আসবে, সে খবর জানার পর থেকেই সে নিঃশব্দ হয়ে গেছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আছে, লাল শাড়ি গায়ে, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক,তবুও মুখে কোনো আলোর ছোঁয়া নেই।
আয়নার দিকে তাকিয়ে সে শুধু নিজের নয়, নিজের কপালের দিকে তাকাচ্ছে।চোখদুটো ফাঁকা,যেখানে একদিন স্বপ্ন ছিল, আজ শুধু অবাধ্য বাস্তব।
আর এদিকে ইউভি বাসায় নেই সে এসবের মধ্যে থাকতে চায় না । অনেক বার ফোন লাগিয়েছে জায়ন কে কিন্তু এখন ফোন টাই যাচ্ছে না।
“রহমত তোকে যে শালা থেকে বিয়াই বানাবো ভাবতে পারিনি । ”
এই বলেই হেসে উঠলেন প্রান্তিক সাহেব।
” আরে দুলাভাই সে তো আমার মাথা তেও ছিল না, চট্টগ্রাম এর প্রজেক্ট শেষ করে আসার পর অয়ন ই বলল একদিন আমি বিয়ে করব আব্বু । আমি তো শুনে অবাক ই হয়েছিলাম বুঝলে দুলভাই।”
এদিকে অয়ন তার আব্বুর কথায় লজ্জায় পড়ে যাচ্ছে।
সে তো তার ভালবাসা কে নিতে এসেছে , যেই অনুভুতি
তিয়াশার তার জন্যে দেখেছিল সেও তো এতদিন সেই অনুভুতি ই নিজের মনে বাড়িয়ে চলেছে। এই তিন বছর
বিজনেস এর ই এক প্রোজেক্ট এর কাজে তাকে চট্টগ্রাম থাকতে হয়েছে । প্রজেক্ট শেষ হওয়ার পর বাসায় এসে মায়ের মুখেই শোনে কোন কারণে জায়ন এর কথা । সে জানে জায়ন ভাই রাজি হবে না এই বিয়েতে তাই এই মুহুর্তেই সে এই সিদ্ধান্ত তার আব্বু কে জানিয়েছে ।
” যখন শুনলাম মেয়ে নাকি আমাদের তিয়াশা আম্মু, তখন কি আর মানা করা যায় ।”
প্রণয় সাহেব ও এবার হেসে বললেন —
” হ্যাঁ রহমত অয়ন ও নিঃসন্দেহে ভালো ছেলে । তাই আমরাও না করিনি । আর তোমরা যে ওই ঘটনা জানার পরেও আমার মেয়ে কে নিতে চাইছো এটাই অনেক ।
” আরে ওসব কথা ছাড়েন মেজো ভাইয়া এখন আমরা বিয়াই হতে যাচ্ছি এসব আর বলেন না। কিন্তু অয়ন এর একটা দাবি আছে ।”
এই কথা শুনতেই যেন চৌধুরী পরিবারের সবাই চমকে উঠলেন সবার মুখে দেখা গেল এক অস্থিরতা,
মেহজাবীন বেগম বলে উঠলেন —
” দাবি কিসের দাবি রে ভাই তোদের ?”
সুনিতা বেগম সবার চিন্তিত মুখ দেখে বললেন –
” আরে আপু তেমন কিছু না , আমাদের অয়ন চায় বিয়েটা তিন চার দিনের মধ্যেই করতে। ওর আবার দেশের বাইরে যেতে হবে তাই ও চাইছে বিয়েটা এখন ই হোক । পরে না হয় তিয়াশা আম্মু কে ধুম ধাম করে বাসায় তুলবো। কি বলেন আপনারা ?
সবার মুখে ফুটে উঠল আবারো হাসি –
প্রান্তিক সাহেব বললেন —
“খুব ভালো সিদ্ধান্ত, কি মেজো ছোট তোদের কোন সমস্যা আছে নাকি ?”
তাহসান সাহেব বললেন —
” না না খুব ভালো সিদ্ধান্ত, ততদিন তিয়াশা আম্মু ও পড়া শোনা টা ঠিক ঠাক করতে পারবে ।”
রুহেনা বেগম বললেন —
“একবার জায়ন কে জানিয়ে সিদ্ধান্ত নিলে হতো না”
জায়ন নামটা শুনতেই অয়ন এর চোখে দেখা গেল এক খুব পরিচিত ভয় , সে জানে জায়ন ভাইয়া যদি একবার জানে তাহলে তাদের এই ভালোবাসা পূর্ণ হতে দেবে না।
অথচ অয়নের জানাই নেই সেদিনের তিয়াশার ভালোবাসা ব্যক্ত করার মানুষ সে নয় বরং জায়নের জন্যই ছিল।
এর মধ্যেই প্রান্তিক সাহেব বলে উঠলেন–
“সে বাড়ির কোন সিদ্ধান্ত নিলে তো, তার কাছ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে সে তো কোন সিদ্ধান্তেই থাকতে চায় না। সে তো ভুলেই গেছে তার কোন পরিবার আছে।”
এই নিয়ে আর কোন কেউ কথা বাড়ালে না। এর মধ্যেই নয়ন বলে উঠল —
“ভাবি কোথায়? ভাবিকে তো দেখতে পাচ্ছি না”
রহেনা বেগম বললেন–
” হ্যাঁ বাবা উপরেই আছে এক্ষুনি ডাকছি।”
রুহেনা বেগম সুরাইয়া বেগমকে বললেন উপর থেকে ওদের ডেকে আনতে —
একটু পরেই নিচে নামল লাল শাড়ি পরিহিতা তিয়াশা
সঙ্গে সুরাইয়া বেগম ও অনন্যা।
অয়ন তিয়াশা কে দেখে এক ঘোরের মধ্যে চলে গেলো , এই তার সেই রূপসী কি মায়াবী। একবার শুধু তার হয়ে যাক ভরিয়ে দেবে ভালোবাসায় ।
অয়ন এর এই অবস্থা দেখে নয়ন একটু কেশে উঠলো —
” ভাইয়া সাবধান সামনে তোমার হবু শ্বশুর বাড়ির লোক জনে ভর্তি।”
” বেশি বকিস না তো ।”
এই বলেই আবার তাকিয়ে রইলো তিয়াশার দিকে ।
সবাই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই রইলো —
” আসো আসো আম্মু এদিকে আসো।”
এই বলে সুনিতা বেগম কাছে বসিয়ে নিলেন । সবার মুখেই হাসি শুধু হাসি নেই তিয়াশা আর অনন্যা র মুখে।
রায়ান অনন্যার পাশে এসে একটু মজার ছলেই বলল
” এরপর তোর পালা বুঝলি। রেডী থাক ।”
এই বলেই দুজনের মধ্যে নিরবে এক খুনসুঁটি চলতে লাগলো। বড় হয়েছে দুজনেই কিন্তু সেই খুনসুঁটি এখনো যায়নি।
তিয়াশার হৃদয় যেন নিঃশব্দে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
ভেতরে ভাঙনের এক নির্মম সুর বেজে চলেছে,কিন্তু কেউ শুনতে পাচ্ছে না, কেউ বোঝেও না।
সে যে প্রতিটা মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিচ্ছে, হাসির আড়ালে লুকিয়ে রাখছে কান্না,তা তো কেউ দেখতে চায় না।
আজকের এই সাজসজ্জা সব যেন তার বুকের উপর এক ভারী পাথর হয়ে বসেছে।
হৃদয়ের প্রতিটা কোণ কাঁপছে, যেন নিজের অস্তিত্বকে সে নিজেই অস্বীকার করতে চাইছে।জায়ন ভাইয়ার মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে ,আর সেই মুখের অভিব্যক্তি কল্পনাতেই সে কেঁপে উঠছে।
সবার মতা মতে সম্পন্ন হলো তাদের আংটি বদলের পর্ব। তিয়া শার হাত এখনো কাপছে, একবার ফিরেও তাকায়নি অয়নের দিকে। মনে মনে দিয়ে চলেছে অজস্র গালি। বুকের এই কষ্ট আর সহ্য করতে না পেরে কাউকে কিছু না বলেই দৌড়ে চলে গেলো উপরে, সবাই ভেবে নিলো হয়তো লজ্জা পেয়েছে কিন্তু এই চলে যাওয়ার পেছনে যে রয়েছে এই পরিস্থিতি থেকে সে নিজেকে মুক্ত করতে চাইছে।
অনন্যা ও যেতে লাগলো কিন্তু হঠাৎ অয়ন ধীম কন্ঠে বলে উঠলো —
” এই যে হবু ছোট শালিকা , একটা কথা ছিল।”
অনন্যা একটু রেগেই বলল —
” এখনো হয়নি শালিকা।”
অয়ন একটু হেসে বলল–
“হয়ে যাবে চার দিনের মধ্যেই।”
“এসব না বলে কি বলতে চান সেটা বলেন”
“তোমার আপু ফেসবুক ইউজ করে?”
“জী কেন?”
“আইডিটা দেবে একটু দরকার আছে”
অনু কি করবে বুঝতে পারছে না দেবে কি দেবে না কিন্তু কি মনে করে আইডিটা দিয়ে দিল।
চৌধুরী বাড়িতে চলছে খাওয়া দাওয়া হাসি ঠাট্টা কিন্তু কেউ একজন নিরবে কেদেই চলেছে তা কারো খেয়াল নেই।
জায়ন তার গেমিং প্রজেক্টের তৃতীয় ধাপ লঞ্চ করতে গিয়ে গত দুই দিন ধরে একটানা কাজ করেছে। ব্যস্ততার চাপে খাওয়ার সময়টুকু পর্যন্ত সে পায়নি সকালের নাস্তা হয়েছে দুপুর গড়িয়ে, আর দুপুরের খাবার কখনো কখনো মধ্যরাতে। একরাশ ক্লান্তি নিয়ে সে ফিরেছে নিজের ইউএসের অ্যাপার্টমেন্টে, কনক্রিট আর কাচের শহরের বুক চিরে গড়ে ওঠা আধুনিক জীবনের এক নিঃসঙ্গ ঠিকানায়।
শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত শরীরটা একটু স্হির করার চেষ্টা করল সে। প্রায় ১৫ মিনিট পর, সাদা তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো। পরনে ছিল ঢিলেঢালা ব্যাগি ট্রাউজার আর নরম সুতোর একটি কালো টিশার্ট।
চুপচাপ চলে গেল তার ছোট্ট বার ক্যাবিনেটের দিকে। সেখান থেকে এক বোতল হুইস্কি বের করে ঢেলে নিল নিজের কাচের গ্লাসটায়। হাতে গ্লাস নিয়ে পা টানল সেই রুমে—যেখানে আলো অন্ধকারে মিশে এক রহস্যময় আবহ তৈরি হয়েছে, আর দেয়ালজুড়ে টিমটিম করে জ্বলছে একাধিক ইলেকট্রনিক স্ক্রিন।
কিছুক্ষণ নিজের গেমিং প্রজেক্টের আপডেট গুলো সেন্ড করে বিছানায় নিজের দেহ টা মিলিয়ে দেওয়ার জন্য উঠতে যাবে —
হঠাৎ চোখে পড়ল তিয়াশার ফেসবুক আইডি তে —
” অয়ন তালুকদার সেন্ড ইউ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট।”
মাত্র কয়েকটি শব্দ, অথচ তার ভেতর যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। রক্ত যেন ধীরে ধীরে মাথায় উঠে গেল, মুখটা ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে উঠল। ঠোঁট চেপে ধরল, চোয়াল শক্ত চোখে ফুটে উঠল চাপা আগুন।
রিকোয়েস্ট ডিলিট করার সিদ্ধান্ত নিয়েই হাত বাড়িয়ে ছিল আবারো কম্পিউটারের কিবোর্ডে। কিন্তু কি মনে করে রিকোয়েস্ট টা একসেপ্ট করল —
একটু পরেই ভেসে উঠলো আরেকটি নোটিফিকেশন
তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩০
” টুডে অয়ন তালুকদার এনগেজড উইথ তিয়াশা রোদ চৌধূরী।”
দেখার সঙ্গে সঙ্গেই নিজের পাশে রাখা কাচের গ্লাস টা ছুঁড়ে মারল কম্পিউটারের স্ক্রিনে।
রুমের মাঝেই বয়ে চলল এক ঝড়, চিৎকার ও অজস্র ফোন কল ।
শেষ ফোন কলে জায়ন এর গলায় শোনা গেল এক গাম্ভীর চিৎকার–
” জেমস আমার ২ দিনের মধ্যেই সব প্রসেসিং শেষ করে বি. ডি. যাওয়ার ২ টো এয়ার টিকিট চাই
অ্যাট এনি কস্ট।”