আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৬

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৬
অরাত্রিকা রহমান

রাত ১০টা~
মিরায়া জুলিয়েট কে কোলে নিয়ে ড্রয়িং রুমে এসেছে‌ কিছুসময় হলো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আর এখন সন্ধ্যার পর রাত হয়ে গেছে কিন্তু রায়ান এখনো বাড়িতে আসেনি। বিষয়টা মিরায়ার মনে আরো অশান্তির সৃষ্টি করছিল। তাই নিচে নেমে রায়ানের বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করছিল।
রান্নাঘরের রামিলা চৌধুরী রাতের খাবার তৈরি করতে ব্যস্ত। মিরায়া জুলিয়েটকে কোলে নিয়েই রান্নাঘরে গিয়ে রামিলা চৌধুরীর পাশে দাঁড়িয়ে নিজের মনে মনে ভাবল- “উনি বাড়ি থেকে বের হয়েছেন অনেকক্ষণ সময় তো হলো। মামনি কে একবার জিজ্ঞেস করে দেখব কি কখন আসবেন?”
রামিলা চৌধুরী মিরায়াকে হঠাৎ পাশে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করলেন-

“মিরা মা, কিছু বলবি?”
মিরায়া হালকা চমকে গিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল-“কই কিছু না তো মামনি। এমনি দেখতে এলাম কি করছো। কোনো সাহায্য লাগবে? আমাকে বলো।”
রামিলা চৌধুরী মিরায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-“না রে মা, কিছু করতে হবে না তোর।”
মিরায়া কৃত্রিম হেঁসে আবার ভাবলো স্বাভাবিক স্বরে রায়ানের কথা একবার জিজ্ঞেস করবে। মিরায়া মৃদু আওয়াজ করে বলতে শুরু করলো-” আচ্ছা মামনি, অনেক তো রাত হলো রা..!” মিরায়া কিছু বলার আগেই দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো।
রামিলা চৌধুরী- “মিরা একটু দেখ তো কে এলো।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিরায়া জুলিয়েট কে কোলে নিয়েই মূল দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলেই সামনে দেখলো রায়ান দাঁড়িয়ে। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট বুঝতে পারলো মিরায়া। রায়ান বাড়ি ফিরেই মিরায়ার মুখটা দেখে অদ্ভুত এক শান্তি অনুভব করলো যেন সব ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে গেছে তার। মিরায়া দরজা ছেড়ে একটু সরে দাড়াতেই রায়ান বাড়িতে প্রবেশ করল। মিরায়ার কোলে জুলিয়েট কে দেখে রায়ানই দরজাটা লাগিয়ে দিল। মিরায়ার কোল থেকে জুলিয়েট নিজ ইচ্ছায় রায়ানের কোলে যাবে বলে অঙ্গভঙ্গি করলো। মিরায়া অবাক-“জুলিয়েট, যে কিনা মিরায়া ছাড়া কারো কোলে থাকতে চায় না। সে নিজের থেকে রায়ানের কোলে যেতে চাইছে।”

রায়ান মিরায়ার কোল থেকে জুলিয়েট কে নিজের কাছে নিলো আর মিরায়াও দিয়ে দিল। রায়ান জুলিয়েট কে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো চুমু খেতে খেতে- “হাই বেবি, পাপা ইজ ব্যাক হোম। ডিড ইউ মিস মি?”
মিরায়া রায়ানের জুলিয়েটের পাপা হিসেবে সম্বোধন করাটা একটু অনিচ্ছুকভাবে মেনে নিল। তার কেন যেন মনে হচ্ছে এখন এসব নিয়ে তর্ক পরিস্থিতি আরো খারাপ করবে। রায়ান মিরায়ার মনভাব বুঝতে পেরে জুলিয়েট কে আরো একটু আদর করে চুমু দিয়ে মিরায়ার কোলে ফিরেয়ে দিলো, যদিও তার ইচ্ছে ছিল না। রায়ান মিরায়ার সাথে কোনো প্রকার কথাই বলল না। ড্রয়িং রুমের সামনে আসতেই রামিলা চৌধুরী রান্নাঘর থেকে হেঁয়ালি করে বলে উঠলেন-
“বাবা সারাদিন পর রাজকুমার আমার বাড়ি ফিরলেন। খুব ব্যস্ত মানুষ ।”

রায়ান মায়ের দিকে মুখ করে বলল-
“উফ্ আম্মু কাজ ছিল। মাত্রই এলাম এখন শুরু করো না তো।”
(মিরায়ার দিকে আড় চোখে দেখলো একবার- সে মাথা নিচু করে জুলিয়েট কে আদর করছে) রায়ান আবার চোখ ঘুরিয়ে জোরে বলল- “আমি উপরে গেলাম। রাতে খাওয়ার সময় ডাক দিও।” রায়ানের কথাটা মিরায়া শুনতে পেল তবে কিছু বলল না, তার মনে এই ভেবে শান্তি লাগছে যে রায়ান বাড়ি ফিরে এসেছে দিন শেষে। রায়ান সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল।
মিরায়াও তারপর নিজের রুমে চলে গেল। কিন্তু সে রিমিকে দেখতে পেল না রুমে। মিরায়া নিজের মনে বিড়বিড় করলো-“অদ্ভুত তো! রুমেই তো ছিল রিমি । এখন আবার কোথায় গেছে!”

ছাদে~
ছাদের উপর নরম ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, যেন প্রতিটা বাতাস শরীর ছুঁয়ে মনকে আলাদা প্রশান্তি দিচ্ছে। আকাশটা পুরো পরিষ্কার। বিশাল অন্ধকার নীল আকাশে ভেসে আছে একফালি চাঁদ আর অজস্র তারা। চাঁদের সাদা আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে, ছাদের মেঝেতেও যেন রুপালি আস্তরণ বিছানো। হাওয়া এসে বারবার ছুঁয়ে দিচ্ছে।রাতটা শান্ত, অথচ অদ্ভুত রোমান্টিক।
এই আবহে ছাদের এক পাশে বসেছিল রুদ্র। হাতে তার শখের গিটার। আঙুল বোলাচ্ছিল তারের উপর, ধীরে ধীরে সুর বেরোচ্ছিল। তারপর নরম কণ্ঠে গেয়ে উঠল—

“যার কথা ভাসে, মেঘলা বাতাসে,
তবু সে দূরে তা মানি না।
যার উষ্ণ আঁচে, ভালোবাসা বাঁচে,
সে হৃদয় ভাঙে তা মানি না।
জানিনা, কেন তা জানি না।
জানিনা, কেন তা জানি না।
জানিনা, কেন তা জানি না…।
জানিনা, কেন তা জানি না….।”
গলার আবেগ, গিটারের সুর আর চারপাশের রাতের পরিবেশ যেন মিলে এক অদ্ভুত যাদু তৈরি করল। রিমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনছিল পিছনে। চোখে ছিল অবাক মুগ্ধতা। যেন রাতের চাঁদের থেকেও উজ্জ্বল লাগছিল রুদ্রর গান।
গান শেষ হতেই গিটার থেমে গেল। এক মুহূর্তের জন্য পুরো ছাদ নিস্তব্ধ। রুদ্রও একটু নিঃশ্বাস নিল বেশ অনেক দিন পর আজ আবার নিজের মধ্যে আগের রুদ্র কে ফিরে পেল মনে হলো তার।
ঠিক তখনই—পিছন থেকে হাততালি দিল রিমি। রুদ্র হকচকিয়ে ঘুরে তাকাল চমকে। পিছনে ঘুরতেই রিমিকে দেখে লজ্জায় পড়ে গেল সে,

— “আরে! রিমি, আপনি এখানে…?”
চোখে অপ্রস্তুত ভাব, ঠোঁটে লাজুক হাসি। কি বলা উচিত বুঝতে পারছে না। রিমি আগিয়ে গেল রুদ্রর কাছে।
রিমি এগিয়ে এসে হেসে বলল—
— “দারুণ হয়েছে। গিটারটাও বেশ বাজিয়েছেন। এতো ভালো গান আপনি, কই আগে তো বলেন নি।”
রুদ্র ঘাড় চুলকে হালকা লজ্জা লুকাতে চেষ্টা করল। তারপর বলল— “এই তো… অল্প স্বল্প।”
তারপর কৌতূহল নিয়ে বলল—
— “দুপুরে আপনাকেও তো দেখলাম গিটার বাজাচ্ছেন। আমিও তো জানতাম না আপনার এই গুন আছে। কোথায় শিখলেন?”
রিমি শান্ত স্বরে উত্তর দিল—

— “ছোটবেলায় শিখেছিলাম। তবে নিজের কোনোদিন গিটার ছিল না… সামর্থ হয়নি। তাই শখটা পুরোপুরি পূরণ হয়নি। টুকটাক পারি এই আর কি।”
তার চোখে হালকা আক্ষেপ। তারপর মৃদু হাসি দিয়ে আবার বলল— “ আসলে এই কারণেই, আজ দুপুরে আপনার ঘরে গিটারটা দেখে আর আটকাতে পারিনি নিজেকে। অনুমতি ছাড়াই ঘরে ঢুকে গিটারটা বাজিয়েছি। আমি জানতাম না আপনার রুম। এজন্য দুঃখিত।”
রুদ্র দ্রুত মাথা নেড়ে বলল—
— “না না! দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। বরং আমার ভালো লেগেছে—মানে…” কথা থামিয়ে ফেলল।
রিমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো
— “ভালো লেগেছে মানে?”
রুদ্র একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল—

— “মানে… শুক্রবারটা আপনি এখানে কাটালেন। বান্ধবী হিসেবে মিরা ভাবির সাথে সময় কাটাতে এসেছেন। তাই… ভালো লাগছে।”
রিমি হালকা মুচকি হেসে মাথা নাড়ল।
— “ওহ্ আচ্ছা, বুঝেছি।”
তারপর দুজনেই নীরবে দাঁড়াল। চাঁদের আলো, ঠাণ্ডা হাওয়া আর রাতের আবহে এক অদ্ভুত শান্তি তৈরি হলো। দুপুরের তার ভাইয়ের খারাপ ব্যবহার করার বিষয়টা আর মাথায় আসছে না রিমির। হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে রিমি বলল—
— “আজ খুব ভালো লাগছে। কিন্তু আপনারা সবাই আমাকে যেভাবে আপন করে নিলেন, মনে হচ্ছে আমি আসলেই আপনজনের মাঝে আছি। এই অনুভূতি আগে কখনো পাইনি।”
তার চোখে তৃপ্তির ছায়া। ঠোঁটে নরম হাসি। রুদ্র চুপচাপ তাকিয়ে রইল রিমির দিকে। চাঁদের আলোয় রিমির মুখটা যেন আলাদা আলো ছড়াচ্ছিল।
তার মনে হলো—
“এই রাত যতই সুন্দর হোক, চাঁদ যতই উজ্জ্বল হোক… রিমির হাসি তার চেয়েও আলোকিত।”

রাত ১১টা~
ডাইনিং টেবিলে সারি সারি খাবার সাজানো। মসলার গন্ধে ভরপুর ঘরটা, মুরগির ঝোল, ভাজি, পোলাও, শূটকি ভর্তা থেকে শুরু করে মিষ্টি দই পর্যন্ত সব সাজানো। রামিলা চৌধুরী নিজে দাঁড়িয়ে হাতে করে প্লেটে প্লেটে খাবার বাড়ছিলেন।রায়হান চৌধুরী টেবিলের মাথায় বসেছেন। রিমি বসেছে রুদ্রর পাশে, সোরায়া রামিলা চৌধুরীর কাছে, আর স্বাভাবিকভাবে রায়ান বসেছে মিরায়ার পাশেই।
রায়ানের চেহারায় ভীষণ সিরিয়াস ভাব। দুপুর থেকে এখন পর্যন্ত মুখে খাবার তেমন যায়নি। কিন্তু এখন সে চুপচাপ মন দিয়ে খাচ্ছিল। মিরায়ার দিকে কোনো কথা নেই, কোনো দৃষ্টি নেই—শুধু প্লেটের দিকে মনোযোগ। ইচ্ছে করেই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে কিনা বলা মুশকিল। তার কাছে যেন অদৃশ্য হয়ে আছে মিরায়া। মিরায়া মাথা নিচু করে খাচ্ছিল। চোখ নামানো, একদম চুপ। তবুও ভেতরে ভেতরে একটা অস্বস্তি তাকে পেয়ে বসেছিল।
খেতে খেতে হঠাৎ রায়হান চৌধুরী বললেন—

— “মহারানি, আজ রান্নাটা সত্যিই জমে গেছে। ওহ্! রেধেছো।”
রামিলা চৌধুরী হাসিমুখে উত্তর দিলেন—
— “সব সময় তো আর পারি না, আজ একটু মন দিয়ে করেছি। সোরায়া রায়ান দুপুরে তো খেলোই না তাই।”
রুদ্র আর রিমি একসাথে হেসে মাথা নাড়ল। সোরায়া মুচকি হেসে যোগ করল—
— “মামণির হাতের রান্নার সঙ্গে আসলেই কারো তুলনা হয় না। আমি আজকে বাইরে খেয়ে অনেক বড়ো মিস করেছি।”
মুহূর্তটা বেশ হালকা, আনন্দময়। হাসি-আড্ডা মিলেমিশে খাবারের টেবিল প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। সবাই আনন্দে খেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঠিক তখনই রায়ান গম্ভীর গলায় বলল—

— “আমি আমেরিকায় ব্যাক করছি। ওখানে কিছু ইম্পরট্যান্ট কাজ আছে আমার।”
কথাটা বলা মাত্রই টেবিলে হাসি-আড্ডা থেমে গেল। মুহূর্তেই পরিবেশ বদলে গেল। কেউ নিজেদের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। চামচের শব্দ থেমে গেল, হাতের ভাত থেমে গেল।
সবাই বিস্মিত চোখে তাকাল রায়ানের দিকে। আর ঠিক তখনই রায়ানের কথা শুনার পর মিরায়ার গলায় ভাত আটকে গেল। কাশতে শুরু করল সে।
সবাই ভয় পেয়ে তাকাল মিরায়ার দিকে। রায়ান তাড়াতাড়ি গ্লাসে পানি এগিয়ে দিল, আরেক হাত মিরায়ার মাথায় রাখল।

—”পানি খাও…”
তার কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা, কিন্তু ভেতরে এক অদ্ভুত কোমলতা।
চোখে ঝলসে উঠছিল যত্নের ছায়া। মিরায়া তাড়াহুড়ো করে পানি খেল। গলা পরিষ্কার হলো, শ্বাস ঠিক হলো।
মনে মনে রায়ান হালকা একটা বিরক্তি মেশানো স্নেহ ভাব নিয়ে বলে উঠল—
“এমনি কাছে আসে না, এখন আবার খাবার আটকে যাচ্ছে গলায় চলে যাবো বলেছি বলে। ধামড়ি মেয়ে খেতে শেখেনি এখনো। এমন বাচ্চা বউ রেখে কোথাও যাওয়াও দ্বায় হবে আমার। চিন্তাতেই ঘুম হবে না।”
কিন্তু রায়ানে মুখে শান্তভাব নিজের ভিতরের যত্ন আড়ালে রেখে বলল—

— “সাবধানে ধীরে খাও ”
মিরায়া চুপচাপ বসে রইল। মাথা নিচু, আর খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিল। খেতে আর ইচ্ছে করছে না।
সবাই একসাথে তাকিয়ে ছিল তাদের দিকে। রায়ান সবাইকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সবার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল—
— “এভাবে দেখার কিছু নেই। আর অবাক হবারও কিছু নেই।কাজ আছে, তাই যাচ্ছি। আমার প্রয়োজন সেখানে।”
তারপর এক ঝলক চোখ তুলে তাকাল মিরায়ার দিকে। মিরায়া তখনও আগের মতো একদম পাথরের ন্যয় বসে আছে। চোখে বিস্ময়, শরীর কেমন জমে গেছে যেন।
রায়হান চৌধুরী ভ্রু কুঁচকে রায়ানকে জিজ্ঞেস করলেন—

— “কবে যাচ্ছো শুনি?”
রায়ান নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিল—
— “কাল। ভোরের ফ্লাইট।” (খাবার মুখে দিতে দিতে)
রামিলা চৌধুরী চমকে উঠলেন।
— “কি! কালই যেতে হবে?”
রায়ান মাথা নাড়ল—
— “হ্যাঁ।”
টেবিলে নিস্তব্ধতা নেমে এলো।

সবাই চুপ। মিরায়া শুধু শুনে যাচ্ছে। কোনো প্রশ্ন নেই তার বলার মতো। রামিলা চৌধুরীর চোখ একবার গিয়ে পড়ল মিরায়ার ওপর। মেয়েটা একদম নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।
তার ঠোঁট ফ্যাকাশে, গালে কোনো রঙ নেই। মনে হচ্ছিল ভেতরটা কেমন খালি খালি হয়ে গেছে।
রায়ান তখন একদম জোরে, যেন মিরায়াকে শুনিয়েই বলল—
— “এত ভাবার আর প্রশ্ন করার তো কিছু দেখছি না। কাজের জন্য যাচ্ছি। কাজ শেষ হলে ফিরে আসব। খুব বেশি দিনের ব্যাপার নয়।”

রিমি চুপচাপ রুদ্রর দিকে তাকাল। রুদ্রও নিরব। সোরায়া চামচ নামিয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইল। তার যদিও কিছু জানার বা বলার নেই শুধু পরিবেশের সাথে তাল মিলাচ্ছে আর তার আপুর মুখের ভাব পর্যবেক্ষণ করছে। মিরায়া পরে আর তেমন কিছু খায় নি। হঠাৎ চেয়ার সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল-
“আমার খাওয়া হয়ে গেছে। আমি ঘরে যাচ্ছি।”

সে আর কিছু না বলে হাত ধুয়ে । দ্রুত নিজের ঘরে চলে গেল।রায়ান সবটাই দেখলো তবে কিছু বলল না। চুপচাপ তাকিয়ে রইল। একবার কিছু বলবে কি না ভেবে মাথা নিচু করল-
“না, এখন আর কিছু বলা ঠিক হবে না। যাওয়ার আগে আর ঝামেলা চাই না। দেশে ফিরে একেবারে খালামণি আর খালুর সাথে কথা বলে তোমাকে আবার নিজের করব হৃদপাখি। আর কিছু দিনের অপেক্ষা। আর একটু ধৈর্য।”
রায়ান নিজেও আর খাবার খেলো না। এয়ারপোর্টে খেয়ে নেবে বলে হাত ধুয়ে নিজের রুমে চলে গেল। টেবিলের সবাই মিরায়া আর রায়ানের আচরণে অবাক তবে সবই সবার বোধগম্য হচ্ছে। খাওয়া শেষ করে সবাই ধীরে ধীরে যার যার ঘরে চলে গেল।

মিরায়া নিজের ঘরে ঢুকে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল।
তার বুক কাঁপছে, মাথায় অদ্ভুত ঝড় বইছে। মনে মনে বলল—
— “উনি চলে যাচ্ছেন… এতে আমার খারাপ কেন লাগছে? কেন খালি খালি লাগছে ভেতরটা? উনি যেখানে খুশি যাক, আমার কি আসে যায়? কেন এমন লাগছে আমার?”
নিজেকে কয়েকটা হালকা থাপ্পর মেরে আবার আওড়ালো –
“না না মিরা তোর কিছুই হচ্ছে না। তোর কেন কিছু হবে। যেখান থেকে এহেন সেখানে চলে যাক। ভালোই হবে তুই বেঁচে যাবি। আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে তোর জীবনে। এবার সব বাদ দিয়ে ঘুমা।”
মিরায়া নিজের বিছানা ঠিক করে চোখ নামিয়ে শুয়ে পড়ল।
কিন্তু ঘুম এল না। শুধু একটার পর একটা প্রশ্ন জ্বালিয়ে মারতে লাগল ভেতরে। বিরক্তি যে আবার জোর করে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।

অন্যদিকে রায়ান নিজের রুমে বসে লাগেজ গুছাচ্ছিল।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আর কিছু দরকারি ফাইল ব্যাগে রাখল। অন্যকিছু নেওয়ার প্রয়োজন নেই—আমেরিকার বাড়িতে সবই আছে। সকালে রওনা দেওয়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত সে। কিন্তু মন মানছিল না।
কাগজগুলো হাতে নিয়েও যেন মাথার ভেতর কেবল একটাই ছবি—মিরায়র সেই বিস্মিত মুখ, ভেতরটা জমে যাওয়া শরীর।
রায়ানের বুকের ভেতর হাহাকার হচ্ছিল।

“যেখানে বউকে ছাড়া এক মুহূর্ত কাটানোও অসহ্যকর লাগে এখন, সেখানে আমেরিকার মতো দূরে গিয়ে কীভাবে থাকব? বিজনেস করি বলে এতো কঠোর হতে হবে। কোম্পানি, ক্লায়েন্ট, প্রজেক্ট… এগুলোই এখন মুখ্য হয়ে গেছে।”
সে একটু হেঁটে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে বলল-
“দেখ নিজেকে একবার রায়ান। কি হয়ে গিছিছ বউয়ের পাল্লায় পড়ে। ধুর ধুর! বালের জীবন। একবার ফিরতে দে হৃদপাখি খালামণি আর খালুর সাথে কথা বলি আগে। তারপর তোর এইভাবে আমাকে জ্বালানোর শোধ আমি তুলবো।”
সে একবার জানালার দিকে তাকাল। আকাশের চাঁদ তার পরিস্থিতর বিদ্রুপ করতে ব্যস্ত। চাঁদের আলো যেন তার বুকের ভেতরকার অস্থিরতা বাড়িয়ে দিচ্ছিল। ব্যাগের চেইন বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে পড়ল বিছানায়। চোখ বন্ধ করল, কিন্তু ভেতরে স্পষ্ট একটা চেহারা—তার হৃদপাখি। ঘুম নেই চোখে এক ফোটাও।

রাত ১২টা~
সোরায়া নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে আজকের কেনা বইটা নিয়ে বসেছে। সে বাবু হয়ে বসে বইটা সামনে নিয়ে বিয়ের উদ্দেশ্যে কথা বলতে থাকলো-
“দেখ, আমার এখন পর্যন্ত কিনা সবচেয়ে দামি বই তুই। এতো টাকা খরচ করেছি তোর উপরে ভালো কিছু যেন পাই তোর থেকে বলে দিলাম।”
সোরায়া নিজের থেকে কথা গুলো বলে বইটা খুলে । বইটা পড়া শুরু করার আগে একটা ডিসক্লেইমার দেওয়া ছিল- তবে সোরায়া সেটা না পড়েই বইটা উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো।
সোরায়া বইয়ে পাতা উল্টাতে উল্টাতে একটা পাতায় থেমে যায়। আগ্রহ নিয়ে ভিতরের একটা পাতা পড়া শুরু করে বইটা কেমন তা একটু ধারণা করতে।
সোরায়ার খুলে ধরা পাতার একটা লাইনে তার নজর আঁটকে যায়। আর সাথে তার চোয়ালও হা হয়ে থাকলো। লাইনটা ঠিক এমন ছিল-

“there is something about corrupting a good girl, delving beneath her skin and ripping out her deepest darkest part.”
যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় কিছু টা এমন-
“একটি ভালো মেয়েকে নষ্ট করার মধ্যে কিছু আছে, তার ত্বকের নিচে ঢুকে তার সবচেয়ে গোপন ও অন্ধকার অংশগুলো বের করে আনার মতো।”
সোরায়া বইটা শব্দ করে বন্ধ করে দিয়ে নিজের থেকে দূরে ঠেলে দিল। সে অবাক হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তার পর বইটা আবার হাতে নিয়ে শুরুর পৃষ্ঠায় থাকা ডিসক্লেমার দেখল। যেখানে স্পষ্ট লেখা আছে এই বইটা ১৮+ কনটেন্ট ধারণ করে। সুতরাং নিজ দায়িত্বে বইটি পড়তে বলা হয়েছে।
সোরায়া নিজের হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে মনে মনে ভাবল-

“আল্লাহ এই বই আমি স্যার এর সামনে কিনেছি তাও এত বড় বড় কথা বলে। আমি এখন স্যারের সামনে কিভাবে দাঁড়াব। হায় হায় হায় কি করলাম এইটা আর বই ছিল না এইটাই হাতে এলো। কি মারাত্মক কথা বার্তা লিখা। যদিও ভালো হয়েছে পড়তে ভালোই লাগবে। কিছু মানসম্মান তো সব গেছে।”
বইটা হাতে নিয়ে বইকে বলতে থাকলো-
“তোরা ভালো মানের হতে বলছে বলে এত ভালো মনের হতে হইলো। আমি স্যার কে মুখ দেখাবো কেমনে? আচ্ছা স্যার আমাকে নিয়ে আবোল তাবোল হচ্ছে না তো। আরে ধুর আবোল তাবোল কি যা ভাবছে ঠিকই তো ভাবছে আমি তো এমনই। কিন্তু কেন?? কেন এমন হলো।”
সে বইটা একবার নিজের মাথায় মেরে বিছানায় চিতপটাঙ হয়ে শুয়ে হাওয়াতে হাত পা ছুড়তে লাগলো নিজের উপরে জেদ করে। তার মাথায় এক- মাহিরের তার প্রতি কি ধারণা হবে এই ভাবনা ঘুরতে থাকে।

ঘরের ঘন অন্ধকারে একাকিত্বের মধ্যে মিরায়া গভীর ঘুমে। চাদর কোমলভাবে শরীরের ওপর পড়ে, জানালার কাঁচে চাঁদের নরম আলো পড়ছে—হালকা, কোমল, যেন ঘরকে অর্ধেক ঘুমে, অর্ধেক জাগ্রত অবস্থায় রেখেছে। বাতাস নেই বললেই চলে; তবে ঘরের ভেতর এক ধরণের নরম শীতলতা আছে, যা শরীরের প্রতিটি স্পর্শকে আরও জীবন্ত করে তোলে। শুধুই হালকা নীরবতা ভরে আছে চারপাশ।
মিরায়ার বুকের হালকা ওঠা-নামা ছাড়া সব ঠিক আছে। হঠাৎ—দরজা হালকা শব্দে খুলে যায়। পায়ের ধীর পদক্ষেপ ধীরে ধীরে বিছানার দিকে এগোচ্ছে। মিরায়ার চোখের সামনে ছায়ার মতো কেউ আসে। মিরার ঘুম ভাঙেনি, কিন্তু অচেনা এক উত্তেজনা বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
একটি কল্পনাহীন মুহূর্তে, সে দেখতে পায়—একটি ছায়া তার বিছানার কাছে আসে। হাঁটু গেড়ে বসে, তার মুখের ঠিক সামনে। চুলগুলো স্বচ্ছন্দে সরিয়ে দিচ্ছে, আর চোখে চোখ পড়ার সাথে সাথে হঠাৎ সময় থমকে যায়। চোখে একদম সরাসরি তাকিয়ে আছে।

মিরায়ার ঘুম অচেতন, কিন্তু ঘুম হালকা কাঁচা হয়ে গেছে। হৃদস্পন্দন দ্রুত ধাক্কা খাচ্ছে, চোখের পলকে ঘুমের নরম আবরণ ছিড়ে যাচ্ছে। অচেনা ব্যক্তিটা, অতি স্নেহের সাথে, ধীরে ধীরে কপালে ঠোঁট রেখে চুমু খায়। মৃদু চুম্বন, কোমল, তবে অদ্ভুত উত্তেজনাপূর্ণ। তারপর হাতের স্পর্শ নয়—নিজের ঠোঁটের আঘাত দিয়ে একের পর এক স্থান স্পর্শ করতে থাকে
অচেনা ছায়ার ঠোঁট ধীরে ধীরে মৃদু চাপ দিয়ে মিরায়ার ঠোঁটের ধারের সাথে মিলায়। প্রতিটি স্পর্শের সাথে তার নিশ্বাস মিলিয়ে মিরায়ার হৃদয় কেঁপে ওঠে। ঠোঁটের নরম চাপ, চুম্বন, সামান্য চুষতে থাকা—সবকিছু একত্রে মিশে অদ্ভুত উত্তেজনা তৈরি করছে।

মিরায়ার শরীর প্রথমে প্রতিরোধ করে, হাত নরমভাবে ঠেলতে চায়, কিন্তু শক্তি আর আকর্ষণের তীব্রতা এত বাস্তব যে সে হার মানে। মিরায়া, ঘুমের ফাঁক দিয়ে অজ্ঞান এবং অপ্রস্তুত, হালকা কাঁপছে। অচেনা স্পর্শগুলো তার শরীরের প্রতিটি স্নায়ুতে ঘূর্ণি তৈরি করছে। হঠাৎ—ঠোঁটের সঙ্গে ঠোঁটের মিলনে মিরায়ার ঘুম ভাঙল। মিরায়ার চোখ বড় হয়ে খুলে যায়। সে বুঝতে পারে, কেউ তার ঠোঁট দখল করে রেখেছে।
প্রথমে সে কিছু করার চেষ্টা করে—ছাড়তে চায়, ঠেলতে চায়। কিন্তু শক্তি আর আবেগের মধ্যে আটকা পড়ে আছে। শরীরের প্রতিটি অংশ অজান্তেই প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। মিরায়া নিজের সমস্ত মনোবল সংগ্রহ করে, হঠাৎ ঠেলে দেয় অচেনা ব্যক্তিটাকে দূরে।
তখনই মিরায়া নিজ চোখে সেই অচেনা ছায়াকে সামনে দেখতে পায়—

— “রায়ান ভাইয়া… আপনি…”
কণ্ঠে আকুতি, বিস্ময় আর অন্তরের সমস্ত ভয় মিশে আছে।
রায়ান ধীরে এগিয়ে আসে, মিরায়ার কাছে। তার চোখের মধ্যে বিরক্তি নেই, শুধু অনিয়ন্ত্রিত আকর্ষণ এবং গভীর আবেগ।
— “সরি, হৃদপাখি। আমি আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছি না… আমাকে তোমার মাঝে সম্পূর্ণ হতে দাও।”
— “দুপুরের অসম্পূর্ণ মুহূর্তটা আমি অসম্পূর্ণ রেখে আমেরিকা যেতে চাই না। প্লিজ, আমাকে আটকিও না পাখি।”
তার সুরে আকুতি, কোমলতা, আর ধীরে ধীরে ছোঁয়া—সব মিশে এক বিন্দুতে।
মিরায়া রায়ানকে দূরে ঠেলে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। চোখে বিস্ময়, শরীরে অস্থিরতা।
— “না, না… এটা সম্ভব না, ভাইয়া। প্লিজ, আমরা এমন করতে পারি না। এটা ভুল, অন্যায়।”
রায়ান মিরায়ার কোমর ধরে নিজের কাছে আনে, ঠোঁট কিঞ্চিৎ দূরে রেখে। তার নিঃশ্বাস, শরীরের গতি, চোখের গভীরতা—সব মিলিয়ে মিরায়ার হৃদয় কাঁপছে অস্থির ভাবে।
রায়ান মিরায়ার ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে ফিসফিস করল-

— “তুমি থামতে বললে থেমে যাব। কিন্তু আমি জানি, তুমি আমাকে থামাবে না… আর আমি তোমাকে চাইছি আরও কাছে। তোমার অস্বীকার করা আমাকে আরও আগ্রহী করছে হার্টবার্ড।”
মিরায়া না সূচক মাথা নাড়ায় আর রায়ান হ্যাঁসূচক। রায়ান আবার এক ঝটকায় মিরায়ার ঠোঁট নিজের ঠোঁটের ভিতরে নিয়ে চুষতে থাকে। মিরায়া কিছু বলতে পারে না কেবল হাত পা ছুড়ছে। হঠাৎ চোখ বন্ধ করে শরীর ছেড়ে দেয় সে যেন আর পারছে না বাঁধা দিতে।

রায়ানের ঠোঁট তার ঠোঁটের ওপর ডুবে যায় আরো গভীরে, আর স্পর্শের মাধ্যমে পুরো শরীরের তীব্রতা অনুভূত হয়। রায়ানের হাতের উন্মত্ত স্পর্শ—মাথা, ঘাড়, কোমর, পিঠ—সব অজান্তেই মিশে যাচ্ছে মিরায়ার।
মিরায়ার নিঃশ্বাস দ্রুত পড়ছে, হৃদয় কাঁপছে। সে অচেতনভাবে দাঁড়িয়ে, তারপর স্বাভাবিক হয়ে আসে, কিন্তু প্রতিটি স্পর্শের খেলা তার মস্তিষ্কে এবং হৃদয়ে গভীর ছাপ ফেলে। মিরায়া অল্প সময় না বলতে না বলতে নিজেকে হাড়িয়ে ফেলে। আর রায়ান—তার হাতের প্রতিটি স্পর্শ মিরায়ার জগৎ উল্টে দিচ্ছে। এক মুহূর্তে সে সব নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, আর রায়ানের শক্তি এবং আবেগে মিশে যাচ্ছে।
হঠাৎ রায়ান দূরে সরে যায়। ঘরের কোণে ঘন কুয়াশার মতো তার উপস্থিতি ম্লান হয়ে যাচ্ছে। মিরায়খর শ্বাস আটকে আসে।
নিজেকে স্থির রাখা কষ্টকর । নিঃশ্বাসের তীব্রতা বাড়ছে। মিরায়া হঠাৎ চিৎকার করে,

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৫

— “রায়ান, প্লিজ… যাবেন না!”
হৃদয় চিৎকার করছে, কিন্তু হাত ধরা সম্ভব নয়।
ঠিক তখনই—
মিরায়ার চোখ ফেটে ওঠে বিছানার উপরে হঠাৎ উঠে বসে। সে নিজেকে বুঝতে পারে না, এটা কি স্বপ্ন ছিল। সব স্পর্শ, সব কুয়াশা, সব উত্তেজনা—মাত্র মনের কল্পনা। হাত মুখে ধরে, রেখে হাজার বার শান্ত হতে চাইছে। হৃদয় দ্রুত ধাক্কা খাচ্ছে। মিরায়া সাথে সাথে অস্থিরতায় ফোন হাতে নেয়। হাত অনবরত কাঁপছে তার। ফোনটা খুলতেই দেখলো সকাল ৫টা বাজে।

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here