স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১১
সানজিদা আক্তার মুন্নী
তৌসির স্বপ্নটা দেখে আর নিদ্রায় আচ্ছন্ন থাকতে পারে না, তটস্থ হয়ে যায় ওর অন্তর। এই স্বপ্ন মাঝেমধ্যেই দেখে। নিত্য দেখলেও ভয়টা দ্বিগুণ রূপেই চেপে ধরে। তৌসির আঁতকে উঠে বসে পড়ে। ওর বাহুতে নাজহার মাথা রাখা ছিলো বিধায় নাজহা পাটি থেকে কিছুটা দূরে ছিটকে পড়ে ফ্লোরে। স্বাভাবিকভাবেই এমনটা হওয়ায় যে কারো ঘুম ভেঙে যাবে। নাজহা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। উঠে বসে আশেপাশে ঘুম ঘুম চোখে কিছুটা আতঙ্কে নিয়ে চোখ বুলাতে থাকে, বুঝার চেষ্টা করে কি হলো এখন ওর সাথে, কেন হঠাৎ এমন ঝটকা খেলো? সামনে তাকাতেই কিছুটা অবাক হয়। তৌসির বসে আছে ছন্নছাড়া রূপ ধারণ করে একদৃষ্টিতে ফ্লোরের ন্যায় তাকিয়ে আছে। তৌসিরের দুই হাতের শক্তপোক্ত বাহু গুলো তিরতির করে কাঁপছে।ঘামের ফোঁটা লেগে আছে ঘাড়ের সাদা চামড়ায়। নাজহা সঠিক ভাবে ধরতে না পারলেও এতটুকু বুঝেছে, “এই কিপ্টে লোক নিশ্চয়ই কিছু ভয়াবহ স্বপ্ন টপ্ন দেখেছে, এর জন্য এমন আতঙ্কে ঠেকিয়ে বসেছে।
নাজহার মন বলে একটাবার জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে, কিছু কি হয়েছে? আচ্ছা আপনি কি পানি খাবেন? পানি দিব? একটু পানি খান, দেখবেন ভেতর শান্ত হয়ে যাবে।
মন চাইলেও মস্তিষ্ক শোধায় বারংবার এমন কিচ্ছু করার প্রয়োজন নেই, সে তার মতো, তুমি তোমার মতো।
নাজহা নিজের মস্তিষ্কের কথাটাই বাস্তব রূপে ধারণ করে নিয়ে চুপটি করে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে উঠে যায়। উদ্দেশ্য ওজু করে তাহাজ্জুদ পড়ে নেওয়া। ঘুম যখন ভেঙেই গেলো তাহলে আর কি-ই বা করা? নামাজ আজ একটু আগেই পড়ে নিক।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
রুমে দুজন মানব, অথচ একটুও টু শব্দ নেই। একজন আরেকজনের নিশ্বাসটাই শুধু শুনছে আর কিছু না। নাজহার কানে স্পষ্ট আসছে তৌসিরের জোরে শ্বাস ছাড়ার শব্দ। কিন্তু তারপরও ও একটিবার জিজ্ঞেস করে না কি হয়েছে আপনার? ও নিজের মতো চুপচাপ উঠে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।
তৌসির নাজহার উঠে যাওয়ার বিষয়টি অনুভব করে ঘাড় ফিরিয়ে একবার তার যাওয়ার দিকে তাকায়। তালুকদারের মাইয়া বলে কথা মায়া দয়া কি থাকবে? থাকার তো কথা নয়, তাই নেই। নিজের পরিবারের মতোই হয়েছে স্বার্থপর। এই যে তৌসিরের এই হালত দেখেও কিছু বললো না, একটিবার জিজ্ঞেসও করলো না। এ কেমন নারী? এ কেমন বউ? বউ না দুশমন?
তৌসির ওর যাওয়ার পানে একইভাবে তাকিয়ে বলে, “ইতরের ঘরে ইতরনি, ডাকাইতের ঘরে ডাকাইত, শয়তান্নি। তোর এই ঠাটা-পড়া বিবেকে গজব পড়ুক, গজব।”
এ বলে ঘাড় ঘুরিয়ে নেয়। নিজেকে নিজেই বলে, “কিছু অতীত হয় সুন্দর, আর কিছু হয় বিভৎস। তাই সব গুলিয়ে নেওয়া উচিত নয়।”
এ বলে আবার ঘুমাতে যাবে, তখনই দেখে বালিশের পাশে নাজহার ফোন পিটপিট করছে এলার্মের আওয়াজে। তৌসির হাত বাড়িয়ে এলার্মটা বন্ধ করে। একটু সময় তাকিয়ে রয় ফোনের দিকে। নাজহার ফোনের পাশেই ওর ফোন রাখা। নাজহার Galaxy S25 Ultra ফোনের পাশে তৌসিরের সতেরো সালের Galaxy S8 পুরাতন ডিসপ্লে ভাঙাচোরা ফোনকে ভারী বেমানান লাগছে। ঠিক তেমন বেমানান, যেমনটা নাজহার পাশে তৌসিরকে লাগে।
তৌসির অসুন্দর নয় বটে, তবে নাজহার সৌন্দর্যের সামনে তৌসির কালা চান এটা তৌসিরের ভাবব না। যতই হোক, নাজহা ব্রিটিশ। ওর জন্ম ইংল্যান্ডে। জন্মের পর ছয় বছর অবধি ছিলোও সেখানে। বাবা বাংলাদেশি হওয়ায় পেয়েছে বাবার আচরণ-স্বভাব সব কিছু, আর মা ব্রিটিশ হওয়ায় পেয়েছে মায়ের সৌন্দর্য।তৌসির মাঝেমধ্যে নাজহার দিকে তাকায় দু-এক পলক। সাথে ভাবে, “এই পুতুল সত্যিই ওর ঘরের বউ? ওর নিজের বউ? ওর ঠিক এখনও বিশ্বাস হয় না এমন একটা মেয়ে ওর মতো মানুষের কপালে সত্যিই খোদা জুটিয়েছেন।”তৌসির এই খণ্ডখানিক ভাবনার অতল গহ্বরে ডুবে স্নান হেসে বলে ওঠে, “এমন এক ঝিজ জুটাইলা দয়াল আমার মতো বজ্জাতের তাকদিরে! যেই হালার পুত দেখবো, সে-ই স্বপ্ন বুনতে শুরু করবো।”
এটা ভেবেই কপাল কুঁচকায়। নিজেই নিজের কথার উত্তর দেয়, “আমার বউ আমার ব্যক্তিগত ঝিজ। ওরে লইয়া স্বপ্ন দেখলেই তো আর পাইবো না!”
উক্ত কথাটা তৌসির নিজের মধ্যে অনুভব করে। এটা ভাবতেই খুশিতে সুরমা নদীতে লাফ দিতে মন চাচ্ছে যে ওর বউ শুধুই ওর। এই পুতুল ওর নিজের একান্ত।এখন যদি স্পিকার বাজানো সম্ভব হতো তবে লুঙ্গি হাতে নিয়ে একটা লুঙ্গি ডান্স দিত। আজ মন বড্ড খুশি। এই খুশি উদযাপন করার জন্য হলেও একটা ঝাক্কাস ডান্স উচিত। সাথে এক বোতল বিয়ার। আর পার্টনার হিসেবে নাজহা হলে মনে হয় দুর্দান্ত একটা ডান্স দিত। কিন্তু যেই নাজহা ডান্সের কথা বললে তৌসিরকে বেইজ্জত করে দিবে ভদ্রভাষায়। তাই ইজ্জত নিয়েই থাকা উত্তম। প্রয়োজন নেই বেইজ্জতি ডান্সের।
তৌসির বালিশে মাথা রাখে। একটু ঘুমানো প্রয়োজন। যেই না বালিশে মাথা রাখে, তখনই নাজহা ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে এসে গাঢ় গলায় বলে, “এরে হুনরানি?” (এই যে শুনছেন)।
নাজহার ডাক শুনে তৌসির এই ডাকের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারে যে হয়তো কোনো প্রয়োজন পড়েছে এই স্বার্থপর ঝিজের। নয়তো এত মিঠা করে ডাক দিত না। কিন্তু তৌসির বালিশ থেকে মাথা তুলে না একিভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে নিমেষ গলায় উত্তর দেয়, “জ্বি হুনরাম” (জ্বি শুনছি)।
নাজহা বুক ঝেরে মর্মপীড়ার নিঃশ্বাস ছেড়ে দু কদম এগিয়ে এসে বলে, “ওজুর লাইনের ট্যাপ কাজ করছে না। ট্যাপের মুখ খুলে গেছে। এখন আমি কিভাবে ওজু করব?”
তৌসির নাজহার কথায় কিছু বলতে নেয় কিন্তু ফের থেমে গিয়ে অন্য কিছু বলে, “তো আমি করব? তোমার যেমনে ইচ্ছে ওমনে গিয়ে করো।”
তৌসিরের কথায় নাজহা রুক্ষ সুরে বলে, “কি বললেন?”
তৌসির ওর গলার সুরটা এমন কঠিন দেখে এক লাফে উঠে বসে। একটু প্রতিশোধ নিচ্ছিল ঐ যে নাজহা ওকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি আগে, তারই প্রতিশোধ নিল। তৌসির নাজহার দিকে তাকায় না, তাকালেই বেইজ্জত চোখ দুটো ওর দিকেই শিকারির বন্দুকের মতো এঁটে যাবে। তাই না তাকিয়েই বলে, “না, কিছু বলিনি। চলো, পুকুর থাইকা ওজু কইরা আসবে।”
এ বলে উঠে দাঁড়িয়ে লুঙ্গির গিট্টু একটু ফস হয়ে গেছিলো। সঙ্গতকারণে গিট্টুটা ঠিক করতে করতে টর্চলাইট নিতে যায় টেবিলের দিকে।নাজহা বিছানার কোণ থেকে নিজের হিজাবটা গায়ে জড়িয়ে উপরে ওড়না জড়িয়ে নেয়। নামাজের হিজাব পড়ে নিলো। এখন নিশি বেলা বলতে গেলে আর এ সময় সাবধানে থাকতে হয় তাই সতর্ক হয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেকে নিলো। ওড়না জড়িয়ে নিয়ে তরঙ্গিত পায়ে সামনে এক কদম ফেলে মুখ তুলে চঞ্চল চোখে তৌসিরের চোখের দিকে তাকায়। যদিও ও ইচ্ছে করে তাকায়নি এমনি এমনিই পড়ে যায় চোখ । নাজহা দেখে তৌসির আগ থেকেই ওর দিকে চোখের পলক না ফেলেই আনমনা চাহনি নিয়ে নির্নিমেষে তাকিয়ে আছে। আসলে নাজহা ওড়নাটা পড়ছিল, সেটাই দেখছিল। নাজহা কে নিজের দিকে তাকাতে দেখে ধ্যান থেকে এক ঝটকায় ফিরে এসে দ্বিধাগ্রস্ত মনোজ্ঞতায় বলে ওঠে, “হ হ চলো।”
চলো বলে আর এক পা দাঁড়িয়ে থাকে না, উচ্ছ্বল হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। নাজহাও ওর পিছনে পিছনে যায়। নিচে এসে সদর দরজার তালা খুলে তৌসির টর্চ জ্বালিয়ে নাজহাকে বলে, “তুমি একটু খাড়াও আমি দেখি কোনো চোর টোর আছে নাকি।লাইট মাইরা পরে বের হইবা।”
এ আদেশ দিয়ে সদর দরজা থেকে সামনে পা রেখে আশেপাশে লাইট মেরে ভালো করে দেখে নেয় কেউ আছে কি না! না, কেউ নেই। থাকার কথাও না, তৌসির জানে কেউ ওত সাহস দেখাবে না। কিন্তু তাও একটু চেক করে নিলো। ওর বউ এই নিশি রাতে বের হয়েছে বলে কথা।
তৌসির ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে নাজহার দিকে তাকায়। যদিও অন্ধকারে ওকে স্পষ্ট দেখতে পায় না কিন্তু অবয়ব চোখে আটকায়। তৌসির বলে, “তালুকদারের মাইয়া, দোয়া দুরুদ যা যা পারো তা পইড়া পা রাখো বাইরে। না পড়লে মা**গির পোলা জ্বিনরা তোমার আবার জাইত্তা ধরব।”
এমন কথায় নাজহার ভেতরে মর্মন্তুদ ক্রোধের সঞ্চার হয়, তদুপরিও নাজহা কিছু বলে না। চুপচাপ আয়াতুল কুরসি পড়ে বাড়ির বাইরে পা রাখে, সদর দরজাটা লাগিয়ে সামনে আগায়। তৌসির সামনে চরণ ফেলতে ফেলতে বলে ওঠে, “তালুকদারের মাইয়া, তুমি বিলাসিতা টা একটু কমাও।”
আকস্মিক এমন কথায় নাজহার মনে মনে তীব্রভাবে কৌপীন্য জমে । আর জমারি তো কথা, এমন লাইনহীন কথা শুনে কেউ কি ঠিক থাকে? নাজহা খানিকটা কঠিন বিষাদময় ধ্বনিতে বলে, “আমি কি বিলাসিতা করেছি, এত বড় বড় কথা বলছেন?”
তৌসির ওর কথায় কিঞ্চিৎ হেসে পিছনে তাকিয়ে ওর দিকে এক পলক চোখ বুলায়, তারপর সামনে দৃষ্টি স্থির করে বলে, “এই যে প্রতিদিন নয়া নয়া ড্রেস পড়ো। মানলাম নয়া বউ এর লাইগা একটু আকটু নতুন কাপড় পড়বা, তাই বইল্লা সব পইড়া নিবা? এ বছরের জন্য দুইটা নাহলে চাইরটা ড্রেস বের করিও। বাকিগুলো রাইখা দিও, অচথা ঘরে পড়ে নতুন কাপড় নষ্ট কইরা কি করবা?”
তৌসিরের কথাগুলো নাজহার কানে যায় তবে আজ রাগ হয় না ওর। এটা তো নতুন কিছু না। নাজহা সৃপ্ত কঠোর ব্যঞ্জনায় বলে, “আমি এক ড্রেস মাসে দুবার পড়ি না, আর আপনি বছরে চারটে বলছেন? দুঃখিত, অসম্ভব তা আমার পক্ষে।”
“আহা, তুমি বুঝতাছো না গো কৈতরি। এই যে নয়া নয়া ড্রেস পড়ো, এগুলোর দাম একেকটা বাংলাদেশি টাকায় ছয়-সাত হাজার। ফুফু-চাচারা তো লন্ডন থাইকা আমদানি দিয়া দেয়। এর জন্য কদর বুঝতাছো না, একটু আয় করতে শিখো।”
নাজহা তৌসিরের কথার উওরে ঘাড়ত্যাড়ামি করে ধারণ করে, “আমি বিলাসিতা ত্যাগ করে আপনার মতো কিপ্টামি করতে পারব না।”
তৌসিরের প্রখর রাগ হয়। শান্ত মেজাজে হঠাৎ তীব্র ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটে। সামনে আগাতে আগাতে অনমনীয় স্বরে নাজহার কথার বিপরীতে বলে, “আম্বানির ঘরে খাম্বানি আমার লগে ঘর করতে যদি হয় তাইলে আয় করতে শিখো, নয়তো বাপের বাড়ি সোজা দৌড়ো।”
নাজহা তৌসিরের কথায় নাক-মুখ কুঁচকে চাপা রাগে মোড়া সুরে বলে, “বউ একটা কাপড় চাইলে মানুষ বউকে দশটা কিনে দেয়, আর আপনি ছিঃ।”
তৌসির নাজহার এই উদাহরণ দেখে মিটি হেসে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, “আমি এলন মাস্ক এর ভাই বেলুন মাস্ক না যে বউ একটা কইলে দশটা কিনে দিমু। একটাও দিমু কি না সন্দেহ আছে।”
নাজহা তৌসিরের এই উওরে অত্যুচ্চ বিরক্ত হয়ে বলে, “ছিঃ, কত ছোটলোক আপনি! এত কিপ্টামি করে কি হবে এই দু-দিনের জীবনে?”
তৌসির ওর কথায় আলতো হেসে মিঠা সুরে শোধায়, “এত বিলাসিতা করে কি হবে এই দু-দিনের রজনীতে?”
নাজহা আর কথা বাড়ায় না। এতক্ষণে ওরা পুকুরে চলে এসেছে। নাজহা চুপচাপ নামতে থাকে পুকুরের সিঁড়ি বেয়ে। তৌসির আওয়াজ দিয়ে বলে, “দেইখো, সাপ-টাপ থাকতে পারে।”
এ বলে নিজেও নেমে যায়। নাজহা মিসওয়াক করে ওযু করে নেয়। তৌসির আশেপাশে লাইট দিয়ে দেখে পানিতে মাছ চোখে পড়ে কি না, কিন্তু না, বড় মাছ চোখে পড়লো না। নাজহা ওযু শেষ করে ওঠে দাঁড়িয়ে বলে, “চলুন।”
তৌসির নাজহার কথায় ওর দিকে সরু চোখে চোখ নামিয়ে তাকিয়ে বলে, “তুমি পাচ মিনিট খাড়াও, আমি একটা ডুব দিয়া লই। ঘাইমা গেছি।”
নাজহা তো অলঙ্ঘনীয়ভাবে অবাক হয় এই তিমিরঘেরা নিশীথে তৌসির গোসল করবে? এ কেমন কথা! নাজহা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রয় তবে বলে না কেন করবেন? প্রয়োজন নেই করার। তৌসির ওর হাতে টর্চটা দিয়ে দু সিঁড়ি নেমে ঝাপ দেয় পুকুরে। নাজহা দু সিঁড়ি উপরে উঠে পানির দিকে লাইট নিক্ষেপ করে। তৌসির সাতঁরিয়ে ডুব দিয়ে ধীরে ধীরে উপরে আসতে আসতে বলে, “যাক গে, একটু আরাম লাগবো। সাউয়া সপ্ন দেইখা ঘাইমা গেছিলাম।”
নাজহা কথাটা শুনে তবে উওরে কিছু বলে না। ওর বেহায়া চোখ-দ্বয় আটকে গেছে তৌসিরের দিকে। ওর পড়নে সাদা একটা সেন্ডো গেঞ্জি আর কালো লুঙ্গি। পানিতে ভিজার কারণে সাদা গেঞ্জিটা ভিজে ওর নিখুঁত পৌরুষমণ্ডিত শরীরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। শরীর দেখে মনে হচ্ছে, এ কিপ্টে আর যাই করুক, জিম-কুস্তি-লড়াই এসব হয়তো করে। নাজহার চোখ আঁটকে রয় সুপারগ্লুর মতো তৌসিরের পানে ওকে এক নজর দেখার কৌতূহলে। ওর প্রশস্ত কাঁধ থেকে নেমে আসা বাহুতে শক্তির প্রবল উপস্থিতি।
বুকের গঠন দেখেই মনে হচ্ছে জিম করে অভ্যস্ত। ভিজে গায়ে লেগে থাকা গেঞ্জির নিচে পেশির প্রত্যেকটি রেখা-শৃঙ্খলা ভেসে ওঠেছে। অ্যাবসগুলো স্পষ্ট, মনে হচ্ছে ইট-গাঁথা দেয়ালের মতো একে একে সাজানো হয়েছে, বা কেউ হয়তো সাজিয়ে দিয়েছে। ফর্সা গায়ে পানি মুক্তার মতো ঝরতেছে। তৌসির নাজহার এই তাকানো লক্ষ্য করে বলে, “কিতা লো এমন তাকাও ক্যান? কেরাশ টিরাশ খাইলা নাকি?”
তৌসিরের কথায় নাজহা বাস্তবে আসে। দেখতে যতই সুন্দর হোক না কেন কথাবার্তা আর আচরণ ইবলিশের মতো, ইবলিশও হয়তো এমন কথাবার্তা বলে না। নাজহা নিজের অবাধ্য দৃষ্টিকে সামলে নিয়ে পানির দিকে চোখ রেখে নাক-মুখ কুঁচকে বলে, “আপনার মতো মানুষের উপর এসব খাওয়া জায়েজ না।”
তৌসির নাজহার কথায় মুচকি হেসে গেঞ্জি খুলতে খুলতে বলে, “মুখের ভাষা একটু খারাপ হইলেও আমি দেখতে মন্দ না, তাই লাইন একটু আধটু মারতেই পারো।”
নাজহা সেই আগের মতো সামনে তাকিয়ে বলে, “আমার লাইন মারার শখ ওঠেনি।”
“শখ ওঠবো কেমনে, করলার মতো তিতা যে মন!”
“আপনার মতো তো আর কালো নয়, তিতা হলে আমার তিতাই ভালো।”
“হা হা, কালা আর ধলার মাঝে পার্থক্য বুঝ বেটি। পরে কালা-ধলা মারাইছ!”
নাজহা শক্ত গলায় ধারণ করে, “আমি বুঝেই বলছি।”
তৌসির হাত বাড়িয়ে নাজহার হিজাবের উপর রাখা ওড়নাটা এক টানে নিয়ে নেয়। এমন আকস্মিক ঘটনায় নাজহা ভারী বিরক্ত হয়। দাঁত চেপে বলে, “আপনি আমার ওড়না নিলেন কেন?”
তৌসির নাজহার ওড়নাটা ভেজা লুঙ্গির ওপর পেঁচাতে পেঁচাতে বলে, “এখন কি কাপড় ছাড়া ঘরে যামু? তোমার ওড়না কোমরে পেঁচাইয়া তোমার সম্পদ জ্বীন-পরীর কাছ থাইকা লুকাইয়া যাইতে হইবো না?”
নাজহা তৌসিরকে লুঙ্গি বদলাতে দেখে লাইট অফ করে নিয়ে রাগ চাপা গলায় বলে, “তো আপনি আমার ওড়না কেন পড়বেন? দিন বলছি, ওড়না।”
তৌসির ভেজা লুঙ্গিটা খুলতে খুলতে পাশ ফিরে নাজহার মুখের দিকে তাকায়। চন্দ্রালোকিত নিশিতে ওর লাবণ্যময় মুখখানা লাবণ্যের উৎকর্ষ মনে হচ্ছে। তৌসির কপাল কুঁচকে বলে, “তো এখন তোমার নিয়ত কি? ওড়না তোমারে দিয়া। লুঙ্গি ছাড়া ঘরে যাইতাম?”
ব্যাস, এমন কথা শুনে নাজহা চুপ হয়ে যায়। এই লোকের সাথে কথায় পারা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। ছিঃ, কি কথা কয় মাঝেমধ্যে।তৌসির নাজহার ওড়নাটা কোমরে শক্ত করে পেঁচিয়ে দু’সিঁড়ি নামতে নামতে বলে, “লাইটা জ্বালাও লো।”
নাজহা ওর কথায় লাইটের বাটনে সুইচ দেয়। তৌসির লুঙ্গি আর গেঞ্জিটা এক চুবড়া মেরে নেয় পানিতে, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কাপড়গুলো চিপতে চিপতে নাজহার দিকে সরু চোখে একনজর তাকায়। দেখে নাজহা অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। এটা দেখে মনে মনে বুনে, “মন চাইতেছে গর্দানায় ধরিয়া ইচ্ছেমতো চুবানি দেই, সাওয়ার মাইয়া রে। আমার দিকে তাকায় না। জালিম-নি কোথাকার।”
তৌসির সিঁড়ি বেয়ে সামনে উঠতে উঠতে বলে, “চলো, আর ওমনে তাকানির দরকার নাই, নাটকবাজ মাইয়া।”
নাজহা ওর কথা গায়ে না লাগিয়ে সামনে আগাতে আগাতে বলে, “আশেপাশে কোনো ফার্মেসি আছে?”
অনির্বাণ ক্ষণে নাজহার মুখে ফার্মেসির কথা শুনে তৌসির স্বল্পমাত্রায় থমকায়। পা থামিয়ে গ্রীবা হেলিয়ে পেছন তাকিয়ে সরু চাহনি ছড়িয়ে দেয় নাজহার মুখপানে। কিছু একটা আঁচ করে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “এখন লাগবে? এখানের এসব ভালো না, আমি টাউনে যামু কালকে, ভালো ব্র্যান্ডের টা আইন্না দিমু নে।”
নাজহা তৌসিরের কথায় ভরকে যায়। এ পুরুষ কি ভেবে নিলো! ধুর, বলাটাই ভুল হয়ে গেছে। কেন যে জিজ্ঞেস করল! নাজহা ঠান্ডা গলায় বলে, “আমি ওসবের জন্য বলছি না, আমার সি-জেট লাগবে। এলার্জি বেড়ে গেছে নাকে-চোখে, তাই বলছি।”
তৌসির এটা শুনে হাঁটতে শুরু করে বলে, “ওহ ওহ, আমি কই অন্য কিছু! আইচ্ছা, সকালে আইন্না দিমু নে। আর ঐসব লাগলে কইও।”
নাজহা ক্ষীণ গলায় বলে, “আপনাকে বলার প্রয়োজন নেই। আমি আমার প্রয়োজন হলে আমি দেখে নিব।”
“ক্যান, আমারে ক্যান বলবা না?”
“আমার ইচ্ছে, তাই আমি বলব না। আপনার কোনো সমস্যা?”
“না না, আমার সমস্যা হইবো ক্যান? যেখানে আস্ত একটা সমস্যাকে তিন কবুল কইরা বুকে ধরছি, সেখানে এইসবে ছোটখাটো বিষয়ে আমার সমস্যা থাকতে পারে?”
“আমায় সমস্যা বললেন আপনি?”
“সমস্যাই তো! বিয়ের আগেই ভালো ছিলাম। ভাবছিলাম বিয়া করলে বউ একটু সেবা-টেবা করব, দিনকাল আরেকটু বালা যাইব। কিন্তু আমার সব ভাবনা বৃথা হইয়া গেল।”
“তাহলে আরেকটি বিয়ে করে নিন, সে বউ সেবা করবে। আমি ওসব পারব না।”
নাজহার কথায় তৌসির অল্পখানি হাসে। তৌসিরের এই হাসি আজ প্রথমবারের মতো নাজহা লক্ষ্য করে ভারী আবেশময়ী এই হাসি। ওর হাসিটি মনে হয় ভোরের প্রথম আলো, যা মুহূর্তেই চারপাশের সবকিছুকে আলোকিত করে তোলে। হাসলে ঠোঁটের কোণে মৃদু বাঁকটি যখন গভীর হয়, তখন গালে টোল দুটো দুটি মিষ্টি গোপন কথার মতো ভেসে ওঠে। দাঁতগুলি মুক্তোর মালার মতো শুভ্র ও ঝকঝকে হয়ে বের হয়। তৌসিরের এই হাসি এতটাই সুন্দর তা বর্ননা করার যোগত্য হয়তো কারো নেই। তৌসির চারপাশে একবার চোখ বুলায়। চাঁদনী রাতের স্নিগ্ধ আঁচলে উঠোন ডুবে আছে রুপালি আলোয়। তারই মধ্যে ওরা দু’জন পাশাপাশি হাঁটছে, পদধ্বনি মিশে যাচ্ছে নিশির বিশদ মূকতায়। ক্ষণিকের ঝটকায় বাতাসের কোমল ঝাপটা এসে কানে ফিসফিস করছে। দূর অরণ্যের গহীনে পেঁচার করুণ ডাক কান বাজছে, সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। এদিকে আকাশের বুক থেকে ছড়িয়ে পড়া আলোয় উঠোনে ছিটকে পড়েছে হাজারো জোনাকি তাদের ক্ষুদ্র জ্যোৎস্নায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রদীপে সাজানো স্বপ্নের মেলার ন্যায় দেখাচ্ছে। সব মিলিয়ে ভারী সুন্দর আজকের চন্দ্রালোকিত নিশীথিনী। সাথে নাজহা তাকায় আরো বেশি ভালো লাগছে।
তৌসির নাজহার কথার প্রতিত্তোরে এবার বলে, “এক ঝিজের যন্ত্রণায় প্রাণ বাঁচে না, আরেকজন আইন্না ডবল যন্ত্রণায় মরার শখ নাই।”
“আমি আপনায় যন্ত্রণা দেই? এত বড় মিথ্যা বলতে লজ্জা করে না?”
“লজ্জা যদি থাকতো, তাইলে করত। নাই তো তাই করে না!”
নাজহার আর কিছু বলে না। এতক্ষণে বাড়ির ভেতর চলে এসেছে ওরা। নাজহা চুপচাপ রুমে চলে আসে, তৌসিরও ওর পিছনে পিছনে আসে। নাজহা এসে নামাজে দাঁড়িয়ে যায়, আর তৌসির একটা নীল আর সাদা চেকের একটা লুঙ্গি পড়ে নেয়।
তৌসির আর নাযেম চাচাকে নূরজাহান, মানে তৌসিরের বিবিজান{ দাদীজান}, হঠাৎ করেই শিকদার কুঠিরে ডেকে পাঠিয়েছেন। শিকদার কুঠির হলো গোটা শিকদার পরিবারের অন্ধকার সব রহস্যের আড্ডাখানা। এখানেই লুকিয়ে আছে তাদের বেইজ্জতি কাজকর্ম, এখানে বসেই নেয়া হয় গোপন সব সিদ্ধান্ত।
সকালটা ভারী অস্বস্তিকর। কুঠিরের বাতাসে চাপা উত্তেজনা ভেসে বেড়াচ্ছে। মেঝের পুরনো লাল কার্পেট অনেকটা বিবর্ণ হয়ে গেছে, কিন্তু তার উপর সাজানো আসবাবপত্রের গাম্ভীর্য এখনও বজায় আছে। চারদিকে ঘন কাঠের দেয়াল, জানালায় মোটা পর্দা টানা, বাইরের আলো একদমই ঢুকতে পারছে না।
বিবিজান নূরজাহান বসে আছেন তার বিশাল মহগনি টেবিলের পেছনে। মুখে গাম্ভীর্য, ঠোঁটে অল্প তাচ্ছিল্যের ছাপ, আর চোখদুটো হীরে কাটা ধারালো মনে হচ্ছে। তার সামনে রাখা লেদারের চেয়ার।তৌসির আর নাযেম চাচা দুজনেই আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসেন।
চুপচাপ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর তৌসির বলে,
“কি হইছে বিবিজান? এত কড়া জরিফ করলা যে।”
বিবিজান ওকে নিজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা যুবতী মেয়েকে দেখান যার নাম রিজা। পড়নে পাতলা একটা সাদা শাড়ি, ফলে পুরো শরীরটা দেখা যাচ্ছে, ব্যবসার জন্য এসেছে আরকি। তৌসির এক নজর ওর দিকে তাকিয়ে আর তাকায় না, এদের দিকে তাকাতে ভালো লাগে না কেন জানি। চোখ ফিরিয়ে বিবিজানের দিকে তাকিয়ে বলে, “নতুন নাকি?”
বিবিজান মাথা নাড়িয়ে কিছুটা শক্ত গলায় বলেন, “হ্যাঁ, নতুন। একটা ফুলের টুকাও দেয়নি কেউ। নতুন কলেজ পাস করে ভার্সিটিতে উঠেছে।”
নাযেম চাচা এটা শুনে বলেন, “ওহ আচ্ছা, তা কে এই মা*গিরে জোগাড় করলো?”
বিবিজান কড়া গলায়ই বলেন, “রায়জার ভার্সিটির এইটা।”
রায়জা একজন ভার্সিটি প্রফেসর। তবে তিনি কেবল ক্লাসরুমের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নন। তৌসিরদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে, আর এই সূত্রে তিনি যুক্ত হয়েছেন তৌসিরদের ভয়ঙ্কর চক্রে।
এই চক্রের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকাদের ওপর যারা নিজেদের প্রতিষ্ঠান থেকেই কিছু মেয়েকে বেছে নেন। যে মেয়েগুলো সাধারণত খোলামেলা চলাফেরা করে, আধুনিক জীবনযাত্রার প্রতি আকৃষ্ট থাকে কিংবা বিলাসবহুল জীবনের স্বপ্ন দেখে। রায়জার মতো শিক্ষিকারাই সেসব মেয়েদের ওপর নজর রাখেন, সুযোগ খুঁজে বের করেন।
প্রথমে তারা মেয়েদের কাছে বন্ধুসুলভ পরামর্শদাতা হয়ে ওঠেন। কথার ঝলকে, আকর্ষণীয় প্রতিশ্রুতির ফাঁদে, ধীরে ধীরে মেয়েদের টেনে আনেন এই লজ্জিত অন্ধকার জগতে। একবার ফাঁসিয়ে ফেলতে পারলে আর ফিরে আসার পথ থাকে না। তারা ওদের ফাঁসিয়ে শেষমেশ তৌসির দের চক্রের হাতে তুলে দেন, তারপর তৌসিরদের এখান থেকে এদের কন্ট্রাক্ট সাইন করিয়ে বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী ক্লায়েন্টদের কাছে পাঠানো হয় শুধু বিলাসিতা আর প্রতারণার স্বপ্ন দেখিয়ে।
বিবিজান রিজার দিকে তাকান শয়তানি চাহনি নিয়ে একপলক, তারপর তৌসিরের দিকে তাকিয়ে বলেন, “তুই চাইলে এক ডোজ নিতে পারিস ওর থাইকা।”
তৌসির এটা শুনে ঠান্ডা হয়ে যায়, এমন কথা ঠিক হজম হয় না। বিয়াত্তি একটা পুরুষ ও। ওর বিবিজান কোন বিবেকে এমন কথা বলেন? পুতুল ঘরে রাখা আছে। পুতুল রেখে পেত্নী কে কেন ছুঁবে ও? তৌসির ছিটফিটিয়ে বলে, “আমার বউয়ের হক আমি কাউরে দিমু না, বিবিজান।”
বিবিজান ডেস্কের উপর রাখা একটা বল ঘোরাতে ঘোরাতে বলেন, “চল একটা বাজি ধরি। অনেকদিন হইলো তোর লগে বাজি ধরা হয় না। পাচ মিনিট ওর লগে এই রুমে থাকবি। শুধু সামলাইতে পারছ নিজরে, তাইলে এ যত ইনকাম কইরা আমাদের দিব। সব খালি তোর। রাজি?”
তৌসির কথাটায় কিছুটা অবাক হয়, তবে টাকার অ্যামাউন্টও আছে। কারণ এদের একেকজনের ইনকাম আকাশছোঁয়া মাফিয়া, গ্যাংস্টারদের থেকে টাকা নেয় বলে কথা। তৌসির মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “আমি রাজি, তবে আমার শরীরে ছুইতে পারবো না। আমার বউ আছে।
“আর যত টাকা এর থাইক্কা পামু, সব আমার বউর নামে একটা একাউন্ট খোলে ওখানে রাখতে হবে। কারণ আমার এই পুরুষত্ব আমার বউয়ের আমানত।”
খানিক্ষণ পর…
বিবিজান আর নাযেম চাচা বাইরে চলে গেছেন। তৌসির বসে আছে চেয়ারে, রুমের মধ্যেখানে। ওর সামনেই রিজা দাঁড়িয়ে আছে। এই রিজা আবার লুচ্চামিতে ফাস্ট ক্লাস একটা খারাপ গান ছেড়ে দেয় স্পিকারে। তারপর ধীরে ধীরে তৌসিরের সামনে এসে ঝুঁকে গিয়ে তৌসিরের দিকে তাকায়। তৌসির সরু চোখে এক পলক চোখ বুলায় রিজার মুখপানে, বুলিয়েই মুচকি হেসে ওঠে।
আর তৌসিরের হাসিটা তো বরাবরই মারাত্মক সুন্দর। তার ব্যক্তিত্ব খারাপ, সে স্বয়ং একজন নিকৃষ্ট মানুষ। কিন্তু এই মন্দ লোকের সবকিছু বিভৎস হলেও তার হাসিটা মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। কেউ না চাইতেও এই হাসির ন্যায় মুগ্ধ চোখে খানিক মুহূর্ত চেয়ে থাকবেই। ভারী মন কাড়ে এই হাসি।
রিজা তব্দা খেয়ে যায়, একদৃষ্টিতে তৌসিরের ঠোঁটের কিনারার দিকে তাকিয়ে রয়। জীবনে অনেক পুরুষ দেখেছে, তবে এমন হাসি এই প্রথম দেখলো। তৌসির রিজার চোখে চোখ রেখে বলে, “তৌসির শিকদারের পুরুষত্ব এতটাও সস্তা নয় যে তোর মতো পাঁচ টাকার মাগির উপর ঢলে পড়ব।”
‘পাচ টাকার’ উক্ত কথাটা শুনে রিজার বিরাট রাগ হয়। রিজা তৌসিরের থেকে সরে গিয়ে, একে একে শাড়ির পিনগুলো খুলে নিয়ে আশেপাশে ফেলে দিতে দিতে বলে, “দেখি আপনি কিভাবে বসে থাকেন।”
এ বলে ওর নিজের শাড়ির আঁচল নিচে ফেলে দেয়। এতে ওর অর্ধ শরীর উন্মুক্ত হয়ে যায়। ধবধবে সাদা শরীরটা জীবন্ত ফুলের মতো ফুটে ওঠে তৌসিরের চোখের সামনে। কিন্তু তৌসির এসবে পাত্তা দেয় না। ওর চোখ যখন রিজার দিকে যায়, কেন জানি নাজহার কথা বড্ড মনে পড়ে। না, ঠিক ওর কথা মনে পড়ে না, ওর ঐ মারাত্মক নয়নজোড়া চোখের সামনে ভাসতে থাকে।
তৌসির রিজার দিকে একটুর জন্যও আর তাকায় না। পুরুষ মানুষের মন-মেজাজের গ্যারান্টি নেই সেকেন্ডের মধ্যে পাল্টি খেতে পারে। তৌসিরের ভেতরটা ধড়ফড় করছে। তবু তৌসির স্থির হয়ে বসে থাকে সামনে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে। রিজা নিজের শাড়ি পুরো খুলে নিয়ে নানাভাবে বাজে ইঙ্গিতে তৌসিরকে সিডিউস করার চেষ্টা করলেও এসব কিছু হয় না। কারণ তৌসির ওর দিকে তাকায়ও না।
পাঁচ মিনিট হয়ে যায়। তৌসির দেয়ালের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠে বলে, “এ মা**গি, কাপড় পর! তোর টাইম শেষ।”
রিজা এমন ধমকে লজ্জায় পড়ে যায়। এত মোহরা ঘেরা সৌন্দর্য রেখেও এই তৌসিরকে গলাতে পারলো না। রিজা নিজের শাড়ি ঠিক করে নেয়, ঠিক করে নিলেও এলোমেলো রয়েই যায়।
তৌসির বুক ভরা শ্বাস ছেড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, আশেপাশে এক নজর তাকায়, তারপর রিজার দিকে কদম এগিয়ে ওকে উদ্দেশ্য করে বলে, “তৌসির শিকদারের লুঙ্গির গিট্টু খুললে একমাত্র তার বউর জন্যই খুলবো, তোদের মতো ব্যাসসাদের জন্য না!”
রিজা তৌসিরের চোখে চোখ রেখে বলে, “আপনি তাকাননি আমার দিকে। যদি তাকাতেন তাহলে আমার প্রতি আসক্ত হতেন।”
তৌসির রিজার কথায় তাচ্ছিল্যের এক চিলতে হাসি দিয়ে বলে, “ঘরে চাঁদ রেখে তোর মতো পাদের দিকে তাকানোর টাইম নাই আমার।”
“আপনার বউয়ের চেয়ে দ্বিগুণ মেহনত করতে রাজি আমি!”
তৌসির এটা শুনে হুমকির সুরে বলে, “এই চুপ! আমার বউয়ের নাম মুখেও নিবি না। মাগিগিরি করবি কর। তোর মতো পাঁচ টাকার মাগির আমার বউয়ের নাম মুখে নেওয়ার যোগ্যতা নাই।”
ব্যাস, রিজা থেমে মাথা নিচু করে নেয়। তৌসির আবার বলে ওঠে, “আর যদি জীবনে আমার সামনে কাপড় খুলিস, তাইলে কাপড়সহ আগুন ধরাইয়া জ্বলাইয়া দিমু।”
এ বলে তৌসির লুঙ্গির কোণ কোমরে ঠেসে নিতে নিতে রাগী মেজাজ নিয়ে বেরিয়ে যায় চেম্বার থেকে। বের হয়ে বিবিজানকে বলে, “আমার একাউন্টে টাকা দিও, সবসময়। ভিতরে কিছু হয়নি।”
এ বলে তৌসির নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
বিবিজান হতাশ হোন বড্ড। উনি চান তৌসিরকে এসবে সরাসরি জড়াতে, কিন্তু তৌসির এসবে নেই। নাযেম চাচা তৌসিরের সাথে পা ফেলতে ফেলতে জিজ্ঞেস করেন ওকে, “কি রে, এত ভয়াবহ আগুন দেইখাও তুই কিছু করলি না?”
উনার কথায় তৌসির রুক্ষ চোখে একপলক উনার দিকে তাকায়, তারপর বলে, “তোমাদের মতো আমার ওত উত্তেজনা নাই যে – যেই মাগি দেখমু, ওর লগে বিছানায় চইল্লা যামু।”
নাযেম চাচা ওর কথার প্রতিত্তোরে বলেন, “এমন সুন্দরী ঝিজ দেখলে মানুষ রাস্তা-ঘাটে কন্ট্রোললেস হয়ে যায়। আর তুই সামনে থেকেও কি করে সম্ভব?”
তৌসির চাচার কথায় খানিকটা তাচ্ছিল্যের সহিত বলে, “রাস্তা-ঘাটে এনে হেনে কন্ট্রোললেস হইয়া এসব ঐ জানুয়াররা করে, যাদের জন্মই রাস্তাঘাটে।”
নাযেম চাচা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, “আগে কইতি বউরে দিয়া কুমারত্ব ধ্বংস কইরা পরে যা ইচ্ছে করবি। তাই এখন করস না ক্যান?”
তৌসির তিক্ত সুরে গরম মাথায় উত্তর এটে দেয়, “বউর লগে কিছু হয়নি এখন।”
নাযেম চাচা এটা শুনে টাশকি খেয়ে বলেন, “কি বললি? তোরা…
তৌসির ঠান্ডা গলায় বলে, “ও অনেক ছোট, ওরে সময় দেওয়া উচিত। আর এসব কথা আর কেউ যেনো না জানে। এখন এসব কথা বাদ, কামের কথা কও।”
নাযেম চাচা ঠান্ডা হয়ে যান, তৌসিরের মতাজ ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না।
সন্ধ্যা নেমেছে, আবছা আলো-ছায়ায় ঢাকা বাগানের কোণটি আজ এক গুপ্ত মন্ত্রণা কক্ষ। বাতাস ভারী হয়ে আছে লোভ আর ষড়যন্ত্রের নিঃশ্বাসে। সবুজ ঘাস আর পাতার আড়ালে যে বৈঠকটি বসেছে, তার মূল কেন্দ্রে রয়েছে তৌসির রাজনৈতিক ক্ষমতার ভেতরের খবর পাচার করার মূল কাণ্ডারী। ওর চারপাশে বসে আছেন নাযেম চাচা মিনহাজ মামা সবাই। তাদের সবার চোখ স্থির হয়ে আছে তৌসিরের হাতের সাদা কাগজের খামের ওপর, এটি কোনো ঐতিহাসিক দলিল নয়, বরং এক সোনার ডিম পাড়া হাঁস। এই খামটিই তাদের বিনা শ্রমে, রাতারাতি ধনী হওয়ার স্বপ্ন।
তৌসির মন্থর গতিতে আত্মতৃপ্তির হাসি হেসে, খামটি খোলে। ভেতর থেকে বের হয়ে আসে ভাঁজ করা একখানা কাগজ সরকারি সিলমোহরযুক্ত, স্পর্শকাতর ‘ডেভেলপমেন্ট ম্যাপ’। এই মানচিত্রটি হলো আসলে রাষ্ট্রের গোপন সিদ্ধান্ত, কোন পথে বইবে উন্নয়নের স্রোত, কোন এলাকাগুলো রাতারাতি হয়ে উঠবে মূল্যবান। এই তথ্য একমাত্র সরকারি কর্মকর্তার ভেতরের কিছু অংশাক লোকরাই জানে, এবং তৌসির বহু চালাকি ও আঁকাবাঁকা পথে এর নকল কপি বের করে এনেছে।
তাদের সামনে টেবিলের অন্য পাশে বসে আছে এলাকার বড় রিয়েল এস্টেট বিল্ডারদের দল। এদের চোখে ক্ষুধার্ত শিকারীর দৃষ্টি। ম্যাপের প্রতিটি চিহ্নিত এলাকা, প্রতিটি রেখা তাদের কাছে লক্ষ লক্ষ টাকার হাতছানি।
চক্রের মূল কৌশলটি পরিষ্কার তৌসির ম্যাপের গোপন তথ্য বিল্ডারদের দেবে। বিল্ডারেরা তখন অতি দ্রুত সেই চিহ্নিত এলাকার সাধারণ ও সরল মানুষদের কাছ থেকে অল্প দামে জমি কিনে নেবে। তাদের বলা হবে এই জমি হয়তো ভবিষ্যতে ঝামেলায় পড়বে বা সরকারি অধিগ্রহণে চলে যাবে, তাই কম দামে বিক্রি করে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আর সাধারণ মানুষ এ জালে জড়িয়ে কম দামে জমি বিক্রি করে দেয়্
এরপর, যখন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে সেই এলাকায় কাজ শুরু করতে আসবে, বিল্ডারেরা সেই জমি কয়েকগুণ চওড়া দামে সরকারের কাছে বিক্রি করবে। এই বিক্রয়লব্ধ অর্থের চল্লিশ শতাংশ সরাসরি চলে আসবে তৌসিরদের পকেটে।
এভাবেই, বিনা পরিশ্রম ও বিনা বিনিয়োগে তৌসিররা কাঁচা টাকা হাতিয়ে নেয়। তবে তৌসির সতর্ক সে একজন ব্যক্তিকে কখনোই পুরো ম্যাপের খবর দেয় না। বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। রাজনীতিতে আসার এই সুযোগকে তারা ব্যবহার করে এক সুন্দর সুযোগ হিসেবে। ভেতর থেকে শান্তি মতো ভেতরকেই ক্ষয় করে যাওয়ার এক নির্লজ্জ খেলায় মেতে ওঠে।
তৌসির ম্যাপটা দেখে ওদের দুজনকে বলে, “পাশে যে বস্তি আছে, ওইটা ইমিডিয়েটলি কিনো। এটা আগামীতে কাজ করা হবে।”
ওই বিল্ডাররা বলে ওঠে, “আচ্ছা, তা কত টাকার খরচ আইবো?”
তৌসির দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে, “এই জমি দশ কোটির উপরে বেচা যাইব। এখন দুই অথবা একে কিনতা পারবা।”
একজন বিল্ডার বলে ওঠে, “যদি পরে সরকার এনে কাজ করে না!”
তৌসিরের মেজাজ তুঙ্গে উঠে যায়। ওর কাজের ওপর সন্দেহ! না, এমন বিচার মানা যায় না। এটা ভারী অন্যায় একখানা কর্ম। তৌসির ধমকে ওঠে বলে, “এই খা**নকির পোলারা, তোরা কি আমারে কাঁচা খেলোয়াড় মনে করস যে সন্দেহ নিয়া কথা কস? তোগো যদি লাগে তো চুপচাপ ডিল কর, নয়তো ভাগ এহান তাকি।”
বিল্ডারা আর কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, “ঠিক আছে, তাইলে এমনি হবে। আপনি যা বলবেন, আমরা কিনে নিব।”
এ বলে ওরা উঠে যায়। তৌসির ওদের শেষ কথাটি সুন্দর ভাষায় বলে, “মনে রাখবেন, এই রাজনীতিতে যদি টিইক্কা থাকতে হয়, তবে ভেতর থেকে শান্তি মতো ভেতরকেই ক্ষয় করে যেতে হয়। এটাই আমাদের বিনিয়োগ, এটাই আমাদের ক্ষমতা। সবাই যেনো মনে করে, আমরা দেশের সেবক। কিন্তু আমরাই জানি, এই সেবার আড়ালে আমরা কেবল নিজেদের ভাগ্য সেবাই করে চলেছি।”
ওরা যেতেই রুদ্র তৌসিরের পাশে এসে বসতে বসতে বলে, “আচ্ছা তৌসির ভাই, একখানা কথা কই।”
তৌসির রুদ্রের কথায় তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “ক।”
রুদ্র বিরাট সংকোচ কাটিয়ে বলে, “এভাবে দেশেরে খয়রাত করা কি ঠিক? এমনিতেই অর্থনীতি এক্কেবারে মরমর অবস্থা, এমন দুর্নীতি করা উচিত না। আমরা বেশি কইরা ফেলছি।”
তৌসির রুদ্রের কথায় মুচকি হাসে। রুদ্রের কাঁধে হাত রেখে আড়চোখে রুদ্রের দিকে কিছু সময় চেয়ে থাকে, তারপর বলে, “শোন, একটা খাঁটি কথা তোরে কই।”
“কও।”
“রাজনীতিতে সরকারি দল হোক, বিরোধী দল হোক প্রেসিডেন্ট হোক বা প্রসিকিউটর, সাংবাদিক হোক বা পুরো নিউজ চ্যানেল সবাই দুর্নীতিবাজ।”
মিনহাজ মামা মদের গ্লাসে বরফ ঢালতে ঢালতে বলেন, “এই দেশে ঝাড়ুদার থাইকা শুরু কইরা মন্ত্রী অবধি ঘুষ খায়, তো আমরা খাইলে কি?”
রুদ্র মুখ পেঁচার মতো করে বসে থাকে এমন মস্ত বড় বড় ডায়লগ শুনে। নাযেম চাচা সিগারেটে টান দিতে দিতে বলেন, “রাজনীতিতে কোনো ছাড় নাই। যে যতো মারতে পারো মাইরা নাও। পতন কেমনে হয়, কওয়া যায় না!”
তৌসির রুদ্রের মুখ গোমড়া দেখে ওর থুতনি ধরে বলে, “এই দেশের কথা চিন্তা কইরা শুকাইস না।”
তৌসিরের কথায় রুদ্র ভুরু কুঁচকে ওর চোখের দিকে তাকায়। তৌসির হেসে বলে ওঠে, “এই দেশের সরকার যদি হয় চোর, তাইলে বেশ অর্ধেক জনগণ ডাকাইত হবে।”
“এই দেশ এরম চলছিল আর চলবে।”
রুদ্র মলিন গলায় বলে, “সত্যি ভাই, সবাই এক থলের বিড়াল!”
নুহমান শাহ তিক্ত সুরে বলে ওঠে, “এ দেশে সরকার-ওপক্ষ-অপজিশন বলে কিছু নাই, আছে শুধু দুর্নীতির ভিন্ন ভিন্ন ব্র্যান্ড।”
তৌসির খেয়াল করে এখানে সবাই থাকলেও কেরামত নেই। এটা দেখে তৌসির নুহমান শাহকে জিজ্ঞেস করে, “কিরে নুহমান, কেরামত কই?”
নুহমান এটা শুনে হেসে বলে, “ও ঘুমে ভাই। গতকাল খেলা দেইখা ঘুমের ঔষধ খাইয়া ঘুমাইতাছে।”
খেলার কথা শুনেই তৌসির দাঁত কেলিয়ে হেসে ওঠে। বলে, “কি ব্যাঙ দেখতো খেলা? একশো ছত্রিশ রানের টার্গেটটাও মিস করলো সাউয়ারা! ছিঃ ছিঃ, কি লজ্জা।”
মিনহাজ মামা হতাশ হয়ে বলেন, “খেলা দেইখা শপথ করছি, আর জীবনেও দেখমু না।”
নাযেম চাচা মিনহাজ মামার কথায় কটাক্ষ করে বলেন, “এমন বিলাইর তওবা তো প্রতিবারই করস।”
তৌসির এর মাঝে বলে ওঠে, “দোষ আসলে খেলোয়াড়দের না। দোষ ওই হালার যে কৃষি প্রধান দেশরে ক্রিকেট প্রধান বানাইছে।”
রুদ্র আক্ষেপের সুরে বলে, “মরণের পরও একটা কাপ আনতে পারব না কেউ।”
তৌসির রুদ্রের কথায় বিরক্তি নিয়ে বলে, “ইদানীং বাংলাদেশের খেলা দেইখা মাঝেমধ্যে মন চায় খেলোয়াড়-সহ স্টেডিয়াম বোমা মাইরা উড়ায়া দেই।”
ওর কথায় উপস্থিত সবাই তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে ওঠে। যদিও হাসছে, কিন্তু মনে ব্যথা ঠিকই রয়ে গেলো। ওরা জানে হারবে, কিন্তু আশা নিয়ে দেখতে বসে। কিন্তু প্রতিবারই এমন হয়।
তৌসির এবার সোফায় হেলান দিয়ে বুক টেনে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে কিছু সময় শান্ত চোখে আসমানের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে”চাচা, একটা গান বাজাও তো। বহুত দিন হইলো ডান্স দেই না।”
নাযেম চাচা এটা শুনে লভ্যাংশি হাসি দিয়ে চেয়ারের পাশে রাখা স্পিকারটার বোতামে চাপ দেন। বোতাম চাপতেই বাজতে লাগে একটা সুপরিচিত ‘গানের’ বিট। টোন শুনতেই সবার কান নিংড়ে উঠে। তৌসির আর রুদ্রের চোখে লাইটনিং ঝাপ্টা লাগে ওরা দু’জন একে অপরের দিকে এক ঝলক হাসি ছুঁড়ে মেরেই সোফা ছেড়ে তড়াক উঠে দাড়ায়। দাঁড়িয়ে এক ছন্দে ঠোঁট চাপে আর হাতটা করে অলিম্পিক মোটিভেশনে উদ্দেশ্য একটা দুর্দান্ত ডান্স দেওয়া।
মিনহাজ মামা লুঙ্গির কোণটা অদ্ভুতভাবে হেলান দিয়ে ধরেন। শুরু হয় আসল মজা। নাযেম চাচা, মিনহাজ মামা, তৌসির, নুহমান শাহ আর রুদ্র সবাই মনে হয় মুহূর্তে এক কাট্টা। লুঙ্গির কোণ হাতে নিয়ে শুরু হয় তাদের উড়াধুরা ডান্স। স্পিকারে এখন গমগম করছে একটা স্পেশাল গানে।এমন সময় তৌসির সোফায় থেকে ঝাঁপ দিয়ে হাতে নেয় একখানা কালো চশমা যার ফ্রেম ভাঙা, লেন্সে টুকটাক আঁশ, কিন্তু ভাঙ্গা থাকা সত্ত্বেও তৌসির চশমাটা হাতে নিয়ে চোখে স্টাইল করে এঁটে নেয়।চশমাটা পড়তে পড়তেই সভাবতই একটা লেন্সই পিছলে যায় চশমার। পিছলে গেলেও তৌসির চশমাটা সোজা করে না, বরং এক চোখ ঢেকে রেখে ডান্সের কৌতুক শুরু করে বলে ওঠে”হাফ-শেড স্টাইল, সেকেন্ড হ্যান্ড।” স্পিকাটের তালে তালে সবাই গলা মেলায়।
“ভোট চাই ভোটারের,
দোয়া চাই সকলের।
শেখ হাসিনার সালাম নিন,
নৌকা মার্কায় ভোট দিন।”
আর তারপর, সেই উদ্দাম আহ্বান,
“Once again, শেখ হাসিনা।
Once again, শেখ হাসিনা।
Once again, শেখ হাসিনা।
জয় বাংলা….!!
নাচের মাঝেই ঘেমে-নেয়ে একসা হয়ে তৌসির বলে উঠে, “শেখের মাইয়া আর কিছু করুক আর না করুক, একটা ঝাক্কাস গান দিয়া গেছে রে, এক্কেরে মনের মতো।
কিছুটা থেমে গিয়ে আবার বলে,
“আগামী পঞ্চাশ বছরেও এমন দুর্দান্ত গান কোনো দল দিতে পারব না!”
এই বলে সে আবার নাচের তালে কোমর দোলাতে শুরু করে।গানের সুরের বাঁধন আরও শক্ত হয়,
“জয় বাংলা জিতবে আমার নৌকা।
জয় বাংলা জিতবে আমার নৌকা।”
রুদ্র নাচতে নাচতে একটা ঢেকুর তুলে চোখ টিপে বলে, “দল যার যার, গান কিন্তু সবার।
“হোক বিরোধী দলের গান নাচমু কিন্তু আমরা সবাই।”
এই বলে সে একটা কালো চশমা চোখে লাগিয়ে নেয়, যেটা আসলে চায়ের দোকান থেকে চুরি করা সানগ্লাস।
স্পিকারে বেজে ওঠে,
“জয় বাংলা, শেখ হাসিনার সালাম নিন।”
স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১০
নাচ যখন জমে ক্ষীর তখন নাযেম চাচার নজর যায় তৌসিরের দিকে। উড়াধুরা নাচের চোটে ওর লুঙ্গি প্রায় হাঁটুর ওপরে উঠে গেছে। নাযেম চাচা সেটা নিচে নামানোর জন্য যেই এক টানে হাত বাড়িয়েছেন, তৌসির অমনি সরে গিয়ে চিৎকার করে উঠে, “এ সরের বাচ্চা, টান মারিস না! নিচে কিছু পড়ি নাই।”
আর তার ফাঁকেই আবার উচ্চস্বরে গানের শেষ অংশ ভেসে ওঠে।
“জয় বাংলা, নৌকা মার্কায় ভোট দিন।”
